ধৃতরাষ্ট্রের গৃহত্যাগ-মহাভারত কথা

 
ধৃতরাষ্ট্রের গৃহত্যাগ

 ধৃতরাষ্ট্রের গৃহত্যাগ ও হিমালয়ে গমন

 

শ্রীসূত গোস্বামী বললেন—“তীর্থ পর্যটন কালে মহর্ষি মৈত্রেয়ের কাছে জীবের পরম গতি সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করে বিদুর হস্তিনাপুর নগরে ফিরে গেলেন। তিনি ইষ্টবিষয়ক সমস্ত জ্ঞান লাভ করেছিলেন। 

 

মৈত্রেয় মুনির কাছে নানা রকম প্রশ্ন করে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি লাভ করার পর আরও প্রশ্ন করা থেকে বিদুর বিরত হলেন।”

 

“যখন বিদুরকে প্রাসাদে ফিরে আসতে দেখলেন, তখন সমস্ত গৃহবাসী— মহারাজ যুধিষ্ঠির, তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতারা, ধৃতরাষ্ট্র,, সাত্যকি, সঞ্জয়, কৃপাচার্য, কুন্তী, গান্ধারী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা, উত্তরা, কৃপী, কৌরবদের আরও অনেক পত্নীগণ এবং সন্তানাদিসহ অন্যান্য মহিলারা সবাই মহানন্দে দ্রুত সেখানে এলেন। 

 

মনে হচ্ছিল যেন দীর্ঘকাল পর তাঁরা আবার তাদের চেতনা ফিরে পেলেন। যেন তাঁদের দেহে পুনরায় প্রাণ ফিরে এসেছে, এইভাবে পরম আকুলতার সঙ্গে তাঁরা সকলে মহানন্দে তাঁর কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। তাঁরা পরস্পর বিধিবৎ প্রণতি বিনিময় করেছিলেন এবং পরস্পরকে আলিঙ্গন করে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেছিলেন।  

 

উৎকণ্ঠা এবং দীর্ঘ বিচ্ছেদের ফলে, তাঁরা সকলে স্নেহের বসে কাঁদতে লাগলেন। মহারাজ যুধিষ্ঠির তখন উপবেশনের আসন প্রদানের আয়োজন করলেন এবং অভ্যর্থনা জানালেন। বিপুলভাবে প্রথম ভোজনান্তে বিশ্রাম করে বিদুর আরামদায়ক একটি আসনে উপবেশন করলেন। 

 

তখন মহারাজ যুধিষ্ঠির স্বভাবসিদ্ধ বিনয় ও নম্রতা সহকারে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন এবং উপস্থিত সকলে তা শুনতে লাগলেন।”


মহারাজ যুধিষ্ঠির বললেন—“হে পিতৃব্য, আপনার কি মনে আছে, কিভাবে আপনি আমাদের জননী সহ সকলকে সর্বপ্রকার দুর্যোগ থেকে নিরন্তর রক্ষা করেছিলেন? পাখির ডানার মতো আপনার পক্ষপাতরূপ ছায়া বিষ প্রয়োগ এবং অগ্নিসংযোগ থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিল। 

 

আপনি ভূমণ্ডল পরিভ্রমণকালে কোন্ বৃত্তির দ্বারা দেহযাত্রা নির্বাহ করতেন? কোন্ কোন্ প্রধান পবিত্রধাম এবং তীর্থের সেবা আপনি করেছেন? হে প্রভু, আপনার মতো মহান্ ভগবদ্ভক্তরাই স্বয়ং পবিত্র তীর্থধাম স্বরূপ। কারণ আপনাদের হৃদয়ে অবস্থিত গদাধারী পরম পুরুষোত্তম ভগবানের পবিত্রতা বহন করে সমস্ত স্থানকেই তীর্থে পরিণত করে থাকেন। 

 

হে পিতৃব্য, আপনি নিশ্চয়ই দ্বারকায় গিয়েছিলেন। সেই পবিত্রধামে আমাদের বন্ধুবান্ধব এবং সুহৃদবর্গ যাদবেরা রয়েছেন, যাঁরা পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের সেবায় সদামগ্ন থাকেন। আপনি নিশ্চয়ই তাঁদের দেখেছেন বা তাঁদের কথা শুনে থাকবেন। তাঁরা সকলে তাঁদের স্ব স্ব গৃহে সুখে আছেন তো?”


