শ্রীমদ্ভাগবত কখন আবির্ভুত হয়
শ্রীমদ্ভাগবতের আবির্ভাব-দেবর্ষি-মহর্ষি-সংবাদ
মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস। দ্বাপর ও কলির সন্ধিক্ষণে তাঁহার আবির্ভাব। এই জাতিকে বাঁচাইবার জন্যই তিনি জন্মিয়াছিলেন। পুরাতন কথা লোকে শুনিতে চায় না। ইহা যুগসন্ধিক্ষণের এক দুর্লক্ষণ। অথচ পুরাতনের সঙ্গে সংযোগ হারাইলে জাতি বাঁচে না। শিকড় কাটিলে গাছ বাঁচে না।
অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্বন্ধ-শূন্য হইলে জাতীয় জীবনে মৃত্যু আসে। এই কারণে পৃথিবীর পৃষ্ঠ হইতে রোম, গ্রীস, মিশর, ব্যবিলন প্রভৃতি দেশের বিরাট সভ্যতার অস্তিত্ব প্রায় লুপ্ত হইয়াছে।
এই বিরাট আর্য্যসভ্যতাকে রক্ষা করিবার জন্য কৃষ্ণদ্বৈপায়ন প্রাচীন শাস্ত্র সকলের যুগোপযোগী নূতন রূপ দান করেন। তাঁহার গ্রন্থগুলির নাম পুরাণ। পুরাপি নব—চির পুরাতন কথা, কিন্তু শুনিলে মনে হইবে অভিনব। পুরাণকার বেদব্যাসের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ
মহাভারতের মধ্যে বিরাজমান অতুলনীয় শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা। শ্রীকৃষ্ণার্জুন-সংবাদের মধ্যে রাখিয়াছেন নিখিল বেদ-উপনিষদের নিৰ্য্যাস।
এত লিখিয়াও বেদব্যাসের চিত্তে প্রশান্তি আসিল না। জগজ্জীবের মহাকল্যাণকল্পে এত গ্রন্থ করিলেন তথাপি কেন আত্মতৃপ্তি আসিল না? চিন্তাকুল বেদব্যাস বসিয়া আছেন সরস্বতী তীরে। ভাবিতেছেন, কেন চিত্তের এই অপ্রশান্তি?
এমন সময় আসিলেন দেবর্ষি নারদ। দুইজনে বহু মূল্যবান্ কথাবার্তা আর্য্য-সংস্কৃতির দুই মধ্যমণি দেবর্ষি ও মহর্ষি। মহর্ষি চিত্তের ভাব সম্যক্ জানিয়া দেবর্ষি কহিলেন, “বেদব্যাস! তুমি বলিয়াছ সকল কথাই, কিন্তু সকল শাস্ত্র-কথা সার্থক হইয়াছে যে মহাজীবনের মধ্যে, সেই জীবন-কথা বল নাই।
সকল শাস্ত্রের মহাদান প্রাণবন্ত হইয়াছে যে মহানায়কের লীলানাট্যে, তুমি তাঁহার কথা বিস্তারে বল নাই। শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমুখের বাণী শ্রীগীতা তুমি বলিয়াছ কিন্তু তাঁহার লীলাকাহিনী শ্রীমদ্ভাগবত তুমি বল নাই। তাহা বলিলেই তোমার চিত্তে পরাতৃপ্তি আসিবে।
তাহা শুনিলেই বিশ্বজীবের পরমা শান্তি লাভ হইবে।” দেবর্ষি নারদ মহর্ষিকে দিলেন বাসুদেব-মন্ত্র আর দিলেন চতুঃশ্লোকী। এই শ্লোকগুলি তিনি পাইয়াছিলেন শ্রীব্রহ্মার নিকট। ব্রহ্মাকে দিয়াছিলেন নারায়ণ স্বয়ং অন্তরে অন্তরে, যখন তিনি ধ্যানস্থ ছিলেন তাঁর নাভি-কমলে।
