অক্রুরের প্রত্যাবর্তন ও যমুনায় বিষ্ণুলােক দর্শন

 
অক্রুরের প্রত্যাবর্তন ও  গোপিকাদের বিরহ

অক্রুরের  যমুনায় বিষ্ণুলােক দর্শন


নন্দ মহারাজ ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অক্রুরকে সাদর অভ্যর্থনা করলেন এবং তাকে রাত্রি যাপনের স্থান দিলেন। ইতিমধ্যে দুই ভাই শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীবলরাম তাদের আহার গ্রহণ করতে গেলেন। অক্রুর বিছানায় বসে গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকল— মথুরা থেকে বৃন্দাবনে আসার সময় সে যা কিছু আশা-প্রত্যাশা করছিল, তার সব ইচ্ছাই পূর্ণ হয়েছে। 

 (শ্রীমদ্ভাগবত-শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলা এন্ড্রয়েড অ্যাপ ডাউনলোড করুন)

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আর এক নাম হচ্ছে শ্রীনিবাস। শুদ্ধ ভক্তের প্রতি সন্তুষ্ট হলে ভক্ত যা কামনা করেন, ভগবান তা সবই তাকে প্রদান করেন। কিন্তু শুদ্ধ ভগবৎ-ভক্ত নিজের ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য কিছুই ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন না।


আহার শেষ করে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীবলরাম রাত্রিকালীন সম্ভাষণ জানাতে কাকা অক্রুরের কাছে এলেন। শ্রীকৃষ্ণ মাতুল কংস সম্বন্ধে প্রশ্ন করলেন, বন্ধুদের সঙ্গে তিনি কি রকম ব্যবহার করছেন?” আবার তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাদের আত্মীয়রা কেমন আছেন?" তারপরে কংসের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় এবং পরিকল্পনা সম্পর্কে অনুসন্ধান করলেন। লীলাপুরুষােত্তম ভগবান তারপর অকে জানালেন যে, তার উপস্থিতি একান্তই ভাল হয়েছে। তার কাছে তিনি জানতে চাইলেন, তার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবেরা সুস্থ দেহে আছেন কিনা। 

 

শ্রীকৃষ্ণ জানালেন যে, তার মামা কংস রাজ্যের প্রধান হয়ে থাকায়, তিনি খুবই দুঃখিত। সমগ্র রাজা শাসন ব্যবস্থায় কংস ছিল সবচেয়ে অসংগতিপূর্ণ ব্যক্তি এবং তার শাসনের সময়ে প্রজারা কোন কল্যাণ তার কাছ থেকে আশা করতে পারেনি। তারপর শ্রীকৃষ্ণ বললেন, শুধু আমি পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করার ফলেই আমার পিতা-মাতা কত দুঃখ- যন্ত্রণা ভােগ করছেন। 

 

শুধু এই কারণের জন্য তিনি অন্যান্য অনেক পুত্রকে হারিয়েছেন। আমি মনে করি এটা আমার পরম সৌভাগ্য যে, আত্মীয় ও আমার বন্ধুরূপে আপনি আমার কাছে এসেছেন। প্রিয় সুহৃৎ অক্রুর, দয়া করে আপনি আমাকে আপনার বৃন্দাবনে আগমনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করুন।"


এই প্রশ্নের পর যদুবংশ-জাত অক্রুর শ্রীকৃষ্ণের পিতা বসুদেবকে কংসের হত্যার প্রচেষ্টা ও মথুরার সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সবিস্তারে বর্ণনা করল। শ্রীকৃষ্ণ যে বসুদেবের পুত্র, এই কথা নারদ প্রকাশ করে দেওয়ার পর যে সব ঘটনা ঘটেছিল, তা অক্রুর বর্ণনা করল। নন্দালয়ে শ্রীকৃষ্ণের পাশে বসে কংসের সকল কাহিনী সে শ্রীকৃষ্ণকে বলল—কিভাবে নারদ কংসের সঙ্গে মিলিত হন এবং কিভাবে কংস তাকে দূতরূপে প্রেরণ করেন।

 

