কৃষ্ণ ভক্তি অনুশীলনের পন্থা ও ভক্তির অঙ্গগুলি-ভক্তিরসামৃতসিন্ধু
ভক্তির অঙ্গগুলির বিশদ বিবেচনা
নিন্দা
ভগবানের ও তাঁর ভক্তের নিন্দা কখনই সহ্য করা উচিত নয়। এই সম্বন্ধে শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধে (১০/৭৪/৪০) শুকদেব গোস্বামী পরীক্ষিৎ মহারাজকে বলেছেন, “হে রাজন! যদি কোন মানুষ ভগবান ও ভক্তের নিন্দা শুনে তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে চলে না যায়, তা হলে তার সমস্ত পুণ্য ক্ষয় হয়।”
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষাষ্টকের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে, তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা / অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়ঃ সদা হরিঃ। অর্থাৎ, ভগবদ্ভক্তের কর্তব্য হচ্ছে, “তৃণের থেকেও নম্র এবং একটি গাছের থেকেও বেশি সহনশীল হয়ে, নিজের জন্য কোন রকম সম্মানের প্রত্যাশা না করে, অপরকে সম্মান প্রদর্শন করা।”
ভক্তরূপে এত দীন ও বিনম্র হওয়া সত্ত্বেও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখন শুনলেন যে, পাষণ্ডী জগাই-মাধাই নিত্যানন্দ প্রভুকে আঘাত করেছে, তখন তিনি তৎক্ষণাৎ সেখানে গিয়ে তাদের নিধন করতে উদ্যত হয়েছিলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর এই আচরণ অত্যন্ত মহত্ত্বপূর্ণ। এর থেকে বোঝা যায় যে, ভক্ত নিজের সম্বন্ধে সর্বদাই নিরভিমান,
সহিষ্ণু ও বিনীত হতে পারেন, কিন্তু যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অথবা তাঁর ভক্তের কোন রকম অবমাননা হয়, তখন তিনি তা সহ্য করেন না।
এই রকম অপমানের তিন রকম প্রতিকার হতে পারে। কেউ যদি বাণীর দ্বারা নিন্দা করে তা হলে ভক্তকে এতই দক্ষ হওয়া উচিত যে, তিনি প্রতিপক্ষকে তর্কের দ্বারা নিরস্ত করতে পারেন। যদি তা না পারেন, তা হলে দীনভাবে সেখানে দাঁড়িয়ে বিষ্ণু-বৈষ্ণব নিন্দা শোনার থেকে বরং আত্মহত্যা করা ভাল।
যদি তাও সম্ভব না হয়, তা হলে সেই স্থান ত্যাগ করে চলে যাওয়া উচিত। যদি এই তিনটি আচারের কোনটিই তিনি পালন না করতে পারেন, তা হলে ভগবদ্ভক্তির মার্গ থেকে তাঁর পতন হয়।
তিলক ও তুলসীমালা ধারণ
পদ্ম-পুরাণে উল্লেখ করা হয়েছে, কিভাবে তিলক ও কণ্ঠিমালার দ্বারা বৈষ্ণব-শরীর বিভূষিত হওয়া উচিত। “যিনি কণ্ঠে তুলসীমালা ধারণ করেন, যাঁর শরীরে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম—এই বিষ্ণুচিহ্ন সহ দ্বাদশ অঙ্গে বিষ্ণুমন্দির অঙ্কিত হয়, যিনি মস্তকে বৈষ্ণব তিলক ধারণ করেন, তিনিই এই জগতে বিষ্ণুভক্ত অর্থাৎ বৈষ্ণব। এই বৈষ্ণবদের উপস্থিতির ফলে জগৎ পবিত্র হয়। তিনি যেখানে অবস্থান করেন, সেই স্থান বৈকুণ্ঠে পরিণত হয়।”
স্কন্দ-পুরাণেও এই ভাবে বলা হয়েছে, “যিনি তিলক অথবা গোপীচন্দনের দ্বারা বিভূষিত হয়ে সমস্ত শরীরে ভগবানের নাম ধারণ করেন এবং যাঁর কণ্ঠে ও বক্ষঃস্থলে তুলসীমালা থাকে, সেই বৈষ্ণবদের কাছে যমদূত আসতে পারে না।” যমদূতেরা হচ্ছে পাপীদের দণ্ডদাতা ও মৃত্যুর দেবতা যমরাজের অনুচর।
বৈষ্ণবেরা কখনও এই ধরনের যমদূতদের আয়ত্তাধীন নন। শ্রীমদ্ভাগবতে অজামিল উদ্ধার পর্বে বলা হয়েছে যে, যমরাজ তাঁর দূতদের স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, কখনও বৈষ্ণবদের কাছে না যেতে। বৈষ্ণবেরা যমরাজের নিয়ন্ত্রণাধীন নন।
পদ্ম-পুরাণেও বলা হয়েছে, “যে মানুষের শরীর চন্দন ও ভগবানের দিব্য নামের দ্বারা বিভূষিত, তিনি সব রকম পাপ থেকে মুক্ত হয়েছেন, এবং তাঁর মৃত্যুর পর তিনি পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গলাভ করার জন্য কৃষ্ণলোকে প্রবিষ্ট হন।”
পুষ্পমাল্য ধারণ
শ্রীমদ্ভাগবতের পরবর্তী নির্দেশটি হচ্ছে যে, ভগবানকে নিবেদিত পুষ্পমাল্য ধারণ করা উচিত। এই সম্পর্কে শ্রীমদ্ভাগবতের একাদশ স্কন্ধে (১১/৬/৪৬) উদ্ধব শ্রীকৃষ্ণকে বলছেন, “হে গোবিন্দ! তোমার ব্যবহৃত ফুলমালা, গন্ধদ্রব্য, বস্ত্র ও অলঙ্কার আমি গ্রহণ করি, এবং কেবল তোমার উচ্ছিষ্ট ভোগ করি, কেন না আমি হচ্ছি তোমার নিত্য দাস।
তাই আমি সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, মায়ার দ্বারা আমি আক্রান্ত হব না।” এই শ্লোকের তাৎপর্য হচ্ছে, যে মানুষ গোপীচন্দন অর্থাৎ চন্দনের তিলক ধারণ করেন এবং শ্রীকৃষ্ণের নির্মাল্য ধারণ করেন, তিনি কখনও মায়ার দ্বারা বশীভূত হন না।
