কল্কি অবতার কখন আবির্ভুত হবে-kalki avatar
কল্কি অবতারের আবির্ভাব এখনো প্রায় ৪,২৬,৮৮২ বছর বাকি
সত্য, ত্রেতা, দ্বাপরের শেষে কলিযুগের আগমন। এভাবে ঘড়ির কাঁটার মতো এ চার যুগ অনাদিকাল ধরে পালাক্রমে আবর্তিত হয়ে আসছে। বর্তমানে আমরা বৈবস্বত মনুর আয়ুষ্কালে অষ্টাবিংশতি চতুর্যুগের শেষে যে দ্বাপরযুগ তার পরবর্তী কলিযুগে অবস্থান করছি। এ চার যুগে ভগবান তাঁর বিভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়ে লীলাবিলাস করছেন। ভগবানের ছয়প্রকার অবতার, তার মধ্যে একটি হচ্ছে লীলাবতার। লীলা অবতার গণের মধ্যে কল্কি অবতার অন্যতম।
চার যুগ অন্তর অন্তর কল্কি অবতার কলিযুগের শেষে এবং পুনরায় সত্যযুগের প্রারম্ভে আবির্ভুত হন। এরই ধারাবাহিকতায় এই কলিযুগেও কল্কি অবতার যথাসময়ে আবির্ভূত হবেন, তাই শাস্ত্রে বর্ণিত আছে। কিন্তু সম্প্রতি ভগবানের অবতার হওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। ভগবানের অবতরণের সুযোগ নিয়ে অনেকেই অবতার হতে চাচ্ছেন বা তার অনুগামীরা তাদের অবতার বলে প্রতিপন্ন করছেন। শাস্ত্রে ভগবদ্ অবতারের যেসব বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা আছে তা না থাকা সত্ত্বেও জনগণের অজ্ঞতার দরুন তারা সমাজে এক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছে। এখানে-সেখানে যত্রতত্র শোনা যাচ্ছে-অমুক নাকি ভগবানের অবতার।
আমরা কলিযুগে জন্মগ্রহণ করেছি। শাস্ত্রের বর্ণনা অনুসারে কলিযুগের শেষে ভগবান কল্কি অবতাররূপে আবির্ভূত হয়ে আবার পৃথিবীতে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন করে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু যেহেতু কল্কি অবতার এখনো আবির্ভূত হননি, তাই এই অবতার নিয়ে চলছে নানারকম কল্পনাবিলাস। ভুরি ভুরি ভুঁইফোড় ব্যক্তি কল্কি অবতার নামে আত্মপ্রকাশ করছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুগামীরা তাদের দল ভারি করার জন্য বিভিন্ন রূপক ও কাল্পনিক যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে শাস্ত্রীয় প্রশাণের অপব্যাখ্যা করছে।
নামে-বেনামে বিভিন্ন বই ছাপিয়ে কল্কি অবতার সম্বন্ধে মানুষকে ভুল তথ্য প্রদান করছে। আর তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ছে শাস্ত্রজ্ঞান সম্বন্ধে অজ্ঞ সাধারণ মানুষ। যখনই কেউ বলছেন, “তিনি ভগবানের অবতার”-সাধারণ মানুষ এর সত্যতা বিচার না করেই তার পেছনেই ছুটছে। বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ।
চার যুগ অন্তর অন্তর কল্কি অবতার কলিযুগের শেষে এবং পুনরায় সত্যযুগের প্রারম্ভে আবির্ভুত হন। এরই ধারাবাহিকতায় এই কলিযুগেও কল্কি অবতার যথাসময়ে আবির্ভূত হবেন, তাই শাস্ত্রে বর্ণিত আছে। কিন্তু সম্প্রতি ভগবানের অবতার হওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। ভগবানের অবতরণের সুযোগ নিয়ে অনেকেই অবতার হতে চাচ্ছেন বা তার অনুগামীরা তাদের অবতার বলে প্রতিপন্ন করছেন। শাস্ত্রে ভগবদ্ অবতারের যেসব বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা আছে তা না থাকা সত্ত্বেও জনগণের অজ্ঞতার দরুন তারা সমাজে এক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছে। এখানে-সেখানে যত্রতত্র শোনা যাচ্ছে-অমুক নাকি ভগবানের অবতার।
আমরা কলিযুগে জন্মগ্রহণ করেছি। শাস্ত্রের বর্ণনা অনুসারে কলিযুগের শেষে ভগবান কল্কি অবতাররূপে আবির্ভূত হয়ে আবার পৃথিবীতে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন করে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু যেহেতু কল্কি অবতার এখনো আবির্ভূত হননি, তাই এই অবতার নিয়ে চলছে নানারকম কল্পনাবিলাস। ভুরি ভুরি ভুঁইফোড় ব্যক্তি কল্কি অবতার নামে আত্মপ্রকাশ করছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুগামীরা তাদের দল ভারি করার জন্য বিভিন্ন রূপক ও কাল্পনিক যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে শাস্ত্রীয় প্রশাণের অপব্যাখ্যা করছে।
