যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণ পত্নীদের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের অনুগ্রহ-শ্রীকৃষ্ণ লীলা-কৃষ্ণ কথা


 যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণ পত্নীদের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের অনুগ্রহ

সেদিন সারা সকাল তাদের খাওয়া হয়নি, তাই গােপবালকেরা ক্ষুদায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছিলেন। তারা তখন কৃষ্ণ ও বলরামের কাছে গিয়ে বললেন, “প্রিয় কৃষ্ণ ও বলরাম, তােমরা উভয়েই সর্বশক্তিমান; 

তােমরা মহা বলশালী, তােমরা সমস্ত' অসুরকে হত্যা করতে পার। এখন আমরা ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছি, দয়া করে আমাদের এই ক্ষুধা নিবৃত্তি করার কোন ব্যবস্থা কর।"

তাদের বন্ধুরা তাদের এইভাবে অনুরােধ করলে, কৃষ্ণ ও বলরাম তখন যজ্ঞ অনুষ্ঠানে রত কয়েকজন ব্রাহ্মণের পত্নীদের প্রতি কৃপাপ্রদর্শন করলেন।

এই সমস্ত দ্বিজপত্নীরা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের মহান ভক্ত এবং এই সুযােগে শ্রীকৃষ্ণ তাদের কৃপা করলেন। তিনি তাঁর সখাদের বললেন, "প্রিয় সখারা, তােমরা নিকটবর্তী ব্রাহ্মণদের বাড়িতে যাও।

তারা এখন স্বর্গলােকে উন্নীত হওয়ার জন্য আঙ্গিরস নামক বৈদিক যজ্ঞ অনুষ্ঠান করছেন। তােমরা সেখানে যাও।” তারপর শ্রীকৃষ্ণ তার সখাদের সাবধান করে দিয়ে বললেন,

"এই সমস্ত ব্রাহ্মাণেরা বৈষ্ণব নয়। তারা আমার নাম, কৃষ্ণ' উচ্চারণ করতে পারেন না। তারা বৈদিক মন্ত্র পাঠ করতে অত্যন্ত ব্যস্ত, কিন্তু তারা জানে না যে, সমস্ত বৈদিক জ্ঞানের উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাকে জানা।

 কিন্তু আমার নামের প্রতি যেহেতু তাদের কোন আকর্ষণ নেই, তাই তােমরা বরং আমার নাম করে তাদের কাছে কিছু প্রার্থনা করাে না। পক্ষান্তরে বলরামের নাম করে তাদের কাছে ভিক্ষা চাইলে ভাল হবে।"

দান সাধারণত অতি উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণকে করা হয়, কিন্তু কৃষ্ণ ও বলরাম ব্রাহ্মণ পরিবারে আবির্ভূত হননি। বলরাম ক্ষত্রিয় রাজা বসুদেবের পুত্র বলে পরিচিত ছিলেন এবং বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণকে সকলেই নন্দ মহারাজের পুত্র বলে জানতেন, যিনি ছিলেন বৈশ্য। তাদের দুজনের কেউই ব্রাহ্মণ পরিবারভুক্ত ছিলেন না।

তাই শ্রীকৃষ্ণ ভাবলেন যে, যজ্ঞ অনুষ্ঠানরত ব্রাহ্মণেরা কোন বৈশ্যকে হয়ত কিছু দান করতে চাইবেন না। তাই শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সখাদের বললেন, 

"কিন্তু তােমরা যদি অন্তত বলরামের নাম নাও, তা হলে তারা কিছু দান করলেও করতে পারেন, কেননা বলরাম হচ্ছেন ক্ষত্রিয়, আর আমি হচ্ছি বৈশ্য, তাই আমার নাম নিলে ওরা হয়ত কিছুই দান করবেন না।”

এইভাবে পরমেশ্বর ভগবানের দ্বারা আদিষ্ট হয়ে গােপবালকেরা ব্রাহ্মণদের কাছে গিয়ে কিছু দান ভিক্ষা করলেন। শ্রদ্ধাসহকারে দণ্ডবৎ প্রণাম করে তারা বললেন, 

“হে পৃথিবীর দেবগণ, কৃপা করে আপনারা আমাদের কথা শুনুন। কৃষ্ণ ও বলরামের আদেশে আমরা এখানে এসেছি। আমরা আশা করি যে, আপনারা তাদের খুব ভালভাবে চেনেন, এবং আমরা আপনাদের সর্ববিধ সৌভাগ্য কামনা করি। 

নিকটেই কৃষ্ণ ও বলরাম গােচারণ করছেন এবং আমরাও তাঁদের সঙ্গে  এসেছি। আমরা আপনাদের কাছে এসেছি কিছু অন্ন ভিক্ষা করার জন্য। 

