ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যে রামায়ণের প্রভাব

ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যে রামায়ণের প্রভাব

 রামায়নের আবির্ভাব

 

পস্যায় সিদ্ধ বাল্মীকি তমসা নদীর তীরে তাঁর আশ্রমে বসে আছেন। উপস্থিত হলেন দেবর্ষি নারদ। বাল্মীকি শুনতে চান কোন আদর্শ চরিত্রের বর্ণনা। নারদ বর্ণনা করে চলেছেন রামের দিব্য চরিত্রের কাহিনী । ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যে রামায়ণের অনেক প্রভাব রয়েছে।

 

রাম জিতেন্দ্রিয়, সংযত-চিত্ত, ধৃতিমান, ৰুদ্ধিমান, মহাবীর্যবান, নীতিজ্ঞ ও শ্রীমান। গাম্ভীর্যে সমুদ্রের তুল্য, ধৈর্যে হিমালয় সদৃশ, ক্রোধে কালাগ্নি সম এবং ক্ষমায় পৃথিবীর মতো। তিনি ধর্ম ও জীবলোকের রক্ষক, সর্বশাস্ত্র মর্মদর্শী এবং ধর্ম ও সত্যের মানবীয় মূর্তি।


ইশ্বাকুবংশের রাজা দশরথ ও কৌশল্যার জ্যেষ্ঠ পুত্ররূপে রাম জন্মগ্রহণ করেছেন। পৃথিবীর পাপ ও রাক্ষস কুলের বিনাশ করে তিনি মর্তে ধর্মরাজ্য সংস্থাপন করবেন। দেবতাদের প্রার্থনায় স্বয়ং বিষ্ণু দশরথের পুত্ররূপে নিজেকে চারভাগে বিভক্ত করে ধরায় এসেছেন। 

 

আজানুলম্বিত বাহু, পদ্মপলাশ তাঁর আঁখি। (১। ৮-১৮) এই সমগ্র বিষয়টি বাল্মীকি রামায়ণে বলেছেন বীজাকারে, মাত্র একশত শ্লোকে আদিকাণ্ডের প্রথম সর্গে। নারদ বিদায় নিলেন। 

 

একদিন প্রাতঃকালে বাল্মীকি তাঁর শিষ্য ভরদ্বাজের সঙ্গে স্নানে চলেছেন তমসা নদীতে। শান্ত, পবিত্র প্রভাতেই হঠাৎ শুনলেন এক আর্তনাদ। দেখলেন রক্তাক্ত শরবিদ্ধ এক ক্রৌঞ্চ তাঁর সামনে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আর ক্রৌঞ্চী উপরে উড়ছে – কণ্ঠে তার প্রিয়-বিরহের বিলাপ-কাতর ধ্বনি। বাল্মীকি হলেন বিমর্ষ। দেখলেন এক নিষ্ঠুর ব্যাধ দাঁড়িয়ে আছে তাঁরই সামনে। 

 

বাল্মীকির কোমল হৃদয় থেকে উঠে এল এক অভিশাপ বাক্য : “মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ। যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।” (১২।২৫)

— ব্যাধ, কামমোহিত অবস্থায় ক্রৌঞ্চ মিথুনের একটিকে বধ করার জন্য তুই চিরকাল প্রতিষ্ঠা লাভ করবি না।

রামায়ণের পর্বে পর্বে আমরা দেখব এই প্রিয়-বিরহের নিদারুণ ব্যথা, এই হৃদয় বিদারক করুণ বিলাপ।


স্নান করে এসেছেন বাল্মীকি, উদাস দৃষ্টি, সেই ব্যথাকে ভুলতে পারছেন না। এলেন স্বয়ং ব্রহ্মা। বললেন: “তোমার ওই ছন্দোবদ্ধ বাক্য, শ্লোক নামেই খ্যাত হবে। আমার ইচ্ছাতেই তোমার মুখ দিয়ে এই সারস্বত বাণী বেরিয়েছে। নারদের কাছে যেমন শুনেছ সেই অনুসারে রাম-লক্ষ্মণ-সীতা ও রাক্ষসদের বিষয়ে লেখ। তোমার এই রাম-মাহাত্ম্য বর্ণনা চিরদিন অমর হয়ে থাকবে—


“যাবৎ স্থাস্যত্তি গিরয়ঃ সরিতশ্চ মহীতলে। তাবদ্ রামায়ণকথা লোকেষু প্রচরিষ্যতি।।”


বাল্মীকি রচনা করলেন চব্বিশ হাজার শ্লোক, তা আবার পাচ শত সর্গে বিভক্ত। এর সাতকাণ্ড – বালকাণ্ড বা আদি, অযোধ্যা, অরণ্য, কিষ্কিন্ধ্যা, সুন্দর, লঙ্কা ও উত্তর কাও। (১৪।২) ব্রহ্মার আজ্ঞায় বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করেন। রচনাকালে বাগদেবী তার কণ্ঠে বিরাজিতা ছিলেন। 

 

(১২।৩১-৩২) রামায়ণ প্রকৃতপক্ষে রামের পুণ্যজীবনের কাহিনী। মহেশ্বর জপ করেন এই মন্ত্র-রাম। "রামো রময়তাং বরঃ রাম আনন্দস্বরূপ এবং আনন্দদাতা, হিন্দুদের প্রিয় অবতার। তার নাম জপ করলে চতুবর্গ ফললাভ হয়। “নরচন্দ্রমাঃ” —সর্বসুখপ্রদ রাম নাম পরম রমণীয়। রামের চেয়ে তাঁর নাম বড়, নামীর চেয়ে নাম বড়। এই জন্য রামায়ণ বেদের সমান—“বেদৈশ্চসন্মিতম্”। (১।১।৯৮)


অযোধ্যার রাজা দশরথ। অযোধ্যা দ্বাদশ যোজন দীর্ঘ, তিন যোজন প্রস্থ যেন মর্ত্তের অমরাবতী—“সিদ্ধানাং তপসাধিগতং দিবি।” (১।৫।১৯) সিদ্ধগণের তপস্যালব্ধ নগরী, অনেক মহাপুরুষের বাস, আর খুবই সুরক্ষিত বলে বলা হয়েছে “অযোধ্যা”। বালকাণ্ডের পঞ্চম সর্গে অযোধ্যার বর্ণনা আছে।


রাজা দশরথ বেদজ্ঞ, শাস্ত্রবিশারদ। তেজে, ঐশ্বর্যে, সত্য ও ধর্মপালনে তিনি ভুবন বিখ্যাত। (১।৬।১-৩) রাজসভায় বসেছেন দশরথ। পাত্র-মিত্র সকলেই সেই সভাগৃহ আলোকিত করে আছেন। উপস্থিত হলেন বিশ্বামিত্র। তাঁর প্রার্থনা রামের দ্বারা রাক্ষসদের বধ করে নির্বিঘ্নে যজ্ঞ সম্পন্ন করা। 

 

একথা শুনে দশরথের মনে ভয় হল। রামকে তিনি একাজে পাঠাতে চান না। কুলগুরু বশিষ্ঠ অভয় দিয়ে বললেন : “বিশ্বামিত্র নিজেই শত্রুনাশে সক্ষম, কেবল আপনার পুত্রদের কল্যাণের জন্য তিনি রামকে চান। আপনি নির্ভয়ে রামকে যেতে দিন। আপনি সত্যপালক, আপনার অঙ্গীকার ভঙ্গ করা উচিত নয়।” 

