গোবর্ধন পূজা-শ্রীকৃষ্ণ লীলা-শ্রীমদ্ভাগবত কাহিনী
গোবর্ধন পূজা
বৈদিক যজ্ঞ অনুষ্ঠান-পরায়ণ ব্রাহ্মণপত্নীদের কৃপা করার পর, কৃষ্ণ ও বলরাম একদিন দেখলেন যে, গােপেরা দেবরাজ ইন্দ্রের সন্তুষ্টিবিধানের জন্য সেই রকমই এক যজ্ঞের আয়ােজন করছেন।
শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে বলা হয়েছে যে, দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে কৃষ্ণভক্ত জানেন যে, ভক্তিসহকারে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করা হলে আর কোন কিছুই করণীয় থাকে না।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুদ্ধ ভক্তকে কোন রকম বৈদিক শাস্ত্র নির্দেশ অনুসারে কোন আচার-অনুষ্ঠান করতে হয় না। অথবা কোন দেব-দেবীর পূজা করতে হয় না।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত হওয়ার ফলে তিনি সব রকমের বৈদিক আচার-অনুষ্ঠান ইতিমধ্যেই সম্পন্ন করেছেন এবং তার সমস্ত দেব-দেবীর পূজা করা হয়ে গেছে।
বৈদিক শাস্ত্রনির্দেশ অনুসারে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান করে অথবা দেব-দেবীর পূজা করে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিলাভ হয় না, কিন্তু কেউ যখন সম্পূর্ণভাবে শ্রীকৃষ্ণের সেবায় যুক্ত হন, তখন সমস্ত বৈদিক আচার-অনুষ্ঠান আপনা থেকেই সম্পাদিত হয়ে যায়।
শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভক্তদের এই ধরনের সমস্ত কার্যকলাপ বন্ধ করতে আদেশ দিলেন, কেননা তিনি বৃন্দাবনে প্রকটকালে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁর প্রতি অনন্য ভক্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। গােপেরা যে ইন্দ্রযজ্ঞের আয়ােজন করেছিল, তা শ্রীকৃষ্ণ জানতে পেরেছিলেন, কেননা তিনি হচ্ছেন সর্বদ্রষ্টা।
কিন্তু সৌজন্যতার বশে তিনি শ্রদ্ধা সহকারে এবং বিনম্রভাবে মহারাজ নন্দ এবং অন্যান্য বয়স্ক গােপদের জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন যে, কিসের আয়ােজন করা হচ্ছে। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পিতাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
“হে পিতঃ, এটা কোন্ যজ্ঞের আয়ােজন করা হচ্ছে? এই যজ্ঞের ফলে কি হয় এবং কার উদ্দেশ্যে এই যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হবে? কিভাবে এই যজ্ঞ করা হবে? আপনি কি দয়া করে তা আমাকে বলবেন? তা জানতে আমি অত্যন্ত উৎসুক, তাই দয়া করে এই যজ্ঞের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আমাকে বলুন।”
কৃষ্ণ তাকে এইভাবে জিজ্ঞাসা করলে তাঁর পিতা নন্দ মহারাজ চুপ করে রইলেন, কেননা তিনি মনে করলেন যে, তার শিশুপুত্রটি এই যজ্ঞ অনুষ্ঠানের জটিলতা বুঝতে পারবে না।
কৃষ্ণ তখন নাছােড়বান্দার মতাে তাঁকে বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, হে পিতা, যারা উদারচেতা এবং সৎ প্রকৃতির মানুষ, তারা কোন কিছুই গােপন করেন না। তারা সকলের প্রতিই উদারভাবাপন্ন।
