জন্মান্তরবাদ ও পু্নর্জন্ম কি

 
জন্মান্তরবাদ ও পুনর্জন্ম

মৃত্যুর পর আত্মা কোথায় যায়


কেউ কেউ তাদের পূর্ব পূর্ব জন্মের কথা মনে করতে পারেন। এসব অতীত জন্মের স্মৃতিচারণা খুব চমকপ্রদ মনে হতে পারে, কিন্তু শুধু বিস্মিত হওয়াই পর্যাপ্ত নয়; জন্মান্তর তত্ত্ব উপলব্ধির প্রকৃত লক্ষ্য হচ্ছে জন্ম-মৃত্যুর এই যন্ত্রণাদায়ক চক্র হতে বিমুক্ত হওয়া। 

 

১৯৭৩-এর আগষ্টে লন্ডনে প্রদত্ত এক প্রবচনে শ্রীল প্রভুপাদ সতর্ক করেন, “এই মৃত্যুবরণ করা, তারপর আবার জন্ম নেওয়া--এটি খুব একটি ভাল কাজ নয়। আমাদের জানতে হবে যে, যখন আমরা মৃত্যুবরণ করি, তখন আমাদের আবার একজন মায়ের গর্ভে প্রবেশ করতে হয়--আর আজকাল তো মায়েরা তাদের সন্তানদের গর্ভের মধ্যেই হত্যা করছে।”

 

দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা ।

 তথা দেহান্তরপ্রাপ্তিধীরস্তত্র ন মুহ্যতি ॥

 

“দেহীর দেহ যেভাবে কৌমার, যৌবন ও জরার মাধ্যমে তার রূপ পরিবর্তন করে চলে, মৃত্যুকালে তেমনই ঐ দেহী (আত্মা) এক দেহ থেকে অন্য কোন দেহে দেহান্তরিত হয়। স্থিতপ্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা কখনও এই পরিবর্তনে মুহ্যমান হন না।” (ভগবদ্গীতা ২/১৩)


সাধারণতঃ মানুষ এই সরল শ্লোকটি বুঝতে পারে না। সেজন্য শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, ধীরস্তত্র ন মুহাতিঃ “কেবল একজন ধীর ব্যক্তি উপলব্ধি করতে পারেন।" কিন্তু বুঝতে সমস্যা কোথায়? কত প্রাঞ্জলভাবে শ্রীকৃষ্ণ এসব তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন! প্রত্যেকের জীবনে তিনটি পর্যায় রয়েছে। 

 

প্রথমটি হচ্ছে, কৌমারম্ পনের বছর বয়স পর্যন্ত এটি স্থায়ী হয়। তারপর, ষোল বছর থেকে শুরু হয় যৌবন কাল, যৌবনম্ । তারপর, চল্লিশ কি পঞ্চাশ বছর পর, বৃদ্ধ হয়, জরা। অতএব, যারা ধীর-স্থির মস্তিষ্ক, স্থির বুদ্ধি, তারা উপলব্ধি করতে পারে : “আমি আমার শরীরটি পরিবর্তন করেছি। 

 

আমি স্মরণ করতে পারি, যখন আমি বালক ছিলাম, তখন কত লাফ-ঝাপ, খেলাধুলা করতাম । তারপর আমি যুবক হলাম, তখন আমি আমার বন্ধুবর্গ আর পরিবারের সঙ্গে জীবন উপভোগ করতাম। এখন আমি একজন বৃদ্ধ, আর যখন এই দেহটির মৃত্যু হবে, তখন আমাকে নতুন আরেকটি শরীরে প্রবেশ করতে হবে।”


এর পূর্ববর্তী শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন, “আমাদের সকলেই--তুমি, আমি এবং এখানে উপস্থিত সমস্ত সৈন্য-সামস্ত ও রাজারা--আমরা পূর্বেও ছিলাম, এখনও বিদ্যমান আছি, ভবিষ্যতেও থাকব।” এই হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের উক্তি। 

 

কিন্তু দুষ্টবুদ্ধি মূঢ়রা বলবে, “কেমন করে এটি হতে পারে যে, আমি অতীতে ছিলাম? আমি কেবল এই  সালে জন্মিয়েছি, আর কিছু নয়। তার পূর্বে আমার কোনই অস্তিত্ব ছিল না। বর্তমানে আমি আছি, সেটি ঠিক। কিন্তু যখনই আমার মৃত্যু হবে, আমার অস্তিত্ব সমাপ্ত হবে--আমার কোন অস্তিত্বই থাকবে না।” 

 

জন্মান্তরবাদ কি?

