কুন্তীদেবীর প্রার্থনা এবং পরীক্ষিতের প্রাণরক্ষা-অমল পুরাণ

 

অশ্বথামার ব্রহ্মাঅস্ত্র থেকে উত্তরাকে রক্ষা করার পর শ্রীকৃষ্ণের প্রতি কুন্তীদেবীর প্রার্থনা

 

সূত গোস্বামী বললেন—“তারপর পরলোকগত আত্মীয়-স্বজনদের উদ্দেশ্যে জল অর্পণ করার মানসে পাণ্ডবেরা দ্রৌপদীসহ গঙ্গাতীরে গমন করলেন। মহিলারা অগ্রভাগে যাচ্ছিলেন। 

 

তাঁদের জন্য বিলাপ করে তাঁরা যথেষ্ট পরিমাণে গঙ্গাজল অর্পণ করলেন এবং গঙ্গায় স্নান করলেন, কেননা সেই জল পরমেশ্বরের শ্রীপাদপদ্মের ধূলিকণা মিশ্রিত হয়ে পবিত্রতা লাভ করেছে। সেখানে কৌরব-নৃপতি মহারাজ যুধিষ্ঠির তাঁর অনুজ ভ্রাতৃবর্গ এবং ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী ও দ্রৌপদীসহ শোকাভিভূত হয়েবসেছিলেন। 

 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণও সেখানে ছিলেন। সর্বশক্তিমানের দুর্বার বিধি-নিয়মাদি এবং জীবের উপরে সেগুলির প্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং উপস্থিত মুনিগণ আর্ত ও শোকাভিভূত সকলকেই সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। 

 

ধূর্ত-দুর্যোধন এবং তার দলবল অজাতশত্রু মহারাজ যুধিষ্ঠিরের রাজ্য কপটতাপূর্বক অপহরণ করেছিল।পরমেশ্বরের কৃপায় তার পুনরুদ্ধার কার্য সুসম্পন্ন হয়েছিল এবং দুর্যোধনের সাথে যে সমস্ত অসৎ রাজারা যোগ দিয়েছিল, 

 

তাদেরও পরমেশ্বর বধ করেছিলেন। রাণী দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ করার ফলে যাদের আয়ু ক্ষয় হয়েছিল, তাদেরও মৃত্যু হয়েছিল। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মহারাজ যুধিষ্ঠিরের তত্ত্বাবধানে তিনটি সুসম্পন্ন অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠানের উদ্যোগ করিয়েছিলেন এবং তার মাধ্যমেই শত যজ্ঞ অনুষ্ঠানকারী ইন্দ্রের মতো যুধিষ্ঠির মহারাজের ধর্ম-খ্যাতি সর্বদিকে মহিমান্বিত করে তুলতে প্রণোদিত করেছিলেন।  

 

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন প্রস্থানের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। শ্রীল ব্যাসদেবপ্রমুখ ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক পূজিত হয়ে তিনি সাত্যকি ও উদ্ধবসহ পাণ্ডবদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাঁদের দ্বারা পূজিত হয়ে ভগবানও তাঁদের প্রতি পূজা করলেন। যে মুহূর্তে তিনি রথে আরোহণ করে গমনোদ্যত হয়েছেন, সেই সময় তিনি দেখলেন যে উত্তরা ভয়ে ব্যাকুল হয়ে তাঁর দিকে দ্রুতবেগে আসছেন।”


উত্তরা বললেন, “হে দেবতাদের দেবতা, হে জগদীশ্বর, হে মহাযোগী! আমাকে রক্ষা করুন; কারণ দ্বন্দ্বভাব সমন্বিত এই জগতে আপনি ছাড়া আর কেউ আমাকে মৃত্যুর করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে পারবে না। 

 

হে পরমেশ্বর, আপনি সর্বশক্তিমান। একটি জ্বলন্ত লৌহবাণ আমার প্রতি দ্রুতগতিতে ধাবিত হচ্ছে। হে নাথ, যদি আপনার ইচ্ছা হয় তাহলে এটি আমাকে দগ্ধ করুক, কিন্তু এটি যেন আমার গর্ভস্থ সন্তানটিকে দগ্ধ না করে। হে পরমেশ্বর, আমাকে এই কৃপা করুন।”


সূত গোস্বামী বললেন—“তাঁর কথা ধৈর্য সহকারে শ্রবণ করে ভক্তবৎসল পরমেশ্বর ভগবান তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলেন যে দ্রোণাচার্যের পুত্র অশ্বত্থামা পাণ্ডব বংশের শেষ বংশধরটিকে বিনষ্ট করার জন্য ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। 