আর যারা ততটা উদার নন, তারাও আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবের কাছে কোন কিছু গােপন করেন না, যদিও শত্রুভাবাপন্ন মানুষদের কাছে তারা কোন কিছু গােপন রাখতে পারেন।
তাই আমার কাছে কিছু গােপন করা আপনার উচিত নয়। সমস্ত মানুষই তাদের কর্ম অনুসারে ফল ভােগ করছে। তাদের কেউ তাদের কৃতকর্ম এবং তার ফল সম্বন্ধে অবগত,
আর কেউ তাদের কর্মের উদ্দেশ্য অথবা ফল সম্বন্ধে কিছু না জেনেই কর্ম করে যাচ্ছে। যে মানুষ পূর্ণ জ্ঞান সহকারে কর্ম করেন, তিনি পূর্ণ ফল প্রাপ্ত হন; কিন্তু যারা না জেনে কর্ম করছেন, তারা পূর্ণ ফল ভােগ করতে পারেন না।
তাই দয়া করে আমাকে বলুন আপনারা যে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে চলেছেন তার উদ্দেশ্য কি? তা কি বৈদিক নির্দেশ অনুসারে সম্পাদিত হচ্ছে। না কি, এটা কেবল একটা জনপ্রিয় উৎসব? দয়া করে আমাকে সবিত্তারে এই যজ্ঞ সম্বন্ধে বলুন।"
কৃষ্ণ এইভাবে প্রশ্ন করতে থাকলে নন্দ মহারাজ উত্তর দিলেন, "কৃষ্ণ, এই যে অনুষ্ঠান করা হচ্ছে, তা একটা প্রচলিত প্রথা।
যেহেতু মেঘেরা হচ্ছে ইন্দ্রের প্রতিনিধি, তাই ইন্দ্রের কৃপার ফলেই বৃষ্টি হয় আর আমাদের জীবনধারণের জন্য জল এত প্রয়ােজনীয় যে বৃষ্টির নিয়ন্তা ইন্দ্রের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা কর্তব্য।
তাই আমরা দেবরাজ ইন্দ্রের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য এই যজ্ঞের আয়ােজন করেছি, কেননা তিনি কৃপা করে আমাদের যথেষ্ট বৃষ্টিদান করেন, যার ফলে আমরা ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম হই।
আমাদের জীবনে জল অত্যন্ত প্রয়ােজনীয় জল ছাড়া আমরা কৃষিকার্য করতে পারি না অথবা শস্য উৎপাদন করতে পারি না। যদি বৃষ্টি না হয় তা হলে আমরা জীবনধারণ করতে পারি না।
তাই যথাযথভাবে ধর্ম-অনুষ্ঠান করার জন্য, অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করার জন্য এবং অবশেষে মােক্ষলাভের জন্য জল অপরিহার্য।
তাই চিরাচরিত প্রথায় এই যে অনুষ্ঠান চলে আসছে তা বন্ধ করা উচিত নয়; আমরা যদি কাম, লােভ বা ভয়ের বশবর্তী হয়ে তা বন্ধ করে দিই, তা হলে তা ভাল দেখাবে না।”
সেই কথা শুনে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পিতা এবং বৃন্দাবনের সমস্ত গােপদের এমন কতকগুলাে কথা বললেন, যাতে দেবরাজ ইন্দ্র অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি বললেন, এই যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার কোনও প্রয়ােজন নেই।
ইন্দ্রের প্রীতিসাধনের জন্য এই যজ্ঞ না করার তিনি দুটি কারণ দেখালেন। প্রথম কারণ, যা ভগবদ্গীতাতেও বলা হয়েছে, পার্থিব উন্নতি সাধনের জন্য কোন দেব-দেবীর পূজা করার প্রয়ােজন নেই; দেব-দেবীর পূজা করে যে ফল হয়, তা ক্ষণস্থায়ী, এবং অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন লােকেরাই কেবল এই ধরনের ক্ষণস্থায়ী ফললাভে উৎসাহী।
দ্বিতীয়ত, যে সমস্ত অনিত্য ফল এই সমস্ত দেব-দেবীদের পূজা করে লাভ হয়, তা পরমেশ্বর ভগবানের আদেশ অনুসারেই তারা মঞ্জুর করে থাকেন।
