অক্রুরের বৃন্দাবনে আগমন-কৃষ্ণ লীলা
অক্রুরের বৃন্দাবনে আগমন
নারদ মুনি শ্রীকৃষ্ণের ব্যোমাসুর বধের কথা যে উল্লেখ করেননি, তার অর্থ কেশী দানবের সঙ্গে একই দিনে সে নিহত হয়েছিল। কেশী দানব খুব সকালবেলা নিহত হয় আর তারপর গােপ-বালকেরা গােবরধন পর্বতে গরু চরাতে যায় এবং সেখানে ব্যামাসুরকে বধ করা হয়। দুটি অসুরকেই সকালবেলা বধ করা হয়।
কংস অক্রুরকে সন্ধ্যার মধ্যেই বৃন্দাবনে উপস্থিত হতে অনুরােধ করে। সেই নির্দেশে অক্রুরও বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে রথে পরের দিন সকালবেলা যাত্রা করে। ভগবানের একজন শ্রেষ্ঠ ভক্ত হওয়ায়, বৃন্দাবনে যাওয়ার পথে অক্রুর শ্রীকৃষ্ণের গুণগান করতে শুরু করল। ভক্ত মাত্রই সব সময় শ্রীকৃষ্ণের চিন্তায় নিমগ্ন থাকেন। তাই অক্রুরও সব সময়ই শ্রীকৃষ্ণের কমল লােচনের কথাই ভাবছিল।
(শ্রীমদ্ভাগবত-শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলা এন্ড্রয়েড অ্যাপ ডাউনলোড করুন)
অক্রুর জানত না কত পুণ্য কর্মের ফলে সে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দর্শনলাভের এই সুযােগ লাভ করেছে। অক্রুর মনে মনে ভাবল শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছা হলেই সে দর্শন পাবে। তাই বড় বড় যােগীরা যাকে দেখতে ইচ্ছা করেন, সেই শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে যাওয়ার জন্য অক্রুর নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান বলে মনে করল।
সে নিশ্চিত ছিল যে, ঐদিন তার বিগত জীবনের সমস্ত পাপ কর্মের অবসান হবে, এবং তার মানব-জীবন সফল হবে। শ্রীকৃষ্ণ আর বলরামকে নিয়ে আসার জন্য কংস অক্রুরকে বৃন্দাবনে প্রেরণ করার ফলে সে ভগবানকে দর্শনে সক্ষম হবে। তাই অক্রুর কংসের দ্বারা নিজেকে অত্যন্ত অনুগৃহীত বলে বিবেচনা করে।
অক্রুর ভাবতে লাগল, পুরাকালে মুনি-ঋষিরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলের উজ্জ্বল নখকণাটুকু দর্শন করেই শুধু জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছিলেন।
অক্রুর মনে করল, একজন সাধারণ মানুষের বেশে সেই লীলা-পুরুষােত্তম স্বয়ং ভগবান আজ এসেছেন এবং এ আমার মহা সৌভাগ্য যে, তাকে মুখােমুখি দেখতে পাব। কুমকুম-রঞ্জিত বক্ষে গােপীরা যে পাদপদ্ম ধারণ করেন, বৃন্দাবনের ভূমিতে যে চরণযুগল বিচরণ করে, দেবাদিদেব শিব, দেবর্ষি নারদ ও ব্রহ্মাদি সকল দেবতারা যার উপাসনা করেন, সেই ভগবানের পাদপদ্ম দর্শনের আশায় অক্রুর উল্লসিত হয়ে উঠল।
অক্রুর আরও ভাবল, আমি এতই ভাগ্যবান যে, আজ আমি ঐ পদারবিন্দ দর্শনে সক্ষম হব। আর তিলক-চিহ্নিত ললাটযুক্ত শ্রীকৃষ্ণের অপূর্ব মুখারবিন্দ আজ নিশ্চয় আমি দর্শন করতে পারব। আমি তার কুঞ্চিত কালাে কেশরাশি ও মধুর হাসি দেখার সুযােগ পাব। কেননা আজ আমি হরিণদের আমার ডান পাশে ঘুরে বেড়াতে দেখতে পাচ্ছি।