নামে-বেনামে বিভিন্ন বই ছাপিয়ে কল্কি অবতার সম্বন্ধে মানুষকে ভুল তথ্য প্রদান করছে। আর তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ছে শাস্ত্রজ্ঞান সম্বন্ধে অজ্ঞ সাধারণ মানুষ। যখনই কেউ বলছেন, “তিনি ভগবানের অবতার”-সাধারণ মানুষ এর সত্যতা বিচার না করেই তার পেছনেই ছুটছে। বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ।
ভারচুয়াল কমিউনিকেশন এবং দ্রুত কোনো সংবাদ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তথ্যপ্রযু্ক্তির জুড়ি নেই। ব্লগিং চ্যাটিং-এ নানা বিষয় নিয়ে চলে তমুল তর্ক-বিতর্ক। ব্লগ এবং গণমাধ্যমগুলোতে সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে যেমন চর্চা হয়, ঠিক তেমনি চর্চা হয় ধর্মীয় বিষয় নিয়েও। ধর্মীয় যেসব বিষয় নিয়ে এসকল গণমাধ্যমগুলোতে চর্চা হয়, তার মধ্যে কল্কি অবতার অন্যতম। তাই কল্কি অবতার আদৌ এসেছেন কি না, তা প্রমাণ করাই এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।
বৈদিক শাস্ত্রে কল্কি অবতার
বৈদিক শাস্ত্র অভ্রান্ত। তাই সঠিক সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে অবগত হওয়ার জন্য শাস্ত্রই একমাত্র প্রমাণ। আমরা যদি শাস্ত্রে বর্ণিত কল্কি অবতারের আবির্ভাবের লঙ্কণ, কাল, কার্য ও উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিচার করে দেখি, তবে খুব সহজেই বোঝা যাবে যে, কল্কি অবতার এখনও আবির্ভুত হননি। তাই শাস্ত্র প্রমাণের আলোকে যদি প্রশাণ করা যায় যে, কল্কি অবতার এখনও আবির্ভূত হননি, তাহলে তথাকথিত ভুঁইফোড় কল্কি অবতারদের আলাদা আলাদা করে মিথ্যা প্রমান করার কোনো প্রয়োজন হবে না। কোনো সত্যকে মিথ্যা প্রমানণত করার জন্য সত্য প্রতিষ্ঠা করে আবশ্যক। অন্ধকারকে দূর করার জন্য যেমন আলোক প্রজ্জ্বলন করতে হয়, ঠিক তেমনি অপসিদ্ধান্ত রূপ অন্ধকারকে দূরীভূত করার জন্য সুসিদ্ধান্তরূপ আলোক প্রজ্জ্বলন আবশ্যক। তাই ধারাবাহিকভাবে কল্কি অবতার সম্বন্ধে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্রীয় প্রমাণ নিম্নে তুলে ধারা হলো।
ভগবান বিভিন্ন যুগে ভিন্ন ভিন্ন রূপে এ জন্য আবির্ভূত হন। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মনং সৃজাম্যহম্।
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।
“হে ভারত, যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই। সাধুদের পরিত্রাণ এবং দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্য আর ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।”
উক্ত শ্লোকে ভগবানের আবির্ভাবের তিনটি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে- ১. সাধুদের পরিত্রাণ, ২. ভগবদ্বিমুখ আসুরিক ব্যক্তিদের বিনাশ এবং ৩. ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান জানতে হলে ভূগোল বই পড়তে হয়, চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্বন্ধে জানতে হলে মেডিক্যাল সায়েন্স-এর বই পড়তে হয় তেমনি ভগবান কে? তা জানতে হলে আমাদের অবশ্যই বৈদিক শাস্ত্রের মাধ্যমে জানতে হবে। ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থে বলা হয়েছে-
শ্রুতি-স্মৃতি, পুরাণাদি পঞ্চরাত্রবিধিং বিনা।
ঐকান্তিকী হরের্ভক্তিরুপাতৈব কল্পতে।।
অর্থাৎ, শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণসমূহ ও নারদপঞ্চরাত্র আদি বৈদিকশাস্ত্রকে অবহেলা করে যে হরিভক্তি, তা সমাজে শুধু উৎপাতই সৃষ্টি করে। সেজন্য আমাদের বৈদিক শাস্ত্র হতে জানতে হবে, ভগবান কে? ভগবানের অবতার কবে, কখন, কোথায়, কীভাবে আবির্ভূত হবেন? তাই যাকে-তাকে ভগবান বলার আগে আমাদের জানতে হবে শাস্ত্রে ভগবান সম্বন্ধে কী বলা হয়েছে? শাস্ত্রোক্ত প্রমাণ ব্যতীত যাকে তাকে ভগবান বলা নির্বুদ্ধিতারই পরিচায়ক। চলুন তবে জেনে নেয়া যাক শাস্ত্রে কল্কি অবতারের আবির্ভাব সম্পর্কে কী বলা হয়েছে-