ভগবদগীতায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ময়ৈব বিহিতান্ হি তানদেবতাদের কাছ থেকে যে সমস্ত সুযােগ-সুবিধা লাভ হয়ে থাকে, তা প্রকৃতপক্ষে পরমেশ্বর ভগবানই প্রদান করেন।
পরমেশ্বর ভগবানের আদেশ ছাড়া কেউই কোন কিছু দিতে পারেন না। কিন্তু মাঝে মাঝে জড়া প্রকৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দেবতারা নিজেদের সর্বেসর্বা বলে মনে করে গর্বান্বিত হয়ে পড়েন এবং পরমেশ্বর ভগবানের পরম ঈশ্বরত্নে কথা ভুলে যান।
শ্রীমদ্ভাগবতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, এখানে শ্রীকৃষ্ণ ইচ্ছা করে ইন্দ্রের ক্রোধ উৎপাদন করতে চেয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ এই জগতে অবতরণ করেন অসুরদের বিনাশ করবার জন্য এবং ভক্তদের পরিত্রাণ করবার জন্য।
দেবরাজ ইন্দ্র অবশ্যই অসুর ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভক্ত, কিন্তু তিনি গর্বান্বিত হয়ে পড়েছিলেন বলে শ্রীকৃষ্ণ তাকে একটু শিক্ষা দেওয়ার আয়ােজন করেছিলেন। তিনি প্রথমে বৃন্দাবনের গােপেদের আয়ােজিত ইন্দ্রপূজা বন্ধ করে তাকে খুব রাগিয়ে দিয়েছিলেন।
মনে মনে সেই উদ্দেশ্য নিয়ে কৃষ্ণ গােপেদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতে লাগলেন যেন তিনি কর্মমীমাংসা সমর্থনকারী একজন নাস্তিক।
এই ধরনের দার্শনিকেরা পরমেশ্বর ভগবানের পরম আধিপত্য স্বীকার করে না। তারা যুক্তি প্রদান করে যে, কেউ যখন ভালভাবে কর্ম করে তখন অবশ্যই তারা তার ফল লাভ করে।
তাদের মত হচ্ছে যে, যদি ভগবান বলে কেউ থেকে থাকেন, যিনি মানুষের কর্ম অনুসারে ফল প্রদান করেন, তা হলে তাকে পূজা করার কোন কারণ নেই।
কেননা মানুষ যদি কর্ম না করে তা হলে তিনি কোন শুভ ফল প্রদান করতে পারেন না। তারা বলে, মানুষের কর্তব্য হচ্ছে দেবতা অথবা ভগবানের পূজা না করে নিষ্ঠা সহকারে কর্তব্যকর্ম করা এবং হলে তার শুভ ফল অবশ্যই লাভ হবে।
শ্রীকৃষ্ণ এই দর্শনের তত্ত্ব অনুসারে তার পিতার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। তিনি বললেন, “হে পিতঃ, আপনার কৃষিকার্যের সাফল্যের জন্য কোন দেবতার পূজা করার প্রয়ােজন আছে বলে আমার মনে হয় না। প্রতিটি জীবই তার পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে জন্ম গ্রহণ করে এবং বর্তমান কর্মের ফল নিয়ে এই দেহ ত্যাগ করে।
প্রতিটি জীবই তার পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন শরীর প্রাপ্ত হয় এবং এই জন্মের কর্ম অনুসারে তার পরবর্তী জন্ম লাভ করে।
বিভিন্ন ধরনের জাগতিক সুখ এবং দুঃখ, স্বাচ্ছন্দ্য এবং দুর্দশা, জীবনের অথবা বর্তমান জীবনের বিভিন্ন রকমের কর্মের ,মহারাজ নন্দ এবং অন্যান্য গােপবৃদ্ধরা যুক্তি দেখালেন যে, দেবতাদের সন্তুষ্ট কেবলমাত্র কর্ম করার মাধ্যমে শুভ-ফল লাভ করা যায় না।
প্রকৃতপক্ষে সেই কথাটি ঠিকই যেমন, অনেক সময় দেখা যায় যে, খুব ভাল ডাক্তারের দ্বারা চিকিৎসা করা সত্ত্বেও এবং খুব ভাল ভাল ওষুধ খাওয়ানাে সত্ত্বেও রােগীর মৃত্যু হয়।
