ভক্তিরসামৃতসিন্ধু-কৃষ্ণ ভক্তির পবিত্রতা

 

ভক্তিরসামৃতসিন্ধু-কৃষ্ণ ভক্তির পবিত্রতা

কৃষ্ণ ভক্তির পবিত্রতার গুরুত্ব-ভক্তিরসামৃতসিন্ধু 

 

শ্রীল রূপ গোস্বামী পূর্বে বিস্তারিতভাবে যে সমস্ত উপদেশ দিয়েছেন তার সারমর্ম হচ্ছে—যতক্ষণ পর্যন্ত বিষয়ভোগ করার বাসনা অথবা ব্রহ্মজ্যোতিতে লীন হয়ে যাওয়ার বাসনা থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত শুদ্ধ ভক্তির জগতে প্রবেশ করা যায় না। 

 

তারপর শ্রীল রূপ গোস্বামী বলেছেন, ভগবদ্ভক্তি সব রকম বৈষয়িক বিচারের ঊর্ধ্বে এবং তা কোন রাষ্ট্র, জাতি, সমাজ অথবা পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিটি জীবেরই তাতে অধিকার রয়েছে। শ্রীমঙ্গাগবতে বলা হয়েছে, ভগবদ্ভক্তি জড় জাগতিক স্তরের ঊর্ধ্বে অপ্রাকৃত স্তরের চিন্ময় বস্তু এবং তা কোন জড় জাগতিক কারণের অধীন নয়।

 

 কোন রকম লাভের আশা না করে ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করতে হয় এবং কোন রকম প্রাকৃত পরিস্থিতি তাকে প্রতিহত করতে পারে না। কোন রকম ভেদভাব ব্যতীত সকলেরই তাতে অধিকার আছে এবং তা হচ্ছে প্রতিটি জীবেরই স্বাভাবিক বৃত্তি।

 

মধ্যযুগে, ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মহান পার্ষদ শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর অপ্রকটের পর, এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভূত মানুষ নিত্যানন্দ বংশীয় গোস্বামী জাতি বলে নিজেদের পরিচয় দিতে থাকে। তারা দাবি করতে থাকে যে, ভগবদ্ভক্তির সাধন ও প্রচারের অধিকার কেবল তাদেরই রয়েছে।  

 

এইভাবে কিছুদিন ধরে তারা তাদের কৃত্রিম একাধিপত্য চালাতে থাকে। কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মহান আচার্য শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর তাদের সেই বিচারকে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করেন। সেই জন্য প্রথম দিকে তাঁকে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়, কিন্তু অবশেষে তিনি সফল হন এবং এখন যথাযথভাবে প্রতিপাদিত হয়েছে যে, ভক্তির অধিকার কোন বিশেষ জাতির মধ্যে সীমিত নয়। 

 

আর তা ছাড়া, যিনি ভক্তিমার্গে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তিনি ইতিমধ্যেই সর্বোত্তম ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেছেন। এইভাবে ভগবদ্ভক্তির আন্দোলনে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের সংগ্রাম সার্থক হয়েছে।

 

তাঁর সেই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই আজ পৃথিবীর যে কোনও প্রান্ত থেকে তথা ব্রহ্মাণ্ডের যে কোনও প্রান্ত থেকে, যে কোনও জীব বৈষ্ণব হওয়ার সুযোগ লাভ করছে। ভগবানের শুদ্ধ ভক্তরা অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত এবং তাই তাঁরা ইতিমধ্যেই জড় জগতের সর্বোত্তম গুণ সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। 

 

পাশ্চাত্য জগতে আমাদের আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন আমাদের পরমারাধ্য গুরুদেব শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের সিদ্ধান্তের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর আজ্ঞায় আমরা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে এই আন্দোলনে যোগদান করার সুযোগ দিচ্ছি। 

 

তথাকথিত কিছু ব্রাহ্মণ বলে যে, ব্রাহ্মণবংশে জন্ম না হলে দীক্ষা প্রাপ্ত হয়ে উন্নত স্তরের বৈষ্ণর হওয়া যায় না। এই সমস্ত মতবাদ আমরা স্বীকার করি না, কারণ এই ধরনের বিচার শ্রীল রূপ গোস্বামী অনুমোদন করেননি এবং বৈদিক শাস্ত্রেও তা অনুমোদন করা হয়নি।

 