 

কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “তুমি আমি, আমরা সকলেই অতীতে ছিলাম, এখনও আমরা রয়েছি, ভবিষ্যতেও আমরা থাকব।” সেটি কি ভুল? না; এটি বাস্তব সত্য। আমাদের জন্মের পূর্বে আমরা ছিলাম, অন্য কোন দেহে; আমাদের মৃত্যুর পরও আমরা থাকব, ভিন্ন আরেকটি শরীরে । 

 

এটি উপলব্ধি করতে হবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, সত্তর বছর আগে আমি একটি বালক ছিলাম, তারপর আমি যুবক হয়েছিলাম, আর এখন আমি একজন বৃদ্ধ । আমার শরীরটি এভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু দেহের মালিক, আমি অপরিবর্তিত রয়েছি।

 

 সুতরাং, এটি বুঝতে অসুবিধা কোথায়? দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে। 'দেহিন' শব্দের অর্থ হচ্ছে- “দেহী, দেহের অধিকর্তা, মালিক", আর দেহে শব্দের অর্থ “শরীরে”। শরীরটি বদলে যাচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে, কিন্তু দেহের মালিক, আত্মা, অপরিবর্তিত রয়েছে ।

যে কেউই বুঝতে পারে যে, তার শরীরটির পরিবর্তন হয়েছে। সুতরাং, তার পূর্ববর্তী জীবনেও তার দেহের পরিবর্তন হবে। কিন্তু আমাদের সেটি স্মরণ না-ও থাকতে পারে। সেটি আরেকটি বিষয়, কিন্তু দেহের পরিবর্তন হবে। গত জন্মে আমার দেহটি কেমন ছিল? আমরা তা স্মরণ করতে পারি না।  

 

অতএব, বিস্মৃতি, ভুলে যাওয়ার প্রবণতা আমাদের স্বভাবের অঙ্গ, কিন্তু কোন কিছুকে ভুলে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে, সেটি আদৌ ঘটেনি। শৈশবে আমি কত কিছু করেছি, এখন যা আমার মনে পড়ে না, কিন্তু আমার পিতা-মাতার স্মরণ আছে, তাঁরা মনে করতে পারেন। সুতরাং পূর্বজন্মের কথা স্মরণ না থাকার অর্থ এই নয় যে, সেটি ঘটেনি ।


ঠিক তেমনি, মৃত্যুর অর্থ হচ্ছে বিস্মৃতি-গত জন্মে আমি কি ছিলাম, সেটি আমি ভুলে গিয়েছি--এই হচ্ছে মৃত্যু। তা নাহলে, আমি, আত্মা অমর, মৃত্যুহীন; আত্মার মৃত্যু নেই । 

 

আত্মা কি? 


মনে করুন, আমি পোশাক পরিবর্তন করছি। কৈশোরে আমি একরকম পোশাক পরতাম, যৌবনে আমি আরেক ধরনের পোশাক পরতাম। এখন এই বৃদ্ধ বয়সে, একজন সন্ন্যাসী হিসাবে আমি ভিন্ন আরেক রকমের পোশাক পরছি। পোশাকগুলোর বদল হতে পারে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, পোশাকের মালিকটির মৃত্যু হয়েছে, সে হারিয়ে গেছে। না, আদৌ তা নয় ।


আত্মার দেহাত্তরের এটি একটি সরল ব্যাখ্যা । এছাড়া, আমরা সকলেই এক একজন ব্যক্তি। সকলের একত্রে মিলে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের প্রত্যেকেই এক একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি। ভগবান একজন ব্যক্তি, আর আমরাও ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিসত্তা। নিত্যো নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানাম্  “সকল নিত্য, চেতন ব্যক্তিসত্তার মধ্যে তিনি হচ্ছেন পরম নিত্য চেতন ব্যক্তি।” 