সমস্ত ধর্ম-অনুষ্ঠান বিষয়ে আপনারা অত্যন্ত পারদর্শী এবং আপনারা যদি মনে করেন যে, আমাদের কিছু অন্ন দান করা আপনাদের কর্তব্য, তা হলে দয়া করে আমাদের তা দিন।

তা হলে কৃষ্ণ ও বলরামের সঙ্গে আমরা তা আহার করব। আপনারা হচ্ছেন মানব-সমাজে সব চাইতে সম্মানিত ব্রাহ্মণ এবং সমস্ত ধর্ম-তত্ত্ব আপনাদের জানা আছে।"

যদিও সেই গােপবালকেরা ছিলেন সাধারণ গ্রামের ছেলে তাই তাদের বৈদিক ধর্মতত্ত্ব জানার কথা নয়, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের সঙ্গ করার ফলে তারা সমস্ত তত্ত্ব অবগত ছিলেন। 

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম যখন কোন কিছু খেতে চাইতেন, সেই গােপবালকেরা তৎক্ষণাৎ তাদের জন্য তা যােগাড় করে আনতেন। ভগবদগীতায় বলা হয়েছে যে, যজ্ঞ-অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিসাধন করা।

বালকেরা বলতে লাগলেন, "কৃষ্ণ ও বলরাম রূপে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণু স্বয়ং আপনাদের থেকে দান গ্রহণ করবার জন্য প্রতীক্ষা করছেন এবং আপনাদের কর্তব্য হচ্ছে যা কিছু খাদ্য-সামগ্রী আপনাদের কাছে রয়েছে, তা সবই তার উদ্দেশ্যে অর্পণ করা।"

তারা ব্রাহ্মণদের আরও বােঝালেন যে, কিভাবে খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করতে হয়। সচরাচর বৈষ্ণব বা ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত সাধারণ যজ্ঞ-অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করেন না। 

কিন্তু বিশেষ যজ্ঞের অন্ন তারা কখনও কখনও গ্রহণ করে থাকেন। তাই গােপবালকেরা বললেন, “হে সজ্জন শ্রেষ্ঠ দীক্ষা আরম্ভ করে যজ্ঞে পশুবধের পূর্ব পর্যন্ত দীক্ষিতের দোষ হয়।

আর তা ছাড়া ইন্দ্রদেবতার যজ্ঞ ব্যতীত অন্য যজ্ঞে দীক্ষিত জনের অন্ন ভােজন করলে দোষ হয় না বলেই তারা আপনাদের অন্ন প্রার্থনা করেছে।

কৃষ্ণ ও বলরামের সহচরেরা যদিও ছিলেন সাধারণ গােপবালক, তবুও বৈদিক কর্মকাণ্ডীয় যজ্ঞ অনুষ্ঠানে রত অতি উন্নত ব্রাহ্মণদেরও ধর্ম সম্বন্ধে উপদেশ দেওয়ার যােগ্যতা তাঁদের ছিল। 

কিন্তু সেই স্মার্ত ব্রাহ্মণেরা, যারা কেবল অনুষ্ঠান করাটাই পরম ধর্ম বলে মনে করেছিলেন, তারা পরমেশ্বর ভগবানের ভক্তদের উপদেশ হৃদয়ঙ্গম করতে পারলেন না। 

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম যে তাঁদের কাছে অন্ন প্রার্থনা করেছেন, সেটা পর্যন্ত যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারলেন না।

কৃষ্ণ ও বলরামের তত্ত্ব সম্বন্ধে যদিও তারা সব রকমের যুক্তি ও প্রমাণ শুনেছিলেন, কিন্তু তবুও তারা তাদের অবহেলা করলেন এবং মৌন অবলম্বন করে সেই গােপবালকদের সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকার করলেন।

বৈদিক কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে তাদের অনেক জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও এই ধরনের অভক্ত ব্রাহ্মণেরা, যদিও নিজেদের অতি উন্নত স্তরের মানুষ বলে মনে করেন, কিন্তু আসলে তারা মুর্খ এবং নির্বোধ।

তাদের সমস্ত কার্যকলাপই অর্থহীন, কেননা তারা বৈদিক জ্ঞানের যথার্থ উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কিছুই জানেন না, যে সম্বন্ধে বলা সমস্ত বেদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকে জানা। 

বেদের আচার অনুষ্ঠান সম্বন্ধে এই ব্রাহ্মণদের যথেষ্ট জ্ঞান থাকলেও শ্রীকৃষ্ণকে জানেন না; তাই তাদের বৈদিক জ্ঞান কেবল আনুষ্ঠানিক জ্ঞান ছাড়া আর কিছুই নয়।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু উপদেশ দিয়ে গেছেন, বিপ্র ন্যাসি কেনে নয়। যেই সেই গুরু হয় যিনি তার যদি ব্রাহ্মণকুলে জন্ম নাও হয়, তবুও তিনি ব্রাহ্মণদের থেকে অনেক উচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত এবং তিনি ব্রাহ্মণদেরও গুরু হওয়ার যােগ্য।

যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার সময় দেশ, কাল, পৃথক দ্রব্য, মন্ত্র, তন্ত্র, অগ্নি দেবতা, যজমান, ক্রতু এবং ধর্ম আদি বিষয়গুলি আয়ােজন করা হয়। 

এই সবই শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টিবিধানের জন্য। বেদে বলা হয়েছে যে, পরমেশ্বর ভগবান পরমতত্ত্ব অধােক্ষজ শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সমস্ত যজ্ঞের প্রকৃত ভােক্তা। আর এখানে তিনি একজন সাধারণ মানবশিশুরূপে আবির্ভূত হয়েছে। 

তাই যারা তাঁর দ্বিভুজ মনুষ্য রূপই কেবল দর্শন করল, তারা তাকে জানতে পারল না। সেই সমস্ত ব্রাহ্মণেরা ছিলেন দেহসুখের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত এবং তাদের একমাত্র আকাক্ষা ছিল স্বর্গলােকে গিয়ে সুখভােগ করা। তাই তারা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে চিনতে পারলেন না।

গােপবালকেরা যখন দেখলেন যে, ব্রাহ্মণেরা তাঁদের সঙ্গে কথা বলবে না, তখন তারা অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। তারা তখন কৃষ্ণ ও বলরামের কাছে ফিরে গিয়ে সমস্ত ঘটনা তাদের কাছে খুলে বললেন। 

তাদের কথা শুনে পরমেশ্বর ভগবান ঈষৎ হেসে তাঁদের বললেন, “ব্রাহ্মণদের কাছে ভিক্ষা চাইতে গিয়ে তােমরা যে নিরাশ হয়েছ, সেই জন্য তােমাদের দুঃখ করা উচিত নয়। 

কেননা ভিক্ষার রীতিই হচ্ছে এটা। ভিক্ষা করতে গিয়ে আমাদের মনে করা উচিত নয় যে, আমরা সব জায়গাতেই কৃতকার্য হব। কোন কোন জায়গায় আমরা ভিক্ষা পাব না, কিন্তু তা বলে আমাদের মর্মাহত হওয়া উচিত নয়।”

শ্রীকৃষ্ণ তখন তার গােপসখাদের আবার সেখানে যেতে বললেন, কিন্তু এবার ব্রাহ্মণদের কাছে ভিক্ষা না চেয়ে তাঁদের পত্নীদের কাছে ভিক্ষা চাইতে বলে দিলেন।

তিনি তাদের আরও বললেন যে, এই সমস্ত দ্বিজপত্নীরা হচ্ছেন তাঁর মহান ভক্ত। তিনি বললেন, তারা সব সময়ই আমাদের চিন্তায় মগ্ন। যাও, সেখানে গিয়ে আমার আর বলরামের নাম করে অন্ন প্রার্থনা কর, তারা তােমাদের প্রচুর অন্ন দান করবেন।”

শ্রীকৃষ্ণের আদেশ অনুসারে বালকেরা তৎক্ষণাৎ দ্বিজ-পত্নীদের কাছে গেলেন। তাঁরা দেখলেন যে, সেই দ্বিজপত্নীরা তাঁদের বাড়ির ভেতরে বসে আছেন। 

তাঁরা সকলেই খুব সুন্দর অলঙ্কারে ভূষিতা ছিলেন। শ্রদ্ধা সহকারে তাদের প্রণাম জানিয়ে বালকেরা বললেন, “আপনারা আমাদের প্রণাম গ্রহণ করুন এবং আমাদের বিনীত নিবেদন শ্রবণ করুন। 

এই স্থানের অদূরে কৃষ্ণ এবং বলরাম তাঁদের গাভী নিয়ে ভ্রমণ করতে করতে আমাদের এখানে পাঠিয়েছেন। আমরা সকলেই ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছি, তাই আমরা আপনাদের কাছে অন্ন প্রার্থনা করতে এসেছি। দয়া করে কৃষ্ণ-বলরাম এবং আমাদের জন্য কিছু অন্ন দান করুন।”

সেই কথা শুনেই তৎক্ষণাৎ দ্বিজপত্নীরা শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের জন্য অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলেন। তাদের এই আবেগ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হল।

কৃষ্ণ এবং বলরাম যে পরমেশ্বর ভগবান, সেই সম্বন্ধে তাদের প্রত্যয় উৎপাদন করার কোন প্রয়ােজন ছিল না। তাঁদের নাম শােনামাত্রই তাঁদের দর্শন করবার জন্য তারা আকুল হয়ে উঠলেন।

নিরন্তর শ্রীকৃষ্ণের কথা চিন্তা করার ফলে তাঁরা সর্বোচ্চ স্তরের ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। সমস্ত দ্বিজপত্নীরা তখন বিভিন্ন পাত্রে নানা রকম সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্য ভরে নিলেন। 

