প্রলম্বাসুর বধ-শ্রীকৃষ্ণ লীলা কাহিনী
প্রলম্বাসুর বধ-শ্রীকৃষ্ণ লীলা কাহিনী
সেই সর্বগ্রাসী দাবানল নির্বাপণ করে কৃষ্ণ তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, গাভী, গােবৎস পরিবৃত হয়ে এবং তাঁদের শ্রীমুখে তার যশােকীর্তন শুনতে শুনতে গাভী পরিপূর্ণ বৃন্দাবনে প্রবেশ করলেন।
কৃষ্ণ এবং বলরাম যখন গােপবালক ও গােপবালিকাদের মাঝে বৃন্দাবনে তাদের অপ্রাকৃত লীলা উপভােগ করছিলেন, তখন গ্রীষ্মের আগমন হল।
ভারতবর্ষে এই গ্রীষ্মকাল তত সুখদায়ক নয়, কেননা সেই সময় প্রচণ্ড গরম পড়ে। কিন্তু বৃন্দাবনে সকলেই অত্যন্ত আনন্দিত ছিলেন, কারণ কৃষ্ণ এবং বলরাম সেখানে থাকার ফলে গ্রীষ্মকে তখন ঠিক বসন্তের মতো সুখদায়ক বলে মনে হয়েছিল।
বৃন্দাবনে অনেক ঝরণা আছে, যেখানে সর্বক্ষণ জল ঝরে পড়ে এবং তার শব্দ এত মধুর যে, তা ঝিল্লির রবকে পর্যন্ত স্তব্ধ করে দেয়। সেখানে সব সময় জল বয়ে যাওয়ার ফলে সেখানকার বনগুলি ঘন সবুজ এবং অত্যন্ত মনােরম।
বৃন্দাবনের অধিবাসীরা কখনই গ্রীষ্মকালীন সূর্যের প্রচণ্ড তাপের দ্বারা উত্ত্যক্ত হন না। বৃন্দাবনের সরােবরগুলির চারপাশে সুন্দর সবুজ ঘাস এবং কলহার, কঞ্জোৎপল আদি ফুল সেখানে ফুটে থাকে, আর বৃন্দাবনের সমীরণ সেই পদ্মফুলের সুরভিত কেশর বহন করে দিকে দিকে প্রবাহিত হয়।
যমুনা, সরােবর এবং ঝরণাগুলির জলকণা যখন ব্রজবাসীদের অঙ্গ স্পর্শ করে, তখন তারা এক স্নিগ্ধ প্রশান্তি অনুভব করেন। তাই গ্রীষ্মে তারা কোন রকম ক্লেশদায়ক তাপ অনুভব করতেন না।
বৃন্দাবনের সৌন্দর্য অতুলনীয়! সেখানে সব সময় ফুল ফুটে থাকে এবং নানা রকম সুন্দর হরিণ সেখানে সব সময় ঘুরে বেড়ায়, পাখিরা কুজন করে, ময়ূরেরা কেকাধ্বনি সহকারে নৃত্য করে, আর ভ্রমরেরা গুন্ গুন্ স্বরে গান গায়। আর কোকিলেরা পঞ্চম সুরে কুহু রবে চারিদিক মুখরিত করে তােলে।
সমস্ত আনন্দের উৎস কৃষ্ণ তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরামের সঙ্গে সমস্ত গােপবালক এবং গাভী পরিবৃত হয়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে বৃন্দাবনের বনে প্রবেশ করলেন।
সেখানে তারা বনফুলের মালা, ময়ূর পুচ্ছ, প্রবাল এবং গৈরিকাদি ধাতুর দ্বারা ভূষিত হয়ে নৃত্য-গীত এবং পরস্পরের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করতে লাগলেন।
কৃষ্ণ যখন নাচতে লাগলেন, তখন কয়েকজন গােপবালক গান গাইতে লাগল, কেউ বাঁশি বাজাতে লাগল, কেউ শিঙ্গা বাজাল আর কেউ হাততালি দিয়ে কৃষ্ণের গুণকীর্তন করে বলতে লাগল, "হে কৃষ্ণ, তুমি সত্যিই খুব সুন্দর নাচতে পার।"
সেই সমস্ত গােপবালকেরা ছিল স্বর্গের দেবতা, শ্রীকৃষ্ণের লীলায় সহযােগিতা করবার জন্য তারা স্বর্গলােক থেকে নেমে এসেছিলেন।