 

বিশ্বামিত্র চেয়েছিলেন শুধু রামকে। দশরথ ডাকলেন রাম ও লক্ষ্মণকে। কারণ লক্ষ্মণ রামের বহিঃস্থিত আত্মা। রামের ঘুম আসে না, সুখাদ্যে রুচি হয় না, লক্ষ্মণকে কাছে না পেলে। (১।১৮।৩০-৩১)


এই প্রথম আমরা দেখছি রাম-লক্ষ্মণকে, এতদিন শুধু নাম শুনেছি। বিশ্বামিত্রকে দশরথ বলেছিলেন: “রামের বয়স ষোলর কম, সে বারো বছরের বালক মাত্র।" বিশ্বামিত্রের আগমনে রাম-লক্ষ্মণের জীবনে গতি সঞ্চারিত হল। এবার রামায়ণ উন্মোচিত হবে আমাদের কাছে। 

 

বালক ও গৃহবাসী নিষ্পাপ রাম জানবেন জীবনকে নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। জানবেন সুরাসুরের চিরন্তন সংগ্রামকে। একই সঙ্গে পরিচিত হবেন ভারতের ইতিহাস, কাহিনী ও তীর্থ-মাহাত্ম্যের সঙ্গে। জানবেন ঋষিগণকে। তাঁদের তপস্যালব্ধ জীবনের দান গ্রহণ অস্ত্রবিদ্যায় হবেন পারদর্শী। তাঁদের আশীর্বাদের রক্ষাকবচে জীবনের সুপ্তশক্তিকে জাগ্রত করবেন।


বিশ্বামিত্রের পশ্চাতে রাম-লক্ষ্মণ। অযোধ্যার রাজপ্রাসাদ থেকে চলেছেন পদব্রজে প্রায় ছয় ক্রোশ পথ। সকলেই কিন্তু মৌন। সরযুর দক্ষিণ তীরে তাঁরা থামলেন বিশ্রামেরজন্য। 

 

বেলা দিপ্রহর। বিশ্বামিত্রের আদেশে রাম সরযুর জ্বলে আচমন করে বসলেন বিশ্বামিত্রের সামনে। বিশ্বামিত্র দীক্ষা দিলেন রামকে। বললেন : "রাম, তুমিই উপযুক্ত আধার। তোমাকে বলা' ও 'অভিবলা' নামে দুই মন্ত্র দান করব। আমার সকল তপস্যা ও সিদ্ধি তোমাকে দান করব। 

 

এই মন্ত্রের প্রভাবে তুমি জয় করবে ক্ষুধা-পিপাসা, মনে কোন বিকার আসবে না, কোন অবস্থাতেই রাক্ষসেরা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কোন বিষয়েই তোমাকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না। এই পবিত্র মন্ত্র নিখিলজ্ঞান ও কল্যাণের জননী।..." "গৃহাণ সর্বলোকস্য গুপ্তয়ে রঘুনন্দন।" (১(২২(১৮)


-হে রাম, সকল জীবের রক্ষার জন্য তুমি এই মন্ত্র গ্রহণ কর। তাঁরা সরযু তীরেই তৃণ শয্যায় রাত কাটালেন। গুরুর সান্নিধ্যে ও তাঁর উপদেশে রাম-লক্ষ্মণ সুখেই আছেন। রাত্রি-শেষে প্রভাত হল। মহর্ষি বিশ্বামিত্র শায়িত রামকে ডেকে বললেন : "নরশ্রেষ্ঠ রাম, মা কৌশল্যা তোমার জন্য সৎপুত্রবর্তী বলিয়া গৌরব করুন। এখন প্রাতঃসন্ধ্যাকাল। এসময় আহ্নিক ও দৈব কর্ম করা বিধেয়। অতএব তুমি শয্যা ত্যাগ কর।”


“কৌশল্যা সুপ্রজা রাম পূর্বসন্ধ্যা প্রবর্ততে উত্তিষ্ঠ নরশাদুল কর্তব্যং দৈবমাহ্নিকম্।” (১:২৩

দক্ষিণ ভারতে প্রতি গৃহে আজও এই শ্লোকটি বহুল প্রচলিত। তাঁরা আবার যাত্রা শুরু করলেন। এলেন অঙ্গদেশে (বিহারে) অনঙ্গাশ্রমে। পরদিন এলেন গঙ্গা ও সরযুর সঙ্গম স্থলে। নৌকায় গঙ্গা পার হবার সময় রাম বিস্মিত হয়ে এই প্রথম কথা বললেন : 

 

“মহর্ষি,ও কিসের শব্দ?” (১।২৪।৭) তাঁর কথার জবাব দিয়ে মুনি ত্রৈলোক্যপাবনী গঙ্গাকে প্রণাম করতে বললেন। রাম-লক্ষ্মণ উভয়েই প্রণাম করলেন। তাঁরা চলেছেন দক্ষিণ তীরে। দেখলেন বিশাল অরণ্য। রামের প্রশ্নে মুনি বললেন : “এককালে এ অঞ্চল বিশেষ সমৃদ্ধ ছিল, বর্তমানে তাড়কা রাক্ষসীর কবলে। 

 

তাড়কা সহস্র হস্তীর বলধারিণী। তার পুত্র মারীচও বলবান। আমাদের চলার পথেই তাদের দেখতে পাবে। রাম, গো-ব্রাহ্মণের হিতের জন্য এই রাক্ষসী তাড়কাকে বধ কর। ঘৃণা করো না; স্ত্রী হত্যাজনিত পাপের ভয় করো না; প্রজা রক্ষার জন্য রাজাদের এই সব কর্ম করাই সনাতন ধর্ম। (১২৫। ১৮-১৯)


রাম তাড়কার দুই বাহু এবং লক্ষ্মণ তার নাক ও কান কেটে দিলেন। পরে রাম তাড়কাকে বধ করলেন। সেই ভয়ঙ্কর বনেই তাঁরা রাত্রি যাপন করেন।


পরদিন অন্য এক আশ্রমে তাঁরা এলেন। বিশ্বামিত্র ও তপস্বিগণ সকলেই আনন্দিত হলেন। বিশ্বামিত্র পরদিন প্রাতঃকালে রামকে বহু দিব্য-অস্ত্র দান করলেন। বিশ্বামিত্রের আহ্বানে রামের সামনে এলেন দিব্যদেহধারী সকল অস্ত্রমূর্তি। তাঁরা করজোড়ে বললেনঃ “রাম, আমরা তোমার ভৃত্য ; তোমার ইচ্ছামত আমরা কাজ করব।” 

 

রাম তাঁদের বললেন: “তোমরা আমার মানসে বিরাজ কর। কার্যকালে আমার মনে অধিষ্ঠিত থেকে আমাকে সাহায্য করো।” (১/২৭।২৭, ১২৮।১৪) অর্থাৎ স্মরণ করলেই এসো। এটি প্রাচীন ভারতের এক বিস্ময়কর কীর্তি।