মৃত্যুকালে যমদূতেরা তাঁদের কাছে আসতে পারে না। এমন কি, কেউ যদি সব রকম বৈষ্ণব আচারগুলি পালন না করেও কেবল কৃষ্ণপ্রসাদ গ্রহণ করেন, তা হলেও তিনি অচিরেই বৈষ্ণবত্ব লাভ করবেন।
তেমনই, স্কন্দ পুরাণেও ব্রহ্মা নারদকে বলছেন, “হে নারদ! যে মানুষ শ্রীকৃষ্ণের প্রসাদী মালা কণ্ঠে ধারণ করেন, তিনি সব রকম পাপ ও রোগ থেকে মুক্ত হয়ে ক্রমশ জড়া প্রকৃতির কলুষ থেকে মুক্ত হন।”
শ্রীমূর্তির সম্মুখে নৃত্য
দ্বারকা-মাহাত্ম্যে শ্রীমূর্তির সম্মুখে নৃত্য করার মহিমা বর্ণনা করে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, “যে মানুষ প্রসন্ন চিত্তে ভক্তিপূর্বক আমার সামনে নৃত্য
করতে করতে শরীরের ভঙ্গিমার দ্বারা অন্তরের বিভিন্ন ভাব প্রকাশ করেন, তাঁর কোটি কোটি জন্মের সঞ্চিত পাপ বিনষ্ট হয়ে যায়।” এই গ্রন্থেই দেবর্ষি নারদ বলেছেন, “দিব্য ভাব প্রকাশ করে যিনি ভগবানের শ্রীবিগ্রহের সম্মুখে নৃত্য করেন এবং করতালি দেন, তাঁর শরীর থেকে পাতকরূপী সমস্ত পক্ষী উড়ে চলে যায়।”
তালি দিলে যেমন পাখিরা উড়ে যায়, তেমনই শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহের সম্মুখে নৃত্য করলে এবং করতালি দিলে শরীর থেকে পাতকরূপী সমস্ত পক্ষীকে উড়িয়ে দেওয়া যায়।
শ্রীবিগ্রহকে সম্মান সহকারে দণ্ডবৎ প্রণাম
নারদীয়-পুরাণে শ্রীবিগ্রহকে সম্মান প্রদর্শন ও দণ্ডবৎ প্রণতি সম্বন্ধে বলা হয়েছে, “যিনি প্রভূত পুণ্যকর্ম আচরণ করেছেন এবং যে মানুষ কেবল শ্রদ্ধা সহকারে পরমেশ্বর ভগবানকে প্রণতি জানিয়েছেন, তাঁরা সম-পর্যায়ভুক্ত নন।” যে মানুষ বহু যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠান করেছেন, তিনি পুণ্যফল লাভ করবেন।
কিন্তু সেই সমস্ত পুণ্যের ফল যখন শেষ হয়ে যায়, তখন তাকে আবার এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করতে হয়, কিন্তু যে মানুষ কেবল একবার শ্রদ্ধা সহকারে ভগবানের শ্রীবিগ্রহকে প্রণতি নিবেদন করেছেন, তাঁকে আর কখনও এই জগতে ফিরে আসতে হবে না, কেন না তিনি সরাসরিভাবে কৃষ্ণলোকে উন্নীত হবেন।
ভগবানকে স্বাগত জানাতে দণ্ডায়মান হওয়া
ব্রহ্মাণ্ড-পুরাণে বলা হয়েছে, “যিনি ভগবানের রথযাত্রার সময় রথে করে তাঁকে আসতে দেখেন এবং তাঁকে স্বাগত জানাবার জন্য দণ্ডায়মান হন, তার শরীর থেকে সমস্ত পাপ বিনষ্ট হয়ে যায়।”
শ্রীমূর্তির অনুগমন
এই ধরনের একটি উক্তি ভবিষ্য পুরাণে রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, “নীচ-কুলোদ্ভূত কোন মানুষও যদি রথের সম্মুখে থেকে অথবা পশ্চাদ্ভাগ থেকে রথের অনুগমন করেন, তা হলে অবশ্যই তিনি শ্রীবিষ্ণুর মতো ঐশ্বর্য প্রাপ্ত হন।”
বিষ্ণুমন্দির অথবা তীর্থে গমন
পুরাণে বলা হয়েছে, “বৃন্দাবন, মথুরা, দ্বারকা আদি পুণ্যভূমিতে যাঁরা গমন করেছেন, তাঁরা ধন্য। তাঁরা অনায়াসে সংসাররূপ মরুভূমি পার হয়ে যান।”
হরিভক্তি-সুধোদয়ে শ্রীকৃষ্ণের মন্দিরে যাওয়ার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। পূর্বে বৃন্দাবন, মথুরা ও দ্বারকায় যাওয়ার যে মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে, সেই সমস্ত পুণ্যভূমিতে ভক্তরা ভগবানের মন্দিরে ভগবানকে দর্শন করার সুযোগ পান।
হরিভক্তি-সুধোদয়ে বলা হয়েছে, “যে সমস্ত মানুষ শুদ্ধ কৃষ্ণভক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন এবং যাঁরা ভগবানের মন্দিরে ভগবানের শ্রীবিগ্রহ দর্শন করতে যান, তাঁদের কখনও মাতৃগর্ভরূপী কারাগারে প্রবেশ করতে হয় না।”
মাতৃগর্ভে অবস্থান করা অত্যন্ত বেদনাদায়ক, কিন্তু বদ্ধ জীব জন্মের পর সেই বেদনাদায়ক স্থার কথা ভুলে যায়। শাস্ত্রে জড় জগতের দুঃখময় অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য প্রত্যেককে ভক্তি সহকারে ভগবানের মন্দিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তার ফলে অনায়াসে এই জড় জগতের দুঃখময় পুনর্জন্ম থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
বিষ্ণুমন্দির পরিক্রমা
হরিভক্তি-সুধোদয়ে বলা হয়েছে, “যে মানুষ বিষ্ণুমূর্তির পরিক্রমা করেন, তিনি এই জড় জগতে জন্ম-মৃত্যুর চক্রকে প্রতিহত করে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হন।” ভবরোগের ফলে বদ্ধ জীব নিরন্তর জন্ম মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হয়, কিন্তু বিষ্ণুমন্দির প্রদক্ষিণ করার ফলে সেই আবর্তন থেকে মুক্ত হওয়া যায়।