কল্কি অবতারের আবির্ভাব কাল
শ্রীমদ্ভাগবতে (১.৩.২৮) বর্ণনা করা হয়েছে, “পূর্বোল্লিখিত এ সমস্ত অবতারেরা হচ্ছেন ভগবানের অংশ বা কলা অবতার। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং। যখন নাস্তিকদের অত্যাচার বেড়ে যায়, তখন আস্তিকদের রক্ষা করার জন্য ভগবান এ ধরাধামে অবর্তীর্ণ হন।”
“অত্থাসৌ যুগসন্ধ্যায়ং দস্যু প্রায়েষু রাজসু।
জনিতা বিষ্ণুযশসো নাম্না কল্কির্জগৎপতিঃ।-
(শ্রীমদ্ভাগবত-১.৩.২৫)
তারপর দ্বাবিংশ অবতারে যুগসন্ধিকালে, অর্থাৎ কলিযুগের অন্তে নৃপতিরা যখন দস্যুপ্রায় হয়ে যাবে, তখন ভগবান কল্কি অবতার নামে বিষ্ণুযশ নামক ব্রাহ্মণের পুত্ররূবে অবতরণ করবেন।” শ্রীল প্রভুপাদ উক্ত শ্লোকের তাৎপর্যে লিখেছেন- “এখানে ভগবান কল্কি অবতারের আবির্ভাব সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। তিনি যুগসন্ধ্যায়, অর্থাৎ কলিযুগের শেষ এবং সত্যযুগের শুরু-এই দুটি যুগের সন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হবেন। দেয়ালপঞ্জির (ক্যালেন্ডারের) মাসের মতো সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর কলি-এ চারটি যুগ আবর্তিত হয়। এই কলিযুগের স্থায়িত্ব হচ্ছে ৪,৩২,০০০ বছর। তার মধ্যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর পরিক্ষীত মহারাজের রাজত্বকাল শুরুর থেকে পাঁচহাজার বছর গত হয়েছে। সুতরাং কলিযুগের আরো ৪,২৭,০০০ বছর বাকি রয়েছে। সেই সময়ের পর কল্কি অবতারের আবির্ভাব হবে, যেকথা শ্রীমদ্ভাগবতে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। তাঁর পিতা হবেন বিষ্ণুযশ নামক এক তত্ত্বজ্ঞানী ব্রাহ্মণ এবং তিনি সম্ভল গ্রামে আবির্ভূত হবেন। এসমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী যথাসময়ে মত্যে পরিণত হবে।”
২ অয়ন (১অয়ন=৬ মাস) = ১ বছর বা দেবলোকের ১দিন, দেবলোকের ১ বছর = ভূলোকের প্রায় ৩৬০ বছর। ৪০০০+৪০০ সন্ধা + ৪০০ সন্ধ্যাংশ = ৪৮০০ দিব্য বছর х ৩৬০ বছর= ১২,৯৬,০০০ বছর = ত্রেতা যুগ।
২০০০+২০০ সন্ধা + ২০০ সন্ধ্যাংশ = ২৪০০ দিব্য বছর х ৩৬০ বছর = ৮,৬৪,০০ বছর = দ্বাপরযুগ ।
১০০০+২০০ সন্ধা + ১০০ সন্ধ্যাংশ = ১২০০ দিব্যবছর х ৩৬০ বছর = ৪,৩২,০০০ বছর= কলিযুগ।
৪ যুগ = ১২০০০ দিব্যবছর = ১ মহাযুগ সৌর সিদ্ধান্ত অনুসারে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০২ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি বা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ১৪ জানুয়ারিতে মধ্যরাতে কলিযুগের সূচনা হয়। কলিযুগের আয়ুষ্কাল ৪,৩২,০০০ বছর। কলিযুগের প্রায় ৫১১৮ বছর ইতোমধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে। তাই বর্তমানে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে বৈবস্বত মম্বন্তরে ২৮ তম কলিযুগের এখনো প্রায় ৪,২৬,৮৮২ বছর বাকি আছে। অর্থাৎ শাস্ত্রে বর্ণিত কল্কি অবতারের আবির্ভাবের সময় এখনো উপস্থিত হয়নি। তাই তাঁর আগমনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
কলিযুগের অন্তর্গত ১০,০০০ বছর সমন্বিত স্বর্ণযুগ সমাপ্ত হওয়ার প্রাক্কালে জড়া প্রকৃতির নিকৃষ্ট গুণগুলো এত শক্তিশালী হয়ে উঠবে যে, এর ফলশ্রুতিতে মানুষ পারমার্থিক কার্য সম্পাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। তখন সকলেই ভগবদ্বিমুখ হয়ে পড়বে। তখন যেসকল সাধু মহাত্মাগণ পৃথিবীতে অবস্থান করবেন, তারা বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তথা গুণাবলিতে সাধারণ লোকদের চেয়ে ভিন্ন হবেন। তখন তাদের নিয়ে ঠাট্রা বা বিদ্রুপ করা হবে এবং শহরে যেভাবে খেলার জন্য পশু শিকার হয়, ঠিক সেভাবে তাদের শিকার করা হবে। তখন তারা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য গুহা বা পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় নিবে অথবা তাদের পার্থিব অস্তিত্ব থেকে নিবৃত্ত হবে। এমনকি তারা একসময় পুণ্যভূমি ভারতবর্ষ ত্যাগ করবে।
