নিরামিষ খাবার কি? নিরামিষ খাওয়ার উপকারিতা
নিরামিষ খাবার বেশি পুষ্টিকারক উপকারিতা ও গুণসম্পন্ন
আধুনিকতাবশতঃ নিজ সংস্কৃতি, আচার-বিচার, ব্যবহার সব কিছুকে জলাঞ্জলি দেওয়া ব্যক্তিদের মিথ্যাধারণা হল যে শাকাহারে উচিত মাত্রায় প্রোটিন বা শক্তিবর্ধক পুষ্টি প্রাপ্তি হয় না। কিন্তু এটি ঠিক নয়।
আধুনিক বৈজ্ঞানিকদের গবেষণায় জানা যায় যে, নিরামিষ খাদ্যে শুধু যে উচ্চশ্রেণীর প্রোটিন প্রাপ্ত হয় তাই নয়, নিরামিষ খাওয়ার অনেক উপকারিতা রয়েছে, এমনকি অন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ, ক্যালোরী ইত্যাদিও বেশি মাত্রায় পাওয়া যায়। সোয়াবীন, চিনাবাদাম ইত্যাদিতে মাংস বা ডিমের থেকে বেশি প্রোটিন থাকে।
সাধারণ ডালেও প্রোটিনের মাত্রা কম থাকে না। গম, চাল, জোয়ার, বাজরা, ভুট্টা ইত্যাদির সঙ্গে উপযুক্ত পরিমাণে ডাল এবং সবুজ সবজী আহার করলে শুধু যে প্রোটিনের প্রয়োজন পূর্ণ হয় তাই নয়, এর দ্বারা সম্পূর্ণ ব্যালান্স খাদ্য প্রাপ্তি হয়, যা নিরামিষাশী ব্যক্তিকে আমিষাশী থেকে বেশি সুস্থ, নীরোগ এবং দীর্ঘায়ু প্রদান করে।
মাংসের নিজস্ব কোন স্বাদ নেই, তাতে তেল, ঝাল, মশালা আদি মেশালে তবেই সেটির স্বাদ হয় কিন্তু ফল, সবজী, মেওয়া ইত্যাদির স্বতন্ত্র নিজস্ব স্বাদ রয়েছে এবং মশলাপাতি ছাড়াও তা খাওয়া যায়।
পশুজগতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে, যেসব পশু সর্বাধিক শক্তিশালী, পরিশ্রমী এবং অধিক সহনশীল এবং বেশিদিন একনাগাড়ে কাজ করতে পারে, যেমন হাতি, ঘোড়া, বলদ, উট ইত্যাদি, এগুলি সবই শাকাহারী। ইংল্যাণ্ডে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, স্বাভাবিক মাংসাহারী শিকারী কুকুরকেও যখন নিরামিষাশী করে রাখা হয়, তখন তার সহ্যশক্তি ও ক্ষমতা বাড়ে।
এভারেষ্ট বিজয়ী তেনজিৎ শেরপাদের শক্তির রহস্য নিরামিষাশী হওয়া বলেই জানিয়েছেন। বহু আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়ও আমিষ খাদ্য পরিত্যাগ করে নিরামিশাষী হচ্ছেন।
বহু
গবেষক জানিয়েছেন নিরামিষাশী মানুষ বেশি সহনশীল, শক্তিশালী, পরিশ্রমী,
শান্তস্বভাবযুক্ত এবং মিষ্ট স্বভাবের হয়। তারা অধিক সময় ক্ষুধা সহ্য করতে
এবং উপবাস করার ক্ষমতা রাখে।
নিরামিষ বনাম আমিষ আহার
যদিও জগতে বহু লোক আমিষ আহার করেন, কিন্তু চিন্তা করলে এই কথাই প্রমাণিত হয় যে আমিষ আহার সর্বতোভাবে ক্ষতিকর। এর দ্বারা ইহলোক-পরলোক দুই-ই নষ্ট হয়। বহু লোক এমন আছেন, যাঁরা আমিষ খাদ্য ক্ষতিকারক জেনেও কু-অভ্যাসের বশবর্তী হওয়ায় এটি ত্যাগ করতে পারেন না।
কিছু লোক আবার আরাম ও ভোগাসক্তির বশীভূত হয়ে আমিষ খাওয়া সমর্থন করেন। কিন্তু আমিষ খাদ্য থেকে উৎপন্ন হওয়া দোষের কোনো সীমা নেই। হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রীষ্টান, জৈন, বৌদ্ধ আদি বিশ্বের সমস্ত বিশিষ্ট ধর্মের প্রচারক এবং মহাপুরুষগণ হিংসা, ক্রূরতা, অসত্য, ক্রোধ, দ্বেষ এবং অন্য জীবদের অকারণ কষ্ট বা পীড়া দেওয়াকে অপরাধ বলেছেন এবং অহিংসা, দয়া, ক্ষমা, সত্য, করুণা ইত্যাদিকে ধর্ম বলে জানিয়েছেন।
তাঁদের প্রধান শিক্ষা হল প্রাণীমাত্রেই সেই পরম পিতারই প্রকাশ দেখে সকলের সঙ্গে সুব্যবহার করা। এই সকল মহাপুরুষগণ শুধুমাত্র আমিষ আহারের নিন্দাই করেননি, তাঁরা সমস্ত জীব-জন্তু, পশু-পক্ষীদের প্রতি দয়া এবং করুণাপূর্ণ ব্যবহারের শিক্ষাপ্রদান করেছেন এবং খাদ্য ইত্যাদি দ্বারা তাদের জীবন-রক্ষা করাকে শুভকর্ম বলেছেন।
প্রকৃতি যেখানে মানুষের আহারের জন্য নানাবিধ বনস্পতি এবং স্বাদু পদার্থ উৎপন্ন করেছে, সেই প্রকৃতিই আবার মানুষের সেবা ও সহায়তার জন্য বিভিন্ন পশু-পক্ষীর সৃষ্টি করেছে। এই পশু-পক্ষী একদিকে যেমন প্রাকৃতিক ভারসম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে অন্যদিকে মানুষের সামান্য দয়া ও ভালোবাসা পেয়ে তারা মানুষের থেকেও বেশি প্রভু ভক্ত ও বিশ্বাসভাজন হয়ে জীবন দিয়ে তাদের সেবা করে।
সেই মানব, প্রকৃতি যাদের শরীরের গঠন মাংসাহারী প্রাণীদের মতো না করে নিরামিষাশী প্রাণীদের মতো করেছেন, তারা যদি প্রকৃতি, ধর্ম ও মহাপুরুষদের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে আমিষ ভক্ষণ করে, তাহলে সেটি হবে তাদের পক্ষে অত্যন্ত কৃতঘ্নতা ও দুষ্কর্ম।
জগতের সমস্ত জীব-জন্তু আমাদেরই মতো পরম পিতার সন্তান। সেই পরম পিতা কি তাঁর এক সন্তানের দ্বারা অন্য সন্তানের অকারণ হত্যা সহ্য করবেন ? না, কখনই নয়। কর্মের অবশ্যই ভোগ করতে হবে। শুভ বা অশুভ কোনো কর্ম কখনই বৃথা যায় না, তার পুরষ্কার বা শাস্তি আগে বা পরে অবশ্যই পেতে হয়। এ অতি নিশ্চিত ও অটল সত্য।
আমিষ আহারের কুফল সুবিদিত। এখন বিশ্বের সকল দিক্ থেকে বৈজ্ঞানিক এবং ডাক্তারেরা সতর্ক করছেন যে, আমিষ আহার ক্যান্সার ইত্যাদি দুরারোগ্য ব্যাধি দ্বারা আয়ু ক্ষীণ করে এবং নিরামিষ আহার অত্যন্ত পুষ্টিদায়ক এবং রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে ; তা সত্ত্বেও মানুষ যদি অন্ধের মতো আধুনিকতার নকল করতে গিয়ে আমিষ খাদ্য ভক্ষণ করে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে, তবে সেটি তার দুর্ভাগ্য ছাড়া অন্য কিছু নয়।
