শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলা, কৃষ্ণ লীলা কথা -শ্রীমদ্ভাগবত - শ্রীমদ্ভগবদ গীতা যথাযথ বাংলা

নতুন পোষ্ট

Add

শুক্রবার, ১ মে, ২০২০

শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলা, কৃষ্ণ লীলা কথা -শ্রীমদ্ভাগবত


শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলা, কৃষ্ণ লীলা কথা -শ্রীমদ্ভাগবত

শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলা


ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন  যে তাঁর জন্ম, কর্ম ইত্যাদি সবই দিব্য, এবং কেউ যখন তত্ত্বগতভাবে তা জানতে পারে, তখন তিনি ভগবদ্ধামে প্রবেশ করবার যোগ্যতা অর্জন করেন। 
 
ভগবানের জন্ম একজন সাধারণ মানুষের মতো নয়। সাধারণ মানুষের জন্ম হয় কর্মফলের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে। কর্মের ফলস্বরূপ সে এক দেহ থেকে অন্য আরেক দেহে দেহান্তরিত হয়। ভগবানের জন্মের কথা বিশ্লেষণ করে ভগবদগীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে, তিনি তাঁর নিজের ইচ্ছার প্রভাবে আবির্ভূত হন। 

গ্রহ নক্ষত্রের শুভ স্থানে অবস্থান

যখন ভগবানের আবির্ভাবের সময় হল, তখন কাল সর্বগুণ সমন্বিত হয়ে পরম সুন্দর হয়ে উঠল। তখন পৃথিবী আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। তিথি, যোগ এবং নক্ষত্র তখন সর্বমঙ্গলময় এবং সর্বসুলক্ষণ যুক্ত হয়ে উঠল। সর্বসুলক্ষণযুক্তা রোহিণী নক্ষত্র তখন তুঙ্গে প্রকাশিত হল। 
 
 
ব্রহ্মা স্বয়ং এই রোহিণী নক্ষত্রের পর্যবেক্ষণ করেন। জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে, নক্ষত্রের অবস্থান ছাড়াও বিভিন্ন গ্রহের অবস্থান ও প্রভাবের ফলে শুভ এবং অশুভ তিথি ও যোগ বিচার করা হয়। শ্রীকৃষ্ণের জন্মের সময় সমস্ত গ্রহগুলি সব সময় মঙ্গলময় অবস্থা এবং সব সময় শুভ ইঙ্গিত প্রদর্শন করে বিরাজ করতে লাগল। 

তখন দশদিক শান্তি ও সমৃদ্ধিতে ভরে উঠল। শুভ নক্ষত্রগুলি নভোমন্ডলে শোভা পেতে লাগল। নগর, গ্রাম, গোচারণভূমি এবং সকলের হৃদয়ে সব রকমের শুভ ইঙ্গিত দেখা যেতে লাগল। জলে পূর্ণ হয়ে নদনদী প্রবাহিত হতে লাগল, সরোবরগুলি বিকশিত পদ্মে পূর্ণ হয়ে শোভা পেতে লাগল। 
 
বনভূমি নানা রকম সুন্দর সুন্দর পাখি ও ময়ুরপূর্ণ হয়ে উঠল। পাখিরা সুমধুর স্বরে গান গাইতে লাগল এবং সেই গানের ছন্দে ময়ুরেরা ময়ুরীদের সঙ্গে নাচতে শুরু করল। সুমধুর গন্ধ বহন করে বায়ু বইতে লাগল এবং শরীরের স্পর্শানুভূতি অত্যন্ত সুখকর বলে বোধ হতে লাগল। 

ব্রাহ্মণেরা অনুভব করল যে, তাদের গৃহের পরিবেশ যজ্ঞানুষ্ঠানের অনুকুল হয়ে উঠেছে। আসুরিক রাজাদের অত্যাচারে যজ্ঞ অনুষ্ঠান তথন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, যজ্ঞের  আগুন প্রায় নিভে গিয়েছিল, কিন্তু এখন তারা আবার প্রশান্ত চিত্তে আগুন জ্বালাতে সক্ষম হল। 
 
যজ্ঞ অনুষ্ঠান করা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে ব্রাহ্মণেরা অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের সময় তাদের চিত্ত প্রসন্ন হয়ে উঠল, কেননা তারা নভোমন্ডলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবসূচক দিব্য শব্দতরঙ্গ শুনতে পেল। 

