শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জগন্নাথ দেবকে দর্শন।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও জগন্নাথ দেবের লীলা কাহিনী
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু দৌড়ে একা একা শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করলেন। তিনি জগন্নাথের রূপ দেখেননি, শ্যামসুন্দর মুরলীধর রূপ দেখলেন। তাই তিনি মগ্ন হয়ে, আনন্দে বিভোর হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। তখন কয়েকজন “পাণ্ডা ভাবল, “এ পাগল, ওকে মার।”
কিন্তু সার্বভৌম ভট্টাচার্য লক্ষণ দেখলেন আজানুলম্বিত ভুজৌ, সুন্দর লম্বা লম্বা হাত, সমগ্র শরীরে মহাপুরুষের লক্ষণ দেখে বললেন, এতো সাধারণ কেউ নয়। জগন্নাথ মন্দির থেকে সার্বভৌম ভট্টাচার্যের বাড়ি অতি নিকটে। তিনি মহাপ্রভুকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন।
তিনি দেখলেন কোনো হৃদস্পন্দন নেই। ভাবলেন- মরে গেছে। নাকি? তাও মনে হয় না। তারপর তুলো নিয়ে নাকে দেখলেন- তুলো একটু একটু নড়ছে। তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, তিনি সমাধিস্থ হয়েছেন। নির্বিকল্প সমাধি। এদিকে মহাপ্রভুর পেছন পেছনে আসা অন্যান্য ভক্ত জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করে সব শুনলেন।
তারপর চলে গেলেন সার্বভৌম ভট্টাচার্যের বাড়িতে। ওখানে কেউ মহাপ্রভুকে জাগাতে পারছেন না। তখন ভক্তরা বলছেন, “আমরা ওনাকে জাগাতে পারব। হরিনাম করলে জেগে উঠবে। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে!"
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হরিনাম শুনতে শুনতে জেগে উঠলেন। সার্বভৌম ভট্টাচার্যের ভগ্নীপতি গোপীনাথ আচার্য বলেছিলেন যে, শ্রীচৈতন্য দেব হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত অবতার, কিন্তু সার্বভৌম ভট্টাচার্য তখনো তা স্বীকার করতে পারেননি। তখন সার্বভৌম ভট্টাচার্য ছিলেন পুরুষোত্তম ধামের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি।
তিনি বিভিন্ন সন্ন্যাসীকে শঙ্করাচার্যের শারীরক ভাষ্য শিক্ষা দিয়েছেন। তখন তিনি বলেছেন যে, “শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, আমি তোমায় বেদান্ত শিক্ষা দিতে পারি।” তখন মহাপ্রভু বলেছেন, “ঠিক আছে। আমি আসব।” এভাবে সাত দিন ধরে মহাপ্রভু এলেন, কিন্তু একদিনও কোনো প্রশ্ন করেনি। সাতদিন পর সার্বভৌম বললেন, “তুমি আমাকে বল কী বুঝতে পারলে?