শ্রীল রূপ গোস্বামী এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ভক্তিযোগ অবলম্বন করে কৃষ্ণভাবনার অমৃত লাভ করার অধিকার প্রতিটি জীবেরই রয়েছে। সেই সম্বন্ধে তিনি শাস্ত্র থেকে বহু প্রমাণ প্রদর্শন করেছেন। তার মধ্যে পদ্ম-পুরাণের একটি শ্লোক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, 

 

যেখানে মহর্ষি বশিষ্ঠ রাজা দিলীপকে বলেছেন, “হে রাজন, মাঘ মাসের সকালে স্নান করার অধিকার যেমন সকলেরই রয়েছে, ঠিক তেমনই ভগবদ্ভক্তি অনুশীলন করার অধিকার সকলেরই আছে।” যেমন স্কন্দ পুরাণের কাশী খণ্ডেও এই তথ্যের প্রমাণ প্রদর্শন করে বলা হয়েছে, “ময়ূরধ্বজ নামক দেশে শূদ্রদের থেকেও নীচ অন্ত্যজ কুলোদ্ভূত মানুষেরাও দীক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে ভক্তিমার্গ অবলম্বন করেন, এবং দ্বাদশ অঙ্গে তিলক ও কণ্ঠিমালায় ভূষিত হন। 

 

এইভাবে যখন বৈষ্ণবসাজে সজ্জিত হয়ে তাঁরা জপমালায় জপ করেন, তখন মনে হয় তাঁরা যেন বৈকুণ্ঠলোক থেকে এসেছেন। অর্থাৎ, তখন তাঁদের দেখেই বোঝা যায় যে, তাঁরা ইতিমধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ব্রাহ্মণত্বের স্তর অতিক্রম করেছেন।” 

 

এইভাবে বৈষ্ণব স্বাভাবিকভাবেই ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন। শ্রীল সনাতন গোস্বামীও এই বিচারের সমর্থন করেছেন। তাঁর রচিত হরিভক্তি-বিলাস নামক গ্রন্থ হচ্ছে বৈষ্ণব সমাজের পথপ্রদর্শক। সেখানে তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, পারার মিশ্রণে কাঁসা যেমন সোনা হয়ে যায়, ঠিক তেমনই কেউ যখন যথাযথভাবে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন, তিনি অবশ্যই ব্রাহ্মণত্বে পরিণত হন। 

 

যথাযথ পরম্পরার ধারায় সদ্গুরুর তত্ত্বাবধানে যে কেউ বৈষ্ণব হতে পারেন এবং তার ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্রাহ্মণত্বের সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত হতে পারেন।

 

শ্রীল রূপ গোস্বামী স্বাবধান করে দিয়েছেন যে, কেউ যেন সদ্গুরুর কাছে দীক্ষাপ্রাপ্ত হয়েই মনে না করেন যে, এই দীক্ষা গ্রহণের ফলে তাঁর সমস্ত কর্তব্য সম্পাদিত হয়েছে। দীক্ষা প্রাপ্ত হওয়ার পরেও সকলকেই খুব সাবধানতার সঙ্গে সমস্ত বিধি-নিষেধগুলি অনুশীলন করতে হয়।  

 

সদ্গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নেওয়ার পর যদি কেউ যথাযথভাবে বিধি-নিষেধগুলির অনুশীলন না করেন, তা হলে আবার তাঁর অধঃপতন হবে। সকলকেই খুব সাবধানতার সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, তিনি হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন অংশ এবং তাঁর অংশ হওয়ার ফলে সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে, পূর্ণ পুরুষোত্তম বা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করা। 

 

আমরা যদি শ্রীকৃষ্ণের সেবা না করি, তা হলে আবার আমরা অধঃপতিত হব। পক্ষান্তরে বলা যায়, কেবল দীক্ষা গ্রহণের ফলে মানুষ উন্নত ব্রাহ্মণে পরিণত হয় না, ব্রাহ্মণোচিত আচরণ করার ফলে এবং গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে শাস্ত্রের নির্দেশ অনুশীলন করার ফলে যথার্থ ব্রাহ্মণত্ব লাভ করা যায়। 

 

শ্রীল রূপ গোস্বামী বলেছেন, যদি কেউ নিয়মিতভাবে ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করেন, তা হলে তাঁর অধঃপতনের কোন প্রশ্নই ওঠে না। দৈবাৎ যদি কখনও অধঃপতন হয়ও, তা হলে বৈষ্ণবকে সেই জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় না। ভক্তিমার্গ থেকে যদি কারও অধঃপতন হয়, তা হলে তাঁকে সেই ভুল সংশোধন করার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় না। 