এর থেকে বােঝা যায় যে, খুব ভাল ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা এবং ভাল ওষুধ খাওয়ানােটাই রােগমুক্ত হওয়ার কারণ নয়; পরম নিয়ন্তা পরমেশ্বর ভগবানের ইচ্ছাই হচ্ছে মূল কারণ।
তেমনই, সন্তানের প্রতি মা-বাবার যত্ন নেওয়াটাই সন্তানের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কারণ নয়। অনেক সময় দেখা গেছে যে, পিতা-মাতাদের যথেষ্ট তত্ত্বাবধান সন্তানেরা বিপথগামী হয়ে অথবা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে।
তাই জড় কারণগুলিই ফললাভের পক্ষে যথেষ্ট নয়। পরমেশ্বর ভগবানের অনুমােদন না থাকলে কোন কিছুই সফল হয় না। নন্দ মহারাজ তাই সেই নীতি সমর্থন করে বললেন যে,
কৃষিকার্যে সুফল লাভ করতে হলে অবশ্যই বৃষ্টির নিয়ন্ত্রণকারী দেবতা ইন্দ্রকে সন্তুষ্ট করতে হবে। এই যুক্তি খণ্ডন করে শ্রীকৃষ্ণ বললেন যে, দেবতারা মানুষকে তার কর্ম অনুসারে ফল দান করে থাকেন।
কেউ যদি যথাযথভাবে তার কর্তব্যকর্ম না করে, তা হলে দেবতারা তাকে কোন রকম সুফল দান করতে পারেন না; তাই দেবতারা মানুষের কর্তব্যকর্মের অধীন। যে কোন মানুষকে তাদের ইচ্ছামতাে ফলদান করতে দেবতারা পারেন না।
শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “হে পিতঃ, ইন্দ্রদেবতার পূজা করার কোন প্রয়ােজন নেই। প্রত্যেককেই তার কর্ম অনুসারে ফল লাভ করতে হয়।
আমরা দেখতে পাই যে, প্রকৃতপক্ষে সকলেই তাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারে কর্মে লিপ্ত হয়; এবং সেই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারে মানুষই হােক্ দেবতাই হােক্, প্রত্যেকে যথাযথ ফল ভােগ করে থাকেন।
প্রতিটি জীবই উচ্চতর বা নিম্নতর দেহ প্রাপ্ত হয় এবং তাদের বিভিন্ন কর্ম অনুসারে শত্রু, মিত্র বা নিরপেক্ষ ভাব অর্জন করে।
তাই খুব সাবধানতার সঙ্গে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারে কর্তব্যকর্ম করে যাওয়া উচিত এবং বিভিন্ন দেব-দেবীদের পূজা করে চিত্তকে বিক্ষিপ্ত করা উচিত নয়।
যথাযথভাবে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করা হলে দেব-দেবীরা আপনা থেকেই সন্তুষ্ট হবেন। তাই তাদের আলাদা করে পূজা করার কোন প্রয়ােজন নেই।
তাই, আমাদের কর্তব্য হচ্ছে খুব ভালভাবে আমাদের কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করা। প্রকৃতপক্ষে যথাযথভাবে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন না করে কেউই সুখী হতে পারে না, তাই যে যথাযথভাবে তার কর্তব্য করে না, তাকে অসতী স্ত্রীলােকের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
ব্রাহ্মণদের কর্তব্যকর্ম হচ্ছে বেদ পাঠ করা; ক্ষত্রিয়ের কর্তব্যকর্ম হচ্ছে প্রজাপালন করা; বৈশ্যের কর্তব্যকর্ম হচ্ছে কৃষি, গােরক্ষা, বাণিজ্য; এবং শূদ্রের কর্তব্যকর্ম হচ্ছে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যের সেবা করা। আমরা বৈশ্য, তাই আমাদের কর্তব্য হচ্ছে কৃষিকার্য করা অথবা সেই কৃষিজাত দ্রব্য নিয়ে বাণিজ্য করা, গােরক্ষা করা, এবং টাকা ধার দেওয়া।”
কৃষ্ণ বৈশ্য সম্প্রদায়ভুক্ত বলে নিজের পরিচয় দিলেন, কেননা নন্দ মহারাজ গাে-পালন করতেন এবং কৃষ্ণ তাঁদের পরিচর্যা করতেন।