 

পার্থক্যটি এই যে, ভগবান কখনই তাঁর শরীর পরিবর্তন করেন না, কিন্তু এই জড় জগতে আমরা ক্রমাগত দেহ পরিবর্তন করতে থাকি। ঠিক যেমন শ্রীকৃষ্ণের দেহ সদ্-চিৎ-আনন্দময়, আনন্দময়, জ্ঞানময় শাশ্বত শরীর, তেমনি যখন আপনারা আপনাদের আপন আলয়ে ভগবদ্ধামে ফিরে যাবেন, আপনারাও একই ধরনের দেহ সদৃ-চিৎ-আনন্দময় শরীর প্রাপ্ত হবেন।

 

পার্থক্যটি হচ্ছে, শ্রীকৃষ্ণ যখন জড়জগতে আসেন, তখন তিনি তার শরীর পরিবর্তন করেন না--স্বরূপে আসেন । সেজন্য তাঁর একটি নাম হচ্ছে অচ্যুত--“যিনি কখনো তাঁর স্থিতি থেকে চ্যুত হন না।"


শ্রীকৃষ্ণ কখনোই পরিবর্তিত হন না। তিনি কখনো চ্যুত হন না, মায়াগ্রস্ত হয়ে পতিত হন না, কেননা তিনি মায়ার, জড়া শক্তির নিয়স্তা, ঈশ্বর। আমরা জড় শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, আর শ্রীকৃষ্ণ জড় শক্তির নিয়স্তা। সেটিই শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য। 

 

আর তিনি কেবল মায়াশক্তির নিয়ন্ত্রণ করেন না, তিনি চিন্ময় শক্তি, অন্তরঙ্গা শক্তিরও নিয়স্তা- সকল শক্তিরই তিনি নিয়ন্তা। আমরা যা কিছু দেখি, যা কিছু প্রকাশিত, অভিব্যক্ত হয়েছে- সবই কৃষ্ণের শক্তি। ঠিক যেমন উত্তাপ ও আলোক সূর্যের শক্তি, তেমনি প্রকাশমান সবকিছুই শ্রীকৃষ্ণের শক্তিরাজির সমন্বয়ে গঠিত।


শ্রীকৃষ্ণের শক্তি অনেক, কিন্তু তাদেরকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয় বহিরঙ্গা শক্তি, অন্তরঙ্গা শক্তি এবং তটস্থা শক্তি। আমরা, জীবসমূহ ভগবানের তটস্থা শক্তি তটস্থার অর্থ হচ্ছে, আমরা ইচ্ছা করলে বহিরঙ্গা শক্তির প্রভাবাধীনে থাকতে পারি, আবার অন্তরঙ্গা শক্তিরও প্রভাবাধীনে থাকতে পারি। 

 

পছন্দের স্বাধীনতা আমাদের, জীবের রয়েছে। ভগবদ্গীতা বলার পর শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, যথেচ্ছসি তথা কুরুঃ “তোমার যা ইচ্ছা, তাই কর।” শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এই পছন্দের স্বাধীনতা দিয়েছেন। তিনি কাউকে শরণাগত হতে বাধ্য করেন না। সেটি ভাল নয় । কোন কিছু জোরপূর্বক আরোপিত হলে সেটি স্থায়ী হয় না। 

 

যেমন, আমরা আমাদের ছাত্রদের উপদেশ দিই, “খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠো।” এই হচ্ছে আমাদের উপদেশ। আমরা কাউকে বাধ্য করি না। অবশ্য, আমরা কাউকে একবার বা দু'বার বাধ্য করতে পারি, কিন্তু সে যদি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে অভ্যাস না করে, তাহলে বাধ্য করা নিরর্থক হয়ে যাবে, কোন কাজে আসবে না ।


ঠিক সেইরকম, শ্রীকৃষ্ণ কাউকে এই জড় জগৎ ত্যাগ করতে বাধ্য করেন না। সমস্ত বদ্ধজীবেরা শ্রীকৃষ্ণের বহিরঙ্গা, যা জড়া শক্তির প্রভাবাধীন।  

 