আরও পড়ুনঃ জড়বন্ধন থেকে মুক্তির উপায়-নৈতিক শিক্ষামূলক গল্প
কল্কিপুরাণে বিষ্ণুযশ বলছেন, “সাধুদের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ এবং ধর্মীয় নীতিসমূহের বিনাশসাধনকারী কলির দ্বারা তাড়িত হয়ে বর্তমানে ধার্মিক ব্রাহ্মণগণ ভরতবর্ষের শেষে তথাকথিত সাধু এবং উচ্চতর তিন বর্ণের সম্ভ্রান্ত বর্ণের গৃহেও ভগবানের কথা আলোচনা হবে না এবং যখন রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত শূদ্র অথবা তার থেকেও নিকৃষ্ট স্তরের মানুষের হাতে ন্যাস্ত হবে এবং যখন স্বাহা, স্বাধা, ষবট ইত্যাদি বৈদিক মন্ত্র আর শোনা যাবে না, তখন ভগবান পরম দন্ডদাতারূপে আবির্ভূত হবেন।”-
শ্রীমদ্ভাগবত (২.৭.৩৮) এভাবে ভগবদ্ভক্তিতে উন্নত প্রকৃত সাধুগণ পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। ঠিক তখনি কলিযুগের তমসাচ্ছন্ন প্রভাব বিস্তার লাভ করবে। কালক্রমে পরিস্তিতি এতই ভয়ানক হবে যে, এ পৃথিবী তখন একটা নরকে পরিণত হবে, যেখানে মানুষ কেবল দুঃখ পাওয়ার জন্যই জন্মগ্রহণ করবে। সরকার এবং পুলিশ উভয়ই দুর্নীতিগ্রস্থ হবে, তাদের কোনো ভালো মন্দ বিচারবোধ থাকবে না। রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের কোনো সুরক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে না। তারা বিভিন্ন অরাজকতর শিকার হবে, কিন্তু তাদের করণীয় কিছু থাকবে না। একে অন্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। পৃথিবীটা তখন একটা যুদ্ধ এবং সংঘাতের ক্ষেত্র হয়ে উঠবে। কিন্তু এখনো ভারতবর্ষ থেকে সাধুরা বিতাড়িত হননি। যদিও ক্রমে ক্রমে কলিযুগের লক্ষণসমূহ প্রকাশিত হচ্ছে,
বিষ্ণুপুরাণে বর্ণিত কালের বর্ণনা অনুসারে এখনো সেই যুগসন্ধিক্ষণ আসেনিঃ
২ অয়ন (১অয়ন=৬ মাস) = ১ বছর বা দেবলোকের ১দিন, দেবলোকের ১ বছর = ভূলোকের প্রায় ৩৬০ বছর। ৪০০০+৪০০ সন্ধা + ৪০০ সন্ধ্যাংশ = ৪৮০০ দিব্য বছর х ৩৬০ বছর= ১২,৯৬,০০০ বছর = ত্রেতা যুগ।
২০০০+২০০ সন্ধা + ২০০ সন্ধ্যাংশ = ২৪০০ দিব্য বছর х ৩৬০ বছর = ৮,৬৪,০০ বছর = দ্বাপরযুগ ।
১০০০+২০০ সন্ধা + ১০০ সন্ধ্যাংশ = ১২০০ দিব্যবছর х ৩৬০ বছর = ৪,৩২,০০০ বছর= কলিযুগ।
৪ যুগ = ১২০০০ দিব্যবছর = ১ মহাযুগ সৌর সিদ্ধান্ত অনুসারে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০২ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি বা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ১৪ জানুয়ারিতে মধ্যরাতে কলিযুগের সূচনা হয়। কলিযুগের আয়ুষ্কাল ৪,৩২,০০০ বছর। কলিযুগের প্রায় ৫১১৮ বছর ইতোমধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে। তাই বর্তমানে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে বৈবস্বত মম্বন্তরে ২৮ তম কলিযুগের এখনো প্রায় ৪,২৬,৮৮২ বছর বাকি আছে। অর্থাৎ শাস্ত্রে বর্ণিত কল্কি অবতারের আবির্ভাবের সময় এখনো উপস্থিত হয়নি। তাই তাঁর আগমনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
কল্কি অবতার আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট
কলিযুগের অন্তর্গত ১০,০০০ বছর সমন্বিত স্বর্ণযুগ সমাপ্ত হওয়ার প্রাক্কালে জড়া প্রকৃতির নিকৃষ্ট গুণগুলো এত শক্তিশালী হয়ে উঠবে যে, এর ফলশ্রুতিতে মানুষ পারমার্থিক কার্য সম্পাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। তখন সকলেই ভগবদ্বিমুখ হয়ে পড়বে। তখন যেসকল সাধু মহাত্মাগণ পৃথিবীতে অবস্থান করবেন, তারা বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তথা গুণাবলিতে সাধারণ লোকদের চেয়ে ভিন্ন হবেন। তখন তাদের নিয়ে ঠাট্রা বা বিদ্রুপ করা হবে এবং শহরে যেভাবে খেলার জন্য পশু শিকার হয়, ঠিক সেভাবে তাদের শিকার করা হবে। তখন তারা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য গুহা বা পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় নিবে অথবা তাদের পার্থিব অস্তিত্ব থেকে নিবৃত্ত হবে। এমনকি তারা একসময় পুণ্যভূমি ভারতবর্ষ ত্যাগ করবে।
