ভক্তিযোগ সাধনের বিধি সমূহ-ভক্তিরসামৃতসিন্ধু
কৃষ্ণভক্তি পালনের বিধি সমূহ
শ্রীল রূপ গোস্বামী উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর অগ্রজ শ্রীল সনাতন গোস্বামী বৈষ্ণবদের ভগবদ্ভক্তির পন্থা প্রদর্শন করবার জন্য হরিভক্তিবিলাস গ্রন্থ সংকলন করে বৈষ্ণবদের আচরণীয় অনেক বিধি বিধানের বর্ণনা করেছেন।
তাদের মধ্যে কতকগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বৈশিষ্ট্যসূচক, এবং তিনি এখানে সেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির উল্লেখ করবেন, যাতে আমরা লাভবান হতে পারি। শ্রীল রূপ গোস্বামীর এই ভক্তির তাৎপর্য হচ্ছে যে, তিনি বিশদীকরণ না করে মূল সিদ্ধান্তগুলি প্রতিপাদন করবেন।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি মুখ্য সিদ্ধান্ত হচ্ছে, গুরুদেবের আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু ঠিক কিভাবে গুরুর আজ্ঞা পালন করা উচিত, তা হচ্ছে সেই সিদ্ধান্তের বিশদ বিবরণ। যেমন, কেউ তাঁর গুরুদেবের আদেশ পালন করছেন, কিন্তু তাঁর গুরুর সেই আদেশ অন্য কোন গুরুর আদেশের থেকে ভিন্ন হতে পারে।
এগুলিকে বলা হয় বিশদ বিবরণ। কিন্তু মূলতত্ত্ব সদ্গুরুর আশ্রয় গ্রহণ করা সকলের পক্ষেই মঙ্গলজনক, যদিও তার বিশদ বিবরণ ভিন্ন হতে পারে। শ্রীল রূপ গোস্বামী এখানে সেই সমস্ত তথ্য বিশদভাবে বর্ণনা করতে চান না। তিনি কেবল আমাদের সামনে সিদ্ধান্তগুলি উপস্থাপিত করতে চান।
মূলতত্ত্বকে তিনি নিম্নলিখিত অঙ্গে বিভক্ত করেছেন—
(১) সদ্গুরুর চরণাশ্রয় গ্রহণ করা।
(২) গুরুদেবের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে কিভাবে ভগবদ্ভক্তি। অনুশীলন করতে হয়, সেই সম্বন্ধে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষালাভ করা।
(৩) শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহকারে গুরুদেবের আদেশ পালন করা।
(৪) গুরুদেবের নির্দেশ অনুসারে আচার্যদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা।
(৫) কিভাবে ভগবদ্ভক্তির পথে অগ্রসর হওয়া যায়, সেই সম্বন্ধে ঐকান্তিকভাবে গুরুদেবের কাছে অনুসন্ধান করা।
(৬) পরমেশ্বর ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য যে কোন জাগতিক বিষয় পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকা (অর্থাৎ আমরা যখন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় যুক্ত হই, তখন আমাদের যে কোন প্রিয় বস্তু ত্যাগ করতে এবং কোন অপ্রিয় নিয়ম অঙ্গীকার করতে প্রস্তুত থাকতে হয়)।
(৭) দ্বারকা, বৃন্দাবন আদি ধামে বাস করা।
(৮) প্রাকৃত জগৎ থেকে কেবল যতটুকু আবশ্যক, ততটুকু গ্রহণ করা।
(৯) একাদশী ব্রত পালন করা। (১০) আমলকী, অশ্বত্থ আদি পবিত্র বৃক্ষের পূজা করা। -
