ভীষ্মপঞ্চক ব্রত কী, কখন ও কীভাবে করবেন?

 
ভীষ্ম

ভীষ্মপঞ্চক ব্রত কী? 

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অভিন্ন প্রকাশ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদপ্রবর ও গৌড়ীয় আচার্যবর্গের অন্যতম শ্রীল সনাতন গোস্বামীপাদ শ্রীশ্রীহরিভক্তিবিলাস গ্রন্থে (১৬.৪৩৪) লিখিছেন- 
 
আরভ্যৈকাদশীং পঞ্চ দিনানি ব্রতমাচরেৎ। 
ভগবৎপ্রীতয়ে ভীষ্মপঞ্চকং যদি শক্নুয়াৎ।।
 
অর্থাৎ, “কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী হতে আরম্ভ করে (পূর্ণিমা পর্যন্ত) পাঁচদিন শ্রীভগবানের প্রীতির জন্য যদি সমর্থ হয়, “ভীষ্মপঞ্চক’ ব্রত আচরণ করবেন।” চাতুর্মাস্যের শেষ মাস অর্থাৎ কার্তিক তথা দামোদর মাসের এই ব্রতে বিশেষ খাদ্যতালিকা থাকে, যে অনুযায়ী কেউ পঞ্চগব্য অথবা ফলমূল অথবা হবিষ্যান্ন গ্রহণ করতে পারেন। এই ব্রত অনুষ্ঠানকারী ব্যক্তিকে ভগবৎপ্রেম প্রদান করে- সর্বপাপবিনির্মুক্তঃ প্রাপ্তকামো হরিং ব্রজেৎ।।(গরুড়পুরাণ, পূর্বখন্ড ১২৩.২)। বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ বা শ্রীবিষ্ণুর প্রীতিপ্রদ বলে একে বিষ্ণুপঞ্চকও বলা হয়। সর্ববিধ বার্ষিক ব্রতের মধ্যে চাতুর্মাস্য ব্রত প্রধান, আর চাতুর্মাস্য ব্রত অপেক্ষা ভীষ্ণপঞ্চক ব্রত সর্বপ্রধান। 




ভীষ্মপঞ্চক ব্রত কীভাবে এলো? 

ভীষ্মপঞ্চক ব্রত প্রসঙ্গে স্কন্দপুরাণের বিষ্ণুখন্ডে, কার্তিকমাসমাহাত্ম্যে ৩২তম অধ্যায়ের বর্ণনা অনুসারে-সত্যযুগের প্রথমে অম্বরীষ ও ভোগ প্রভৃতি নৃপগণ চাতুর্মাস্যের শেষ মাস অর্থাৎ, কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষে এই ব্রতাচরণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে মহারাজ শান্তনুতনয় ভীষ্ম ভগবান বাসুদেবের নিকট এই ব্রত প্রাপ্ত হন। মহাত্মা ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ন করে পরপর রাজধর্ম, মোক্ষধর্ম ও দানধর্ম কীর্তন করেন; পান্ডবগণ ভীষ্মভাষিত সেই ধর্মতত্ত্ব প্রবণ করেন; এমনকি কৃষ্ণও তা শ্রবণ করেন। তখন ভীষ্মভাষিত ধর্ম শ্রবণে মনে মনে প্রীত হয়ে কৃষ্ণ বলেন-