 

হে মুনিশ্রেষ্ঠ (শৌনক), পাণ্ডবেরা তখন জ্বলন্ত ব্রহ্মাস্ত্র তাঁদের অভিমুখে আসতে দেখে তাঁদের পাঁচটি নিজ নিজ অস্ত্র তুলে নিলেন। সর্বশক্তিমান পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন দেখলেন যে সর্বতোভাবে তাঁর শরণাগত অনন্য ভক্তদের মহা বিপদ উপস্থিত হয়েছে, তখন তিনি তাঁদের রক্ষা করার জন্য আপন অস্ত্র সুদর্শন চক্র ধারণ করলেন। 

 

পরম যোগ রহস্যের নিয়ন্তা যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ সর্ব জীবের হৃদয়ে পরমাত্মারূপে বিরাজ করেন। তাই কুরুবংশ রক্ষা করার জন্য তাঁর যোগমায়ার দ্বারা তিনি উত্তরার গর্ভ আবৃত করলেন। হে শৌনক, যদিও অশ্বত্থামা কর্তৃক নিক্ষিপ্ত ব্রহ্মাস্ত্র ছিল অব্যর্থ এবং অনিবার্য, তথাপি শ্রীবিষ্ণুর (শ্রীকৃষ্ণের) তেজের দ্বারা প্রতিরুদ্ধ হওয়াতে তা সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রিয় এবং ব্যর্থ হল। 

 

হে ব্রাহ্মণগণ, যে আশ্চর্যময় ও অচ্যুত পরমেশ্বর ভগবান তাঁর মায়াশক্তির দ্বারা এই জড় জগতের সৃষ্টি করেন, পালন করেন ও ধ্বংস করেন এবং যিনি প্রাকৃত জন্মরহিত, তাঁর পক্ষে এই ব্রহ্মাস্ত্র প্রশমন-কার্য বিশেষ বিস্ময়কর বলে মনে করবেন না। 

 

এইভাবে ব্রহ্মাস্ত্রের তেজ থেকে মুক্ত হয়ে কৃষ্ণভক্ত সাধ্বী কুন্তী তাঁর পঞ্চপুত্র এবং দ্রৌপদীসহ একযোগে শ্রীকৃষ্ণের স্তব করতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণ তখন দ্বারকার অভিমুখে গমনোদ্যত হলেন।”শ্রীমতী কুন্তীদেবী বললেন—“হে কৃষ্ণ, আমি তোমাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। 

 

কারণ তুমি আদি পুরুষ এবং জড়া প্রকৃতির সমস্ত গুণের অতীত। তুমি সকলের অন্তরে ও বাহিরে অবস্থিত, তথাপি তোমাকে কেউ দেখতে পায় না। তুমি ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানের অতীত, তুমি মায়ারূপা যবনিকার দ্বারা আচ্ছাদিত, অব্যক্ত ও অচ্যুত। মূঢ়দ্রষ্টা যেমন অভিনেতার সাজে সজ্জিত শিল্পীকে দেখে সাধারণত চিনতে পারে না, তেমনই অজ্ঞ ব্যক্তিরা তোমাকে দেখতে পায় না। 

 

পরমার্থের পথে উন্নত পরমহংসদের, মুনিদের এবং জড় ও চেতনের পার্থক্য নিরূপণ করার মাধ্যমে যাঁদের অন্তর নির্মল হয়েছে, তাঁদের অন্তরে অপ্রাকৃত ভক্তিযোগ-বিজ্ঞান বিকশিত করার জন্য তুমি স্বয়ং অবতরণ কর। 

 

তাহলে আমার মতো স্ত্রীলোকেরা কিভাবে তোমাকে সম্যরূপে জানতে পারবে। বসুদেবতনয়, দেবকীনন্দন, গোপরাজ নন্দের পুত্র এবং গাভী ও ইন্দ্রিয়সমূহের আনন্দদাতা পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে আমি বার বার আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।”


“হে পরমেশ্বর, তোমার উদর-কেন্দ্রের নাভিদেশ পদ্মসদৃশ আবর্তে চিহ্নিত, গলদেশে পদ্মের মালা নিয়ত শোভিত, তোমার দৃষ্টিপাত পদ্মের মতো স্নিগ্ধ এবং পাদদ্বয় পদ্ম চিহ্নাঙ্কিত, তোমাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। 

 