আজ আমার পক্ষে পরম ধাম বিষ্ণু-লােকের প্রভা দর্শন করার বাস্তবিক সুযােগ লাভ সম্ভব হবে। কেননা, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন বিষ্ণু, আর তিনি স্বেচ্ছায় এই জগতে অবতরণ করেছেন। তিনি সমস্ত সৌন্দর্যের পরম উৎস। তাই তাকে দেখে আজ আমার চোখ জুড়িয়ে যাবে।
অক্রুরের বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম বিষ্ণু। ভগবান বিষ্ণু জড়া প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং এইভাবে বিশ্ব চরাচরের প্রকাশ হয়। তিনি এই জড় জগতের সৃষ্টিকর্তা হলেও, তার আত্মমায়ার দ্বারা জড়া প্রকৃতির প্রভাব থেকে তিনি সব সময় মুক্ত।
এই আত্মমায়ার দ্বারা তিনি জড়া প্রকৃতির তমান্ধকার ভেদ করতে সক্ষম। সেই রকম মূল বিষ্ণু শ্রীকৃষ্ণ তার আত্ম-মায়া প্রকাশের মাধ্যমে ব্রজবাসীদের সৃষ্টি করেছিলেন। ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে কৃষ্ণলােক ও তার পরিকর আদি সবই তার আত্মমায়ার অংশ-প্রকাশ।
ভগবানের সেই আত্মমায়াই বৃন্দাবন রূপে এই ধরাধামে প্রদর্শিত হয়েছে, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তার পিতা, মাতা ও তার সখা গােপ ও গােপীদের সঙ্গ উপভােগ করেন। অক্রুরের বর্ণনা অনুযায়ী স্পষ্ট বােঝা যায় যে, শ্রীকৃষ্ণ যেমন প্রকৃতির গুণের অতীত, সেই রকম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিপূর্ণ সেবায় সর্বদা নিয়ােজিত ব্রজবাসীরাও ছিল গুণাতীত।
ভগবানের অলৌকিক কার্যকলাপের প্রয়ােজনীয়তার কথাও অক্রুর বিবেচনা করেছিল। অক্রুর ভেবেছিল, কৃষ্ণলীলা, কৃষ্ণগুণ, তার উপদেশ, তাঁর দিব্য কার্যাবলী সবই জনগণের পরম সৌভাগ্যের দ্যোতক। ভগবানের অপ্রাকৃত রূপ গুণ-লীলা ও পরিকর আদি আলােচনার মাধ্যমে জনগণ সর্বক্ষণই কৃষ্ণ-ভাবনায় নিমগ্ন থাকতে পারে।
এইভাবে কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করে সারা বিশ্ব বাস্তবিক এক মঙ্গলময় সমৃদ্ধিশালী জীবন যাপন করে শান্তিপূর্ণভাবে জীবনের পথে অগ্রসর হতে পারে। কিন্তু কৃষ্ণভাবনাহীন মনুষ্য-জীবন মৃতদেহকে সজ্জিত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। একটি মৃতদেহকে খুব সুন্দর করে সাজান যেতে পারে, কিন্তু চেতনাহীন এই সাজসজ্জা সবই নিরর্থক। তাই কৃষ্ণভাবনাহীন মানব-সমাজ অর্থহীন ও প্রাণহীন।
অক্রুর ভাবল, সেই লীলা পুরুষােত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আজ যদুবংশে আবির্ভূত হয়েছেন। তার দ্বারা প্রণীত আইন হচ্ছে ধর্মের মূল নীতি। এই নিয়ম ও আইনগুলি যারা মেনে চলেন, তারা হচ্ছেন দেবতা, আর যারা তা অমান্য করে, তারা হচ্ছে অসুর। যাঁরা পরমেশ্বর ভগবানের বিধিনিষেধের প্রতি নিষ্ঠাবান, সেই দেবতাদের রক্ষা করার জন্য তিনি স্বয়ং আবির্ভূত হয়েছেন।
