মহাভারতের মহারাজ পরীক্ষিতের জন্ম কথা

 
মহাভারতের  মহারাজ পরীক্ষিতের জন্ম কথা

 অভিমন্যু পুত্র পরীক্ষিতের পরিচয়

 

শৌনকমুনি বললেন— “অশ্বত্থামার দ্বারা উপসৃষ্ট ভয়ঙ্কর এবং অপরাজেয় ব্রহ্মাস্ত্রের দ্বারা মহারাজ পরীক্ষিতের জননী উত্তরাদেবীর গর্ভ বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। 

 

কিন্তু পরমেশ্বর ভগবানের দ্বারা মহারাজ পরীক্ষিৎ রক্ষা পান। অতীব বুদ্ধিসম্পন্ন এবং পরম ভক্ত, মহান সম্রাট পরীক্ষিৎ কেমন করে সেই গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন? 

 

কেমন করেই বা তাঁর মৃত্যু হল, এবং তাঁর মৃত্যুর পরে তিনি কোন্ গতি লাভ করলেন? যে মহারাজ পরীক্ষিতের কাছে শ্রীশুকদেব গোস্বামী অপ্রাকৃত তত্ত্বজ্ঞান প্রদান করেন, আমরা সকলে শ্রদ্ধা সহকারে তাঁর কথা শুনতে চাই। 

 

দয়া করে এই বিষয়ে কিছু বলুন।” শ্রীসূত গোস্বামী বললেন—“মহারাজ যুধিষ্ঠির তাঁর রাজত্বকালে সকলকে সুখ-সমৃদ্ধি প্রদান করেছিলেন। তিনি ছিলেন ঠিক তাঁর পিতার মতো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে নিরন্তরভাবে সেবা সম্পাদনের ফলে তিনি ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং সকল প্রকার ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তির বিষয় থেকে মুক্ত ছিলেন। 

 

যুধিষ্ঠির মহারাজের পার্থিব ঐশ্বর্যের কথা, অর্থাৎ যে সমস্ত যজ্ঞ অনুষ্ঠানের দ্বারা তিনি উচ্চতর গন্তব্যস্থল প্রাপ্ত হয়েছিলেন তার কথা, তাঁর মহিষীদের কথা, তাঁর পরাক্রমশালী ভ্রাতাদের কথা, তাঁর বিস্তৃত রাজ্যের কথা, এই পৃথিবীর উপর তাঁর আধিপত্যের কথা এবং তাঁর যশ ইত্যাদির কথা স্বর্গলোকে পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।  

 

হে ব্রাহ্মণগণ, মহারাজ যুধিষ্ঠিরের ঐশ্বর্য এমনই মনোমুগ্ধকর ছিল যে স্বর্গের অধিবাসীরাও তা লাভ করার বাসনা করতেন। কিন্তু যেহেতু তিনি ভগবানের সেবায় মগ্ন ছিলেন, তাই ভগবদ্ সেবা ভিন্ন অন্য কিছুই তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারত না।”


“হে ভৃগুনন্দন (শৌনক), মাতা উত্তরার গর্ভে অবস্থানকালে মহাবীর পরীক্ষিৎ (অশ্বত্থামা কর্তৃক নিক্ষিপ্ত) ব্রহ্মাস্ত্রের তাপে যখন দগ্ধ হচ্ছিলেন, তখন তিনি পরমেশ্বর ভগবানকে দর্শন করেছিলেন। তিনি (ভগবান) ছিলেন মাত্র অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ দীর্ঘ, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে জড়াতীত। 

 

তাঁর অচ্যুত এবং অপূর্ব সুন্দর দেহটি ছিল ঘনশ্যাম বর্ণ। তাঁর পরনে তড়িৎ বর্ণ পীতবসন এবং মস্তকে উজ্জ্বল স্বর্ণমুকুট ছিল। এইভাবে শিশু পরীক্ষিৎ তাঁকে দর্শন করেছিলেন। ভগবান ছিলেন চতুর্ভুজসম্পন্ন, তাঁর কর্ণে ছিল তপ্তকাঞ্চনের কুণ্ডল এবং ক্রোধবশত তাঁর চক্ষু হয়েছিল আরক্তিম। 

 

তিনি যখন পরিভ্রমণ করছিলেন, তখন তাঁর গদা উল্কার মতো নিরন্তর তাঁর চতুর্দিকে ঘুরছিল। সূর্য যেমন হিমরাশি বাষ্পীভূত করে, তেমনই ভগবান তাঁর গদার প্রভাবে অশ্বত্থামা নিক্ষিপ্ত সেই ব্রহ্মাস্ত্রের তেজ বিনাশ করেছিলেন। গর্ভস্থিত শিশু তাঁকে দর্শন করেছিলেন এবং তিনি কে ছিলেন, সে সম্বন্ধে মনে মনে চিন্তা করেছিলেন। 

