ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপস্থিতিতে ভীষ্মদেবের প্রয়াণ
ভীষ্মদেবের অন্তিম সময়ের গুরুত্বপূর্ণ বাণী
শ্রীসূত গোস্বামী বললেন—“কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে বহু প্রজা হত্যা করার জন্য ভীত হয়ে যুধিষ্ঠির মহারাজ অতঃপর ধর্মতত্ত্ব জানার জন্য সেই যুদ্ধক্ষেত্রে গমন করলেন। সেখানে ভীষ্মদেব শরশয্যায় শায়িত হয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছিলেন।
সেই সময়ে তাঁর সমস্ত ভ্রাতারা স্বর্ণালঙ্কারে সজ্জিত উত্তম অশ্বদের চালিত অত্যন্ত সুন্দর সুন্দর রথে আরোহণ করে তাঁর অনুগমন করলেন। তাঁদের সঙ্গে ব্যাসদেব, পাণ্ডবদের প্রধান পুরোহিত ধৌম্যের মতো ঋষিরা এবং অন্যেরা ছিলেন।”
“হে বিপ্রর্ষি, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণও অর্জুনের সনে একটি রথে চড়ে তাঁদের অনুগমন করলেন। এইভাবে যুধিষ্ঠির মহারাজকে অত্যন্ত আভিজাত্যসম্পন্ন বলে হতে লাগল, ঠিক যেমন কুবেরকে গুহ্যক আদি সঙ্গী পরিবৃত অবস্থায় মনে হয়। আকাশমার্গ থেকে বিচ্যুত এক দেবতার মতো তাঁকে (ভীষ্মদেবকে) ভূমিতে শায়িত দেখে পাণ্ডবরাজ যুধিষ্ঠির তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর উদ্দেশ্যে প্রণতি নিবেদন করলেন।
ভরত মহারাজের বংশধরগণের মধ্যে যিনি ছিলেন প্রধান, সেই ভীষ্মদেবকে দর্শন করার জন্য ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত মহাত্মারা, অর্থাৎ সত্ত্বগুণে স্থিত দেবর্ষি, ব্রহ্মর্ষি ও রাজর্ষিরা সেখানে সমবেত হয়েছিলেন। সেখানে পর্বতমুনি, নারদমুনি, ধৌম্য, ভগবদাবতার ব্যাসদেব, বৃহদশ্ব, ভরদ্বাজ, পরশুরাম ও তাঁর শিষ্যবর্গ, বশিষ্ঠ, ইন্দ্রপ্রমদ, ত্রিত, গৃৎসমদ, অসিত, কক্ষীবান, গৌতম, অত্রি, কৌশিক এবং সুদর্শনের মতো মহান মুনি ঋষিরা উপস্থিত ছিলেন।”
“হে ব্রাহ্মণগণ, এছাড়া শুকদেব আদি অমল পরমহংসগণ এবং কশ্যপ ও আঙ্গিরস প্রমুখ মুনিগণ তাঁদের নিজ নিজ শিষ্য পরিবৃত হয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। ধর্মতত্ত্ববেত্তা, দেশ-কাল-পাত্র অনুসারে কার্য সম্পাদনে দক্ষ,
অষ্টবসুশ্রেষ্ঠ ভীষ্মদেব সেই সমস্ত মহাপ্রভাবশালী ঋষিদের সেখানে উপস্থিত দেখে যথাযথভাবে তাঁদের স্বাগত অভ্যর্থনা জানালেন। পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ প্রত্যেকেরই হৃদয়ে অধিষ্ঠিত রয়েছেন, তবুও তিনি তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তিবলে নিজ অপ্রাকৃত স্বরূপ প্রকাশিত করে থাকেন।
সেই পরমেশ্বরই ভীষ্মদেবের সম্মুখে উপবিষ্ট ছিলেন এবং যেহেতু ভীষ্মদেব তাঁর মহিমা সম্বন্ধে অবগত তাই তিনি যথাযোগ্যভাবে শ্রীকৃষ্ণের পূজা করলেন। মহারাজ পাণ্ডুর পুত্রেরা তাঁদের মরণোন্মুখ পিতামহের প্রতি প্রীতিবশত অভিভূত হয়ে নিঃশব্দে কাছেই বসেছিলেন। তাই দেখে ভীষ্মদেব ভাবাবেগে তাঁদের অভিনন্দন জানালেন। তাঁদের প্রতি প্রীতি এবং স্নেহের বশে তিনি অভিভূত হয়েছিলেন বলে তাঁর চোখে ভাবোচ্ছ্বাসের অশ্রু দেখা দিল।”