দেবতা এবং ভগবন্তুক্তেরা শ্রীকৃষ্ণের নিয়ম মেনে চলেন এবং তাতে অশেষ আনন্দ লাভ করেন। ঠিক সেই রকমই শ্রীকৃষ্ণও নানাভাবে তাদের রক্ষা করে পরম আনন্দ লাভ করেন। ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে যে, ভগবান অসুরদের নিধন করেন এবং তাঁর ভক্তদের রক্ষা করেন। ভগবানের এই সমস্ত দিব্য লীলা শ্রবণ ও কীর্তন সব সময়ই মানুষের জন্য অশেষ কল্যাণকর। ভগবানের এই মহান কার্যাবলী দেবতা ও ভক্তদের দ্বারা চিরকাল কীর্তিত হয়ে থাকে।
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সকল গুরুবর্গেরও গুরু; তিনি হচ্ছেন পতিতপাবন। তিনি ক্রিলােকের পতি জগন্নাথ; ভক্তিপূর্ণ নয়নে যে কেউ তাকে দেখতে পারেন। আজ আমি পরমেশ্বর ভগবানের দর্শন লাভ করব যিনি তাঁর দিব্য কমনীয়তার দ্বারা লক্ষ্মীদেবীকে চিরকাল তার সঙ্গে বাস করতে আকৃষ্ট করেছেন।
বৃন্দাবনে উপস্থিত হওয়া মাত্রই এই রথ থেকে আমি অবতরণ করব এবং মায়াধীশ পরমেশ্বর ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রণত হয়ে, আমি তাকে শ্রদ্ধা জানাব। যােগীরা সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মের উপাসনা করেন; তাই আমিও শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলের উপাসনা করে গােপবালকদের মতাে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের একজন সখায় পরিণত হব।
যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে এইভাবে আমি প্রণত হব, তখন নিশ্চয়ই তিনি তার অভয় করকমলের দ্বারা আমার শির স্পর্শ করবেন। যারা ভগবানের চরণে শরণাগত, সেই মায়াবদ্ধে জীবদের সকলকেই তিনি তার অভয় পদ প্রদান করেন। যারা সংসার ভয়ে ভীত, সেই সব লােকেদের জীবনের অন্তিম লক্ষ্যই হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ, এবং যখন আমি শ্রীকৃষ্ণের দর্শন লাভ করব, নিশ্চয়ই তার চরণকমলে তিনি আমায় আশ্রয় দান করবেন। আমার শিরােদেশে ভগবানের কমলহস্তের স্পর্শের জন্য আমি ব্যাকুলভাবে কামনা করছি।
এইভাবে অক্রুর শ্রীকৃষ্ণের করকমল থেকে শুভাশিস আশা করছিল। অক্রুর জানত যে, স্বর্গ, মর্ত ও পাতাল এই তিন লােকের অধিপতি স্বর্গরাজ ইন্দ্র ভগবানকে শুধু সামান্য জল দান করলে, তিনি তা গ্রহণ করায় ইন্দ্ৰও ভগবানের আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন। সেই রকম বামনদেবকে ত্রিপাদ ভূমি ও সামান্য জল দান করলে, ভগবান তা গ্রহণ করায়, বলি মহারাজ ইন্দ্রপদ লাভ করেছিলেন।
ভগবানের সঙ্গে রাসনৃত্য করার সময় গােপীরা অবসন্ন ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পদ্ম-গন্ধময় করকমল দিয়ে গােপীদের মুক্তোর মতাে স্বেদবিন্দুময় মুখারবিন্দকে স্পর্শ করলে তখনই তারা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন।