ভারতবর্ষে বর্ষাকালের চারটি মাস (শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক) কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের জন্য এক স্থান থেকে আর এক স্থানে ভ্রাম্যমান সাধুরা তাদের ভ্রমণ স্থগিত রেখে কোন পুণ্যস্থানে অবস্থান করেন। এই সময় কতকগুলি বিশেষ বিধি-নিষেধ অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে পালন করা হয়।
স্কন্দ পুরাণে বলা হয়েছে যে, সেই সময়ে কেউ যদি অন্তত চারবার বিষ্ণুমন্দির প্রদক্ষিণ করেন, তা হলে বুঝতে হবে যে, তিনি সমস্ত ব্রহ্মাও ভ্রমণ করেছেন। এই ধরনের পরিক্রমার ফলে গঙ্গার জলের দ্বারা নিম্নাত সমস্ত পুণ্যতীর্থ দর্শন করা হয়ে যায়, এবং চাতুর্মাস্য ব্রত পালন করার ফলে অনায়াসে ভগবদ্ভক্তির স্তরে উন্নীত হওয়া যায়।
অৰ্চনা
অৰ্চনা মানে মন্দিরে ভগবানের শ্রীবিগ্রহের পূজা করা। ভক্তির এই অঙ্গ অনুশীলন করার ফলে বুঝতে পারা যায় যে, আমরা এই শরীর নই, আমাদের স্বরূপে আমরা চিন্ময় আত্মা। শ্রীমদ্ভাগবতের দশম ঋন্ধে (১০/৮১/১৯) বর্ণনা করা হয়েছে যে, কৃষ্ণের অন্তরঙ্গ সথা সুদামা ব্রাহ্মণদের গৃহে গিয়ে স্বগতোক্তি করে বলেছিলেন,
“কেবলমাত্র কৃষ্ণের অর্ধনা করার ফলে অনায়াসে স্বর্গের সমস্ত ঐশ্বর্য প্রাপ্ত হওয়া যায়, মোক্ষলাভ করা যায়, এই ব্রহ্মাণ্ডের সার্বভৌমত্ব লাভকরা যায়, জড় জগতের সমস্ত ঐশ্বর্য লাভ করা যায় এবং যোগসিদ্ধি লাভ করা যায়।”
সুদামার এই স্বগতোক্তির কারণ হচ্ছে—শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সখা সুদামাকে ব্রাহ্মণদের গৃহে গিয়ে কিছু আহার্য ভিক্ষা করার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। সেই সময় ব্রাহ্মণেরা যজ্ঞ-অনুষ্ঠান করছিলেন এবং শ্রীকৃষ্ণ সুদামাকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিলেন যে, কৃষ্ণ ও বলরাম অত্যন্ত ক্ষুধার্ত, তাই তাঁদের জন্য কিছু আহার্যের প্রয়োজন।
কিন্তু সেখানে গেলে পরে ব্রাহ্মণেরা সুদামাকে কোন কিছু দিতে অস্বীকার করে। কিন্তু ব্রাহ্মণ-পত্নীরা যখন শুনলেন যে, কৃষ্ণ ও বলরাম কিছু খাবার চেয়ে পাঠিয়েছেন, তৎক্ষণাৎ তাঁরা নানা রকম উপাদেয় খাদ্যদ্রব্য নিয়ে নিজেরাই রওনা হলেন কৃষ্ণ-বলরামকে নিবেদন করার জন্য। বিষ্ণু রহস্যেও বলা হয়েছে, “এই জগতে যে মানুষ পরমেশ্বর শ্রীবিষ্ণুর আরাধনা করছেন, তিনি অনায়াসে নিত্য আনন্দময় ভগবৎ-ধাম বৈকুণ্ঠলোকে প্রবেশ করতে পারেন।”
ভগবানের পরিচর্যা
বিষ্ণু-রহস্যে বলা হয়েছে, “রাজার পরিচারকেরা যেভাবে রাজার সেবা করে, ঠিক সেইভাবে যদি কোন মানুষ ভগবানের সেবা করেন, তা হলে অবশ্যই তিনি দেহত্যাগের পর কৃষ্ণলোকে উন্নীত হবেন।” প্রকৃতপক্ষে, ভারতবর্ষে ভগবানের মন্দিরগুলি ঠিক রাজপ্রাসাদের মতো।
সেগুলি কোন সাধারণ বাড়ি নয়, কেন না রাজা যেভাবে তাঁর প্রাসাদে সেবিত হন, কৃষ্ণরে ঠিক সেইভাবে সেবা করা উচিত। তাই বৃন্দাবনে শত শত মন্দিরে রাজকীয়ভাবে ভগবানের শ্রীবিগ্রহের আরাধনা করা হয়। নারদীয় পুরাণে বলা হয়েছে, “কেউ যদি কেবল কয়েক মুহূর্তের জন্য ভগবানের মন্দিরে থাকেন, তা হলে অবশ্যই তিনি ভগবৎ-ধাম প্রাপ্ত হবেন।”
সুতরাং এর সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, সমাজে যারা বিত্তবান, তাঁদের কর্তব্য হচ্ছে ভগবানের জন্য সুন্দর সুন্দর মন্দির তৈরি করা, এবং তাঁর পূজার আয়োজন করা, যাতে মানুষ সেই মন্দিরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ভগবানের দিব্যনাম কীর্তন করে, ভগবানের শ্রীবিগ্রহের সম্মুখে আনন্দে মগ্ন হয়ে নৃত্য করতে পারে, অথবা ভগবানের দিব্যনাম শ্রবণ করতে পারে।
এইভাবে সকলেই ভগবৎ-ধামে উন্নীত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করতে পারে। পক্ষান্তরে বলা যায়, কোন সাধারণ মানুষও যদি ভগবানের মন্দিরে যান, তা হলে তিনি অনায়াসে পরম সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারেন। সুতরাং যে সমস্ত ভগবদ্ভক্ত নিরন্তর পূর্ণ কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে ভগবানের সেবায় রত, তাঁদের সৌভাগ্যের কথা কে অনুমান করতে পারে?