ভীষ্মদেব বললেন—“হায়, সাক্ষাৎ ধর্মের পুত্র হওয়ার ফলে তোমরা কী ভীষণ দুঃখ-কষ্ট এবং কী ভীষণ অন্যায় আচরণ ভোগ করেছ। সেই ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে তোমাদের জীবিত থাকার কথা নয়, তবুও ব্রাহ্মণ, ভগবান এবং ধর্মের দ্বারাই তোমরা সুরক্ষিত হয়েছিলে। মহারথী পাণ্ডুর মৃত্যুর পর আমার পুত্রবধূ কুন্তী বহু শিশু সন্তানাদিসহ বিধবা হন, এবং সেইজন্য বহু দুঃখ কষ্ট তিনি ভোগ করেন।
আর যখন তোমরা বড় হয়ে উঠলে, তখনও তোমাদের কার্যকলাপের জন্য তাঁকে প্রভূত দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। আমার মতে, এই সবই ঘটেছে অনিবার্য কালের প্রভাবে, যার দ্বারা প্রতিটি গ্রহের প্রতিটি জীব নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, ঠিক যেমন মেঘরাশি বায়ুর দ্বারা বাহিত হয়ে থাকে।
অনিবার্য কালের প্রভাব কি অদ্ভুত। এই প্রভাব অপরিবর্তনীয়—তা না হলে, ধর্মপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির যেখানে, গদাধারী মহাযোদ্ধা ভীমসেন ও শক্তিশালী অস্ত্র গাণ্ডীবধারী মহাধনুর্ধর অর্জুন যেখানে, এবং সর্বোপরি পাণ্ডবদের সাক্ষাৎ সুহৃদ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যেখানে, সেখানে প্রতিকূলতা হয় কি করে?”
ভগবান “হে রাজন্, পরমেশ্বরের (শ্রীকৃষ্ণের) পরিকল্পন কেউই জানতে পারে না। এমনকি, মহান্ দার্শনিকেরাও বিশদ অনুসন্ধিৎসা সহকারে নিয়োজিত থেকেও কেবলই বিভ্রান্ত হন। হে ভরতকুলতিলক (যুধিষ্ঠির), আমি তাই মনে করি যে এ সবই পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্কল্পের অন্তর্গত।
পরমেশ্বর ভগবানের অবিচিন্ত্য সঙ্কল্পকে স্বীকার করে নিয়ে তোমাকে তা অবশ্যই মেনে চলতে হবে। তুমি এখন সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছ হে নাথ, এখন যারা অনাথ হয়েছে, সেই সব প্রজাদের যত্ন এবার তোমাকে নিতে হবে। এই শ্রীকৃষ্ণ সাক্ষাৎ অচিন্ত্য, আদি পুরুষ। তিনি আদি নারায়ণ, পরম ভোক্তা।
কিন্তু তিনি তাঁর নিজের সৃষ্ট মায়াশক্তির প্রভাবে আমাদের মুগ্ধ করে বৃষ্ণিকুলেরই একজনের মতো হয়ে তাঁদের মাঝে বিচরণ করছেন। হে রাজন, শিব, দেবর্ষি নারদ এবং ভগবদাবতার কপিলদেব আদি সকলেই সাক্ষাৎ সংস্পর্শের মাধ্যমে তাঁর অতি নিগূঢ় মহিমারাজি সম্বন্ধে অবগত।
হে রাজন, নিতান্তই মোহের বশে যাঁকে তোমরা তোমাদের মাতুল-পুত্র, অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী, মন্ত্রণাদাতা, দূত, হিতকারী, সারথী ইত্যাদি বলে মনে করেছ, তিনিই হচ্ছেন সেই পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। অদ্বয়-তত্ত্ব পরমেশ্বর ভগবান হওয়ার জন্য তিনি প্রত্যেকের হৃদয়ে বিরাজমান।
তিনি সকলের প্রতি সমভাবে করুণাশীল, ভেদবুদ্ধিজনিত অভিমানশূন্য এবং সকল প্রকার আসক্তিরহিত। তাই তিনি যা করেন, তা সবই জড় বিকারশূন্য। তিনি সমভাবাপন্ন পুরুষ। সকলের প্রতি সমদর্শী হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমার জীবনের অন্তিম সময়ে কৃপা করে আমাকে দর্শন দিতে এসেছেন, কারণ আমি তাঁর ঐকান্তিক সেবক।