 

কেবলমাত্র ভগবদ্ভক্তির বিধি-নিষেধগুলি পালন করার ফলেই তিনি আবার ভক্তিমার্গে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারেন। এটিই হচ্ছে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মাহাত্ম্য।

 

চিন্ময় স্তরে চেতনাকে উন্নীত করার তিনটি পন্থা রয়েছে। সেই পন্থাগুলি হচ্ছে কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি। বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান কর্মকাণ্ডের অন্তর্গত। মনোধর্মপ্রসূত জল্পনা-কল্পনা, জ্ঞানকাণ্ডের অন্তর্গত। যিনি ভক্তিমার্গ অবলম্বন করে. ভগবানের সেবায় যুক্ত হয়েছেন, তাঁর সঙ্গে কর্মকাণ্ডের ও জ্ঞানকাণ্ডের কোন সম্পর্ক নেই। 

 

পূর্বে বিশ্লেষণ করা হয়েছে যে, শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তিতে কর্ম অথবা জ্ঞানের লেশ মাত্র নেই। ভক্তিতে দার্শনিক জল্পনা-কল্পনা অথবা আচার-অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা নেই।

 

এই সম্পর্কে শ্রীল রূপ গোস্বামী শ্রীমদ্ভাগবত থেকে একটি প্রমাণ উল্লেখ করেছেন। একাদশ স্কন্ধে (১১/২১/২) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবকে বলেছেন, “দোষ ও গুণের নির্ণয় এইভাবে করা যায় ভক্তিযোগী পুরুষ কখনও সকাম কর্ম অথবা মনোধর্মের আশ্রয় নেন না। 

 

আচার্য ও শাস্ত্রের বিধিবিধান অনুসরণ করে ভক্তিমার্গে নিষ্ঠাপরায়ণ হওয়াই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ।" শ্রীমদ্ভাগবতে (১/৫/১৭) অন্য আর এক জায়গাতে এই সত্য প্রতিপন্ন হয়েছে। শ্রীনারদ মুনি ব্যাসদেবকে বলেছেন—“যদি কেউ তাঁর স্বধর্ম ত্যাগ করে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরির চরণারবিন্দের আশ্রয় গ্রহণ করেন, তা হলে তাতে তাঁর কোন দোষ হয় না, এবং সর্ব অবস্থাতেই তিনি নিরাপদ থাকেন। 

 

এমন কি, ভগবদ্ভক্তি অনুশীলন করার সময় যদি অসৎ সঙ্গের প্রভাবে তাঁর অধঃপতন হয় অথবা ভক্তি সাধন হওয়ার পূর্বেই যদি তাঁর মৃত্যু হয়, তা হলেও তাতে তাঁর কোন ক্ষতি হয় না। কিন্তু কেউ যদি কৃষ্ণভাবনা-বিহীন বর্ণ ও আশ্রম অনুসারে তাঁর স্বধর্ম অনুষ্ঠান করেন, তা হলেও তিনি মানব-জীবনের যথার্থ উদ্দেশ্য সাধন করতে পারেন না।” 

 

অর্থাৎ, যে সমস্ত বদ্ধ জীব জানে না যে, সকাম কর্মের দ্বারা ভববন্ধন কখনও দূর হয় না, তারাই উন্মত্তের মতো ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির চেষ্টায় মগ্ন থাকে, তাদের বারবার জন্ম মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হতে হয়।

 

শ্রীমদ্ভাগবতের পঞ্চম স্কন্ধে ভগবান ঋষভদেব তাঁর পুত্রদের উপদেশ দিচ্ছেন—“সকাম কর্মী জন্ম-মৃত্যুর বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত না তার হৃদয়ে ভগবান বাসুদেবের প্রতি প্রেমভাবের উদয় হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এই দৃঢ় বন্ধন থেকে সে মুক্ত হতে পারে না।” 

 

যে সমস্ত মানুষ গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে বর্ণাশ্রম ধর্ম অনুসরণ করেন, কিন্তু ভগবান বাসুদেবের প্রতি ভক্তিপরায়ণ হতে পারেননি, প্রকৃতপক্ষে তাঁরা মনুষ্য জীবনের পরম সৌভাগ্য হেলায় হারাচ্ছেন।