পশুকে হত্যা করার আগে তার শরীরের রোগ সম্বন্ধে কোনো পরীক্ষা করা হয় না, তাই তার শরীরের সম্ভাব্য রোগ আমিষ খাদ্য ভক্ষণকারী ব্যক্তির দেহে প্রবেশ করে। ভয়াবহ পরিবেশে অন্যান্য পশুদের সামনেই ভীষণ কষ্ট ও যন্ত্রণা দিয়ে প্রতিটি পশুকে হত্যা করা হয়।
তার ফলে দুঃশ্চিন্তা (টেনশন), ভয়, ক্রোধ, আতঙ্কে পশুর রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় এবং দেহে এ্যাডরিন্যালিন (Adrenalin) নামক পদার্থের সৃষ্টি হয়, তাতে তার মাংস বিষাক্ত হয়ে ওঠে। সেই বিষাক্ত, রোগগ্রস্ত মাংস আমিষ আহারীর শরীরে প্রবেশ করে তাকে নানা অসাধ্য রোগে আক্রান্ত করে আর সেই পশুটির মৃত্যুর মুহূর্তে করা শপথ যে ‘তুমি যেমন আমাকে খাবে, আমিও তোমায় তেমনভাবে খাব', পূর্ণ করে।
আমিষাশী বন্ধুগণ ! দয়া করে পরের বার আমিষ খাদ্য গ্রহণের পূর্বে একবার মুরগী পালন কক্ষে গিয়ে এই মূর্ক প্রাণীদের ওপর কীভাবে অত্যাচার করে তাদের বধ করা হয়, সেই অত্যাচার—তাদের দুঃখ-কষ্ট, তাদের হত্যা করার পদ্ধতি দেখে, খাবার সময় সেগুলি চিন্তা করবেন এবং নিজেদের অন্তরাত্মাকে জিজ্ঞাসা করবেন যে, আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মানবত্বের কী এই পরিচয় যে, আমরা শুধু নিজেদের রসনার স্বাদের জন্য এইসব নিরপরাধ প্রাণীদের জীবন চিরকালের জন্য ছিনিয়ে নিই, যা আমরা কখনোই তাদের ফিরিয়ে দিতে পারি না ?
প্রিয় বন্ধুগণ ! কৃপা করে নিজেদের লাভ ও ক্ষতির বিষয় চিন্তা করুন। আমিষ খাদ্য পুষ্টির পরিবর্তে শরীরে অসাধ্য রোগের সংক্রমণ করে আয়ু হ্রাস করে ; মন, বুদ্ধি ইত্যাদি দূষিত করে সুখ-শান্তি নষ্ট করে এবং আমাদের নৈতিক ও চারিত্রিক অধঃপতন ঘটায়।
এটি শুধু আমাদের অনাগত বংশকে অসাধ্য রোগাক্রান্ত করে তাই নয়, এটি আমাদের অপার দুঃখ-কষ্টেও ফেলে দেয়। নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তানকে মাংসাহার জনিত অসুখ, হৃদরোগ, ক্যান্সার এবং অন্য সামাজিক দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে রক্ষার জন্য আজই আমিষ খাদ্য পরিত্যাগ করুন। ভুল শোধরানোর জন্য যে কোনো মুহূর্তই উত্তম। শাস্ত্র অনুসারে ‘আমিষ খাদ্য পরিত্যাগকারীর যজ্ঞকারীর মতো ফল লাভ হয়।
মানুষের আহার কেমন হবে
মানুষের জীবিত থাকার জন্য বায়ু এবং জলের পর সর্বাধিক প্রয়োজনীয় বস্তু হল আহার। মানুষের আহার্য কেমন হবে, তার উদ্দেশ্য কী, সেটি কী এবং তা কতোটা হবে, তার দিকে লক্ষ্য দেওয়া প্রয়োজন।
মানুষের আহারের উদ্দেশ্য—ভোজনে মানুষের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র উদর পূর্তি, স্বাস্থ্য রক্ষা বা স্বাদ নয়; বরং মানসিক এবং চারিত্রিক বিকাশও তার লক্ষ্য। আমাদের আচার, বিচার, ব্যবহার সবকিছুর সঙ্গেই আহারের গভীর সম্পর্ক আছে। প্রসিদ্ধ উক্তি আছে যে ‘যেমন খাদ্য খাবে, তেমনি মন তৈরি হবে’—আজ একথা সম্পূর্ণ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
মানুষ যেসব পশু পক্ষীর মাংস আহার করে, সেই পশু-পক্ষীর গুণ, আচরণ ইত্যাদি তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়, ফলে তার প্রকৃতিও ক্রমশঃ সেইরূপ হতে থাকে। সেইজন্য সেই ব্যক্তি ইহজন্মেই মনুষ্যোচিত স্বভাব থেকে প্রায়শঃ চ্যুত হয়ে পশুস্বভাবসম্পন্ন, ক্রূর ও অমর্যাদাপূর্ণ জীবন পন করতে থাকে এবং মৃত্যুর পর সেই ধারণার ফলস্বরূপ, আর নিজ কর্মের ফল ভোগ করার জন্য সেই পশু-জন্ম প্রাপ্ত হয়ে মহাদুঃখ ভোগ করে।
পিতামহ ভীষ্ম বলেছেন—
আহার নিরামিষ না আমিষ ? সিদ্ধান্ত নিজেই নিন
যেন যেন শরীরেণ যদ্যৎ কর্ম করোতি যঃ।
তেন শরীরেণ তত্তৎ ফলমুপাশুতে। (মহাভারত, অনুশাসনপর্ব ১১৬।২৭)
‘যে যে শরীরে প্রাণী যেমন যেমন কর্ম করে, সেই সেই শরীর লাভ করে সে তেমন তেমনই ফল ভোগ করে।'
মানুষের বিভিন্ন প্রকারের আহারের প্রতি রুচি তার আচরণ ও চরিত্র প্রকাশ করে। তাই আমাদের আহারের উদ্দেশ্য হবে সেই সব পদার্থ গ্রহণ যা আমাদের শারীরিক, নৈতিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক উন্নতিকারী এবং স্নেহ, প্রেম, দয়া, অহিংসা, শান্তি ইত্যাদি গুণের বৃদ্ধিকারী হয়।
মানুষের আহার কেমন হবে – আহার এমন সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে যাতে শরীরে শক্তি, পুষ্টি এবং উত্তাপ বজায় থাকে ; প্রোটিন, শর্করা, ভিটামিন, খনিজ জাতীয় পদার্থ অনুপান ও পর্যাপ্ত মাত্রায় থাকা প্রয়োজন যাতে শরীরে ভালো ভাবে নতুন কোষ (New Cells) এবং R.B.Cs. তৈরি হয়, কারণ আমাদের শরীরে লক্ষ লক্ষ R.B.C. (Red Blood Corpuscle) প্রতি সেকেণ্ডে ধ্বংস হয় ও উৎপন্ন হয়।
এরূপ অনুমান করা হয় যে ছয় বছরে আমাদের শরীরের সকল কোষাণু (Cells and Tissues) (১) সম্পূর্ণভাবে বদলে যায় অর্থাৎ সাপ যেমন প্রত্যেক ছয় মাসে তাদের চামড়া (Skin) পরিবর্তন করে, তেমনই ছয় বছরে আমাদের শরীরের সমস্ত কোষাণু (Cell and Tissues) সম্পূর্ণভাবে বদলে যায়, যার গুণাগুণ আমাদের খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল।
সেই সঙ্গে আহার্যে এমন পদার্থ থাকা উচিত যাতে শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা এবং শরীরের ময়লা এবং ক্ষতিকারক জিনিষ (toxins) বার করার পথে বাধা না হয়। খাদ্যে রোগ উৎপাদক, স্বাস্থ্যনাশক এবং উত্তেজনাকারী বস্তু যেন না থাকে, কারণ তাতে মানসিক শান্তি নষ্ট হয়ে আবেগের জন্ম দেয় আর মানুষকে অমর্যাদাসম্পন্ন ও উচ্ছৃঙ্খল করে তোলে।