এইভাবে অক্রুর শ্রীকৃষ্ণের করকমলের শুভ আশীর্বাদ কামনা করছিল। শ্রীকৃষ্ণ সকল শ্রেণীর লােককে তার কৃপা-আশীর্বাদ প্রদান করেন, যদি তারা কৃষ্ণানুশীলন করে। কেউ যদি দেবরাজ ইন্দ্রের মতাে জড়জাগতিক সুখ চায় শ্রীকৃষ্ণের কাছে, সে ঐ বর লাভ করতে পারে। কেউ যদি সংসার ক্লেশ থেকে মুক্ত হতে চায়, ঐ বরও সে শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে লাভ করতে পারে। আর শুদ্ধ কৃষ্ণভক্ত ভগবৎ-সান্নিধ্য ও ভগবানের শ্রীঅঙ্গের স্পর্শের অভিলাষী হলে সেও তার করকমল থেকে সেই আশীর্বাদ পেতে পারে।
যাই হােক, শ্রীকৃষ্ণের শত্রু কংসের প্রতিনিধি হয়ে আসার জন্য অক্রুর ভয় পেয়েছিল। সে ভাবল, শত্রুর দূত হয়ে আমি শ্রীকৃষ্ণকে আজ দর্শন করতে যাচ্ছি। আবার ভাবল, প্রত্যেকেরই হৃদয়ে পরমাত্মারূপে শ্রীকৃষ্ণ রয়েছেন। তাই তিনি আমারও হৃদয়ের কথা জানেন। অক্রুর শ্রীকৃষ্ণের শত্রুর বিশ্বাসভাজন হলেও তার হৃদয় শুদ্ধ ও নির্মল ছিল।
সে ছিল এক শুদ্ধ কৃষ্ণভক্ত। কংসের ক্রোধের আশঙ্কায় সে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়। অক্রুর নিশ্চিত ছিল যে, যদিও সে কংসের প্রতিনিধিরূপে যাচ্ছিল, তবুও শ্রীকৃষ্ণ তাকে কখনই শত্রুরূপে গ্রহণ করবেন না। সে চিন্তা করল, 'যদিও কংসের হয়ে আমি পাপ কর্ম সাধনে প্রবৃত্ত হচ্ছি, তবু যখন আমি পরমেশ্বর ভগবানের কাছে উপস্থিত হব, তখন করজোড় এবং সর্বান্তঃকরণে বিনীতভাবে আমি তার কাছে দাঁড়াব।
নিশ্চয়ই তখন তিনি আমার ভক্তিপূর্ণ ভাব দেখে তুষ্ট হবেন ও সস্নেহ-হাস্য সহকারে আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করবেন। এইভাবে আমার সমস্ত পাপ থেকে আমি চিরতরে মুক্ত হব। তখন আমি চিন্ময় ও পরম-আনন্দময় স্তরে অধিষ্ঠিত হব। শ্রীকৃষ্ণ নিশ্চয়ই আমার অন্তরের কথা জানেন, তাই আমি যখন তার সম্মুখীন হব, তিনি নিশ্চয়ই আমাকে স্নেহালিঙ্গন করবেন।
আমি শুধু একজন যদুবংশের বংশধরই নই; আমি তার একজন অনন্য ভক্ত। ভগবানের এই স্নেহালিঙ্গনের ফলে আমার দেহ, হৃদয়, আত্মা সবই বিগত জীবনের সমস্ত কর্মফল থেকে সর্বতােভাবে মুক্ত হবে। এইভাবে আলিঙ্গনের ফলে আমি তখনই দণ্ডায়মান হয়ে বিনীতভাবে করজোড়ে প্রণতি নিবেদন করব।
নিশ্চয়ই শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীবলরাম তখন 'অক্রুর কাকা বলে আমাকে ডাকবেন এবং সেই সময় আমার সমগ্র জীবন মহিমান্বিত হবে, গৌরবান্বিত হবে। আমার জীবন সার্থক হবে। পরমেশ্বর ভগবানের দ্বারা কেউ স্বীকৃত না হলে, তার জীবন কখনও সার্থক ও সফল হয়ে উঠতে পারে না।
এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, ভক্তিপূর্ণ ভগবৎ সেবার মাধ্যমে ভগবানের স্বীকৃতি লাভের প্রয়াসী হওয়া উচিত। এই ভগবৎ-স্বীকৃতি ছাড়া মানব-জীবন দুঃসহনীয় ও নিন্দনীয় হয়ে ওঠে। ভগবদ্গীতায় উল্লেখ আছে যে, পরমেশ্বর ভগবান সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন। কেউ তার বন্ধু নয়, কেউ তার শক্রও নয়। কিন্তু যে ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে তার সেবা করে, সেই ভক্তের প্রতি তিনি আসক্ত হন।