গন্ধর্ব এবং কিন্নরেরা সুমধুর সুরে গান গাইতে লাগল এবং সিদ্ধ ও চারণেরা ভগবানের গুণকীর্তন করে তাঁর স্তব করতে লাগল। স্বর্গলোকে দেবতারা তাঁদের সহচরী এবং অস্পরাদের সঙ্গে সুললিত ছন্দে নৃত্য করতে লাগলেন। দেবতারা এবং মুনিঋষিরা পুষ্পবর্ষণ করতে লাগলেন। সমুদ্রের উপকূলে তরঙ্গের মৃদু মৃদু শব্দ হতে লাগল এবং সমুদ্রের উপরে সুমধুর মেঘগর্জন হতে লাগল। 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চতুর্ভুজ রূপে আবির্ভাব

তখন ভগবান বিষ্ণু, যিনি সকলের হৃদয়ে বিরাজ করেন, তিনি রাতের গভীর অন্ধকারে পরমেশ্বর ভগবানরূপে দেবকীর সম্মুকে আবির্ভূত হলেন। পূর্ণচন্দ্র যেভাবে পূর্বদিগন্তে উদিত হয়, ঠিক তেমন ভাবেই পরমেশ্বর ভগবান আবির্ভূত হলেন। 
 
কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, অষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়েছিল তা হলে পূর্ণচন্দ্রের উদয় হল কি করে? এর অর্থ উত্তরে বলা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণ চন্দ্রবংশে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাই চন্দ্র সেই রাত্রে অপূর্ণ থাকলেও সেই বংশে ভগবানের আবির্ভাবের জন্য আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে সেদিন পূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। 

খমাণিক্য নামক জ্যোতিষ শাস্ত্রগ্রন্থে ভগবানের আবির্ভাব সময়কালীন গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান খুব সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে প্রমাণ করা হয়েছে যে, এই শুভ মুহূর্তে যে শিশুটির জন্ম হল, তিনি হচ্ছেন পরম-ব্রহ্ম। 
krishna

বসুদেব দেখলেন যে, সেই অদ্ভুত শিশুটি চতুর্ভুজ। তিনি তাঁর চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা এবং পদ্ম ধারণ করে আছেন। বক্ষে তাঁর শ্রীবৎস চিহ্ন, কন্ঠে তাঁর কৌস্তভ শোভিত কন্ঠহার, পরনে তাঁর পীতবসন, উজ্জ্বল মেঘের মতো তাঁর গায়ের রঙ, বৈদুর্য মণিভূষিত কিরীট তাঁর মস্তকে শোভা পাচ্ছে, নানা রকম মহামূল্য মণি-রত্ন শোভিত সমস্ত অলঙ্কার তাঁর দিব্য দেহে শোভা পাচ্ছে, তাঁর মাথা ভর্তি কুঞ্চিত কালো কেশরাশি। 
 
এই অদ্ভুত শিশুটিকে দেখে বসুদেব অত্যন্ত আশ্চর্য হলেন। তিনি ভাবলেন কিভাবে একটি নবজাত শিশু এই রকম সমস্ত অলঙ্কারে ভূষিত হল? তাই তিনি বুঝতে পারলেনম যে, শ্রীকৃষ্ণই তাঁর পুত্ররূপে আবির্ভত হয়েছেন। 
 
তিনি তখন অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। বসুদেব তখন ভাবতে লাগলেন, যদিও তিনি একজন সাধারণ মানুষ এবং বাহ্যিক দিক দিয়ে কংসের কারাগারে আবদ্ধ, তবুও পরমেশ্বর ভগবান বিষ্ণু তাঁর স্বরূপ ধারণ করে তাঁর সন্তানরূপে আবির্ভুত হয়েছেন। 

কোনও মনুষ্যশিশু এইভাবে চতুর্ভুজ রূপ নিয়ে অলঙ্কার এবং সব রকম দিব্য সাজে সজ্জিত হয়ে এবং পরমেশ্বর ভগবানের সমস্ত লক্ষণগুলি যুক্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। 
 
বসুদেব বারবার সেই শিশুসন্তানটির দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন এবং ভাবতে লাগলেন কিভাবে তাঁর এই পরম সৌভাগ্যের মুহুর্তটি তিনি উদযাপন করবেন। তিনি ভাবলেন, “সাধারণত যখন পুত্রসন্তানের জন্ম হয়, মানুষ তখন মহোৎসব করে, আর পরমেশ্বর ভগবান আজ আমার গৃহে আমার সন্তানরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। কত মহা আড়ম্বরে আমার এই উৎসব পালন করা উচিত।” 

বসুদেব, যাঁর আরেক নাম আনকদুন্দুভি, যখন তাঁর নবজাত শিশুটির দিকে তাখিয়ে দেখলেন, তখন তাঁর হৃদয়ে আনন্দে এত উৎফুল্ল হয়ে উঠল যে, তিনি তখন নানা অলঙ্কারে ভূষিত হাজার হাজার গাভী ব্রাহ্মণদের দান করতে ইচ্ছা করলেন। 
 