এই সম্পর্কে শ্রীমদ্ভাগবতের চতুর্থ স্কন্ধে (৪/২১/৩১) মহারাজ পৃথু তাঁর প্রজাদের বলছেন, “হে প্রজাগণ, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরি হচ্ছেন সমস্ত অধঃপতিত জীবের প্রকৃত ত্রাণকর্তা। কোন দেবতা বন্ধ জীবকে মুক্ত করতে পারেন না, কেন না তাঁরা নিজেরাই হচ্ছেন বদ্ধ। কোন বদ্ধ সত্তার পক্ষে অপর কোন বদ্ধ সত্তাকে মুক্ত করা সম্ভব নয়।
কেবল পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং অথবা তাঁর যথার্থ প্রতিনিধিই বদ্ধ জীবকে মুক্ত করতে পারেন। ভগবান শ্রীবিষ্ণুর পদনখ থেকে গঙ্গা উদ্গত হয়ে এই পৃথিবী ও অন্য সমস্ত গ্রহগুলিতে প্রবাহিত হয়ে পাপপঙ্কিল জীবসমূহকে উদ্ধার করছেন। সুতরাং, যে মানুষ নিরন্তর ভগবানের সেবায় যুক্ত, তাঁর মুক্তির কথা নিয়ে কিছু বলার কি প্রয়োজন?
তাঁদের মুক্তি সম্বন্ধে কোন সন্দেহই নেই। তাঁদের পূর্বজন্মে যদি রাশিকৃত পাপও সঞ্চিত হয়ে থাকে, তা হলেও তাতে কিছু যায় আসে না।” পক্ষান্তরে বলা যায়, যে মানুষ ভগবানের সেবায় যুক্ত হয়েছেন, তাঁর জন্ম-জন্মান্তরের সমস্ত পাপফল অচিরেই বিনষ্ট হয়।
ভগবানের আরাধনা করার পন্থা পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে এবং নিষ্ঠা সহকারে সেই সমস্ত বিধি-নিষেধগুলি অনুসরণ করার চেষ্টা করা উচিত।
কীর্তন
লিঙ্গ-পুরাণে ভগবানের মহিমা কীর্তন সম্বন্ধে বলা হয়েছে, “ভগবানের মহিমা নিরন্তর কীর্তনকারী ব্রাহ্মণ অবশ্যই কৃষ্ণলোক প্রাপ্ত হন। দেবাদিদেব মহাদেবের স্তুতি থেকেও এই কীর্তন শ্রীকৃষ্ণের অধিক প্রিয়।”
সংকীর্তন
কেউ যদি উচ্চৈঃস্বরে ভগবানের লীলা, গুণ, রূপ আদির মহিমা কীর্তন করেন, তাকে বলা হয় সংকীর্তন। সংকীর্তন বলতে সমবেতভাবে ভগবানের দিব্য নাম কীর্তনকে বোঝায়।
বিষ্ণুধর্মে এই সংকীর্তনের মহিমা বর্ণনা করে বলা হয়েছে, “এই কৃষ্ণনাম এতই পবিত্র যে, এই নাম কীর্তনের ফলে তৎক্ষণাৎ জন্ম জন্মান্তরের পুঞ্জীভূত পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়।” এই কথাটি ধ্রুব সত্য। চৈতন্য-চরিতামৃতে উল্লেখ করা হয়েছে, “কেউ যদি একবার মাত্র কৃষ্ণনাম উচ্চারণ করেন, তা হলে তাঁর এত পাপ নাশ হয় যে, তত পাপ করার সাধ্য কোন পাপীর নেই।”
কোন পাপী অসংখ্য পাপকর্ম করতে পারে, কিন্তু একবার মাত্র কৃষ্ণনাম উচ্চারণের ফলে যত পাপ ক্ষয় হয়, তত পাপ করার ক্ষমতা কোন পাপীর নেই।
শ্রীমদ্ভাগবতের সপ্তম স্কন্ধে (৭/৯/১৮) প্রহ্লাদ মহারাজ ভগবানের শ্রীপাদপদ্মে প্রার্থনা করেছেন, “হে নৃসিংহদেব! আমি যদি আপনার চরণ-কমলের দাসত্ব লাভ করতে পারি, তা হলে আমার পক্ষে আপনার লীলা শ্রবণ করা সম্ভব হবে। আপনিই হচ্ছেন পরম সুহৃৎ, পরম আরাধ্য ভগবান।
আপনার দিব্য লীলাসমূহ শ্রবণ করা মাত্র সমস্ত পাপ দূর হয়ে যায়। তাই সেই সমস্ত পাপকর্মকে আমি আর ভয়করি না, কারণ আপনার লীলাসমূহ শ্রবণ করার ফলে আমি অনায়াসে জড় জগতের সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত হতে পারব।”
ভগবানের লীলা সম্বন্ধীয় বহু গান রয়েছে। যেমন, ব্রহ্মা ব্রহ্ম সংহিতায় গেয়েছেন, নারদ মুনি নারদ-পঞ্চরাত্রে গেয়েছেন, এবং শুকদেব গোস্বামী শ্রীমদ্ভাগবতে গেয়েছেন। কোন মানুষ যদি এই সমস্ত সঙ্গীত শ্রবণ করেন, তা হলে তিনি অনায়াসে জড়-জগতের কলুষিত বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারেন।
ভগবানের মহিমা কীর্তনকারী এই সমস্ত সঙ্গীত শ্রবণ করা অত্যন্ত সহজ। কোটি কোটি বছর ধরে এই সমস্ত সঙ্গীত গান করা হচ্ছে এবং আজও মানুষ সেগুলি গাইছে। সুতরাং এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে কেন মানুষ জড় জগতের কলুষিত বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করবে না?
শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম স্কন্ধে (১/৫/২২) নারদ মুনি তাঁর শিষ্য ব্যাসদেবকে বলছেন, “হে ব্যাস! জেনে রাখ যে, তপ, ত্যাগ, বেদ অধ্যয়ন, যজ্ঞানুষ্ঠান, বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ, দান আদি পুণ্য কর্মগুলির একমাত্র পরম ফল হচ্ছে ভক্তসঙ্গে ভগবানের মহিমা কীর্তন করা।” এখানে বোঝানো হয়েছে যে, ভগবানের মহিমা কীর্তন হচ্ছে জীবের সর্বশ্রেষ্ঠ কার্য।
জপ
মৃদুমন্দ স্বরে মন্ত্র উচ্চারণ করাকে বলা হয় জপ, এবং উচ্চৈঃস্বরে মন্ত্র উচ্চারণ করাকে বলা হয় কীর্তন। যেমন, মহামন্ত্র (হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ॥) যখন কেবল নিজের শোনার জন্য আস্তে আস্তে উচ্চারণ করা হয়, তখন তাকে বলা হয় জপ। সেই মন্ত্রই যখন সকলের শোনারজন্য উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারণ করা হয়, তখন তাকে বলা হয় কীর্তন।
মহামন্ত্র জপ ও কীর্তন দুটিই করা যায়। জপের ফলে কেবল নিজেরই লাভ হয়, কিন্তু কীর্তনের ফলে শ্রবণকারী সহ সকলেরই কল্যাণ হয়।
পদ্ম-পুরাণে বলা হয়েছে, “যে মানুষ ভগবানের দিব্য নাম জপ অথবা কীর্তন করেন, তাঁর কাছে স্বর্গসুখ ও মোক্ষ লাভের পন্থা তৎক্ষণাৎ উন্মুক্ত হয়।”
আত্মনিবেদন
স্কন্দ পুরাণে ভগবানের শ্রীপাদপদ্মে আত্মনিবেদন সম্বন্ধে নিম্নলিখিত তিনটি পন্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে (১) সম্প্ৰাৰ্থনাত্মিকা—গভীর আবেগের সঙ্গে ভগবানের প্রার্থনা করা;
(২) দৈন্যবোধিকা—দীনভাবে ভগবানের শরণাগত হওয়া; (৩) লালসাময়ী সিদ্ধি লাভের অভিলাষী হওয়া। পারমার্থিক সিদ্ধি লাভের এই প্রচেষ্টা ইন্দ্রিয়তৃপ্তি নয়। মানুষ যখন পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে তাঁর নিত্য সম্পর্কের কথা অবগত হন, তখন তিনি বুঝতে পারেন যে, শ্রীকৃষ্ণের দাসরূপে, সখারূপে, পিতা-মাতারূপে অথবা প্রেমিকারূপে তাঁর যে পরিচয়, সেটিই হচ্ছে যথার্থ স্বরূপ।
একে বলা হয় লালসাময়ী, অথবা নিজের যথার্থ স্বরূপে অধিষ্ঠিত হওয়ার ঐকান্তিক বাসনা। আত্মনিবেদনের এই লালসাময়ী স্তর হচ্ছে যথার্থ মুক্তির স্তর, যাকে বলা হয় স্বরূপসিদ্ধি—জীব তখন আত্মজ্ঞান লাভ করে ভগবানের সঙ্গে তার প্রকৃত সম্পর্কের কথা জানতে পারে।
পদ্ম-পুরাণে ঐকান্তিকভাবে আত্মনিবেদনের ভাব প্রকাশিত হয়েছে ভগবানের প্রতি ভক্তের প্রার্থনায়, “হে প্রভু! যুবতীরা যেমন স্বাভাবিকভাবে যুবকদের প্রতি আকৃষ্ট হয়, এবং যুবকেরাও যেমনস্বাভাবিকভাবে যুবতীদের প্রতি আকৃষ্ট হয়, আমি প্রার্থনা করি, আমার মন যেন ঠিক সেইভাবে আপনার প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে।”
এই দৃষ্টান্তটি অত্যন্ত সুন্দর। যুবক-যুবতীরা পরস্পরকে দর্শন করে পরিচয় ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে আকৃষ্ট হয়। যৌন আবেদনের ফলে কোন রকম শিক্ষা ব্যতীত স্বাভাবিকভাবেই এই আকর্ষণ দেখা দেয়। এটি অবশ্য একটি জড় দৃষ্টান্ত, কিন্তু ভক্ত ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন যাতে তিনি তেমনই স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কোন রকম লাভ-ক্ষতির বিচার বা অন্য কারণ ব্যতীতই পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারেন।
ভগবানের প্রতি এই স্বাভাবিক আকর্ষণ হচ্ছে আত্মনিবেদনের চরম প্রকাশ।পদ্ম-পুরাণের আর একটি জায়গায় দৈন্যভাবে আত্মনিবেদনের প্রার্থনা বর্ণনা করা হয়েছে—“হে প্রিয় প্রভু, আমার থেকে পাপী আর কেউ নেই। আমার থেকে বড় অপরাধীও কেউ নেই। আমি এত পাপী ও এত অপরাধী যে, আপনার সামনে সেই পাপের কথা স্বীকার করতে এসে আমার অত্যন্ত লজ্জা হয়।”
এটি ভক্তের স্বাভাবিক অবস্থা। বদ্ধ জীব মাত্রই পূর্বজীবনে কিছু না কিছু পাপকর্ম করেছে, এবং ভগবানের সামনে সেই সমস্ত পাপের কথা স্বীকার করা উচিত। তা যখন করা হয়, পরমেশ্বর ভগবান তখন ঐকান্তিক ভক্তকে ক্ষমা করেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আমরা ভগবানের এই অহৈতুকী কৃপার সুযোগ নিয়ে পাপ করে যেতে থাকব এবং আশা করব যে, তিনি আমাদের পাপ বারবার মোচন করতে থাকবেন।
এটি হচ্ছে নির্লজ্জ মানুষদের মনোবৃত্তি। এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “আমি যখন আমার পাপকর্মের কথা স্বীকার করতে আসি, তখন আমি অত্যন্ত লজ্জিত হই।” সুতরাং, কেউ যদি তার পাপের জন্য লজ্জাবোধ না করে এবং পাপ স্বীকার করে নিলে ভগবান পাপমোচন করবেন, এই কথা জেনে ক্রমান্বয়ে সে একই পাপ করে যেতে থাকে, সেটিচরম নির্লজ্জতার প্রকাশ। এই ধারণা বৈদিক শাস্ত্রে স্থান পায়নি।
