কৃষ্ণ ভক্তি বা ভগবদ্ভক্তির শাস্ত্র-প্রমাণ-ভক্তিরসামৃতসিন্ধু

কৃষ্ণ ভক্তি বা ভগবদ্ভক্তির শাস্ত্র-প্রমাণ

শ্রীগুরুর চরণাশ্রয়

শ্রীমদ্ভাগবতের একাদশ স্তন্ধে (১১/৩/২১) ঋষি প্রবুদ্ধ মহারাজ নিমিকে বলছেন, “হে রাজন! নিশ্চিতভাবে জেনে রাখুন যে, প্রাকৃত জগতে সুখের লেশমাত্রও নেই। এই দুঃখময় স্থানে সুখের প্রতীতি কেবল ভ্রমমাত্র। 

 

যে মানুষ যথার্থ সুখ লাভের জন্য ঐকান্তিকভাবে আগ্রহী, তাকে অবশ্যই একজন সদ্গুরুর অন্বেষণ করতে হবে এবং তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে তাঁর চরণাশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। যথার্থ সদগুরু হচ্ছেন তিনি, যিনি স্বয়ং যুক্তি ও তর্কের দ্বারা শাস্ত্রের সিদ্ধান্তে নিম্নাত এবং যিনি অপরকে সেই সিদ্ধান্তে প্রত্যয় উৎপাদন করতে সমর্থ। 

 

যিনি সব রকম জাগতিক কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করে পরমেশ্বর ভগবানের শরণাগত হয়েছেন, সেই মহাপুরুষই যথার্থ সদ্গুরু। পরমানন্দ লাভ করাই হচ্ছে মানব-জীবনের উদ্দেশ্য, সুতরাং প্রতিটি মানুষের কর্তব্য হচ্ছে সদ্গুরুর শরণাপন্ন হওয়া।"

এই শ্লোকের তাৎপর্য হচ্ছে, শাস্ত্র সম্বন্ধে যার কোন রকম জ্ঞান নেই, যে শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে আচরণ করে না, যার চরিত্র সন্দেহজনক, যে ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করে না, অথবা যে ষড় রিপুর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি, 

 

সেই রকম কোন মহামূর্খকে গুরু বলে বরণ করা উচিত নয়। জড় ইন্দ্রিয়সুখ উপভোগের ছয়টি মাধ্যম হচ্ছে জিহ্বা, উপস্থ, উদর, ক্রোধ, মন ও বাক্য। ইন্দ্রিয়ের এই ছয়টি বেগ যিনি দমন করতে সমর্থ, তিনিই হচ্ছেন যথার্থ গুরু এবং তিনি সমস্ত পৃথিবী জুড়ে শিষ্য গ্রহণ করতে পারেন।  

 

এই ধরনের সদ্গুরুর শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করা আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতি সাধনের প্রামাণিক পন্থা। সদগুরুর আশ্রয় লাভ করেছেন যে ভাগ্যবান, তিনি নিশ্চিতভাবে এই ভববন্ধন থেকে মুক্ত হবেন। 

 

সদ্গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ এবং তাঁর কাছ থেকে শিক্ষালাভ, ঋষি প্রবুদ্ধ মহারাজ নিমিকে আরও বলেন, “হে রাজন! শিষ্য শ্রীগুরুদেবকে কেবল গুরুরূপেই স্বীকার করবেন না, তাঁকে পরমেশ্বর ভগবানের প্রতিনিধি পরমাত্মারূপে দর্শন করা উচিত। অর্থাৎ, শিষ্যের কর্তব্য হচ্ছে শ্রীগুরুদেবকে পরমেশ্বর ভগবান বলে মনে করা, কেন না তিনি হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের বাহ্য প্রকাশ।” 

 