‘হে ভীষ্ম, তুমিই ধন্য; কেননা, তুমি আজ আমাদের শ্রেষ্ঠ ধর্ম শ্রবণ করিয়েছে। তুমি আজ আমাদের শ্রেষ্ঠ ধর্ম শ্রবণ করিয়েছ। তুমি কার্তিক মাসের একাদশী দিবসে জল যাঞ্চা করেছিলে, অর্জুন বানবেগে গঙ্গাজল আনয়নপূর্বক তোমার শরীর শীতল করেছেন। অতএব, তদবধি সকলেই কার্তিকের শুক্লা একাদশী হতে পূর্ণিমা পর্যন্ত অর্ঘ্যদানে তোমার সন্তোষ সাধন করবে। অতএব, সকলেই কার্তিকের শুক্লা একাদশী হতে পূর্ণিমা পর্যন্ত অর্ঘ্যদানে তোমার সন্তোষ সাধন করবে। অতএব, সকলেই সর্ব প্রযত্নে আমার প্রীতিপ্রদ এই ভীষ্মপঞ্চক নামক ব্রত আচরণ করুক। কার্তিক ব্রত করে যে নর এই ভীষ্মপঞ্চক ব্রত না করে, তার সমগ্র কার্তিক ব্রত বিফল হয়ে থাকে। মানব যদি কার্তিক ব্রত করতে অসমর্থ হয়, তবে কেবল ভীষ্মপঞ্চক করেই সমগ্র কার্তিক ব্রতের ফল লাভ করতে পারে।” পদ্মপুরাণের উত্তরখন্ডে (১২৪/২৯-৩০) বলা হয়েছে-  
ভীষ্মেণৈতদযতঃ প্রাপ্তং ব্রতং পঞ্চদিনাত্মকম্।। 
সকাশাদ্বাসুদেবস্য তেনোক্তং ভীষ্মপঞ্চকম্।
“ভগবান বাসুদেবের নিকট থেকে ভীষ্মদেব এই পঞ্চদিনাত্মক ব্রত প্রাপ্ত হয়েছেন, তাই তা ভীষ্মপঞ্চক ব্রত নামে অভিহিত।”  
ব্রতানাং মুনিশার্দ্দূল প্রবরং বিষ্ণুপঞ্চকম্।
তস্মিন যঃ পূজয়েদ্ভক্ত্যা শ্রীহরিং রাধয়া সহ।।
গন্ধপুষ্পের্ধূপদীপৈর্বস্ত্রৈর্নানাবিধৈঃ ফলৈঃ। 
স যাতি বিষ্ণুসদনং সর্ববিবর্জিতঃ।।
(পদ্মপুরাণ, স্বর্গখন্ড ৪৮/৩-৪) 
অর্থাৎ, “বিষ্ণুপঞ্চক ব্রত ব্রতসমূহের মধ্যে প্রবর। সেসময় যিনি ভক্তি সহকারে গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, বস্ত্র ও নানাবিধ ফল দ্বারা শ্রীরাধাসহ শ্রীহরিকে অর্চনা করেন, তিনি সর্বপাপ বিবর্জিত হয়ে বিষ্ণুসদনে গমন করেন।”


পত্র-পুষ্প অর্বণ বিধি

ব্রতকালে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণ বা ভগবানের অন্য যেকোনো রূপের শ্রীবিগ্রহকে ঘৃত প্রদীপ ও পুষ্প নিবেদন করা উচিত। ভগবানের শ্রীবিগ্রহে প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন পুষ্প নিবেদনের নিয়ম রয়েছে। এ প্রসঙ্গে গরুড়পুরাণ, পূর্বখন্ড ১২৩ অধ্যায়ে (৮-৯) বলা হয়েছে- ১ম দিন : পদ্মফুল- চরণকমলে, ২য় দিন: বিল্বপত্র- জানুতে, ৩য় দিন: গন্ধদ্রব্য- নাভিকমলে, ৪র্থ দিন- বিল্বপত্র ও জবাফুল- স্কন্দদেশে, ৫ম দিন: মালতীফুল-শিরোদেশে। যদি কখনো দুটো তিথি একদিনে পড়ে, তবে ঐদিন দু’দিনের উদ্দিষ্ট ফুলগুলো একই দিনে নিবেবদন করতে পারেন। আর যদি কারো নিকট ফুলগুলো না থাকে, তবে ভগবানের নির্ধারিত স্থানে নির্ধারিত ফুলগুলো কেউ মানসিকভাবে নিবেদন করতে পারেন।

আহার বিধি :

ব্রতকারী কতবার আহার গ্রহণ করতে পারে সে ব্যাপারে নির্ধারিত কোনোকিছু উল্লেখ নেই। ভীষ্মপঞ্চক ব্রত ব্যাক্তির সামর্থ্য অনুসারে বিভিন্ন স্তরে উদযাপন করা যায়-একথা পদ্মপুরাণে (স্বর্গখন্ড ৪৮/১৫) বলা হয়েছে-এবং কর্ত্তুমশক্তে ষঃ ফলমূলঞ্চ ভোজনম্।কুর্য্যাদ্ববিষ্যৎ বা বিপ্র যথোক্তবিধিনা হ বৈ।।
সাধারণত একাদশীতে সম্পূর্ণ উপবাস এবং তার পরবর্তী চারদিন ফলমূল গ্রহণ করতে বলা হয় অথবা কেউ পাঁচদিনই ফলমূল গ্রহণ করতে পারেন। ভক্তরা তাদের সুবিধামতো নিম্নোক্ত স্তরগুলোর যেকোনোটি অনুসরণ করতে পারেন, যেন তাদের সাধারণ ভক্তিমূলক সেবা ও দৈনন্দিন সাধনায় বিঘ্ন সৃষ্টি না করে।