ভক্তিসমাহিত চিত্তে যে ভক্তেরা তাঁর ভাবে আবিষ্ট হয়ে তাঁর মহিমা কীর্তন করেন, তিনি তাঁদের জড়দেহ ত্যাগের সময় কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত করেন। আমার প্রভু যিনি চতুর্ভুজ এবং যাঁর বদনকমল নবোদিত সূর্যের মতো রক্তিম নেত্র ও প্রফুল্ল হাস্যের দ্বারা সুশোভিত, তিনি কৃপা করে আমার এই জড়দেহ পরিত্যাগের মুহূর্তে আমার জন্য প্রতীক্ষা করুন।”
শ্রীসূত গোস্বামী বললেন—“ভীষ্মদেবের সেই মর্মস্পর্শী বাক্য শ্রবণ করে, মহারাজ যুধিষ্ঠির সমস্ত মহান ঋষিবর্গের সমক্ষে শরশয্যাশায়ী ভীষ্মদেবের কাছে ধর্ম বিষয়ক বিভিন্ন কর্তব্যকর্মাদির অত্যাবশ্যক নীতি-নিয়মাদি সংক্রান্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন।
মহারাজ যুধিষ্ঠিরের অনুসন্ধিৎসায় ভীষ্মদেব প্রথম মানুষের জীবনের স্বভাব ও যোগ্যতা অনুসারে সমস্ত বর্ণ এবং আশ্রম বিভাগের সংজ্ঞা বিবৃত করলেন। তারপর তিনি যথাক্রমে দুই শ্রেণীবিভাগের মাধ্যমে অনাসক্তির প্রতিরোধী ক্রিয়া এবং আসক্তির অন্তঃক্রিয়ার বর্ণনা করলেন।
তারপর তিনি বিভাগ অনুসারে দানধর্ম, রাজধর্ম এবং মোক্ষধর্মসমূহ ব্যাখ্যা করলেন। তারপর তিনি স্ত্রীলোক এবং ভক্তদের কর্তব্যকর্মাদি সংক্ষিপ্ত এবং বিস্তারিত দুভাবেই বর্ণনা করলেন। হে ঋষি, তারপর ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষলাভের উপায়াদি যথাপূর্বক বর্ণনা প্রসঙ্গে তত্ত্বজ্ঞ ভীষ্মদেব ইতিহাস থেকে দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বিভিন্ন বর্ণ এবং আশ্রমের কর্তব্য কর্ম সম্বন্ধে বিবৃত করেছিলেন।
যখন বৃত্তি অনুযায়ী কর্তব্য-কর্মের বিষয়ে ভীষ্মদেব উপদেশ দিচ্ছিলেন, তখন সূর্যের গতিপথ উত্তর গোলার্ধের অভিমুখী হয়। সিদ্ধযোগীরা যারা তাঁদের ইচ্ছানুযায়ী মৃত্যুবরণ করতে চান, তাঁরা এই বিশেষ সময়টির অভিলাষ করে থাকেন।
অবিলম্বে সেই ব্যক্তিটি, যিনি সহস্র অর্থ সমন্বয়ে বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ দিতেন, যিনি সহস্র সহস্র রণাঙ্গনে সংগ্রাম করেছিলেন এবং সহস্র সহস্র মানুষকে রক্ষা করেছিলেন, তিনি বাক্য রোধ করলেন এবং সমস্ত বন্ধন থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়ে সমস্ত বিষয় থেকে তাঁর মন প্রত্যাহার করে নিলেন; তাঁর নয়ন-সমক্ষে যে দীপ্তিময় উজ্জ্বল পীতবসনধারী চতুর্ভুজ আদি পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁর দিকে তখন প্রসারিত নির্নিমেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রইলেন।
বিশুদ্ধ ধ্যানে মগ্ন হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দর্শন লাভ করার ফলে তিনি জড় জাগতিক সমস্ত অশুভ বিষয় থেকে তৎক্ষণাৎ মুক্ত হলেন এবং শরাঘাতে প্রাপ্ত সমস্ত দৈহিক বেদনার উপশম হল। এইভাবে তাঁর ইন্দ্রিয়াদির বাহ্যিক কার্যকলাপ তৎক্ষণাৎ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি তাঁর জড়দেহ পরিত্যাগের সময় সমস্ত জীবের নিয়ন্ত্রর উদ্দেশ্যে অপ্রাকৃতভাবে স্তব করতে লাগলেন।”
ভীষ্মদেব বললেন—“আমার চিন্তা, অনুভূতি এবং ইচ্ছা, যা এতদিন বিভিন্ন বিষয় এবং বৃত্তিগত কর্তব্যে নিয়োজিত ছিল, তা এখন সর্বশক্তিমান ভগবান শ্রীকৃষ্ণে বিনিযুক্ত হোক। তিনি সর্বদা আত্মতৃপ্ত, কিন্তু কখনো কখনো ভক্তকুলশ্রেষ্ঠ-রূপে তিনি এই জড় জগতে অবতরণ করে অপ্রাকৃত আনন্দ উপভোগ করেন, যদিও এই জড় জগৎ তাঁর থেকেই সৃষ্ট হয়েছে।
