মহাজন উপদেশ-প্রহ্লাদ মহারাজ
শ্রীপ্রহ্লাদ মহারাজের উপদেশ
প্রহ্লাদ যখন মাতৃগর্ভে অবস্থান করছিলেন, তখন মাতা কয়াদু ঘটনাক্রমে নারদমুনির আশ্রমে ভগবৎ কথা শ্রবণ করছিলেন। প্রহ্লাদের বিষ্ণুবিরোধী পিতা হিরণ্যকশিপু তখন কঠোর তপস্যায় ব্রতী ছিলেন। নারদমুনির ভগবত শিক্ষা গ্রহণ করেই প্রহ্লাদ রাজপ্রসাদে বাবা-মার সঙ্গে প্রত্যাবর্তন করেন। শুক্রাচার্যের দুই পুত্র যশু ও অকর্মের কাছে প্রহ্লাদকে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়। শিক্ষকেরা রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি অনেককিছুই শিক্ষা দান করেছিলেন। কিন্তু এক সময় দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু তার পুত্র প্রহ্লাদকে স্নেহভরে জিজ্ঞাসা করেন-
হে বৎস, তোমার শিক্ষকদের কাছে তুমি যে সমস্ত বিষয় পাঠ বরেছ, তার মধ্যে কোন বিষয়টি তুমি শ্রেষ্ঠ বলে মনে করো, তা আমাকে বলো। শিক্ষক ষন্ড ও অকর্ম ছিলেন প্রহ্লাদের পিতার কর্তৃক নিযুক্ত শৌক্র পরম্পরার গুরু। তাঁদের শিক্ষাগুলি ছিল একটি রাজপুত্ররূপে জাগতিক শিক্ষার বিষয়। যেগুলি প্রহ্লাদের কাছে কোনও আকর্ষণীয় ছিল না। শ্রীনারদের শিক্ষা প্রহ্লাদ গ্রহণ করেছিলেন। তাই প্রহ্লাদ তাঁর উত্তরে বলতে লাগলেন-
সেই বিষয়টি শিক্ষা করাই সর্বশ্রেষ্ঠ যাতে প্রত্যক্ষ ও পূর্ণরূপে নববিধা ভক্তির মাধ্যমে শ্রীহরির সেবা করা হয়। ভগবানের দিব্য নাম, রূপ,গুণ, পরিকর ও লীলাসমূহ শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, ভগবৎপাদপদ্ম সেবন, ষোড়শ উপচারে শ্রদ্ধার সঙ্গে ভগবৎ বিগ্রহ অর্চনা, ভগবৎপাদপদ্ম সেবন, ষোড়শ উপচারে শ্রদ্ধার সঙ্গে ভগবৎ বিগ্রহ অর্চনা, ভগবানের বন্দনা, তাঁর দাস হওয়া, তাঁকে প্রিয়তম বন্ধু বলে মনে করা এবং তাঁর কাছে সর্বস্ব সমর্পণ করা বা কায়মনোবাক্যে তাঁর সেবা করা-
এইগুলি শুদ্ধভক্তির নয়টি পন্থা। এই ভক্তির দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের সেবায় যিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন, তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্ধান, তিনি পূর্ণ জ্ঞানী। যদিও এই কথায় অসররাজ হিরণ্যকশিপু ক্রোধান্বিত হয়েছিলেন তবুও প্রহ্লাদ বলতে লাগলেন-
অসংযত ইন্দ্রিয় বিষয়াসক্ত ব্যক্তিরা নারকীয় জীবনে প্রবেশ করে একই বস্তু বার বার চর্বণ করে। সেই ধরনের দুর্বুদ্ধি থাকলে কখনও কোনও হিতোপদেশে, কিংবা নিজের বিবেকের বিচারেও কেউ কৃষ্ণভক্তি জিনিষটার প্রতি আকৃষ্ট হবে না। তারা কেবল ভগবান সম্বন্ধে তাদের একটা জড় বদ্ধ বিকৃত ধারণা পোষণ করবে। যারা জড় সংসারটাকে ভোগ করার বাসনাতে আবদ্ধ হয়ে আছে, তারা তাদেরে মতো একটা বিষয়াসক্ত অন্ধ ব্যক্তিকে তাদের নেতা বা গুরুরূপে বরণ করছে। তারা বুঝতেই পারে না যে, দুর্লভ জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবদধামে ফিরে যাওয়া এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় যুক্ত হওয়া। অন্ধ যেমন অন্ধের দ্বারা পরিচালিত হয়ে অন্ধকুপে পতিত হয়, প্রকৃত পথের সন্ধান পায় না, তেমনই বিষয়াসক্ত ব্যক্তিরা বিষয়ী গুরুর দ্বারা পরিচালিত হয়ে সকাম কর্মরূপ অত্যন্ত শক্ত রজ্জুর বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