মন্ত্র ও শ্লোক পাইয়া মহর্ষি ধ্যানমগ্ন হইলেন। তখন অপরোক্ষ অনুভূতিতে শ্রীকৃষ্ণের সমগ্র লীলা তিনি দর্শন করিলেন। দ্রষ্টা বেদব্যাসের লেখনী হইতে স্বউৎসারিত হইল শ্রীমদ্ভাগবত।
ব্যাস ও শুক-সংবাদ
শ্রীভাগবত প্রকটিত হইলেন। এখন তাহা দেশময় প্রত্যেক নরনারীর কাছে পৌঁছাইয়া দিবার উপায় কি? বেদব্যাস ভাবিলেন, কোন ছাত্রকে ভাগবত পড়াইব। সে দেশে দেশে গিয়া সজ্জন সভায় পাঠ করিবে, তবেই প্রচারণ হইবে।
ভাগবত এমন তত্ত্ব ও রসের পরিবেশন করিয়াছেন, যাহা আস্বাদন করিতে হইলে আজন্ম ঊর্ধ্বরেতা ব্রহ্মচারী প্রয়োজন। বেদব্যাস এইরূপ ছাত্র পাইলেন না। তাই নিজে যোগ্য সন্তানের পিতা হইবার সংকল্প করিলেন। পিতার তপস্যায় মাতৃগর্ভে সন্তান আসিলেন। দীর্ঘ দিনেও সন্তান ভূমিষ্ঠ না হওয়ায় বেদব্যাস মহামায়ার তপস্যা করিয়া তাঁহার অনুগ্রহে পৃথিবীকে ক্ষণাৰ্দ্ধ সময় মায়াস্পর্শশূন্য করাইলেন। সেইক্ষণে ভূমিষ্ঠ হইলেন শ্রীশুকদেব।
উপবীতাদি হইবার পূর্বেই শুকদেব তপস্যায় চলিলেন। বেদব্যাস হা পুত্র, হা পুত্ৰ বলিয়া পিছনে ডাকিলেন। বন হইতে ডাকের প্রতিধ্বনি আসিল, পুত্র কিন্তু সাড়া দিলেন না। আজন্ম তপস্বী শুকদেব হইলেন ব্রহ্মজ্ঞানী। “ব্রহ্মভূতঃ প্রসন্নাত্মা ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি। সমঃ সর্বেষু ভূতেষু”—এই হইল শুকদেবের অবস্থা। তখনও “মদ্ভক্তিং লভতে পরাম্” হয় নাই, কারণ ভাগবতে প্রবেশ হয় নাই।
বেদব্যাস পুত্রকে ভাগবতে টানিলেন। সে এক অপূর্ব কাহিনী। বনে ব্রহ্মধ্যানে মগ্ন শুকদেব। কখনও অন্তর্দশা কখনও অৰ্দ্ধবাহ্যদশা। অৰ্দ্ধবাহ্যদশায় শুনিতে পাইলেন ভাগবতের এক শ্লোক—
অহো বকী ষং স্তনকালকুটং জিঘাংসয়াপায়য়দপ্যসাধ্বী।
লেভে গতিং ধাক্রাচিতাং ততোহন্যং কং বা দয়ালুং শরণং ব্রজেম৷
শ্লোক শুনিয়া বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন শ্রীশুকদেব। এই মন্ত্রের দ্রষ্টা কে, অনুসন্ধানে জানিয়া, আসিলেন পুনঃ পিতার তপোবনে। আকুল আগ্রহ জানাইলেন ভাগবতীর তত্ত্বরসের আস্বাদনের জন্য। প্রবল লালসা দেখিয়া ব্যাসদেব পুত্রকে ভাগবত দিলেন। তীব্র লালসাই এই বস্তু প্রাপ্তির মূল্য—একান্ত আগ্রহ-মূল্যে শুকদেব ভাগবতধন পাইলেন পিতার নিকট। “তত্র লৌল্যমপি মূল্যমেকলম্”।