আরও পড়ুনঃ জড়বন্ধন থেকে মুক্তির উপায়-নৈতিক শিক্ষামূলক গল্প
কল্কিপুরাণে বিষ্ণুযশ বলছেন, “সাধুদের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ এবং ধর্মীয় নীতিসমূহের বিনাশসাধনকারী কলির দ্বারা তাড়িত হয়ে বর্তমানে ধার্মিক ব্রাহ্মণগণ ভরতবর্ষের শেষে তথাকথিত সাধু এবং উচ্চতর তিন বর্ণের সম্ভ্রান্ত বর্ণের গৃহেও ভগবানের কথা আলোচনা হবে না এবং যখন রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত শূদ্র অথবা তার থেকেও নিকৃষ্ট স্তরের মানুষের হাতে ন্যাস্ত হবে এবং যখন স্বাহা, স্বাধা, ষবট ইত্যাদি বৈদিক মন্ত্র আর শোনা যাবে না, তখন ভগবান পরম দন্ডদাতারূপে আবির্ভূত হবেন।”-
শ্রীমদ্ভাগবত (২.৭.৩৮) এভাবে ভগবদ্ভক্তিতে উন্নত প্রকৃত সাধুগণ পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। ঠিক তখনি কলিযুগের তমসাচ্ছন্ন প্রভাব বিস্তার লাভ করবে। কালক্রমে পরিস্তিতি এতই ভয়ানক হবে যে, এ পৃথিবী তখন একটা নরকে পরিণত হবে, যেখানে মানুষ কেবল দুঃখ পাওয়ার জন্যই জন্মগ্রহণ করবে। সরকার এবং পুলিশ উভয়ই দুর্নীতিগ্রস্থ হবে, তাদের কোনো ভালো মন্দ বিচারবোধ থাকবে না। রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের কোনো সুরক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে না। তারা বিভিন্ন অরাজকতর শিকার হবে, কিন্তু তাদের করণীয় কিছু থাকবে না। একে অন্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। পৃথিবীটা তখন একটা যুদ্ধ এবং সংঘাতের ক্ষেত্র হয়ে উঠবে। কিন্তু এখনো ভারতবর্ষ থেকে সাধুরা বিতাড়িত হননি। যদিও ক্রমে ক্রমে কলিযুগের লক্ষণসমূহ প্রকাশিত হচ্ছে,
তবুও এখনো সমাজ থেকে ধর্ম সম্পূর্ণরূপে চলে যায়নি। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রবর্তিত সংকীর্তন আন্দোলন আজ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, ষড়গোস্বামী, পূর্বতন আচার্যবর্গের কৃপায় শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের মনোবিলাষ পূর্ণ করার জন্য ইসকন প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য শ্রীল এ.সি. ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ বিশ্বব্যাপী এই সংকীর্তন আন্দোলন ব্যাপক ভাবে বিস্তার করছেন। দিকে দিকে হরিনাম সংকীর্তনের প্রতিধ্বনি ধ্বনিত হচ্ছে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ নির্বিশেষে সকলে একত্রে চৈতন্য মহাপ্রভুর এ সংকীর্তন আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে। শ্রীল প্রভুপাদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে আগামী ১০,০০০ বছর ধরে মহাপ্রভুর এ সংকীর্তন আন্দোলনের বিজয়পতাকা উড্ডীয়মান থাক। এসকল লক্ষণের সাথে কল্কি অবতারের আবির্ভাবকালীন প্রেক্ষাপটের কোনো সামঞ্জস্য নেই। তাই এটা সুস্পষ্ট যে, কল্কি অবতার আবির্ভূত হওয়ার সময় এখনো আসেনি।
আবির্ভাব স্থান ও বংশ পরিচয়
শ্রীমদ্ভাগবতে (১২.২.১৮) বলা হয়েছে- “ভগবান কল্কি সম্ভল গ্রামের মুখ্য ব্রাহ্মণ মহাত্মা বিষ্ণুযশের গৃহে আবির্ভূত হবেন।” মহাভারতের বনপর্বে (১৯০.৯৩-৯৭) কল্কি অবতারের আবির্ভাব প্রসঙ্গে বলা হয়েছে “কালক্রেমে বিষ্ণুযশ নামে এক ব্রাহ্মণের আবির্ভাব হবে। মহাবীর্য ও মহানুভব কল্কি সেই ব্রাহ্মণগৃহে জন্ম পরিগ্রহণ করবেন। তাঁর মননমাত্রেই সমুদয় বাহন, কবচ, বিবিধ আয়ুধ ও ভুরিভুরি যোদ্ধা উপস্থিত হবে। তিনি ধর্ম বিজয়ী সম্রাট হয়ে পর্যায়কুল লোক সকলের প্রতি প্রসন্ন হবেন। ক্ষয়কারী ও যুগপরিবর্তক সেই দীপ্তপুরুষ উত্থিত ও ব্রাহ্মণগণ পরিবৃত হয়ে সর্বত্রগত ম্লেচ্ছগণকে উৎসারিত করবেন।”