ভগবানের দিব্য নাম উচ্চারণ করার ফলে যে পূর্বকৃত সমস্ত পাপের মোচন হয়, সেই সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, পাপমুক্ত হওয়ার পর আমরা আবার সেই পাপ করতে শুরু করব এবং আশা করব যে, ভগবানের দিব্য নামের প্রভাবে এই পাপ মোচন হয়ে যাবে।
এই ধরনের ধারণাগুলি সম্পূর্ণ অর্থহীন এবং ভগবদ্ভক্তিতে এর কোন স্থান নেই। কেউ মনে করতে পারে, “সারা সপ্তাহ ধরে আমি পাপ করে যাব আর সপ্তাহে একদিন মাত্র ভগবানের মন্দিরে অথবা গির্জায় গিয়ে ভগবানের কাছে আমার পাপের স্বীকারোক্তি দিয়ে আসব, যাতে সেই পাপ মোচন হয়ে যায় এবং তারপর আবার পাপ করতে শুরু করব।”
এটি সম্পূর্ণ অর্থহীন এবং অপরাধজনক ধারণা, এবং ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থের প্রণেতা সেই মনোভাবের স্বীকৃতি দেননি।
নারদ-পঞ্চরাত্রে স্বরূপসিদ্ধি কামনা করে আত্মনিবেদনের বর্ণনা করা হয়েছে। ভক্ত বলছেন, “হে প্রিয় প্রভু, সেই দিন করে আসবে যখন তুমি আমাকে চামর ঢুলাতে বলবে, এবং তোমার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য তুমি বলবে, ‘এইভাবে আমাকে বাতাস করো।”
এই শ্লোকের তাৎপর্য হচ্ছে যে, ভক্ত ব্যক্তিগতভাবে চামর ব্যজন করে ভগবানের সেবা করতে চাইছেন, অর্থাৎ ভগবানের নিজের পার্ষদ হওয়ার অভিলাষ করছেন। নিঃসন্দেহে দাস, সখা অথবা প্রেমিকরূপে প্রত্যেক ভক্ত সর্বদাই ভগবানের সান্নিধ্যে থাকেন।
নিজের রুচি অনুসারে তিনি কোন একভাবে ভগবানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার অভিলাষ করেন। এখানে ভক্ত ভগবানের দাস হয়ে তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তি লক্ষ্মীদেবীর মতো । চামর ব্যজন করে তাঁর সেবা করতে চাইছেন। এখানে ভক্ত আরও অভিলাষ করেছেন যে, ভগবান যেন প্রসন্ন হয়ে ‘এইভাবে চামর ব্যজন করো' বলে তাঁকে আদেশ দেন। এই দিব্য অভিলাষ অথবা লালসাময়ী বিজ্ঞপ্তি হচ্ছে স্বরূপ উপলব্ধির চরম স্তর।
নারদ-পঞ্চরাত্রে আর এক জায়গায় আত্মনিবেদনের প্রার্থনা করে ভক্ত বলছেন, “হে প্রিয় প্রভু! সেই দিন করে আসবে যখন যমুনার তটে তোমার নাম কীর্তন করতে করতে আমার দুই চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়বে এবং ভাবোন্মত্ত হয়ে আমি নৃত্য করব?”
এটিও হচ্ছে সিদ্ধ অবস্থার প্রকাশ। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও সেই অভিলাষ প্রকাশ করে বলেছেন—যুগায়িতং নিমেষেণ চক্ষুষা প্রাকৃষায়িতম্। শূন্যায়িতং জগৎ সর্বং গোবিন্দবিরহেণ মে। অর্থাৎ, “হে গোবিন্দ ! তোমার বিরহে এক-একটি মুহূর্তকে এক যুগ বলে মনে হচ্ছে, এবং সমস্ত জগৎ শূন্য বলে মনে হচ্ছে।”
অনুভূতি সহকারে এইভাবে প্রার্থনা করা উচিত এবং নিজের রুচি অনুসারে ভগবানের সেবা করতে উৎসুক হওয়া উচিত। সেটি হচ্ছে সমস্ত মহান আচার্যদের শিক্ষা, বিশেষ করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা।
পক্ষান্তরে বলা যায় যে, ভগবানের জন্য আকুল হয়ে ক্রন্দন করতে শিখতে হবে। কোন বিশেষভাবে ভগবানের সেবায় যুক্ত হওয়ার জন্য ঐকান্তিকভাবে ক্রন্দন করতে হবে। একে বলা হয় লৌল্যম্, এবং এই অশ্রু হচ্ছে পরম সিদ্ধি লাভের মূল্য।
কারও অন্তরে যদি এই লৌলাম্ প্রকাশিত হয় অথবা ভগবানের সঙ্গে মিলিত হওয়ার এবং কোন বিশেষভাবে তাঁর সেবা করার ঐকান্তিক আগ্রহ প্রকাশিত হয়, সেটি হচ্ছে ভগবানের রাজ্যে প্রবেশ করার মূল্য। এ ছাড়া কোন জড় হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে ভগবানের রাজ্যে প্রবেশ করার প্রবেশপত্রের মূল্য নিরূপণ করা যায় না।
এই প্রবেশাধিকারের একমাত্র মূল্য হচ্ছে লৌলাম্ লালসাময়ী, অথবা গভীর আকাঙ্ক্ষা ও ঐকান্তিক বাসনা।
স্তব পাঠ
মনীষীদের মত অনুসারে ভগবদ্গীতা বহু প্রামাণিক স্তবে পরিপূর্ণ, বিশেষ করে একাদশ অধ্যায়ে। কারণ, সেখানে অর্জুন ভগবানের বিশ্বরূপ দর্শন করে তাঁর স্তব করেছিলেন। এইভাবে গৌতমীয়-তন্ত্রে সব কটি শ্লোকই হচ্ছে ভগবানের স্তব। শ্রীমদ্ভাগবতে তো ভগবানের শত শত স্তব রয়েছে।
ভক্তের উচিত এই সমস্ত শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে কিছু শ্লোক চয়ন করে প্রতিদিন তা পাঠ করা। স্কন্দ-পুরাণে বলা হয়েছে, “যাঁর জিহ্বা নিরন্তর শ্রীকৃষ্ণের স্তবরত্নের দ্বারা বিভূষিত, তিনি মুনি ঋষিদের নমস্য এবং দেবতাদেরও আরাধ্য।”
অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করার পরিবর্তে জগৎকে ভোগ করার বাসনায় বিভিন্ন দেব-দেবীদের পূজা করতে চায়। কিন্তু এখানে বলা হয়েছে, যে ভক্ত নিরন্তর ভগবানের স্তব করেন, তিনি দেবতাদেরও আরাধ্য। শুদ্ধ ভক্তের কোন দেব-দেবীর কাছ থেকে কিছু চাওয়ার থাকে না, বরং সমস্ত দেব-দেবীরাই শুদ্ধ ভক্তের আরাধনা করার জন্য উৎকণ্ঠিত থাকেন।
