সুস্থ থাকার উপায় সমূহ-দুধ পানের উপকারিতা
সুস্থ থাকার বৈদিক উপায় সমূহ-আয়ুর্বেদ নির্যাস
আমাদের বৈদিক শাস্ত্রে সুস্থ থাকার উপায় সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। ভগবানের লীলা হেতু সৃষ্ট জগতের মানবগণের এমন কি প্রত্যেকটি প্রাণীর মঙ্গলার্থে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের সৃষ্টি।
ভারতীয় উপমহাদেশ চিকিৎসা বিজ্ঞানের আদি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বেদ-বেদাঙ্গ, তক্ষশিলাতে প্রাপ্ত তামা ও কাসাঁয় তৈরি শল্য চিকিৎসার উপকরণাদি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ভারতীয় ঋষিগণ ভগবান হতে পরম্পরার মাধ্যমে আয়ুর্বেদের জ্ঞান অর্জন করেছেন।
তারা দিনে দিনে এর নিগূঢ় তত্ত্ব বিশ্লেষণ ও আবিষ্কারের মাধ্যমে পৃথিবীর সকলের যে উন্নতি করেছেন, তা যথার্থ ইতিহাস বেত্তাগণ কখনোই অস্বীকার করতে পারবেন না।
স্বাস্থ্যই সম্পদ। অসুস্থ অবস্থায় বিধি মার্গে ভজন করা কঠিনতর হয়ে ওঠে। এছাড়া ব্যক্তিজীবনে নানা রকম সমস্যা তৈরি হয়। সুতরাং, স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন হওয়া অত্যাবশ্যক।
ভগবান ধন্বন্তরি বলেছেন, আয়ুর্বেদের প্রয়োজন দুইটি- ১. রোগীর রোগমুক্তি, ২. সুস্থের স্বাস্থ্যরক্ষা। আয়ু যে গ্রন্থে বিবৃত হয়েছে, তারই নাম আয়ুর্বেদ। জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মাবলির জ্ঞানই হলো আয়ুর্বেদ।
সুস্থ থাকার উপায়ের গ্রন্থ-আয়ুর্বেদের ইতিহাস
“প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা, ঋক্, যজু, সাম ও অথর্ব- চারবেদ দর্শন করে, পরে তার অর্থ সকল পর্যালোচনাপূর্বক আয়ুর্বেদ নামে অপর একটি বেদের সৃষ্টি করলেন। অনন্তর ভগবান ব্রহ্মা উক্ত বেদ ভাস্করদেবকে দান করলে, ভাস্করদেব সেই আয়ুর্বেদ হতে স্বতন্ত্র একটি সংহিতা প্রস্তুত করলেন। (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ১৬/৭-১৪)।
প্রথমে ব্রহ্মা আয়ুর্বেদ স্মরণ করে প্রজাপতি দক্ষকে শিক্ষা প্রদান করেন। তৎপরে প্রজাপতি অশ্বিনী কুমারদ্বয়কে, অশ্বিনী কুমারদ্বয় ইন্দ্রকে, তারপর আত্রেয়, ধন্বন্তরি, নিমি প্রমুখ মুনিগণকে এবং আত্রেয়াদি মুনিগণ অগ্নিবেশ প্রমুখকে আয়ুর্বেদ উপদেশ দিয়েছিলেন।
অগ্নিবেশাদি ছয়জন ঋষি যথা- অগ্নিবেশ, ভের, জতুকর্ণ, পরাশর, হারীত ও ক্ষারপাণি এরা স্বকীয় নামে পৃথক পৃথক সংহিতা বিস্তৃত করেন।