 

শ্রীমদ্ভাগবতে (১১/১১/৩২) এই সত্য প্রতিপন্ন করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবকে বলেছেন—“হে উদ্ধব! যে মানুষ অন্য সমস্ত কর্তব্য ত্যাগ করে পূর্ণরূপে আমার শরণাগত হয় এবং আমার আজ্ঞা পালন করে, সে-ই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ।” 

 

পরমেশ্বর ভগবানের এই উক্তি থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, যে সমস্ত মানুষ দাতব্য, নৈতিক, পরহিতবাদী, রাজনৈতিক ও সমাজকল্যাণ কার্যকলাপে আসক্ত, জড় জাগতিক বিচারে তাদের খুব ভাল মানুষ বলে গণ্য করা যেতে পারে, কিন্তু শ্রীমদ্ভাগবতাদি প্রামাণিক বৈদিক শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে, যে মানুষ ভক্তিযোগে যুক্ত হয়ে কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত কর্ম করেন, তিনি হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ। 

 

এই সিদ্ধান্ত শ্রীমদ্ভাগবতে (১১/৫/৪১) আরও দৃঢ়তাপূর্বক প্রতিপন্ন হয়েছে। করভাজন মুনি মহারাজ নিমিকে বলেছেন—“হে রাজন! যে মানুষ বর্ণাশ্রম বিহিত সমস্ত ধর্ম ত্যাগ করে কায়মনোবাক্যে একমাত্র শরণ্য মুকুন্দের শরণাগত হন, তিনি দেব, ঋষি ও পিতৃবর্গের কাছে আর ঋণী থাকেন না, এবং তাঁদের প্রতি তাঁর কোন কর্তব্য থাকে না। 

 

তাঁর পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তাঁর আর পঞ্চ মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে হয় না। কেবলমাত্র ভগবদ্ভক্তি অনুশীলন করার ফলে তিনি সব রকম দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত হন।” এই শ্লোকের তাৎপর্য হচ্ছে, জন্মের সময় থেকেই মানুষ অনেকের কাছে ঋণী থাকেন। 

 

তাঁরা ঋষিদের কাছে ঋণী থাকেন, কেন না তাঁদের রচিত শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে তাঁরা জ্ঞান অর্জন করেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, ব্যাসদেব রচিত গ্রন্থ থেকে আমরা জ্ঞান লাভ করছি। ব্যাসদেব আমাদের জন্য সমস্ত বেদ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। 

 

ব্যাসদেব লিপিবদ্ধ করার আগে বৈদিক জ্ঞান শ্রৌতপন্থায় প্রবাহিত হত। অর্থাৎ, শ্রীগুরুদেবের শ্রীমুখ থেকে বৈদিক জ্ঞান শ্রবণ করে শিষ্য সেই জ্ঞান লাভ করতেন। গ্রন্থপাঠ করার প্রচলন তখন ছিল না পরবর্তীকালে ব্যাসদেব বিবেচনা করলেন যে, কলিযুগের মানুষ যেহেতু অত্যন্ত অল্প মেধাসম্পন্ন হবে এবং কোন কিছুই মনে রাখতে পারবে না, তাই তিনি কৃপা করে এই যুগের মানুষদের জন্য পুরাণ, বেদান্ত, মহাভারত ও শ্রীমদ্ভাগবত শাস্ত্র গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করে গেছেন।  

 

শঙ্করাচার্য, গৌতম মুনি, নারদ মুনি আদি বহু ঋষি আছেন, যাঁদের প্রতি আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ, কেন না তাঁদের জ্ঞান আমরা আহরণ করি। তেমনই আমরা আমাদের পিতৃপুরুষের প্রতি কৃতজ্ঞ, কারণ কোন বিশেষ পরিবারে আমরা জন্মগ্রহণ করি, উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁদের সম্পত্তি লাভ করি এবং নানা রকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করি। 

 

তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁদের উদ্দেশ্যে পিণ্ড (ভগবানের প্রসাদ) দান করতে হয়। তেমনই, আমরা জনসাধারণের কাছে কৃতজ্ঞ, আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, এমন কি গাভী কুকুর আদি পশুদের কাছেও কৃতজ্ঞ থাকি, কারণ তাদের কাছ থেকে আমরা নানা রকম সেবা উপভোগ করি।

 