যজ্ঞ অনুষ্ঠানের জন্য নানা রকমের সুস্বাদু খাদ্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। সেই সমস্ত খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করে তারা তাদের পরম প্রেমাস্পদ শ্রীকৃষ্ণের কাছে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। 

নদী যেভাবে সমুদ্রের প্রতি ধাবিত হয়, ঠিক সেইভাবে তারা কৃষ্ণ এবং বলরামকে দর্শন করবার জন্য ধাবিত হলেন।

দ্বিজপত্নীরা বহুকাল ধরে শ্রীকৃষ্ণের দর্শন করবার জন্য আকুল হয়ে ছিলেন। কিন্তু যখন তারা তাঁকে দর্শন করবার জন্য গৃহ থেকে বেরােবার আয়ােজন করছিলেন, তখন তাদের পতি, পিতা, পুত্র এবং সমস্ত আত্মীয়-স্বজনেরা নিষেধ করতে লাগলেন। 

কিন্তু তারা সেই নিষেধ শুনলেন না। শ্রীকৃষ্ণের আকর্ষণে অধীর হয়ে ভক্ত যখন তার কাছে যাওয়ার জন্য আকুল হয়ে ওঠেন, তখন তিনি কোন রকম জড় বন্ধন গ্রাহ্যই করেন না। 

দ্বিজপত্নীরা যমুনার উপকুলে অশােক বৃক্ষের নব পল্লবে সুশােভিত বৃন্দাবনের বনে প্রবেশ করলেন। সেই বনে তাঁরা গােপসখাসহ গােচারণরত কৃষ্ণ এবং বলরামকে দর্শন করলেন। 

krishna Photo

দ্বিজপত্নীরা উজ্জ্বল পীত বসন পরিহিত শ্রীকৃষ্ণকে দেখলেন। গলায় তাঁর অতি সুন্দর বনফুলের মালা এবং মাথায় ময়ূরপুচ্ছ শােভা পাচ্ছে। ধাতু এবং প্রবাল দ্বারা নটবর বেশে সজ্জিত হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন।

তাঁর এক হাত তার এক সহচরের কাঁধে এবং তার অপর হাতে তিনি লীলাকমল ধারণ করেছিলেন। তার কর্ণদ্বয়ে উৎপল, কপােলযুগলে অলকা, তার শ্রীঅঙ্গে তিলক এবং মুখপদ্মে সুমধুর হাস্য শােভা পাচ্ছিল। 

দ্বিজপত্নীরা স্বচক্ষে পরমেশ্বর ভগবানকে দর্শন করলেন। যাঁর কথা তারা বহুবার শুনেছেন, যিনি ছিলেন তাদের অতি প্রিয় এবং যার ধ্যানে চিত্ত সর্বদাই সমাহিত ছিল।

এখন তারা তার মুখােমুখি হয়ে তাকে দর্শন করলেন এবং তাদের নয়নপথ দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের হৃদয়ে প্রবেশ করলেন। 

তাঁরা প্রাণভরে শ্রীকৃষ্ণকে আলিঙ্গন করতে লাগলেন এবং তার ফলে তাদের বিরহ বেদনা বিদুরিত হল। মহান ঋষিরা যেমন পরমাত্মাকে আলিঙ্গন করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাইরের কিছুই গ্রাহ্য করেন না,

তেমনই তারাও শ্রীকৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন। পরমাত্মারূপে সকলের হৃদয়ে বিরাজমান শ্রীকৃষ্ণ জানতেন যে, তাঁরা তাঁদের আত্মীয়স্বজন পিতা, পতি, ভাই, বন্ধু সকলের নিষেধ সত্ত্বেও এবং নানা রকম গৃহকর্ম সত্ত্বেও তাঁর কাছে এসেছিলেন।

তারা কেবল তাঁদের প্রাণনাথকে দর্শন করতে এসেছিলেন। ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ, সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ অর্থাৎ সব রকমের ধর্ম এবং কর্তব্য আদি পরিত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়াটাই হচ্ছে পরম ধর্ম। তারা সেই নির্দেশই অনুসরণ করছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে, দ্বিজপত্নীরা সর্বতােভাবে ভগবদগীতার নির্দেশ পালন করেছিলেন। এখানে একটা বিষয় দ্রষ্টব্য—শ্রীকৃষ্ণ যদিও দ্বিজপত্নীদের হৃদয়ে প্রবেশ করেছিলেন এবং তারা তাঁকে আলিঙ্গন করে তার মধ্যে আত্মহারা হয়ে যাওয়ার দিব্য আনন্দ অনুভব করেছিলেন,

কিন্তু তা হলেও পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার স্বরূপ হারিয়ে ফেলেননি এবং সেই দ্বিজপত্নীরাও তাদের স্বরূপ হারিয়ে ফেলেননি। ভগবান এবং দ্বিজপত্নীদের উভয়ের সত্তাই বর্তমান ছিল,