অগ্নিবেশাদিকৃত অতি বিস্তৃত সেই সমস্ত সংহিতা হতে সারতত্ত্ব বিষয়সকল গ্রহণ করে আমি (মহর্ষি বাগভট) সংক্ষিপ্ত ও নাতিবিস্তৃতভাবে এই অষ্টাঙ্গ হৃদয় নামক গ্রন্থ সংগ্রহ করছি।”
চরক সংহিতায় সূত্রস্থান ১.২ ও ৯-এ উল্লেখ আছে- ধরাতলে সর্বপ্রাণী ভয়ংকর রোগসকল উপস্থিত হওয়াতে মহর্ষি ভরদ্বাজ ঋষিগণের অনুরোধে আয়ুর্বেদ শিক্ষার্থে ইন্দ্রের নিকট গমন করেছিলেন।
ইন্দ্র ভরদ্বাজের প্রশস্ত অভিপ্রায় অবগত হয়ে তাঁকে সংক্ষেপে সমস্ত আয়ুর্বেদ শিক্ষা দিলেন। এরপর ঋষিগণ সেই শিক্ষা লাভ করেন। এছাড়াও অথর্ববেদে আয়ুর্বেদের বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে।
আয়ুর্বেদের অঙ্গসমূহ
আয়ুর্বেদের আটটি অঙ্গ। প্রত্যেক অঙ্গের সংক্ষিপ্ত বিবরণ সুশ্রুত সংহিতা অনুসারে নিম্নে উপস্থাপন করা হলো।
(১) শল্য-চিকিৎসা : বিবিধ তৃণ, কাষ্ঠ, পাষাণ, ধূলি, লৌহ, লোষ্ট্র, অস্থি, কেশ, নক প্রভৃতি শরীরে প্রবিষ্ট হলে তা বের করার জন্য পূযস্রাব করার জন্য এবং গর্ভশল্য উদ্ধার করার জন্য যেরূপ উপায় সকল আবশ্যক, তা এই শাস্ত্রে বর্ণিত আছে।
(২) শলোক্য তন্ত্র (ঊধ্বাঙ্গ-চিকিৎসা): এই তন্ত্রে কর্ণ, চক্ষু, মুখ, নাসিকা প্রভৃতির রোগসমূহের চিকিৎসা পদ্ধতি উল্লেখ আছে।
(৩) কায় চিকিৎসা : এই তন্ত্রে সর্বাঙ্গ সংশ্রিত ব্যাধি অর্থাৎ জ্বর, অতিসার রক্ত পিত্ত, শোষ, উন্মাদ, অপস্মার, কুষ্ঠ, মেহ প্রভৃতির চিকিৎসার কথা উল্লেখ আছে।
(৪) ভূত বিদ্যা (গ্রহ-চিকিৎসা): দেব, দৈত্য, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস, পিতৃ গণ, পিশাচ, নাগ প্রভৃতি গ্রহদিগের আবেশের ফলে যাদের মন বিকৃত হয়েছে, তাদের গ্রহশান্তির জন্য শান্তিকর্ম উপদিষ্ট হয়েছে।
(৫) কৌমার ভৃত্য: শিশু পালন, ধাত্রীদুগ্ধের শোধন এবং দূষিত স্তন্য ও গ্রহদোষজনিত বাল্যরোগসমূহের চিকিৎসার করা উল্লেখ আছে।
(৬) অগদন্ত্র (বিষ চিকিৎসা) : সর্প, কীট, লুতা, বৃশ্চিক ও মৃষিকাদির দংশনজনিত বিষের বিবরণ এবং বিবিধ প্রকার বিষ ও সংযোগ বিষের চিকিৎসা উল্লেখ আছে।
(৭) রসায়ন তন্ত্র : যাতে অকালে বৃদ্ধ না হওয়া যায়, যাতে আয়ু, মেধা ও বল হয় এবং যাতে চিরকারী রোগসমূহের উপশম হয়, এই শাস্ত্রে সেসকল ঔষধ উল্লেখ রয়েছে।
(৮) বাজীকরণ চিকিৎসা : অল্প শুক্রের বর্ধন, দূষিত শুক্রের শোধন, ক্ষীণ শুক্রের উপচয় ও শুষ্ক শুক্রের পুনরুৎপাদন এবং পুংশক্তি বৃদ্ধির উপায় সকল উল্লেখ রয়েছে।