বৈশ্যদের জন্য তিনি চার রকমের বৃত্তি প্রদর্শন করলেন যথা, কৃষি, বাণিজ্য, গােরক্ষা এবং টাকা ধার দেওয়া। যদিও বৈশ্যরা এর যে কোনও একটি বৃত্তি গ্রহণ করতে পারেন, কিন্তু ব্রজবাসীরা গোরক্ষা কার্যেই যুক্ত ছিলেন।
কৃষ্ণ তার পিতাকে আরও বােঝালেন, "এই জড় জগৎ সত্ত্ব, রজ এবং তম, প্রকৃতির এই তিনটি গুণের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এই তিনটি গুণ হচ্ছে সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয়ের কারণ।
রজোগুণের প্রভাবে মেঘ উৎপন্ন হয় তাই কারণ হচ্ছে রজোগুণ। এই বৃষ্টি হওয়ার ফলে মানুষ তার কৃষিকার্যে সাফল্য লাভ করে।
হলে এই ব্যাপারে ইন্দ্রের কি করণীয় আছে? আপনি যদি ইন্দ্রের সন্তুষ্টি বিধান নাও করেন, হলে তিনি কি করতে পারেন? আমরা ইন্দ্রের কাছ থেকে বিশেষ ফল পাচ্ছি না। তিনি যদি বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করতেন, তাহলে হলে সমুদ্রের বুকে কেন বৃষ্টি হয় যেখানে জলের কোন প্রয়ােজন নেই।
সমুদ্রে এবং জমিতে সব জায়গাতেই বৃষ্টি হচ্ছে; তা ইন্দ্রকে পূজা করার উপর নির্ভর করে না। আমাদের অন্য কোন শহর বা গ্রামে বা বিদেশে যাওয়ার কোন প্রয়ােজন নেই।
শহরে অনেক রাজকীয় প্রাসাদ আছে, কিন্তু আমরা এই বৃন্দাবনের বনে বাস করেই সুখী। গােবর্ধন পর্বত এবং বৃন্দাবনের বনের সঙ্গে আমাদের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে।
তাই আমি আপনাদের অনুরােধ করব, আপনারা এমন এক যুজ্ঞ অনুষ্ঠান করুন যাতে স্থানীয় ব্রাহ্মণেরা এবং গােবরধন পর্বত সন্তুষ্ট হন। ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে করণীয় আর আমাদের কিছুই নেই।”
শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনে নন্দ মহারাজ বললেন, "কৃষ্ণ, তুমি যখন বলছ তখন আমি নিশ্চয়ই স্থানীয় ব্রাহ্মণ এবং গােবর্ধন পর্বতের উদ্দেশ্যে আলাদা একটা যজ্ঞের আয়ােজন করব। কিন্তু এখন আমরা ইন্দ্রযজ্ঞ সম্পাদন করি।
কৃষ্ণ বললেন, “হে পিতা, দেরি করার আর প্রয়োজন নেই। গােবর্ধন পর্বত এবং স্থানীয় ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করতে অনেক সময় লাগবে।
তাই ইন্দ্রযজ্ঞের জন্য যে আয়ােজন করা হয়েছে তা দিয়ে এখনই গােবর্ধন পর্বত এবং স্থানীয় ব্রাহ্মণদের সন্তুষ্টিবিধানের জন্য যজ্ঞ করলে ভাল হবে।”
মহারাজ নন্দ অবশেষে রাজী হলেন। গােপেরা তখন কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন কিভাবে তিনি যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে চান, এবং কৃষ্ণ তাঁদের বললেন,
"যজ্ঞের জন্য সংগৃহীত সমস্ত শস্য এবং ঘি দিয়ে খুব ভাল ভাল নানা রকমের খাবার তৈরি করা হােক। পুষ্পান্ন, ডাল, হালুয়া, পকোরা, পুরী, মিষ্টান্ন, রসগােল্লা, সন্দেশ, লাড়ু ইত্যাদি তৈরি করা হােক, এবং সমস্ত বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের নিমন্ত্রণ করা হােক যারা বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণে এবং অগ্নিতে আহুতি প্রদানে সুদক্ষ।