অগ্নিপুরাণ (১৬.৭-৯)-এ বর্ণনা করা হয়েছে, “যখন অনার্যরা রাজ্যপদ অধিকার করে নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের শোষণ করতে শুরু করবে, তখন ভগবান কল্কি বিষ্ণুযশের পুত্র এবং যাজ্ঞ্যবল্কের শিষ্য হিসেবে সেসকল অনার্যদের তাঁর অস্ত্র দ্বারা বিনাশ করবেন। তিনি চার বর্ণ ও আশ্রম সমন্বিত নীতি প্রতিষ্ঠা করবেন। তারপর আবার জনগণ সত্য ও ন্যায়ের পথে ফিরে আসবে।” পদ্মপুরাণে (৬.৭১.২৭৩-৩৮৩) বর্ণনা করা হয়েছে- “ভগবান কল্কি ম্লেচ্ছদের বিনাশ করে সকল দুরাবস্থা অপসারণ করে কলিযুগের অবসান ঘটাবেন। তিনি সকল ব্রাহ্মণদের একত্রিত করে পরম সত্য প্রতিস্থাপন করবেন।
তিনি ধ্বংসপ্রাপ্ত সকল প্রকার জীবনধারা সম্বন্ধে অবগত থাকবেন এবং ব্রাহ্মণ তথা ধার্মিক ব্যক্তিদের ক্ষুধা অপসারণ করবেন। তিনি হবেন জগতের একমাত্র নিয়ন্ত্রক। তাঁকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না এবং তিনিই হবেন বিশ্বের বিজয়পতাকা।” এই ভবিষ্যদ্বাণীটি ব্যাখ্যা করতে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে (প্রকৃতি খন্ড ৭.৬০,৫৮-৫৯) কলিযুগ এবং কল্কি অবতারের উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে- “তখন পৃথিবীতে অরাজকতা বিরাজ করবে। সর্বত্র অযাচিত কার্যসকল-যেমন, চৌর্যবৃত্তি ও লুটতরাজ বৃদ্ধি পাবে। সেসময় বিষ্ণুযশ নামে এক ব্রাহ্মণের পরিবারে ভগবান নারায়ণ আবির্ভূত হবেন।
তিনি এক সুবৃহৎ অশ্বে সওয়ার হয়ে হাতে তরবারি ধারণপূর্বক পৃথিবীতে ম্লেচ্ছদের বিনাশ করবেন। এভাবে পৃথিবী ম্লেচ্ছদের থেকে মুক্ত হবে।” এই শ্লোকে আমরা দেখতে পাই ভগবান কল্কি একজন যোদ্ধারূপে আবির্ভূত হবেন। কালক্রমে পৃথিবী যৌক্তিক জ্ঞানে অসমর্থ ব্যক্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। তরা হবে অনুন্নত মেধা ও বুদ্ধিসম্পন্ন, পারমার্থিক জ্ঞান ও জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অজ্ঞ। তাদের কী করা উচিত, সে সম্বন্ধে তারা অজ্ঞ থাকবে না। তাই ভগবান কল্কি অবতাররূপে শিক্ষা দেয়ার জন্য নয় বরং ধ্বংস করার জন্য আবির্ভূত হবেন।
আরেকটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ যে, কোন বংশে এবং কোথায় কল্কি অবতার আবির্ভূত হবেন, তারও বর্ণনা পাওয়া যায়। তাঁর পরিবার হবে বিদ্ধান ব্রাহ্মণ। তার অর্থ হলো যত খারাপ কিছুই হোক না কেন, তথনো পৃথিবীতে ব্রাহ্মণ বর্তমান থাকবে। পদ্মপুরাণে (৬.২৪২.৮-১২) বর্ণনা করা হয়েছে- “কলিযুগ শেষ হবার প্রাক্কালে ভগবান কল্কি সম্ভল গ্রামে এক ব্রহ্মণের গৃহে আবির্ভূত হবেন।
বর্ণিত আছে, স্বায়ম্ভুব মনু গোমতী নদীর তীরে নৈমিষায় ভগবান বিষ্ণুকে তিনি জন্মে তাঁর পুত্ররূপে পাবার জন্য কঠোর তপস্যা করেছিলেন। তাঁর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে ভগবান তাঁকে তিন জন্ম রাম, কৃষ্ণ এবং কল্কির পিতা হবার বর দান করেন। এভাবে স্বায়ম্ভুব মনু দশরথ, বসুদেব এবং বিষ্ণুযশ রূপে আবির্ভূত হন।” কল্কি পুরাণে(২.১) ব্রহ্মার আদেশে দেবগণ তাঁর সম্মুখে উপবেশনপূর্বক কলির দোষে ধর্মহানির কথা নিবেদন করলেন। ব্রহ্মা দেবগণের আদেশ শ্রবণ করে বললেন, “চল আমরা বিষ্ণু সমীপে গমনপূর্বক অভীষ্ট সাধনের জন্য তাঁকে প্রসন্ন করি।’
অতঃপর দেবগণসহ ব্রহ্মা গোলোকে উপস্থিত হলেন ও শ্রীহরির স্তব-স্তুতিপূর্বক ব্রহ্মা দেবগণের অভিপ্রায় এবং প্রার্থনার কথা নিবেদন করলেন। পদ্ধপলাশলোচন হরি তৎসমুদয় শ্রবণান্তে ব্রহ্মাকে বললেন, হে ব্রাহ্মণ। আমি অনুরোধ নিমিত্ত ধরাতলে সম্ভল নামক স্থানে বিষ্ণুযশ নামক বিপ্রের গৃহে তা পত্নী সুমতির গর্ভে জন্মগ্রহণ করব। হে দেববৃন্দ, স্বর্গবাসীদের কল্যাণার্থে তোমরা নিজ নিজ অংশে জন্মগ্রহণ পূর্বক আমার সাথে সৌহার্দ্য স্থাপন করবে। আমার প্রিয়া লক্ষীদেবীও সিংহলরাজ বৃহদ্রথের পত্নী কৌমুদীর গর্ভে পদ্মা নাম ধারণপূর্বক জন্মগ্রহণ করবে।” “হে দেবগণ, তোমরা শীঘ্র নিজ নিজ অংশে মর্ত্যধামে গমন কর। আমি পুনর্বার মরু ও দেবাপি নামক নৃপদ্বয়কে পৃথিবীর শাসনভার অর্পণ করব। পুনরায় আমি সত্যযুগের সৃষ্টি করতঃ পূর্বের ন্যায় ধর্ম সংস্থাপন করব এবং কলিরূপে দৃষ্ট ভুজঙ্গকে দূর করে বৈকুন্ঠে প্রত্যাবর্তন করব।”