গােপবালকে রূপ পরিগ্রহ করে তারা শ্রীকৃষ্ণের নাচে উৎসাহ দিচ্ছিলেন, ঠিক যেমন একজন শিল্পী অপর শিল্পীকে প্রশংসার দ্বারা অনুপ্রাণিত করেন।
বলরাম এবং কৃষ্ণের তখনও পর্যন্ত চূড়াকরণ সংস্কার হয়নি, তাই তাদের মাথাভর্তি ছিল কোকড়ানাে কালাে চুল। তাঁরা সর্বক্ষণ তাঁদের সখাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতেন অথবা লক্ফ দিতেন অথবা পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করতেন।
কখনও কখনও তাঁর সখারা যখন নৃত্য করত বা গান গাইত কৃষ্ণ তখন তাদের প্রশংসা করে বলতেন, আমার প্রিয়তম বন্ধুরা, তােমরা সত্যিই খুব সুন্দর নাচতে পার এবং গান গাইতে পার।”
তাঁরা বেল এবং আমলকী নিয়ে লােফালুফি করতেন। তারা কানামাছি খেলতেন। কখনও আবার তাঁরা বনের হরিণের এবং বিভিন্ন রকমের পাখির অনুকরণ করতেন। কখনও আবার তাঁরা ব্যাঙের ডাক ডেকে পরস্পরের সঙ্গে ঠাট্টা করতেন এবং গাছের ডালে দোলনা চড়তেন।
কখনও তারা রাজা-প্রজার অভিনয় করতেন। এইভাবে নদ-নদী, সরােবর এবং ফলে-ফুলে শােভিত বৃন্দাবনের বনে শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরাম তাদের সখা-পরিবৃত হয়ে নানা রকম খেলা করে বৃন্দাবনের অপূর্ব সুন্দর পরিবেশ উপভােগ করতেন।
এক সময় তাঁরা যখন তাদের অপ্রাকৃত লীলাবিলাস করছিলেন, তখন প্রলম্বাসুর নামক এক ভয়ঙ্কর অসুর কৃষ্ণ এবং বলরামকে চুরি করে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেখানে প্রবেশ করল।
কৃষ্ণ যদিও একটি গােপবালকরূপে লীলাবিলাস করছিলেন, তবুও তিনি ছিলেন পরমেশ্বর ভগবান এবং অতীত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান সবই তার জানা ছিল।
তাই প্রলম্বাসুর যখন ছদ্মবেশ ধারণ করে শিশুদের দলে প্রবেশ করল তখন কৃষ্ণ ভাবতে লাগলেন কিভাবে তিনি সেই অসুরটিকে হত্যা করবেন। কিন্তু বাইরে তিনি তার সঙ্গে বন্ধুর মতােই আচরণ করতে লাগলেন।
তিনি বললেন, "হে প্রিয় সখা, তুমি যে আমাদের সঙ্গে এই খেলায় যােগ দিতে এসেছ তাতে খুব ভাল হয়েছে।” কৃষ্ণ তখন তার সমস্ত সখাদের ডেকে বললেন, "এখন আমরা দু'দলে ভাগ হয়ে একে অপরের সঙ্গে লড়াই করব।”
তখন সমস্ত বালকেরা সমবেত হয়ে কেউ কৃষ্ণের দলে এবং কেউ বলরামের দলে যােগ দিলেন, এবং একে অপরের সঙ্গে লড়াই করার আয়ােজন করতে লাগলেন। এই লড়াইয়ের শর্ত ছিল, যে পরাজিত হবে তাকে বিজয়ীকে কাঁধে করে নিয়ে ঘােরাতে হবে।
তারা এইভাবে খেলতে শুরু করলেন এবং সেই সঙ্গে গাভীদেরও তত্ত্বাবধান করতে লাগলেন। শ্রীদামা ও বৃষভসহ বলরামের দল জয়ী হল, তাই কৃষ্ণের দলকে তাদের কাঁধে নিয়ে বৃন্দাবনের বনে ঘােরাতে হল।