উপরোক্ত এই দশটি অঙ্গ অনুশীলন না করলে সাধন ভক্তির মার্গে উন্নতি লাভ করা যায় না। শ্রীরূপ গোস্বামী ২০টি অঙ্গের উল্লেখ করেছেন, এবং তাদের প্রত্যেকটিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০টির মধ্যে প্রথম তিনটি—অর্থাৎ সদ্গুরুর চরণাশ্রয় গ্রহণ করা, তাঁর কাছ থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত হওয়া এবং শ্রদ্ধা-সম্ভ্রমের সঙ্গে তাঁর সেবা করা—
এই তিনটি সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ।
তার পরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলি হচ্ছে—
(১) বৈষ্ণব তিলকে অঙ্গ ভূষিত করা। (তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বৈষ্ণবের অঙ্গে তিলক-চিহ্ন দেখে তৎক্ষণাৎ মানুষের হৃদয়ে কৃষ্ণস্মৃতিরউদয় হবে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলে গেছেন, বৈষ্ণর হচ্ছেন তিনি, যাঁকে দেখামাত্রই শ্রীকৃষ্ণের কথা মনে পড়ে।
তাই মানুষকে শ্রীকৃষ্ণের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য বৈষ্ণবের তিলক ধারণ করা কর্তব্য।)
(২) তিলক ধারণ করার সাথে সাথে শরীরে 'হরেকৃষ্ণ’ আদি নাম লেখা।
(৩) শ্রীকৃষ্ণ ও গুরুদেবের প্রসাদী ফুল ও মালা ধারণ করা।
(৪) ভগবানের শ্রীবিগ্রহের সামনে নৃত্য করা।
(৫) ভগবানের শ্রীবিগ্রহ বা শ্রীগুরুদেবকে দর্শন করা মাত্রই দণ্ডবৎ প্রণতি নিবেদন করা।
(৬) ভগবানের শ্রীমন্দিরে দণ্ডায়মান থাকা।
(৭) শোভাযাত্রা সহকারে যখন ভগবানের শ্রীবিগ্রহ পথ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তৎক্ষণাৎ সেই শোভাযাত্রায় যোগদান করা।
(এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্য যে, ভারতবর্ষে, বিশেষ করে সেখানকার বিষ্ণু মন্দিরে মূল বিগ্রহ ছাড়াও একটি ছোট বিগ্রহ থাকে, যাকে বলা হয় 'বিজয় বিগ্রহ'। এই বিজয়-বিগ্রহকে শোভাযাত্রা সহকারে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়।
কোন কোন মন্দিরে প্রচলিত প্রথা হচ্ছে, প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় অতি সুন্দরভাবে সজ্জিত সিংহাসনে বা পালকিতে করে ভগবানের শ্রীবিগ্রহকে শোভাযাত্রা সহকারে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। শ্রীবিগ্রহের উপর অপূর্ব সুন্দর ছত্র ধারণ করা হয় এবং সেই শোভাযাত্রায় নানা রকম বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়।
শ্রীবিগ্রহকে যখন রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন ভক্তরা তাঁদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ভগবানকে নানা রকম ভোগ নিবেদন করেন, এবং সকলেই সেই শোভাযাত্রায় ভগবানের অনুগামী হন। সেই দৃশ্য অতীব মনোরম। শ্রীবিগ্রহ যখন বেরিয়ে আসেন, তখন মন্দিরের সেবকেরা ভগবানকে সেই দিনের কার্যকলাপের বিবরণ শোনান। তাঁরা ভগবানকে বলেন যে, কত টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে এবং কত টাকা ব্যয় হয়েছে।