ভগবদ্গীতায় আরও বলা হয়েছে যে, ভক্তের প্রেমময় ভগবৎ সেবায় ভগবান তুষ্ট হয়ে তার প্রার্থনায় সাড়া দেন। অক্রুর আরও ভাবছিল, শ্রীকৃষ্ণ স্বর্গরাজ্যের কল্পবৃক্ষের মতাে ভক্তের ইচ্ছানুযায়ী ফলদান করেন। পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন সব কিছুর পরম উৎস। কিভাবে ভগবানের সেবা করতে হয় ভক্তের অবশ্যই তা জানা উচিত।
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে তাই ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, একই সঙ্গে শ্ৰীকৃষ্ণ ও সদ্গুরু উভয়েরই সেবা করা উচিত এবং এইভাবে কৃষ্ণভাবনায় উন্নীত হওয়া যায়। সদগুরুর নির্দেশে শ্রীকৃষ্ণ সেবাই হচ্ছে বৈধ ভগবৎ-সেবা। কারণ সদ্গুরু হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের বহিঃপ্রকাশ।
তাই শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর বলেছেন, কেউ যখন সদ্গুরুকে তুষ্ট করে, তখন সে পরমেশ্বর ভগবানকেও তুষ্ট করে। এটি ঠিক সরকারি অফিসের কাজের সঙ্গে তুলনা করা যায়, যেমন একজন বিভাগীয় প্রধানের অধীনে কাজ করতে হবে। বিভাগের তত্ত্বাবধানকারী তুষ্ট হলে স্বাভাবিক ভাবেই সেই কর্মচারীর পদোন্নতি ও সঙ্গে সঙ্গে বেতন বৃদ্ধি হবে।
তারপর অক্রুর ভাবল, যখন শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীবলরাম আমার প্রতি তুষ্ট হবেন, নিশ্চয়ই তারা আমার হাত ধরে আমাকে তাদের গৃহে নিয়ে যাবেন এবং আমাকে নানারকম সম্মানসূচক আতিথ্য প্রদান করবেন। তখন তারা কংস ও তার বন্ধুবর্গের কার্যাবলী সম্বন্ধে আমাকে নানারকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন।
এইভাবে মথুরা থেকে যাত্রা করে শফন্ধের পুত্র অক্রুর গভীরভাবে কৃষ্ণচিস্তায় নিমগ্ন ছিল। তারপর দিনান্তে অক্রুর বৃন্দাবনে পৌঁছল।
সারা পথ অতিক্রম করলেও তাতে কত সময় লেগেছিল, তা সে জানত না। যখন সে শ্রীধাম বৃন্দাবনে পৌছল, তখন সূর্য দিগন্তে অস্ত যাচ্ছিল। বৃন্দাবনের সীমানায় প্রবেশ করা মাত্রই সে গাভীদের পদচিহ্ন ও অঙ্কুশ, কমল, বজ্র, ধ্বজ আদি লক্ষণ সমন্বিত শ্রীকৃষ্ণের পদচিহ্নের দর্শন লাভ করল। শ্রীকৃষ্ণের সেই পদচিহ্ন দর্শন মাত্রই অক্রুর শ্রদ্ধাপূর্ণ চিত্তে রথ থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল।
সে সাত্ত্বিক ভাবে অভিভূত হয়ে পড়ল এবং ক্রন্দন করতে শুরু করল। তার দেহ কম্পিত হতে থাকল। সে শ্রীকৃষ্ণের চরণধূলি দর্শন করে পরম আনন্দে অভিভূত হয়ে, ভূমিতে পড়ে গড়াগড়ি দিতে শুরু করল।