সেই সমস্ত ব্রাহ্মণদের নানা রকম শস্য দান করা হােক। গাভীদের খুব সুন্দর সজ্জায় ভূষিত করা হােক এবং তাদের খুব ভাল করে খাওয়ানাে হােক। তার পর ব্রাহ্মণদের অর্থদান করা হােক।
সমাজের নিম্নস্তরের চণ্ডাল আদি মানুষদের, যাদের সাধারণ লােক অস্পৃশ্য বলে মনে করে, তাদেরও প্রচুর পরিমাণে প্রসাদ দেওয়া হােক। গাভীদের তৃণ প্রদান করে গােবর্ধন পর্বতের পূজা উপহার প্রদান করা হােক। এই পূজা হলে আমি অত্যন্ত তৃপ্ত হব।”
এখানে শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত বৈশ্য সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক ভিত্তি বর্ণনা করেছেন। মানব-সমাজের প্রতিটি সম্প্রদায়ে এবং গাভী, কুকুর, ছাগল ইত্যাদি পণ্ড সম্প্রদায়েও সকলেরই একটা বিশেষ স্থান রয়েছে।
সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে যৌথভাবে সমস্ত সমাজের মঙ্গলসাধনের জন্য কাজ করা। এই কথা কেবল সচেতন প্রাণীদের ক্ষেত্রেই প্রযােজ্য নয়; বন পর্বত আদি অচেতন পদার্থকেও বিবেচনা করে।
ফসল উৎপাদন করে গাে-পালন করে প্রয়ােজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করে, বাণিজ্য করে, এবং ঋণদান করে সমাজের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করার দায়িত্বভার বিশেষ করে বৈশ্য সম্প্রদায়ের উপর অর্পিত হয়েছে।
এর থেকে আমরা এটাও বুঝতে পারি যে, কুকুর, বেড়াল ইত্যাদি পশুদের যদিও খুব একটা প্রয়ােজনীয়তা নেই, তবুও তাদের অবহেলা করা উচিত নয়। তাদের রক্ষা করাও মানুষের কর্তব্য।
তবে অবশ্য কুকুর, বেড়াল রক্ষা করার থেকে গাভীদের রক্ষা করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এবং এখানে আমরা আরেকটা ইঙ্গিত দেখতে পাই যে, চণ্ডাল বা সমাজের যারা অস্পৃশ্য, তাদেরও অবহেলা করা উচিত নয়।
সকলেরই যথাযথ প্রয়ােজনীয়তা আছে, তবে কেউ সরাসরিভাবে মানব-সমাজের উন্নতিসাধনের জন্য যুক্ত, আর কেউ পরােক্ষভাবে যুক্ত। কিন্তু সমাজ যখন কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ওঠে, তখন সকলেই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে বসবাস করতে পারে।
আমাদের কৃষ্ণভাবনাময় সমাজে গােবর্ধন পূজার অনুষ্ঠান করা হয়। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নির্দেশ দিয়ে যে, শ্রীকৃষ্ণ যেমন আরাধ্য, তেমনই তাঁর ধাম বৃন্দাবন এবং গােবর্ধন পর্বতও আরাধ্য।
সেই দিন থেকে এখনও অন্নকূট নামক এই গাের্বধন পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বৃন্দাবনে এবং বৃন্দাবনের বাইরে মন্দিরগুলিতে এই উপলক্ষ্যে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত করা হয় এবং গিরিরাজ গােবর্ধনকে উৎসর্গ করার পর তা জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
মাঝে মাঝে এই প্রসাদ ছুঁড়ে দেওয়া হয় এবং উপস্থিত ভক্তরা মাটি থেকে কুড়িয়ে সেই প্রসাদ উপভােগ করেন।
এর থেকে যায় যে, শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদিত প্রসাদ কখনও দূষিত বা কলুষিত হয় না, এমন কি মাটিতে ছুঁড়ে দিলেও নয়। তাই মানুষ মাটি থেকে তা কুড়িয়ে নিয়ে গভীর তৃপ্তি সহকারে তা সেবন করেন।