নৃসিংহ-পুরাণে বলা হয়েছে, “কোন ব্যক্তি যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহের সম্মুখে এসে বিভিন্ন স্তব পাঠ করেন, তিনি যে তৎক্ষণাৎ সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়ে বৈকুণ্ঠলোকে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।”
প্রসাদ সেবন
পদ্ম-পুরাণে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “ভগবানের শ্রীবিগ্রহ থেকে একটু দূরে গিয়ে যে মানুষ তুলসী ও চরণামৃতযুক্ত ভগবানের প্রসাদ নিয়মিত সেবন করেন, তিনি তৎক্ষণাৎ কোটি কোটি যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার পুণ্য অর্জন করেন।”
চরণামৃত পান
সকালবেলায় ভগবানকে শৃঙ্গার করার আগে ভগবানকে যে স্নান করানো হয়, সেই স্নানের জল হচ্ছে চরণামৃত। গন্ধ ও পুষ্পসহ সেই জল ভগবানের শ্রীপাদপদ্ম বেয়ে নেমে আসে এবং তা এক জায়গায় সংগ্রহ করে তার সঙ্গে দধি মেশানো হয়।
এইভাবে চরণামৃত অতি মধুর আস্বাদপূর্ণ তো হয়ই, উপরন্তু তাতে প্রবল পারমার্থিক মাহাত্ম্য নিহিত থাকে। পদ্ম-পুরাণের বর্ণনা অনুসারে, যে মানুষ কোন দিনও দান, যজ্ঞ, স্বাধ্যায়, অৰ্চন আদি কোন রকম পুণ্যকর্ম করেনি, সে-ও ভগবানের মন্দিরে গিয়ে চরণামৃত পান করে পরম ধামে প্রবেশ করার যোগ্য হয়। মন্দিরে চরণামৃত বড় পাত্রে রাখার প্রথা আছে। ভগবানের শ্রীবিগ্রহ দর্শন ও অভিবাদন করতে এসে ভক্ত নম্রভাবে এই চরণামৃতের তিনটি বিন্দু পান করে পরমানন্দ লাভ করেন।
অর্পিত ধূপ ও পুষ্পের সৌরভ আঘ্রাণ
হরিভক্তি-সুধোদয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, “কোন বিশেষ ওষধি। আঘ্রাণ করার ফলে যেমন সাপের বিষ কেটে যায়, তেমনই ভগবানকে অর্পিত সুগন্ধি পুষ্প আঘ্রাণ করার ফলে জড় বিষয়ের বিষময়ী প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত হওয়া যায়।”
জঙ্গলে এক রকম ওষধি পাওয়া যায়, যা সাপুড়েরা সর্প দংশনে অচেতন মানুষের চেতনা ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যবহার করেন। কেবলমাত্র সেই ওষধি আগ্রাণ করার ফলে সাপের বিষের প্রতিক্রিয়া তৎক্ষণাৎ নষ্ট হয়ে যায়। তেমনই, কোন মানুষ যখন মন্দিরে এসে ভগবানকে নিবেদিত সুগন্ধি পুষ্প ও ধূপ আঘ্রাণ করেন, তখন তিনি সমস্ত জড় কলুষ থেকে মুক্ত হন।
মন্দিরে গিয়ে ভক্তের উচিত ফল, ফুল, ধূপ ইত্যাদি কোন না কোন পদার্থ ভগবানকে অবশ্যই অর্পণ করা। ধন দান করার সামর্থ্য যদি না থাকে, তা হলে অন্য কিছু ভগবানকে নিবেদন করা যায়। সকালবেলায় মন্দিরে গিয়ে মানুষ নানা রকম উপঢৌকন ভগবানকে দেন।
বিশেষ কিছু না দিতে পারলেও অন্তত একমুঠো চাল ভগবানকে নিবেদন করা যায়। শাস্ত্রের বিধি হচ্ছে, কোন রকম উপঢৌকন না নিয়ে সাধুসন্ত অথবা মন্দিরে ভগবানের শ্রীমূর্তি দর্শন করতে যাওয়া উচিত নয়।
সেই নিবেদন যতই তুচ্ছ বা মূল্যহীন হোক, তাতে কিছু যায় আসে না। ফল, ফুল, জল ইত্যাদি যা পাওয়া যায়, তা-ই ভগবানকে অর্পণ করা উচিত। কোন ভক্ত যখন মন্দিরে ভগবানের দর্শনের জন্য যান, তখন তিনি অবশ্যই ধূপ আঘ্রাণ করবেন এবং তার ফলে তিনি ভবরোগের বিষ থেকে মুক্ত হবেন।
তন্ত্রশাস্ত্রে বলা হয়েছে, “ভগবানকে নিবেদিত ফুলের মালার সৌরভ যখন কোন মানুষের নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে, তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর সমস্ত পাপের বন্ধন থেকে মুক্ত হন। কেউ যদি কোন পাপকর্ম করেও থাকেন, কিন্তু তবুও কেবলমাত্র ভগবানকে নিবেদিত সুগন্ধি পুষ্প আঘ্রাণ করে, তিনি নির্বিশেষবাদের বিষময় প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে ভক্তে পরিণত হতে পারেন।”
এর অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। সনকাদি চার কুমারের ভগবৎ-ধামে উন্নতি তার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। এই চার কুমারেরা ছিলেন নির্বিশেষবাদী, কিন্তু ভগবানের মন্দিরে ভগবানকে নিবেদিত সুগন্ধি পুষ্প আঘ্রাণ করার ফলে, তাঁরা ভগবদ্ভক্তে পরিণত হন। উপরোক্ত এই শ্লোক থেকে বোঝা যায় যে, নির্বিশেষবাদী জ্ঞানীরাও কিছুমাত্রায় কলুষিত। তাঁরা সম্পূর্ণভাবে নির্মল নন।
শ্রীমদ্ভাগবতে সেই কথা প্রতিপন্ন হয়েছে, “যিনি সমস্ত পাপ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে পারেননি, তিনি ভক্ত হতে পারেন না। শুদ্ধ ভক্তের পরমেশ্বর ভগবানের ভগবত্তা সম্বন্ধে কোন রকম সন্দেহ থাকেনা, এবং তার ফলে তিনি নিরন্তর কৃষ্ণভাবনা ও ভক্তিযোগে যুক্ত থাকেন।”
অগস্ত্য-সংহিতাতেও এই রকম একটি বর্ণনা রয়েছে, ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের বিশুদ্ধিকরণের জন্য মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণকে অর্পিত পুষ্পের আঘ্রাণ নেওয়া উচিত।