হে হৃষীকেশ, সকল ইন্দ্রিয়ের অধিপতি ও সর্বেশ্বরেশ্বর, তোমার জননী দেবকীকে ঈর্ষাপরায়ণ কংস দীর্ঘকাল যাবৎ কারারুদ্ধ করে রাখাতে তিনি শোকে অভিভূত হলে তুমি তাঁকে কারামুক্ত করেছিলে, তেমনই তুমি আমাকে এবং আমার পুত্রদের বারে বারে বিপদরাশি থেকে মুক্ত করেছ। 

 

হে কৃষ্ণ, পরমেশ্বর শ্রীহরি! বিষ, মহা অগ্নি, নরখাদক রাক্ষস, পাপচক্রান্তময় সভা, বনবাসের দুঃখ-কষ্ট থেকে, এবং যুদ্ধে বহু মহারথীর প্রাণঘাতী অস্ত্রসমূহ থেকে তুমি আমাদের পরিত্রাণ করেছ। আর এখন অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্র থেকে তুমি আমাদের রক্ষা করলে। 

 

হে জগদীশ্বর, আমি কামনা করি যেন সেই সমস্ত সঙ্কট বারে বারে উপস্থিত হয়, যাতে বারে বারে আমরা তোমাকে দর্শন করতে পারি। কারণ তোমাকে দর্শন করলেই আমাদের আর জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হতে হবে না বা এই সংসার চক্র দর্শন করতে হবে না। 

 

হে পরমেশ্বর, যাঁরা জড় আসক্তিশূন্য হয়েছে, তুমি সহজেই তাদের গোচরীভূত হও। আর যে ব্যক্তি জড়জাগতিক প্রগতিপন্থী এবং সম্ভ্রান্ত কুলোদ্ভূত হয়ে বিপুল ঐশ্বর্য, উচ্চ শিক্ষা, দৈহিক সৌন্দর্য নিয়ে আপন উন্নতি লাভে সচেষ্ট, সে ঐকান্তিক ভাব সহকারে তোমার কাছে আসতে পারে না। 

 

জড় বিষয়ে যারা সম্পূর্ণভাবে নিঃস্ব, তুমি সেই অকিঞ্চনগণের সম্পদ। তুমি প্রকৃতির গুণের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অতীত। তুমি সম্পূর্ণরূপে আত্মতৃপ্ত এবং তাই তুমি সর্বপ্রকার কামনা-বাসনা রহিত হয়ে প্রশান্ত এবং মুক্তি দানে সমর্থ। আমি তোমাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। 

 

হে পরমেশ্বর, আমি মনে করি যে তুমি নিত্যকালস্বরূপ, পরম নিয়ন্তা, আদি ও অন্তহীন এবং সর্বব্যাপ্ত। তুমি সমভাবে সকলের প্রতি তোমার করুণা বিতরণ কর। পরস্পরের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগের ফলে জীবের মধ্যে কলহ হয়।  

 

হে পরমেশ্বর, তোমার অপ্রাকৃত লীলা কেউই বুঝতে পারে না, যা আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ মানুষের কার্যকলাপের মতো বলে মনে হয় এবং তাই তা বিভ্রান্তিজনক। কেউই তোমার বিশেষ কৃপার অথবা বিদ্বেষের পাত্র নয়। 

 

মানুষ কেবল অজ্ঞতাবশত মনে করে যে তুমি পক্ষপাতিত্বপূর্ণ। হে বিশ্বাত্মা, তুমি প্রাকৃত কর্মরহিত হওয়া সত্ত্বেও কর্ম কর, তুমি প্রাকৃত জন্মরহিত এবং সকলের পরমাত্মা হওয়া সত্ত্বেও জন্মগ্রহণ কর। তুমি পশু, মানুষ, ঋষি এবং জলচর কুলে অবতরণ কর। 

 

স্পষ্টতই সমস্ত অত্যন্ত বিমোহিতকর। হে কৃষ্ণ, দধিভাণ্ড ভঙ্গ করার অপরাধে যশোদা যখন তোমাকে বন্ধন করার জন্য রজ্জু গ্রহণ  করেছিলেন, তখন তোমার নয়ন অশ্রুর দ্বারা প্লাবিত হয়েছিল এবং তা তোমার নয়নের অঞ্জন বিধৌত  করেছিল। 

 