ভাগবত পাইয়া শ্ৰীশুকদেব হইলেন ভাগবতপুরুষ, জীবন্ত ভাগবত, চলন্ত ভাগবত। চলিতে চলিতে আসিলেন তিনি হরিদ্বারে ব্রহ্মকুণ্ডের তীরে। সেখানে বিরাট জনসভা। মধ্যস্থলে মহারাজ পরীক্ষিৎ। সাত দিন অনশন সংকল্পে উপবিষ্ট।
এইবার সেই কাহিনী বলি। পরীক্ষিৎ অর্জুনের পৌত্র, অভিমন্যুর পুত্র। তিনি তৎকালে ভারতের সম্রাট্। তাঁহার রাজত্বকালে কলির আগমন হয়। পরীক্ষিৎ রাজা কলিকে স্থান দিতে রাজী হন না। কলি পরীক্ষিতের দেহে পাপের রন্ধ্র খুঁজিতে থাকে।
পরীক্ষিত ও শুক-সংবাদ
“প্রাচীং সরস্বতীম্।” পূর্ববাহিনী সরস্বতী। তীর ধরিয়া চলিয়াছেন মহারাজ পরীক্ষিৎ। দেখিলেন এক অদ্ভুত দৃশ্য। একটি শুভ্র বৃষ। একটি কৃশা গাভী। একজন দণ্ডহস্ত ধূর্ত ব্যক্তি। বৃষটি একপদে দণ্ডায়মান, ভয়ে কম্পমান (বেপমানং পদৈকেন)। গাভীটি মৃতবৎসার ন্যায় রোরুদ্যমানা (বিবৎসামশ্রুবদনাং)। ধূর্তব্যক্তিটি রাজচিহ্নধারী (নৃপলাঞ্ছনম্), লগুড় দ্বারা পুনঃ পুনঃ আঘাত করিতেছে গোমিথুনের গাত্রে।
দূর্বলের উপর অত্যাচার। পরীক্ষিৎ মহারাজ অগ্নিমূর্তি। অমনি ধনুকে বাণ যোজনা করিয়া (সমারোপিতকার্শ্বকঃ) গম্ভীর স্বরে কহিলেন—“দুঃখিতের দুঃখ দূর করাই রাজধর্ম (আৰ্ত্তানামাত্তি নিগ্রহঃ)। আমি অর্জুনের পৌত্র, শ্রীকৃষ্ণের দাস। তুমি রাজবেশী পরপীড়ক। বধ করিব তোমাকে এখনই।” ধূর্ত ব্যক্তি ভয়ে জড়সড় হইল।
আপনারা কে? পরিচয় চাহিলেন উত্তরানন্দন। বৃষ কহিলেন, আমি ধর্ম। সত্যযুগে চারি পা ছিল। “তপঃ শৌচং দয়া সত্যং।” এখন কোন প্রকারে এক পায়ে চলি। তাহাও ভাঙিয়া দিতে চাহিতেছে এই হীন কলি ধূর্ততার আঘাতে। ইনি ধরণী দেবী। ইনি হইয়াছেন কৃষ্ণহারা, তদুপরি কলির প্রহারে লক্ষ্মীছাড়া। অনন্যোপায়া হইয়া রোদনপরা।'
উদ্যত হইলেন ক্রোধে অভিমন্যুনন্দন কলির বধসাধনে। চরণে শরণাগত হইল কলি (পাদয়োঃ পতিতং)। পরীক্ষিৎ ভাবিলেন, শরণাগত অবধ্য। বধ করিলে পাছে সেই ছিদ্রপথে কলি প্রবেশ করে। তাই কহিলেন, “তোমাকে বধ করিব না। তবে তাড়াইয়া দিব এই রাজ্য হইতে।”
করজোড়ে কলি কহিল, “যদি জীবন দান করিলেন মহারাজ, একটু স্থান দান করুন মাথা গুঁজিবার।” পরীক্ষিৎ কহিলেন, যাও, সেইখানে বাস কর গিয়া, যেখানে “দ্যূতং পানং স্ট্রিয়ঃ সূনাঃ” এই চারি অধর্ম। জুয়াখেলা, মদ্যপান, ব্যভিচার ও প্রাণিহিংসা। কাতর কণ্ঠে কলি কহিল, “মহারাজ, আপনার রাজত্বে ত এই সকল নাই।”