এভাবে জন্ম-মৃত্যুর সংসার চক্রে বারংবার আবর্তিত হয়ে ত্রিতাপদুঃখ ভোগ করতে থাকে। যে গুরু বা শিক্ষক নিজেই ভক্ত নয়, নিজেই জড়জগতের কলুষে কলুষিত সে কখনও কাউকে কৃষ্ণভক্তিতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে না। শুদ্ধভক্তের চরণধূলিতে ভূষিত না হওয়া পর্যন্ত বিষয়াসক্ত ব্যক্তিরা কখনও শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আসক্ত হতেও পারে না। যতদিন শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত না হওয়া যায়, যতদিন পর্যন্ত কৃষ্ণভক্তি অনুশীলনে ব্রতী না হওয়া যায়, ততদিন পর্যন্ত জড়জগতের কলুষতা থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়।
নাস্তিক অসুর হিরণ্যকশিপু নিজেকেই ভগবান বলে জাহির করেছিল, সে নির্মমভাবে প্রহ্লাদকে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করলেও প্রহ্লাদ অবিচলিত ছিল। তারপর আবার প্রহ্লাদকে পাঠশালায় পাঠানো হয়। পাঠশালাতে অবসরকালে প্রহ্লাদ তাঁর সহপাঠীদের শিক্ষা দিতে লাগলেন-
এই মনুষ্য জন্ম বড় দুর্লভ। এই মনুষ্য-জীবনে যাঁরা প্রজ্ঞাবান বা বুদ্ধিমান তাঁরা বাল্যকাল থেকেই অন্য সমস্ত প্রয়াস ত্যাগ করে ভাগবতধর্ম অনুষ্ঠান করবেন। মানব শরীরটি অন্যান্য শরীরের মতো অনিত্য অর্থাৎ ক্ষণস্থায়ী হলেও এই মনুষ্য শরীর অত্যন্ত অর্থপূর্ণ। কারণ, মনুষ্য-জীবনে ভগবান শ্রীহরির সেবা সম্পাদন করা সম্ভব হয়। যে কেউ নিষ্ঠা সহকারে কিঞ্চিৎমাত্র ভগবদভক্তির অনুশীলন করলেও পূর্ণসিদ্ধি লাভ করতে পারে।
আরও পড়ুনঃ জড়বন্ধন থেকে মুক্তির উপায়-নৈতিক শিক্ষামূলক গল্প
তোমরা জানবে যে, মনুষ্য-জীবন ভগবদধা, শ্রীবৈকুন্ঠে ফিরে যাওয়ার সুযোগ প্রদান করে। তাই প্রত্যেকটি মানুষের অবশ্যই কর্তব্য হচ্ছে ভগবান শ্রীহরির পাদপদ্মসেবায় যুক্ত হওয়া। এই ভক্তি জীবের স্বাভাবিক কর্ম। কারণ পরমেশ্বর শ্রীহরি সকলেরই পরম প্রিয়, পরমাত্মা এবং পরম সুহৃদ্।
হে বন্ধুরা, তোমরা জানবে যে, দেহের সঙ্গে ইন্দ্রিয়-বিষয়ের সংযোগ বশত যে ইন্দ্রিয়সুখ লাভ হয়, তা মনুষ্য-জীবনেই কেন যে কোনও জন্মেই পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে লাভ হয়ে থাকে। এই রকমের সুখ আপনা থেকেই কোনরকম প্রচেষ্টা ছাড়াই লাভ হয়, ঠিক যেমন বিনা প্রচেষ্টায় দুঃখ লাভ হয়। তাই মনুষ্য-জীবনে একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে ভগবানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তার ফলে ভগবানের নিত্যধামে নিত্যজীবনে ফিরে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জিত হয়। যেকোনও জড় শরীর গ্রহণ করা মাত্রই সুখ-দুঃখ আসে। কিন্তু মনুষ্য শরীরের সর্বশ্রেষ্ঠ উপযোগিতা হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। মানুষ যদি কৃষ্ণভক্তি অনুশীলনে যত্নশীল না হয়, কেবল ইন্দ্রিয় তর্পণ ও অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনের জন্য সময় ও শক্তির অপচয় করে তবে বাস্তবিক তাতে কোনও লাভ হয় না। যখনই তার মনুষ্য শরীরটি ত্যাগ হয়ে যাবে তারপরেই তাকে পরবর্তী জন্মে ইতর প্রাণীরূপে অধঃপতিত হতে হবে।
অতএব জড়জগতে অবস্তানকালে নিত্য শাশ্বত ও অনিত্য ক্ষণিকের পার্থক্য নিরুপণ করে যে পর্যন্ত এই সুন্দর মানব-শরীরটি রয়েছে, ততক্ষণ ভীত না হয়ে জীবনের চরম লক্ষ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়াই বুদ্ধিমান ব্যক্তির কর্তব্য। মানুষের আয়ুষ্কাল বড়জোর একশো বছর। অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিদের সেই একশো বছরের মধ্যে অর্ধেক সময় অনর্থক অতিবাহিত হয়। অজ্ঞানের অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে দিনের অর্ধেক সময়টাই তারা ঘুমিয়ে থাকে।
অতএব এই রকম ব্যক্তির আয়ুষ্কাল পঞ্চাশ বছর বলা যায়। বাল্যকালে অজ্ঞান অবস্থায় দশ বছর, কৈশোরে খেলাধুলায় দশ বছর, এভাবে কুড়ি বছর বিফলে যায়। বৃদ্ধ বয়সে জরাগ্রস্ত হয়ে কুড়ি বছর বৃথা অতিবাহিত হয়। বাকি সময়টি অসংযত ইন্দ্রিয় ও অতৃপ্ত কামনাবাসনা, প্রবল মোহগ্রস্ত হয়ে পারিবারিক ও অন্যান্য জাগতিক জীবনের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত হয়ে থাকে। কৃষ্ণভক্তি কর্মে যুক্ত হওয়ার মতো তার কোনও সময় অবশেষ থাকে না।
মানুষ তার প্রিয় প্রাণকেও বিপন্ন করে অর্থ-উপার্জন করে পারিবারিক সম্বন্ধে মোহিত হয়ে। এভাবে সে কিছুতেই বুঝতে পারে না যে, কিভাবে মনুষ্যজীবন পরম সত্যকে উপলদ্ধি না করে অনর্থক হয়ে যাচ্ছে। অতচ বিষয়ী অর্থসংগ্রাহী ব্যক্তি অত্যন্ত বুদ্ধি খাটিয়ে সাবধানতার সঙ্গে দেখে যে, একটি পয়সাও যেন নষ্ট না হয়।
হে বন্ধুরা, কোন দেশে কোন কালে ভগবদভক্তিজ্ঞানহীন ব্যক্তি নিজেকে জন্মমৃত্যুর দুঃখপূর্ণ বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারেনি। বরং ভগবৎ বিমুখ হয়ে জড়া প্রকৃতির কঠোর নিয়মের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকে। এই জড় সংসারে বেশীর ভাগ লোকেই ইন্দ্রিয়তৃপ্তির প্রতি অত্যন্ত আসক্ত। তাদের জীবনের লক্ষ্য হলো, কি করে বেশী পরিমাণে যৌনসুখ ভোগ করবে। এভাবে পরিণামে অন্ধকারাচ্ছন্ন নরকে পতিত হবে।
অনেকে মনে করে যে, ভোগের পরে তারা ত্যাগব্রত হয়ে সাধন ভজন করবে, কিন্তু দেখা যায় তারা পুত্র পৌত্র প্রপৌত্রদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েই ভজনবিমুখ হয়ে থাকে।