সাতদিন পরও তিনি কোনো প্রশ্ন করলেন না? এতো কঠিন বেদান্তসূত্র।" তখন মহাপ্রভু বললেন, “সবসময় তো শ্রোতাগণের প্রশ্ন থাকে না। আমারও কোনো প্রশ্ন নেই। তুমি যে বেদান্ত সূত্র বলছো, আমি তা বুঝতে পারছি। তোমার ব্যাখ্যাটা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
যেহেতু বেদান্ত সূত্র বুঝতে পারছি। তাই ব্যাখ্যা বোঝার কোনো দরকার নেই।” শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শুদ্ধ বৈষ্ণব মতে বেদান্ত সূত্রের সরাসরি ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু শঙ্করাচার্যের ব্যাখ্যা একটু ঘুরিয়ে নিরাকার সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠা করে। যেমন বেদান্তসূত্রে আছে জন্মাদস্য যত- সবকিছু পরম সত্য, ঠিক আছে।
এর মানে আমাদের যদি রূপ থাকে, তবে পরম সত্যেরও রূপ থাকবে। কিন্তু আমাদের রূপ আর পরম সত্যের রূপ ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু রূপ ছাড়া পরম সত্য হতে পারে না। এভাবে বিভিন্ন বাখ্যার পর, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু চৌষট্টিভাবে শ্রীমদ্ভাগবতের আত্মারাম শ্লোকের ব্যাখ্যা করলেন।
তখন সার্বভৌম ভট্টাচার্য ভাবলেন, গোপীনাথ আচার্য সত্যিই বলেছেন, তিনিই পরমেশ্বর। তাঁর পাণ্ডিত্য আর চেহারা দেখে তা-ই মনে হচ্ছে। এভাবে চৈতন্য দেবের চরণে প্রণাম করে সার্বভৌম প্রার্থনার সুরে বললেন, “তোমার আসল আমাকে দেখাও।” তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁকে ষড়ভুজ রূপ দেখালেন।
ষড়ভুজ রূপ সার্বভৌম ভট্টাচার্যের দেয়ালে আঁকা আছে। তিনি কৃষ্ণ, তিনিই রাম এবং তিনিই গৌর। সেই থেকে সার্বভৌম ভট্টাচার্য ভক্ত হয়ে গেলেন। ভক্তসঙ্গে হরিনাম করে তিনিও নাচতে লাগলেন। এত বড় একজন মায়াবাদী পণ্ডিত ভক্ত হয়ে গেলেন।
একদিন শ্রীচৈতন্য দেব মঙ্গল আরতির পর জগন্নাথের মহাপ্রসাদ নিয়ে তাঁর ঘরে ছুটে গেলেন। জগন্নাথের মহাপ্রসাদ কি জয়! সার্বভৌম ভট্টাচার্য মহাপ্রসাদ নিয়ে খেলেন, খেজুর প্রসাদ ছিল। তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কৌতুক করে বললেন, “আরে তুমি স্নান করনি, মুখ ধৌত করনি অথচ প্রসাদ খাচ্ছ ?
তোমার ব্রাহ্মণবিধির তো সর্বনাশ হলো এবার।” কেননা আগে তিনি স্মার্ত ব্রাহ্মণ ছিলেন। নিয়মের অনেক কড়াকড়ি ছিল। এমন ব্রহ্মণ হয়ে কীভাবে তিনি মুখ ধৌত না করেই প্রসাদ গ্রহণ করছেন! বিছানা থেকে উঠেই খাওয়া শুরু করেছেন।
সার্বভৌম ভট্টাচার্য বড় পণ্ডিত এক শ্লোক পাঠ করে বললেন, “যখন জগন্নাথের মহাপ্রসাদ উপস্থিত হয়, তখন দেশ, কাল, পাত্র কোনো কিছু বিচার না করে সাথে সাথেই তা গ্রহণ করতে হয়।” তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অত্যন্ত খুশি হলেন। বললেন, “আমি তোমাকে এতক্ষণ পরীক্ষা করছিলাম।
সে পরীক্ষায় তুমি কৃতকার্য হলে । তুমি ভগবানের পরম ভক্ত।” সার্বভৌম ভট্টাচার্য কি জয়! তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু খেজুর প্রসাদ সবাইকে বিতরণ করলেন। সবাই তখন প্রসাদ পেলেন। খেজুর তো সাধারণ একটা জিনিস অদ্ভুত কিছু না যেহেতু এতে কৃষ্ণের মুখপদ্মের রস মিশেছে, তাই এর এতো স্বাদ।