পরাজিত হয়ে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীদামাকে তার কাঁধে নিয়ে বৃন্দাবনের বনে ঘুরতে লাগলেন। ভদ্রসেন বৃষভকে কাঁধে নিল।
তাদের এই খেলার অনুকরণ করে গােপশিশুর ছদ্মবেশধারী প্রলম্বাসুর বলরামকে তার কাঁধে তুলে নিল। প্রলম্বাসুর ছিল এক মহা শক্তিশালী অসুর এবং সে অনুমান করেছিল যে, সমস্ত গােপবালকদের মধ্যে কৃষ্ণই সব চাইতে বলবান।
কৃষ্ণকে এড়াবার জন্য প্রলম্বাসুর বলরামকে কাঁধে নিয়ে অনেক দূরে চলে গেল। যদিও সেই অসুর ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী ও বলবান, কিন্তু সে বলরামকে কাধে নিয়ে যাচ্ছিল যাকে একটা পর্বতের সঙ্গে তুলনা করা চলে।
তাই অচিরেই সে তার ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল এবং তখন সে তার আসল রূপ পরিগ্রহ করল। সে যখন তার আসল রূপ ধারণ করল, তখন তার মাথায় স্বর্ণমুকুট এবং কানে বিরাট বড় বড় সােনার কুণ্ডল শােভা পেতে লাগল যা দেখে মনে হচ্ছিল বিদ্যুৎ সহ মেঘ যেন চাদকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে।
বলরাম দেখলেন যে সেই অসুরের শরীর বাড়তে বাড়তে মেঘ স্পর্শ করল, তার চোখ দুটি অগ্নিপিণ্ডের মতাে উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং তার মুখ থেকে ধারাল দাঁতগুলি বেরিয়ে এল।
অসুরের এই রূপ দেখে বলরাম প্রথমে একটু আশ্চর্য হয়ে পড়েছিলেন এবং তিনি ভাবতে লাগলেন, "কিভাবে হঠাৎ এই গােপশিশুটি এরকম ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করল?” কিন্তু তার পরেই তিনি বুঝতে পারলেন যে, একটি অসুর তাকে হত্যা করার অভিপ্রায়ে তার বন্ধুদের থেকে তাকে দুরে নিয়ে যাচ্ছে।
তিনি তখন ইন্দ্র যেভাবে পর্বতের উপর ব্রাঘাত করেন, ঠিক সেইভাবে সেই অসুরের মাথায় মুষ্ট্যাঘাত করলেন। বলরামের মুষ্ট্যাঘাতে সেই অসুর একটি ভগ্নমত্তক সর্পের মতাে প্রাণত্যাগ করে ভূতলশায়ী হল এবং তার মুখ দিয়ে রক্ত বেরােতে লাগল।
সেই অসুরের যখন পতন হল, তখন এমন প্রচণ্ড শব্দ হল, যেন মনে হল ইন্দ্রের বজ্রাঘাতে পর্বত বিদীর্ণ হচ্ছে। সমস্ত বালকেরা তখন সেখানে ছুটে এল। সেই বীভৎস দৃশ্য দেখে তারা অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হল এবং বলরামের প্রশংসা করে বলতে লাগল, “সাধু সাধু!” মৃত্যুমুখ থেকে প্রত্যাগত বলে মনে করে তারা সকলে গভীর আবেগের সঙ্গে বলরামকে আলিঙ্গন করলেন এবং তাদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাতে লাগলেন।
স্বর্গে সমস্ত দেবতারা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলরামের অপ্রাকৃত শরীরের উপর পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন এবং ভয়ঙ্কর প্রলম্বাসুরকে বধ করার জন্য তাদের আশীর্বাদ ও অভিনন্দন জানাতে লাগলেন।
আরও পড়ুনঃ