যদিও তারা ভগবানের সঙ্গে তাদের অস্তিত্বের এককত্ব অনুভব করেছিলেন। প্রেমিকা যখন সব রকমের স্বার্থ ত্যাগ করে প্রেমিকের কাছে আত্মনিবেদন করে, তখন সেটাও হচ্ছে এক রকমের এককত্ব।

এই এককত্বের অনুভূতি সম্বন্ধে শিক্ষা দিয়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শিক্ষাষ্টকে বলেছেন, যথা তথা বা বিদধাতু লম্পটো মৎ প্রাণনাথস্ত স এব নাপরঃ'। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সম্পূর্ণ স্বাধীন।

তিনি তার ইচ্ছামতাে যা কিছু করতে পারেন, কিন্তু ভক্ত সর্বদাই তাঁর ইচ্ছার অধীন। ভগবানের চরণে এই যে প্রপত্তি, এটাই হচ্ছে এককত্ব যা দ্বিজপত্নীরা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাদের ভালবাসার মাধ্যমে প্রদর্শন করেছিলেন।

শ্রীকৃষ্ণ তাদের আহ্বান করে বললেন, “হে দ্বিজপত্নীগণ, তােমরা সকলেই অত্যন্ত সৌভাগ্যবর্তী এবং আমি তােমাদের স্বাগত জানাই, দয়া করে আমাকে বল, আমি তােমাদের জন্য কি করতে পারি।

তােমাদের আত্মীয়স্বজন পিতা, পতি, ভাই এদের সকলের নিষেধ উপেক্ষা করে তােমরা যে এখানে আমাকে দর্শন করতে এসেছ, তা তােমাদের সঙ্গতই হয়েছে। যিনি তা করেন, তিনি জানেন কিসে তার যথার্থ মঙ্গল হবে, কেন না ভক্তিসহকারে আমার প্রতি অহৈতুকী এবং অপ্রতিহত সেবাই জীবের যথার্থ মঙ্গলসাধন করে।"

শ্ৰীকৃষ্ণ এখানে প্রতিপন্ন করেছেন যে, জীবনের পরম পূর্ণতা হচ্ছে তার শরণাগত হওয়া। অন্য সমস্ত কর্তব্য এবং দায়দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে সর্বতােভাবে আত্মনিবেদন করাই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্য, কেননা পরমেশ্বর ভগবানই হচ্ছেন প্রতিটি জীবের পরম প্রেমাস্পদ।

প্রকৃতপক্ষে, সকলেই শ্রীকৃষ্ণকে ভালবাসেন কিন্তু ভগবত্তত্ত্বজ্ঞানের মাত্রা অনুসারে তা উপলব্ধি করা যায়। কেউ যখন জানতে পারেন যে, 

তিনি হচ্ছেন চিন্ময় আত্মা এবং সেই চিন্ময় আত্মা হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের বিভিন্ন অংশ, তাই পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন প্রেমের পরম লক্ষ্য, এইভাবে উপলব্ধি করে কেউ যখন তাঁর চরণে আত্মনিবেদন করেন, তখন জীবের পরম মঙ্গল সাধিত হয়। 

আমাদের জীবন, ধনসম্পদ, গৃহ, পত্নী, পুত্র-কন্যা, দেশ, সমাজ এবং অন্য যা কিছু আমাদের অত্যন্ত প্রিয়, তা সবই পরমেশ্বর ভগবানেরই প্রকাশ। 

তিনিই হচ্ছেন আমাদের প্রেমের কেন্দ্রবিন্দু, কেননা তিনিই বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয়ে আমাদের বিভিন্ন অবস্থা অনুসারে অর্থাৎ দৈহিক, মানসিক অথবা আত্মিক স্তর অনুসারে আমাদের আনন্দ প্রদান করে থাকেন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “হে প্রিয় দ্বিজপত্নীগণ, তােমরা এখন বাড়ি ফিরে যাও। 

সেখানে গিয়ে যজ্ঞ অনুষ্ঠানে তােমাদের পতিদের সহযােগিতা কর। এখন গৃহ- কর্ম পরিচালনা কর যাতে তােমাদের পতিরা তােমাদের প্রতি প্রসন্ন হন এবং যাতে যে যজ্ঞ-অনুষ্ঠান তাঁরা শুরু করেছেন, তা যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়। 

তােমাদের পতিরা হচ্ছেন গৃহস্থ এবং তােমাদের সাহায্য ছাড়া তাঁরা কিভাবে তাঁদের কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করবেন?" দ্বিজপত্নীরা উত্তর দিলেন, “হে প্রভু, এই ধরনের নির্দেশ আপনার উপযুক্ত নয়। 

আপনি প্রতিজ্ঞা করেছেন যে, আপনি সব সময় আপনার ভক্তদের রক্ষা করবেন। তাই এখন আপনার সেই প্রতিজ্ঞা আপনাকে পালন করতে হবে। 