বৈদিক প্রথা অনুসারে যখন ক্ষত্রিয় রাজার প্রসাদে কোন শুভ অনুষ্ঠান হয়, রাজা তখন নানা রকম সম্পদ দান করেন। বিশেষ করে ব্রাহ্মণ এবং মুনি-ঋষিদের তাঁরা স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত গাভী দান করেন। 
 
শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি উদযাপন করতে বসুদেবও দান করতে ইচ্ছা করলেন। কিন্তু যেহেতু তিনি কংসের কারাগারে শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিলেন, তাই তাঁর পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। তাই মনে মনে তিনি ব্রাহ্মণদের হাজার হাজার গাভী দান করলেন। 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে বসুদেবের প্রার্থনা


বসুদেবের মনে আর যখন কোন সংশয় রইল না যে, এই নবজাত শিশুটিই হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, তখন তিনি করজোড়ে প্রণিপাত করে তাঁর বন্দনা করতে শুরু করলেন। বসুদেব তখন চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং তিনি সম্পূর্ণভাবে কংসের ভয় থেকে মুক্ত হলেন। সেই শিশুটির অঙ্গকান্তিতে সেই ঘর উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। 

বসুদেব তখন প্রার্থনা করতে লাগলেন, “হে প্রিয় প্রভু, আমি জানি আপনি কে। আপনিই হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, সমস্ত জীবের পরমাত্মা এবং সত্য। আপনি আপনার নিত্য স্বরূপ নিয়ে আবির্ভুত হয়েছেন, যা আমি এখন সরাসরিভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারছি। 
 
আমি বুঝতে পারছি যে, যেহেতু আমি কংসের ভয়ে ভীত, তাই সেই ভয় থেকে আমাকে উদ্ধার করার জন্য আপনি আবির্ভূত হয়েছেন। আপনি এই প্রকৃতির অতীত; আপনিই হচ্ছেন সেই পরম পুরুষ, যিনি মায়ার প্রতি দৃষ্টিপাত করে এই জড় জগৎকে প্রকাশিত করেন। 

কেউ তর্ক করতে পারে যে, পরমেশ্বর ভগবান, যিনি কেবলমাত্র দৃষ্টিপাত করার মাধ্যমে সমস্ত জড় সৃষ্টিকে প্রকাশিত করেন, তাঁর পক্ষে বসুদেবের পত্মী দেবকীর গর্ভে আবির্ভূত হওয়া কি করে সম্ভব! সেই সন্দেহ দূর করার জন্য বসুদেব বললেন, “হে প্রিয় ভগবান, আপনি যে দেবকীর গর্ভে আবির্ভূত হয়েছেন এটা তেমন কোন আশ্চর্যের বিষয় নয়। কেননা এই জড় সৃষ্টিও অনেকটা সেইভাবেই প্রকাশিত হয়েছে। 
 
 
আপনি মহাবিষ্ণুরূপে কারণসমুদ্রে শয়ন করে আছেন এবং আপনার নিঃশ্বাসের প্রভাবে অনন্ত কোটি ব্রহ্মান্ড প্রকাশিত হচ্ছে। তারপর গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণরূপে আপনি প্রতিটি ব্রহ্মান্ডে প্রবিষ্ট হয়েছেন। 
 
তারপর আবার আপনি নিজেকে ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণুরূপে প্রকাশ করে সমস্ত জীবের হৃদয়ে প্রবেশ করছেন, এমন কি প্রতিটি পরমাণুর মধ্যেও আপনি নিজেকে প্রকাশ করছেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। যদিও মনে হচ্ছে যে, আপনি দেবকীর গর্ভে প্রবেশ করছেন, কিন্তু তা হলেও আপনি সর্বব্যাপ্ত। 

জড় দৃষ্টান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আপনার প্রবেশ এবং সর্বব্যাপ্তি উপলব্ধি করতে পারি না। ১৬টি উপাদানে বিভক্ত হওয়ার পরেও জড়া প্রকৃতি অবিকৃতই থেকে যায়। জড় শরীর মাটি, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশ-এই পঞ্চ মহাভূতের সমন্বয় মাত্র। 
 
জড় শরীর দেখলেই মনে হয় যেন এই উপাদানগুলি নতুন সৃষ্টি করা হয়েছে, কিন্তু সেউ উপাদনগুলি দেহের বাইরে সব সময়েই রয়েছে। তেমনই, যদিও আপনি একটি শিশুরূপে দেবকীর গর্ভে আবির্ভূত হয়েছেন, তবুও আপনি বাইরেও বিরাজ করছেন। আপনি সব সময়ই আপনার ধামে বিরাজ করতে পারেন। 