যেহেতু আমরা শ্রীকৃষ্ণের অবিচ্ছেদ্য অংশ, আমরা সকলেই প্রত্যক্ষভাবে শ্রীকৃষ্ণের পুত্র। আর যদি কোন পিতার পুত্র দুর্দশায় পড়ে, তাহলে পিতাও কষ্ট পান, পরোক্ষভাবে মনে করুন, পুত্রটি উন্মাদ হয়ে গেছে--অথবা, আজকাল যেমন দেখা যাচ্ছে, হিপি হয়ে গেছে । পিতা তখন খুবই দুঃখিত হন“ওঃ! আমার পুত্র এখন একজন হতচ্ছাড়ার মতো জীবন যাপন করছে।

 

 সুতরাং, তখন পিতা সুখী হতে পারেন না। ঠিক তেমনি, বদ্ধ জীবেরা জড়জগতে কত দুর্দশা ভোগ করছে, হতচ্ছাড়া, দুর্ভাগা, মূঢ়ের মতো জীবন যাপন করছে। সুতরাং, শ্রীকৃষ্ণ সুখী নন। সেজন্য, কিভাবে তাঁর কাছে ফিরে যাওয়া যায়, তিনি স্বয়ং ব্যক্তিগতভাবে আমাদের তা শিক্ষা দেওয়ার জন্য এই জড়জগতে আসেন। (যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ......... তদাত্মানং সৃজাম্যহম্)।


যখন শ্রীকৃষ্ণ এখানে এই জগতে আসেন, তখন তিনি নিজের আদি নিত্যস্বরূপে আসেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমরা শ্রীকৃষ্ণকে আমাদের একজন বলে মনে করি এক অর্থে তিনি আমাদের মতো একজন, যেহেতু তিনি পিতা, আর আমরা তাঁর পুত্র । কিন্তু তিনি প্রধান, পরম নিত্যো নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানাম্ । 

 

তিনি আমাদের চেয়ে বেশি শক্তিমান তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিমান, তিনি পরম শক্তিমান পুরুষ । সেটিই হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য। আমরা ভগবানের সমকক্ষ হতে পারি না । কেউই কৃষ্ণের সমকক্ষ হতে পারে না কিংবা তার থেকে শ্রেষ্ঠতর হতে পারে না। প্রত্যেকেই শ্রীকৃষ্ণের অধীন । 

 

একেলা ঈশ্বর কৃষ্ণ, আর সব ভৃত্যপ্রত্যেকে কৃষ্ণের ভৃত্য, সেবক, এবং শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন একমাত্র প্রভু। ভোক্তারং যজ্ঞতপসাম সর্বলোক মহেশ্বরম্ “আমি একমাত্র ভোক্তা; আমি সবকিছুর অধীশ্বর," শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন। আর সেটি বাস্তব সত্য।


সুতরাং, আমরা আমাদের শরীর পরিবর্তন করছি, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তাঁর দেহ পরিবর্তন করেন না। আমাদের এটি উপলব্ধি করতে হবে। তার প্রমাণ হচ্ছে, শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত--সবকিছু অবগত, ভগবদ্গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে আপনারা দেখতে পাবেন, শ্রীকৃষ্ণ বলছেন যে, তিনি ভগবদ্গীতার এই তত্ত্বদর্শন সূর্যদেব বিবস্বানকে বলেছিলেন প্রায় ১২,০০,০০,০০০ (১২ কোটি) বছর আগে। 

 

এতো সুদূর অতীতের কথা শ্রীকৃষ্ণ কিভাবে স্মরণ রাখতে পারেন? তার কারণ তিনি তাঁর দেহ পরিবর্তন করেন না। আমরা অনেক কিছু ভুলে যাই, তার কারণ হচ্ছে প্রতি মুহুর্তেই আমাদের দেহের পরিবর্তন হচ্ছে, আমরা শরীর পরিবর্তন করছি। এটি একটি শারীরবিদ্যাগত ঘটনা, চিকিৎসা বিজ্ঞান সংক্রান্ত সত্য। 

 

