বৈষ্ণব সেবার মাহাত্ম্য
বৈষ্ণব মাহাত্ম্য
শ্রীশ্রীহরিভক্তিবিলাসে বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে বৈষ্ণব মহিমা সম্পর্কে যে সকল বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তার কিছু অংশ নিম্নে দেওয়া হলোঃ
“সৌপর্ণে শ্রী শক্রোক্তৌ--
কলৌ ভাগবতং নাম দুর্ল্লভং নৈব লভ্যতে।
ব্রহ্মরুদ্রপদোৎকৃষ্টং গরুণা কথিতং মম ।।৬৫।।
কলিযুগে বৈষ্ণব নাম দুষ্প্রাপ্য, কদাচই প্রাপ্ত হওয়া যায় না, বৈষ্ণব নাম রুদ্রপদ অপেক্ষা উত্তম, বৃহস্পতি মৎসকাশে (ইন্দ্রের নিকট) ইহা কীর্ত্তন করিয়াছেন।
শ্রীমার্কন্ডোয়োক্তৌ--
সমীপে তিষ্ঠতে যস্য হ্যস্তকালেহ পি বৈষ্ণবঃ।
গচ্ছতে পরমং স্থানং যদ্যপি ব্রহ্মহা ভবেৎ।।৬৭।।
মরণসময়ে বৈষ্ণবজন সন্নিহিত থাকিলে ব্রহ্মঘাতী পাপীও পরম পদ লাভ করে।
নারদীয়ে শ্রীবামদেবরুকমাঙ্গদসংবাদে-
শ্বপচোহপি মহীপাল বিষ্ণোর্ভক্তো দ্বিজাধিকাঃ।
বিষ্ণুভক্তিবিহীনো যো যতিশ্চ শ্বপচাধিকঃ।।৬৮।।
হে নৃপতে! বৈষ্ণব হইলে শ্বপচ ব্যক্তিও দ্বিজ হইতে শ্রেষ্ঠ এবং হরিভক্তিবর্জিত হইলে যতি ব্যক্তিও স্বপচাপেক্ষা হীন বলিয়া গণনীয়।
কাশীখন্ডে ধ্রুব চরিত্রে--
ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়া বৈশ্যঃ শূদ্রো বা যদি বেতরঃ।
বিষ্ণুভক্তিসমাযুক্তো জ্ঞেয়ঃ সর্ব্বোত্তমোত্তমঃ।।৭৮।।
হরিভক্তিমান হইলে কি বিপ্র, কি ক্ষত্রিয়, কি বৈশ্য, কি শুদ্র, কি অন্ত্যজ, যে কোন জাতিই হউক্ না সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হইয়া থাকে।
ইতিহাসসমুচ্চয়ে শ্রীলোমশবাক্যে-
যে ভজন্তি জগদযোনিং বাসুদেবং সনাতনম্ ।
ন তেভ্যো বিদ্যতে তীর্থমধিকং রাজসত্তম।।৮২।।
হে নৃপতিপ্রবর! যে সকল ব্যক্তি জগৎকারণ সনাতন হরিকে আরাধনা করেন, তাঁহারাই প্রধান তীর্থস্বরূপ, তাঁহাদিগের অপেক্ষা তীর্থশ্রেষ্ঠ আর বিদ্যমান নাই।
যত্র ভাগবতাঃ স্নানং কুর্বন্তি বিমলাশয়াঃ।
তত্তীর্থমধিকং বিদ্ধি সর্ব্বপাপবিশোধনম।।৮৩।।
বিমলমতি ভগবদ্ভক্তেরা যথায় স্নান করেন, সেই স্নান সর্বাপেক্ষা তীর্থশ্রেষ্ঠ বলিয়া জানিবে; কেননা উহাতে নিখিল পাপের সম্যকশুদ্ধি হয়।
তস্মাদেতে মহাভাগা বৈষ্ণবা বীতকল্মষাঃ
পুনন্তি সকলাঁল্লোকাংস্তত্তীর্থমধিকং ততঃ।।৮৫।।
এই হেতু এই সমস্ত পাপহীন মহাভাগ বৈষ্ণবেরা অখিল লোক পবিত্র করেন; সুতরাং তাঁহারাই পরম তীর্থস্বরূপ।
তস্মাদ্বিষ্ণুপ্রসাদায় বৈষ্ণবান পরিতোষয়েৎ।
প্রসাদসুমুখো বিষ্ণুস্তেনৈব স্যান্ন সংশয়ঃ।।৮৭।।
এই হেতু হরির প্রীতি-সাধনার্থ বৈষ্ণবগণের তুষ্টি বিধান করিবে, তাহা হইলেই নিঃসন্দেহ হরি প্রসন্ন মুখ হইবেন।
আদিপুরাণে কৃষ্ণার্জুন সংবাদে-
যে মে ভক্তজনাঃ পার্থ ন মে ভক্তাশ্চ তে জনাঃ।
মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ।।
যে কেচিৎ প্রাণিনো ভক্তা মদর্থে ত্যক্ত বান্ধবাঃ।
তেষামহং পরিক্রীতো নন্যক্রীতো ধনঞ্জয়।।৯৩।।
হে অর্জুন। যাহারা আমার ভক্ত, তাহারা প্রকৃত ভক্ত বলিয়া গণনীয় নহে; মদীয় ভক্তগণের ভক্তেরাই মদীয় সর্বোত্তম ভক্ত বলিয়া পরিকীর্ত্তিত। হে পার্থ, যাহারা মদ্ভক্তিমান হইয়া মদর্থে বন্ধু বান্ধব বিসর্জ্জন দিয়াছে, আমি সেই সকল জীবের নিকটে ক্রীত আছি, আমাকে ক্রয় করিতে অপর কাহারও সাধ্য নাই।
বৃহন্নারদীয় পুরাণে--
রাগদ্বেষবিহীনা যে মৎভক্তা মৎপরায়ণাঃ।
বদন্তি সততং তে মাং গতাসূয়া অদাম্ভিকাঃ।।
পরাপকারবিমুখা মদ্ভক্তার্চ্চনতৎপরাঃ।
মৎকথাশ্রবণাসক্তা বহন্তি সততং হি মাম্ ।।১০১।।
মৎপরাণ, রাগদ্বেষরহিত ভক্তেরা নিরন্তর অসূয়া ও দম্ভ বিসর্জ্জন করতঃ আমার গুণাদি কীর্তন করিয়া থাকেন। যে সকল ব্যক্তি কদাচ পরের অনিষ্ট সাধন না করেন, মদ্ভক্তকুলের অর্চ্চনায় নিরত থাকেন আর যে সকল ব্যক্তি মৎকথাশ্রবণে অনুরাগী, তাঁহারাই নিরন্তর আমাকে বহন করিয়া থাকেন।
নবমে শ্রীভগবতঃ-
সাধবো হৃদয়ং মহ্যং সাধুনাং হৃদয়ং ত্বহম্।
মদন্যন্তে ন জানন্তি নাহং তেভ্যো মনগপি।।১৩৮।।
যাঁহারা আমাতে নিজনিজ হৃদয় সমর্পণ করেন, আমি তাঁহাদিগের হৃদয় জানি, আমাকে ভিন্ন তাঁহারা অপর কাহাকেও জানেন না এবং আমিও তাাঁহাদিগকে ভিন্ন অন্য কাহাকেও জানি না।
একাদশে শ্রীবাসুদেবস্য--
যথোপশ্রয়মাণস্য ভগবন্তং বিভবসুং।
শীতং ভয়ং তমোহপ্যেতি সাধূন্ সংসেবতস্তথা।।১৫১।।
ভগবান্ বিভাসুর আশ্রয় লইলে যেরূপ শীত, অন্ধকার ও ভীতি বিদুরিত হয়, সেইরূপ সাধুগণের সেবা করিলেও পাতক বিধ্বস্ত হইয়া থাকে।
স্কন্দ পুরাণে--
যেষাং স্মরণমাত্রেণ পাপলক্ষশতানি চ।
দহ্যন্তে নাত্র সন্দেহো বৈষ্ণবানাং মহাত্মনাং।।১৭৩।।
বৈষ্ণবগণকে স্মরণ করিলে নিঃসন্দেহে শতলক্ষ পাতক ভস্মীভূত হইয়া থাকে। পাদ্মে শ্রীযমবাহ্মণসংবাদে মহীরথনৃপোক্তৌ--
পাদ্মে শ্রীযমব্রাহ্মণসংবাদে মহীরথনৃপোক্তৌ--
যদা প্রপদ্যমানস্য ভগবন্তং বিভাবসুম।
শীতং ভয়ং তমোহপ্যেতি সাধুন সংসেবতঃ সদা।।১৮৯।।
ভগবান বিভাবসুর আশ্রয় লইলে যেরূপ শীত, ভীতি ও অন্ধকার বিদুরিত হয়, সেইরূপ সাধুসেবী ব্যক্তিরও যাবতীয় ভয় বিনাশ প্রাপ্ত হইয়া থাকে।
অক্ষ্নোঃ ফলং ত্বাদৃশদর্শনং হি, ত্বন্বাঃ ফলং ত্বাদৃশগাত্রসঙ্গঃ।
জিহ্বাফলং ত্বাদৃশকীর্তনং হি, সুদূর্লভা ভাগবতা হি লোকে।। ২১৬।।
ত্বাদৃশ ভক্ত দর্শনই নেত্রযুগলের ফল, ত্বাদৃশভক্তগণের গাত্রসঙ্গই শরীরফল এবং ত্বাদৃশভক্তদিগের নামকীর্তনই রসনার ফল; সুতরাং একমাত্র ভগবদ্ভক্তবর্গই সংসরামধ্যে পরম দুরাপ।”
বৈষ্ণব অপরাধ করলে কি হয়?