“তবে দূর হও” উত্তর দিলেন পাণ্ডব-বংশতিলক। নিগৃহীত কলি মিনতি করিতে রাজা আরও স্থান দিলেন, সুবর্ণ (ধন)। তৎসঙ্গে আসিবে পাঁচটি অনর্থ—মিথ্যা, মদ, কাম, হিংসা ও শত্রুতা। রাজাদেশে রাজ্যের নরনারী সতর্ক—কোন ফাঁকে কলি না প্রবেশ করে।
একদিন পরীক্ষিৎ গিয়াছেন মৃগয়ায়। মৃগের পশ্চাতে ধাবন করিবার ফলে হইয়াছেন “মৃগাননুগতঃ শ্ৰান্তঃ ক্ষুধিতস্তৃষিতো ভৃশম্”, ক্লান্ত ক্ষুধার্ত তৃষাযুক্ত। প্রবেশ করিলেন এক আশ্রমপদ দেখিয়া। দেখিলেন, “শান্তং মীলিতনোচনম্” শমীক ঋষিকে। শুষ্ক কণ্ঠে জল চাহিলেন। উত্তর না পাইয়া হইলেন ক্রুদ্ধ। এরূপ ক্রোধ হয় নাই তাঁহার জীবনেও।
বুঝি বা ক্ষুব্ধ কলি অসতর্ক ক্ষণের সুযোগ খুঁজিতেছে। ক্রোধের অভিব্যক্তি হইল—ধ্যানস্থ ঋষির গলদেশে এক মৃতসর্প জড়াইয়া দিলেন পরীক্ষিৎ তাঁহার ধনুকের অগ্রভাগ দ্বারা। মহদবমাননা এক মহাব্যভিচার। কলি পাইল প্রশস্ত পথ প্রবেশ করিবার।
অভিসম্পাতে কৃপাসম্পাত
শমীক ঋষির আত্মজ শৃঙ্গী। খেলার সাথীদের মুখে শুনিলেন ধ্যানস্থ পিতার অমর্য্যাদার কথা। ক্রোধে আরক্তলোচন ঋষিকুমার কৌশিকী নদীর জলে আচমন করিয়া অভিসম্পাত দিলেন বজ্রতুল্য “বাঞ্চজ্রং বিসসৰ্জ্জ হ।” মর্য্যাদালঙ্ঘনকারী কুলাঙ্গারকে অদ্য হইতে সপ্তম দিবসে দংশন করিবে বিষধর তক্ষক। “ইতি লঙ্ঘিত-মৰ্য্যাদাং তক্ষকঃ সপ্তমেহহনি, দঙ্ক্ষ্যতি স্ম কুলাঙ্গারম্” শাপ দিয়া ঋষিকুমার করস্থ জল ভুমিতে নিক্ষেপ করিলেন। পৃথিবী কম্পিতা হইয়া উঠিলেন।
ঋষির ধ্যান ভাঙ্গিল। শুনিলেন সকল কথা। দুঃখে মুহ্যমান হইলেন। হায় হায় করিতে করিতে পুত্রকে কহিলেন—লঘু পাপে (অল্পীয়সি দ্রোহে) গুরুদণ্ড (উরুদমঃ) অতীব বিগর্হিত কাৰ্য্য। পরীক্ষিৎ পৃথিবীর রত্ন। যাহাকে বক্ষে দোলাইতে হয়, তাঁহাকে পদদলিত করিয়াছ। শ্রীকৃষ্ণ তোমাকে ক্ষমা করুন।
ব্যথাহত ঋষিবর গৌরমুখ নামে এক শিষ্যকে পাঠাইয়া দিলেন রাজভবনে, রাজাকে এই মর্মান্তিক সংবাদটা জানাইয়া দিতে। পরীক্ষিৎ মহারাজও গৃহে ফিরিয়া দগ্ধীভূত হইতেছেন তীব্র অনুপাতের জ্বালায়। “অহো ময়া নীচমনার্য্যবৎ কৃতং” “অহো! আমি নরাধম, কী হীনকার্য্যই করিলাম।” কলির আক্রোশেই বা এমন হইয়া থাকিবে। পাত্র, অমাত্য, মন্ত্রী, জননী উত্তরা সবাইকে ডাকিয়া ডাকিয়া আৰ্ত কণ্ঠে কহিতে লাগিলেন—“আমার কী গতি হইবে?”