আমাদের রক্তকণিকাগুলো প্রতি সেকেন্ডে পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু সমগ্র শরীরটির পরিবর্তন হচ্ছে অলক্ষিতে, অদৃশ্যভাবে। সেজন্যই একটি বেড়ে উঠতে থাকা শিশুর বাবা-মা লক্ষ্য করেন না, কিভাবে তাদের সন্তানটির দেহ রূপান্তরিত হচ্ছে। কোন তৃতীয় ব্যক্তি যদি কিছুকাল না দেখার পর আসেন, তিনি বুঝতে পারেন শিশুটি বড় হয়েছে; তিনি বলেন, “এই শিশুটি কত বড় হয়ে গেছে!” কিন্তু বাবা-মা হয়ত তার বৃদ্ধি লক্ষ্য করেননি, কারণ তাঁরা সবসময়ই তাকে দেখছেন, আর তাঁর দেহের রূপান্তর ঘটছে অদৃশ্যভাবে, অগোচরে--প্রতি মুহুর্তে। 

 

সুতরাং, আমাদের শরীরটি সবসময়ই পরিবর্তিত হচ্ছে, কিন্তু আমি, আত্মা--দেহের মালিকটির কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। এটি উপলব্ধি করতে হবে।


আমরা সকলেই জীবাত্মা, আর আমরা শাশ্বত, কিন্তু যেহেতু আমাদের শরীরটির পরিবর্তন ঘটছে, সেজন্য আমরা জন্ম, মৃত্যু, জরা এবং ব্যাধির দুর্দশাগুলো ভোগ করতে বাধ্য হচ্ছি। কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদেরকে এই সদা-পরিবর্তনশীল অবস্থা থেকে মুক্ত করা । “যেহেতু আমি নিত্য, সনাতন, তাহলে কিভাবে আমি পুনায় সেই শাশ্বত চিরস্থায়ী অবস্থায় ফিরে যেতে পারি?” 

 

সেটিই আমাদের প্রশ্ন হওয়া উচিত। প্রত্যেকেই শাশ্বতকাল বাঁচতে চায়, কেউই মরতে চায় না। যদি আমি আপনার সামনে একটি রিভলভার নিয়ে উপস্থিত হই, আর বলি, “আমি তোমাকে এখনই হত্যা করব,” আপনি তৎক্ষণাৎ আতস্বরে চীৎকার করে উঠবেন, কেননা আপনি মরতে চান না। 

 

এটি কোন ভাল কাজ কিছু নয়--মরে যাওয়া, তারপর আবার জন্ম নেওয়া। এটি অত্যন্ত কষ্টদায়ক। আমরা সকলেই অবচেতনভাবে এটি জানি। আমরা জানি যে, আমরা যখন মৃত্যুবরণ করি, তখন তারপর আমাদের আরেকজন মায়ের গর্ভে প্রবেশ করতে হবে; আর আজকাল তো মায়েরা তাদের গর্ভের মধ্যে সন্তানদের হত্যা করছে। 

 

তারপর আবার আরেকজন মায়ের গর্ভে এভাবে চলতে থাকে। এভাবে একের পর এক দেহ ধারণের প্রক্রিয়াটি অত্যস্ত দীর্ঘ এবং অত্যন্ত কষ্টদায়ক। অবচেতন মনে আমরা এই সমস্ত কষ্ট ভোগান্তির কথা স্মরণ করতে পারি, আর সেজন্যই আমরা মরতে চাই না ।


অতএব, আমাদের প্রশ্ন হওয়া উচিত এই“আমি সনাতন, শাশ্বত, তাহলে কেন আমাকে এই ক্ষণস্থায়ী অবস্থায় রাখা হয়েছে?” এই হচ্ছে প্রকৃত বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ প্রশ্ন । আর এটিই হচ্ছে আমাদের প্রকৃত সমস্যা। কিন্তু যারা নির্বোধ মূঢ়, দুষ্টবুদ্ধি, তারা এই প্রকৃত সমস্যাকে উপেক্ষা করে। 

 