“গভীর বুদ্ধিমত্তা সহকারে আপনার আবির্ভাবের তত্ত্ব উপলব্ধি করতে হয়, কেননা জড়া প্রকৃতিও আপনার থেকেই উদ্ভুত হয়েছে। সূর্য যেমন সূর্যকিরণের উৎস, আপনিও তেমনই জড়া প্রকৃতির আদি উৎস। সুর্যকিরণ কখনও সূর্যমন্ডলকে আচ্ছাদিত করতে পারে না। 
 
ঠিক তেমনই আপনার থেকে উদ্ভুত হওয়ার ফলে জগা প্রকৃতি কখনও আপনাকে আবৃত্ত করতে পারে না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যেন আপনি জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা প্রভাবিত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জড়া প্রকৃতির গুণ কখনই আপনাকে প্রভাবিত করতে পারে না।

গভীর বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন দার্শনিকেরা তা বুঝতে পারেন। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, যদিও মনে হয় যে, আপনি এই জড়া প্রকৃতিতে রয়েছেন, তবুও আপনি কখনও তার দ্বারা আচ্ছাদিত হন না।”

বৈদিক শাস্ত্র থেকে আমরা জানতে পরি যে, পরমব্রক্ষের দেহ-নির্গত রশ্মিচ্ছটার প্রভাবে সব কিছু প্রকাশিত হয়। ব্রহ্মসংহিতা থেকে আমরা জানতে পারি যে, ব্রহ্মজ্যোতি হচ্ছে ভগবানের দেহ-নির্গত রশ্মিচ্ছটা, এবং ব্রহ্মজ্যোতি থেকে সব কিছুর সৃষ্টি হয়। ভগবদগীতাতে আরও বলা হয়েছে যে, পরমেশ্বর ভগবানই হচ্ছেন ব্রহ্মজ্যোতির উৎস। প্রকৃতপক্ষে তিনিই হচ্ছেন সব কিছুর মূল কারণ। কিন্তু অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা মনে করে যে, পরমেশ্বর ভগবান যখন এই জড় জগতে আবির্ভূত হন, তখন তিনি জড় গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন। এই ধরনের সিদ্ধান্ত যারা করে, তারা অত্যন্ত মুর্খ, ভগবান সম্বন্ধে তাদের কোন জ্ঞানই নেই।

পরমেশ্বর ভগবান প্রত্যক্ষভাবে এবং পরোক্ষভাবে সর্বত্রই বিরাজ করেন। তিনি কেবল গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুরূপেই এই জড় সৃষ্টির অন্তরেও বিরাজ করেন তা নয়, তিনি প্রতিটি পরমাণুর মধ্যেও বিরাজ করছেন। তিনি আছেন বলেই সব কিছুর অস্তিত্ব আছে। তাঁকে ছাড়া কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না। বৈদিক শাস্ত্রে আমরা দেখতে পাই যে, পরমাত্মা থেকে স্বতন্ত্র হয়ে কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই। তাই এই জড়া প্রকৃতিও তাঁরই শক্তির প্রকাশ। জড় পদার্থ এবং চিন্ময় আত্মা উভয়েই তাঁর থেকে উদ্ভত হয়েছে। মূর্খ লোকেরাই কেবল মনে করে যে, পরমেশ্বর ভগবান যখন আবির্ভূত হন, তখন তিনি জড়া প্রকৃতির দ্বারা প্রভাবিত হন।

তিনি একটি জড় শরীর গ্রহণ করছেন বলে মনে হলেও তিনি কখনই জড়া প্রকৃতির অধীন হন না। শ্রীকৃষ্ণ তাই আবির্ভূত হয়ে পরমেশ্বর ভগবানের আবির্ভাব এবং অপ্রকট সম্বন্ধীয় সব কটি ভ্রান্ত মতবাদকে পরাস্ত করলেন।

“হে প্রভু, আপনার আবির্ভাব, অবস্থান এবং অপ্রকট লীলা জড় জগতের সব কটি গুণের সমস্ত প্রভাবের অতীত, যেহেতু আপনিই হচ্ছেন সব কিছুর নিয়ন্তা এবং পরমব্রহ্মের আশ্রয়, তাই আপনার পক্ষে অসম্ভব কিছুই নয় এবং কিছুই আপনাতে বিসদৃশ নয়। একজন সরকারী কর্মচারী যেমন রাষ্ট্রপ্রধানের অধীন কাজ করেন, জড়া প্রকৃতিও ঠিক তেমনই আপনার তত্ত্বাবধানে কাজ করেন। তাই আপনার পক্ষে কারো অধীনস্থ হওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না, পরব্রহ্ম এবং সব কিছুই আপনাকে আশ্রয় করে আছে এবং জড়া প্রকৃতির সমস্ত কার্যকলাপ আপনার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