ঠিক জন্মের পরই মথুরা থেকে শ্রীকৃষ্ণকে বৃন্দাবন পাঠানাের সমস্ত কাহিনী এবং কংস প্রেরিত সকল অসুর শ্রীকৃষ্ণের হাতে নিহত হওয়ার কথা যা নারদ কংসকে বলেছিলেন তা সবই অক্রুর শ্রীকৃষ্ণকে বিশদভাবে বর্ণনা করে। তারপর অক্রুর শ্রীকৃষ্ণকে তার বৃন্দাবন আগমনের উদ্দেশ্য জানিয়ে দিল। কংসের দুষ্ট পরিকল্পনার কথা শুনে শত্রু নিধনে নিপুণ শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীবলরাম মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন।


ধনুর্যজ্ঞ নামে মথুরায় অনুষ্ঠিতব্য উৎসবে অংশগ্রহণে গােপবালকদের আমন্ত্রণ জানাবার জন্য তারা নন্দ মহারাজকে অনুরােধ করলেন। কংস চেয়েছিল তারা সকলেই এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করুন। শ্রীকৃষ্ণের অনুরােধে নন্দ মহারাজ তখনই সকল গােপবালকদের ডেকে পাঠালেন এবং দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত সব রকম খাদ্যদ্রব্য ঐ অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে বললেন। 

 

কংসের বিরাট ধনুর্যজ্ঞ অনুষ্ঠান ও ব্রজবাসীদের সকলকে অংশগ্রহণে আমন্ত্রণের কথা জানাতে নন্দ মহারাজ বৃন্দাবনের মুখ্য কোতােয়ালকেও নির্দেশ দিলেন। নন্দ মহারাজ গােপবালকদের জানালেন যে, পরদিন সকালে তারা যাত্রা শুরু করবেন; তাই গাভী ও বলদগুলি যাতে তারা মথুরায় নিয়ে যেতে পারেন, গােপবালকেরা তার ব্যবস্থা করলেন।


শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীবলরামকে মথুরায় নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে অক্রুরকে আসতে দেখে ব্ৰজগােপিকারা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমন বিষন্ন হয়ে পড়লেন যে, তাদের মুখ কালাে হয়ে গেল, তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন; তাদের হৃদয় কেঁপে উঠল। অচিরেই তাদের কেশ ও বেশবাস শিথিল হয়ে পড়তে দেখলেন তাঁরা। 

 

অন্যান্যরা যারা গৃহকর্মে নিযুক্তা ছিলেন, তারা সকলেই শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীবলরামের মথুরা যাত্রার কথা শুনে যেন অন্যলােকের উদ্দেশ্যে মৃত্যুপথযাত্রীর মতাে সব কিছু ভুলে গিয়ে, কাজ-কর্ম থেকে অচিরেই বিরত হলেন। কেউ কেউ শ্রীকৃষ্ণ-বিরহে মুর্ছিতা হয়ে পড়লেন। শ্রীকৃষ্ণের অনুপম হাসি ও তাদের সঙ্গে মধুর বার্তালাপের কথা স্মরণ করে গােপীরা দুঃখে অভিভূত হলেন। 

 

কিভাবে তিনি ব্রজে ঘুরে বেড়াতেন, তার হাস্য-কৌতুকময় কথায় তাদের হৃদয়কে তিনি কিভাবে আকর্ষণ করতেন, পরমেশ্বর ভগবানের এই সব লীলা-বিলাসের কথা ব্রজগােপিকারা সকলেই স্মরণ করতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণের কথা ভেবে এবং শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাদের আসন্ন বিরহের কথা ভেবে বিষন্ন ও কম্পিত হৃদয়ে গােপীরা সকলে সমবেত হলেন। শ্রীকৃষ্ণচিন্তায় সম্পূর্ণ আবিষ্ট গােপীদের চোখ থেকে অবিরত অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল। তারা নিজেদের মধ্যে এইভাবে কথাবার্তা বলতে লাগলেন—


“হে বিধাতা! আপনি অত্যন্ত নির্দয়, আপনি অতীব নিষ্ঠুর। মনে হয় আপনি কখনাে অন্যদের প্রতি কৃপা প্রদর্শন করেন না। আপনার নির্দেশেই বন্ধুরা পরস্পর সান্নিধ্যে আসে, কিন্তু তাদের বাসনা পূর্ণ হবার আগেই আপনি তাদের বিচ্ছিন্ন করেন। এগুলি শিশুদের খেলাধুলার মতােই অর্থহীন। 

 