জগন্নাথ দেব কি জয়! বলদের কি জয়! সুভদ্রা মা কি জয়! শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নিজে রন্ধন করতেন না। বিভিন্ন গৃহস্থের সেবা ছিল, তাঁর জন্য রান্না করে প্রসাদ দেওয়া। সার্বভৌম ভট্টাচার্য তখন বলছেন, “আমি পুরো মাস তোমার সেবা দিব।”
কিন্তু মহাপ্রভু বলছেন তুমি একা কীভাবে এতো সেবা করবে? এখানে তো আরো অনেক গৃহস্থ আছে। কিন্তু তার এতো শখ যে, তিনি ও তার স্ত্রী। সবসময় চৈতন্যদেবের জন্য রান্না করবেন।
পরমানন্দ পুরীর আশ্রম ছিল লোকনাথ শিবের কাছে যাওয়ার রাস্তায় জগন্নাথ মন্দিরের পেছনে। শ্রীচৈতন্য দেবের সম্প্রদায়ের মূল হচ্ছেন মাধবেন্দ্র পুরী। পরমানন্দ পুরী, মাধবেন্দ্র পুরা, ব্রহ্মানন্দ ভারতী এরকম আট জন সন্ন্যাসী।
পরমানন্দ পুরীর আশ্রম এখানেই তখন পুলিশ থানা ছিল না। উনি ওখানেই কুয়া কেটেছেন কিন্তু সমুদ্রের ধারে মিষ্টি জল পাওয়া খুব কঠিন। এখানে নোনতা জল বেশি। উনি চান মিষ্টি জল ভগবানকে নিবেদন করবেন। কিন্তু কৃয়া কেটে দেখেন জলটা নোনতা।
একদিন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এসেছেন সব ভক্ত নিয়ে। পরমানন্দ পুরীকে দুঃখিত দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হলো?” তিনি বললেন, “আমি কূয়া কেটেছি, কিন্তু জল নোনতা।” তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু চারদিকে কীর্তন করে করে পরিক্রমা করলেন।
আপনারা যেমন পরিক্রমা করছেন পুরো শ্রীক্ষেত্র, তেমনই মহাপ্রভু পরিক্রমা করলেন কুয়াটি। পরিক্রমা করার পর কৃয়ার জল মিষ্টি হয়ে গেল। এখনও মানুষ সেই মিষ্টি জল নিয়ে খায় গঙ্গা জলের মতো।
জগদানন্দ পণ্ডিত ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের বাল্যকালের বন্ধু। যখন শ্রীচৈতন্যদেব পুরীতে এলেন, তিনিও তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন। একদিন তিনি সুগন্ধি তৈল নিয়ে এলেন। সুগন্ধি তৈল নিয়ে মহাপ্রভুর কাছে অর্পণ করলেন। মহাপ্রভু বললেন, "আমি সন্ন্যাসী, আমি সুগন্ধি তৈল দিলে মানুষ কী বলবে, কী মনে করবে। সুগন্ধি তৈল সন্ন্যাসীদের জন্য নয়।
তুমি তা জগন্নাথকে দাও , প্রদীপ জ্বালাবে।” তিনি বারবার চেষ্টা করলেন মহাপ্রভুকে দেওয়ার জন্য, কিন্তু তিনি গ্রহণ করছেন না। জগদানন্দ পণ্ডিতও মানছেন না। তিনি ভাবছেন চন্দনের তেল লাগালে মহাপ্রভুর মাথা একটু ঠাণ্ডা হবে।
কিন্তু মহাপ্রভু তখনো মানছেন না দেখে, তিনি তেল নিয়ে ঘরে ফিরে গিয়ে রাগ করে তৈলভাগুটিই ভেঙ্গে দিলেন। দরজা আটকে দিয়ে তিন দিন উপবাস করলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বুঝতে পারলেন ভক্তের রস।
তখন তিনি তাঁকে গিয়ে বললেন, “জগদানন্দ তুমি আমার জন্য রান্না করো। আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে।" তখন জগদানন্দ পণ্ডিত এসে রান্না করলেন। তখনো রাগ ছিলোই, মহাপ্রভু বললেন, “রাগ করলে প্রসাদ আরো মিষ্টি হয়, আরো সু-স্বাদু লাগে।" এভাবে জগদানন্দ পণ্ডিতকে খেতে বাধ্য করলেন। জগদানন্দ পণ্ডিত সত্যভামার অবতার বামপন্থী রাণী। এভাবে অনেক লীলা হয়েছে এখানে।