“আপনাকে ‘শুক্লম্’ বলে সম্বোধন করা হয়। ‘শুক্লম্’ বা সাদা হচ্ছেন পরমেশ্বর সত্যস্বরূপ আপনার এক প্রতীক মাত্র। কেননা আপনি জড়জাগতিক গুণের দ্বারা প্রভবিত হন না। ব্রহ্মাকে ‘রক্ত’ বলঅ হয়, কেননা তিনি সৃজনাত্মকরূপে রজোগুণের অধিকারী, আর তমোগুণ শিবের অধীন, কেননা তিনিই সমস্ত সৃষ্টির সংহার করেন। সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয় আপনার দ্বারাই সম্পাদিত হয়, কিন্তু তবুও আপনি সেই সমস্ত গুণের অতীত।” বেদে বিহিত হয়েছে, “হরির্হিনির্গুণসাক্ষাৎ”- পরমেশ্বর ভগবান সর্বদাই জড়জাগতিক গুণের অতীত। সেখানে আরও বলা হয়েছে যে, পরমেশ্বর ভগবানে তমো ও রজোগুণের কোন রকম অস্তিত্ব নেই।

“হে প্রভু! আপনিই হচ্ছেন পরম নিয়ন্তা পরমেশ্বর ভগবান পরম ব্রহ্ম। আপনিই সমস্ত সৃষ্টি পরিচালনা করেন। পরম নিয়ন্তা হওয়া সত্ত্বেও আপনি কৃপা করে আমার গৃহে অবতরণ করেছেন এবং আপনার অবতরণের কারণ হচ্ছে সেই সমস্ত অসুরদের সংহার করা, যারা রাজবেশ ধারণ করে পৃথিবীর  উপর রাজত্ব করছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তরা হচ্ছে অসুর। আপনি যে তাদের এবং তাদের সমস্ত অনুচরদের সংহার করবেন, সেই সম্বন্ধে আমার কোন সন্দেহ নেই।

“আমি জানি যে, বর্বর কংস ও তার দুরাচারী সঙ্গীদের সংহার করবার জন্য আপনি অবতরণ করেছেন। কিন্তু আপনি যে তাকে এবং তার অনুচরদের সংহার করাবার জন্য অবতরণ করবেন, সেই কথা জানতে পেরে কংস আপনার পূর্বজাত বড় ভাইদের হত্যা করেছে। এখন সে কেবল আপনার জন্ম সংবাদের প্রতীক্ষা করছে। যখনই সেই সংবাদ সে পাবে, তখনই সে আপনাকে হত্যার জন্য সশস্ত্র উপস্থিত হবে।”

মাতা দেবকীর শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা

বসুদেবের এই প্রার্থনার পর, শ্রীকৃষ্ণের মাতা দেবকী প্রার্থনা করতে শুরু করলেন। তাঁর ভাই কংসের অত্যাচারে তিনি অত্যন্ত ভীতা ছিলেন। দেবকী বললেন , “প্রিয় প্রভু! নারায়ণ, রাম, শেষ, বরাহ, নৃসিংহ, বামন; বলদেব এবং এই রকম কোটি কোটি অবতারের বর্ণনা বৈদিক শাস্ত্রে রয়েছে। আপনিই হচ্ছে আদি পুরুষ, কেননা আপনার সমস্ত অবতারেরাই এই জড় জগতের অতীত। এই সৃষ্টির পূর্বেও আপনি ছিলেন। আপনার রূপ নিত্য এবং সর্বব্যাপ্ত। তা জ্যোতির্ময়, অপরিবর্তনশীল এবং জড় গুণের থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আপনার এই সমস্ত নিত্য স্বরূপ চিন্ময় এবং আনন্দময়। তারা সকলেই শুদ্ধসত্ত্বে অধিষ্ঠিত এবং সর্বদাই বিভিন্ন লীলায় রত। কোনও বিশেষ রূপের দ্বারা আপনি সীমিত নন। এই সব ক’টি নিত্য ও দিব্যরূপই স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমি জানি যে, আপনিই হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান শ্রীবিষ্ণু।