তার ফলে সকলেই অনুভব করতে পারেন যে, মন্দিরের মালিক হচ্ছেন ভগবান, এবং মান্দরের । সমস্ত পূজারী ও কর্মচারী হচ্ছেন তাঁর সেবক। এই প্রথা অত্যন্ত প্রাচীন এবং আজও এই প্রথা প্রচলিত আছে। তাই এখানে নির্দেশ। হয়েছে, ভগবানের শ্রীবিগ্রহ যখন শোভাযাত্রায় বের হন, তখন সেই দেওয়া শোভাযাত্রায় তাঁর অনুগামী হওয়া উচিত।
(৮) প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় অন্তত একবার অথবা দুবার ভগবানের শ্রীমন্দিরে যাওয়া ভক্তের কর্তব্য। (বৃন্দাবনে ভগবানের ভক্তরা অত্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে এই প্রথা অনুশীলন করেন। বৃন্দাবনের সমস্ত ভক্তরা প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় বিভিন্ন মন্দিরে ভগবানকে দর্শন করতে যান।
তাই সেই সময় শহরের সর্বত্র খুব ভিড় থাকে। বৃন্দাবনে প্রায় ৫০০০ মন্দির আছে। অবশ্যই সব কয়টি মন্দিরে যাওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু তবুও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অনুগামী গোস্বামীদের প্রতিষ্ঠিত অন্তত দশ-বারোটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিশাল মন্দিরগুলিতে ভগবানের শ্রীবিগ্রহ দর্শন করতে যাওয়া উচিত।
(৯) অন্ততপক্ষে তিনবার ভগবানের শ্রীমন্দির পরিক্রমা করা উচিত (প্রত্যেক মন্দিরেই পরিক্রমা মার্গ থাকে। ভক্ত তার সংকল্প অনুসারে দশ বার বা পনের বার বা আরও অধিক পরিক্রমা করেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নিত্য-পার্ষদ গোস্বামীরা প্রতিদিন গোবর্ধন পর্বত প্রদক্ষিণ করতেন। এবং সমগ্র বৃন্দাবন ধামও পরিক্রমা করা উচিত।
(১০) মন্দিরে ভগবানের শ্রীবিগ্রহ বিধিপূর্বক অর্চন করা উচিত। আরতি, ভোগ, শৃঙ্গার ইত্যাদির দ্বারা নিয়মিত ভগবানের আরাধনা করা উচিত।)
(১১) পরিচর্যা অর্থাৎ ভগবানের তৈজসাদি পরিষ্কার করা, অঙ্গন আদি মার্জন করা, শ্রীবিগ্রহ বেশভূষাদির দ্বারা শোভিত করা ইত্যাদি।
(১২) গীত অর্থাৎ একাকী ভগবানের যশকীর্তন করা।
(১৩) সংকীর্তন অর্থাৎ অনেক ভক্ত মিলিত হয়ে কীর্তন অথবা শ্রীভগবানের নাম, রূপ, গুণ, লীলাদির উচ্চ কীর্তন করা।
(১৪) জপ অর্থাৎ মনে মনে মন্ত্র উচ্চারণ করা।
(১৫) বিজ্ঞপ্তি অর্থাৎ শ্রীহরির উদ্দেশ্যে বাক্য এবং মনের দ্বারা নিজ ভাব নিবেদন করা।
(১৬) স্তব পাঠ করা।
(১৭) ভগবানকে নিবেদিত প্রসাদ আস্বাদন করা।
(১৮) পাদ্য অর্থাৎ ভগবানের পাদোদক আস্বাদন করা।
(১৯) ভগবানকে নিবেদিত ধূপ, মাল্য ইত্যাদির সুগন্ধ
(২০) ভগবানের শ্রীমূর্তি স্পর্শ করা।
(২১) ভক্তিভরে ভগবানের শ্রীমূর্তি দর্শন করা।
(২২) নির্দিষ্ট সময়ে ভগবানের আরতি করা।
(২৩) শ্রীমদ্ভাগবত, ভগবদ্গীতা আদি শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে শ্রীকৃষ্ণের নাম, রূপ, গুণ, লীলা ইত্যাদি শ্রবণ করা।
(২৪) ভগবানের কৃপা-ভিক্ষা করে তাঁর কাছে প্রার্থনা করা।
(২৫) স্মরণ অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের নাম, রূপ গুণ, লীলা ইত্যাদি স্মরণ করা।