কি বালক, কি যুবক, কি বৃদ্ধ-কারওই ভগবানের আরধনা করতে কোনও বাধা-প্রতিবন্ধকতা নেই। কেননা জীবের সঙ্গে ভগবানের সম্পর্ক সর্বদাই বাস্তব এবং তাই অনায়াসে ভগবানের প্রসন্নতা বিধান করা যায়। তিনি সমস্ত জীবের অন্তরে কর্মের সাক্ষী রূপে বিরাজমান। নাস্তিকেরা তাঁর অস্তিত্ব বুঝতে পারে না।
আরও পড়ুনঃ হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করার নিয়ম
অতএব হে বন্ধুগণ, তোমরা শত্রুভাব বা দ্বৈতভাব রহিত হয়ে কর্ম করো। হরিভক্তির জ্ঞান প্রদান করে সমস্ত জীবের প্রতি তোমাদের করুণা প্রদর্শন করো। এভাবে তোমরা জগতের শুভাকাঙ্ক্ষী হও। প্রতিটি জীবের হৃদয়ে পরমাত্মারূপে বিরাজমান ভগবানকে সর্বদা স্মরণ করা উচিত। প্রতিটি জীবকে তার স্থিতি অনুসারে সম্মান করা উচিত। এভাবে মানুষ কাম-ক্রোধ-লোভ -মোহ-মদ-মাৎসর্য জয় করে কৃষ্ণভক্তি সম্পাদন করতে সক্ষম হবে। নিরন্তর ভগবানের কথা স্মরণ করার ফলে ভক্তের মন ও শরীর জড় কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে চিন্ময়ত্ব লাভ করে। কেউ যখন ভগবৎ সেবায় যুক্ত হয়, তখন তার জীবনের সমস্যা অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুর চক্রের গতি সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়। নিত্য দিব্য আনন্দ আস্বাদন করার সৌভাগ্য তার লাভ হয়।
এভাবে জন্ম-মৃত্যুর সংসার চক্রে বারংবার আবর্তিত হয়ে ত্রিতাপদুঃখ ভোগ করতে থাকে। যে গুরু বা শিক্ষক নিজেই ভক্ত নয়, নিজেই জড়জগতের কলুষে কলুষিত সে কখনও কাউকে কৃষ্ণভক্তিতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে না। শুদ্ধভক্তের চরণধূলিতে ভূষিত না হওয়া পর্যন্ত বিষয়াসক্ত ব্যক্তিরা কখনও শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আসক্ত হতেও পারে না। যতদিন শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত না হওয়া যায়, যতদিন পর্যন্ত কৃষ্ণভক্তি অনুশীলনে ব্রতী না হওয়া যায়, ততদিন পর্যন্ত জড়জগতের কলুষতা থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়।
নাস্তিক অসুর হিরণ্যকশিপু নিজেকেই ভগবান বলে জাহির করেছিল, সে নির্মমভাবে প্রহ্লাদকে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করলেও প্রহ্লাদ অবিচলিত ছিল। তারপর আবার প্রহ্লাদকে পাঠশালায় পাঠানো হয়। পাঠশালাতে অবসরকালে প্রহ্লাদ তাঁর সহপাঠীদের শিক্ষা দিতে লাগলেন-
এই মনুষ্য জন্ম বড় দুর্লভ। এই মনুষ্য-জীবনে যাঁরা প্রজ্ঞাবান বা বুদ্ধিমান তাঁরা বাল্যকাল থেকেই অন্য সমস্ত প্রয়াস ত্যাগ করে ভাগবতধর্ম অনুষ্ঠান করবেন। মানব শরীরটি অন্যান্য শরীরের মতো অনিত্য অর্থাৎ ক্ষণস্থায়ী হলেও এই মনুষ্য শরীর অত্যন্ত অর্থপূর্ণ। কারণ, মনুষ্য-জীবনে ভগবান শ্রীহরির সেবা সম্পাদন করা সম্ভব হয়। যে কেউ নিষ্ঠা সহকারে কিঞ্চিৎমাত্র ভগবদভক্তির অনুশীলন করলেও পূর্ণসিদ্ধি লাভ করতে পারে।