“এইভাবে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করলে, মহাত্মা বিদুর যদুবংশ ধ্বংসের সমাচার ব্যতীত, ব্যক্তিগতভাবে যেসব অভিজ্ঞতা তিনি লাভ করেছিলেন, তা ক্রমশ বর্ণনা করলেন। 

 

করুণাময় মহাত্মা বিদুর কোন সময়ই পাণ্ডবদের দুর্দশা দেখতে পারতেন না। তাই তিনি অপ্রিয় আর অসহনীয় এই ঘটনার কথা প্রকাশ করলেন না। কারণ দুর্যোগাদি আপনা হতেই আসে। এই মহাত্মা বিদুর তাঁর জ্ঞাতি-সম্প্রদায়ের সকলের কাছে ঠিক দেবতুল্য মানুষের মতোই সমাদৃত হয়ে কিছুদিন সেখানে রইলেন যাতে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ধৃতরাষ্ট্রের মনোবৃত্তির মঙ্গলসাধন করতে পারেন এবং তার দ্বারা অন্য সকলেরও প্রীতিবিধান করা যায়।”


“মণ্ডূক মুনির দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে বিদুর যতদিন শূদ্রত্ব ধারণ করে ছিলেন, সেই শতবর্ষব্যাপী অর্যমা পাপীদের পাপকর্ম অনুসারে যথাযথ দণ্ড বিধানের জন্য যমরাজের পদাভিষিক্ত হয়েছিলেন।”


“মহারাজ যুধিষ্ঠির তাঁর রাজ্য জয় করে এবং তাঁর বংশের মহান্ ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রাখবার উপযুক্ত এক পৌত্রের জন্মের দর্শন লাভ করার পরে, শান্তিতে রাজত্ব করেছিলেন এবং তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতারা, যাঁরা ছিলেন জনসাধারণের কাছে সকলেই দক্ষ প্রশাসক, তাঁদের সহযোগিতা নিয়ে তিনি অসামান্য ঐশ্বর্য ভোগ করেছিলেন। 

 

যাঁরা গৃহ-পরিবার বিষয়ে অত্যন্ত আসক্ত এবং সর্বদাই সেই চিন্তায় মগ্ন থাকে, পরম দুস্তর অনন্ত কাল অজ্ঞাতসারে তাদের অতিক্রম করে যায়।”


মহাত্মা বিদুর এই সমস্ত বিষয়ে অবগত ছিলেন এবং তাই তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, “হে রাজন, শীঘ্র আপনি এখান থেকে বেরিয়ে পড়ুন। আর বিলম্ব করবেন না। দেখুন, মহাভয় কিভাবে আপনাকে আচ্ছন্ন করছে। এই জড় জগতের কোনও মানুষের দ্বারা এই ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রতিকার হতে পারে না। 

 

হে প্রভু, পরম পুরুষোত্তম ভগবানই মহাকালরূপে আমাদের সকলের সম্মুখে উপস্থিত হয়েছেন। যে-ই মহাকালের দ্বারা প্রভাবগ্রস্ত হয়, তাকে অবশ্যই তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় প্রাণই সমর্পণ করতে হয়, এবং ধন-সম্পদ, মান-মর্যাদা, সন্তান সন্ততি, জমি-বাড়ি এই সবের মতো অন্যান্য জিনিসের কথা আর কী বলার আছে!  