সমস্ত শাস্ত্রে এই কথা বলা হয়েছে, এবং শিষ্যের কর্তব্য হচ্ছে সেইভাবে শ্রীগুরুদেবকে গ্রহণ করা। গভীর নিষ্ঠা সহকারে শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ করা উচিত এবং শ্রীগুরুদেবের প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাপরায়ণ হওয়া উচিত। শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ ও কীর্তনরূপ ধর্মপন্থা অবলম্বন করার ফলে ভগবৎ-সেবা ও ভগবৎ-প্রেম লাভ করা যায়। 

 

শিষ্যের কর্তব্য হচ্ছে শ্রীগুরুদেবের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য সর্বক্ষণ সচেষ্ট থাকা। তা হলে তার পক্ষে দিব্যজ্ঞান লাভ করা অত্যন্ত সুলভ হবে। বেদে তা প্রমাণিত হয়েছে, এবং শ্রীল রূপ গোস্বামী তা পুনরায় বিশ্লেষণ করবেন। শ্রীগুরুদেব ও শ্রীকৃষ্ণের প্রতি যিনি অবিচলিতভাবে শ্রদ্ধাপরায়ণ, তাঁর হৃদয়ে সমস্ত তত্ত্ব আপনা থেকেই অনায়াসে স্ফুরিত হয়।

 

শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস সহকারে গুরুসেবা

শ্রীগুরুদেবের কাছ থেকে শিক্ষাপ্রাপ্তি সম্বন্ধে শ্রীমদ্ভাগবতের একাদশ স্কন্ধে (১১/১৭/২৭) শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, “প্রিয় উদ্ধব! শ্রীগুরুদেবকে কেবল আমার প্রতিনিধি বলেই মনে করা উচিত নয়, পরন্তু তাঁকে আমার স্বরূপ বলে জানবে। কখনও তাঁকে অবজ্ঞা করবে না এবং তাঁকে একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করবে না। 

 

একজন সাধারণ মানুষের প্রতি মানুষ যেমন ঈর্ষাপরায়ণ হয়, গুরুদেবের প্রতি কখনও সেইভাবে ঈর্ষাপরায়ণ হওয়া উচিত নয়। গুরুতে সর্বদেবতার অধিষ্ঠান বলে জানবে, এবং তাই গুরুদেবকে সেবা করার ফলে সমস্ত দেবতাদের সেবা করা হয়।”

 

মহাজনদের পদাঙ্ক অনুসরণ

স্কন্দ-পুরাণে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ভক্তের কর্তব্য হচ্ছে পূর্বতন আচার্য ও মহাত্মাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা। কারণ তাঁদের অনুসরণ করার ফলে অভীষ্ট সিদ্ধ হয় এবং তখন আর বিভ্রান্ত হয়ে শোকগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

ব্রহ্মযামল শাস্ত্রে বলা হয়েছে, “কেউ যদি শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে আচরণ না করে মহান ভক্ত হওয়ার অভিনয় করে, তা হলে সে কখনও ভগবদ্ভক্তির পথে উন্নতি সাধন করতে পারে না। পক্ষান্তরে, সে কেবল ঐকান্তিকভাবে আগ্রহী সাধক-ভক্তদের সাধন-মার্গে উৎপাতের সৃষ্টি করে।” 

 

যারা নিষ্ঠা সহকারে শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসরণ করে না, তাদের সাধারণত সহজিয়া বলা হয়, অর্থাৎ যারা মনে করে যে, সব কিছুই অত্যন্ত সস্তা, এবং তারা তাদের মনগড়া সমস্ত ধারণার সৃষ্টি করে এবং তারা কখনও শাস্ত্রের বিধি-নিষেধগুলি অনুসরণ করে না।  

 

এই সমস্ত মানুষেরা ভগবদ্ভক্তির পথে কেবল উৎপাতই সৃষ্টি করে। এই বিষয়ে শাস্ত্র অবজ্ঞাকারী অভক্তরা তর্ক করতে পারে। তার একটি দৃষ্টান্ত বৌদ্ধ দর্শনে পাওয়া যায়। ভগবান বুদ্ধ অতি সম্ভ্রান্ত ক্ষত্রিয় রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর দর্শন বৈদিক সিদ্ধান্তের অনুগামী ছিল না এবং তাই তত্ত্বদ্রষ্টা পুরুষেরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। 