আরও পড়ুনঃ জড়বন্ধন থেকে মুক্তির উপায়-নৈতিক শিক্ষামূলক গল্প
তোমরা জানবে যে, মনুষ্য-জীবন ভগবদধা, শ্রীবৈকুন্ঠে ফিরে যাওয়ার সুযোগ প্রদান করে। তাই প্রত্যেকটি মানুষের অবশ্যই কর্তব্য হচ্ছে ভগবান শ্রীহরির পাদপদ্মসেবায় যুক্ত হওয়া। এই ভক্তি জীবের স্বাভাবিক কর্ম। কারণ পরমেশ্বর শ্রীহরি সকলেরই পরম প্রিয়, পরমাত্মা এবং পরম সুহৃদ্।
হে বন্ধুরা, তোমরা জানবে যে, দেহের সঙ্গে ইন্দ্রিয়-বিষয়ের সংযোগ বশত যে ইন্দ্রিয়সুখ লাভ হয়, তা মনুষ্য-জীবনেই কেন যে কোনও জন্মেই পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে লাভ হয়ে থাকে। এই রকমের সুখ আপনা থেকেই কোনরকম প্রচেষ্টা ছাড়াই লাভ হয়, ঠিক যেমন বিনা প্রচেষ্টায় দুঃখ লাভ হয়। তাই মনুষ্য-জীবনে একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে ভগবানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তার ফলে ভগবানের নিত্যধামে নিত্যজীবনে ফিরে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জিত হয়। যেকোনও জড় শরীর গ্রহণ করা মাত্রই সুখ-দুঃখ আসে। কিন্তু মনুষ্য শরীরের সর্বশ্রেষ্ঠ উপযোগিতা হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। মানুষ যদি কৃষ্ণভক্তি অনুশীলনে যত্নশীল না হয়, কেবল ইন্দ্রিয় তর্পণ ও অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনের জন্য সময় ও শক্তির অপচয় করে তবে বাস্তবিক তাতে কোনও লাভ হয় না। যখনই তার মনুষ্য শরীরটি ত্যাগ হয়ে যাবে তারপরেই তাকে পরবর্তী জন্মে ইতর প্রাণীরূপে অধঃপতিত হতে হবে।
অতএব জড়জগতে অবস্তানকালে নিত্য শাশ্বত ও অনিত্য ক্ষণিকের পার্থক্য নিরুপণ করে যে পর্যন্ত এই সুন্দর মানব-শরীরটি রয়েছে, ততক্ষণ ভীত না হয়ে জীবনের চরম লক্ষ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়াই বুদ্ধিমান ব্যক্তির কর্তব্য। মানুষের আয়ুষ্কাল বড়জোর একশো বছর। অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিদের সেই একশো বছরের মধ্যে অর্ধেক সময় অনর্থক অতিবাহিত হয়। অজ্ঞানের অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে দিনের অর্ধেক সময়টাই তারা ঘুমিয়ে থাকে।
অতএব এই রকম ব্যক্তির আয়ুষ্কাল পঞ্চাশ বছর বলা যায়। বাল্যকালে অজ্ঞান অবস্থায় দশ বছর, কৈশোরে খেলাধুলায় দশ বছর, এভাবে কুড়ি বছর বিফলে যায়। বৃদ্ধ বয়সে জরাগ্রস্ত হয়ে কুড়ি বছর বৃথা অতিবাহিত হয়। বাকি সময়টি অসংযত ইন্দ্রিয় ও অতৃপ্ত কামনাবাসনা, প্রবল মোহগ্রস্ত হয়ে পারিবারিক ও অন্যান্য জাগতিক জীবনের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত হয়ে থাকে। কৃষ্ণভক্তি কর্মে যুক্ত হওয়ার মতো তার কোনও সময় অবশেষ থাকে না।