 

আপনার পিতা, ভ্রাতা, বন্ধু, কথা আর কী বলার আছে! আপনার পিতা, ভ্রাতা, বন্ধু, পুত্রবর্গ সকলেই মৃত এবং প্রয়াত। আপনি নিজেও আপনার জীবনের বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত করেছেন, আপনার দেহ এখন জরাগ্রস্ত, এবং আপনি অন্যের গৃহে বাস করছেন। 

 

আপনি জন্মকাল থেকেই অন্ধ, এবং সম্প্রতি আপনার শ্রবণশক্তিও হ্রাস পেয়েছে। আপনার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে, এবং বুদ্ধিভ্রংশ হচ্ছে। আপনার দন্তরাজি জীর্ণ হয়েছে, আপনার যকৃতের ত্রুটি ঘটেছে এবং আপনার কাশির সঙ্গে সশব্দে কফ নির্গত হচ্ছে। 

 

আহা, কোনও জীবের বেঁচে থাকার আসা কী বলবতী! যথার্থই, আপনি ঠিক একটা পোষা কুকুরের মতোই বেঁচে রয়েছেন আর ভীমের দেওয়া উচ্ছিষ্ট অন্ন গ্রহণ করছেন। যাদের আপনি অগ্নিতে নিক্ষেপ করে এবং বিষ প্রয়োগে হত্যা করতে চেষ্টা করেছিলেন, তাদের দাক্ষিণ্যে নির্ভর করে অধঃপতিত জীবন যাপন করবার কোনও প্রয়োজন নেই। 

 

আপনি তাদের স্ত্রীদেরও একজনকে অপমানিতা করেছিলেন এবং তাদের রাজ্য ও ধন-সম্পদ অপহরণ করে নিয়েছিলেন। মৃত্যুবরণে আপনার অনিচ্ছা সত্ত্বেও এবং মান-মর্যাদা নষ্ট করে বেঁচে থাকার জন্য আপনার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও, আপনার কার্পণ্যদুষ্ট দেহটি অবশ্যই একটা পুরনো পোশাকের মতো জরাগ্রস্ত এবং ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। 

 

তাঁকেই ধীর বলা হয় যিনি কোন অজ্ঞাত দূরদেশে চলে যান, এবং সমস্ত দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে, জড় দেহটি যখন অব্যবহার্য হয়ে পড়ে তখন তা ত্যাগ করেন। যিনি নিজের উদ্যোগে বা অন্যের কাছ থেকে শুনে আত্মজ্ঞানসম্পন্ন হয়ে ওঠেন এবং এই জড় জগতের অলীক মায়া আর দুঃখ-দুর্দশা উপলব্ধি করেন, 

 

এবং তাই গৃহত্যাগ করে পরিপূর্ণভাবে তাঁর হৃদিস্থিত পরম পুরুষ ভগবান শ্রীহরিতে ভরসা রাখেন, সুনিশ্চিতভাবে তিনিই সর্বোত্তম মানবসত্তা। অতএব আপনি অনুগ্রহ করে আপনার আত্মীয়-স্বজনদের অজ্ঞাতসারে উত্তর দিকে গমন করুন, কারণ শীঘ্র এমন একটি সময় আসছে, যার প্রভাবে মানুষদের সদ্গুণাবলী নষ্ট হয়ে যাবে।”


“এইভাবে তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিদুর কর্তৃক উপদিষ্ট হয়ে আজমীঢ় বংশজ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র আধ্যাত্মিক জ্ঞান (প্রজ্ঞা) লাভ করে চিত্তের দৃঢ়তার দ্বারা আত্মীয়বর্গের নিবিড় স্নেহপাশ ছিন্ন করে গৃহ থেকে মুক্তিলাভের পথে বহির্গত হলেন। 

 

যুদ্ধে তীব্র আঘাত পাওয়া সত্ত্বেও প্রশান্তচিত্ত যোদ্ধার মতো সন্ন্যাসদণ্ড অবলম্বনকারী সন্ন্যাসীদের আনন্দদায়ক যে হিমালয় পর্বতমালা, সেই অভিমুখে তাঁর পতিকে গমন করতে দেখে গান্ধাররাজ সুবলের কন্যা পতিব্রতা সাধ্বী গান্ধারী তাঁর অনুগামিনী হলেন। 

 