একবার যে আপনার কাছে আত্মনিবেদন করেছে, তাকে আর জড় জগতের বদ্ধ জীবনে ফিরে যেতে হয় না। আমরাও তাই আশা করি যে, আপনি আপনার প্রতিজ্ঞা এখন পূর্ণ করবেন। 

আমরা সর্বতােভাবে তুলসী পত্রশােভিত আপনার শ্রীপাদপদ্মে আত্মনিবেদন করেছি। তাই আর আমাদের তথাকথিত আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং সমাজের কাছে আপনার শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় পরিত্যাগ করে আমরা ফিরে যেতে চাই না।

আর ঘরে ফিরে আমরা কিই বা করব? আমাদের পতি, পুত্র, পিতা, মাতা, ভাই, বন্ধু এরা কেউই আর আমাদের দর্শন করতে চায় না, কেননা আমরা তাদের সকলকে ত্যাগ করে চলে এসেছি। 

তাই ফিরে যাওয়ার মতাে কোন আশ্রয় আর আমাদের নেই। দয়া করে তাই আপনি আর আমাদের ঘরে ফিরে যেতে বলবেন না, পক্ষান্তরে আপনার আশ্রয়ে, আপনার শ্রীপাদপদ্মে যেন আমরা নিত্যকাল অবস্থান করতে পারি, সেই ব্যবস্থা করুন।"


 

পরমেশ্বর ভগবান উত্তর দিলেন, “প্রিয় দ্বিজপত্নীগণ, তােমরা নিশ্চিন্ত থাক যে, তােমরা ফিরে গেলে তােমাদের পতিরা তােমাদের অবহেলা করবেন না এবং তােমাদের সাদরে গ্রহণ করবেন।

যেহেতু তােমরা হচ্ছ আমার শুদ্ধ ভক্ত, তাই কেবল তােমাদের আত্মীয়-স্বজনেরাই নয়, সমস্ত মানুষ এমন কি স্বর্গের দেবতারাও তােমাদের প্রতি প্রসন্ন হবেন। পরমাত্মারূপে শ্রীকৃষ্ণ সকলেরই হৃদয়ে বিরাজমান, তাই কেউ যখন শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত হন, তখন তিনি সকলেরই প্রিয় হন। 

ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত কারও প্রতি শত্রুভাবাপন্ন নন। কোন সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন মানুষ ভগবানের শুদ্ধ ভক্তের সঙ্গে শত্রুতা করতে পারে না। শ্রীকৃষ্ণ আরও বললেন, আমার প্রতি দিব্য প্রেম দেহ সম্বন্ধযুক্ত নয়, কিন্তু যার চিত্ত সর্বদাই আমাতে সমর্পিত, তিনি অবশ্যই অতি শীঘ্র আমার সঙ্গলাভ করার জন্য আমার কাছে আসবেন।”

পরমেশ্বর ভগবানের দ্বারা এইভাবে আদিষ্ট হয়ে সমস্ত দ্বিজপত্নীরা তাদের গৃহে তাদের পতিদের কাছে ফিরে গেলেন। তাদের পত্নীদের ফিরে আসতে দেখে ব্রাহ্মণেরা অত্যন্ত প্রীত হলেন এবং শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে একত্রে উপবেশন করে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করলেন।

বৈদিক নীতি অনুসারে পতি এবং পত্নীকে মিলিতভাবে ধর্ম-অনুষ্ঠান করতে হয়। দ্বিজপত্নীরা যখন ফিরে এলেন, তখন যথাযথভাবে যজ্ঞ সম্পাদন হল। 

একজন দ্বিজপত্নী শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করতে যেতে পারেননি, কেননা তাকে জোর করে ধরে রাখা হয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণ যে নিকটেই প্রতীক্ষা করছেন, সেই কথা শুনে এবং তার চিন্তায় সর্বতােভাবে মগ্ন হয়ে তিনি জড়া প্রকৃতির নিয়মের দ্বারা আবদ্ধ তার জড় দেহটি ত্যাগ করে চলে গেলেন।

নিত্য আনন্দময় পরমেশ্বর ভগবান গােবিন্দ একজন সাধারণ মানুষরূপে তাঁর অপ্রাকৃত লীলাবিলাস করেছিলেন এবং দ্বিজপত্নীদের নিবেদিত খাদ্যদ্রব্য উপভােগ করেছিলেন।

এইভাবে তিনি সাধারণ মানুষদের তার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলেন। তিনি গাভীদের, গােপবালকদের এবং বৃন্দাবনের গােপবধূদের তার বাণীর প্রতি এবং তার সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট করেছিলেন।

দ্বিজপত্নীরা যখন শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে ফিরে গেলেন, তখন যজ্ঞ-অনুষ্ঠানে রত ব্রাহ্মণেরা পরমেশ্বর ভগবানকে অন্নদান করতে অস্বীকার করার পাপের জন্য অনুশােচনা করতে লাগলেন। 