 

এইভাবে শিশু পরীক্ষিৎকে দর্শন দান করে, স্থান ও কালের অতীত, সর্বদিক ব্যাপ্ত, সর্বশক্তিমান, ধর্মরক্ষক পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরি অন্তর্হিত হলেন। তারপর শুভ গ্রহসমূহ অন্যান্য অনুকূল গ্রহগণের সঙ্গে সম্মিলিত হলে, পাণ্ডু সদৃশ তেজস্বী পাণ্ডুর বংশধর জন্মগ্রহণ করলেন। 

 

সেই সময়ে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির প্রফুল্লচিত্তে সেই নবজাত বালকের জাতকর্ম সম্পাদন করিয়েছিলেন। ধৌম্য, কৃপাচার্য প্রমুখ তত্ত্বজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা মঙ্গলজনক স্বস্তিবাচন পাঠ করেছিলেন। কিভাবে, কখন ও কোথায় দান করতে হয়, সে বিষয়ে অভিজ্ঞ মহারাজ যুধিষ্ঠির পুত্রসন্তানের জন্ম উপলক্ষ্যে ব্রাহ্মণদের স্বর্ণ, গাভী, ভূমি গ্রাম, হস্তী, অশ্ব ও উত্তম অন্ন-শস্যাদি দান করেছিলেন। 

 

বিদ্বান ব্রাহ্মণেরা দান লাভে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে পুরুকুলশ্রেষ্ঠ বলে সম্বোধন করে বললেন যে, তাঁর পুত্রটি অবশ্যই পুরু বংশের উপযুক্ত।” ব্রাহ্মণেরা বললেন—“মহাপ্রভাবশালী এবং সর্বব্যাপ্ত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণু আপনাদের প্রতি অনুগ্রহ করে এই নির্মল সন্তানটিকে পুনরুদ্ধার করেছেন। 

 

এক অব্যর্থ অতি প্রাকৃত ব্রহ্মাস্ত্রের প্রভাবে যখন তাঁর বিনাশ অনিবার্য হয়েছিল, তখন তাঁকে রক্ষা করা হয়েছিল। পরমেশ্বর ভগবান বিষ্ণু কর্তৃক যেহেতু রক্ষিত হয়েছিলেন, তাই এই শিশুটি জগতে বিষ্ণুরাত নামে সুপ্রসিদ্ধ হবেন। হে মহাভাগ্যবান, এই শিশুটি যে ভগবানের উত্তম ভক্ত হবেন এবং সমস্ত সদ্গুণে ভূষিত হবেন, সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই।”


ধর্মরাজ (যুধিষ্ঠির) জিজ্ঞাসা করলেন—“হে মহাত্মাগণ, এই নবজাত কুমার কি প্রশংসা ও সৎ কীর্তির দ্বারা আমাদের বংশের পবিত্রকীর্তি মহামান্য রাজর্ষিদের অনুসরণ করতে পারবে?”


ব্রাহ্মণেরা বললেন—“হে কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠির, এই বালক সাক্ষাৎ মনুপুত্র ইক্ষ্বাকুর মতো প্রজারক্ষক এবং দশরথনন্দন শ্রীরামচন্দ্রের মতো ব্রাহ্মণের হিতকারী ও ব্রহ্মণ্য নীতিপরায়ণ, বিশেষত সত্যপ্রতিজ্ঞ হবেন। এই শিশুটি উশীনর রাজ্যের রাজা যশস্বী শিবির মতো বদান্য দাতা ও শরণাগতের পালক হবেন, 

 

ও মহারাজা দুষ্মন্তের পুত্র ভরতের মতো জ্ঞাতিবর্গ ও যাজ্ঞিকসহ তাঁর বংশের যশ বিস্তার করবেন। ধনুর্ধারীদের মধ্যে এই শিশু অর্জুনের মতো শ্রেষ্ঠ হবেন। তিনি অগ্নির মতো দুর্ধর্ষ এবং সমুদ্রের মতো দুস্তর হবেন। এই শিশুটি সিংহের মতো বিক্রমশালী, হিমালয়ের মতো সুমহান আশ্রয়, ধরিত্রীর মতো ধৈর্যশীল এবং তাঁর পিতামাতার মতোই সহনশীল হবেন। 

 

এই শিশুটি মানসিক সাম্যতায় তাঁর পিতামহ যুধিষ্ঠির অথবা ব্রহ্মার সমতুল্য হবেন, কৈলাস পর্বতের অধিপতি শিবের মতো তিনি মহাবদান্য হবেন এবং লক্ষ্মীদেবীরও আশ্রয়স্থল পরমেশ্বর ভগবান শ্রীনারায়ণের মতোই তিনি প্রত্যেকের আশ্রয় হবেন। 

 