অজাতশত্রু যুধিষ্ঠির মহারাজ সন্ধ্যা-বন্দনাদি ক্রিয়া এবং হোমাদি কার্য সমাপন করে তিল, গাভী, ভূমি ও রত্নাদির দ্বারা ব্রাহ্মণদের প্রণতি নিবেদন করে ও গুরুজনদের বন্দনা করার জন্য প্রাসাদে প্রবেশ করে সেখানে পিতৃব্য বিদুর ও ধৃতরাষ্ট্র এবং সুবল-তনয়া গান্ধারীকে দেখতে পেলেন না।”


উদ্বিগ্নচিত্ত যুধিষ্ঠির সেখানে সঞ্জয়কে সমুপবিষ্ট দেখে জিজ্ঞাসা করলেন—“হে সঞ্জয়, আমাদের বৃদ্ধ এবং অন্ধ পিতৃব্য কোথায়? আমাদের পরম আত্মীয় খুল্লতাত বিদুর এবং হত-পুত্র শোককাতরা মাতা গান্ধারীই বা কোথায় গিয়েছেন? আমার জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র তাঁর পুত্র এবং পৌত্রদের মৃত্যুতে অত্যন্ত বিরহকাতর। 

 

নিঃসন্দেহে আমি অত্যন্ত অকৃতজ্ঞ। তিনি কি আমার সেই অপরাধে নিদারুণ ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর পত্নীসহ গঙ্গায় আত্মবিসর্জন দিলেন? যখন আমাদের পিতা পাণ্ডু শয্যাগত হলেন, এবং আমরা সকলে নিতান্ত শিশু, তখন এই দুই পিতৃব্য আমাদের সকল প্রকার দুর্যোগ থেকে রক্ষা করেছিলেন। 

 

তাঁরা সকল সময়ে ছিলেন আমাদের মঙ্গলময় শুভাকাঙক্ষী। হায়, তাঁরা এখান থেকে কোথায় গেলেন?” সূত গোস্বামী বললেন—“তাঁর প্রভু ধৃতরাষ্ট্রকে না দেখে বিরহকাতর সঞ্জয় দয়া এবং স্নেহজনিত বিকলতা হেতু অত্যন্ত কাতর হওয়ায় মহারাজ যুধিষ্ঠিরের সেই প্রশ্নের যথাযথ প্রত্যুত্তর প্রদান করতে পারলেন না। 

 

প্রথমে তিনি ধীরে ধীরে তাঁর বুদ্ধির দ্বারা মনকে সংযত করে, তারপর তাঁর দুই হাত দিয়ে চোখের জল মুছে এবং তাঁর প্রভু ধৃতরাষ্ট্রের চরণযুগল ধ্যান করতে করতে, অজাতশত্রু মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে প্রত্যুত্তর দিতে শুরু করলেন।”


সঞ্জয় বললেন—“হে কুরুবংশের বংশধর, আপনার দুই পিতৃব্য এবং গান্ধারীর অভিপ্রায় কিছুই আমি জানি না। হে মহাবাহো, আমি সেই মহাত্মাগণ কর্তৃক বঞ্চিত হয়েছি।”


“সঞ্জয় যখন এইভাবে বলছিলেন, তখন বীণা হস্তে মহাভাগবত নারদ সেইখানে আবির্ভূত হলেন। মহারাজ যুধিষ্ঠির তখন তাঁর ভাইদের সঙ্গে নিজ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নারদ মুনিকে অভিবাদনপূর্বক পূজা করে অভ্যর্থনা জানালেন।”


মহারাজ যুধিষ্ঠির বললেন—“হে ভাগবত, আমার দুই পিতৃব্য কোথায় গেছেন তা আমি জানি না, এবং সমস্ত পুত্রহীনা, শোক-কাতরা আমার মাতৃসম তপস্বিনী গান্ধারীকেও আমি দেখতে পাচ্ছি না। আপনি মহাসাগরে কর্ণধারের মতো আমাদের লক্ষ্যপথ দেখাতে পারেন।”