ত্রিলোকের (স্বর্গ, মর্ত এবং পাতাল) মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর, তমালের মতো নীলাভ বর্ণযুক্ত, সূর্যকিরণের মতো নির্মল দীপ্ত বসনে বিভূষিত এবং কুঞ্চিত কেশদামে আবৃত মুখপদ্ম সমন্বিত দিব্য শরীরধারী এই অর্জুন-সথা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আমার কর্মফল-বাসনারহিত চিত্তবৃত্তি আসক্তি লাভ করুক।
যুদ্ধক্ষেত্রে (যেখানে শ্রীকৃষ্ণ সখ্য বশত অর্জুনের রথের সারথি হয়েছিলেন) শ্রীকৃষ্ণের আলুলায়িত কেশরাশি অশ্ব খুরোখিত ধূলির দ্বারা ধূসর বর্ণ ধারণ করেছিল এবং পরিশ্রমের ফলে তাঁর মুখমণ্ডল ঘর্মবিন্দুর দ্বারা সিক্ত হয়েছিল। তাঁর এই সমস্ত শোভা আমার তীক্ষ্ণ শরাঘাতের ক্ষতচিহ্নাদি দ্বারা প্রকটিত হয়ে তাঁর উপভোগ্য হয়েছিল।
সেই শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আমার চিত্ত ধাবিত হোক। অর্জুনের আদেশ পালনার্থে তাঁর সখা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে অর্জুন এবং দুর্যোধনের সৈন্যদের মাঝখানে তাঁর রথটি নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তখন সেখানে তাঁর কৃপা কটাক্ষের দ্বারাই বিপক্ষ দলের আয়ু হরণ করে নিলেন।
শত্রুর দিকে শুধুমাত্র তাঁর দৃষ্টিপাতের ফলেই তা সাধিত হল। আমার চিত্ত সেই শ্রীকৃষ্ণে নিবদ্ধ হোক। দূরস্থিত বৃহৎ সেনাবাহিনীর মুখগুলি এবং সেই সেনাবাহিনীর অগ্রভাগস্থিত স্বজন বীরপুরুষদের দর্শন করে আপাত অজ্ঞানের ফলে কলুষিত বুদ্ধির প্রভাবে অর্জুন যখন মনে করেছিলেন যে আত্মীয়-স্বজনের বিনাশের ফলে তাঁর পাপ হবে, তখন অপ্রাকৃত জ্ঞান দান করে যিনি সেই অজ্ঞানতা দূর করেছিলেন,
সেই শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্ম আমার আসক্তির বিষয় হোক। আমার অভিলাষ পূর্ণ করার জন্য তিনি তাঁর নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেও রথ থেকে নেমে এসে রথের চাকা তুলে নিয়েছিলেন এবং হস্তিকে বধ করার জন্য প্রবল বেগে ধাবমান সিংহের মতো পৃথিবী কম্পিত করে তিনি আমার দিকে ধাবিত হয়েছিলেন। তখন তাঁর উত্তরীয়খানিও তাঁর শরীর থেকে পথে পড়ে গিয়েছিল।
রণক্ষেত্রে আমার তীক্ষ্ণ শরে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে বিধ্বস্ত বর্ম নিয়ে রক্তাক্ত কলেবরে যেন রাগান্বিত হয়ে আমাকে বধ করার জন্য প্রবল বেগে আমার দিকে ছুটে এলেন, সেই মুক্তিদাতা ভগবান মুকুন্দ পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ আমার পরম গতি হোন। মৃত্যুর সময় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আমার চেতনা সম্পূর্ণরূপে আকৃষ্ট হোক।
দক্ষিণ হস্তে চাবুক এবং বাম হস্তে অশ্ব-বগাধারী সর্ব উপায়ে অর্জুনের রথের রক্ষাকারী সারথিরূপে শোভমান শ্রীকৃষ্ণে আমি আমার চিত্ত একাগ্র করছি। কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে তাঁকে যাঁরা দর্শন করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তাঁরা সকলেই তাঁদের স্বরূপ প্রাপ্ত হয়েছেন।
