ভোগ ও নৈবেদ্য নিবেদন পদ্ধতি মন্ত্র
ভোগ নিবেদন পদ্ধতি
যদিও গৃহে শ্রীবিগ্রহ উপাসনার ক্ষেত্রে সর্বদা সঠিক সময়ে ভোগ নিবেদন পদ্ধতি নিয়মানুবর্তিতা আশা করা চলে না, তা হলেও যথা সম্ভব সময়ানুবর্তিতা অবলম্বন করতে চেষ্টা করা উচিত।
যখনই যা কিছু খাদ্য সামগ্রী তৈরী হবে, তখনই তা অবশ্যই শ্রীবিগ্রহাদির প্রীতিবিধানে নিবেদন করা চাই, ফলে নিবেদনের সংখ্যা কম বেশী হতে পারে।
যাই হোক,দিনের মধ্যে কয়েকটি নির্দিষ্ট ভোগ নিবেদননের সময় অবশ্যই নির্ধারিত থাকবে (যেমন প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজ, নৈশভোজ) যার সাথে পরিবার বর্গের রান্নাবান্নার কার্যসূচীরও সামঞ্জস্য করে নিতে হবে।
প্রারম্ভিক করণীয়
- শ্রীবিগ্রহ কক্ষের বাইরে আচমন সেরে শ্রীগুরদেব এবং শ্রীবিগ্রহাদির উদ্দেশ্যে দন্ডবৎ প্রণাম সহ মন্ত্রোচ্চারণ।
- হাতে তালি বাজিয়ে, বা ঘণ্টাধ্বনি করে, কিংবা দরজায় টোকা দিয়ে শ্রীবিগ্রহাদির মনোযোগ আকর্ষণ করা দরকার তারপরে শ্রীবিগ্রহ নাম জপ করতে করতে বিগ্রহ কক্ষে প্রবেশ করতে হয়।
- ভোগনিবেদনের জায়গাটুকু পরিষ্কার করে, নিজের হাত ধুয়ে, খাদ্যসামগ্রী রাখবার জায়গাটি পরিষ্কার করে, টেবিল মুছে রাখতে হয়।
- ঘণ্টা বাজিয়ে, শ্রীগুরুদেবের চরণপ্রান্তে কিছু ফুল দিয়ে শ্রীবিগ্রহ সেবার অনুমতি প্রার্থনা করতে হয়। (প্রয়োজন হলে, ফুলের পরিবর্তে পঞ্চপাত্র থেকে জল অর্পণ করা চলে- চামচে জল নিয়ে শ্রীগুরুদেবের প্রতিকৃতির উদ্দেশ্যে ধারণ করে তার পরে সেই জল বিসর্জনীয় পাত্রে ফেলে দিতে হয়। তা না হলে শুধুমাত্র মানসভাবে ফুল নিবেদন করাও চলে।)
- শ্রীগুরুদেবের জন্য একটি আসন নিবেদন করা চাই।
ভোগ ও শুদ্ধিকরণ
ভোগ নিবেদনের পাত্রগুলি এনে টেবিলে বা চৌকিতে রাখতে হয়। ডান হাত দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল ছিটিয়ে প্রত্যেকটি পাত্রকে প্রোক্ষণ করতে হয় এবং প্রত্যেক পাত্রে তুলসীপত্র দিতে হয়।
ভোগ গ্রহণের জন্য শ্রীভগবানকে আমন্ত্রণ
- ঘণ্টা বাজিয়ে শ্রীবিগ্রহাদির মর্যাদা অনুসারে একে একে প্রত্যেকের শ্রীচরণে পুষ্প নিবেদন করে মনোযোগ আকর্ষণ করা দরকার এবং পরে ভোগ-নৈবেদ্যের আহার্য সামগ্রী গ্রহণের জন্য তাঁদের প্রার্থনা জানাতে হয়। (প্রয়োজন হলে পুষ্প নিবেদনের পরিবর্তে পঞ্চপাত্র থেকে জল নিবেদন করা চলে, কিংবা শুধুমাত্র মানসভাবে পুষ্প নিবেদন করলেও হয়।)
- আসনের জন্য কোনও আসন বা গদি যদি না থাকে, তা হলে শ্রীবিগ্রহাদির উদ্দেশ্যে নিবেদিত ভোগপাত্রগুলির সামনেই কিছু ফুলের পাঁপড়ি রাখা যায়। শ্রীবিগ্রহাদির মর্যাদাক্রমে এবং হাত দিয়ে তাঁদের নিয়ে আসার ভঙ্গিতে ভোগ গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ করতে হয়।
- আসনে বসে বাঁ হতে ঘণ্টা বাজিয়ে, পঞ্চপাত্র থেকে জল নিয়ে শ্রীগুরুদেব এবং তার পরে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু থেকে শুরু করে তাঁর পার্ষদবৃন্দ, অন্যান্য শ্রীবিগ্রহাদি হয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর সহচরদের উদ্দেশ্যে পাদ্য অর্ঘ্য ও আচমন নিবেদন করতে হয়।
- পাদ্য অর্ঘ্য এবং আচমনের জন্য নেওয়া প্রত্যেকবার চামচ ভর্তি জল বিসর্জনীয় পাত্রে ফেলে দিতে হয়।
ভোগ নিবেদনের মন্ত্র
- ভোগপাত্রগুলির দিকে নির্দেশ করে প্রত্যেক শ্রীবিগ্রহের উদ্দেশ্যে নিবেদিত ভোগ এবং জল গ্রহণের জন্য প্রার্থনা জানাতে হবে।
- ঘণ্টা বাজিয়ে শ্রীগুরুদেবের উদ্দেশ্যে তিনবার প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণ করে শ্রীবিগ্রহাদি সেবার জন্য তাঁর অনুমতি প্রার্থনা করতে হয়-
নম ওঁ বিষ্ণুপাদায় কৃষ্ণপ্রেষ্ঠায় ভূতলে।
শ্রীমতে (গুরুদেবের নাম) ইতি নামিনে।।
- শ্রীল প্রভুপাদের উদ্দেশ্যে নীচের প্রণাম মন্ত্রটি তিনবার জানিয়ে তার কৃপাভিক্ষা করতে হয়।-
নমো ওঁ বিষ্ণুপাদায় কৃষ্ণপ্রেষ্ঠায় ভূতলে।
শ্রীমতে ভক্তিবেদান্ত স্বামীনিতি নামিনে।।
নমস্তে সারস্বতে দেবে গৌরবাণী প্রচারিণে।
নির্বিশেষ শূন্যবাদি পাশ্চ্যাত দেশ তারিণে।।
- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উদ্দেশ্যে নীচের প্রার্থনাটি তিনবার জানিয়ে তাঁর কৃপা ভিক্ষা করতে হয়। -
কৃষ্ণায় কৃষ্ণচৈতন্য নাম্নে গৌরত্বিষে নমো।।
- ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে নীচের প্রার্থনাটি তিনবার উচ্চারণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হয়।
নমো ব্রহ্মণ্যদেবায় গো-ব্রাহ্মণ্য হিতায় চ।
জগদ্ধিতায় কৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমো নমঃ।।
শ্রীবিগ্রহকক্ষ ত্যাগ করে বাইরে এসে গায়ত্রীমন্ত্র জপ করতে হয়। শ্রীগুরুদেব প্রদত্ত মন্ত্রগুলি সবই এই সময়ে জপ করা যেতে পারে। (সামান্য ভোগ নিবেদনের ক্ষেত্রে, কেবলমাত্র ব্রহ্ম-গায়ত্রী শ্রীগুরুদেব প্রদত্ত সাতটি মন্ত্রের প্রথমটি অথবা গোপাল-মন্ত্র শ্রীগুরুদেব প্রদত্ত সাতটি মন্ত্রের ষষ্ঠটি জপ করা যেতে পারে।) হরিনাম দীক্ষা প্রাপ্ত ভক্তগণ একমালা হরিনাম জপ করবেন)