এমন সময় আসিলেন গৌরমুখ মুনি। জানাইলেন অভিশাপের কথা। অতি প্রশান্ত মনে গ্রহণ করিলেন মহারাজ পরীক্ষিৎ তাঁহার বাক্য। তক্ষকের বিষাগ্নিকে তিনি মনে করিলেন হিতসাধনকারী, “স সাধু মেনে তক্ষকানলম্”। ভাবিলেন, বিস্ফোটকে অস্ত্রোপচার হইয়া গেল। ইহাতে অপরাধ যাইবে। বিষয়াসক্তিও দূর হইবে।
এখন কী কর্তব্য? ভক্ত-শিরোমণি কর্তব্য স্থির করিলেন মুহূর্ত মধ্যে। পুত্র জনমেজয়ের উপরে প্রজাপালন-ভার অর্পণ করতঃ (স্বসুতন্যস্তভারঃ) গঙ্গাতীরে প্রায়োপবেশনে শ্রীকৃষ্ণপাদপদ্ম সেবাই এখন একমাত্র করণীয়। তাহাই করিলেন। উপাবিশৎ প্রায়মমৰ্ত্তনদ্যাম্। ১।১৯।৫ ভাগ,
কৃষ্ণাঙ্ঘি-সেবামধিমন্যমান সকল ভক্তগণের হৃদয়তন্ত্র একসুরে বাঁধা। একস্থানে আঘাত পড়িলে ঝঙ্কার উঠে সর্বত্র। মহারাজ পরীক্ষিৎ গঙ্গাতীরে প্রায়োপবেশন করিয়াছেন। অমনি নিখিল সাধু-হৃদয়ে সাড়া পড়িল। আসিতে লাগিলেন দিব্যমূর্তি ঋষি মুনিগণ।
অত্রি, বশিষ্ঠ, চাবন, শরদ্বান্, অরিষ্টনেমি, ভৃগু, অঙ্গিরা, পরাশর, বিশ্বামিত্র, পরশুরাম, উতথ্য, ইন্দ্রপ্রমদ, সুবাহু, মেধাতিথি, দেবল, ভরদ্বাজ, গৌতম, পিপ্পলাদ, মৈত্রেয়, ঔব্য, কবর, অগস্ত্য, বৎসদেব, নারদ—আর কত নাম বলিব। যত দেবর্ষি, মহর্ষি, ব্রহ্মর্ষি, রাজর্ষি, যোগী, মুনি, তপস্বী সকলেই আসিলেন।
তাঁহারা স্থির করিলেন, সাতদিনই তাঁহারা মহারাজের সন্নিধানে গঙ্গাতটে থাকিবেন। আনন্দোৎফুল্ল পরীক্ষিৎ মহারাজ! কী মহাভাগ্য সমুপস্থিত! ভাবিলেন, কই এতকাল রাজধানীতে তো এত মহতের পদধূলি একই সময় লাভ করিবার ভাগ্য হয় নাই। আহা!
ঋষির অভিসম্পাতের মধ্য দিয়াও কত কৃপাসম্পাত, নিশ্চয়ই স্বয়ং ব্রহ্মণ্যদেব ব্রহ্মশাপরূপে আমাকে কৃতার্থ করিয়াছেন। জনে জন দণ্ডবৎ করিয়া সকলের পদধুলি মাথায় তুলিয়া, হর্ষে কহিলেন রাজর্ষি পরীক্ষিৎ—ঋষি-মুনিগণ, “গায়ত বিষ্ণুগাথাঃ” আপনারা গোবিন্দ নাম কীর্তন করুন। আমি তক্ষকদংশনের ভাবনা আর ভাবি না।
আমি এখন শ্রীগোবিন্দ চরণাশ্রিত। আপনারা ও সুরধুনী আমাকে শ্রীচরণে স্থান দিন। মরিতে আর ভয় নাই। শুধু একটি প্রার্থনা, যেখানেই জন্মিনা কেন, যেন শ্রীকৃষ্ণে রতি থাকে (অনন্তে রতিঃ), তাঁহার ভক্তে প্রীতি থাকে (মহৎত্সু প্রসঙ্গঃ), আর থাকে সর্বজীবে সখ্যভাব (মৈত্রং তু সর্বত্র)। মহারাজের অন্তরের সাধকে মনে হয় কবি বিদ্যাপতি ভাষা দিয়াছেন,
কিয়ে মানুষ, পশু পাখী জনমিয়ে, অথবা কীট পতঙ্গে। করম বিপাকে, গতাগতি পুনঃ পুনঃ, মতি রহু তুয়া পরসঙ্গে ৷৷ সাতদিনই কৃষ্ণকথায় কাটাইবেন ইহা মহারাজের অন্তরের অভিলাষ। আহার নিদ্রা ত্যাগ করিয়া কৃষ্ণকথা শুনিবেন। একাসনেই শুনিবেন। কিন্তু বলিবেন কে? সাতদিন অবিশ্রাম কৃষ্ণকথা শুনাইবেন কার আছে এমন যোগ্যতা, এমন মহাভক্তি সম্পদ। কৃষ্ণকথা যদি মূর্তি ধরিয়া আসেন তবে হয়ত ইহা সম্ভব!
তখন শ্রীশুকদেবের আগমন ঘঠিল, তিনি পরিক্ষিৎ মহারাজকে সাত দিবস শ্রীমদ্ভাগবত কথা শ্রবণ করিয়াছিলেন।