মানুষের খাদ্য কী হবে- প্রকৃতি মানুষের আহারের জন্য নানাপদার্থ আনাজ, ফল, শাক-সব্জী ইত্যাদি উৎপন্ন করেছে, যাতে সর্বপ্রকার পুষ্টিদায়ক বস্তু পর্যাপ্ত মাত্রায় বিদ্যমান।
(৩) প্রকৃতি মানব-শরীর নিরামিষাশী জীবদের মতোই সৃষ্টি করেছেন এই জগতে নিরামিষ ও আমিষ- আহারী জীবদের বহু জাতি এবং অনেক প্রকার ছোট থেকে বড়ো আকারের বিভিন্ন প্রকারের জীব আছে, কিন্তু নিরামিষ খাদ্য গ্রহণকারী জীবদের শরীরের গঠন, হাত, পা, দাঁত ইত্যাদি এবং তাদের দেখার, ঘ্রাণ নেবার শক্তি এবং খাওয়া-দাওয়ার ভঙ্গী মাংসাহারী জীবদের থেকে পৃথক হয়।
যেমন—
১) মাংসাহারী জীবদের নখ ও দাঁত শাণিত হয় যাতে তারা শিকার ধরে কেটে ছিঁড়ে খেতে পারে।
নিরামিষাশী জীবদের দাঁত তত শাণিত হয় না, হাতের থাবার নখও তত তীক্ষ্ণ হয় না যাতে শিকারকে কাটা-ছেঁড়া করা যায়। তাদের দাঁত ও নখ ফল ইত্যাদি খাবার উপযুক্ত হয়ে থাকে।
২) নিরামিষাশী জীবদের নীচের চোয়াল শুধুমাত্র ওপরে-নীচে নড়াচড়া করে এবং তারা খাবার না চিবিয়েই গিলে ফেলে। নিরামিষাশী জীবদের নীচের চোয়াল ওপর, নীচে, ডাইনে, বাঁয়ে—সব দিকেই নড়াচড়া করে এবং তারা খাবার চিবিয়ে খায়।
৩) মাংসাহারী জীবদের জিভ ধারালো (কর্কশ) হয়, তারা জিভ বার করে তার দ্বারা জল পান করে। নিরামিষাশীদের জিভ নরম হয়, তারা জলপান করার জন্য জিভ বার করে না, বরং ঠোঁট দিয়ে জল পান করে।
মাংসাহারী জীবদের অস্ত্র (Intestine) কম লম্বা হয়, সেটি প্রায়শঃ তাদের দেহের দীর্ঘতার সমান লম্বা হয় এবং কোমর থেকে গলা পর্যন্ত দেহাংশের ৬ গুণ লম্বা হয়। অন্ত্র ছোট হওয়ায় মাংস পচন ধরা বা বিষাক্ত হওয়ার আগেই তা শরীর থেকে বার হয়ে যায়।
নিরামিষাশী জীবদের অস্ত্র (Intestine) অধিক লম্বা হয়, সেটি তাদের দেহের দীর্ঘতার চার গুণ ও মূল দেহের থেকে ১২ গুণ বেশি লম্বা হয়, তাই প্রকৃতি মানব শরীর নিরামিষাশী জীবদের মতোই সৃষ্টি করেছেন সেটি মাংসকে শীঘ্র বাইরে ফেলতে পারে না।
(৫) মাংসাহারী জীবদের লিভার ও কিডনী অনুপাতে বড় হয়, যাতে মাংসের অপ্রয়োজনীয় অংশ সহজে দেহ থেকে বার হতে পারে। নিরামিষাশীদের লিভার ও কিডনী ছোট হয়, তা মাংসের অপ্রয়োজনীয় অংশ বাহিরে বের করতে পারে না।
৬) মাংসাহারী জীবদের পাচক যন্ত্রে মানুষের পাচক যন্ত্র থেকে দশগুণ বেশি হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড তৈরি হয়, যাতে মাংস সহজে হজম হয়। নিরামিষাশী জীবদের পাচক যন্ত্রে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড কম তৈরি হয়, তাই মাংস তেমন সহজে হজম হয় না।
৭) মাংসাহারী জীবদের স্যালিভা (মুখের লালা) অ্যাসিডিক (Acidic) হয়। নিরামিষাশীদের মুখের লালা (Saliva) এ্যালকাইন (Alkaline) হয় এবং তাদের লালায় টায়লিন (Ptyaline) থাকায় কার্বোহাইড্রেট্স হজমে সুবিধা হয়।
(৮) মাংসাহারী জীবদের রক্তে PH কম থাকে ফলে তাতে Acidic tendency থাকে। নিরামিষাশীদের রক্তে PH বেশি হয় ফলে সেটির tendency Alkaline মুখি হয়।
৯) মাংসাহারী জীবদের Blood Lipo-Proteins ভিন্ন প্রকারের হয়। নিরামিষাশী মানুষ ও পশুদের ব্লাড লিপো প্রোটিন একই ধরনের হয় এবং মাংসাহারী জীবদের থেকে তা ভিন্ন প্রকারের হয়।
১০) মাংসাহারী জীবদের ঘ্রাণশক্তি তীব্র হয়, রাত্রে তাদের চোখ জ্বলজ্বল করে এবং দিনের মতোই দেখতে পায়। এই শক্তি তাদের শিকার করায় সাহায্য করে। নিরামিষাশী জীবদের ঘ্রাণশক্তি তত তীব্র নয় এবং রাত্রে দিনের মতো দেখার শক্তি থাকে না।
১১) মাংসাহারী জীবদের আওয়াজ কর্কশ ও ভয়ংকর হয়। নিরামিষাশী জীবদের আওয়াজ কর্কশ হয় না।
১২) মাংসাহারী জীবদের বাচ্চারা জন্মের পর প্রায় এক সপ্তাহ দেখতে পায় না।
নিরামিষাশী জীবদের বাচ্চারা জন্মের সময় থেকেই দেখতে পায়। উপরোক্ত তথ্যাদি দ্বারা জানা যায় যে, প্রকৃতি মানুষের সৃষ্টি করেছে। অন্যান্য শাকাহারী জীব তথা গরু, ঘোড়া, উট, জিরাফ, বলদ ইত্যাদি শাকাহারী জীবেদের মতো, তাদের নিরামিষ খাদ্য সহজে প্রাপ্ত করার ও হজম করার ক্ষমতা দিয়েছে।
মানুষ ব্যতীত জগতের কোনো জীব প্রকৃতি প্রদত্ত শরীর ও স্বভাবের বিপরীত আচরণ করতে চায় না। বাঘ-সিংহ ক্ষুধার্ত হলেও শাকাহারী হয় না এবং গরুর ক্ষুধা পেলেও সে মাংসাহারী হয় না, কারণ এসব তাদের স্বাভাবিক বা প্রকৃতি অনুকূল খাদ্য নয়।
মাংসাহারী পশু সারাজীবন মাংসাহার করে, কারণ এই তার খাদ্য। কিন্তু মানুষ শুধু মাংসাহার করে বেশিদিন জীবিত থাকতে পারে না কারণ শুধু মাংস খেলে তার শরীরে এতো বেশি অ্যাসিড এবং টক্সিন উৎপন্ন হবে যে ফলে তার শরীরের সঞ্চালন ক্রিয়া বিকল হয়ে যাবে।
যে ব্যক্তি প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে মাংসাহার করে, তার কিছু না কিছু নিরামিষ আহার করতেই হয়, কারণ শুধুমাত্র মাংসাহার অপূর্ণ খাদ্য এবং তাতে মানুষের আয়ুক্ষীণ হয়। এস্কিমোরা (Eskimos) যে পরিস্থিতিতে প্রায়শঃ মাংসাহার করে থাকে, তাদের গড় আয়ু মাত্র ত্রিশ বৎসর হয়। কিন্তু নিরামিষ খাদ্য গ্রহণকারী মানুষ সুস্থভাবে দীর্ঘায়ু হয়ে থাকে।
(১)জন্স্ হোপকিন্স ইউনিভার্সিটির ডাঃ এলন ওয়াকার দাঁতের Mycroscopic Analysis করে বলেছেন যে, মানুষ নিরামিষাশীদের বংশধর, মাংসাহারীদের নয়।
কোনো ব্যক্তিই ফল, সব্জী, আনাজ দেখে মুখ ফেরায় না, কিন্তু অনেকেই ঝোলানো মাংস দেখে ঘৃণা করে। এটা কি মানুষের স্বাভাবিক শাকাহারী প্রকৃতির দ্যোতক নয় ?