শ্রীবিগ্রহ স্পর্শন
বিষ্ণুধর্মোত্তরে শ্রীমূর্তির চরণারবিন্দ স্পর্শ সম্বন্ধে বলা হয়েছে, “যে মানুষ বৈষ্ণব দীক্ষায় দীক্ষিত এবং কৃষ্ণভাবনাময়ে ভাবিত হয়ে ভগবানের সেবায় যুক্ত হয়েছেন, তিনিই কেবল ভগবানের শ্রীবিগ্রহ স্পর্শ করার অধিকারী।”
বৈদিক শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে শূদ্র, চণ্ডাল আদি অধম শ্রেণীর মানুষদের মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ। এই নিষেধ তাদের অশুদ্ধ আচরণের জন্য। কিন্তু গান্ধীর দ্বারা পরিচালিত রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় সেই বৈদিক পদ্ধতির বিরোধিতা করা হয়েছিল। অধম শ্রেণীর মানুষদের অশুদ্ধ আচরণের জন্য মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, সেই নীচ কুলোদ্ভূত মানুষেরা যদি শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তের সঙ্গের প্রভাবে ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করতে শুরু করে, তা হলে তারাও সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হতে পারে।
নীচকুলে জন্ম হওয়ার ফলে মানুষের মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ হচ্ছে না, তার নিষেধের কারণ হচ্ছে তার অশুদ্ধ আচরণ। তাই বিশুদ্ধিকরণের প্রক্রিয়া অবশ্যই অঙ্গীকার করতে হবে। গান্ধী কেবল তাদের পিঠে হরিজন ('ভগবানের সন্তান') ছাপ মেরে তাদের শুদ্ধিকরণ করতে চেয়েছিলেন, এবং তাই মন্দিরের ব্যবস্থাপক ও গান্ধীর অনুগামীদের মধ্যে প্রবল সংঘর্ষ বাধে।
কিন্তু শাস্ত্রের বিধান হচ্ছে—কেউ যদি কলুষমুক্ত হয়ে পবিত্র হয়, তা হলে সে মন্দিরে প্রবেশ করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, সেটিই হচ্ছেশাস্ত্রের নির্দেশ। যিনি যথাযথভাবে দীক্ষিত হয়েছেন, যিনি যথাযথভাবে শাস্ত্রের নির্দেশিত বিধি-নিষেধগুলি অনুসরণ করছেন, তিনিই মন্দিরে প্রবেশ করতে পারেন এবং ভগবানের শ্রীবিগ্রহ দর্শন করতে পারেন সকলে তা পারে না।
যে মানুষ বিধি-নিষেধগুলি যথাযথভাবে অনুশীলন করে ভগবানের শ্রীবিগ্রহ স্পর্শ করেন, তিনি তৎক্ষণাৎ সব রকমের জড় কলুষ থেকে মুক্ত হন এবং অচিরেই তাঁর সমস্ত বাসনা পূর্ণ হয়।
শ্রীবিগ্রহ দর্শন
মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ দর্শনের মহিমা বরাহ-পুরাণে কীর্তিত হয়েছে। এক ভক্ত বলছেন, “হে বসুন্ধরে! যে মানুষ বৃন্দাবনে গিয়ে গোবিন্দদেবের শ্রীবিগ্রহ দর্শন করেন, তিনি যমালয় থেকে মুক্ত হন · এবং সর্বোচ্চ লোকে প্রবিষ্ট হওয়ার অনুমতি লাভ করেন, যে লোকে দেবতারা বাস করেন।”
অর্থাৎ, যদি কোন সাধারণ মানুষও কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে বৃন্দাবনে গিয়ে ঘটনাক্রমে ভগবানের শ্রীমন্দির দর্শন করেন, বিশেষ করে গোবিন্দদেবের মন্দির দর্শন করেন, তিনি যদি ভগবৎ-ধামে উন্নীত নাও হতে পারেন, তবুও অন্তত তিনি যে স্বৰ্গলোকে উন্নীত হবেন, সেই সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। অর্থাৎ শ্রীশ্রীগোবিন্দদেবের শ্রীবিগ্রহ দর্শন করার ফলে অগাধ পুণ্য অর্জিত হয়।
আরতি দর্শন
ভগবানের আরতি সম্বন্ধে স্কন্দ-পুরাণে বর্ণনা করা হয়েছে, “কেউ যদি আরতির সময় ভগবানের শ্রীমুখমণ্ডল দর্শন করেন, তা হলে তিনি কোটি কোটি বছরের সঞ্চিত সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন। তিনি এমন কি ব্রহ্মহত্যার মতো জঘন্যতম পাপ থেকেও মুক্ত হন।”
উৎসব অনুষ্ঠান
পূর্বেই বলা হয়েছে, শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী, রামনবমী, মহান বৈষ্ণবদের জন্মতিথি, ঝুলনযাত্রা, দোলযাত্রা আদি বিভিন্ন উৎসবের অনুষ্ঠান করা উচিত। ভগবানের উৎসবের দিনগুলিতে রথে করে ভগবানকে নিয়ে শোভাযাত্রা বার করা হয়, যার ফলে মানুষ অনায়াসে ভগবানের দর্শন লাভ করতে পারে।
ভবিষ্য-পুরাণে বলা হয়েছে, “এই সমস্ত উৎসবের দিনে যদি কোন চণ্ডালও (যে মানুষ কুকুরের মাংস আহার করে) কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে রথে উপবিষ্ট ভগবানকে দর্শন করে, তা হলে সেও বিষ্ণুর পার্ষদত্ব লাভ করে।”
অগ্নি-পুরাণে বলা হয়েছে, “আনন্দের সঙ্গে কেউ যদি মন্দিরে ভগবানের বিগ্রহপূজা দর্শন করেন, তা হলে তিনি পঞ্চরাত্রের ক্রিয়াযোগের ফল প্রাপ্ত হন।” ক্রিয়াযোগ ভক্তিযোগেরই মতো অভ্যাসের পদ্ধতি, কিন্তু তা বিশেষ করে ধ্যানযোগীদের জন্য নির্দেশিত হয়েছে। অর্থাৎ, এই পদ্ধতি অনুশীলন করে ক্রমান্বয়ে ধ্যানযোগী অবশেষে ভগবদ্ভক্তির স্তরে অধিষ্ঠিত হতে পারেন।
আরও পড়ুন
* কৃষ্ণ ভক্তির পবিত্রতা ভক্তিরসামৃতসিন্ধু