তারা সবসময়ই চিন্তা করছে কিভাবে আহার করবে, কিভাবে নিদ্রা যাবে, কিভাবে মৈথুন উপভোগ করবে, কিভাবে আত্মরক্ষা করবে। কিন্তু আপনি যদি অত্যন্ত সুন্দরভাবেও আহার করেন, এবং সুন্দরভাবে নিদ্রা যান, পরিশেষে আপনাকে মৃত্যুবরণ করতেই হবে। মৃত্যুর সমস্যাটি তখনও থাকছে। কিন্তু এরা এই আসল সমস্যাটির কোন গুরুত্ব দেয় না। তারা ক্ষণস্থায়ী সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য অত্যন্ত তৎপর, সেগুলো প্রকৃতপক্ষে কোন সমস্যাই নয়। 

 

পশু-পাখিরাও আহার করে, ঘুমায়, বংশবৃদ্ধি করে এবং আত্মরক্ষা করে। এগুলো কেমন করে করতে হয় তারা ভালই জানে, যদিও তাদের মানুষের মতো শিক্ষালাভের ব্যবস্থা নেই, মানুষের মতো তথাকথিত সভ্যতা নেই। সুতরাং, এগুলো আমাদের প্রকৃত সমস্যা নয়। আসল সমস্যাটি হচ্ছে মৃত্যু, আমরা মরতে চাই না, তবুও আমাদের মৃত্যুবরণ করতে হয়। এটিই আমাদের জীবনের প্রকৃত সমস্যা ।


কিন্তু মৃঢ়বুদ্ধি মানুষ এটি জানে না। তারা সবসময়ই ক্ষণস্থায়ী সমস্যাগুলো নিয়ে শশব্যস্ত । দৃষ্টাত্তস্বরূপ, মনে করুন, তীব্র শীতের আবহাওয়া রয়েছে। এটি একটি সমস্যা আমাদের তখন একটি সুন্দর উষ্ণ কোট খুঁজতে হয়, ফায়ারপ্লেস খুঁজতে হয়; আর যদি সেগুলো পাওয়া না যায়, তাহলে আমাদের দুরাবস্থায় পড়তে হয়। 

 

সুতরাং, তীব্র শীত একটি সমস্যা। কিন্তু এটি একটি ক্ষণস্থায়ী, সমস্যা। তীব্র শৈত্য, শীত ঋতু আসে যায়। এটি কোন স্থায়ী সমস্যা নয়। আমার স্থায়ী সমস্যা হচ্ছে। অজ্ঞানতাবশতঃ আমি জড়দেহে জন্মগ্রহণ করছি, আমি ব্যাধি স্বীকার করছি, বার্ধক্য স্বীকার করছি, মৃত্যুকে স্বীকার করছি। এগুলোই আমার প্রকৃত সমস্যা। সেজন্য শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “জন্ম-মৃত্যু-জরা ব্যাধি দুঃখ-দোষানুদর্শনম্ যাদের প্রকৃত জ্ঞান হয়েছে, তারা এই দুঃখগুলো দর্শন করে--জন্ম, মৃত্যু, জরা আর ব্যাধি ॥”


 মৃত্যুকে কিভাবে জয় করা যায়


এখন, শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, ধীরস্তত্র ন মুহ্যুতি“ধীর ব্যক্তি কখনো মৃত্যুকালে মুহ্যমান হন না।" আপনি যদি নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করে তোলেন, তাহলে আপনি মুহ্যমান হবেন কেন? উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি আপনার কৈশোরে ও যৌবনে নিজেকে সুন্দরভাবে প্রস্তুত করে তোলেন, আপনি যদি সুশিক্ষিত হন, তাহলে আপনি একটি ভাল চাকরী পেতে পারেন, একটি সুন্দর অবস্থায় আপনি সুখী হতে পারেন । 

 

সেইরকমভাবে, আপনি যদি আপনার আলয় ভগবদ্ধামে ফিরে যাওয়ার জন্য এই জীবনে নিজেকে প্রস্তুত করে তোলেন, তাহলে মৃত্যুর সময় শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ার আর প্রশ্ন কোথায়? আপনি তখন জানবেন, “আমি শ্রীকৃষ্ণের কাছে ফিরে যাচ্ছি। আমি আমার আপন আলয় ভগবদ্ধামে ফিরে যাচ্ছি। 

 