দুধ পানের উপকারিতা
দুধ সত্ত্বগুণসম্পন্ন খাদ্য। গো এবং দুগ্ধ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কতটা প্রিয় তা সকলেই জানেন। নন্দ মহারাজের বহু গাভী ছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গো-গণের দেখাশোনা করতেন। অমৃতময় কতই না লীলা করতেন।
আর্য়ুবেদ শাস্ত্র মতে, দুগ্ধ আট প্রকার। যথা (১) গো-দুগ্ধ, (২) মেষী দুগ্ধ, (৩) মহিষী দুগ্ধ, (৪) উষ্ট্রীদুগ্ধ, (৫) ছাগী দুগ্ধ, (৬) একশফ (অখন্ডিত-ক্ষুর) জন্তুদিগের দুগ্ধ, (৭) হস্তিনী দুগ্ধ এবং (৮) মানুষী দুগ্ধ।
উক্ত প্রকারের মধ্যে গো-দুগ্ধই উত্তম এবং সর্বোৎকৃষ্ট। শ্রীমদ্ভাগবতের (১.১৬.৪) তাৎপর্যে শ্রীল এ.সি. ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ লিখেছেন-
“দুধ একটি অলৌকিক খাদ্য। কারণ তাতে মানবদেহের প্রয়োজনীয় সবকটি ভিটামিন রয়েছে। ব্রাহ্মণ্যসংস্কৃতির প্রগতি হয় তখনই, যখন মানুষ সত্ত্বগুণে বিকশিত হওয়ার শিক্ষা লাভ করে এবং সেজন্য দুধ, ফল এবং শস্যজাত খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে অধিক।”
ভগবদ্গীতা অনুসারে, যজ্ঞানুষ্ঠানের ফলে দেবতাগণ সন্তুষ্ট হয়ে আমাদের প্রার্থিত ভোগ্যবস্তু প্রদান করেন। যজ্ঞানুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজন সত্ত্বগুণসম্পন্ন ব্রাহ্মণ। আর মানুষের সত্ত্বগুণ বিকাশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হলো গোদুগ্ধ। চরক সংহিতার ২৭তম অধ্যায়ের সূত্রস্থান ১৮০- তে বলা হয়েছে-
“স্বাদু শীতং মৃদু স্নিগ্ধং বহলং শ্নক্ষপিচ্ছিলম্ ।
গুরু মন্দং প্রসন্নঞ্চ গব্যং দশগুণং পয়ঃ।।
তদেবং গুণমেযৌজঃ সামান্যাদভিবর্দ্ধয়েৎ।
প্রবরৎ জীবনীয়ানাং ক্ষীরমুক্তং রসায়নম্ ।।”
অর্থাৎ-গো-দুগ্ধ স্বাদু, শীতল, মৃদু, স্নিগ্ধ, বহল(ঘন), শ্লক্ষ, পিচ্ছিল, গুরু, মন্দ ও নির্মল- এ দশটি গুণযুক্ত। এসকল গুণ থাকাতে এবং গোদুগ্ধের সাথে ওজোধাতুর সাম্য থাকাতে গোদুগ্ধে ওজোধাতুর বৃদ্ধি হয়। জীবনীয়দিগের মধ্যে দুগ্ধ উৎকৃষ্ট ও রসায়ন।
সুশ্রুত সংহিতার ৪৫ অধ্যায়ের ৪৫ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, “দুগ্ধ বাত, শোষ, ক্ষয়, গুল্ম, উন্মাদ, উদর, মূর্চ্ছা, ভ্রম, মদ, দাহ, পিপাসা, হৃদরোগ, বস্তিরোগ, পান্তুরোগ, গ্রহণীদোষ, অর্শ, শূল, উদাবর্ত, অতিসার, প্রবার্হিকাম যোনিরোগম গর্ভাস্রাব, রক্তপিত্ত, শ্রম ও ফ্লমনাশক।