আপনার এই ব্যবস্থা সত্যিই নিন্দনীয় যে, আপনি মনােহর শ্রীকৃষ্ণকে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, যাঁর নীল কুঞ্চিত কেশ, যার উন্নত নাসা ও কপালকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে, যার সদা-হাসি জড়জাগতিক সকল সুখকে তুচ্ছ জ্ঞান করে; আর পরক্ষণেই আপনি তাকে আমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেন।


“হে বিধাতা! আপনি এমনই ক্রুর। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর এই যে, আপনি এখন এই অক্রুর' নামে আমাদের কাছে উপস্থিত হয়েছ, যার অর্থ 'ক্রুর নয়'। শ্রীকৃষ্ণের মুখারবিন্দের দর্শনের উদ্দেশ্যে আমাদের এই নয়নগুলি দানের জন্য প্রথমে আমরা আপনার কলানৈপুণ্যের প্রশংসা করেছিলাম, কিন্তু এখন থেকে যাতে আমরা শ্রীকৃষ্ণকে আর দর্শন করতে না পারি, তাই নির্বোধের মতাে আপনি আমাদের নয়নের মণিকেই তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।


"নন্দদুলাল শ্রীকৃষ্ণও অত্যন্ত নিষ্ঠুর। তার সব সময়ই নতুন সখা চাই। সে কারাে সঙ্গে দীর্ঘকালের বন্ধুত্ব রক্ষা করা পছন্দ করে না। আমাদের গৃহ, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় আদি ত্যাগ করে আমরা তার দাসী হয়েছি, কিন্তু সে আমাদের উপেক্ষা করে চলে যাচ্ছে। আমরা সম্পূর্ণভাবে শরণাগত হওয়া সত্ত্বেও সে আমাদের একটুও ডাকে না। এখন মথুরা নগরীর সমগ্র যুবতীরা সাগ্রহে শ্রীকৃষ্ণের আগমন প্রত্যাশা করছে। তারা শ্রীকৃষ্ণের মধুর হাসি উপভােগ করবে ও তার মধু আস্বাদন করবে।


“আমাদের আশঙ্কা এই যে, একনিষ্ঠ, দৃঢ়ব্রত ও ধীর হওয়া সত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণ মথুরার সুন্দরী কিশােরীদের মুখশ্রী দর্শন করে নিজেকে ভুলে যাবে। আমাদের আরও আশঙ্কা হয়, সে তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আমাদের মতাে বৃন্দাবনের গ্রাম্য কিশােরীদের ভুলে যাবে। সে আমাদের প্রতি আর সদয় হবে না, আমাদের আর কৃপা করবে না। তাই শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে ফিরে আসবে, এটা আর আশা করি না। সে মথুরার কিশােরীদের সান্নিধ্য ত্যাগ করবে না।”


মথুরার বিরাট ধনুর্যজ্ঞ অনুষ্ঠানের কথা ব্রজগােপিকারা ভাবতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণ যখন মথুরার পথ দিয়ে যাবেন, তখন সমস্ত কিশােরী ও পুরনারীরা তাদের গৃহের বারান্দা থেকে শ্রীকৃষ্ণকে দেখবেন। তখন দশাহ, ভােজ, অন্ধক ও সাত্বত নামে মথুরায় বিভিন্ন সম্প্রদায় ছিল। এঁরা সকলেই, শ্রীকৃষ্ণ যে বংশে আবির্ভূত হন, সেই যদু বংশের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। 

 

তারাও সকলে শ্রীকৃষ্ণের আগমন প্রতীক্ষা করছিলেন। ইতিমধ্যেই সবাই জেনে গিয়েছিলেন যে, শ্রীকৃষ্ণ, যিনি লক্ষ্মীদেবীর আশ্রয়স্থল এবং যিনি সমস্ত দিব্যগুণ সম্পন্ন ও সমস্ত আনন্দের ভাণ্ডার, তিনি মথুরানগর পরিভ্রমণে যাচ্ছেন।


গােপিকারা তখন অক্রুরের কার্যকলাপকে ধিক্কার দিতে শুরু করলেন। তারা বললেন, তাদের নয়নের মণি, পরম প্রেমাস্পদ শ্রীকৃষ্ণকে অক্রুর নিয়ে যাচ্ছে। তাদের না বলে, তাদের সান্ত্বনা না দিয়েই অক্রুর শ্রীকৃষ্ণকে তাদের চোখের আড়ালে বহু দূরে নিয়ে চলে যাচ্ছে। গােপীদের প্রতি অক্রুরের এত নিষ্ঠুর হওয়া উচিত নয়, বরং তাদের প্রতি করুণা-পরবশ হওয়াই উচিত।