“কোটি কোটি বছরের পর, যখন ব্রহ্মার জীবনের অন্তিম সময় আসে, তখন প্রলয় হয়। সেই সময় ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু এবং আকাশ এই পঞ্চ মহাভূত মহত্তত্ত্বে লীন হয়ে যায়। কালের প্রভাবে তারপর মহত্তত্ত্ব অব্যক্ত প্রকৃতিতে প্রবেশ করে। প্রকৃতি প্রধানে প্রবেশ করে এবং প্রধান আপনাতে প্রবিষ্ট হয়। তাই প্রলয়ের পর কেবল আপনিই আপনার দিব্য নাম, রূপ, গুণ এবং পরিকরসহ বর্তমান থাকেন।

“হে প্রভু, শ্রদ্ধাবনত চিত্তে আমি আপনাকে প্রণতি জানাই। কেননা আপনিই জচ্ছেন অব্যক্ত প্রকৃতির পরিচালক এবং জড়া প্রকৃতির পরম আশ্রয়। হে প্রভু! নিখিল সৃষ্টি এক পলক থেকে শুরু করে কল্প পর্যন্ত আপনারই কালের অধীন। সকলেই আপনার পরিচালনায় কর্ম করে। আপনি পরম নিয়ন্তা এবং সমস্ত শক্তির উৎস।

“হে প্রভু, তাই আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি উগ্রসেনের নিষ্ঠুর পুত্র কংসের হাত থেকে আপনি আমাকে আদ্ধার করুন। আপনার ভক্তকে রক্ষা করার জন্য আপনি সব সময়ই প্রস্তুত, তাই আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি আমাকে আপনি রক্ষা করুন।” ভগবদগীতায় ভগবান অর্জুনের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছেন, ‘ন মে ভক্ত প্রণশ্যতি’- আমার ভক্তের বিনাশ হবে না।

এইভাবে প্রার্থনা করতে করতে মাতা দেবকীর হৃদয় বাৎসল্যরসে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল এবং তিনি বললেন, “আমি জানি যে, মহাত্মারা ধ্যান করে আপনার এই দিব্য স্বরূপ দর্শন করতে পারে, কিন্তু আপনার জন্মের সংবাদ পেয়ে কংস আপনার অনিষ্ট সাধন করবে, এই আশঙ্কায় আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি যে, আপনি আমাদের জড় দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে যান।”

পক্ষান্তরে বলা যায় যে, দেবকী ভগবানকে একজন সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করার অনুরোধ করছিলেন। “আপনার জন্য আমি আমার ভাই কংসের ভয়ে ভীত হচ্ছি। হে মধুসূদন! কংস যদি জানতে পারে যে, আপনি জন্মগ্রহণ করেছেন, তখন সে আপনার অনিষ্ট সাধন করবার জন্য ছুটে আসবে। 
 
তাই আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি বিষ্ণুর চারটি প্রতীকসহ আপনার এই চতুর্ভুজ রূপ সবংবরণ করুন। হে প্রভু! প্রলয়ের পর আপনি সমস্ত ব্রহ্মান্ড আপনার গর্ভে ধারণ করেন। আর সেই আপনিই আপনার অহৈতুকী কৃপার প্রভাবে আমার গর্ভে আবির্ভূত হয়েছেন। আপনি যে আপনার ভক্তকে আনন্দ দান করার জন্য একজন সাধারণ মানুষের মতো লীলাবিলাস করেন, এতে আমি অত্যন্ত আশ্চর্য হয়েছি।”

দেবকী ও বসুদেবের পূর্বজন্ম বৃত্তান্ত


দেবকীর প্রার্থনা শুনে ভগবান বললেন, “হে মাতঃ! স্বায়ম্ভুব মনুর সময় আমার পিতা বসুদেব সুতপা নামে একজন প্রজাপতি ছিলেন আর আপনি ছিলেন তাঁর পত্নী। আপনার নাম ছিল পৃশ্মি। সেই সময় ব্রহ্মা প্রজা বৃদ্ধি করার আকাঙক্ষায় আপনাদের সন্তান উৎপাদন করতে অনুরোধ করেন। 
 
তখন আপনারা আপনাদের ইন্দ্রিয় সংযম করে কঠোর তপস্যা করেছিলেন। প্রাণায়াম করে আপনি এবং আপনার পতি জড়া প্রকৃতির সমস্ত নিয়মগুলি সহন করেছিলেন- বর্ষার বর্ষণ, গ্রীষ্মের তাপ, ঝড়-ঝঞ্ঝা সব আপনারা সহ্য করেছিলেন, তপশ্চর্যা পালন করে আপনারা কেবল গাছের ঝরা পাতা আহার করে জীবন ধারণ করেছিলেন, 
 
তারপর আপনারা ইন্দ্রিয়নিগ্রহ করে একাগ্রচিত্তে আমার আরাধনা করে আমার কাছ থেকে কোনও অদ্ভুত বর প্রার্থনা করেছিলেন। আপনারা দেবতাদের গণনা অনুসারে ১২,০০০ বছর ধরে কঠোর তপস্যা করেছিলেন। সেই সময় আপনাদের চিত্ত কেবল আমাতেই সমাহিত ছিল। 
 