(২৬) ধ্যান অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের নাম, রূপ, লীলা ইত্যাদি সুষ্ঠুভাবে চিন্তা করা।
(২৭) দাস্য ভাবযুক্ত হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভগবানের সেবা করা।
(২৮) সখ্য অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা এবং ‘শ্রীকৃষ্ণ আমার বন্ধু’—এই ধারণা পোষণ করা।
(২৯) আত্মনিবেদন অর্থাৎ সমস্ত কর্ম শ্রীকৃষ্ণকে সমর্পণ করা।
(৩০) প্রিয়োপকরণ অর্থাৎ যে বস্তু সাধারণত লোকে উত্তম বলে এবং যা নিজের প্রিয়, সেই রকম বস্তু শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন করা।
(৩১) শ্রীকৃষ্ণের জন্য সব রকমের ঝুঁকি নিতে ও চেষ্টা করতে প্রস্তুত থাকা।
(৩২) সর্ব অবস্থাতেই ভগবানের শরণাগত থাকা।
(৩৩) শ্রীকৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয় তুলসীর সেবা করা।
(৩৪) নিয়মিতভাবে শ্রীমদ্ভাগবত আদি শাস্ত্রগ্রন্থ শ্রবণ করা।
(৩৫) শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় মথুরা বা বৃন্দাবনের মতো দিব্য ধামে বাস করা।
(৩৬) শ্রীকৃষ্ণের ভক্তদের সেবা করা।
(৩৭) সাধ্য অনুসারে ভগবানের সেবাসূচক মহোৎসব অনুষ্ঠান করা।
(৩৮) বিশেষভাবে ঊর্জাব্রত অর্থাৎ কার্তিকব্রত পালনে সচেষ্ট হওয়া।
(৩৯) জন্মযাত্রা—ভগবানের আবির্ভাব তিথি পালন এবং সেই তিথিতে উৎসব করা।
(৪০) শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মের সেবায় শ্রদ্ধা এবং বিশেষভাবে প্রীতি প্রদর্শন করা।
(৪১) রসিক ভক্তের সঙ্গে শ্রীমদ্ভাগবতের অর্থ আস্বাদন, অর্থাৎ প্রীতি সহকারে আলোচনা করা।
(৪২) স্বজাতীয় ও উচ্চ অধিকার-বিশিষ্ট স্নিগ্ধ সাধুর সঙ্গ করা।
(৪৩) শ্রীহরির নাম সংকীর্তন করা এবং (৪৪) শ্রীমথুরামণ্ডলে বাস করা।
এইভাবে ভক্তির ৬৪টি অঙ্গ নির্ধারিত হয়েছে। পূর্বেই উল্লেখ করা যে, প্রথম দশটি হচ্ছে ভক্তির প্রারম্ভিক অঙ্গ। তার পরের দশটি মাধ্যমিক বিধি এবং তারপর আরও চুয়াল্লিশটি অতিরিক্ত অঙ্গ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এইভাবে সাধন-ভক্তি অনুশীলনের ৬৪টি অঙ্গ নিরূপিত হয়েছে।
এই ৬৪টি অঙ্গের মধ্যে পাঁচটি—তুলসীতে জলসেচন, শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ, ভক্তসঙ্গ, সংকীর্তন ও মথুরাবাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভক্তির এই ৬৪টি অঙ্গের দ্বারা কায়িক, বাচিক ও মানসিক সমস্ত কার্যকলাপকে সার্থক করা উচিত। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভক্তির বিধি হচ্ছে সব কয়টি ইন্দ্রিয়কে ভগবানের সেবায় যুক্ত করা। কিভাবে তা করা সম্ভব, তা নিরূপিত হয়েছে এই ৬৪টি সাধনার মাধ্যমে। এখন শ্রীল রূপ গোস্বামী নানা শাস্ত্র থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করে এই ভক্ত্যঙ্গগুলির যথার্থতা প্রমাণ করেছেন।
---হরে কৃষ্ণ----
* কৃষ্ণ ভক্তির পবিত্রতা ভক্তিরসামৃতসিন্ধু
* শুদ্ধ ভক্তির লক্ষণ গুলো কি কি? ভক্তিরসামৃতসিন্ধু