গােপিকারা বললেন"সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, নন্দতনয় কৃষ্ণ কোন বিচার-বিবেচনা না করেই স্বয়ং রথে আরােহণ করল। এ থেকে মনে হয় কৃষ্ণ তেমন বুদ্ধিমান নয়। যদি সে অত্যন্ত বুদ্ধিমান হয়ও, তবে তেমন সভ্য নয়, ভদ্র নয়। শুধু তা নয় সকল গােপেরাও এমনই উদাসীন যে, মথুরা যাওয়ার উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যেই তারা বলদ ও গাভীদের জোয়াল পরাচ্ছে। 

 

বৃন্দাবনের বয়ােবৃদ্ধরাও নির্দয় ও হৃদয়হীন। আমাদের দুর্দশার কথা তারাও বিবেচনা করেন —মথুরা যাত্রায় তারাও কৃষ্ণকে নিবৃত্ত করছে না। এমন কি দেব-দেবতাদেরও আমাদের প্রতি এইটুকু দয়া নেই, তারা কৃষ্ণের মথুরা যাত্রায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছেন না।"


শ্রীকৃষ্ণ যাতে মথুরায় যেতে না পারেন, এই জন্য প্রবল বর্ষণ, ঘুর্ণি ঝড় আদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক যাতে দেবতারা সৃষ্টি করেন, সেই উদ্দেশ্যে গােপিকারা রার্থনা করতে লাগলেন। তারপর ব্রজললনারা বিবেচনা করতে লাগলেন আমাদের বৃদ্ধ পিতামাতারা যাই মনে করুন না কেন, আমরা নিজেরাই কৃষ্ণকে মথুরা যেতে নিবৃত্ত করব। এইভাবে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম করে তাকে এই কাজে নিবৃত্ত করা ছাড়া আমাদের আর কোন পথ নেই। 

 

কৃষ্ণকে আমাদের চোখের সামনে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকে আমাদের সঙ্গে বিরুদ্ধাচরণ করছে। তাকে ছাড়া আমরা এক মুহূর্তও বেঁচে থাকতে পারি না।


এইভাবে ব্রজাঙ্গনারা পথে শ্রীকৃষ্ণের রথ অবরােধ করবেন বলে মনস্থির করলেন। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি শুরু করলেন,কৃষ্ণের সঙ্গে রাসনৃত্য করবার সময় আমরা এক সুদীর্ঘ রাত অতিবাহিত করেছি। অথচ সেই দীর্ঘ সময় আমাদের কাছে মুহূর্তমাত্র বােধ হয়েছে। আমরা তার সঙ্গে মধুর আলাপ করে, তার সঙ্গে আলিঙ্গন করে তার মুখারবিন্দ সতৃষ্ণ নয়নে দর্শন করেছিলাম। 

 

সে যদি চলে যায়, তাকে ছাড়া এক মুহূর্ত এখন আমরা বেঁচে থাকব কি করে? দিনের শেষে সন্ধ্যায় গােধূলি লগ্নে অগ্রজ বলরাম ও সখাদের নিয়ে কৃষ্ণ ফিরে আসত। গাভীদের খুরের ধুলােয় কৃষ্ণের মুখ আচ্ছন্ন হত, হাসি মুখে সে তার বেণু বাজাত, আর আমাদের দিকে সস্নেহে দৃষ্টিপাত করত। সুতরাং আমরা তাকে ভুলে থাকব কি করে? 

 

আমাদের পরম প্রেমাস্পদ, আমাদের প্রাণনাথ কৃষ্ণকে আমরা ভুলে থাকব কিভাবে? নানাভাবে রাতদিন সে এমনভাবে আমাদের হৃদয়কে অপহরণ করেছে, এখন সে যদি আমাদের ছেড়ে চলে যায়, তাহলে আমাদের জীবন ধারণ করা একেবারেই অসম্ভব।"


শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন ত্যাগ করে চলে যাওয়ার সময় এই রকম ভাবতে ভাবতে ব্ৰজবালিকারা বিরহকাতর হয়ে পড়েছিলেন। তাই গােপীরা তাদের মনকে সংযত করতে না পেরে, “হে প্রিয় মাধব! হে প্রিয় দামােদর!” বলে শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন নাম ধরে উচ্চস্বরে ক্রন্দন করতে থাকেন।


শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন ত্যাগের আগে সারা রাত গােপীরা ক্রন্দন করে কাটালেন। অত্র প্রাতঃস্নান সমাপন করে রথে আরােহণ করল এবং শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের মথুরার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হল। দুধ, দই, ঘি, ইত্যাদি সামগ্রীতে গরুর গাড়ি ভর্তি করে, নন্দ মহারাজ ও গােপেরা তাতে আরােহণ পূর্বক শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের রথকে অনুসরণ করতে শুরু করল। পথে রথের গতিরােধ করতে শ্রীকৃষ্ণ গােপীদের নিষেধ করলেন, তবুও রথকে চতুর্দিকে ঘিরে তারা করুণ দৃষ্টিতে শ্রীকৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।


গােপবালাদের এই দুঃখকাতর অবস্থা দেখে শ্রীকৃষ্ণ অত্যন্ত অভিভূত হলেন। কিন্তু মথুরাযাত্রা করা তার কর্তব্য, কারণ নারদ আগেই একথা বলেছেন। এইজন্য শ্রীকৃষ্ণ গােপীদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন যে, দুঃখে কাতর হওয়া তাদের পক্ষে উচিত নয়; কেননা তার কর্তব্য সমাপন করে যত শীঘ্র সম্ভব তিনি বৃন্দাবনে ফিরে আসবেন।


কিন্তু এইভাবে অনুনয় বিনয় করা সত্ত্বেও তাদের ফেরানাে গেল না। যাই হােক, তবু রথ পশ্চিম দিকে চলতে লাগল, আর রথ এগােতে শুরু করলে গােপীদের মনও যত সম্ভব রথকে অনুসরণ করে এগােতে লাগল। যতক্ষণ রথের পতাকাটি দেখা যায়, তারা সেটির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। অবশেষে রথের ধূলিই শুধু তারা দেখতে পাচ্ছিলেন। যতক্ষণ রথটি তাদের দৃষ্টিপথ থেকে চলে না যায়, ততক্ষণ তারা কেউ একটুও নড়লেন না, একই জায়গায় দাঁড়িয়েই রইলেন চিত্রপটের তারা সকলে স্থির করলেন, শ্রীকৃষ্ণ অচিরেই বৃন্দাবনে ফিরে আসছে না; গভীর নৈরাশ্যে তারা নিজ নিজ গৃহে ফিরে গেলেন। 


অক্রুর ও বলরামকে সঙ্গে নিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সবেগে যমুনার তীরের দিকে রথকে চালনা করলেন। একবার মাত্র যমুনায় স্নান করেই যে কেউ অশেষ পাপকর্মের ফল থেকে মুক্ত হতে পারে। শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীবলরাম দুজনেই যমুনায় স্নান করে মুখ প্রক্ষালন করলেন। স্ফটিকের মতাে স্বচ্ছ যমুনার জল পান করে, তারা আবার রথে গিয়ে আসন গ্রহণ করলেন।


একটি বিরাট গাছের নিচেই রথটি দাঁড়িয়ে ছিল, তাতে দুভাই-ই বসে ছিলেন। যমুনায় স্নান করার উদ্দেশ্যে অক্রুর তারপর তাদের অনুমতি গ্রহণ করে জলে নামল। বৈদিক ক্রিয়াকর্ম অনুযায়ী, স্নান সমাপন করে অর্ধ নিমজ্জিত অবস্থায় মৃদুস্বরে পবিত্র গায়ত্রী মন্ত্র জপ করা উচিত। তা করতে গিয়ে, অক্রুর যমুনায় হঠাৎ শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীবলরাম দুজনকেই দেখতে পেল। 

 

অক্রুর তাঁদের সেখানে দেখে অবাক হয়ে গেল; কারণ সে নিশ্চিতভাবেই জানত যে, তারা রথেই বসে আছেন। তাই যখন তাদের দুজনকে রথে সে দেখল, তখন তাদের যমুনার জলে দেখেছে কিনা চিন্তা করে অবাক হয়ে ভাবতে লাগল এবং আবার যমুনার জলে সে ফিরে গেল।


এইভাবে সে শুধু দেখতে পেল, তাই নয়—সেখানে গন্ধর্ব, চারণ, সিদ্ধ সকলকে এবং অন্যান্য বহু দেবতাদেরও দেখতে পেল, দেবতারা সকলে অনন্ত শয়ানে শায়িত ভগবানের সামনে দণ্ডায়মান ছিলেন। অক্রুর আরাে দেখতে পেল, সহস্র ফণাবিশিষ্ট নীলবসন অনস্তশেষ এবং তার গ্রীবাগুলি ছিল শ্বেতবর্ণের।