আপনারা যখন ভক্তিযোগ অনুষ্ঠান করছিলেন এবং আপনাদের হৃদয়ে সর্বক্ষণ আমারই ধ্যান করছিলেন, তখন আমি অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছিলাম। হে নিষ্পাপ মাতঃ! আপনার অন্তঃকরণ নির্মল। সেই সময়েও আমি এই রূপ নিয়েই আপনার কাছে আবির্ভূত হয়েছিলাম আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার জন্য। 
 
আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনি কি কামনা করেন?’ সেই সময়ে আপনি বলেছিলেন, আমি যেন আপনার পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করি। যদিও আপনি তখন মুক্তি প্রার্থনা না করে আপনি কেবল আমাকে আপনার পুত্ররূপে কামনা করেছিলেন।”
litle krishna

পক্ষান্তরে বলা যায় যে, পরমেশ্বর ভগবান এই জড় জগতে আবির্ভূত হওয়ার জন্য পৃশ্নি এবং শতপাকে তাঁর পিতা-মাতারূপে মনোনীত করেছিলেন। ভগবান যখনই একজন মনুষ্যরূপে অবতরণ করেন, তখন তিনি তাঁর কোন ভক্তকে তাঁর পিতা-মাতারূপে গ্রহণ করেন। তাই তিনি পৃশ্মি এবং সুতপাকে তাঁর মাতা এবং পিতারূপে গ্রহণ করেছিলেন। 
 
সেই জন্যই পৃশ্মি এবং সুতপা মুক্তি প্রার্থনা করেননি। ভগবানের চিন্ময় সেবার কাছে মুক্তি অত্যন্ত নগণ্য। ভগবান তৎক্ষণাৎ পৃশ্নি এবং সুতপাকে মুক্তি দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তাঁদের এই জড় জগতেই থাকতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, যাতে তাঁরা তাঁর মাতা এবং পিতারূপে তাঁর লীলায় তাঁর সঙ্গলাভ করার আনন্দ উপভোগ করতে পারেন।

ভগবানের কাছ থেকে তাঁর মাতা ও পিতা হওয়ার বর লাভ করে পৃশ্মি এবং সুতপা তাঁদের তপশ্চর্যা সমাপ্ত করে ভগবানকে তাদের পুত্ররূপে লাভ করার জন্য, পতি ও পত্মীরূপে বসবাস করতে লাগলেন।

যথাসময়ে পৃশ্নি গর্ভবতী হলেন এবং একটি পুত্রসন্তান লাভ করলেন। দেবকী এবং বসুদেবকে ভগবান বললেন, “সেই সময় আমার নাম হয়েছিল পৃশ্নিগর্ভ। পরবর্তী যুগে আপনারা অদিতি ও কশ্যপরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং আমি উপেন্দ্র নামে আপনাদের সন্তান হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। সেই সময় আমি বামনরূপ ধারণ করেছিলাম আর সেই জন্য আমার নাম হয়েছিল বামনদেব।

আমি আপনাদের বর দিয়েছিলাম যে, তিনবার আমি আপনাদের সন্তানরূপে জন্মগ্রণ করব। তাই প্রথমে আমি পৃশ্নি এবং সুতপার সন্তান পৃশ্নিগর্ভরূপে, তারপর অদিতি এবং কশ্যপের পুত্র উপেন্দ্ররূপে এবং এখন আপনাদের কৃষ্ণরূপে আমি এসেছি।

আমি এই চতুর্ভুজ রূপ নিয়ে আবির্ভুত হয়েছি, কেবল আপনাদের প্রত্যয় উৎপাদন করবার জন্য যে, আমি পরমেশ্বর ভগবান, আমার প্রতিজ্ঞা অনুসারে আবার আপনাদের পুত্ররূপে আবির্ভূত হয়েছি। আমি  একটি সাধারণ শিশুর মতো রূপ নিয়ে আবির্ভূত হতে পারতাম, 
 
কিন্তু তা হলে আপনারা বিশ্বাস করতেন না যে, আমি পরমেশ্বর ভগবান আপনাদের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছি। হে পিতঃ, হে মাতঃ, আপনারা বহুবার আপনাদের সন্তানরূপে গভীর স্নেহ ও ভালবাসার সঙ্গে লালন-পালন করেছেন, আমি তাই আপনাদের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ এবং আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি যে, এইবার আপনারা চিৎ-জগতে আমার অপ্রাকৃত ধামে ফিরে যাবেন। 
 