অবশেষে তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। বৈদিক কর্মকাণ্ডীয় অনুষ্ঠানে মগ্ন থেকে তারা পরমেশ্বর ভগবানকে অবহেলা করেছিলেন—যিনি একজন মানুষের রূপ পরিগ্রহ করে এই জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাদের কাছে অন্ন প্রার্থনা করেছিলেন। 

তাঁদের পত্নীদের বিশ্বাস এবং ভক্তি দেখে তারা নিজেদের ধিক্কার দিতে লাগলেন। তাদের গভীর অনুতাপ হল যে, যদিও তাদের পত্নীরা শুদ্ধ ভক্তির স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন, তবুও তারা বুঝতে পারলেন না কিভাবে পরমেশ্বর ভগবানকে ভালবাসতে হয়।

 তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন, “ধিক আমাদের ব্রাহ্মণত্ব! ধিক্‌ আমাদের বৈদিকশাস্ত্রজ্ঞান! ধিক্ আমাদের যজ্ঞ অনুষ্ঠান এবং শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধের অনুষ্ঠান।

ধিক্ আমাদের পরিবার পরিজন। এ সমস্তই ধিক্, আমাদের হৃদয়ে দেহ, মন এবং ইন্দ্রিয়ের অগােচর পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি প্রেমের উদয় হয়নি।

এই সমস্ত শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা যদিও বৈদিক আচার অনুষ্ঠানে অত্যন্ত সুদক্ষ ছিলেন, তাঁরা যথার্থভাবেই অনুশােচনা করেছিলেন। 

কেননা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেমভক্তির উদয় যদি না হয়, তা হলে সমস্ত ধর্ম-অনুষ্ঠানই কেবল সময় এবং শক্তির অপচয়মাত্র। তারা পরস্পরের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন, "ভগবানের মায়া এতই প্রবল যে, তা মহান যােগীদেরও মােহিত করে, যদিও আমরা শাস্ত্রনিপুণ ব্রাহ্মণেরা, 

মানব-সমাজের অন্য সমস্ত বর্ণের গুরু বলে বিবেচিত হই, সেই আমরাও ভগবানের মায়ার দ্বারা মােহিত হয়েছি। কিন্তু দেখ, এই স্ত্রীরা কত সৌভাগ্যবতী!

তারা কত ঐকান্তিকভাবে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে। তারা অনায়াসে তাদের পরিবারের বন্ধন ত্যাগ করতে পেরেছে যা অত্যন্ত কঠিন। সংসার-জীবন একটা অন্ধকূপের মতাে, কেননা সেখানে নিরন্তর জড়জাগতিক দুঃখ ভােগ করতে হয়।”

স্ত্রীলােকেরা সাধারণত সরল চিত্ত বলে অতি অনায়াসে কৃষ্ণভক্তি অবলম্বন করতে পারেন এবং কৃষ্ণপ্রেম বিকশিত করে অনায়াসে মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারেন যা তথাকথিত অতি বুদ্ধিমান ও পণ্ডিত পুরুষদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। 

বৈদিক নির্দেশ অনুসারে স্ত্রীলােকেরা দীক্ষার মাধ্যমে সংস্কৃত হয়ে যজ্ঞ উপবীত ধারণ করতে পারেন না এবং তারা ব্রহ্মচারিণীরূপে গুরুর আশ্রমে বাস করতে পারেন না; এমন কি কঠোর নিয়মকানুনগুলি পালন করতেও তাঁদের নিষেধ আছে। আর তারা তত্ত্বদর্শন বা আত্মােপলব্ধি সম্বন্ধে আলােচনা করতেও সুদক্ষ নন।

প্রকৃতিগতভাবেও তারা বিশেষ পবিত্র নন এবং শুভ কর্ম অনুষ্ঠানের প্রতিও তাঁরা বিশেষ আকৃষ্ট নন। তাই ব্রাহ্মণেরা বিস্ময়ভরে বললেন, "কী আশ্চর্য! তারা যােগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের প্রতি দিব্য প্রেম লাভ করেছে। 

তাদের ভক্তিবলে এবং তাদের সুদৃঢ় বিশ্বাসের ফলে তারা আমাদের সকলকে ছাড়িয়ে গেছে। জড়জাগতিক জীবনের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত হয়ে আমরা বুঝতে পারিনি জীবনের যথার্থ উদ্দেশ্য কি! যদিও সকলেই মনে করে যে, আমরা হচ্ছি সমস্ত সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।

 গােপবালকেরা আমাদের কৃষ্ণ ও বলরামের কথা জানিয়েছিল, কিন্তু তাদের কথা আমরা শুনিনি। আমরা এখন বুঝতে পারছি যে, পরমেশ্বর ভগবান তার সখাদের পাঠিয়ে আমাদের কাছ থেকে অন্ন ভিক্ষা করে আমাদের প্রতি কৃপা প্রদর্শন করতে চেয়েছিলেন।