বারো বছরের এক নাবালককে মুনি দিলেন এই সব ভয়ঙ্কর দিব্যাস্ত্র। তিনি উপযুক্ত আধারে সমস্ত বিদ্যা দান করে পরিতৃপ্তি চান। ধর্মস্থাপনের জন্য এসব প্রয়োজনীয়। সিদ্ধাশ্রমে এলেন তাঁরা। বিশ্বামিত্র সেই দিনই শুরু করলেন তাঁর যজ্ঞ আদেশ দিলেন রামকে যজ্ঞ-নাশক রাক্ষসদের বধ করতে।  

 

ছয়দিন তিনি মৌনব্রত নেবেন। দুই ভাই নিদ্রা পরিত্যাগ করে পাহারা দিলেন ছয়দিন। শেষদিনে মারীচ এবং অন্যান্য রাক্ষসদের অত্যাচার শুরু হল। রাম মারীচকে না মেরে শরাঘাতে তার বক্ষশ্ছেদন করে তাকে বহুদূরে (আটশত মাইল) মহাসাগরে নিক্ষেপ করলেন। সুবাহু প্রভৃতি রাক্ষসগণকে তিনি বধ করলেন। যজ্ঞ সম্পন্ন হল, বিশ্বামিত্র অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। গুরু-ঋণ শোধ করলেন রাম।


রাম ও লক্ষ্মণ— বিশ্বামিত্র ও অন্যান্য মুনিগণের সঙ্গে ভ্রমণ করতে করতে মিথিলায় এলেন। এই স্থানে একটি নির্জন আশ্রম সম্বন্ধে রাম জানতে চাইলে বিশ্বামিত্র— ঋষি গৌতম ও তাঁর পত্নী অহল্যার কাহিনী বললেন। তার মুখে রাম শুনলেন যে, দেবরাজ ইন্দ্রের দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে অহল্যা তাঁর পবিত্রতা হারিয়েছিলেন। 

 

অসৎ কাজে অহল্যারও সম্মতি ছিল। সেজন্য অহল্যার স্বামী গৌতম অহল্যাকে অভিশাপ দেন  “দুষ্টচারিণী, তুমি এই বনে অদৃশ্য হয়ে কঠোর তপস্যা করে অনুতাপে দগ্ধ হও। একদিন রাম আসবেন এই বনে। তাঁকে শ্রদ্ধার সহিত সেবা করলে তুমি পবিত্র হয়ে আবার পূর্বরূপ ফিরে পাবে ও আমার সঙ্গে মিলিত হবে।” এই বলে গৌতম হিমালয়ে চলে যান তপস্যার জন্য।


রামের আবির্ভাবে অহল্যার শাপমোচন হল। তিনি ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী নারী। তাঁর মধ্যে কোন শ্রীহীনতা ছিল না বলে বলা হত অহল্যা। (শ্রীহীনতা যাঁর নেই তিনি অহল্যা) রাম ও লক্ষ্মণ অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে তপস্বিনী অহল্যার চরণ বন্দনা করেন। অহল্যাও তাঁদের যথারীতি অর্চনা করেন। সেসময় গৌতম আশ্রমে আসেন এবং অতিথিদের যথাবিধি সৎকার করে অহল্যাকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান হিমালয়ে তপস্যার জন্য।


রাম ও সীতার বিবাহ


দুই ভাই এসে উপস্থিত হলেন রাজর্ষি জনকের যজ্ঞশালায়। জনক ও অন্যান্য সকলে তাঁদের পরিচয় পেয়ে এবং তাঁদের গুণ ও রূপ দেখে অত্যন্ত পুলকিত হলেন। বিশ্বামিত্রের অনুরোধে জনক রামকে "হরধনু” দেখালেন। 

 

সকলের সম্মতি নিয়ে রাম অনায়াসে “হরধনু” ভঙ্গ করেন। হাজার হাজার দর্শক ধন্য ধন্য করেন রামের বীরত্ব দেখে। জনক তাঁর কন্যা সীতার সঙ্গে রামের বিবাহের সংবাদ অযোধ্যায় পাঠালে দশরথ, ভরত ও শত্রুঘ্ন প্রভৃতি মিথিলায় আসেন। মহাসমারোহে উত্তর-ফাল্গুনী নক্ষত্রে শুভলগ্নে রামের সঙ্গে সীতার বিয়ে হয়। 

 

এই শুভকাজের পরদিনই বিশ্বামিত্র সকলের কাছে বিদায় নিয়ে হিমালয়ে চলে যান তপস্যার জন্য। বিশ্বামিত্র প্রকৃতপক্ষে রামের শস্ত্রগুরু ছিলেন। যজ্ঞের নাম করে বিশ্বামিত্র রামকে অস্ত্রশিক্ষা ও দিব্যাস্ত্র দান করেছিলেন এবং ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে বলেছিলেন। 

 

রাম তাঁর সঙ্গে বহু জনপদ ও আশ্রম দেখেছেন। শুনেছেন বহু আখ্যায়িকা। ভারত সম্বন্ধে রামের কিছুটা পরিচিতি ঘটেছে বশিষ্ঠ মুনি এসব পূর্বেই জানতেন। তিনি দশরথকে বলেছিলেন যে বিশ্বামিত্রের দ্বারা তাঁর পুত্রের কল্যাণ হবে। রামকে শিক্ষাদি দিয়ে এবং বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বিশ্বামিত্র রামের সুপ্ত শক্তি জাগরণে বিশেষ সহায়তা করেন।


বিয়ের পর সকলে অযোধ্যায় ফেরার কালে পরশুরাম এলেন রামের শক্তি পরীক্ষা করতে। দশরথের কাতর মিনতিকে অগ্রাহ্য করলেন তিনি। রাম পরশুরামের ঔদ্ধত্যে কিছুটা আহত হয়ে তাঁর ধনুতে বাণ যোজনা করে বলেনঃ "আপনি ব্রাহ্মণ এবং আমার গুরু বিশ্বামিত্রের আত্মীয়। 

 

আপনার প্রাণনাশ আমি করব না। কিন্তু হয় আপনার গতি শক্তি, না হয় আপনার তপস্যার ফল নষ্ট করে দেব।” কুঠারধারী ব্রাহ্মণ পরশুরামের দর্প চূর্ণ হল। দশরথ যেন নতুন জন্ম লাভ করলেন। ভয়শূন্য হলেন তিনি।


রামের চরিত্রের এক বিশেষ দিক আমরা দেখলাম। পরশুরামের মতো রাম ঔদ্ধত্যপ্রকাশ করেননি। তিনি নম্র : গর্ব-অহঙ্কার তাঁর সমগ্র জীবনে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। তিনি শান্ত কণ্ঠে বলেছেন : “ভার্গব, আপনার বীরত্ব আমার জ্ঞাত আছে। আপনি আমার শক্তিকে অবজ্ঞা করছেন। এ আমি সহ্য করব না।” রামের আচরণে পরশুরাম হলেন নির্বীর্য, হতবল ও নির্জীব। 

 

তাঁর তেজ সংক্রমিত হল রামের দেহে। কিন্তু পরশুরামও মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি রামকে বললেন : “রাম, তুমি ত্রৈলোক্যনাথ, মধুসূদন। তোমার ধনু গ্রহণ করামাত্র আমি তা বুঝেছি। তোমার হাতে পরাজয় বরণ করে আমার কোন লজ্জা নাই। তুমি আমার তপোবল নষ্ট করে দাও, আমি মহেন্দ্র পর্বতে চলে যাব।” রামকে প্রদক্ষিণ করে প্রস্থান করলেন তিনি। দশরথ ও তাঁর সহযাত্রিগণ আনন্দে ফিরে এলেন অযোধ্যায়।


মহা সমারোহে অযোধ্যায় বিবাহ উৎসব শেষ হল। সকলেই আনন্দিত। রাম ও অন্যান্য ভায়েরা পিতার সেবা করছেন। কিছুকাল পরে ভরত ও শত্রুঘ্ন গেলেন মাতুলালয়ে। সীতা-রামের জীবন শান্তিতে কাটছে। দীর্ঘ বারো বছর অতিবাহিত হল পরম সুখে।


 রামের বনবাসে গমন


এবার অযোধ্যার জীবনে এল এক ভীষণ দুর্দিন। রামের চরিত্র-মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে প্রথম সর্গে সাতাশটি শ্লোকে। (৭-৩৪) সর্ববিষয়ে রাম আদর্শ—বিনয়ে, বীর্ষে, দক্ষতায়, প্রজাপালনে এবং জ্ঞানে। কিন্তু তাঁর আবির্ভাব হয়েছে দেবতাদের কাতর প্রার্থনার ফলশ্রুতিরূপে দর্পী রাবণের সংহারের জন্য। (১৭) দশরথ চান রামকে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করতে। রাজসভায় তিনি ঘোষণা করলেন এই প্রস্তাব। (২।২-৩) আনন্দের সঙ্গে সকলেই সমর্থন করলেন তাঁর প্রস্তাব।


প্রাচীন ভারতের আদর্শ রাজাগণ পুণ্য অর্জন করতেন শান্তি ও ন্যায়সঙ্গত উপায়ে প্রজা পালন করে। রাজা ও প্রজায় ছিল প্রীতির সম্বন্ধ। রাজা ছিলেন শুধু ধর্মের রক্ষক নন, প্রজাবৃন্দের সেবকও। সেজন্য দশরথ আবার জিজ্ঞাসা করলেন—কেন সভা রামকে চান যুবরাজরূপে। 

 

সভার মত জানতে চান দশরথ ; দ্বিধাহীন হতে চান তাঁর এই শুভকার্যে। প্রজারা যেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নির্ভয়ে তাঁদের মত ব্যক্ত করেন। তাঁরা সকলেই একবাক্যে চেয়েছেন রামকে। রাম প্রজাবৃন্দের অতি প্রিয়জন। রাজ্যাভিষেকের প্রস্তুতি চলেছে পুরোদমে। আগামীকাল পুষ্যানক্ষত্রে রামের অভিষেক হবে। রাম সেই শুম্ভ সংবাদ দিয়েছেন মাতা কৌশল্যাকে। রাম-সীতা শুদ্ধচিত্তে মৌনব্রত অবলম্বন করে প্রথানুসারে তৃণশয্যায় বিষ্ণুমন্দিরে শয়ন করেছেন।


ক্রৌঞ্চমিথুনের শোক থেকে বাল্মীকির মনে উঠেছিল শ্লোক। আনন্দের নিবিড় মুহূর্তে কোথা থেকে এল হঠাৎ দুর্ভাগ্যের ঘোষণা। রামায়ণে এই দৃশ্য আমরা অনেক ক্ষেত্রেই দেখতে পাব। অযোধ্যায়, কিষ্কিন্ধ্যায়, আবার বনবাস শেষে রামের রাজ্যাভিষেকের এক বছরের মধ্যেই সেই ব্যাধের কালশর ছিন্ন করে দিয়েছে সুখের নীড়— সীতা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে।


মন্থরা ও কৈকেয়ীর চক্রান্তের কথা আমাদের সকলের জানা আছে। রামের রাজ্যাভিষেকের পূর্বরাত্রি দশরথের কেটেছে অতি দুঃখে। পরদিন প্রাতে নির্লজ্জের মতো কৈকেয়ী মিথ্যা কথা বলেছেন সুমন্ত্রকে। রাম সব শুনেছেন কৈকেয়ীর মুখে। সব শুনেও রাম বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। 

 

তিনি চান তাঁর প্রাণপ্রিয় ভ্রাতা ভরত সুখী হোন। সেজন্য তিনি তাঁর প্রাণ বিসর্জন দিতেও সদা প্রস্তুত। কৈকেয়ী আবার রামকে বলেছেন: “তোমার বনগমন না হলে মহারাজ স্নানাহার করবেন না।” রাম বলেছেন : “দেবি, পিতার মত ও ধর্ম পালনেই আমার চিরদিনের শান্তি। আমি ধর্মের জন্য পিতৃসত্য পালন করব। আজই বনবাসে যাব।”


রাম চলেছেন তাঁর বনবাসের সংকল্প জানাতে জননী কৌশল্যার পূজাগৃহে। অনেক অশ্রুপাত ও যুক্তিতর্কের পর তিনি পুত্রকে আশীর্বাদ জানিয়ে সম্মতি দিয়েছেন। ভ্রাতৃ ভক্ত লক্ষ্মণকে শান্ত করে রাম চলেছেন সীতার নিকটে। তখনও সীতা এই অশুভ সংবাদের বিন্দুবিসর্গ জানেননি।


বহু বাদানুবাদের পর স্থির হল, সীতাও রামের সঙ্গে যাবেন। রামের সঙ্গে সীতার কথাবার্তার সময়ও রামের ছায়ারূপে লক্ষ্মণ ছিলেন তাঁর সঙ্গে। রামের যুক্তিতর্ক লক্ষ্মণকে বাধা দিতে পারেনি। তিনি রামের সম্মতি পেয়েছেন। রামের আদেশে লক্ষ্মণ তাঁদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাবেন বনবাসে। 

 

দুই ভাই তাঁদের ধনরত্ন ব্রাহ্মণ, তপস্বী ও অনুজীবিগণকে দান করে তাঁদের সকলের শুভেচ্ছা নিয়ে বনগমনের জন্য প্রস্তুত হলেন। বশিষ্ঠ-পুত্র সুযজ্ঞকে রাম-সীতা যুক্ত করে বহু মূল্যবান অলঙ্কার দিলেন। অন্যান্য সকলকেও এঁরা সব-কিছু দিয়েছেন। রাম ভৃত্যগণকে অনুমতি দিলেন তারা যেন সকলেই তাঁর ও লক্ষ্মণের গৃহে অবস্থান করে। প্রত্যেক ভৃত্যকে জীবিকা নির্বাহের জন্য রাম প্রচুর অর্থাদি দিলেন। এই দুঃসময়েও রাম পরিহাস করে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণকে সহস্র ধেনু দান করলেন।


রামের এই বনগমনের দৃশ্য তাঁর চরিত্রের এক অতি উজ্জ্বল দৈবীসত্তার প্রকাশ। অযোধ্যা ও বনবাস তাঁর চোখে সমান। শুধু এখানেই নিশ্চিতরূপে প্রমাণ করে তাঁর অলৌকিক জীবনের অমরত্ব। রামের বিদায়কালে দশরথের আদেশে সুমন্ত্র এনেছেন দশরথের তিনশত একান্ন পত্নীকে (অবশ্য কৈকেয়ীকে বাদ দিয়ে)। দশরথ রামকে দিতে চেয়েছিলেন সৈন্যসামন্ত ও ধনরত্ন। রাম বিনয়ের সঙ্গে সেসব গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। রাম সকলকে প্রবোধ দিয়েছেন।


তিনি দশরথের নিকট নত মস্তকে প্রার্থনা করেন : “আমার মাতা বৃদ্ধা, তাঁর মধ্যে যথেষ্ট উদারতা আছে, তিনি কখনও আপনার নিন্দা করেন নাই। এখন এঁকে আপনি সম্মানের সঙ্গে রক্ষা করবেন। শোকে তিনি যেন প্রাণ ত্যাগ না করে।”আবার বিদায়কালে মাকে রাম বললেন : “আপনি পিতাকে এইজন্য কটুবাক্য বলবেন না।"


তারপর সমবেত জননীগণকে করজোড়ে বললেন : “জননীগণ, আমার দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। সর্বদা একত্র বাস করার জন্য আমার অজ্ঞানতাবশতঃ দোষ-ত্রুটি ঘটে থাকতে পারে।” রামের পশ্চাতে চলেছেন বহু অযোধ্যাবাসী। কিছুদূর গেলে রাম তাঁদের ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেন এবং তাঁরা যেন ভরতকে রাজকার্যে সহায়তা করেন সে অনুরোধও করলেন।


অনুগত বৃদ্ধ তপস্বী ব্রাহ্মণগণ রথের অনুগমন করছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য রামের সহযাত্রী হয়ে জীবন নির্বাহ করা। তাঁদের প্রাণের একান্ত আকুতি, তাঁদের রাম-বিহীন অযোধ্যায় বাস না করার দৃঢ় সংকল্প, জীবন পণ করে রামের অনুগমন ইত্যাদি বিষয়গুলি রামায়ণে বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে।


রমণীয় তমসা নদীর তীরে তাঁদের কাটল প্রথম রাত্রি। সান্ধ্য প্রার্থনার পর রামের জন্য তৃণশয্যা রচনা করলেন সুমন্ত্র ও লক্ষ্মণ। রাম-সীতা নিদ্রিত বৃক্ষতলে। দূরে লক্ষ্মণ ও সুমন্ত্র রাত্রি কাটালেন জাগ্রত অবস্থায়।


পরদিন এঁরা এলেন শৃঙ্গবেরপুরে (গঙ্গার উত্তর তীরে মির্জাপুরের নিকট)। এখানে নিষাদরাজ গুহক এলেন রামকে অভ্যর্থনা জানাতে। সঙ্গে এনেছেন অনেক উপাদেয় খাদ্য, পানীয়, বসন, ভূষণ ইত্যাদি। রাম গুহককে আলিঙ্গন করে বললেন : “তোমার প্রীতির দান আমাদের কোন প্রয়োজনে আসবে না। কারণ আমরা সকলেই চীরধারী তপস্বী। শুধু আমার অশ্বের জন্য খাদ্য ও পানীয় দিও।"


লক্ষ্মণ নিজে গঙ্গাজল এনে সীতা-রামের পা ধুইয়ে দিলেন। গঙ্গার জল পান করে লক্ষ্মণের দ্বারা প্রস্তুত করা তৃণশয্যায় রাম-সীতা শয়ন করলেন। লক্ষ্ণণ রাম-গুণগান করে রাত্রি কাটালেন।


পরদিন প্রাতে রাম সুমন্ত্রকে অতিকষ্টে বিদায় দিলেন। রাম-সীতা ও লক্ষ্মণ গঙ্গা পার হলেন নৌকায়। গঙ্গার অপর তীরে এসে রাম বললেন : “লক্ষণ, সর্বত্র সীতাকে রক্ষা করো। তুমি আগে চল, সীতার পশ্চাতে আমি থাকব।” যমুনার উত্তর তীরে প্রয়াগের নিকটে।


সন্ধ্যা বন্দনার পর রাম লক্ষ্মণের কাছে মনের দুঃখ জানাচ্ছেন : “ভূমি উৎকণ্ঠা প্রকাশ করো না, আমাদের এই ভাবে প্রতি রাত্রিই জেগে কাটাতে হবে। আমার আশঙ্কা, কৈকেয়ী পিতার প্রাণহানি করতে পারেন। পিতার অত্যধিক দুর্বলতার জন্যই আমাদের এই দুর্গতি। 

 

এখন মনে হয় সংসারে ধর্ম ও অর্থ অপেক্ষা কামই প্রবল। মহারাজের কামাসক্তির জন্যই তিনি আমাকে ত্যাগ করেছেন। কৈকেয়ীই সব দুঃখের মূল। তিনি আমাদের দুই মাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করতে পারেন। আমার মনে হয় ভাই, তুমি আগামী কালই অযোধ্যায় গমন কর। 

 

আমার জননীর মতো কোন নারী যেন এমন দুঃখ ভোগ না করে। আমার জন্যই তাঁর এত দুঃখ। আমি ক্রোধ প্রকাশ করলে একাই পৃথিবী জয় করতে পারি। শুধু অধর্মের ভয়ে আমি তা করতে চাই না।” (২।৫৩।৬-২৫)


তাঁর নির্দেশে পরদিন তাঁরা এলেন চিত্রকূটে (বর্তমানে উত্তরপ্রদেশে বান্দা জেলা)। আজ অরণ্য যাত্রার পঞ্চম দিন। কাঠের ভেলা তৈরী করে তাঁরা পার হলেন যমুনা।


পরদিন প্রাতে তাঁরা চিত্রকূটে বাল্মীকির আশ্রমে এলেন। লক্ষ্মণ একটি কুটির নির্মাণ করলেন। গৃহ প্রবেশের দিন বাস্তু দেবতার পূজা করলেন রাম। শুভ মুহূর্তে গৃহে প্রবেশ করলেন। বোধ হয় এটা বনবাসের সপ্তম বা অষ্টম দিন। এই পর্বতের সৌন্দর্য দেখে রাম-সীতা মুগ্ধ। তাঁরা অযোধ্যার চেয়ে সুখেই আছেন। (২।৯৫(১৭)


প্রায় পাঁচ সপ্তাহ কেটে গেছে। হঠাৎ তাঁরা দেখলেন, ভরত আসছেন সৈন্যসামন্ত নিয়ে। তা দেখে লক্ষ্মণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ। তাঁর বিশ্বাস, ভরত আসছেন মন্দবুদ্ধির বশে। অতএব তাঁকে বধ করা প্রয়োজন। লক্ষ্মণের মুখে এ কথা শুনে রাম তাঁকে বলেন : “ভাই, হত্যা করে যা লাভ হয় তা তো বিষ। তোমাদের সুখের জন্য আমার রাজ্যলাভ। 

 

অধর্মের মাধ্যমে আমি ইন্দ্ৰত্বও চাই না। ভরত কোন দিন আমাদের দুঃখের কারণ হননি, কাজেই তাঁকে সন্দেহ করা উচিত নয়। তোমার যদি রাজ্য ভোগের বাসনা থাকে তাহলে আমার আজ্ঞায় ভরত তোমাকে রাজ্য দেবে।" রামের এই কথায় লক্ষ্মণ অত্যন্ত লজ্জিত হলেন। 

 

কিছুপরেই চীরধারী ভরত ও শত্রুঘ্ন রামের সম্মুখে এলেন। রামের প্রশ্নের উত্তরে ভরত জানালেন—পিতার দেহত্যাগের সংবাদ। রাম মন্দাকিনী নদীতে পিতৃতর্পণ করে তিন মাকেই প্রণাম জানালেন। রামকে অযোধ্যায় ফেরানোর জন্য ভরতের ক্রন্দন ও প্রার্থনা এবং বশিষ্ঠ প্রভৃতি গুরুজনদের অনুরোধ সবই ব্যর্থ হল। অবশেষে বশিষ্ঠের উপদেশানুসারে রামের পাদুকা নিয়ে অযোধ্যায় ফিরে গেলেন ভরত।


এরপর রাম আবার স্থান পরিবর্তন করলেন। তাঁরা এক রাত্রি অত্রি মুনির আশ্রমে থেকে দণ্ডকারণ্যে প্রবেশ করলেন। এখানেই তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধে বিরাধ নামে রাক্ষসের মৃত্যু হয়। বিরাধই তাঁদের বলেন শরভঙ্গ মুনির আশ্রমে যাবার জন্য। 


এরপর তাঁরা এলেন শরভঙ্গ মুনির আশ্রমে। দেবরাজ ইন্দ্র তখন সেখানে ছিলেন। রামের আসার পূর্বেই তিনি অদৃশ্য হলেন। রাবণ বধের পর তিনি রামের সঙ্গে দেখা করবেন, এই কথা মুনিকে বলে গেলেন। রামকে দেখার জন্যই মুনি ইন্দ্রের সঙ্গে স্বর্গে যান নি। রামকে সুতীক্ষ্ণ মুনির নিকট যাবার কথা বলেই তিনি রামের সামনেই দেহত্যাগ করলেন। ঠিক একই ভাবে রামকে দর্শন করে আনন্দিত হয়ে সুতীক্ষ্ণ মুনি রামের সামনেই দেহত্যাগ করেন।


সুতীক্ষ্ণ মুনির আশ্রম থেকে তাঁরা চলেছেন প্রাতে। এই সময় সীতা— রাম ও লক্ষ্মণের বিপদের আশঙ্কা করে রামকে বলেন, নিরপরাধ দস্যুদের হত্যা না করতে। রাম তপস্বীদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁদের বিপদ থেকে মুক্ত করবেন। সেজন্য তিনি বৈদেহীর প্রার্থনা পূরণ করতে পারেননি। আর্ত শরণাগত হলে তাকে রক্ষার জন্য অস্ত্রধারণ করাই হল ক্ষাত্রধর্ম।


এপর্যন্ত এঁরা পরম আনন্দেই ছিলেন। বিভিন্ন আশ্রমে বিভিন্ন ভাবে এঁদের দিন কেটেছে। এঁদের এখন সর্বসমেত বনবাসের কাল দশ বছর অতিবাহিত হল।(৩।১১।২৭) এঁরা আশ্রমগুলিতে বা নিজেদের কুটিরে কোথাও বেশীদিন থাকেননি। তাঁরা আবার সুতীক্ষ্ণের আশ্রমে ফিরে এসেছিলেন, বোধ হয় দু-বছরের বেশী ছিলেন এখানে। 

 

কিছুক্ষণ চিন্তা করে তিনি পঞ্চবটীর নাম উল্লেখ করলেন। মুন ও রাম দুজনেই আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন অগস্ত্যের আশ্রমে থাকার জন্য। অগস্তা কিন্তু জানতে রামের ভাগ্যে কি আছে। বিধিলিপি অন্যরূপ। তাই গোদাবরীতীরে পঞ্চবটীতে এঁরা গেলেন। (বোধ হয় বর্তমানে নাসিকের নিকট পঞ্চবটী অবস্থিত ছিল।) পথে জটায়ুর সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়। ইনি দশরথের সখা, তাই রাম তাকে সম্মান দেখিয়ে পঞ্চবটীতে থাকার জন্য অনুরোধ করেন। উদ্দেশ্য—দুই ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে ইনি সীতাকে রক্ষাকরবেন। 

 

সীতা হরণ

 

রাম, সীতা ও লক্ষ্মণের জীবনে এবার শুরু হল দুর্ভাগ্যের দিন— যা তাদের জীবনকে ভবিষ্যতে একেবারে বিষময় করে তুলবে।

একদিন রাবণের ভগিনী শূর্পণখা রাম-লক্ষ্মণের নিকটে কামার্তা হয়ে উপস্থিত হল। রামের আদেশে লক্ষ্মণ তার নাক ও কান কেটে দিলেন। সেইজন্যই এই স্থানের নাম নাসিক। পঞ্চবটীর নিকট জনস্থানে গিয়ে শূর্পণখা তার ভাই খর ও দূষণকে সব বলায় তারা চৌদ্দ সহস্র রাক্ষস সৈন্য নিয়ে রাম-লক্ষ্মণকে আক্রমণ করলে রাম তাদের অনায়াসে বধ করেন।

 

এবার শূর্পণখা গেল লঙ্কায় রাবণের কাছে। রাবণ এলেন জনস্থানে, মায়াবী সন্ন্যাসী মারীচের আশ্রমে। রাবণ মারীচকে বললেন : “মায়মৃগরূপে তুমি সীতার মন হরণ করলে, আমার সুবিধা হবে সীতাকে হরণ করতে।” মারীচ রামের মাহাত্ম্য কীর্তন করে। রাবণকে এই হীন কাজ করতে নিষেধ করলেন এবং বললেন এতে রাবণের নিশ্চিত সর্বনাশ হবে। 

 

একথা শুনে রাবণ ফিরে গেলেন লঙ্কায়। আবার বোনের অনুরোধে এলেন মারীচের আশ্রমে। মারীচের উপদেশ রাবণ গ্রহণ করেননি। তিনি প্রাণের ভয় দেখিয়েছেন মারীচকে। মারীচ রাবণের ইচ্ছানুসারে কাজ করে রাবণকে সীতা হরণে সাহায্য করেন।

 

লক্ষ্মণের উপদেশ সীতা ও রাম উভয়েই অগ্রাহা করে বিধির বিধানে মায়ামৃগের জন্য প্রলুব্ধ হন। মায়ার অচিন্তনীয় শক্তি। “বলাৎ আকৃষ্য মোহায় মহামায়া প্রযচ্ছতি।" (চণ্ডী, ১।৫৫) রাম ও লক্ষ্মণের জীবনে এল ভীষণ দুর্যোগ। রাম লক্ষ্মণকে মৃদু তিরস্কার করলেন তাঁর আদেশ অমান্য করার জন্য। মায়ামৃগের সন্ধানে দুই ভাই প্রবৃত্ত হলে দুরাচারী রাবণ সীতাকে হরণ করেন। 

 

ফিরে এসে তাঁরা সীতাকে দেখতে না পেয়ে তন্ন তন্ন করে চারদিক খুঁজতে লাগলেন। সীতার বিরহে রামের বিলাপে বনের জীবজন্তু ও প্রকৃতি পর্যন্ত বিষণ্ণ। লক্ষ্মণ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছেন।

 

জনস্থানে সীতা অন্বেষণের সময় তাঁরা দেখা পেলেন জটায়ুকে, সব জানলেন তাঁর কাছে। রাবণের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত জটায়ু মারা গেলে রাম অত্যন্ত দুঃখ পেলেন। তাঁর সৎকার করেন রাম-লক্ষ্মণ।

 

এবার তাঁদের যুদ্ধ হয় কবন্ধের সঙ্গে। মৃত্যুর আগে কবন্ধই বলেন, সুগ্রীবের সহায়তায় সীতা উদ্ধারের উদ্যোগ নিতে। রামের হাতে মৃত্যুতে কবন্ধের শাপমুক্তি ঘটে। তিনি শবরীর কথাও রামকে বলেন। পম্পাতীরে শবরীর আশ্রমে রাম উপস্থিত হন। 

 

শবরী পুণ্যে ও তপস্যায় রামের সম্মুখেই চিতানলে দেহত্যাগ করে স্বর্গে গেলেন। ওখানকার মুনিদের আশ্বাসেই তপস্বিনী শবরী দীর্ঘকাল কঠোর তপস্যা করে রামের দর্শন পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন।

 

সুগ্রীবের সঙ্গে রাম-লক্ষ্মণের বন্ধুত্ব হয়। কবন্ধের উপদেশ মতো কাজ করে সুগ্রীবের সাহায্যে রাম সীতাকে উদ্ধার করেন। সুগ্রীবের সৈন্যসামন্ত নিয়ে রাম শুভদিনে যুদ্ধের জন্য যাত্রা করলেন। রাম হনুমানের কাঁধে আর লক্ষ্মণ অঙ্গদের কাঁধে চড়ে এলেন সমুদ্রতীরে। মাত্র পাঁচদিনে সুগ্রীবের অন্যতম মন্ত্রী ও স্থপতি নল সমুদ্রের উপর সেতু বাঁধলেন। 

 

হনুমানের পিঠে রাম আর অঙ্গদের পিঠে চড়ে লক্ষ্মণ সেতু পার হলেন। রাম সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে অঙ্গদকে পাঠালেন রাবণের নিকট। শর্ত ছিল– (১) সীতাকে প্রত্যর্পণ ও (২) ক্ষমা প্রার্থনা। নচেৎ যুদ্ধ। দৌত্য ব্যর্থ হল।

 

যুদ্ধের প্রথম রাত্রিতেই ইন্দ্রজিতের নাগপাশে রাম ও লক্ষ্মণ সর্পরাণে আহত হয়ে অচৈতন্য হলেন। বানর সৈন্যরা বিচলিত। বিভীষণের আশ্বাসে তাদের মনোবল ফিরে এল। কিছু পরে রাম মূর্ছা থেকে জাগরিত হলেন। গরুড়ের সাহায্যে লক্ষ্মণও সুস্থ হলেন। গরুড়ের স্পর্শে দুই ভাইয়ের দেহের ক্ষত চিহ্নগুলি সব মিলিয়ে গেল। 

 

তাঁদের দেহের লাবণ্য ও শক্তি দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেল। যুদ্ধে রাক্ষস বীরদের মৃত্যুতে এবার স্বয়ং রাবণ এলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। সুগ্রীব, লক্ষ্মণ, হনুমান ও নীলের সঙ্গে প্রথমে তাঁর যুদ্ধ চলে। পরে রামের আহ্বানে তিনি আসেন রামের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। রামের পরাক্রমে রাবণ বিস্মিত। তিনি ক্লান্ত বলে রাম তাঁকে বিশ্রাম নেবার উপদেশ দেন।

 

পরের দিন রামের হাতে কুম্ভকর্ণের মৃত্যু হয়। আবার ইন্দ্রজিতের ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগে রাম, লক্ষ্মণ ও অন্যান্য বানর সেনাদের সংজ্ঞা লোপ পায়। জাম্বুবানের উপদেশে হনুমান হিমালয় থেকে আনেন দিব্য ঔষধ। এর প্রয়োগে সকলে সুস্থ হন।

 

একদিন ইন্দ্রজিতের সঙ্গে যুদ্ধে দুই ভাই অত্যন্ত বিচলিত হন। তাঁদের দেহ রক্তাক্ত এবং অগণিত বানর সৈন্য হতাহত হয়। ইন্দ্রজিৎ মায়াবলে অদৃশ্য হয়ে যুদ্ধ করেন। সে সময় লক্ষ্মণ ইন্দ্রজিতের উপর ক্রোধ প্রকাশ করে রামকে বলেন, তিনি ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে সকল রাক্ষসকে বধ করতে চান। তার উত্তরে রাম বলেন: “একজনের দোষের জন্য পৃথিবীর সমস্ত রাক্ষসকে বধ করা উচিত নয়। যুদ্ধে নিবৃত্ত, পলায়মান, শরণাগত, অঞ্জলিবদ্ধ অথবা মত্ত শত্রুকে বধ করা বিধেয় নয়।"  


ইন্দ্রজিতের মায়া-সীতা বধে রাম শোকে অভিভূত। বিভীষণের আশ্বাসে তিনি শোক ত্যাগ করেন। ইন্দ্রজিৎকে বধের জন্য লক্ষ্মণ ও বিভীষণ যাত্রা করেন এবং লক্ষ্মণ তাঁকে বধ করেন।

 

এবার রাবণ পুনরায় এলেন যুদ্ধে। রাম রাবণকে প্রথমেই বধ করতে পারতেন কি রাবণের যুদ্ধে অসামর্থ্যের জন্য তিনি যুদ্ধে বিরত হন। (৬।১০৩।২৮) পরে অগস্থ্যের দেওয়া আদিত্য-হৃদয় মন্ত্র জপ করে রাম যুদ্ধ শুরু করেন। শেষে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগে রাবণকে। বধ করেন।

 

রাম বিভীষণকে লঙ্কার সিংহাসনে বসিয়ে হনুমানকে নির্দেশ দেন, বিভীষণের অনুমতি নিয়ে সীতাকে এই বিজয়ের বার্তা জানানোর জন্য। পরে সীতাকে আনা হল রামের সম্মুখে।

সীতাকে দেখে রাম বজ্রকঠোর কণ্ঠে কিছু অপমানকর উক্তি করেন। কেউ তাঁর প্রতিবাদ

করতে সাহস না করলেও সীতা সমুচিত উত্তর দিয়েছেন।

 

রামকে কিছুদিন লঙ্কায় থাকার জন্য প্রার্থনা করেন বিভীষণ। রাম ভরতের জন্য সত্বর অযোধ্যায় ফিরতে চান। বিভীষণের প্রদত্ত পুষ্পক-বিমানে রাম লজ্জমানা সীতাকে ক্রোড়ে নিয়ে লক্ষণ, বিভীষণ ও সুগ্রীবাদিসহ অযোধ্যার উদ্দেশে যাত্রা করেন। সীতার অনুরোধে কিষ্কিন্ধ্যায় বিমান নামানো হয় এবং বানরপত্নীগণও বিমানে চড়ে অযোধ্যায় যান।

 

প্রথমে ভরদ্বাজ আশ্রমে রাম অবতরণ করেন। রাম হনুমানকে আদেশ দেন ওহুককে এই সংবাদ দিয়ে নন্দীগ্রামে ভরতকে বনবাসের “সব বার্তা” জানাতে। তিনি আরও বলেন, কথা বলার সময় লক্ষ্য রাখবে ভরতের মনে ও দেহে কী প্রতিক্রিয়া হয়। ভরতের প্রতি রামের সন্দেহ ছিল। রামের বনবাসের কাল পূর্ণ হয়েছে।