দুগ্ধ পাপ নাশক (সত্ত্বগুণ বৃদ্ধির মাধ্যমে পাপকার্য থেকে বিরত হতে সহায়তা করে) বল্য, বৃষ্য, বাজীকরণ, রসায়ণ, মেধ্য, সন্ধান, স্থাপন, বয়ঃস্থাপন, আযুষ্য, জীবন, বৃংহন, বমনোপগ, বিরেচনপগ এবং ওজো ধাতুর তুল্য গুণ বলে ওজোধাতুর বর্ধক। এটি বাল, বৃদ্ধ, ক্ষতক্ষীণ, ক্ষু- ধাতুর, ব্যবায়ক্ষীণ ও ব্যায়ামক্ষীণ দিগের পথ্যতম।”
দুধ পানের সঠিক সময় এবং নিয়ম
আয়ুর্বেদে বলা হয়েছে- সকাল বেলা দুধ পানে শরীরে বল ও পুষ্টি দেয়। যারা শরীর বৃদ্ধি (ওজন) করতে চায়, তারা সকালে দুধ পান করতে পারে। সকালে দুধ পানে শরীরে অগ্নি বৃদ্ধি হয়।
দুপুরে দুধ পানে বল বৃদ্ধি, রুচি দেয়, মূত্র রোগ নাশক। যাদের শরীরে পাথর হয়েছে, তারা দুপুরে দুধ পান করতে পারে।
রাতে দুধ পানে শরীরের দোষ নাশ হয়। যারা সকলে ব্যায়াম করে, তারা রাতে দুধ পেতে পারে। রাতে দুধ নাড়ীকে শান্ত করে।
ব্রহ্মচারীদের রাতে উষ্ণ গরম দুধ পান করা উচিত। দুধ যতটুকু, সেই পরিমাণ জল দিয়ে জ্বাল দিয়ে আবার দুধের পরিমাণ আনা হলে সেই দুধ ব্রহ্মচারীদের জন্য অতি উত্তম।
গুড় দিয়ে দুধ খাওয়া যাবে না। তবে যাদের মূত্র সমস্যা আছে, তারা গুড় দিয়ে দুধ খেতে পারে, তাও নিয়মিত নয়। ঠান্ডা দুধ কখনোই খাওয়া উচিত নয়। যদি খেতে হয় তো দুপুরে খাওয়া যেতে পারে।
কফ-রোগী যেন কখনোই ঠান্ডা দুধ না খায়। উষ্ণ গরম দুধই শ্রেষ্ঠ। মিশ্রির সাথে দুধ উত্তম ফলদায়ক। ঘি দিয়ে দুধ অতি উত্তম। এতে শরীরে ধাতু পুষ্ট হয় এবং পরমায়ু বৃদ্ধি হয়।
সবসময়ই মনে রাখা উচিত-দুধের সাথে লবণ নয় (ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, ব্রহ্মখন্ড-২৭-২২)। লবণাক্ত কিছু খাওয়ার আধাঘণ্টা আগে বা পরে দুধ খাওয়া যেতে পারে। দুধ পানে বদহজম বা লুস মোশন (ডায়রিয়া) হলে সরাসরি দুধ খাওয়া উচিত নয়।
সেই সময়ে শুঁঠ (আদাচূর্ণ), হলুদ অথবা রাধুণী মিশিয়ে দুধ খাওয়া দুধ খাওয়া যেতে পারে। সন্ধ্যাকালীন দুধ পান সকলের জন্যিই ভালো। ভরপেট খাওয়ার ৪৫ মিনিট বা দুই ঘণ্টা পর দুধ খাওয়া উচিত। যোগ রত্নাকর গ্রন্থে আছে, যেকোনো জ্বরের প্রারম্ভে বা জ্বরে দুধ সেবন উচিত নয়। যাদের যোকোনো চর্ম রোগ আছে, তাদের বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী দুধ খাওয়া উচিত।