নয়ত আমাদের কাছে তাদের পাঠাবার তার কি প্রয়ােজন ছিল। তিনি কেবল তার ইচ্ছাশক্তির দ্বারাই তাদের ক্ষুধার নিবৃত্তি করতে পারতেন।”

শ্রীকৃষ্ণ তার জীবনধারণের জন্য গােপালন করছিলেন, এই কথা শুনে কেউ যদি কৃষ্ণের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অস্বীকার করেন, অথবা কেউ যদি মনে করেন যে তিনি খাবার চেয়ে পাঠিয়েছিলেন বলে তিনি সত্যি সত্যিই ক্ষুধার্ত ছিলেন, তা হলে তাদের এটা বিবেচনা করা উচিত যে,

সৌভাগ্যলক্ষ্মী সর্বদাই শ্রীকৃষেগ্র সেবায় রত। ভগবানকে সেবা করার ফলেই চঞ্চলা লক্ষ্মী অচঞ্চলা হন। ব্রহ্মসংহিতা আদি বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, শত সহস্র লক্ষ্মী সমভরে ভগবানের ধামে ভগবানের সেবা করছে।

তাই কেউ যদি মনে করেন যে, শ্রীকৃষ্ণ অভাবে পড় ব্রাহ্মণদের কাছে ভিক্ষা করেছিলেন, তা হলে সেটা তার অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। 

প্রকৃতপক্ষে, তিনি এই ছলনা করেছিলেন যাতে শুদ্ধ ভক্তি সহকারে তারা তাকে গ্রহণ করতে পারে। তা ছিল তাদের প্রতি তার অহৈতুকী কৃপারই প্রকাশ।

বৈদিক যজ্ঞ অনুষ্ঠানের সমস্ত সামগ্রী-উপযুক্ত স্থান, উপযুক্ত কাল, পৃথক দ্রব্য, বৈদিক মন্ত্র, যজ্ঞ অনুষ্ঠান, ঋত্বিক, অগ্নি, দেবতা, যজমান এবং ধর্ম—এই সবই শ্রীকৃষ্ণকে জানবার জন্য কেননা শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। তিনিই হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান বিষ্ণু। তিনিই হচ্ছেন সমস্ত যােগীদের ঈশ্বর।

ব্রাহ্মণেরা বললেন, "যেহেতু তিনি যদুকুলে একজন শিশুরূপে আবির্ভূত হয়েছেন, তাই মুর্খ আমরা জানতে পারলাম না যে, তিনিই হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। 

কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা গর্ব অনুভব করছি কেননা আমাদের পত্নীরা এত উন্নত যে, তারা আমাদের গোঁড়ামি সত্ত্বেও ভগবানের প্রতি শুদ্ধ ভক্তি লাভ করেছে। 

তাই আমরা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে শ্রদ্ধাবনত প্রণতি জানাই, যার মায়াশক্তির প্রভাবে আমরা সকাম কর্মে মগ্ন হয়ে আছি। 

তাই আমরা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন কৃপাপরবশ হয়ে আমাদের ক্ষমা করেন, কেননা আমরা তাঁর বহিরঙ্গা শক্তির প্রভাবে মােহিত হয়ে পড়েছি। আমরা তার অপ্রাকৃত মহিমা না জেনে তার আদেশ অমান্য করেছি।

এইভাবে ব্রাহ্মণেরা তাদের পাপকর্মের জন্য অনুশোচনা করতে লাগলেন। তারা শ্রীকৃষ্ণকে তাদের প্রণতি জানাবার জন্য তার কাছে যেতে ইচ্ছা করলেন, কিন্তু কংসের ভয়ে ভীত হয়ে তারা যেতে পারলেন না। 

পক্ষান্তরে, বলা যায় ভক্তিযুক্ত সেবার মাধ্যমে সর্বতােভাবে পবিত্র না হয়ে পরমেশ্বর ভগবানের চরণে আত্মনিবেদন করা অত্যন্ত কঠিন। 

সেই সম্পর্কে সর্বশাস্ত্র বিশারদ ব্রাহ্মণ এবং তাদের পত্নীরাই হচ্ছে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। দ্বিজপত্নীরা যেহেতু শুদ্ধ ভক্তির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তাই তারা কোন রকম প্রতিবন্ধকের পরােয়া করেননি; 

তাঁরা তৎক্ষণাৎ শ্রীকৃষ্ণের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণেরা ভগবানের পরমেশ্বরত্ব সম্বন্ধে অবগত হওয়া সত্ত্বেও এবং তাঁর প্রতি তাদের অপরাধের জন্য অনুশােচনা করা সত্ত্বেও কংসের ভয়ে ভীত হয়ে তারা তার কাছে যেতে পারলেন না, কেননা তারা জড় সুখভােগের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত ছিলেন।

 

আরও পড়ুনঃ 

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url