কল্কি অবতারের পিতা ও মাতার নাম এবং তাঁর আবির্ভাব স্থান সম্বন্ধে অনেকে রূপক অর্থ করেন। কিন্তু এখানে রূপক অর্থ করার কোনো সুযোগ নেই। কেননা, শাস্ত্রে যেসকল নাম বা স্থান সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, ঠিক সেই নামেই সেসকল ব্যক্তি বা স্থানসমূহ প্রকাশিত হয়েছে। আবার দুজন ব্যক্তির নামের অর্থ এক হওয়া মানে এই নয় যে, দুজন একই ব্যক্তি। দুজন ব্যক্তির নাম এক হলেও তারা ব্যক্তি হিসেবে ভিন্ন হন।
একজন ব্যক্তির সাথে অন্য কোনো ব্যক্তির অসংখ্য মিল থাকতে পারে। যেমন, ক ও খ দুজন ব্যক্তি। তাদের দুজনেই একই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন। দুজনের পিতাই ডাক্তার। দুজনেই চশমা পরেন। দুজনেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন। এভাবে অসংখ্য মিল আমরা খুঁজে পেতে পারি। আবার একইসাথে তাদের মধ্যে অসংখ্য অমিলও দেখানো সম্ভব। যেমন, তারা এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেও একই বাড়িতে না-ও হতে পারে। আবার দুজনে একই দিনে জন্মগ্রহণ করলেও একই সময়ে না-ও হতে পারে। আবার একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করলেও একই ডিগ্রী না-ও হতে পারে।
এভাবে দু-জনের মধ্যে অসংখ্য অমিলও দেখানো যেতে পার। তাই দুজন ব্যক্তির মধ্যে রূপক বা কাল্পনিক কিছু মিল উত্থাপন করলেই দুজন একই ব্যক্তি হবেন না। চুন এবং দই আপাত এক বলে মনে হলেও দুটির ক্রিয়া সম্পূর্ণ বিপরীত। দুজন ব্যক্তির পরিচয় তখনই এক বলে স্বীকৃত হবে যখন দুজনের মধ্যে কোনো অমিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই যারা রূপক অর্থ কল্পনা করে কল্কি অবতারের সাথে অন্য কোনো ব্যক্তির মিল খোঁজার প্রয়াস করছে, তারা নিঃসন্দেহে মিথ্যাচার করছে। বৈদিক শাস্ত্র মহাসমুদ্রের মতো, কেবল নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য শাস্ত্র থেকে অর্ধকুক্কুটির ন্যায় কিছু অংশ তুলে ধরে মানুষকে বিভ্রান্ত করে তারা অবশ্যই জনসাধরণের সাথে প্রতারণা করছে।
কল্কি অবতারের কার্যাবলী
কল্কি পুরাণে (৩.৯-১০) কল্কিদেবের গুরু পরশুরাম শিক্ষা প্রদানের পর বললেন, “ব্রহ্মার প্রার্থনানুসারে কলির বিনাশ নিমিত্ত সর্বাশ্রয় পূর্ণ হরি সম্ভলে আবির্ভূত হন। তুমিই সেই পূর্ণবিষ্ণু, বর্তমানে তুমি আমার নিকট বিদ্যা, শিবের নিকট অস্ত্র এবং বেদময় গুরুকে প্রাপ্ত হয়ে সিংহলে আপন প্রিয়া পত্মার পাণিগ্রহণপূর্বক নিত্যধর্ম স্থাপন করবে। তুমি দিগ্বিজয়ে বহির্গত হয়ে কুলিপ্রিয় নৃপতিগণকে পরাজিত করবে এবং বৌদ্ধগণকে উন্মুলনপূর্বক দেবপি ও মরু নামক ধর্মপরায়ণদ্বয়কে রাজ্য প্রদান করবে।” ভগবান কল্কি কলির সকল আশ্রয়স্থলসমূহ ধ্বংস করবেন। শ্রীমদ্ভাগবতে (১২/২/১৯-২০) কল্কি অবতারের কার্যবলী বর্ণনা করে বলা হয়েছে- “বিশ্বের অধীশ্বর ভগবান কল্কিদেব তাঁর দেবদত্ত নামক শ্বেত অশ্ব চালিয়ে ও এক হাতে তরবারি নিয়ে তাঁর ভগবত্তার আটটি ঐশ্বরিক শক্তি প্রদর্শনপূর্বক সমগ্র পৃথিবী ভ্রমণ করবেন। তাঁর অসীম জ্যোতি প্রদর্শন করে এবং অত্যন্ত দ্রুতবেগে অশ্ব চালিয়ে তিনি রাজার বেশধারী লক্ষ লক্ষ চোরদের নিধন করবেন।” লিঙ্গ পুরাণ, বায়ু পুরাণ এবং ব্রহ্মান্ড পুরাণের বর্ণনায় দেখা যায় যে, ভগবান কল্কি আবারও অবতীর্ণ হবেন যিনি পূর্বৈ স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে প্রমীতি রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কলিযুগ সমাপ্ত হওয়ার প্রাক্কালে ভৃগুর দেহত্যাগের পর কল্কি (প্রমীতি) মনুর চন্দ্রবংশে আবির্ভূত হবেন। তিনি সমগ্র ব্রহ্মান্ডে অদৃশ্যরূপে বিচরণ করবেন।
আরও পড়ুনঃ শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলা, কৃষ্ণলীলা কাহিনী