উপরোক্ত সকল তথ্যই প্রমাণ করে যে, প্রকৃতি মানুষকে নিরামিষাশী এবং নিরামিষ খাদ্যেরই অনুকূল করে সৃষ্টি করেছেন।
আমিষ আহার অসুখের জন্মদাতা
আমিষ খাদ্য কত প্রাণঘাতী এবং কত অসাধ্য রোগকে আমন্ত্রণ করে —এই বিষয়ে বড়ো বড়ো ডাক্তার এবং বৈজ্ঞানিকেরা যে প্রবন্ধ লিখেছেন, তা একবার দেখা উচিত।
(1) State University of New York, Buffalo তে করা গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে যে, আমেরিকাতে মাতা-পিতা মাংসাহারী হওয়ায় ৪৭০০০ হাজারের বেশি শিশু প্রতি বছর কোনও না কোনও অসুখ নিয়ে জন্মায় এবং বড় হলেও সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয় না।
(২) 1885 এ নোবেল বিজয়ী আমেরিকান ডাক্তার মাইকেল. এস. ব্রাউন এবং ডাক্তার জোসেফ.এস.গোল্ডষ্টীন প্রমাণ করেছেন যে, হৃদরোগ থেকে বাঁচার জন্য কোলেষ্টেরোলের বৃদ্ধি রোধ করা অতি আবশ্যক, এটি বনস্পতিতে না থাকারই মত। ডিমে এটি সর্বাধিক পরিমাণে থাকে এবং মাংস ও পশু থেকে প্রাপ্ত খাদ্যেও এটি অধিক মাত্রায় থাকে।
যে ব্যক্তি মাংস বা ডিম খায় তার শরীরে ‘রেস্পটরের’ সংখ্যা কম হয়ে যায় যাতে রক্তে কোলেষ্টরেলের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাতে হৃদ্রোগ, কিডনীর অসুখ এবং গলব্লাডারে স্টোন ইত্যাদি রোগের উপসর্গ দেখা দেয়।
বিট্রেনের ডাক্তার এম. রক এক গবেষণার পর জানিয়েছেন যে ‘শাকাহারীদের মধ্যে সংক্রামক এবং প্রাণঘাতী অসুখ মাংসাহারীদের থেকে কম হয়। তারা মাংসাহারীদের থেকে বেশি সুস্থ, শ্রীযুক্ত চেহারাসম্পন্ন, শান্ত প্রকৃতি এবং চিন্তাশীল হয়।'
বি.বি.সির টেলিভিশান বিভাগ প্রচারিত শাকাহারের এক সাপ্তাহিক কার্যক্রমে নিয়মিতভাবে মাংসাহারীদের স্পষ্ট সতর্ক করা হয় যে, আহার নিরামিষ না আমিষ ? সিদ্ধান্ত নিজেই নিন আপনি প্রাণঘাতী রোগের সম্মুখীন হতে পারেন।”
পশ্চিমী দেশে যেখানে মাংসাহার অত্যধিক প্রচলিত, সেখানে হার্ট এ্যাটাক, ক্যান্সার, ব্লাড প্রেশার, মেদবৃদ্ধি, কিডনীর অসুখ, কোষ্ঠ-কাঠিন্য, সংক্রামক ব্যাধি, লিভারের উপসর্গ, স্টোন ইত্যাদি প্রাণঘাতী অসুখ বেশি হয়। অথচ ভারত, জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকা আদি দেশে যেখানে মাংসাহারের প্রচলন কিছুটা কম, সেখানে এই সকল তত বেশি পরিমাণে হয় না।
(১)হুজা নামক জনবসতীর ৯০ থেকে ১১০ সাল পর্যন্ত বয়সের লোকেদের অধ্যয়ন করার পর জানা যায় যে তাদের এতো বেশি বয়স এবং সুস্থ থাকার কারণ হল নিরামিষাশী হওয়া।
গোয়ালিয়রের দুই গবেষক ডা. জসরাজ সিংহ এবং শ্রী. সী. কে. ডবাস গোয়ালিয়র জেলের ৪০০ বন্দীর ওপর গবেষণা করে জানিয়েছেন যে, ২৫০ আমিষাশীদের মধ্যে ৮৫ % খিটখিটে ও ঝগড়াটি স্বভাবের এবং অবশিষ্ট ১৫০ নিরামিষাশী বন্দীর মধ্যে ৯০% শান্ত ও মিষ্ট স্বভাববিশিষ্ট।
(২)আমেরিকার বিশেষজ্ঞ ডা. উইলিয়ম. সী. রবার্টস বলেছেন যে আমেরিকাতে মাংসাহারী লোকেদের মধ্যে হৃদ্রোগীর সংখ্যা অধিক, সেই তুলনায় নিরামিষাশীদের মধ্যে হৃদ্রোগীর সংখ্যা কম।
আমেরিকান ডাক্তারদের আরও বক্তব্য হল যে আমিষ খাদ্যের তুলনায় নিরামিষ খাদ্যে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বেশি থাকে। আমিষাশীদের প্রায়শঃই কোষ্ঠ-কাঠিন্য দেখা যায়, যাতে বহু রোগ স্বতঃই আক্রমণ করে।
(৩) অন্য আরেকটি রিপোর্ট অনুসারে একপ্রকার কীট যাকে Brain Bug বলা হয়, সেটি কামড়ালে পশু পাগল হয়ে যায়। কিন্তু এই রোগ পূর্ণভাবে প্রকাশ পেতে ১০ বছর সময় নিয়ে থাকে। এর মধ্যে যদি কেউ এই পশুর মাংস খায় তবে সেই পশুর গুপ্ত রোগ মাংসাহারীর শরীরে প্রবেশ করে।
সকলেই জানেন যে হত্যা করার আগে পশু-পক্ষী বা মৎস্য ইত্যাদির কোনও প্রকারের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় না এবং তাদের দেহের অসুখের কথাও জানা যায় না। ডিম, পশু, পক্ষী, মৎস্যাদিও ক্যান্সার, টিউমার ইত্যাদি রোগগ্রস্ত হয় এবং তাদের মাংস খেলে মানুষেরও সেই রোগ হওয়ার আশংকা থাকে।
(>) শুধু আমেরিকাতেই 40000 এর বেশি কেস প্রতিবছর পাওয়া যায় যা রোগগ্রস্ত ডিম বা মাংস খেলে হয়।
(2) Health Education Council অনুসারে বিষাক্ত আহারে হওয়া 90% মৃত্যুর কারণ হল মাংসাহার।
পশু যখন কসাইখানায় মৃত্যুর সম্মুখীন হয় তখন সে কেঁপে ওঠে। মৃত্যুকে সম্মুখীন দেখে সেই পশু ২।১ দিন আগে থেকেই খাওয়া বন্ধ করে। ভয়ে তার পায়খানার কিছুটা বেরিয়ে যায়। দেহের মল যখন রক্তের সংস্পর্শে আসে তখন তা বিষাক্ত হয়ে ওঠে।
মাংসে রক্ত, বীর্য, মল, মূত্র ইত্যাদি নানা বস্তুর অংশ থাকে ! মৃত্যুর পূর্বে অসহায় পশু আত্মরক্ষার জন্য ছটফট করতে থাকে। এসব অর্থহীন হয়ে গেলে তার ভয় বৃদ্ধি পায়, রাগে চোখ লাল হয়ে যায়, মুখ দিয়ে ফেনা পড়তে থাকে। এই অবস্থায় তার দেহে Adrenalin উৎপন্ন হয়, যাতে তার রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় এবং তার মাংস বিষাক্ত হয়ে ওঠে।
মানুষ সেই মাংস খেলে তার মধ্যে Adrenalin প্রবেশ করে তাকে প্রাণঘাতী রোগের শিকার করে। Adrenalin এর সঙ্গে যখন Chlorinated Hydrocarbon নেওয়া হয়, তখন সেটি সম্ভাব্য প্রাণঘাতী হার্ট এ্যাটাক করে জীবন সংশয়যুক্ত করে।
মাছ, ডিম ইত্যাদি সংরক্ষণের জন্য Boric Acid বা বিভিন্ন বোরেট্স ব্যবহৃত হয়। এই কম্পাউণ্ডগুলি Cerebal Tissues তে একত্রিত হয়ে গভীর বিপদ উৎপন্ন করে।