স্বয়ং ভয়েরও ভয়স্বরূপ তুমি তখন ভয়ে  ভীত হয়েছিলে। তোমার সেই অবস্থা আমার কাছে 1 এখনও বিমোহিতকর। কেউ কেউ বলেন পুণ্যবান রাজাদের মহিমান্বিত করার জন্য অজ জন্মগ্রহণ করেছে। এবং কেউ কেউ বলেন তোমার অন্যতম প্রিয়ভক্ত যদুর আনন্দ বিধানের জন্য তুমি জন্মরহিত হওয়া সত্ত্বেও যদুবং শে জন্মগ্রহণ করেছ। 

 

মলয় পর্বতের যশ বৃদ্ধির জন্য যেমন সেখানে চন্দন বৃক্ষের জন্ম হয়, তেমনই তুমি মহারাজ যদুর বংশে জন্মগ্রহণ করেছ। অন্য কেউ কেউ বলেন যে বসুদেব এবং দেবকী তোমার কাছে প্রার্থনা করায় তুমি তাঁদের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছ। 

 

নিঃসন্দেহে তুমি প্রাকৃত জন্মরহিত, তথাপি তুমি তাঁদের মঙ্গল সাধনের জন্য এবং দেববিদ্বেষী অসুরদের সংহার করার জন্য জন্মগ্রহণ করেছ। অন্যেরা বলেন যে সমুদ্রের মধ্যে নৌকার মতো পৃথিবী অতি ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে দারুণভাবে পীড়িত হলে তোমার পুত্র ব্রহ্মা তোমার কাছে প্রার্থনা জানায়, আর তাই তুমি সেই ভার হরণ করার জন্য অবতীর্ণ হয়েছ। 

 

আবার অন্য আরও অনেকে বলেন যে অবিদ্যাজনিত কাম এবং কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ জড় জাগতিক দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত বদ্ধজীবেরা যাতে  ভক্তিযোগের সুযোগ নিয়ে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে, সেই উদ্দেশ্যেই শ্রবণ, স্মরণ, অর্চন আদি ভক্তিযোগের পন্থাসমূহ পুনঃপ্রবর্তনের জন্য তুমি অবতরণ করেছিলে। 

 

হে শ্রীকৃষ্ণ, যাঁরা তোমার অপ্রাকৃত চরিত-কথা নিরন্তর শ্রবণ করেন, কীর্তন করেন, স্মরণ করেন এবং অবিরাম উচ্চারণ করেন অথবা অন্যে তা করলে আনন্দিত হন, তাঁরা অবশ্যই তোমার শ্রীপাদপদ্ম অচিরেই দর্শন করতে পারেন, যা একমাত্র জন্ম-মৃত্যুর প্রবাহকে নিবৃত্ত করতে পারে। 

 

হে প্রভু, তুমি তোমার সমস্ত কর্তব্য স্বয়ং সম্পাদন করেছ। যদিও আমরা সর্বতোভাবে তোমার কৃপার উপর নির্ভরশীল এবং তুমি ছাড়া আমাদের রক্ষা করার আর কেউ নেই এবং যখন সমস্ত রাজারা আমাদের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ, সেই অবস্থায় তুমি কি আজ আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছ? 

 

জীবাত্মার প্রয়াণ ঘটলেই যেমন কোন দেহের নাম ও যশ শেষ হয়ে যায়, তেমনই তুমি যদি আমাদের না দেখ তাহলে আমাদের সমস্ত যশ ও কীর্তি পাণ্ডব এবং যদুদের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ শেষ হয়ে যাবে। হে গদাধর (শ্রীকৃষ্ণ), আমাদের রাজ্য এখন তোমার শ্রীপাদপদ্মের সুলক্ষণযুক্ত চিহ্ন দ্বারা অঙ্কিত হয়ে শোভা পাচ্ছে; কিন্তু তুমি চলে গেলে আর তেমন শোভা পাবে না। 

 

এই সমস্ত জনপদ সর্বতোভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে, কারণ প্রভূত পরিমাণে শস্য ও ঔষধি হচ্ছে, বৃক্ষসমূহ পরিপক্ব ফলে পূর্ণ হয়েছে, নদীগুলি প্রবাহিত হচ্ছে, গিরিসমূহ ধাতুতে পূর্ণ হয়েছে এবং সমুদ্র সম্পদে পূর্ণ হয়েছে। 

 

আর এ সবই হয়েছে সেগুলির উপর তোমার শুভ দৃষ্টিপাতের ফলে। হে জগদীশ্বর, হে সর্বান্তর্যামী, হে বিশ্বরূপ, দয়া করে তুমি আমার আত্মীয়-স্বজন, পাণ্ডব এবং যাদবদের প্রতি গভীর স্নেহের বন্ধন ছিন্ন করে দাও।  