এই শিশুটি শ্রীকৃষ্ণের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সমস্ত দিব্যগুণজনিত মহিমায় তাঁরই মতো হবেন। তিনি উদারতায় মহারাজ রন্তিদেব এবং ধর্মযাজনে মহারাজ যযাতির মতো হবেন। এই শিশুটি ধৈর্যে বলি মহারাজের মতো হবেন, প্রহ্লাদ মহারাজের মতো নৈষ্ঠিক কৃষ্ণভক্ত হবেন, বহু অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করবেন এবং বৃদ্ধ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অনুগমন করবেন। 

 

এই শিশুটি রাজর্ষিদের জন্মদাতা হবেন। বিশ্বশান্তি ও ধর্মের স্বার্থে, তিনি উচ্ছৃঙ্খল ও কলহপ্রিয় সকলেরই দণ্ডদাতা হবেন। এক ব্রাহ্মণতনয় কর্তৃক প্রেরিত এক তক্ষক নাগের দংশনে তাঁর মৃত্যু হবে, তা শোনার পরে, তিনি সমস্ত জড়জাগতিক আসক্তি থেকে মুক্ত হবেন এবং তিনি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরির শ্রীপাদপদ্মে আশ্রয় গ্রহণ করবেন। 

 

হে রাজন! এই বালকটি বেদব্যাসের পুত্র ব্রহ্মর্ষি শুকদেবের মুখ থেকে যথার্থ আত্মজ্ঞান জানতে ইচ্ছুক হবেন এবং সমস্ত জড় আসক্তি পরিত্যাগ করে ভয়লেশহীন হবেন।”


“জ্যোতিষ-শাস্ত্রে পারদর্শী এবং নবজাত শিশুর ভাগ্য গণনায় দক্ষ সেই বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা এইভাবে মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে নবজাত শিশুর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে উপদেশ দিয়ে, প্রচুর পরিমাণে পারিতোষিক লাভ করে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন।”


“এই বালক জগতে পরীক্ষিৎ নামে (যিনি পরীক্ষা করেন) প্রসিদ্ধ হবেন, কেননা তিনি তাঁর জন্মের পূর্বে যে পুরুষকে দর্শন করেছিলেন, তাঁরই অনুসন্ধানে সমস্ত মানুষদের পরীক্ষা করতে থাকবেন। এইভাবে তিনি নিরন্তর তাঁরই কথা চিন্তা করবেন।

 

 রাজপুত্র (পরীক্ষিৎ) তাঁর পিতামহদের অভিভাবকত্বে সস্নেহে প্রতিপালিত হয়ে শুক্লপক্ষের চন্দ্রের মতো দিনে দিনে বর্ধিত হতে লাগলেন। সেই পরীক্ষিৎ বালক অবস্থাতেই স্বভাবত ধার্মিক, সকলের প্রিয়ভাজন, মহানভক্ত এবং বুদ্ধিমান হয়েছিলেন।”


“ঠিক এই সময় মহারাজ যুধিষ্ঠির জ্ঞাতিবধজনিত পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এক অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার কথা বিবেচনা করছিলেন। কিন্তু কিছু অর্থ সংগ্রহের কথা ভেবে তিনি উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, কেননা উদ্বৃত্ত তহবিল না থাকায় কর এবং জরিমানা আদায় করা ছাড়া অর্থ সংগ্রহের আর কোনও উপায় ছিল না। 

 

মহারাজের ঐকান্তিক অভিলাষ সম্বন্ধে অবগত হয়ে তাঁর ভাইয়েরা শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ অনুসারে উত্তর দিকে গমনপূর্বক (মহারাজ মরুত্তের পরিত্যক্ত) প্রচুর ধনরত্ন সং গ্রহ করে এনেছিলেন। সেই সম্পদের দ্বারা মহারাজ যুধিষ্ঠির যজ্ঞের উপকরণ সংগ্রহ করে তিনটি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে পেরেছিলেন। 

 

এইভাবে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে আত্মীয়-স্বজন বধজনিত পাপের ভয়ে ভীত ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরির সন্তুষ্টি বিধান করেছিলেন। মহারাজ যুধিষ্ঠির কর্তৃক সেই যজ্ঞে আহুত হয়ে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেখানে আগমনপূর্বক (দ্বিজ) ব্রাহ্মণদের দ্বারা যজ্ঞ সম্পাদন করিয়ে আত্মীয় স্বজনদের আনন্দ বিধানের জন্য কয়েক মাস সেখানে অবস্থান করেছিলেন।”


“হে শৌনক, তারপর দ্রৌপদীসহ মহারাজ যুধিষ্ঠির এবং বন্ধুবান্ধবদের বিদায় জানিয়ে অর্জুনসহ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যাদবগণ পরিবেষ্টিত হয়ে দ্বারকা নগরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।”

আরও পড়ুন
 
* ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সকল লীলা কাহিনী

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url