সকলেই জানেন যে রক্তে ব্যাকটিরিয়া শীঘ্র বৃদ্ধি পায়। মাংসে রক্ত মিশ্রিত হওয়ায় তাতে Bacteria-র Infection শীঘ্রই বৃদ্ধি পায়। পশুর মৃত্যু হলেই মাংস পচতে শুরু করে এবং শাকাহার পদার্থের তুলনায় তা অতি শীঘ্র পচতে থাকে। এরূপ মাংস—যা মৃতদেহ খাবারই মতো, তা যখন ভক্ষণকারীর শরীরে প্রবেশ করে, তখন সেটি এমন অসাধ্য রোগের জন্ম দেয় যা মাংসাহারীকে অন্তিম সময় পর্যন্ত রেহাই দেয় না। আজ যে মাংস ভক্ষণ করে, কিছুদিন পর সেই মাংসই তাকে ভক্ষণ করে।
কসাইখানার মাংস যে কতো ক্ষতিকারক, দূষিত, রোগগ্রস্ত হয় তা অনুমান করা যায় এই থেকে যে ইউরোপের অত্যাধুনিক, নতুন টেকনিক দ্বারা সঞ্চালিত কসাইখানাকেও স্বাস্থ্যের দৃষ্টিতে আদর্শ বলা হয় না, তখন ভারতের কসাইখানার মাংসের আর কথাই কী!
মাংসাহারের সঙ্গে অসাধ্য রোগের যে সম্পর্ক, তার অনুসন্ধানের পরিণাম কিছুটা এইরূপ— (১)জার্মানীর প্রোফেসর এরবর্গের বক্তব্য হল ডিম 51.83% কফ উৎপন্ন করে। এটি শরীরের পোষক তত্ত্বের অনুপাতকে নষ্ট করে।
আমেরিকান ডাঃ ই. বি. এমারী এবং ইংল্যাণ্ডের ডাঃ ইন্হা, তাঁদের বিশ্ববিখ্যাত বই ‘পুষ্টির নবীনতম জ্ঞান’ এবং ‘রোগীদের প্রকৃতি’তে স্পষ্ট বলেছেন যে ডিম মানুষের পক্ষে বিষতুল্য।
ইংল্যাণ্ডের ডাঃ আর. জে. উইলিয়াম বলেছেন যে ‘সাধারণতঃ ডিমভক্ষণকারী প্রথমে বেশি শক্তি অনুভব করে, কিন্তু পরে তাদের হৃদ্রোগ, এক্জিমা, প্যারালিসিস ইত্যাদি ভয়ানক রোগের শিকার হতে হয়। পরীক্ষায় জানা যায় যে ডিম যদি ৮°৫ এর বেশি তাপে ১২ ঘণ্টার বেশি সময় থাকে, তবে তাতে পচনক্রিয়া শুরু হয়।
এই অবস্থায় ভারতের মতো দেশে, যেখানে তাপমাত্রা সর্বদা ৮°৫ এর চাইতে বেশি থাকে এবং পোল্ট্রী ফার্মে ডিম উৎপন্ন হয়ে বিক্রী হওয়া পর্যন্ত সেটি ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় বাইরে থাকে, এর ফলে তাতে পচনক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। কারণ উৎপন্ন হওয়ার পর বিক্রয় পর্যন্ত ডিমকে রেফ্রিজারেটরে রাখা কখনও সম্ভব নয়।
ডিম পচতে থাকলে প্রথমে তার জলীয় অংশ খোলস থেকে বাষ্প হয়ে উবে যায়, তারপর রোগ সংক্রমণ হতে থাকে এবং হলুদ অংশে গিয়ে পুরো প্রভাব বিস্তার করে। সূক্ষ্মস্তরে পচন ধরায় সেটি ঠিকভাবে বোঝা যায় না এবং উদরস্থ করা হয়। তার ফলে পেটের রোগ, Food Poisoning ইত্যাদি হয়।
(ইংল্যাণ্ডের শ্রীনীতিন মেহতার বক্তব্য অনুসারে প্রতিবছর প্রায় ৫০ লাখ মানুষ Salmonella দ্বারা প্রভাবিত হন। N. H. S. অনুসারে মুরগী বা ডিম থেকে হওয়া Food Poisoning প্রভাবগ্রস্থ রোগীদের চিকিৎসায় প্রতি বছর ২০ লাখ ডলার খরচ হয়।
Salmonella ছাড়া Listeriaও ছড়িয়ে পড়ে, যা ফ্লু উৎপন্ন করে এবং যার থেকে Meningitis (Brian swelling) বা Food Poisoning বৃদ্ধি পায়। তাতে গর্ভবতী মহিলার গর্ভপাত বা গর্ভস্থ শিশুর রোগগ্রস্ত হওয়ায় সম্ভাবনা থাকে। স্বাস্থ্য বিভাগের সূচনা অনুসারে ১২% 'Ready to eat poultry food'-এর নমুনাতে Listeria পাওয়া গেছে। Creutzfeldt Jacob's disease, Beef থেকে উৎপন্ন হয়, যা হল একটি মানসিক রোগ যা ভেড়ার মধ্যে পাওয়া অসুখ Serapie র মতো। এই অসুখ মাংসাহার দ্বারা পশুর দেহ থেকে মানুষে প্রবেশ করার সম্পর্ক জানা গেছে।
Australia, যেখানে সর্বাধিক মাংসাহার করা হয় এবং যেখানে গড়ে প্রতি ব্যক্তি প্রতি বছর 130K.G. Beef ভক্ষণ করে, সেখানে Bowel Cancer সর্বাধিক। Dr. Andrew Gold তাঁর পুস্তক Diabetes: Its Causes and Treatment এ শাকাহার ভোজনেরই পরামর্শ দিয়েছেন।
আমিষ আহার যেসব অসাধ্য রোগের জন্ম দেয় সম্প্রতি এই বিষয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে করা অনুসন্ধানের তালিকা হল এইরূপ—
হৃদরোগ এবং উচ্চরক্তচাপ-রক্তের শিরার দেওয়ালের গায়ে কোলেষ্টরল জমা হওয়া হল এর প্রধান কারণ। কোলেষ্টরল এর সর্বাধিক স্রোত ডিম, তারপর মাংস, মাখন ও ঘি। ১০০ গ্রাম ডিম প্রতিদিন গ্রহণ করলে প্রয়োজনের তুলনায় ২১।২ গুণ বেশি কোলেষ্টরল সংগ্রহ করা হয়।
জগতের মহাপুরুষগণ কর্তৃক আমিষ আহারের নিন্দা
বিশ্বের ইতিহাসে দৃষ্টি দিলে জানা যায় যে জগতের সমস্ত বিখ্যাত মহাপুরুষ, চিন্তাশীল ব্যক্তি, বৈজ্ঞানিক, শিল্পী, কবি, লেখক, যেমন পিথাগোরাস, প্লুটার্ক, স্যার আইজাক নিউটন, মহান চিত্রকর লিওনার্ডো দ্যা ভিঞ্চি, ডাঃ এ্যানি বেসান্ত, এ্যালবার্ট আইনষ্টাইন, এরা সকলেই নিরামিশী ছিলেন।
শাকাহারের জন্যই তাঁরা সহিষ্ণুতা, দয়া, অহিংসা ইত্যাদি সদ্গুণ দ্বারা বিভূষিত হয়েছিলেন। মহান বৈজ্ঞানিক এ্যালবার্ট আইনষ্টাইন বলেছেন যে “নিরামিষ আহারের দ্বারা প্রকৃতির ওপর গভীর প্রভাব পড়ে। জগৎ যদি নিরামিষ ভোজী হয় তাহলে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হতে পারে।
জল-চিকিৎসার আবিষ্কারক সুপ্রসিদ্ধ স্যার লুইকুও বলেছেন যে, মানুষ আমিষাশী প্রাণী নয়। তারা মাংসভক্ষণ করে প্রকৃতির বিরুদ্ধ কর্ম করে নানা প্রকার বিপদ ডেকে আনে। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি খাঁচায় বন্দী পাখি কিনে, তাদের উড়িয়ে দিতেন। তিনি বলতেন যে, মানুষ যদি স্বাধীনতা চায়, তাহলে পশু-পাখিদের কেন বন্দী করে ?