এরপর আর ক্রমাগত জড় দেহ পরিবর্তন করতে হবে না; আমি একটি অপ্রাকৃত চিন্ময় দেহ লাভ করব। এখন আমি শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে খেলব, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে নৃত্য করব, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে ভোজন করব।” এই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃত--নিজেকে পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুত করে তোলা।


কখনও কখনও মরণাপন্ন মানুষেরা ভয়ার্ত স্বরে কেঁদে ওঠে, কেননা কর্মের নিয়ম অনুসারে যারা অত্যন্ত পাপী, তারা মৃত্যুর সময়ে অনেক ভয়ানক, বীভৎস সব দৃশ্য দেখতে থাকে। পাপকর্মাসক্ত মানুষ বুঝতে পারে যে, সে একটি জঘন্য ধরনের দেহ লাভ করতে চলেছে।  

 

কিন্তু যারা ধার্মিক, ভক্ত, তাঁরা কোন উৎকণ্ঠা ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে। মূর্খ লোকেরা বলবে, “তোমরা ভক্তরা মৃত্যুবরণ করছ, অভক্তরাও মৃত্যুবরণ করছে, সুতরাং পার্থক্য কোথায়?” পার্থক্য রয়েছে। একটি বিড়াল তার ছানাকে মুখে করে নিয়ে যায়, আবার তার মুখ দিয়ে ইঁদুরও ধরে । 

 


আপাতদৃষ্টিতে আমাদের কাছে মনে হতে পারে যে বিড়ালটি তার ছানা ও ইঁদুর উভয়কে একইভাবে ধরেছে। কিন্তু তার ধরার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ছানাটি মায়ের মুখে থাকা অবস্থায় আনন্দ অনুভব করছেঃ “ওঃ, আমার মা আমাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে।” আর ইঁদুরটি মৃত্যুর শীতল স্পর্শ অনুভব করছে : “ওঃ! এখন আমি মারা যাব!” এই হচ্ছে পার্থক্য। অতএব, ভক্ত ও অভক্ত উভয়েই মৃত্যুবরণ করে, কিন্তু মৃত্যুর সময়ে উভয়ের অনুভবের পার্থক্য থাকে--ঠিক বিড়াল ছানা ও ইঁদুরের মতো ।


কখনও মনে করবেন না যে, তারা উভয়ই একইরকমভাবে মৃত্যুবরণ করে । দৈহিক প্রক্রিয়াটি একইরকম হতে পারে, কিন্তু মানসিক অবস্থার পার্থক্য থাকে । ভগবদ্গীতায় (৪/৯) শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন ?

জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ ।

ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন ॥


যদি আপনারা কেবল শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন, তাহলে মৃত্যুর সময়ে আপনারা তাঁর কাছে ফিরে যেতে পারেন। শ্রীকৃষ্ণের সবকিছুই দিব্য, অপ্রাকৃত । শ্রীকৃষ্ণের কার্যাবলী, শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব, শ্রীকৃষ্ণের পূজা-আরাধনা, শ্রীকৃষ্ণের মন্দির, শ্রীকৃষ্ণের মহিমা--সবকিছুই অপ্রাকৃত। সুতরাং, কেউ যদি এই বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পারে, কিংবা এমনকি উপলব্ধি করার চেষ্টাও করে, তাহলে সে জন্ম-মৃত্যুর এই শৃঙ্খল হতে মুক্ত হতে পারে। 

 

এটিই শ্রীকৃষ্ণ এখানে বলছেন। সুতরাং, কৃষ্ণোপলব্ধি অর্জনের জন্য অত্যন্ত ঐকান্তিক হোন, এবং কৃষ্ণচেতনায় স্থিত থাকুন। তখন এই সমস্ত সমস্যা--জন্ম, মৃত্যু, জরা এবং ব্যাধি--এগুলোর আপনা থেকেই সমাধান হয়ে যাবে, অত্যন্ত সহজেই ।


একজন স্থিরমস্তিষ্ক ব্যক্তি, ধীর ব্যক্তি চিন্তা করবেন, “আমি শাশ্বত কাল বাঁচতে চাই। আমার জীবনে মৃত্যু আসে কেন? আমি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে বাঁচতে চাই, তাহলে ব্যাধি আসে কেন? আমি বৃদ্ধ হতে চাই না। তাহলে বার্ধক্য আসে কেন? জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি, এগুলোই প্রকৃত সমস্যা । 

 

কেবলমাত্র কৃষ্ণভাবনাময় হলে, কেবল শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করলে যে-কেউ অত্যস্ত সহজেই এই সমস্যাগুলো থেকে অব্যাহতি পেতে পারেন। আর শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করার জন্য ভগবদ্গীতা রয়েছে, সুন্দরভাবে সেখানে সবকিছু ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সুতরাং, আপনার জীবন সফল করুন। উপলব্ধি করুন যে, আপনি এই দেহটি নন। 

 

আপনি এই দেহের অভ্যন্তরে আবদ্ধ, কিন্তু আপনি নিজে এই দেহটি নন । দৃষ্টান্তস্বরূপ, একটি পাখি খাঁচায় আবদ্ধ থাকতে পারে, কিন্তু খাঁচাটি পাখি নয়। মূর্খ মানুষেরা খাঁচাটির খুব সুন্দর যত্ন নেয়, কিন্তু পাখিটিকে উপেক্ষা করে, আর পাখিটি অনাহারে কষ্ট পেতে থাকে। সুতরাং, আমরা পারমার্থিক অনাহারে কষ্ট পাচ্ছি। সেজন্য এই জড়জগতে কেউই সুখী নয়, পারমার্থিক অনাহার । 

 

সেজন্য আপনি দেখেন যে, আমেরিকার মতো ধনী দেশে——যেখানে আহার-বাসস্থান এবং জড়ীয় বিলাস সামগ্রীর অঢেল প্রাচুর্য রয়েছে, সেখানেও মানুষ হিপি হয়ে যাচ্ছে। যুবকেরা সন্তুষ্ট নয়, সুখী নয়-- পারমার্থিক অনাহারের জন্য। জড়জাগতিক দিক থেকে আপনারা অত্যস্ত ঐশ্বর্যশালী হতে পারেন, কিন্তু পারমার্থিক দিক দিয়ে আপনি যদি অনশন করতে থাকেন, তাহলে আপনি সুখী হতে পারেন না।


এক পারমার্থিক নবজাগরণ প্রয়োজন। আপনাদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে, অহং ব্রহ্মাস্মি “আমি এই জড় দেহ নই, আমি ব্রহ্ম, চিন্ময় আত্মা।” তখন আপনারা সুখী হবেন। ব্রহ্মভূতঃ প্রসন্নাত্মা ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি, সমঃ সর্বেষু ভূতেষু। তখন মানব সমাজে সাম্য, সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ববোধ দেখা দেবে। তা নাহলে তথাকথিত উন্নতি, সভ্যতা--শূন্যগর্ভ, বিফল--কেবল কিছু বড় বড় শব্দের আড়ম্বর, সারহীন বাক্যবিন্যাস ছাড়া আর কিছুই নয়। 

 

কৃষ্ণভাবনামৃত ব্যতীত সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি আসতে পারে না সভ্যতায়। আপনি পারমার্থিক স্তরে উপনীত হোন, তাহলে সকলকে সমদৃষ্টিতে দর্শন করতে পারবেন। তা নাহলে আপনি ভাববেন, “আমি একজন দুই হাত দুই পা-বিশিষ্ট মানুষ, আর গরুর ঐরকম হাত-পা নেই। সুতরাং, গরুটিকে আমি হত্যা করে খেয়ে ফেলি ।”

 

 কেন? একটি পশুকে হত্যা করার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? আপনার সাম্যের কোন ধারণাই নেই--কৃষ্ণচেতনার অভাবের জন্য। সেজন্য এই জড়জগতে, তথাকথিত শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভ্রাতৃত্ব--সবই বোগাস। কৃষ্ণভাবনামৃত তত্ত্ব অধ্যয়নের জন্য যথার্থ, উপযুক্ত বিষয়। সেটি করলে যথার্থ সুখী হবে মানব সমাজ। অন্যথায় নয়। আপনাদেরকে অশেষ ধন্যবাদ। 


 
 
 
 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url