কেননা, আপনাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হেয়েছে। আমি জানি যে, আপনারা আমাকে নিয়ে অত্যন্ত শঙ্কিত এবং কংসের ভয়ে ভীত। তাই এখন আমাকে গোকুলে নিয়ে চলুন। সেখানে নন্দ এবং যশোদার একটি কন্যা হন্মগ্রহণ করেছে। আমাকে ওখানে রেখে তাকে এখানে নিয়ে আসুন।”

এইভাবে তাঁর পিতা-মাতার সঙ্গে কথা বলে ভগবান নিজেকে একটি ছোট্র শিশুতে পরিণত করলেন। শ্রীকৃষ্ণ দ্বারা আদিষ্ট হয়ে বসুদেব সুতিকাগার থেকে তাঁর সন্তানটিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। সেই সময় গোকুলে নন্দ এবং যশোদার একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করেছিল। 
 
তিনি ছিলেন ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তি যোগমায়া। যোগমায়ার প্রভাবে কংসের প্রাসাদের প্রতিটি বাসিন্দা বিশেষ করে প্রহরীরা মোহাচ্ছন্ন হয়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন হল এবং কারাগারের সব কটি দরজা আপনা থেকেই খুলে গেল, যদিও সেগুলি খিল দেওয়া ছিল এবং লোহার শিকল দিয়ে বাঁধা ছিল। সেই রাত্রিটি ছিল ঘোর অন্ধকার। কিন্তু যখনই বসুদেব তাঁর শিশুসন্তানটিকে কোলো নিয়ে বাইরে এলেন, তিনি সব কিছু দিনের আলোর মতো দেখতে পেলেন।

চৈতন্য চরিতামৃতে বলা হয়েছে “কৃষ্ণ- সূর্যসম; মায়া হয় অন্ধকার। যাঁহা কৃষ্ণ, তাঁহা নাহি মায়ার অধিকার।।” অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সূর্যের মতো এবং তিনি যেখানে থাকেন সেখানে মায়ার অন্ধকার থাকতে পারে না। 
 
বসুদেব যখন শ্রীকৃষ্ণকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন রাত্রির অন্ধকার বিদুরিত হয়ে গেল। কারাগারে সব ক’টি দ্বার আপনা থেকেই খুলে গেল। আর ঠিক সেই সময় গভীর বজ্রনিনাদের সঙ্গে প্রবল বর্ষণ হতে শুরু করল। 
 
বসুদেব যখন তাঁর শিশুসন্তান শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে সেই বৃষ্টির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন ভগবান শেষ সর্পরূপ ধারণ করে, সেই বর্ষণ থেকে বসুদেবকে রক্ষা করার জন্য বসুদেবের মাথার উপরে তাঁর ফণা বিস্তার করলেন। বসুদেব যমুনার তীরে এসে দেখলেন যে, যমুনার জল প্রচন্ড গর্জন করতে করতে ছুটে চলেছে, তার বিশাল তরঙ্গগুলি ফেনিলোচ্ছল হয়ে উঠেছে। 
 
কিন্তু এই ভয়ঙ্কর রূপ সত্ত্বেও যমুনা্ বসুদেবকে যাওয়ার পথ করে দিলেন, ঠিক যেমন ভারত মহাসাগর রামচন্দ্রের সেতুবন্ধনের সময় তাঁর জন্য পথ করে দিয়েছিলেন। এইভাবে বসুদেব যমুনা পার হয়ে অপর পাড়ে গোকুলে নন্দ মহারাজের গৃহে উপস্থিত হলেন।

সেখানে তিনি দেখলেন যে, সমস্ত গোপ-গোপীরা গভীর নিদ্রায় মগ্ন। সেই সুযোগে তিনি নিঃশব্দে যশোদা মায়ের গৃহে প্রবেশ করে তাঁর পুত্রসন্তানটিকে সেখানে রেখে যশোদার সদ্যোজাত কন্যাকে নিয়ে কংসের কারাগারে ফিরে এলেন এবং নিঃশব্দে দেবকীর কোলে কন্যাটিকে রাখলেন। তিনি নিজেকে আবার শৃঙ্খলাবদ্ধ করলেন যাতে কংস বুঝতে না পারে যে, ইতিমধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে।

মা যশোদার জ্ঞান ছিল যে, তাঁর একটি সন্তান হয়েছে, কিন্তু প্রসব বেদনায় অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে তিনি গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিলেন। তাঁর যখন ঘুম ভাঙল তখন তিনি স্থির করতে পারলেন না যে, তিনি একটি পুত্র না কন্যা প্রসব করেছিলেন।

আরও পড়ুন
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

২টি মন্তব্য: