শুদ্ধ ভক্তির লক্ষণ গুলো কি কি? ভক্তিরসামৃতসিন্ধু

 

শুদ্ধ  ভক্তির লক্ষণ

শুদ্ধ ভক্তির লক্ষণ-ভক্তিরসামৃতসিন্ধু

শ্রীমদ্ভাগবতের তৃতীয় স্কন্ধে (৩/২৯/১২-১৩) ভগবান কপিলদেব তাঁর মাতা দেবহূতিকে পারমার্থিক তত্ত্ব সম্বন্ধে নির্দেশ দেবার সময় শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তির লক্ষণ বর্ণনা করে বলেছেন—“হে মাতঃ, যাঁরা আমার শুদ্ধ ভক্ত, এবং যাঁদের পার্থিব কোন লাভের বাসনা অথবা মনোধর্ম প্রসূত জ্ঞানের প্রতি কোন আসক্তি নেই, তাঁদের চিত্ত সর্বদাই আমার সেবায় এত গভীরভাবে মগ্ন যে, তাঁরা আমার কাছ থেকে আমার প্রতি অহৈতুকী ভক্তি ছাড়া আর কিছুই প্রত্যাশা করেন না। 

 

এমন কি, তাঁরা আমার ধামে আমার সঙ্গে বাস করার সৌভাগ্য পর্যন্ত কামনা করেন না।”[মুক্তি পাঁচ রকমের, যথা—সাযুজ্য বা ভগবানের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়া, সালোক্য বা ভগবানের লোকে বাস করা, সারূপ্য বা ভগবানের রূপ প্রাপ্ত হওয়া, সামীপ্য বা ভগবানের সান্নিধ্যে বাস করা এবং সাষ্টি বা ভগবানের সমান ঐশ্বর্য প্রাপ্ত হওয়া। ভগবদ্ভক্ত পার্থিব সুখভোগের কথা দূরে থাকুক, এই পাঁচটি মুক্তির কোনটিই কামনা করেন না। 

 

প্রীতি সহকারে ভগবানের সেবা করেই তিনি সম্পূর্ণ তৃপ্ত। এটিই হচ্ছে শুদ্ধ ভক্তির লক্ষণ। শ্রীমদ্ভাগবতে কপিলদেবের এই উক্তিতে শুদ্ধ ভক্তের যথার্থ মনোভাব বর্ণিত হয়েছে, এবং ভক্তির সামান্য লক্ষণও বর্ণিত হয়েছে।

 

শ্রীল রূপ গোস্বামী শাস্ত্র-প্রমাণের মাধ্যমে ভক্তির বিভিন্ন লক্ষণ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, শুদ্ধ ভক্তির ছয়টি লক্ষণ আছে-

১) শুদ্ধ ভক্তি ক্লেশঘ্নী, অর্থাৎ সব রকম প্রাকৃতিক ক্লেশ তৎক্ষণাৎ নিবৃত্তি করে। 

(২) শুদ্ধ ভক্তি শুভদা, অর্থাৎ সর্বতোভাবে মঙ্গলময়। 

(৩) শুদ্ধ ভক্তি সান্দ্রানন্দবিশেষাত্মা, অর্থাৎ শুদ্ধ ভক্তি দিব্য আনন্দ প্রদান করে।

(৪) শুদ্ধ ভক্তি সুদুর্লভা, অর্থাৎ শুদ্ধ ভক্তি লাভ করা অত্যন্ত দুর্লভ।

( ৫) শুদ্ধ ভক্তি মোক্ষলঘুতাকৃৎ, অর্থাৎ শুদ্ধ ভক্তি মোক্ষকেও তুচ্ছ করে দেয়। 

(৬) শুদ্ধ ভক্তি শ্রীকৃষ্ণাকর্ষিণী, অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণকে আকর্ষণ করার একমাত্র উপায়।

শ্রীকৃষ্ণ সর্বাকর্ষক, কিন্তু শুদ্ধ ভক্তি তাঁকেও আকর্ষণ করে। অর্থাৎ শুদ্ধ ভক্তি শ্রীকৃষ্ণের থেকেও বলবতী, কারণ তিনি হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তি।

ক্লেশঘ্নী (শুদ্ধ ভক্তি ক্লেশ নিবারণ করে)

 

ভগবদ্গীতায় ভগবান বলেছেন যে, সমস্ত কার্যকলাপ পরিত্যাগ করে তাঁর শরণাগত হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে তিনি এই প্রতিজ্ঞাও করেছেন যে, এই ধরনের সমর্পিত আত্মাদের তিনি সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করবেন। শ্রীল রূপ গোস্বামী বলেছেন যে, এই জন্মের পাপ ও পূর্বকৃত পাপ—–—দুই-ই ক্লেশের কারণ।  

 

সাধারণত পাপকর্ম অবিদ্যার ফলে সংঘটিত হয়ে থাকে। কিন্তু অবিদ্যার অজুহাত দেখিয়ে পাপের প্রতিক্রিয়া থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। পাপের ফল দুই রকমের— প্রারব্ধ ও অপ্রারব্ধ। যে পাপকর্মের ফল আমরা বর্তমানে ভোগ করছি তা প্রারব্ধ। 

 

যা এখনও ভোগ হয়নি, সেই সঞ্চিত পাপকর্মকে অপ্রারব্ধ বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যেমন কোন দুর্বৃত্ত অনেক অপরাধ করা সত্ত্বেও এখনও ধরা পড়েনি, কিন্তু যখনই সে ধরা পড়বে, তখনই তাকে কারাগারে দণ্ড দেওয়া হবে। এইভাবে আমাদের অপ্রারব্ধ পাপের ফল আমরা ভবিষ্যতে প্রাপ্ত হব, আর আমাদের প্রারব্ধ পাপকর্মের ফল এখন আমরা ভোগ করছি। 

 

এইভাবে পাপকর্ম ও তার পরিণামরূপী ক্লেশ ক্রমান্বয়ে চলতে থাকে। এইভাবে বদ্ধ জীব এই সমস্ত পাপের ফলে জন্ম-জন্মান্তরে দুঃখভোগ করে থাকে। বর্তমানে পূর্বকৃত পাপের ফল ভোগ করতে করতে সে পরবর্তী জীবনের দুঃখরূপী নতুন বীজ বপন করতে থাকে। ভীষণ রোগ, আইন সংক্রান্ত অভিযোগ, নীচকুলে জন্ম অথবা বিদ্যা বা রূপের অভাব—এই সমস্ত প্রারব্ধ পাপকর্মের লক্ষণ।

 

পূর্বকৃত পাপের অনেক ফল আমরা বর্তমানে ভোগ করছি এবং বর্তমানে যে সমস্ত পাপ আমরা করছি, তার ক্লেশ আমাদের ভবিষ্যতে ভোগ করতে হবে। কিন্তু আমরা যদি কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হই, তা হলে এই সমস্ত পাপকর্মের ফল অবিলম্বে নিবারিত হতে পারে। 

 

তার প্রমাণস্বরূপ শ্রীল রূপ গোস্বামী শ্রীমদ্ভাগবতে একাদশ স্কন্ধের চতুর্দশ অধ্যায়ের ঊনবিংশতি শ্লোকটি উদ্ধৃত করেছেন। উদ্ধবকে উপদেশ প্রদানকালে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, “হে উদ্ধব, আমার প্রতি ভক্তি প্রজ্বলিত অগ্নির মতো, যা ইন্ধনরূপী অপার পাপরাশি ভস্ম করতে পারে।” 

 

অর্থাৎ, প্রচণ্ড অগ্নি যেমন যে কোনও পরিমাণ ইন্ধনকে ভস্মীভূত করতে পারে, তেমনই কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্তি পাপকর্মরূপী সমস্ত ইন্ধনকে ভস্মীভূত করতে পারে। যেমন, কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে অর্জুন মনে করেছিলেন যে, যুদ্ধ করাটা পাপকর্ম, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে সেই যুদ্ধে নিযুক্ত হতে আদেশ দিলেন, এবং তার ফলে তাঁর কাছে সেই যুদ্ধ ভগবদ্ভক্তিতে পর্যবসিত হল। তাই অর্জুনকে কোন পাপের ফল ভোগ করতে হল না।

 

শ্রীল রূপ গোস্বামী শ্রীমদ্ভাগবতের (৩/৩৩/৬) শ্লোকে উল্লেখ করেছেন, যেখানে দেবহূতি তাঁর পুত্র কপিলদেবকে বলেছেন, “প্রভু! শ্রবণ, কীর্তন আদি ভক্তিযোগের নয়টি সাধনাঙ্গ রয়েছে। যদি কেউ আপনার লীলাশ্রবণ, যশকীর্তন, বন্দন, ভক্তিভরে আপনাকে প্রণাম, আপনাকে স্মরণ আদি নবধা ভক্তির যে কোনও একটি অঙ্গ অনুশীলন করেন, তা হলে তিনি তৎক্ষণাৎ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার যোগ্যতা অর্জন করেন। 

 

তিনি যদি চণ্ডালকুলেও জন্মগ্রহণ করে থাকেন, তবুও ভক্তিযোগের প্রভাবে তিনি সর্বতোভাবে পবিত্র হতে পারেন।” অর্থাৎ যিনি পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে যথার্থ ভক্তি অনুশীলনে তৎপর হয়েছেন, তিনি সর্বতোভাবে কলুষমুক্ত না হয়ে পারেন না। 

 

কৃষ্ণভাবনা বা ভগবদ্ভক্তিপরায়ণ পুরুষ অবশ্যই সব রকম পাপকর্ম থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়েছেন। বস্তুত, ভক্তিযোগের সমস্ত পাপ ভস্মীভূত করার শক্তি রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভক্ত নিরন্তর সচেতন থাকেন * যাতে আর কোনও পাপ না হয়; এটিই হচ্ছে ভক্তের বৈশিষ্ট্য। 

 

এইভাবে শ্রীমদ্ভাগবতে নির্ণয় করা হয়েছে যে, ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবায় তৎপর হলে, চণ্ডাল কুলোদ্ভূত মানুষও বৈদিক যজ্ঞ করার যোগ্যতা অর্জন করেন। এই নির্দেশ থেকে বোঝা যায় যে, চণ্ডাল কুলোদ্ভূত মানুষের সাধারণত যজ্ঞ করার অধিকার থাকে না। বৈদিক যজ্ঞ করার অধিকার ব্রাহ্মণদেরই আছে; অতএব ব্রাহ্মণ না হলে কেউই এই কর্ম করতে পারে না। 

 

পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে মানুষ ব্রাহ্মণ বা চণ্ডালকুলে জন্মগ্রহণ করে। যিনি চণ্ডালকুলে জন্মগ্রহণ করেছেন, তিনি অবশ্যই পূর্বজন্মে অসংখ্য পাপ করেছেন। কিন্তু তিনি যদি ভক্তিমার্গ অঙ্গীকার করে ‘হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র’ কীর্তন করেন, তা হলে তিনি তৎক্ষণাৎ যজ্ঞ আদি কর্ম করার যোগ্যতা অর্জন করেন। তাঁর সমস্ত পাপ কর্মফল তৎক্ষণাৎ দূর হয়ে যায়।

 

পদ্ম-পুরাণে বলা হয়েছে, পাপকর্মের ফল চার রকমের হয়— ১) অপ্রারব্ধ, ২) কূট, ৩) বীজ এবং ৪) ফলোন্মুখ। সেখানে এও বলা হয়েছে যে, কেউ যখন ভগবান বিষ্ণুর শরণাগত হয়ে পূর্ণরূপে ভক্তি সহকারে তাঁর সেবায় তৎপর হন, তখন তাঁর এই চার রকমের পাপফল তৎক্ষণাৎ বিনষ্ট হয়ে যায়।

 

যে পাপের ফল ভোগ হতে চলেছে, তাকে বলা হয় ফলোন্মুখ। হৃদয়ে বীজরূপে যে পাপের ফল রয়েছে, তাকে বলা হয় বীজ। বীজের উন্মুখতার কারণকে বলা হয় কূট এবং যে পাপের ফল এখনও প্রকাশিত হয়নি, তাকে বলা হয় অপ্রারব্ধ। পদ্ম-পুরাণের এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, জড় কলুষ অত্যন্ত সূক্ষ্ম।  

 

এর সূচনা, ফলন, পরিণাম এবং দুঃখরূপে তার ফলভোগ—এই সবই একটি বিশাল শৃঙ্খলের অন্তর্ভুক্ত। কারও যখন রোগ হয়, সাধারণত সেই রোগের কারণ নির্ণয় করা খুবই কঠিন। তার শুরু কোথায় এবং কিভাবে তা বর্ধিত হচ্ছে, তা বোঝা খুবই দুষ্কর। কিন্তু রোগের ক্লেশ অকস্মাৎ প্রকাশ হয় না, তার সময় লাগে। 

 

চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসক যেমন সাবধানতা অবলম্বন করে রোগের প্রতিকারের জন্য টীকা দেন, তেমনই সব রকমের পাপবীজকে অঙ্কুরিত হওয়া থেকে নিরোধ করার জন্য পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম করা অত্যন্ত আবশ্যক।

 

এই সম্পর্কে শুকদেব গোস্বামী শ্রীমদ্ভাগবতে (৬/২/১৭) অজামিল উপাখ্যানে উল্লেখ করেছেন। অজামিল প্রথম জীবনে একজন কর্তব্যনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ ছিলেন, কিন্তু যৌবনে বেশ্যার সঙ্গ করার ফলে তিনি সম্পূর্ণরূপে ভ্রষ্ট হয়ে পড়েন। কিন্তু তাঁর পাপময় জীবনের অন্তিম সময়ে নারায়ণের' নাম উচ্চারণ করার ফলে, তিনি তাঁর সমস্ত পাপ থেকে উদ্ধার পান। 

 

শুকদেব গোস্বামী বলেছেন যে, তপস্যা, দান, ব্রত ইত্যাদির প্রভাবে পাপের নাশ হয়, কিন্তু হৃদয়ের পাপবীজের নাশ হয় না, যা অজামিলের যৌবনে হয়েছিল। এই পাপবীজের নাশ একমাত্র কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হওয়ার ফলেই হতে পারে, এবং তা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে মহামন্ত্র বা হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করার প্রভাবে অতি সহজেই লাভ করা যায়। 

 

পক্ষান্তরে বলা যায় যে, ভগবদ্ভক্তির পথ অবলম্বন না করলে, সমস্ত পাপ থেকে পূর্ণরূপে মুক্ত হওয়া যায় না। বেদবিহিত কর্ম, দান, তপস্যা ইত্যাদির দ্বারা মানুষ কিছু সময়ের জন্য পাপকর্মের ফল থেকে মুক্ত হতে পারে, কিন্তু তার পরেই আবার সে পাপকর্মে প্রবৃত্ত হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, অতিরিক্তভাবে অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ করার ফলে যৌন রোগাক্রান্ত পুরুষ যখন ভীষণ কষ্ট -পায়, তখন সে সাময়িকভাবে স্ত্রীসঙ্গ থেকে বিরত থাকে। 

 

কিন্তু যেহেতু তার হৃদয় থেকে স্ত্রীসঙ্গ করার বাসনা দূর হয়নি, তাই রোগ নিরাময়ের পরে সে আবার অবৈধ স্ত্রীসঙ্গে লিপ্ত হয় এবং তার ফলে আবার রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং চিকিৎসার প্রভাবে সাময়িকভাবে এই যৌনব্যাধির নিরাময় হতে পারে, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষ বুঝতে পারছে যে, যৌনজীবন অত্যন্ত জঘন্য, ততক্ষণ পর্যন্ত তার এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভ করা অসম্ভব। 

 

তেমনই, বৈদিক কর্ম, দান, তপস্যা ইত্যাদির ফলে সাময়িকভাবে পাপকর্মের নিবৃত্তি হতে পারে, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না হৃদয় সম্পূর্ণভাবে নির্মল হচ্ছে, ততক্ষণ মানুষ বারবার পাপকর্মে লিপ্ত না হয়ে পারে না।

 

শ্রীমদ্ভাগবতে এই সম্বন্ধে হস্তীস্নানের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। হাতি সরোবরে খুব ভালভাবে স্নান করে। কিন্তু জল থেকে ডাঙ্গায় উঠে এসে সে আবার তার সারা গায়ে ধূলি ছড়িয়ে দেয়। এই উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে, কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করার শিক্ষা যে পায়নি, সে পাপকর্মের বাসনা থেকে পূর্ণরূপে মুক্ত হতে পারে না। 

 

কর্ম, জ্ঞান বা যোগের দ্বারা পাপকর্মের বাসনা থেকে পূর্ণরূপে মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। শুধুমাত্র শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তির প্রভাবেই তা সম্ভব হয়। শ্রীমদ্ভাগবতে (৪/২২/৩৯) আর একটি দৃষ্টান্ত দেখা যায়, যেখানে সনৎকুমার বলছেন, “হে রাজন, মানুষের মিথ্যা অহঙ্কার এতই প্রবল যে, তা রজ্জ্বর মতো মানুষকে ভববন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে। 

 

ভক্তরাই কেবল ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবায় যুক্ত হওয়ার ফলে, এই বন্ধন থেকে অনায়াসে মুক্ত হতে পারেন। যারা কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত না হয়ে যোগী বা সকাম কর্মী হওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁরা কখনই ভগবদ্ভক্তের মতো কর্মবন্ধন মোচন করতে পারেন না। তাই সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে অহঙ্কার ও প্রাকৃত কর্মের দৃঢ় বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে ভগবৎ-সেবায় নিযুক্ত হওয়া।” 

 

মিথ্যা অহঙ্কারের এই দৃঢ় গ্রন্থি অজ্ঞানতাপ্রসূত। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তার স্বরূপ সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকে, ততক্ষণ সে অবশ্যই অনুচিত কর্মে প্রবৃত্ত হবে এবং প্রাকৃত বন্ধনে আবদ্ধ হবে। এই তত্ত্বজ্ঞানের অভাব কৃষ্ণভাবনার প্রভাবে দূরীভূত হতে পারে, যা পদ্ম-পুরাণে প্রমাণিত হয়েছে—“কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত শুদ্ধ ভক্তি হচ্ছে পরম উজ্জ্বল জ্ঞানবর্তিকা, যা বাসনারূপ অমঙ্গলকারী সর্পদের জন্য দাবানল-স্বরূপ।” 

 

বনে যখন দাবানল জ্বলে ওঠে, তখন সেই আগুনে সমস্ত সাপ দগ্ধ হয়। অন্যান্য পশুরা পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে পারে, কিন্তু সাপেরা কোন মতেই নিস্তার পায় না, তারা সেই আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায়। সেই রকম, কৃষ্ণভাবনারূপী প্রজ্বলিত অগ্নি এতই প্রবল যে, তার প্রভাবে অবিদ্যারূপ সর্প অচিরেই ভস্মীভূত হয়ে যায়।

 

কৃষ্ণভাবনা সর্ব মঙ্গলময়

শ্রীল রূপ গোস্বামীপাদ মঙ্গলময় কথাটির একটি সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন। তিনি বলেছেন যে, যথার্থ মঙ্গল সমগ্র জগতের কল্যাণ সাধন করে। আজকাল কিছু মানুষকে সমাজ, জাতি, বা রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনে তৎপর হতে দেখা যায়। যেমন রাষ্ট্রসংঘ (United Na tions)-এর মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের হিতসাধন করার একটি প্রচেষ্টা চলছে। 

 

কিন্তু এই সমস্ত প্রচেষ্টা সংকীর্ণ জাতীয়তাবোধের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ফলে, সমগ্র বিশ্বের কল্যাণ সাধন করতে পারে না। কিন্তু কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন এমনই সর্বাঙ্গসুন্দর যে, তা সমগ্র মানব সমাজের পরম উপকার সাধন করে। সকলেই এই আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে, এবং তার সুফল অনুভব করতে পারে। 

 

তাই, শ্রীল রূপ গোস্বামী প্রমুখ মহাজনেরা এই বিষয়ে একমত যে, কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের দ্বারা সমস্ত জগতে ভক্তিযোগের ব্যাপক প্রচার এবং প্রসার করাই হচ্ছে মানুষের সর্বোত্তম পরোপকার। 

 

কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন সমগ্র বিশ্বকে আকৃষ্ট করতে পারে, এবং সমস্ত মানুষই এই কৃষ্ণভাবনার অমৃত আস্বাদন করতে পারে। এই সম্বন্ধে পদ্ম-পুরাণে বলা হয়েছে—“যে মানুষ পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে ভগবদ্ভক্তি সাধনে তৎপর হয়েছেন, তিনি সমস্ত জগতের সর্বোত্তম সেবা করতে করতে সমস্ত জীবের পরম কল্যাণ সাধন করেন। 

 

তিনি কেবল মানব-সমাজেরই নয়, গাছপালা, পশু-পাখিদেরও কল্যাণ সাধন করেন, কারণ তারাও এই আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ভগবানের কৃপা লাভ করে।” শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখন সংকীর্তন আন্দোলন প্রচার করার জন্য মধ্য-ভারতের ঝারিখণ্ডের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি তার একটি প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত দিয়ে গেছেন। সেই বনের বাঘ, হাতি, হরিণাদি সমস্ত বন্যজন্তুরা তাঁর সঙ্গে ‘হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র’ কীর্তন করতে করতে নৃত্য করেছিল।

 

কৃষ্ণভাবনাময় ভগবৎ-সেবায় যিনি যুক্ত হয়েছেন, তাঁর মধ্যে দেবতাদের সমস্ত গুণাবলী বিকশিত হয়। শ্রীমদ্ভাগবতে (৫/১৮/১২) শুকদেব গোস্বামী বলেছেন, “হে রাজন! শ্রীকৃষ্ণের প্রতি যাঁরা অবিচলিত শ্রদ্ধাসম্পন্ন এবং যাঁরা নিষ্কপট, তাঁরা সমস্ত দৈবী গুণাবলী অর্জন করতে পারেন। ভক্তের বিকশিত কৃষ্ণভাবনার প্রভাবে তাঁর মধ্যে সমস্ত দৈবী গুণাবলীর বিকাশ হয়, এবং সেই জন্য স্বর্গের দেবতারাও তাঁর সঙ্গলাভ করতে চান।” 

 

পক্ষান্তরে, যে সমস্ত মানুষ কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত নয়, তাদের মধ্যে কোনই সদ্গুণ দেখা যায় না। জড় দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে তারা মস্ত বড় বিদ্বান হতে পারে, কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় যে, তাদের কার্যকলাপ পশুদের থেকেও অধম। জড় বিদ্যায় মানুষ যতই পণ্ডিত হোক না কেন, সে তার মানসিক স্তরের ঊর্ধ্বে যেতে পারে না, তাই তার সমস্ত কার্যকলাপই জড়-জাগতিক স্তরে অনুষ্ঠিত হয়, এবং তার ফলে সে চিরকাল পাপ-পঙ্কিলময় হয়ে থাকে। 

 

আধুনিক জগতে এমন অনেক মানব আছে, যারা জড় বিশ্ববিদ্যালয়ে গভীরভাবে পড়াশুনা করে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছে, কিন্তু দেখা যায় যে, তারা কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনকে গ্রহণ করতে পারেনি এবং তার ফলে তারা সমস্ত দৈবী গুণাবলীর বিকাশ করতে পারেনি।

 

জড় বিদ্যার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চশিক্ষিত না হলেও কৃষ্ণভাবনাময় ভাবিত যুবক পরস্ত্রী গমন, দ্যূতক্রীড়া, মাংসাহার ও মদ্যপান—এই সমস্ত পাপকর্ম থেকে অনায়াসে নিবৃত্ত হতে পারে, কিন্তু যারা কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত নয়, তারা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও প্রায়ই মদ্যপায়ী, মাংসাহারী, লম্পট ও জুয়াড়ী হয়। 

 

কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত মানুষদের মধ্যে সমস্ত সদ্গুণের চরম বিকাশ হয়, কিন্তু কৃষ্ণভাবনা বিহীন মানুষদের মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও দেখতে পাওয়া যায় না, এটিই হচ্ছে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। আমরা দেখেছি, কৃষ্ণভাবনাময় ভাবিত যুবকেরা চলচ্চিত্র, নাইটক্লাব, নগ্ন নৃত্য, হোটেল, মদ্যশালা ইত্যাদির প্রতি সম্পূর্ণ নিরাসক্ত। তাঁরা এই সমস্ত অনর্থ থেকে মুক্ত হন এবং ধূম্রপান, মদ্যপান, থিয়েটার, নৃত্য ইত্যাদিতে তাঁদের দুর্মূল্য সময়ের অপব্যবহার করেন না।

 

যে মানুষ কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত নয়, সে এক জায়গায় আধঘণ্টার জন্যও স্থির চিত্তে বসে থাকতে পারে না। আজকাল তথাকথিত সমস্ত যোগপদ্ধতি শিক্ষা দিচ্ছে যে, চুপচাপ বসে থাকলেই উপলব্ধি করা যাবে ‘আমি ভগবান'। এই পদ্ধতি বিষয়ী মানুষদের কাছে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক হতে পারে, কিন্তু এটিও বিবেচনা করে দেখা উচিত যে, কতক্ষণ তারা এইভাবে চুপচাপ বসে থাকতে পারবে?

 

কৃত্রিমভাবে তারা এই তথাকথিত ধ্যানে বসতে পারে, কিন্তু এই যোগ অভ্যাসের পরেই তারা আবার পরস্ত্রী গমন, মদ্যপান, দ্যূতক্রীড়া, মাংসাহার ইত্যাদি পাপকর্মে প্রবৃত্ত হয়। 

 

কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত ভক্ত এই কপট ধ্যান না করে ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বগামী হন। কৃষ্ণভক্তি-পরায়ণ হওয়ার ফলে তিনি অনায়াসে এই সমস্ত পাপকর্ম থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়ে সমস্ত ‘সদ্গুণাবলীতে ভূষিত হন। শ্রীকৃষ্ণের শুদ্ধ ভক্ত হওয়ার ফলে সর্বোচ্চ চরিত্র বিকশিত হয়। এর সিদ্ধান্তে বলা যায় যে, কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত না হলে কেউই যথার্থ সদ্গুণাবলীর অধিকারী হতে পারে না।

 

আরও পড়ুন

* কৃষ্ণ ভক্তি অনুশীলনের পন্থা ও ভক্তির অঙ্গগুলি-ভক্তি-রসামৃতসিন্ধু 

*  কিভাবে প্রকৃত আনন্দ ও শান্তি লাভ করা যায়

* সৃষ্টিকর্তা আছেন তাঁর প্রমাণ কি?

 

* মৃত্যুর পর আত্মা কোথায় যায়, জন্মান্তরবাদ

 
 
 

 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url