 

হনুমান মানুষের বেশে নন্দীগ্রামে যান এবং ভরতকে সব বলেন। কিন্তু সীতার অগ্নিপরীক্ষার কথা বলেননি। রাম পুষ্যানক্ষত্রে নন্দীগ্রামে আসেন। ওখান থেকে স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে দিব্যরথে চড়ে অযোধ্যায় উপস্থিত হন।

 

রামের রাজ্যাভিষেক সুসম্পন্ন হল। অতিথিগণ বিদায় নিয়ে নিজ নিজ আবাসে ফিরে গেলেন। রাম রাজকার্যে মনোনিবেশ করেছেন। দিনের প্রথম ভাগে পূজা-আরাধনা, রাজকার্য ও গুরুসেবা ইত্যাদি করেন, আর অপরাহ্ণে অন্তঃপুরে সীতার সঙ্গে অশোকবনে কাটান। সীতার জীবনে এই একটি বছর কেটেছে পরম আনন্দে এবং শান্তিতে। অশোকবনে রাম ও সীতার জীবনের সুন্দর আলেখ্য বর্ণিত হয়েছে রামায়ণে। (৭।৪২।১৭-২২)

 

আবার এল বিরহের দিন। এক ব্যাধের নিষ্ঠুর শরাঘাতে চিরদিনের জন্য ধ্বংস হয়ে গেল দম্পতির শান্তির নীড়। সীতার নামে আবার সেই মিথ্যা অভিযোগ ছড়াল। জনরবে রাম অত্যন্ত বিচলিত হয়ে সীতাকে ত্যাগ করলেন। লোকনিন্দার ভয়ে রাম নিজেই নিজের জীবনকে বঞ্চিত করলেন। 

 

সীতার জন্য আমাদের প্রাণ কাঁদে, কিন্তু রাম প্রজানুরঞ্জক রাজা হিসাবে যা কর্তব্য বলে মনে করেছেন তার জন্য নিজেকেও বলি দিয়েছেন। তাঁর জীবনে ছিল একপত্নী ব্রত। সীতার ধ্যান করেই বাকি সুদীর্ঘ জীবন কাটিয়ে তিনি ধর্ম পালনের এক শ্রেষ্ঠ আদর্শ মানুষের জন্য রেখে গেছেন।

 

রাম এক বৎসরব্যাপী অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছেন মহা সমারোহে—গোমতী নদীর তীরে নৈমিয়ারণ্যে। রামের আদেশে সীতাকে ঋষি বাল্মীকি যজ্ঞভূমিতে এনে উপস্থিত করলেন। এবার আবার সীতার পবিত্রতার শপথ গ্রহণের প্রস্তাবে সীতা নিজের মায়ের কাছে— মাটির নিচে চিরতরে চলে গেলেন। 

 

রাম সীতার বিরহে সাময়িকভাবে অত্যন্ত মুহ্যমান হয়ে পড়েন। এরপর বারো বছর কেটেছে। আরও অন্যান্য অনেক যজ্ঞ তিনি করেছেন এবং প্রতিবারে সীতার স্বর্ণমূর্তিই স্থাপন করেছেন যজ্ঞস্থলে।

 

এর কিছুদিন পর কালের কাছে প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে রাম লক্ষ্মণকে বর্জন করেন। পরে রাম নিজেও মহাপ্রস্থানে যান। সূক্ষ্ম বস্ত্র পরিধান করে দুই হাতের অঙ্গুলিতে কুশ ধারণ করেন। বেদমন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে তিনি পদব্রজে যান তিন মাইল পথ সরযু অভিমুখে। নদীতে অবতরণ করে বৈষ্ণবতেজে তিনি চিরতরে বিলীন হলেন।

 

মানবরূপে রাম মর্তে লীলা করেছেন মাত্র ঊনসত্তর বছর একমাস কুড়ি দিন। [বারো বছর বয়সে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে তাড়কাবধের উদ্দেশ্যে যাত্রা, তেরো বছর বয়সে বিবাহ, অযোধ্যায় বারো বছর এবং বনবাসে চৌদ্দ বছর কাল যাপন— মোট ঊনচল্লিশ বছর। 

 

সিংহাসনে বসেন ঐ বয়সে। তারপর ত্রিশ বছর একমাস দশ দিন রাজত্ব করে মহাপ্রস্থান করেন।] (রামায়ণের চরিতাবলী – সুখময় ভট্টাচার্য্য, পৃঃ ১২৩ দ্রষ্টব্য)

 

বাল্মীকির রামায়ণে রামের মহাপ্রস্থানের যে দৃশ্য আছে তা ভারতের ইতিহাসেই সম্ভব। মহাকাব্যের শেষ হল বিচ্ছেদে নয়—এক পরম শান্তিতে। সকল কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে, সকল মিলন-বিচ্ছেদের পারে যে দিব্য প্রশান্তি, দেহবোধহীন আত্মরতি, জ্যোতির্ময় দিব্যসত্তা, সেখানেই চলে গেলেন রাম, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন এবং অসংখ্য অনুচর। কারো মনে ছিল না বিষাদ, জীবনের পূর্ণতায় সকলের ছিল এক দিব্য-আনন্দ ও অপার শান্তি।

 

এই আমাদের চিরপরিচিত রাম। বাল্মীকি-রামচন্দ্র বা রামভদ্র শব্দ ব্যবহার করেন নি। রাম ও কৃষ্ণকে নিয়ে ভারতের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। উত্তর ভারতে তুলসীদাসের রামায়ণ আজও প্রায় প্রতি গৃহেই পঠিত হয়। রামের চরিত্র ভারতবাসীকে মুগ্ধ করেছে চিরদিনের জন্য। 

 

তাঁর শৌর্য-বীর্য, ক্ষমা, আশ্রিত-বাৎসল্য, পিতৃভক্তি, ভ্রাতৃপ্রেম, পত্নীপ্রেম, বন্ধুপ্রীতি, প্রজানুরঞ্জন, তাঁর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি অনুরাগ, তাঁর ধর্মপালনে সর্বপ্রকার ত্যাগ প্রভৃতি গুণের জন্য তাঁর চরিত্র আমাদের এত প্রিয়। সীতাকে তিনি ত্যাগ করেননি। তাঁর ধর্ম প্রজাপালন। তিনি সর্বস্ব ত্যাগ করে সর্বস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে তা পালন করেছেন।

 

লোকের কাছে আদর্শ নৃপতির দৃষ্টান্ত রেখেছেন সীতাকে ত্যাগ করে। কিন্তু লোকনিন্দাকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে, স্বর্ণসীতা নির্মাণ করে সীতার পবিত্রতার কথা জগতে অকুণ্ঠিত চিত্তে ঘোষণা করেছেন। এইভাবে তিনি জনমতের প্রতিবাদ করেন। রাম নামে মানুষের মুক্তি। রাম আমাদের হৃদয়ের চির উজ্জ্বল মণি, জীবনের ধ্রুবতারা ও মরণের সাথী।


আরও পড়ুন

 * রাম বন বাসে যাওয়ার ৩ টি রহস্য 

 * সীতা অপহরণের গুপ্ত কথা  

* বালী বধ ন্যায় নাকি অন্যায় 



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url