 

মহারাজ অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম সমস্ত ভারতবর্ষে ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে প্রচারিত হয়, কিন্তু মহান আচার্য শঙ্করাচার্যের আবির্ভাবের পর এই বৌদ্ধধর্ম প্রকৃতপক্ষে যা হচ্ছে প্রচ্ছন্ন নাস্তিক্যবাদ, ভারতবর্ষ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত হয়। 

 

বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা যদিও শাস্ত্রনির্দেশ অনুসরণ করে না, তবুও তারা দাবি করে, বুদ্ধদেবের অনেক ভক্ত তাঁর প্রতি তাদের ভক্তি প্রদর্শন করে, এবং তাই তাদের ভক্ত বলেই গণ্য করা উচিত। এর উত্তরে শ্রীল রূপ গোস্বামী বলেছেন যে, বুদ্ধদেবের অনুগামীরা ভক্ত পর্যায়ভুক্ত নয়। 

 

বুদ্ধদেব যদিও ছিলেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতার, কিন্তু তাঁর অনুগামীরা বৈদিক তত্ত্বদর্শন-বিহীন হওয়ার ফলে পরমার্থ সম্বন্ধে অজ্ঞান। বৈদিক শাস্ত্র অধ্যয়ন করার ফলে পরমেশ্বর ভগবানের পরম ঈশ্বরত্ব সম্বন্ধে অবগত হওয়া যায়। তাই যে সমস্ত ধর্ম পরমেশ্বর ভগবানের পরম ঈশ্বরত্ব স্বীকার করে না, সেগুলি ধর্ম নয়, সেগুলি হচ্ছে নাস্তিক্যবাদ।

 

নাস্তিকতার অর্থ, বেদের প্রামাণিকত্ব অস্বীকার করা এবং যে সমস্ত মহান আচার্য জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য বৈদিক শাস্ত্রজ্ঞান শিক্ষাদান করেন তাঁদের অবজ্ঞা করা। 

 

শ্রীমদ্ভাগবতে বুদ্ধদেবকে শ্রীকৃষ্ণের অবতার বলে স্বীকার করা হয়েছে, কিন্তু সেই শ্রীমদ্ভাগবতেই আবার বলা হয়েছে যে, নাস্তিক মানুষদের মোহিত করবার জন্য বুদ্ধদেব আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাই তাঁর শিক্ষা কেবল নাস্তিকদের বিমোহিত করার জন্যই, পরমার্থ সাধনে ঐকান্তিকভাবে আগ্রহী মানুষদের জন্য নয়। 

 

যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন, “শ্রীকৃষ্ণ কেন তা হলে নাস্তিক্যবাদ প্রচার করলেন?” তার উত্তরে বলা হয়েছে যে, বেদের নামে তখন যে অসংখ্য পশু বলি হচ্ছিল, তা বন্ধ করার জন্য পরমেশ্বর ভগবান বেদের নিন্দা করে তথাকথিত অহিংসার বাণী প্রচার করেছিলেন। 

 

সেই সময় ব্রাহ্মণেরা বেদবিহিত যজ্ঞের নাম করে অসংখ্য পশু হত্যা করছিল এবং পশুর মাংস আহার করছিল। তাই বুদ্ধদেব সেই সমস্ত অধঃপতিত মানুষদের এইভাবে বেদের নামে পাশবিক আচরণ থেকে রক্ষা করার জন্য অবতরণ করেছিলেন। 

 

আর তা ছাড়া নাস্তিকদের জন্য তিনি নাস্তিক্যবাদ প্রচার করেছিলেন, যাতে তারা তাঁর অনুগামী হয় এবং তার ফলে পরোক্ষভাবে কৃষ্ণভক্তে পরিণত হয়। 

 