 

হে মধুপতি, গঙ্গা যেমন অপ্রতিহতভাবে সমুদ্র অভিমুখে প্রবাহিত হয়, তেমনই আমার একনিষ্ঠ মতি যেন নিরন্তর তোমাতেই আকৃষ্ট হয়। হে শ্রীকৃষ্ণ, হে অর্জুনের সখা, হে বৃষ্ণিকুলশ্রেষ্ঠ, পৃথিবীতে উৎপাতকারী রাজন্যবর্গের তুমি বিনাশকারী। 

 

তুমি অক্ষয় বীর্য, তুমি গোলোকাধিপতি। গাভী, ব্রাহ্মণ এবং ভক্তদের দুঃখ দূর করার জন্য তুমি অবতরণ কর। তুমি যোগেশ্বর, জগদ্গুরু, সর্বশক্তিমান ভগবান এবং তোমাকে আমি বারবার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।”


শ্রীসূত গোস্বামী বললেন—“পরমেশ্বর ভগবান তাঁর মহিমা কীর্তনের উদ্দেশ্যে সুনির্বাচিত শব্দমালার দ্বারা রচিত কুন্তীদেবীর প্রার্থনা এইভাবে শ্রবণ করে মৃদু হাসলেন। সেই হাসি তাঁর যোগশক্তির মতোই ছিল মনোমুগ্ধকর। 

 

শ্রীমতী কুন্তীদেবীর প্রার্থনা এইভাবে গ্রহণ করে পরমেশ্বর ভগবান পরে হস্তিনাপুরের প্রাসাদে প্রবেশপূর্বক অন্যান্য মহিলাদের তাঁর বিদায়ের কথা জানালেন। কিন্তু তিনি গমনোদ্যত হলে মহারাজ যুধিষ্ঠির তাঁকে প্রেমভরে অনুনয় করে নিবারণ করলেন। 

 

ব্যাসদেব প্রমুখ মহর্ষিগণ এবং অদ্ভুতকর্মা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ ইতিহাস আদি শাস্ত্রসমূহের প্রমাণ উল্লেখপূর্বক উপদেশ দেওয়া সত্ত্বেও শোকসন্তপ্ত মহারাজ যুধিষ্ঠির শাস্তি পেলেন না।”


হে মুনিগণ, ধর্মপুত্র মহারাজ যুধিষ্ঠির তাঁর আত্মীয় ও বন্ধুবর্গের মৃত্যুতে সাধারণ জাগতিক মানুষের মতো শোকাভিভূত হয়েছিলেন এবং এইভাবে স্নেহ ও মোহের বশীভূত হয়ে তিনি বলতে লাগলেন, “হায়! আমি অত্যন্ত পাপিষ্ঠ! আমার হৃদয় গভীর অজ্ঞানতায় আচ্ছন্ন! 

 

এই দেহ, যা অবশেষে অন্যদের ভক্ষ্য, তারই জন্য আমি বহু বহু অক্ষৌহিণী সেনা বধ করেছি। আমি বহু বালক, ব্রাহ্মণ, সুহৃদ, সখা, পিতৃব্য, গুরুজন এবং ভ্রাতাদের বধ করেছি। তাই এই সমস্ত পাপের ফলে আমার জন্য যে নরক বাস আসন্ন, লক্ষ লক্ষ বছর জীবিত থাকলেও তা থেকে আমার মুক্তি হবে না।

 

 ন্যায়সঙ্গত কারণে প্রজাপালক রাজা শত্রু বধ করলে কোন পাপ হয় না। কিন্তু শাস্ত্রের এই সমস্ত অনুশাসন আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আমি স্ত্রীলোকদের বহু পতি ও বান্ধবকে বধ করেছি এবং এইভাবে আমি এতই শত্রুতার সৃষ্টি করেছি যে জড়জাগতিক কল্যাণ সাধনের দ্বারা তা অপনোদন করা সম্ভব নয়। 

 

কর্দমের দ্বারা যেমন কর্দমাক্ত জল পরিশ্রুত করা যায় না অথবা সুরার দ্বারা যেমন সুরা-কলঙ্কিত পাত্র পবিত্র করা যায় না, তেমনই যজ্ঞে পশুবধ করে নরহত্যাজনিত পাপও রোধ করা যায় না।”

 

আরও পড়ুন
 
* ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সকল লীলা কাহিনী

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url