অক্রুরের এই বৃন্দাবন যাত্রা শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয়। যিনি বৃন্দাবন দর্শনে ইচ্ছুক, তার পক্ষে অক্রুরের আদর্শ পদাঙ্ক অনুসরণ করে, প্রতিনিয়ত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্যলীলা স্মরণ করা উচিত। বৃন্দাবনের সীমানায় উপস্থিত হওয়া মাত্রই জড়জাগতিক পদমর্যাদার কথা ভুলে গিয়ে, ব্রজের ধূলিতে তার অবগাহন করা উচিত।
নরােত্তম দাস ঠাকুর মহাশয় তার বিখ্যাত ভজনগীতিতে বলেছেন বিষয় ছাড়িয়া কবে শুদ্ধ হবে মন’—অর্থাৎ বিষয় ভােগ ত্যাগ করে যখন আমার মন শুদ্ধ হবে, তখন আমি বৃন্দাবনের দর্শন লাভ করব। প্রকৃতপক্ষে, টিকিট কেটে কেউ বৃন্দাবনে যেতে পারেন না।
বস্তুত, অক্রুরই বৃন্দাবনে যাবার পন্থা প্রদর্শন করেছে। বৃন্দাবনে প্রবেশ করেই অক্রুর শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীবলরামকে গাে-দোহনের তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত দেখেছিল। শ্রীকৃষ্ণ তখন পীত বসন ও শ্রীবলরাম নীল বসন পরিধান করেছিলেন। অক্রুর আরও দেখেছিল যে, শ্রীকৃষ্ণের নয়নযুগল শরতের প্রস্ফুটিত পদ্মের মতাে সুন্দর। শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীবলরাম দুজনেই কিশাের।
শ্রীকৃষ্ণ শ্যামবর্ণ আর বলরাম শ্বেতবর্ণ। তারা দু'জনেই লক্ষ্মীদেবীর আশ্রয়স্থল স্বরূপ। তাঁদের সুগঠিত দেহ, বাহু ও বদন সকলই সুন্দর ছিল। তারা ছিলেন হাতির মতাে বলশালী। তাদের পদচিহ্ন দেখার পর এখন অক্রুর বাস্তবিক শ্রীকৃষ্ণকে মুখােমুখি দর্শন করল। তখন সবচেয়ে প্রভাবশালী হলেও হাসিমুখে তারা অক্রুরের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন।
অক্রুরও বুঝতে পারল, গােচারণ করে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীবলরাম বন থেকে ফিরে এসেছেন। স্নান সমাপন করে তারা মূল্যবান রত্ন-অলঙ্কার ভূষিত মালা ও বস্ত্র পরিধান করেছেন। তাদের দেহ চন্দন-লিপ্ত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীবলরামের উপস্থিতিতে তাদের দেহনিঃসৃত চন্দন ও কুসুমের গন্ধ অক্রুর বিশেষভাবে অনুভব করেছিল। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তার অংশ-প্রকাশ বলরামকে দর্শন করে সে নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান মনে করছিল।
কারণ সে জানত যে, তারা দু জন হচ্ছেন সৃষ্টির আদি পুরুষ। ব্রহ্মসংহিতায় এই কথা বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ আছে যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন আদি পুরুষ পরমেশ্বর ভগবান এবং সকল কারণের পরম কারণ। অক্রুর বুঝতে পেরেছিল যে, সৃষ্টির কল্যাণে অসুর নিধন এবং ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং আবির্ভূত হয়েছে।
তারা তাদের দেহ-বিচ্ছুরিত আলােকের দ্বারা সমস্ত জগতের অন্ধকার বিদূরিত করছিলেন, কেননা তারা ছিলেন উজ্জ্বল নীলকান্ত মণি ও রজতময় পর্বতের ন্যায়। তখনই অক্রুর ইতস্তত না করে, দ্রুত রথ থেকে নেমে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীবলরামের সামনে ভূমিতে দণ্ডবৎ নিপতিত হয়ে প্রণতি নিবেদন করল।