এইভাবে যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে মহাভাগবত, দার্শনিক ভক্তশ্রেষ্ঠ দেবর্ষি নারদ বলতে লাগলেন—“হে ধার্মিক  রাজন, কারও জন্য শোক করো না, কারণ প্রত্যেকেই পরমেশ্বর ভগবানের অধীন। তাই সমস্ত জীব এবং  তাদের পালকবর্গ প্রার্থনা করে থাকেন যেন নির্বিঘ্নে থাকতে পারেন। 

 

ভগবানই তাদের মিলিত করেন এবং বিচ্ছিন্নও করেন। গাভী যেমন নাসিকায় রজ্জুর দ্বারা আবদ্ধ হয়ে থাকে, তেমনি মানুষেরাও বিভিন্ন অনুশাসনাদির দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পরমেশ্বর ভগবানের আদেশ পালন করতে বাধ্য হয়। 

 

কোনও খেলোয়াড় যেমন তার নিজের ইচ্ছামতো তার খেলার জিনিসপত্র সাজায় আর ছত্রাকার করে ফেলে, তেমনই ভগবানের পরম ইচ্ছায় মানুষের মিলন ও বিচ্ছেদ ঘটে থাকে।”


“হে রাজন, যদিও মানুষকে জীব রূপে নিত্য ও দেহরূপে অনিত্য, অথবা অনির্বচনীয় হেতু নিত্য ও অনিত্য উত্তম রূপেই আপনি মনে করেন, তবে যে কোন অবস্থা থেকে বিচার করলে তারা আপনার শোকের পাত্র নয়। মোহজনিত স্নেহ ব্যতীত শোকের আর অন্য কোন কারণ নেই। 

 

অতএব আত্মস্বরূপে অজ্ঞানতাজনিত আপনার এই উৎকণ্ঠা পরিত্যাগ করুন। আপনি এখন ভাবছেন, যারা অনাথ অসহায়, সেই সব জীবেরা আপনাকে ছাড়া কিভাবে প্রাণ ধারণ করবে। এই পাঞ্চভৌতিক শরীরটি কাল, কর্ম, ও গুণের বশবর্তী। 

 

তার ফলে সর্পগ্রস্ত হয়ে থাকার মতো সেই শরীর কিভাবে অন্যদের রক্ষা করবে? হক্তরহিত প্রাণীরা হস্তযুক্ত প্রাণীদের শিকার, পদরহিত যারা, তারা চতুষ্পদ প্রাণীদের শিকার। দুর্বল জীবেরা বলবান জীবেদের জীবন ধারণের ভরসা এবং এক জীব অন্য জীবের খাদ্য—এটাই সাধারণ রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

 

অতএব হে রাজন্, আপনি কেবলমাত্র সেই পরমেশ্বর ভগবানকেই অবলোকন করুন—যিনি এক এবং অদ্বিতীয়, যিনি বিভিন্ন শক্তির মাধ্যমে নিজেকে প্রকটিত করেন এবং যিনি অন্তরে ও বাইরে দু'ভাবেই প্রকাশিত হন।” 


“হে মহারাজ, সেই ভূতভাবন পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবদ্-বিদ্বেষীদের বিনাশ করার জন্য সর্বগ্রাসী কালরূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন। 

 

পরমেশ্বর ভগবান দেবতাদের সাহায্য করার উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যেই তাঁর কর্তব্যকর্ম সম্পন্ন করেছেন এবং এখন তিনি অবশিষ্ট কার্যের প্রতীক্ষা করছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত ভগবান এই পৃথিবীতে আছেন, সেই পর্যন্ত আপনারা পাণ্ডবেরা অপেক্ষা করে থাকতে পারেন।”


“হে রাজন, আপনার পিতৃব্য ধৃতরাষ্ট্র, তাঁর ভ্রাতা বিদুর এবং তাঁর পত্নী গান্ধারী সহ হিমালয়ের দক্ষিণ দিকে গিয়েছেন, যেখানে ঋষিদের আশ্রম আছে। সেই স্থানে পবিত্র গঙ্গানদী সপ্তঋষির প্রীতি সম্পাদনের জন্য নিজেকে সপ্তধারায় বিভক্ত করেছেন, সেই জন্য এই স্থানকে লোকে সপ্তস্রোত তীর্থ বলে। 