সৎ-ধর্ম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা

নারদীয়-পুরাণে বলা হয়েছে, “কেউ যদি ভগবদ্ভক্তি সম্বন্ধে ঐকান্তিকভাবে আগ্রহী হয়, তা হলে তার অভিলষিত সর্ব অর্থ অচিরেই সিদ্ধ হয়।”

কৃষ্ণার্থে ভোগাদি ত্যাগ

পদ্ম-পুরাণে বলা হয়েছে, “যে মানুষ প্রাকৃত ইন্দ্রিয়তৃপ্তি ত্যাগ করে ভগবদ্ভক্তির পন্থা অঙ্গীকার করেছেন, তাঁর জন্য বিষ্ণুলোকের সমস্ত ঐশ্বর্য প্রতীক্ষা করছে।”

পুণ্যভূমিতে বাস

স্কন্দ পুরাণে বলা হয়েছে, কেউ যদি এক বছর, ছয় মাস, এক মাস অথবা এক পক্ষও দ্বারকাতে বাস করেন, তা হলে তিনি বেকুণ্ঠলোকে উন্নীত হন এবং ভগবানের পার্ষদত্ব লাভ করে সারূপ্য মুক্তি (নারায়ণের মতো চতুর্ভুজ রূপ) প্রাপ্ত হন।

 

ব্রহ্ম-পুরাণে বলা হয়েছে, “ভগবান জগন্নাথের আশি বর্গমাইল। ব্যাপী পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের মাহাত্ম্য যথাযথভাবে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। স্বর্গের দেবতারাও জগন্নাথপুরীর অধিবাসীদের বৈকুণ্ঠবাসীদের মতো চতুর্ভুজ রূপে দর্শন করেন।”

 

নৈমিষারণ্যে সমস্ত মহর্ষিরা যখন সমবেত হয়েছিলেন, শ্রীল সূত গোস্বামী তখন শ্রীমদ্ভাগবত শোনাচ্ছিলেন এবং সেখানে গঙ্গার মাহাত্ম্য বর্ণনা করে বলা হয়, “গঙ্গার জল সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মে অর্পিত তুলসীর সৌরভ বহন করছে এবং এইভাবে গঙ্গার জল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহিমা প্রচার করে প্রবাহিত হচ্ছে। 

 

যেখানেই গঙ্গার জল প্রবাহিত হচ্ছে, সেখানে সব কিছুই বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণভাবে পবিত্র হয়ে যায়।” আবশ্যকতা অনুসারে গ্রহণ নারদীয়-পুরাণে বলা হয়েছে, “ভগবদ্ভক্তি অনুশীলনে ঐকান্তিকভাবে আগ্রহীর পক্ষে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোন কিছু গ্রহণ করা উচিত নয়।” 

 

অর্থাৎ ভক্তির বিধানের উপেক্ষা করা উচিত নয়। যা তিনি সহজভাবে পালন করতে সমর্থ নন, সেই সমস্ত বিধান গ্রহণ করা উচিত নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ভক্তের উচিত প্রতিদিন জপমালায়।

 

লক্ষ নাম জপ করা। কিন্তু তা যদি সম্ভব না হয়, তা হলে তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী তিনি কম সংখ্যক নাম জপ করতে পারেন। সাধারণত আমি আমার শিষ্যদের অন্ততপক্ষে পঁচিশ হাজার নাম জপ করার নির্দেশ দিয়েছি, এবং এই পঁচিশ হাজার নাম তাদের অবশ্যই জপ করতে হয়। 

 

কিন্তু কেউ যদি পঁচিশ হাজার নাম জপ করতেও না পারে, তা হলে অবশ্যই তাকে সেই জপ পরের দিন পূর্ণ করতে হবে। এই নির্দেশ অনুসরণে সকলকে অবশ্যই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। যদি কেউ দৃঢ়তার সঙ্গে তা না করে, তা হলে সে প্রমাদগ্রস্ত হবে।

 

 ভগবৎ সেবার পথে এটি একটি মস্ত বড় অপরাধ। আমরা যদি অপরাধমুক্ত না হই, তা হলে আমরা ভগবদ্ভক্তির মার্গে উন্নতি সাধন করতে পারব না। নিজের যোগ্যতা অনুসারে নিয়ম করে যদি অবিচলিতভাবে তা পালন করা হয়, তাও ভাল। তার ফলে পারমার্থিক জীবনে উন্নতি লাভ করা যায়।

 

একাদশী ব্রত পালন

ব্রহ্মবৈবর্ত-পুরাণে বলা হয়েছে যে, একাদশীর দিন উপবাস করলে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়ে আত্যন্তিক পুণ্য লাভ করা যায়। একাদশীর দিন উপবাস করাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে গোবিন্দ বা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অধিক শ্রদ্ধা ও প্রেমপরায়ণ হওয়া। 

 

একাদশীর দিন উপবাস করার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে, শারীরিক আবশ্যকতাগুলি খর্ব করে ভগবানের মহিমা কীর্তন এবং অন্যভাবে ভগবানের সেবা করে সময়ের সদ্ব্যবহার করা। উপবাসের দিন নিরন্তর গোবিন্দের লীলা স্মরণ এবং তাঁর দিব্য নাম শ্রবণ করাই হচ্ছে সর্বোত্তম।

 

অশ্বত্থ আদি বৃক্ষকে সম্মান প্রদর্শন

স্কন্দ পুরাণে বলা হয়েছে যে, তুলসী ও আমলকী বৃক্ষে জল সেচন করা উচিত। গাভী ও ব্রাহ্মণদের সম্মান ও পূজা করা উচিত এবং শ্রদ্ধা সহকারে বৈষ্ণবদের দণ্ডবৎ প্রণতি নিবেদন করা উচিত এবং তাঁদের ধ্যান করা উচিত। এই সমস্ত আচরণ ভক্তকে তার প্রাকৃত পাপকর্মের ফল থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করে।

 

অভক্ত সঙ্গত্যাগ

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে একবার তাঁর এক গৃহস্থ ভক্ত বৈষ্ণব-আচার সম্বন্ধে প্রশ্ন করেন। তার উত্তরে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেন যে, বৈষ্ণবের কর্তব্য হচ্ছে সর্বক্ষণ অভক্ত সঙ্গ থেকে দূরে থাকা। তারপর তিনি বিশ্লেষণ করেন যে, অভক্ত দুই রকমের। এক শ্রেণীর অভক্ত হচ্ছে কৃষ্ণবিদ্বেষী এবং অপর শ্রেণী হচ্ছে বিষয়ী। 

 

পক্ষান্তরে বলা যায় যে, ইন্দ্রিয়তৃপ্তির অভিলাষী ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিরোধী হচ্ছে অবৈষ্ণব, এবং কখনই তাদের সঙ্গ করা উচিত নয়।

 

কাত্যায়ন-সংহিতায় বলা হয়েছে যে, জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে লোহার খাঁচায় থাকাও বরং ভাল, কিন্তু কৃষ্ণবিদ্বেষী অভক্তের সঙ্গ করা উচিত নয়। তেমনই বিষ্ণু-রহস্যে বলা হয়েছে যে, বিষয়-বাসনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নানা দেব-দেবীর উপাসকদের সহবাস করার থেকে সর্প, ব্যাঘ্র অথবা কুমিরকে আলিঙ্গন করা অনেক ভাল।

 

শাস্ত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃত অভিলাষ পূর্ণ করার জন্য নানা দেব-দেবীর উপাসনা করার কথা বলা হয়েছে। যেমন, সুন্দরী স্ত্রী লাভের জন্য পার্বতীর এবং বিদ্যালাভের জন্য সরস্বতীর আরাধনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এইভাবে শ্রীমদ্ভাগবতে নানা রকম কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসনা করার উল্লেখ রয়েছে। 

 

এই সমস্ত উপাসকদের যদিও আপাতদৃষ্টিতে সেই সমস্ত দেব-দেবীদের মহান ভক্ত বলে মনে হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা হচ্ছে অভক্ত। কোন অবস্থাতেই তাদের ভক্ত বলে মনে করা উচিত নয়। 

 

মায়াবাদীরা বলে, যে কোনও রূপের উপাসনা করা যায়, কেন না চরমে লক্ষ্য একই। যে কোনও রূপে উপাসনা করলেই পরিণামে ভগবানকে পাওয়া যায়। কিন্তু ভগবদ্গীতায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, দেব-দেবীদের উপাসকেরা অবশেষে দেব-দেবীদের লোকে উন্নীত হয়, কিন্তু ভগবদ্ভক্ত বৈকুণ্ঠলোকে প্রবিষ্ট হন। 

 

দেব-উপাসকদের গীতায় যথেষ্ট নিন্দা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, অত্যধিক কামনা বাসনার ফলে যাদের বুদ্ধি বিনষ্ট হয়েছে, তারাই বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করে। তাই বিষ্ণু-রহস্যে এই সমস্ত দেব-দেবীর উপাসকদের ঘোর ভর্ৎসনা করে বলা হয়েছে যে, এই সমস্ত দেব-উপাসকদের সঙ্গে সঙ্গ করার থেকে বরং ভয়ঙ্কর জন্তুদের সঙ্গে থাকাও ভাল।

 

অযোগ্য শিষ্য গ্রহণ না করা, বড় মন্দির নির্মাণের প্রয়াস না করা এবং বহু গ্রন্থ পাঠ না করা আর একটি নিয়ম হচ্ছে যে, বহু শিষ্য গ্রহণ করলেও করা যেতে পারে, কিন্তু কখনই এই রকম আচরণ করা উচিত নয়, যার ফলে কোন কাজের জন্য অথবা কৃপা লাভের জন্য কোন শিষ্যের অধীন হয়ে পড়তে হয়। 

 

নতুন মন্দির নির্মাণ করার জন্য অধিক উদ্যম করাও উচিত নয় এবং ভক্তিবর্ধক গ্রন্থ ব্যতীত অন্য কোন রকম পুস্তক পাঠকরা উচিত নয়। প্রকৃতপক্ষে, কেউ যদি যত্ন সহকারে ভগবদ্‌গীতা শ্রীমদ্ভাগবত, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা ও এই ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থ পাঠ করেন, তা হলেই তিনি কৃষ্ণভাবনামৃত বিজ্ঞান সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করতে পারেন। তখন আর অন্য কোন গ্রন্থ পাঠ করার কষ্ট স্বীকার করতে হয় না। 

 

শ্রীমদ্ভাগবতের সপ্তম স্কন্ধে (৭/১৩/৮) শ্রীনারদ মুনি মহারাজ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে বিভিন্ন বর্ণ ও আশ্রমের কর্তব্য সম্বন্ধে বর্ণনা করার সময়, বিশেষ করে সন্ন্যাসীদের কর্তব্য সম্বন্ধে বর্ণনা করে বলেন যে, অযোগ্য ব্যক্তিদের শিষ্যরূপে গ্রহণ করা সন্ন্যাসীদের উচিত নয়। 

 

সন্ন্যাসীর কর্তব্য হচ্ছে, সবার আগে পরীক্ষা করে দেখা উচিত যে, শিষ্য হওয়ার অভিলাষী ব্যক্তি ঐকান্তিকভাবে কৃষ্ণভক্তি লাভে প্রয়াসী কি না। তা যদি না হয়, তা হলে তাকে শিষ্যত্বে বরণ করা উচিত নয়। কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অহৈতুকী কৃপা এতই অসীম যে, তিনি সমস্ত সদ্গুরুদের সর্বত্র কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার করার আদেশ দিয়েছেন। 

 

তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পরম্পরায় সন্ন্যাসীরাও সর্বত্র কৃষ্ণভাবনার অমৃতবাণী প্রচার করেন এবং যদি কেউ ঐকান্তিকভাবে শিষ্য হতে ইচ্ছুক হয়, তা হলে সন্ন্যাসী তাকে শিষ্যত্বে বরণ করেন।