১ম স্তর-পঞ্চগব্য গ্রহণ 

পঞ্চগব্যের একেকটি একেক দিনে গ্রহণ করা যেতে পারে (গ.পু.পূর্ব ১২৩.১০; প.পু. স্বর্গ.৪৮.১১-১৪; স্কন্দ.পু.কার্তিকমাসমাহাত্ম্য ৩২. ৪৬, ৪৭, ৫০)।  ১ম দিন:  গোময়, ২য় দিন : গোমুত্র, ৩য় দিন:  দুধ, ৪র্থ দিন: দধি, ৫ম দিন: গোময়, গোমূত্র, দুগ্ধ,


২য় স্তর-ফলমূল গ্রহণ 

যদি কেউ ১ম স্তর অনুসরণ করতে না পারেন, তবে ফলমূল গ্রহণ করা যেতে পারে। অধিকাংশ ব্যক্তি ফলমূল গ্রহণ করেন। তাই আলু, মূল এবং ফল যেমন কলা, আপেল, কূল, পানিফল, বাদাম, আখরোট, হেলেনটস, কাজুবাদাম, কিসমিস ও খেজুর খাওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন ফলের মতো এগুলোও ফল হিসেবে বিবেচিত হয়। 
 
আখের রস এবং ইক্ষুদ্রব্য যেমন মিছরি গ্রহণ করা যাবে। কিন্তু গুড় এবং মোলাসেস অনুমোদিত নয়। আলু, কাঁচকলা বা মিষ্টি আলু সেদ্ধ করে গ্রহণ করা যেতে পারে। স্বাদের জন্য সৈন্ধব লবণ ব্যবহার অনুমোদিত। তবে দুধ বা দুগ্ধজাত কোনো দ্রব্য গ্রহণ করা যাবে না। নারকেল ও নারকেলের জল গ্রহণ করা যাবে।

ভীষ্মপঞ্চক ব্রতের উদ্দেশ্যঃ 

যেহেতু উদ্দেশ্যটি হলো আমাদের নিয়মিত ভগবদ্ভক্তি চালিয়ে যাওয়া, এমন নয় যে, আমি উপবাস করছি, তাই আমি কিছু করব না। যাদের ডায়াবেটিস আছে অথবা যারা সম্পূর্ণ উপবাস করতে পারবেন না, তারা হবিষ্যান্ন পেতে পারেন। যে ব্যাপারটি চিত্তাকর্ষক তা হলো, ভীষ্মদেব তাঁর পিতার কারণে বিবাহ না করার প্রতিজ্ঞা করেছেন। 
 
এর পেছনে এক বৃহৎ কাহিনী রয়েছে। প্রার্থনায় আছে, ‘আজন্ম ব্রহ্মচারিণে’, আমরা তাঁর জন্য তর্পণ করছি। তাঁর কোনো সন্তান নেই, তিনি কখনো বিবাহ সারা ভারত এবং সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ ভীষ্মদেবের জন্য ভীষ্মপঞ্চক করছেন; এবং তারা তর্পণ করছেন; কিন্তু তাঁর কোনো সন্তান নেই এবং তিনি গঙ্গাদেবী প্রসন্ন হন যে, তাঁর পুত্র সম্মানপ্রাপ্ত হচ্ছেন। এভাবে এই ব্রতের ফলে মাতাগঙ্গা, মহাত্মা ভীষ্মদেব এবং সর্বোপরি পরমেশ্বর ভগবান প্রসন্ন হন। আর তাঁকে প্রসন্ন হন। আর তাঁকে প্রসন্ন করাই সমস্ত যজ্ঞ, দান, ব্রত বা তপস্যার মুখ্য উদ্দেশ্য। 

আরও পড়ুন

 * একাদশী কী? কিভাবে একাদশীর আবির্ভাব হলো

* তুলসী মাহাত্ম-বৃক্ষ হয়েও তুলসী কেন পূজনীয়া?

*শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সকল অধ্যায় সমূহ  

            

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url