তারপর বত্রিশ বছর বয়সে তিনি তার অভিযান আরম্ভ করবেন। তিনি তাঁর সাথে অশ্ব, রথ, হস্তী এবং শুদ্ধ ব্রাহ্মণদের হাতে অস্ত্র সমন্বিত সৈন্যবহর দ্বারা বেষ্টিত থাকবেন। ম্লেচ্ছ রাজা ও দুষ্ট অসুরেরা তাঁর সাথে যুদ্ধ করতে এললেও তিনি সব পাষন্ডদের হত্যা করবেন। কেউ তাঁকে থামাতে পারবে না। পরিশেষে তিনি গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী স্থানে তাঁর মন্ত্রী এবং অনুগামীদের নিয়ে বিশ্রাম করবেন। তিনি কেবল কতিপয় ব্যক্তিদের পৃতিবীর বিভিন্ন স্থানে রেখে যাবেন। তারাই হবে পরবর্তী প্রজন্মের বীজস্বরূপ। তারপর যখন ভগবান কল্কি পরবর্তী যুগের মার্গ তৈরি করে যাবেন তা পরবর্তী সত্যযুগের সূচনা করবে এবং কলিযুগের ভয়ানক প্রভাব থেকে সভ্যতাকে রক্ষা করবে। তারপর তিনি তাঁর সৈন্যসামন্তসহ স্বধামে প্রত্যাবর্তন করবেন। (লিঙ্গ পুরাণ ৪০.৫০-৯২), ব্রহ্মান্ড পুরাণ ১.২.৩১.৭৬-১০৬, ২.৩.৭৩.১০৪-১২৬ এবং বায়ু পুরাণ ৫৮.৭৫-১১০) কল্কি অবতার যেভাবে সমগ্র পৃথিবীতে অত্যাচারীদের বিনাশ করবেন এবং শ্বেত অশ্ব নিয়ে সৈন্যবহরসহ পৃথিবী পরিভ্রমণ করবেন এবং সমস্ত পৃথিবী থেকে অদর্মীদের বিনাশ করবেন, এমন ব্যক্তি এখনও পৃথিবীতে দৃশ্যমান হয়নি।
সত্যযুগের পুনরাগমন
মহাভারতের বণপর্বে (১০১.১-৬) ভগবান কল্কিদেবের কার্যাবলীর কথা বর্ণনা করে বলা হয়েছে- মার্কন্ডেয় ঋষি বলেছেন-“মহারাজ, তারপর ভগবান কল্কি চৈৗরক্ষয় করে মহাযজ্ঞ অশ্বমেধ সমুদয় মেদিনীমন্ডল ব্রাহ্মণহস্তে সমর্পণ ও লোকমধ্যে বিধাতৃবিহিত মর্যাদা সংস্থাপনপূর্বক পরমরমণীয় কাননে প্রবেশ করবেন। ভূলোকবাসী মনুষ্যগণ সেই নিয়মানুসারেই কার্য করবে; সত্যযুগে ব্রাহ্মণগণের প্রভাবে অনায়াসে চৌরক্ষয় হবে। দ্বিজোত্তম কল্কি পরাজিত দেশসমুদয়ে কৃষ্ণাজিন, শক্তি, ত্রিসূল ও অন্যান্য আয়ুধসমুদয় সংস্থাপনপূর্বক ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক সংস্তুয়মান হয়ে দস্যুদল দলনপূর্বক পৃথিবীমন্ডল ভ্রমণ করবেন।
তখন দস্যুগণ দারূণ যাতনায় ‘হা তাত! হা মাতঃ ! হা পুত্র!’ বলে করুণস্বরে ক্রন্দনপূর্বক তার করাল করবালের বলিস্বরূপ হবে। “হে মহারাজ, এইরূপে সত্যযুগ আরম্ভ হলে অধর্মের নাশ, ধর্মের বৃদ্ধি ও মনুষ্যগণ ক্রিয়াবান হয়ে উঠবে। চতুর্দিকে উপবন, চৈত্য, তড়াগ, আবাসস্থল, পুস্করিণী ও দেবতাস্থান-সমুদয় নির্মাণ এবং বিবিধ যজ্ঞ ক্রিয়ানুষ্ঠান হবে। সর্বদাই ব্রাহ্মণ, সাধু ও তপস্বীগণ দৃষ্ট হবে। পূর্বে যে সমুদয় আশ্রমে সবই সত্যপরায়ণ জনগণে পরিপূর্ণ হবে।
চিরবদ্ধমূল কুসংস্কার সমুদয় প্রজাহণের হৃদয়ক্ষেত্র হতে দূরীভূত হবে। মনুষ্যগণ দান, ব্রত ও নিয়মে নিরত হবে। বিপ্রগণ জপযজ্ঞ পরায়ণ, ষটকর্মনিরত, ধর্মাভিলাষী ও সতত সন্তুষ্টচিত্ত হবেন, ক্ষত্রিয়গণ বিক্রমে রত হবে, ভূপতিগণ ধর্মসহকারে পৃথিবী পালন করবেন, বৈশ্যগণ ব্যবহারনিরত এবং শূদ্রগণ উক্ত বনত্রিয়ের শুশ্রুষাপরায়ণ হবে। (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, প্রকৃতি খন্ড, অধ্যায় ৭.৬৩-৬৮, মহাভারত, বনপর্ব, অধ্যায় ১৯১.৭-১৭) কিষ্ণু পুরাণে (অধ্যায়-২৪) বর্ণনা করা হয়েছে-
“তাঁর দুর্দমনীয় প্রতাপের দ্বারা তিনি সকল ম্লেচ্ছ ও পাপকার্যে প্রবৃত্তদের সংহার করবেন এবং পুনরায় পৃথিবীতে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন। যেসকল মানুষ কলিযুগের শেষেও বর্তমান থাকবে তারা জাগরিত হবে এবং তারা স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ হবে। যারা এ যুগ পরিবর্তনকালে তাদের গুণের প্রভাবে টিকে থাকবে, তারাই হবে ভবিষ্যতের বীজস্বরূপ। তারা এমন এক জাতির জন্ম দেবে যারা পূর্ণরূপে সত্যযুগের বিধিনিষেধসমূহ অনুশীলন করবে। যখন চন্দ্র, সূর্য, পূষ্যনক্ষত্র এবং বৃহস্পতি একরাশিতে, তখন পুনরায় সত্যযুগের সূচনা হবে। অগ্নি পুরাণে (১৬/১০) বর্ণনা করা হয়েছে- “ভগবান হরি কল্কিরূপ ত্যাগ করে বৈকুন্ঠে গমন করবেন। তখন পুনরায় সত্যযুগের সূচনা হবে।”
সন্তুষ্ট হলাম, ধন্যবাদ।