সেন্ট ম্যাথু, সেন্ট পল মাংসাহারকে ধার্মিক পতনের সূচক বলে মনে করতেন। মেথোডিষ্ট এবং সেভেন্থ ডে এডভেন্টিস্ট আমিষ আহার ও মদ্যপানের কঠোর নিষেধ করেছেন। টলস্টয় এবং রুশ-এর খ্রীষ্টান মোমিনও আমিষ আহার করা খ্রীষ্ট ধর্মের বিরুদ্ধ বলে জানিয়েছেন।
গ্রীক দার্শনিক পিথাগোরাসের শিষ্য রোমান কবি সেনেকা নিরামিষাশী হয়ে অত্যন্ত সুখপ্রদ আশ্চর্য অনুভূতি লাভ করেছিলেন যে, তাঁর মন পূর্বের থেকে বেশি সুস্থ, সচেতন ও সমর্থ হয়ে গিয়েছিল।
জর্জ বার্নার্ড শ তাঁর এক কবিতায় লিখেছিলেন যে, 'আমরা মাংস ভক্ষণকারীরা হলাম এক একটি জীবন্ত কবর, যার মধ্যে জানোয়ারদের মৃতদেহ পোরা আছে—আমাদের স্বাদের জন্য যাদের বধ করা হয়েছে।'
ডাক্তারেরা বার্নার্ড শ কে বলেছিলেন ‘মাংস না খেলে আপনি মরে যাবেন।' তার উত্তরে বার্নার্ড শ বলেছিলেন ‘মাংস খাওয়ার থেকে মৃত্যু শ্রেয়’। তিনি ডাক্তারদের বলেছিলেন ‘আমি যদি বেঁচে যাই, তাহলে আশা করব আপনারাও নিরামিষাশী হবেন'।
বার্ণার্ড শ তো বেঁচে গেলেন, কিন্তু ডাক্তারেরা নিরামিষাশী হলেন না। এই মহান ব্যক্তি সঙ্গী-জীবদের খাওয়ার পরিবর্তে মৃত্যুও শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন।
এরূপ মহাত্মা গান্ধীর সন্তানের যখন কঠিন অসুখ হয় তখন ডাক্তারেরা তাঁকে বলেছিলেন, শিশুকে মাংসের সুপ না দিলে সে বাঁচবে না। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, পরিণাম যা-ই হোক না কেন, মাংসের সূপ দেওয়া যাবে না। শিশুটি মাংসের সুপ না খেয়েই বেঁচে গিয়েছিল।
চাণক্য নীতিতে বলা হয়েছে যে, যে মাংস খায়, মদ্যপান করে সেই পুরুষরূপী পশুদের ভারে পৃথিবী দুঃখ পেয়ে থাকে। মহর্ষি রমণ অহিংসাকে সর্বপ্রথম ধর্ম বলে জানিয়েছেন এবং সাত্ত্বিক আহার যেমন ফল, দুধ, শাক-সব্জী ইত্যাদি একটি নিশ্চিত মাত্রায় গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
ভারতীয় ঋষি-মুনি কপিল, ব্যাস, পাণিনি, পতঞ্জলি, শংকরাচার্য, আর্যভট্ট আদি সকল মহাপুরুষ, ইসলামের সব সূফী সন্ত এবং ‘অহিংসা পরমো ধর্মঃ' প্রচারক মহাত্মা বুদ্ধ, ভগবান মহাবীর, গুরুনানক, মহাত্মা গান্ধী সকলেই শুদ্ধ নিরামিষ আহারী ছিলেন এবং এঁরা সকলেই আমিষ আহারের বিরোধিতা করেছেন।
কারণ শুদ্ধ বুদ্ধি এবং আধ্যাত্মিকতা আমিষ আহারের দ্বারা সম্ভব নয়। মহাত্মা গান্ধী এমন কথাও বলেছেন যে, ‘আমার বিচারানুসারে গো রক্ষার প্রশ্ন স্বরাজ্যের প্রশ্ন থেকে ছোট নয়। কয়েকটি বিষয়ে আমি সেটি স্বরাজ্যের প্রশ্ন থেকেও বড়ো মনে করি।
আমার কাছে গো-হত্যা এবং মানুষ হত্যা একই মনে হয়।' প্রসিদ্ধ কবি Coleridge তাঁর কবিতায় (The Ancient Mariner) বলেছেন সেটি হল সকল ধর্মের সারকথা।
He prayeth best, who loveth best All things both great and small, For the dear God who loveth us,He made and loveth all.
ভাবার্থ – যিনি এই জগতের ছোটো-বড়ো সকল প্রাণীর তথা সকল বস্তুর প্রতি অসীম ভালোবাসা পোষণ করেন, তিনিই ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাসক; কারণ, সেই পরমেশ্বর—যিনি আমাদের পরম প্রিয় এবং আমাদের সবাইকে যিনি একান্তভাবে ভালোবাসেন তিনিই এই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং এই সমস্ত কিছুতেই তাঁর প্রেম সমানভাবে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে।
আমিষ আহার করলে ঈশ্বর অসন্তুষ্ট হয়.