 

সেই সপ্তস্রোতা নদীর তীরে, ধৃতরাষ্ট্র প্রতিদিন সকাল, দুপুর এবং সন্ধ্যায় স্নান করে, অগ্নিহোত্র যজ্ঞ সম্পাদনপূর্বক কেবলমাত্র জলপান করে অষ্টাঙ্গ-যোগ অনুশীলন শুরু করেছেন। এই অনুশীলন মন এবং ইন্দ্রিয় সংযমে সহায়ক এবং মানুষকে পুত্র-কলত্রের আসক্তি থেকে সম্পূর্ণ রূপে মুক্ত করে। 

 

যিনি যৌগিক আসনের পদ্ধতি এবং শ্বাস-প্রক্রিয়াদি আয়ত্ত করেছেন, তিনি জড় বিষয় থেকে ছয় ইন্দ্রিয় প্রত্যাহার করে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরির ভাবনায় মগ্ন হতে পারেন এবং সেইভাবে জড়া প্রকৃতির সত্ত্ব, রজো এবং তমোগুণজনিত কলুষ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। 

 

ধৃতরাষ্ট্রকে আত্মজ্ঞান-স্বরূপ বুদ্ধির সাথে আপন শুদ্ধ পরিচয়ের সংযোগ সাধন করতে হবে এবং তারপরে পরম ব্রহ্মের সাথে এক জীবসত্তারূপে তাঁর গুণগত একাত্মতার জ্ঞান অর্জন করে পরম সত্তার মাঝে সাযুজ্য লাভ করতে হবে। 

 

জড়জাগতিক আবদ্ধ আকাশ থেকে মুক্ত হয়ে, তাঁকে চিদাকাশে উন্নীত হতে হবে। ইন্দ্রিয়ের সমস্ত কার্যকলাপ বাইরে থেকেও সংযত করে এবং ভোক্তার বুদ্ধিতে বাহ্য বিষয় আহরণ রূপ জড়া প্রকৃতির গুণবৈশিষ্ট্যাদির দ্বারা প্রভাবিত সর্ব প্রকার ক্রিয়া থেকে নিবৃত্ত হয়ে স্থানুর মতো নিশ্চলভাবে তাঁকে অবস্থান করতে হবে। 

 

সব রকম জড়জাগতিক কর্তব্য পরিত্যাগ করবার পরে, সেই পথের সমস্ত বিঘ্ন অতিক্রম করে, তাঁকে অবিচল হয়ে অধিষ্ঠিত হতে হবে।”


“হে রাজন্, আজ থেকে খুব সম্ভবত পঞ্চম দিনে তিনি দেহত্যাগ করবেন এবং তাঁর সেই দেহ ভস্মে পরিণত হবে। বাইরে থেকে পর্ণকুটিরসহ তাঁর পতির দেহ যোগাগ্নিতে দগ্ধ হতে দেখে পতিব্রতা পত্নী গান্ধারীও সেই অগ্নিতে প্রবেশ করে একাগ্রচিত্তে তাঁর পতির অনুবর্তিনী হবেন।”


“হে কুরুনন্দন, তখন বিদুরও সেই আশ্চর্য ঘটনা দর্শন করে হর্ষ এবং বিষাদে অভিভূত হয়ে তীর্থসেবার জন্য সেই পুণ্য পবিত্র তীর্থস্থান পরিত্যাগ করবেন। এই বলে দেবর্ষি নারদ তাঁর বীণা হস্তে স্বর্গে আরোহণ করলেন এবং যুধিষ্ঠির মহারাজও নারদের বাণী হৃদয়ে ধারণ করে শোক পরিত্যাগ করলেন।”

আরও পড়ুন 

* মহাভারতের মহারাজ পরীক্ষিতের জন্ম কথা 

*  মহাভারতের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী ও শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ  

*   ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেন পান্ডবদের রক্ষা করলেন না

* দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী’র রহস্য-বাংলা-মহাভারত
 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url