পরমেশ্বর ভগবানের চরণকমল স্পর্শ করে, পরম আনন্দে সে অভিভূত হয়ে পড়ল। তার কণ্ঠ অবরুদ্ধ হয়ে গেল; সে কোন কথা বলতে পারছিল না। শ্রীকৃষ্ণের দিব্য সান্নিধ্যের ফলে অবিরল ধারায় সে অশ্রুপাত করছিল। ভাবাবেশে সম্পূর্ণভাবে স্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় সে যেন তার সম্পূর্ণ বাক্ ও দর্শন শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। তখন ভক্তবৎসল ও করুণাময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অক্রুরকে হাত ধরে তুলে তাকে আলিঙ্গন করলেন।
মনে হচ্ছিল, শ্রীকৃষ্ণ অক্রুরের প্রতি অত্যন্ত তুষ্ট হয়েছেন। বলরামও অক্রুরকে আলিঙ্গন করেছিলেন। কৃষ্ণ বলরাম তার হাত ধরে বাইরের ঘরে তাকে নিয়ে এলেন। তারপর তাকে বসার সুন্দর আসন দিলেন এবং পা ধােয়ার জল প্রদান করলেন। মধু ও অন্যান্য উপযুক্ত উপকরণ দ্বারা তাকে তারা আরাধনা করলেন।
এইভাবে অক্রুর যখন আরামদায়ক আসনে উপবেশন করল, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে একটি গাভী দান করেন এবং তার জন্য উপাদেয় আহার্য দ্রব্যাদি নিয়ে আসেন। অঙ্কুরের আহার সমাপ্ত হলে তার তৃপ্তির জন্য শ্রীবলরাম চন্দনসহ তাকে তাম্বুলাদি দান করলেন। বৈদিক রীতি অনুযায়ী অতিথিকে গৃহে কিভাবে গ্রহণ করতে হয় সকলকে তা শিক্ষাদানের জন্য স্বয়ং ভগবান তা সম্পূর্ণভাবে পালন করেছিলেন।
বৈদিক অনুশাসন হচ্ছে যে, শত্রুও যদি অতিথি হয়, তাকে এমনভাবে গৃহে গ্রহণ করা উচিত, যাতে অতিথি নিজেকে বিপদগ্রস্ত বােধ না করেন। গৃহকর্তা দরিদ্র হলেও অন্তত উপবেশনের জন্য তাকে (অতিথিকে) কুশ-আসন ও এক পাত্র পানীয় জল দেওয়া উচিত।
অক্রুরকে যথাযোগ্য মর্যাদা অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীবলরাম তাকে স্বাগত জানান। অক্রুরকে যথাযথভাবে অভ্যর্থনা জানিয়ে ও তাকে উপযুক্ত আসন দান করে শ্রীকৃষ্ণের পালক পিতা নন্দ মহারাজ বললেন, "প্রিয় অক্রুর, আপনার কাছে আমি কি জানতে পারি? আমি জানি সবচেয়ে নিষ্ঠুর অসুর কংস আপনাকে কসাইখানায় পশুদের কসাই যেমন রক্ষা করে, সে রকমই রক্ষা করছেন।
কিন্তু কসাই ভবিষ্যতে পশুদের হত্যা করে। কংস এতই স্বার্থপর যে, সে তার নিজ ভাগনেয়দের সব হত্যা করেছে, তাই আমি কি করে বিশ্বাস করব যে, সে মথুরাবাসীদের রক্ষা করছে।" এই কথাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক নেতা বা দেশের কর্মকর্তারা যদি অত্যন্ত স্বার্থান্বেষী ও আত্মকেন্দ্রিক হয়, তা হলে তারা কখনও দেশের নাগরিকদের কল্যাণে যত্নবান হতে পারে না।
নন্দ মহারাজের মধুর কথা শ্রবণ করে অক্রুর মথুরা থেকে বৃন্দাবন যাত্রার সারা দিনের ক্লান্তি সম্পূর্ণভাবে ভুলে গিয়েছিল।
Khub sundor tobe ektu kichu শ্লোক দিলে আরো ভালো হতো