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাই বৃন্দাবনের গােপেদের উপদেশ দিলেন ইন্দ্র পূজা বন্ধ করে গােবর্ধন পূজা শুরু করতে, কেননা ইন্দ্র স্বর্গের রাজা হওয়ার ফলে অত্যন্ত গর্বান্বিত হয়ে পড়েছিলেন এবং তাই তিনি তাকে শাসন করতে চেয়েছিলেন।
নন্দ মহারাজের নেতৃত্বে সরলচিত্ত গােপেরা কৃষ্ণের এই প্রস্তাব মেনে নিলেন এবং তারা গিরি গােবর্ধন পূজা করলেন এবং তাকে প্রদক্ষিণ করলেন।
সময়ে বৃন্দাবনবাসীরা এখনও খুব সুন্দরভাবে সজ্জিত হয়ে গােবর্ধন পর্বতের সামনে সমবেত হয়ে গিরিরাজের পূজা করেন এবং তারপর গাভীসহ প্রদক্ষিণ করেন।
শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে নন্দ মহারাজ এবং গােপেরা বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের নিমন্ত্রণ করে এনেছিলেন এবং বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে এবং নানা রকমের ভােগ নিবেদন করে পূজা করেছিলেন। সমস্ত ব্রজবাসীরা তখন সমবেত হয়ে তাদের গাভীদের নানা অলঙ্কারে ভূষিত করে তৃণ দান করেছিলেন।
তারপর গাভীদের সামনে রেখে পর্বত পরিক্রমা করেছিলেন। মূল্যবান রত্ন অলঙ্কারে ভূষিত হয়ে গরুর গাড়িতে বসে শ্রীকৃষ্ণের মহিমা কৃত্তন করেছিলেন। সমবেত মুনিরা গােবর্ধন পূজা করে সমস্ত ব্রজবাসীদের আশীর্বাদ করেছিলেন।
সমস্ত অনুষ্ঠান যথাযথভাবে সম্পন্ন হলে, শ্রীকৃষ্ণ এক বিরাট দিবা ধারণ করে বৃন্দাবনের অধিবাসীদের কাছে ঘােষণা করলেন যে, তিনিই পর্বত, যাতে তার ভক্তদের চিত্তে কোন সংশয় না থাকে যে, গােবর্ধন পর্বত এবং তিনি অভিন্ন।
তারপর কৃষ্ণ সমস্ত নৈবেদ্য ভােজন করতে লাগলেন। কৃষ্ণ এবং পর্বতের অভিজ্ঞতা ভক্তরা শ্রদ্ধা সহকারে এখনও মেনে আসছেন।
আজও কৃষ্ণভক্তরা গােবর্ধন শিলাকে অভিন্ন কৃষ্ণজ্ঞানে মন্দিরে পূজা করে আসছেন। ভক্তরা তাই পর্বত থেকে ক্ষুদ্র শিলা নিয়ে এসে তাদের গৃহে পূজা করেন, কেননা এই পূজা শ্রীকৃষ্ণের শ্রীবিগ্রহের পূজারই মতাে।
যে রূপ পরিগ্রহ করে শ্রীকৃষ্ণ নৈবেদ্য ভােজন করেছিলেন, সেই রূপ ছিল ভিন্ন, এবং কৃষ্ণ নিজে অন্য সমস্ত ব্রজবাসীদের সঙ্গে সেই বিগ্রহকে এবং গােবর্ধন পর্বতকে প্রণাম করতে লাগলেন।
তার সেই বিরাট রূপকে এবং গােবর্ধন পর্বতকে প্রণাম জানিয়ে কৃষ্ণ ঘােষণা করলেন, "দেখ, গােবর্ধন পর্বত কেমন এই বিরাট রূপ ধারণ করেছেন এবং নৈবেদ্য গ্রহণ করে আমাদের কৃপা করছেন।
সেই সভায় কৃষ্ণ আরও ঘােষণা করলেন, “যে এই গোবর্ধন পূজা অবহেলা করবে, যা আমি নিজে অনুষ্ঠান করছি, সে কখনও সুখী হবে না।
এই গােবর্ধন পর্বতে অনেক বিষধর সর্প আছে এবং যারা এই পূজার অবহেলা করবে তারা সেই সর্প দংশনে প্রাণত্যাগ করবে।
তাদের গাভী এবং তাদের নিজেদের সৌভাগ্যের জন্য গোবর্ধন পূজা সম্পাদন করে বৃ্ন্দাবনবাসীরা বসুদেব-তনয় শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ পালন করলেন এবং তারপর তাঁদের গৃহে ফিরে গেলেন।
এইভাবে পূজা সম্পাদন করে বৃন্দাবনবাসীরা বসুদেব- শ্রীকৃষ্ণের পালন করলেন এবং তারপর তাদের গৃহে ফিরে গেলেন।
আরও পড়ুনঃ