 

শিষ্যসংখ্যা না বাড়ালে কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের ব্যাপক প্রসার হওয়া সম্ভব নয়, তাই কখনও কখনও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অনুগামী সন্ন্যাসীরা বিপদের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এমন অনেক মানুষকে শিষ্যত্বে বরণ করেন, যারা শিষ্য হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করেনি। এই ধরনের সদ্গুরুর কৃপায় ধীরে ধীরে অযোগ্য শিষ্য ভক্তিমার্গে উন্নতি লাভ করে। কিন্তু কেউ যদি কেবল মিথ্যা সম্মান লাভের জন্য, যশ বৃদ্ধির জন্য শিষ্য সংখ্যা বাড়ায়, তবে সে অবশ্যই কৃষ্ণভাবনাময় অমৃতময় মার্গ থেকে অধঃপতিত হবে।

 

তেমনই, আবার নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করে বিভিন্ন জায়গায় ভাষণ দিয়ে নাম কেনার জন্য বহু গ্রন্থ পাঠ করা সদগুরুর উচিত নয়। এই সমস্ত রোগ বর্জন করা উচিত। আরও বলা হয়েছে যে, মন্দির বানাতে সন্ন্যাসীদের উৎসাহী হওয়া উচিত নয়। 

 

আমরা দেখতে পাই যে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অনুগামী বিভিন্ন আচার্যরা মন্দির তৈরি করতে খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না। কিন্তু কেউ যদি মন্দির তৈরি করার কাজে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে আসেন, তা হলে অনুৎসাহী আচার্য সেই সেবককে বহু ব্যয়সাধ্য মন্দির নির্মাণ করতে অনুমতি দেন। মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ শ্রীল রূপ গোস্বামীর সেবা করতে চেয়েছিলেন। 

 

তাই শ্রীল রূপ গোস্বামী তাঁকে বহু ব্যয়সাধ্য বিশাল গোবিন্দজীর মন্দির নির্মাণ করতে আদেশ দেন। সুতরাং স্বয়ং মন্দির তৈরি করার দায়িত্ব সদ্গুরুর গ্রহণ করা উচিত নয়, কিন্তু কোন বিত্তশালী মানুষ যদি শ্রীকৃষ্ণের সেবায় তাঁর অর্থ ব্যয় করতে চান, তখন শ্রীল রূপ গোস্বামীর মতো আচার্য তাঁর সেই অর্থ ভগবানের সুন্দর মন্দির নির্মাণের সেবায় উপযোগ করতে পারেন। 

 

দুর্ভাগ্যবশত, কখনও কখনও গুরু হওয়ার অযোগ্য ব্যক্তিরাও ধনাঢ্য পুরুষদের কাছ থেকে মন্দির নির্মাণ করবার জন্য অর্থভিক্ষা করে। অযোগ্য গুরু এই ধন বাস্তবিক প্রচারকার্যে প্রয়োগ না করে কেবল আরামে থাকবার জন্য বড় বড় মন্দির তৈরি করে, সেটি মস্ত বড় অপরাধ। 

 

পক্ষান্তরে বলা যায় যে, তথাকথিত পারমার্থিক উন্নতির নামে মন্দির বানাতে উৎসাহী হওয়া সদ্গুরুর উচিত নয়। তাঁর প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হচ্ছে ভগবানের বাণী প্রচার করা। এই সম্বন্ধে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী মহারাজ নির্দেশ দিয়ে গেছেন যে, গুরুর কর্তব্য হচ্ছে গ্রন্থ প্রকাশ করা। কারও যদি টাকা থাকে, তা হলে ব্যয়সাপেক্ষ মন্দির না বানিয়ে কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের প্রচারের জন্য বিভিন্ন ভাষায় গ্রন্থ প্রকাশ করে সেই অর্থ ব্যয় করা উচিত।

 