আমার চিত্ত শ্রীকৃষ্ণে নিবদ্ধ হোক, যাঁর সুন্দর গমনভঙ্গি, মধুর হাস্য এবং প্রেমপূর্ণ ঈক্ষণ ব্রজগোপিকাদের আকর্ষণ করেছিল। (রাসনৃত্য থেকে তাঁর অন্তর্হিত হওয়ার পর) ব্রজগোপিকারা তাঁর বিরহে উন্মত্তবৎ হয়ে তাঁর গমনভঙ্গি ও বিবিধ কার্যকলাপের অনুকরণ করেছিলেন।
মহারাজ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে সমস্ত মুনি, ঋষি এবং শ্রেষ্ঠ নরপতিদের মহান সমাবেশ হয়েছিল এবং সেই সভায় শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর ভগবানরূপে সকলের দ্বারা পূজিত হয়েছিলেন। আমি তা প্রত্যক্ষভাবে দর্শন করেছিলাম এবং তাঁর চরণে আমার চিত্ত নিবদ্ধ করার জন্য আমি সেই ঘটনা স্মরণ করছি।
এখন আমি পূর্ণ একাগ্রতা সহকারে আমার সম্মুখে উপস্থিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করতে পারি, কারণ তাঁর সম্বন্ধে আমার দ্বৈতভাবের সমস্ত মোহ এখন দূর হয়ে গেছে। তিনি এক এবং অদ্বিতীয় হওয়া সত্ত্বেও সকলের হৃদয়ে, এমনকি মনোধর্মীদের হৃদয়ে পর্যন্ত বিরাজ করেন। সূর্য ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রতিভাত হলেও সূর্য একটিই।”
সূত গোস্বামী বললেন—“এইভাবে ভীষ্মদেব তাঁর মন, বাক্য ও চক্ষু প্রভৃতি ইন্দ্রিয় বৃত্তি দ্বারা তাঁর চেতনাকে পরমাত্মা ভগবান শ্রীকৃষ্ণে আবিষ্ট করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। অন্তহীন পরব্রহ্মে শ্রীভীষ্মদেব মিলিত হয়েছেন জেনে সেখানে উপস্থিত সকলে দিবাবসানে পাখিদের মতো মৌনভাবে অবস্থান করতে লাগলেন।
অতঃপর স্বর্গের দেবতাবৃন্দ এবং মর্ত্যের মানবেরা তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে দুন্দুভি ধ্বনি করলেন। সৎ প্রকৃতির রাজন্যবর্গ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন শুরু করলেন এবং আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল।” “হে ভৃগুবংশতিলক (শৌনক), ভীষ্মদেবের মৃতদেহের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করে মহারাজ যুধিষ্ঠির ক্ষণিকের জন্য দুঃখে অভিভূত হলেন।
সমস্ত মহর্ষিগণ গূঢ় বৈদিক মন্ত্রের দ্বারা সেখানে উপস্থিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গুণ কীর্তন করলেন। তারপর শ্রীকৃষ্ণকে হৃদয়ে ধারণ করে তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ আশ্রমে প্রত্যাবর্তন করলেন। অতঃপর মহারাজ যুধিষ্ঠির অচিরেই পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণসহ তাঁর রাজধানী হস্তিনাপুরে গমন করে তাঁর জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র ও তাতপত্নী তপস্বিনী গান্ধারীকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন।
তারপর মহান ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্রের অনুজ্ঞা এবং পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের সম্মতি অনুসারে ধর্মের বিধান ও রাজকীয় নীতি-নিয়মাদি কঠোরভাবে পালন করে তাঁর পিতৃ-পিতামহের পদাঙ্ক অনুসরণে রাজ্যশাসন করতে লাগলেন।”