একমাত্র বৈষ্ণব অপরাধই ভক্ত জীবনে পতন ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। সুতরাং ভক্তদের এ বিষয়ে যৎপরোনাস্তি সাবধানতা অবলম্বন করা অত্যন্ত আবশ্যক। এ বিষয়ে বিভিন্ন শাস্ত্র থেকে উদ্বৃতি নিম্নে প্রদত্ত হল।
“স্কান্দে মার্কন্ডেয় ভগীরথসংবাদে--
যো হি ভাগবতং লোকমুপহাসং নৃপোত্তম।
করোতি তস্য নশ্যন্তি অর্থধর্ম্মযশঃসুতাঃ।।২৩৮।।
হে রাজেন্দ্র! ভগবদ্ভক্তের প্রতি উপহাস করিলে ধর্ম্ম, অর্থ, কীর্তি ও সন্ততি বিনাশ প্রাপ্ত হয়।
নিন্দাং কুর্বন্তি যে মূঢ়া বৈষ্ণবানাং মহাত্মনাম্ ।
পতন্তি পিতৃভিঃ সার্দ্ধং মহারৌরবসংজ্ঞিতে।।
হন্তি নিন্দতি বৈ দ্বেষ্টি বৈষ্ণবান্নাভিনন্দতি।
ক্রুদ্ধতে যাতি নো হর্ষয় দর্শনে পতনানি ষট।।২৩৯।।
মহাত্মা বৈষ্ণবজনের নিন্দাকারী মূঢ় ব্যক্তিগণ পিতৃগণ সহ মহারৌরবনামা নরকে নিমগ্ন হয়। বৈষ্ণবগণকে প্রহার, দ্বেষ বা অনাদর করিলে, তাহাদিগের প্রতি রোষ প্রদর্শন করিলে এবং তাঁহাদিগকে দেখিয়া হর্ষপ্রকাশ না করিলে নরকে নিমগ্ন হইতে হয়; এই ছয়টি নরক পতনের কারণ।”
ভক্তি সন্দর্ভে ৩১৩ শ্লোকে উল্লেখ করা হয়েছে--
যে শ্রীবিষ্ণ এবং তাঁর ভক্তের নিন্দা করে, তার শতজন্মার্জিত পুণ্য বিনষ্ট হয়। সে কম্ভীপাক নামক ভয়ঙ্কর নরকে পচতে থাকে এবং যতদিন পর্যন্ত সূর্য এবং চন্দ্র বিরাজমান থাকে ততদিন পর্যন্ত কীটেরা তাকে খেতে থাকে। তাই যে বিষ্ণু এবং বৈষ্ণবের নিন্দা করে তার মুখ দর্শন করা উচিত নয়। কোন অবস্থাতেই সেই প্রকার মানুষের সঙ্গ করা উচিত নয়।
শ্রীমদ্ভাগবতে (১০-৭৪-৪০) বলা হয়েছে-
ভগবান এবং ভগবানের ভক্তের নিন্দা শুনা মাত্রই কেউ যদি তৎক্ষণাৎ সেই স্থান পরিত্যাগ না করেন, তাহলে তিনি ভক্তিমার্গ থেকে অধঃপতিত হন।
শ্রীমদ্ভাগবত (৪-৪-১৭) বলা হয়েছে-
কর্ণৌ পিধায় নিরিয়াদ্ যদকল্প ঈশে
ধর্মাবিতর্য্যশৃণিভির্নৃভির্নৃভিরস্যমানে।
ছিন্দ্যাৎ প্রসহ্য রূষতীমসতাং প্রভুশ্চে-
জ্জিহ্বামসৃণপি ততো বিসৃজেৎ স ধর্মঃ।।
কেউ যদি কোন কান্ডজ্ঞানহীন ব্যক্তিকে ধর্মের ঈশ্বর এবং নিয়ন্তার নিন্দা করতে শোনে তাহলে তাকে দন্ডদান করতে অক্ষম হলে, কান বন্ধ করে সেখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।
শ্রীহরিনাম চিন্তামণিতে চারপ্রকারে বৈষ্ণব নিন্দার কথা বলা হয়েছে
১। নীচ কুলোদ্ভুত বলে তাঁর নিন্দা করা।
২। পূর্বের দোষের দরুন তাঁর নিন্দা করা।
৩। আকস্মিক দোষের জন্য তাঁর নিন্দা করা।
৪। প্রায় দোষ মুক্ত অবস্থায়ও তাঁর নিন্দা করা।
আরও পড়ুন