নিষ্কপট ব্যবহার এবং লাভ ও ক্ষতিতে সমভাবাপন্ন পদ্ম-পুরাণে বলা হয়েছে, “ভগবদ্ভক্তি পরায়ণ ব্যক্তির পক্ষে জাগতিক লাভ বা ক্ষতিতে কখনও বিচলিত হওয়া উচিত নয়। ভোজন ও আচ্ছাদন সাধনকারী বস্তুর অপ্রাপ্তিতে বা প্রাপ্ত বস্তুর বিনাশে বিহ্বলচিত্ত না হয়ে কেবল ভগবানকেই স্মরণ করা উচিত।” 

 

অর্থাৎ প্রতিটি বদ্ধ জীবই সর্বক্ষণ জড়-জাগতিক কার্যকলাপের চিন্তায় মগ্ন; এই সমস্ত চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনায় মগ্ন হওয়া উচিত। পূর্বে বিশ্লেষণ করা হয়েছে যে, কৃষ্ণভাবনামৃতের প্রধান সিদ্ধান্ত হচ্ছে সর্বক্ষণ শ্রীকৃষ্ণের কথা চিন্তা করা। প্রাপ্ত বস্তুর বিনাশে বিচলিত না হয়ে মনকে সর্বক্ষণ ভগবানের চরণারবিন্দে নিবদ্ধ রাখাই কর্তব্য। 

 

কখনই শোক ও মোহের দ্বারা বশীভূত হওয়া ভক্তের উচিত নয়। পদ্ম-পুরাণে বলা হয়েছে, “শোক ও মোহের দ্বারা যাদের চিত্ত বিমোহিত হয়েছে, তাদের হৃদয়ে শ্রীকৃষ্ণ কখনই প্রকাশিত হন না।”

 

অন্য দেবতাদের অবজ্ঞা

অন্য দেব-দেবীদের অসম্মান করা উচিত নয়। দেবতাদের ভক্ত না হওয়ার অর্থ এই নয় যে, তাঁদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করতে হবে। বৈষ্ণব যদিও শিব বা ব্রহ্মার ভক্ত নন, কিন্তু তবুও তাঁদের মতো মহান দেবতাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা তাঁর কর্তব্য। বৈষ্ণব দর্শন অনুসারে একটি পিপীলিকাকে পর্যন্ত সম্মান করা উচিত, সুতরাং শিব-ব্রহ্মার মতো মহাপুরুষদের কি কথা।

 

পদ্ম-পুরাণে বলা হয়েছে, “ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বা হরি হচ্ছেন সমস্ত দেবতাদের ঈশ্বর এবং তাই সর্ব অবস্থাতেই তিনি হচ্ছেন আরাধ্য। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, ব্রহ্মা, রুদ্রাদি দেবতাদের অবজ্ঞা করতে হবে।”

 

কোন জীবকে ক্লেশ না দেওয়া

মহাভারতে বলা হয়েছে—“যে মানুষ অন্য কোন জীবকে উত্ত্যক্ত করে না অথবা ক্লেশ দেয় না, যিনি সকলকে পুত্রবৎ দর্শন করেন, যাঁর হৃদয় নির্মল, তিনি অচিরেই পরমেশ্বর ভগবানের কৃপা লাভ করেন।” আজকের তথাকথিত সভ্য সমাজে কখনও কখনও পশুহিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়, কিন্তু কসাইখানাগুলিতে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ নিরীহ পশু হত্যা হচ্ছে। বৈষ্ণবের মনোভাব সেই রকম নয়। বৈষ্ণব কখনও পশুহত্যা বরদাস্ত করেন না এবং তিনি কখনই কাউকে কোন রকম ক্লেশ দেন না।

 আরও পড়ুন 

* কৃষ্ণ ভক্তির পবিত্রতা ভক্তিরসামৃতসিন্ধু

* শুদ্ধ ভক্তির লক্ষণ গুলো কি কি? ভক্তিরসামৃতসিন্ধু  

* ভক্তিযোগ সাধনের বিধি সমূহ 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url