য ইচ্ছেৎ পুরুষোঽত্যন্তমাত্মানং নিরুপদ্রবম্। স বর্জয়েৎ মাংসানি প্রাণিনামিহ সর্বশঃ॥
(মহাভারত, অনুশাসনপর্ব, ১১৫।৪৮)
“যে ব্যক্তি আত্যন্তিক শান্তি লাভ করতে চান, জগতে তাঁর কোনো প্রাণীর মাংস কোনো উপলক্ষ্যেই খাওয়া উচিত নয়।' সমগ্র চরাচর জগৎস্রষ্টা পরম পিতা পরমাত্মার দৃষ্টিতে সকল জীব সমান,
অর্থাৎ তাঁর বলার তাৎপর্য হল, তাঁর দ্বারা সৃষ্ট হওয়ায় সকলেই তাঁর সন্তান। তাই ভক্তদের দৃষ্টিতে সকলজীবই ভ্রাতৃতুল্য, এই রহস্য জানা ঈশ্বর-ভক্তের পক্ষে পরম পিতা পরমাত্মার সন্তান, নিজের বন্ধুসদৃশ কোনো প্রাণীকে হত্যা করা তো দূরের কথা, তিনি কাউকে বিন্দুমাত্র কষ্টও দিতে পারেন না।
যাঁরা একথা না জেনে স্বার্থবশতঃ অন্য জীবকে হত্যা করেন এবং হত্যা করেও নিজে ভগবানের দয়া ভিক্ষা করেন ও ঈশ্বর-প্রাপ্তি কামনা করেন, তাঁরা অত্যন্ত ভুল করেন। প্রাণীবধকারী ক্রূর মানুষের ওপর ঈশ্বর কীভাবে প্রসন্ন হতে পারেন ?
কোনো পিতার একজন পুত্র যখন লোভের বশে তার আর এক নির্দোষ ভাইকে কষ্ট দেয় বা হত্যা করে, তাতে পিতা যেমন ক্রুদ্ধ হন, তেমনই প্রাণীদের কষ্টদানকারী লোকও ঈশ্বরের অপ্রসন্নতা ও কোপভাজন হন।
আমিষ আহার নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক পতনের কারণ
মানুষের চিন্তাই তার কর্মকে প্রভাবিত করে। যার মধ্যে অহিংসা, দয়া, পরোপকার ইত্যাদির চিন্তা থাকে, সে এমন কর্ম করবে না বা করাতে চাইবে না যাতে অন্য প্রাণী কষ্ট পায়। যার হৃদয় কোনো প্রাণীকে দুঃখ-কষ্টে দেখে দ্রবীভূত হয়, সেইরূপ চিন্তাযুক্ত মানুষ মাংস ভক্ষণের কথা চিন্তাই করতে পারে না।
নিজ স্বার্থের জন্য অন্যকে কষ্ট দিতে দ্বিধাবোধ করে না, তার কাছে মাংসাহার কেন, কোনো অনৈতিক কাজ করতেই সে পিছপা হয় না। যার মন পশুর বুকে ছুরি চালানোতে আহত হয় না, সে মানুষের ওপর গুলি বর্ষণ করতে কেন ভয় পাবে? যে নিজের স্বাদ এবং শরীরের পুষ্টির জন্য প্রাণীকে বধ করে তার মাংস খায়, সে তার অন্য আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য—ব্যবসা, পদ-প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির লোভে যে কোনো হিংসা করতে বা করাতে পিছুপা হবে কেন ? এরূপ স্বার্থপর ব্যক্তি থেকে কি কখনও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের আশা করা যায় ?
‘মাংস মাংসাহারী মানুষ নির্দয় হয়ে যায় আর যার দয়া নেই তার ধর্মহীন হওয়াতে কোনো সন্দেহই থাকে না। মাংসাহারী ব্যক্তি ভুলে যায় যে, ভক্ষণ করে কতো বড়ো নির্দয় কাজ করছি। আমার তো কিছু সময়ের জন্য রসনার তৃপ্তি, ক্ষুণ্ণিবৃত্তি হচ্ছে ; কিন্তু বেচারী পশু বা পক্ষীর প্রাণ চিরকালের মতে চলে যাচ্ছে।' প্রাণনাশের মতো দুঃখ আর কী আছে ? জগতে সকল প্রাণীই প্রাণনাশের ভয় পায়।
অনিষ্টং সর্বভূতানাং মরণং নাম ভারত।
মৃত্যুকালে হি ভূতানাং সদ্যো জায়তে বেপথুঃ॥
(মহাভারত, অনুশাসনপর্ব, ১১৬।২৭) ‘হে ভারত ! মৃত্যু সকল জীবের পক্ষেই অনিষ্টকর, মরণের সময় সকল জীবই সহসা কম্পিত হয়।
মাংসাহার দ্বারা মস্তিষ্কের সহ্যশীলতা এবং স্থৈর্য হ্রাস হয়, বাসনা এবং উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়, ক্রূরতা ও নির্দয়ভাব জন্ম নেয়। কোনো বালককে যখন প্রথম থেকেই মাংসাহারে অভ্যস্ত করানো হয়, তখন সে স্বার্থের জন্য অন্য জীবের মাংস খাওয়া, তাকে কষ্ট দেওয়া, মারা ইত্যাদি কাজ এতো সহজে করে যে কাউকে হত্যা করতে, হিংসার কাজ করতে তার কোনো অপরাধ বোধ আসে না।
অহিংসা, দয়া, পরোপকারের চিন্তা তার মাথায় আসে না। তার মধ্যে শুধু স্বার্থের চিন্তাই বেড়ে ওঠে, যা তাকে নিজের তুচ্ছ স্বার্থের জন্য জাতি, দেশেরও ক্ষতি করতে বাধা দেয় না।
আধুনিক বিশ্বে হিংসা, ঘৃণা, দুষ্কর্ম বৃদ্ধির মুখ্য কারণ হল মাংসাহারের ফলে কোমল সৎচিন্তার বিনাশ এবং স্বার্থপরতা আদির বৃদ্ধি। হয় ততোই আরও বেড়ে ওঠে, কখনোই তার তৃপ্তি হয় না। বাসনার পথে আমিষ আহার নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক পতনের কারণ আমিষ খাদ্য বাসনাসমূহকে উত্তেজিত করে এবং তা যতো ভোগ করা কোনো বাধা এলে ক্রোধ উৎপন্ন হয়, ক্রোধের ফলে ভালো-মন্দের বিচার নষ্ট হয়ে যায়, বুদ্ধিবিভ্রম ঘটে, তাতে পথভ্রষ্ট হয় অথবা সর্বনাশ হয়ে যায়।
সুতরাং আমরা দেখতে পাই যে, আমিষ আহারে অন্যান্য ক্ষতি ছাড়াও বিশ্বে হিংসা, অমানবিকতা, দুষ্কর্ম ইত্যাদি বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ এবং এটি মানুষকে সর্বনাশের পথে নিয়ে যায়। আমাদের কর্তব্য হল একে রোধ করা। আমরা যদি তা করতে সক্ষম না হই আমাকে এর ভয়ানক ফল ভুগতে হবে।
তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্মে প্রায়শঃ দেখা যায় যে দুষ্কর্ম, ধর্ষণ, নির্দয়ভাবে হত্যা ইত্যাদি করে যেসব দুর্বৃত্ত, তারা সাধারণ অবস্থায় এই কাজ করে না। এই সব কাজের আগে তারা মদ্যপান ও মাংসাহার করে, তাতে তাদের বিবেক, মানবিকবোধ, নৈতিকতা নষ্ট হয়ে যায়, ফলে এই দুষ্কর্ম করা তাদের পক্ষে সহজ হয়ে যায়।
অর্থাৎ যখন কেউ এই অন্যায় কাজ করতে মন থেকে তৈরি থাকে না, তখন তার অন্তরের কথা অগ্রাহ্য করার জন্য এইসব পদার্থের উপভোগ করে। দুর্ভাগ্যের কথা যে, আজকাল লোকেরা ফ্যাসান, আধুনিকতা কিংবা নিজেদের আধুনিক দেখানোর জন্য আমিষ খাদ্য গ্রহণ করে এবং এটি সর্বজনবিদিত যে আজকে মানুষের নৈতিক স্তরের মানদণ্ড কোথায় নেমেছে ! নিজের নিজের অন্তর্মনই এটি ভালো করে জানে।
কিছু নিরামিষাশী ব্যক্তি আধুনিক হওয়ার জন্য নিরামিষ পদার্থ দ্বারা পশু-পক্ষীর আকৃতির খাদ্য তৈরি করে মাংসাহারীদের মতো ভোজন করেন, যেন তাঁরাও মাংসাহারী। এরূপ আহার যদিও স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ নয়, কিন্তু চিন্তার দিক থেকে এটি অনুচিত। কারণ চিন্তাই আমাদের তদনুরূপ কর্মের পথে প্রেরণ করে। এরূপভাবে নিরামিষ আহার করলেও মনে তো এই চিন্তারই উদয় হয় যে আমরা প্রাণী বধ করে আনন্দে তা আহার করছি।
এই চিন্তাই আমাদের অহিংসা, দয়া, প্রেমের মতো গুণ থেকে অপসারিত করে ক্রমে হিংসা, ক্রূরতা ইত্যাদির দিকে প্রেরণ করে এবং অবশেষে যা আমাদের বা আমাদের বংশধরদের আমিষাশী করে তুলবে।
আমিষ খাওয়া মহাপাপ
ধর্মে সর্বপ্রথম স্থান দেওয়া হয়েছে অহিংসাকে, অন্যান্য দয়া, সংযম আদি সব ধর্মেরই অঙ্গ, কিন্তু অহিংসা পরম ধর্ম—‘অহিংসা পরমো ধর্মঃ।” (মহাভারত, অনুশাসনপর্ব ১১৫।২৫)। ধর্মের তাৎপর্য অহিংসাতে।
ধর্মমান্যকারী সকল ব্যক্তিই অহিংসা ও ত্যাগের প্রশংসা করেন। যে ধর্ম মানুষের মনোবৃত্তিকে অহিংসা, ত্যাগ, নিবৃত্তি ও সংযমের দিকে নিয়ে যায়, সেটিই হল প্রকৃত ধর্ম। যে ধর্মে এই সকল গুণের অভাব থাকে, সেই ধর্ম পূর্ণ নয়, মাংস-ভক্ষণকারীরা অহিংসা-ধর্ম হনন করেন, ধর্ম-হননই পাপ।
কেউ যদি বলেন যে ‘আমি তো নিজে পশুকে মারি না হত্যা করাই না, অন্যের দ্বারা বধ করা পশু-পক্ষীর মাংস ক্রয় করে খাই, তাহলে আমি কেন প্রাণী-হত্যার পাতক হব ?’ এর উত্তর স্পষ্ট। মাংসাহারীদের জন্যই প্রাণী হিংসা করা হয়। কসাইখানা মাংসহারীদের জন্যই নির্মিত হয়েছে।
মাংসাহারীরা যদি মাংসাহার ত্যাগ করেন তাহলে প্রাণীবধ করা হবে কেন ? আর এই কথাও বুঝতে হবে যে কেবল নিজ হাতে হত্যা করলেই ঘাতক হয় না। মহর্ষি পতঞ্জলি অহিংসার প্রধানতঃ সাতাশটি ভাগের কথা বলেছেন—
যথা—‘বিতর্কা হিংসাদয়ঃ কৃতকারিতানুমোদিতা লোভক্রোধমোহ পূর্বকা মৃদমধ্যাধিমাত্রা দুঃখাজ্ঞানানন্তফলা ইতি প্রতিপক্ষভাবনম্। (যোগদর্শন ২।৩৪)
অর্থাৎ হিংসা তিন প্রকারের—নিজে হিংসা করা, অপরের দ্বারা করানো এবং হিংসা সমর্থন করা। এই তিন প্রকারের হিংসা লোভ, ক্রোধ ও অজ্ঞানবশতঃ হওয়ায় (৩ × ৩ = ৯) নয় প্রকারের হয়ে ওঠে এবং এই নয় প্রকারের হিংসা মৃদু, মধ্য এবং অধিকমাত্রা হওয়ায় (৯ × ৩ = ২ ৭) সাতাশ প্রকারের হয়ে ওঠে। এইভাবে মিথ্যা ভাষণ ইত্যাদির
আমিষ থেকে কী করে মুক্তি পাওয়া যায়
যেসব মানুষ আমিষ বর্জন করে নিরামিষাশী হতে চান কিন্তু সামাজিক ও পারিবারিক পরিস্থিতির জন্য অথবা স্বাদের জন্য এটি ত্যাগ করতে পারেন না, আমাদের মতে তাঁদের নিম্নলিখিত উপায় অবলম্বন করা উচিত।
১) আমিষ খাদ্যের দ্বারা হওয়া ক্ষতিগুলি বারংবার পড়ে আমিষ ত্যাগ করার এক সাধারণ চিন্তাকে দৃঢ় ইচ্ছায় পরিণত করে নেবেন। দৃঢ় ইচ্ছা না থাকলে সাফল্য আসে না, কথায় বলে ‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।”
২) নিশ্চিতভাবে জানবেন যে, আমিষ খাদ্য ত্যাগ করা সমাজ শোধরাবার ও পরিবার কল্যাণের একটি উত্তম কাজ। এটি আপনাকে আধুনিকতার দিকে নিয়ে যায়, কারণ সেই ব্যক্তিই আধুনিক, যিনি নতুন পথ জেনে সবার আগে তাতে অগ্রসর হন। নিরামিষাশী হওয়া গর্বের বিষয় বলে ভাববেন।
৩) নিজ মনকে ভালোভাবে বোঝাবেন যে আমিষ খাওয়া ছেড়ে দিলে শরীর দুর্বল হয় না, বরং ক্যান্সার ইত্যাদি অসুখ থেকে বাচা যায় ও শরীর বেশি পুষ্ট হয়।
৪) প্রারম্ভে কিছুদিন নিজ স্বাদ অনুযায়ী নিরামিষ পদার্থ দ্বারা প্রস্তুত কাবাব ইত্যাদি (আমিষের মতো দেখতে) খাবার নেবেন। পরে ক্রমশঃ সাধারণ নিরামিষে চলে আসবেন।
৫) ডাইনিং টেবলে বা রান্নাঘরে আমিষের ক্ষতি দর্শানো কোনো বাক্য যেমন ‘আমিষ আহার রোগাদির ভাণ্ডার' ইত্যাদি লিখে রাখবেন, যাতে সেটি পড়ে পরিবারের সব সদস্যই আমিষ খাদ্য ত্যাগের কথা ভাবে।
৬) আমিষ খাদ্য সংগ্রহে পশুদের ওপর হওয়া অত্যাচার এবং তাদের কষ্টের কথা চিন্তা করবেন আর ভাববেন এরা আমার পূর্বজন্মের কেউ নয় তো?
৭) উপরোক্ত সকল প্রকারের চেষ্টা সত্ত্বেও যদি আমিষ খাদ্য ত্যাগ করতে না পারেন, তাহলে সাত সপ্তাহের জন্য একটি কার্যক্রম তৈরী করুন। প্রথম সপ্তাহে একদিন আমিষ খাবেন না, দ্বিতীয় সপ্তাহে দুদিন। এইভাবে প্রতি সপ্তাহে একদিন করে বাড়িয়ে সপ্তম সপ্তাহে আমিষ খাদ্য একেবারে ত্যাগ করবেন।
আমিষ খাদ্য ত্যাগ করতে শুধু মনের দৃঢ়তাই প্রয়োজন। এটি ত্যাগ করতে কোনো অসুবিধা হয় না। আমিষাশী বহু ব্যক্তিই এটি একেবারেই পরিত্যাগ করেছেন। সুতরাং আপনিও পারেন আমিষ খাদ্য ত্যাগ করতে। মনে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে আজই এই সর্বনাশকারী আহার থেকে নিজেকে মুক্ত করুন।
মন হারলে হার, মন জিতলে জয়। মাংস খাব না আমি, তাতে যে হয় আয়ু ক্ষয়।
আরও পড়ুন