মানুষ তার প্রিয় প্রাণকেও বিপন্ন করে অর্থ-উপার্জন করে পারিবারিক সম্বন্ধে মোহিত হয়ে। এভাবে সে কিছুতেই বুঝতে পারে না যে, কিভাবে মনুষ্যজীবন পরম সত্যকে উপলদ্ধি না করে অনর্থক হয়ে যাচ্ছে। অতচ বিষয়ী অর্থসংগ্রাহী ব্যক্তি অত্যন্ত বুদ্ধি খাটিয়ে সাবধানতার সঙ্গে দেখে যে, একটি পয়সাও যেন নষ্ট না হয়।
হে বন্ধুরা, কোন দেশে কোন কালে ভগবদভক্তিজ্ঞানহীন ব্যক্তি নিজেকে জন্মমৃত্যুর দুঃখপূর্ণ বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারেনি। বরং ভগবৎ বিমুখ হয়ে জড়া প্রকৃতির কঠোর নিয়মের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকে। এই জড় সংসারে বেশীর ভাগ লোকেই ইন্দ্রিয়তৃপ্তির প্রতি অত্যন্ত আসক্ত। তাদের জীবনের লক্ষ্য হলো, কি করে বেশী পরিমাণে যৌনসুখ ভোগ করবে। এভাবে পরিণামে অন্ধকারাচ্ছন্ন নরকে পতিত হবে।
অনেকে মনে করে যে, ভোগের পরে তারা ত্যাগব্রত হয়ে সাধন ভজন করবে, কিন্তু দেখা যায় তারা পুত্র পৌত্র প্রপৌত্রদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েই ভজনবিমুখ হয়ে থাকে।
কি বালক, কি যুবক, কি বৃদ্ধ-কারওই ভগবানের আরধনা করতে কোনও বাধা-প্রতিবন্ধকতা নেই। কেননা জীবের সঙ্গে ভগবানের সম্পর্ক সর্বদাই বাস্তব এবং তাই অনায়াসে ভগবানের প্রসন্নতা বিধান করা যায়। তিনি সমস্ত জীবের অন্তরে কর্মের সাক্ষী রূপে বিরাজমান। নাস্তিকেরা তাঁর অস্তিত্ব বুঝতে পারে না।
আরও পড়ুনঃ হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করার নিয়ম
অতএব হে বন্ধুগণ, তোমরা শত্রুভাব বা দ্বৈতভাব রহিত হয়ে কর্ম করো। হরিভক্তির জ্ঞান প্রদান করে সমস্ত জীবের প্রতি তোমাদের করুণা প্রদর্শন করো। এভাবে তোমরা জগতের শুভাকাঙ্ক্ষী হও। প্রতিটি জীবের হৃদয়ে পরমাত্মারূপে বিরাজমান ভগবানকে সর্বদা স্মরণ করা উচিত। প্রতিটি জীবকে তার স্থিতি অনুসারে সম্মান করা উচিত। এভাবে মানুষ কাম-ক্রোধ-লোভ -মোহ-মদ-মাৎসর্য জয় করে কৃষ্ণভক্তি সম্পাদন করতে সক্ষম হবে। নিরন্তর ভগবানের কথা স্মরণ করার ফলে ভক্তের মন ও শরীর জড় কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে চিন্ময়ত্ব লাভ করে। কেউ যখন ভগবৎ সেবায় যুক্ত হয়, তখন তার জীবনের সমস্যা অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুর চক্রের গতি সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়। নিত্য দিব্য আনন্দ আস্বাদন করার সৌভাগ্য তার লাভ হয়।
আরও পড়ুন
* মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী*মহাজন উপদেশ-শ্রী যমরাজ
*মহাজন উপদেশ-শ্রীব্রহ্মা
* শ্রীশিক্ষাষ্টকম্-মহাপ্রভুর বানী
* কল্কি অবতার কখন আবির্ভুত হবে-kalki avatar
* কলিযোগের কথা
* রাধাকৃষ্ণের সম্পর্কের প্রকৃত রহস্য
* শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সকল অধ্যায় সমূহ