এইভাবে আমরা দেবতাদের কাছে, ঋষিদের কাছে, পিতৃবর্গের কাছে, আত্মীয়-স্বজনের কাছে, পশুদের কাছে এবং সমগ্র মানব সমাজের কাছে কৃতজ্ঞ। তাই আমাদের কর্তব্য হচ্ছে যে, তাঁদের সেবা করে সেই সমস্ত ঋণ থেকে মুক্ত হওয়া। 

 

কিন্তু যদি কেউ এই সমস্ত কর্তব্য পরিত্যাগ করে অনন্যভাবে পরমেশ্বর ভগবানের শরণাগত হন, তা হলে তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর সমস্ত ঋণ থেকে মুক্ত হন, এবং কারও প্রতি তাঁর তখন আর কোন কর্তব্যের বন্ধন থাকে না।

 

ভগবদ্গীতাতেও আশ্বাস প্রদান করে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “হে অর্জুন! সব রকম জড়-জাগতিক ধর্ম পরিত্যাগ করে একমাত্র আমারই শরণাপন্ন হও। তা হলে আমি তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব, সেই জন্য তুমি কোন চিন্তা করো না।” 

 

কেউ মনে করতে পারে যে, যেহেতু তিনি পরমেশ্বর ভগবানের কাছে শরণাগত হচ্ছেন, তাই তিনি তাঁর অন্যান্য কর্তব্যগুলি সম্পন্ন করতে সক্ষম হবেন না। কিন্তু ভগবান বারংবার বলছেন, “ইতস্তত করো না। মনে করো না যে, যেহেতু তুমি অন্যান্য কর্তব্যগুলি ত্যাগ করেছ, তাই তোমার জীবনে কিছু ত্রুটি থেকে যাবে। 

 

তুমি সেই রকম মনে করো না। আমি তোমাকে সর্বতোভাবে রক্ষা করব।” ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এটিই প্রতিশ্রুতি। 

 

অগস্ত্য-সংহিতাতেও বলা হয়েছে, “মুক্ত পুরুষদের যেমন শাস্ত্রের বিধি-নিষেধগুলি অনুশীলন করতে হয় না, তেমন, যে-মানুষ ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের সেবায় যুক্ত হয়েছেন, তাঁকে আর বৈদিক শাস্ত্র-নির্দেশিত বিধি-নিষেধের অনুশীলন করতে হয় না।” 

 

পক্ষান্তরে বলা যায় যে, ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বা কৃষ্ণচন্দ্রের ভক্তরা ইতিমধ্যেই সব রকমের জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে গেছেন, এবং তাঁদের আর শাস্ত্র নির্দেশিত বিধি-নিষেধের অনুশীলন করতে হয় না।

 

তেমনই, শ্রীমদ্ভাগবতের একাদশ স্কন্ধের পঞ্চম অধ্যায়ে করভাজন মুনি মহারাজ নিমিকে বলছেন, “হে রাজন! যিনি অন্য সমস্ত দেব দেবীদের পূজা পরিত্যাগ করে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মের ভজন করেন, তিনি তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। 

 

তিনি যদি প্রমাদবশত কোন নিষিদ্ধ কর্মও করে ফেলেন, তা হলে তাঁকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় না। কারণ তাঁর হৃদয়ে অবস্থিত পরমেশ্বর ভগবান তাঁর প্রতি করুণার বশবর্তী হয়ে তাঁর হৃদয়াভ্যন্তর থেকে সেই ভুল সংশোধন করে দেন।” 

 

ভগবদ্গীতার বহু শ্লোকে প্রতিপন্ন হয়েছে যে, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিশেষভাবে ভক্তবৎসল অর্থাৎ তাঁর ভক্তদের প্রতি তিনি অত্যন্ত কৃপা পরায়ণ, এবং তিনি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছেন যে, কোন কারণেই তাঁর ভক্তের পতন হতে পারে না। তিনি সর্বদাই তাঁকে রক্ষা করেন।

আরও পড়ুন

* শুদ্ধ ভক্তির লক্ষণ গুলো কি কি? ভক্তিরসামৃতসিন্ধু 

* ভক্তিযোগ সাধনের বিধি সমূহ-ভক্তিরসামৃতসিন্ধু  

* কৃষ্ণ ভক্তি অনুশীলনের পন্থা ও ভক্তির অঙ্গগুলি-ভক্তি-রসামৃতসিন্ধু 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url