তা তখন তুষারাবৃত পর্বতের মতাে দেখাচ্ছিল। অক্রুর দেখল, শ্রীকৃষ্ণ চতুর্ভুজরূপে শেষনাগের বঙ্কিম কোলে শান্তভাবে উপবিষ্ট আছেন। তার নয়নযুগল পদ্মফুলের রক্তিম আভাযুক্ত পাপড়ির ন্যায় শােভা পাচ্ছিল।


পক্ষান্তরে বলা যায়, যমুনার জলে ফিরে এসে অক্রুর শ্রীবলরামকে শেষনাগ ও শ্রীকৃষ্ণকে মহাবিষণু রূপে দর্শন করেছিল। তার চতুর্ভূজ রূপ ছিল সর্বমনােহর, দেহ সুগঠিত, আজানুলম্বিত বাহুযুগল, ওষ্ঠ রক্তিম, উন্নত নাসা, উন্নত ললাট ও বিস্তৃত কর্ণ, উচ্চ স্কন্ধ, শঙ্খাকৃতি বিস্তৃত বক্ষ, গভীর নাভি, ত্রিরেখাঙ্কিত উদর, রমণীদের নিতম্বের মতাে বিস্তৃত তার কটি দেশ এবং হাতির শুঁড়ের মতাে তার উরু সমন্বিত রূপ ছিল অপূর্ব দর্শন। 

 

তার পায়ের গ্রন্থি, অন্যান্য অংশ ও নিম্নাঙ্গের প্রান্ত ভাগ ছিল সর্বতােভাবে সুন্দর। তার পদনখ অতিশয় উজ্জ্বল এবং পায়ের পাতা কমলদলের মতাে সুন্দর। তার মুকুট অমূল্য রত্নরাজিতে বিভূষিত। বক্ষে উপবীত ও কোমরে সুন্দর কটিবন্ধ। বার উপরের ভাগে অনন্ত ও হস্তদ্বয় বলয়ের দ্বারা ভূষিত। পদদ্বয় নূপুরের দ্বারা শশাভিত। তিনি অতি উজ্জ্বলবর্ণ, উজ্জ্বলরূপ ধারণ করেছিলেন এবং তার করতল ছিল পদ্মফুলের মতাে সুন্দর। 

 

বিষ্ণুর বিভিন্ন প্রতীক চিহ্ন শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম চার হাতে ধারণ করে তিনি অপূর্ব সুন্দর রূপ প্রকাশ করেছিলেন। তার বক্ষ শ্রীবৎস চিহ্নিত ছিল এবং তিনি নির্মল পুষ্পমালায় শােভিত ছিলেন।


সর্বোপরি বলা যায়, তিনি অত্যন্ত দর্শনীয় রূপ ধারণ করেছিলেন। অক্রুর আরও দেখল দেবাদিদেব শিব, ব্রহ্মা এবং চতুঃকুমারসনক, সনাতন, সনন্দ ও সনৎকুমারাদি এবং নন্দ সুনন্দ প্রভৃতি অন্তরঙ্গ পার্ষদ কর্তৃক ভগবান পরিবেষ্টিত। নবযােগেন্দ্র, ভক্তপ্রবর প্রহ্লাদ মহারাজ এবং নির্মল ও বিশুদ্ধ হৃদয়ে বন্দনারত নারদ মুনিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। 

 

অধােক্ষজ পরমেশ্বর ভগবানের দর্শন লাভ করে তৎক্ষণাৎ অক্রুর ভক্তিরসে আপ্লুত হল এবং তার শ্রীঅঙ্গ শুদ্ধ সাত্ত্বিক ভাবে রােমাঞ্চিত হতে লাগল। ক্ষণিকের জন্য বিমােহিত হলেও অক্রুর তাঁর শুদ্ধ ভাবনা কৃষ্ণভক্তি-ভাব রক্ষা করে ভগবানের সম্মুখে প্রণত হল, এবং করজোড়ে কম্পিত স্বরে ভগবানের উদ্দেশ্যে স্তব করতে শুরু করল।

 

আরও পড়ুন

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
৩২. অক্রুরের বৃন্দাবনে আগমন
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url