শ্রীভগবানের আহার গ্রহণের সময়ে, নিজের পছন্দমতো বিভিন্ন শ্লোক আবৃত্তি করা চলতে পারে কিংবা (বিশেষত মধ্যাহ্ন ভোগের সময়ে ‘ভোগ আরতি’ ভজ ভকত বৎসল শ্রীগৌরহরি কীর্তনের পরে, জয় জয় গোবিন্দ গোবিন্দ গোপাল নাম কীর্তন করতে হয়। তারপরে পূজারী যখন ভোগ নিবেদনের শেষে শঙ্খ বাজিয়ে পর্দা সরিয়ে দেন,
তখণ ভক্তগণ ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করে যশোমতি নন্দন নাম কীর্তন এবং পঞ্চতত্ব মহামন্ত্র ও হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করেন, এবং শেষে ‘নৃসিংহদেবের স্তব’ নমস্তে নরসিংহায় কীর্তন সমাপ্ত করে জয়ধ্বনি ঘোষণার মাধ্যমে মধ্যাহ্ন ভোগ আরতি অনুষ্ঠান সমাপ্ত করেন)।
নির্দিষ্ট কিছু সময় বাদে ( সাধারণত প্রাতরাশের মধ্যাহ্ন ভোগের ও সান্ধ্য ভোগের ক্ষেত্রে পনের-কুড়ি মিনিট, মঙ্গল-আরতির আগে বাল্য-ভোগের ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে দশ মিনিট), দরজায় টোকা দিয়ে, হাতে তালি বাজিয়ে, কিংবা ঘণ্টা বাজিয়ে তার পরে শ্রীবিগ্রহ-কক্ষে ঢুকতে হয়।
ভগবানের আহার গ্রহণের পরে করণীয়
- আসনে বসে বাম হাতে ঘণ্টা বাজিয়ে প্রত্যেক-শ্রীবিগ্রহাদির হস্ত-মুখ প্রক্ষালন, পাদ্য এবং আচমনের জন্য জল অর্পণ করে বস্ত্র দিয়ে হস্ত, মুখ ও পাদ্য মুছিয়ে দিতে হয়।
- ধ্যানমগ্ন হয়ে চিন্তা করতে হয় যেন শ্রীবিগ্রহাদিকে নিজ নিজ বেদি-আসনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং সেই উদ্দেশ্যে হস্তভঙ্গিমা সহকারে তাঁদের পথ নির্দেশ করে নিয়ে যেতে হয়।
ভগবানের পার্ষদবর্গের মধ্যে প্রসাদ নিবেদন
- শ্রীভগবানের প্রসাদ একবার শ্রীগুরুদেবকে এবং শ্রীভগবানের পার্ষদবর্গের মধ্যে অর্পণ করতে হয় এবং সেই সঙ্গে বলতে হয়-
হে শ্রীগুরু মহারাজ, কৃপা করে এই মহাপ্রসাদ গ্রহণ করুন।
হে শ্রীভগবানের পার্ষদবর্গ, আপনারা কৃপা করে এই মহাপ্রসাদ গ্রহণ করুন।
শ্রীবিগ্রহের ন্যায় গুরুদেব ও পার্ষদবর্গের আচমন অর্পণ করে বস্ত্র দিয়ে হস্ত, মুখ ও পাদ মুছিয়ে দিতে হয়।
- সবশেষে, পাত্রগুলি সরিয়ে নিয়ে জায়গাতি পরিষ্কার করে দিতে হয়।
- বাহিরে এসে শঙ্খ বাজিয়ে পর্দা সরিয়ে আরতি করতে হয়।
আরও পড়ুন