ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে দেবরাজ ইন্দ্রের প্রার্থনা-কৃষ্ণ লীলা কথা

 
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে দেবরাজ ইন্দ্রের প্রার্থনা

 দেবরাজ ইন্দ্রের প্রার্থনা-কৃষ্ণ লীলা কথা

শ্রীকৃষ্ণ যখন গিরি গােবর্ধন ধারণ করে ইন্দ্রের ক্রোধ থেকে বৃন্দাবন বাসীদের রক্ষা করলেন, তখন দেবরাজ ইন্দ্র এবং গােলােক বৃন্দাবন থেকে সুরভী গাভী তার কাছে এসে উপস্থিত হল।

 স্বর্গের দেবতাদের রাজা ইন্দ্র বুঝতে পেরেছিলেন যে, শ্রীকৃষ্ণের চরণে তিনি মস্ত বড় অপরাধ করে ফেলেছে; তাই তিনি নির্জনে শ্রীকৃষ্ণের সামনে এসে উপস্থিত হলেন। এসেই তিনি শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মে পতিত হলেন যদিও তার মাথায় সূর্যের মতাে দীপ্তিময় মুকুট শােভা পাচ্ছিল। 

ইন্দ্র শ্রীকৃষ্ণের প্রভাব সম্বন্ধে অবগত ছিলেন, কেননা শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন প্রভু, কিন্তু ইন্দ্র প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি যে, শ্রীকৃষ্ণ এইভাবে বৃন্দাবনে সাধারণ গােপেদের সঙ্গে একজন সাধারণ নরশিশুর মতাে লীলাবিলাস করতে পারেন। 

শ্রীকৃষ্ণ যখন ইন্দ্রের আধিপত্য অস্বীকার করলেন, তখন ইন্দ্র ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন, কেননা তিনি মনে করেছিলেন যে, তিনিই হচ্ছেন এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বেসর্বা এবং তার মতাে শক্তিশালী আর কেউ নেই।

কিন্তু এই ঘটনার পর তাঁর দৰ্প চূর্ণ হয়েছিল। তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে, তিনি প্রভু নন, তিনি ভৃত্য, তখন কৃতাঞ্জলিপুটে শ্রীকৃষ্ণের সামনে এসে তিনি তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন।

ইন্দ্র প্রার্থনা করলেন, “হে প্রভু, অহঙ্কারে মত্ত হয়ে আমি মনে করেছিলাম যে, গােপেদের ইন্দ্রযজ্ঞ বন্ধ করে আপনি আমার প্রতি অপরাধ করেছেন, এবং আমি মনে করেছিলাম যে,

সেই যজ্ঞের সমস্ত সামগ্রী আপনি উপভােগ করতে চেয়েছিলেন। আমি মনে করেছিলাম যে, গােবর্ধন পূজার নাম করে আমার প্রাপ্য বস্তু জোর করে নিয়ে নিচ্ছিলেন, তাই তখন আমি আপনাকে চিনতে পারিনি।

এখন আপনার কৃপায় আমি বুঝতে পেরেছি যে, আপনিই হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, এবং আপনি সমস্ত জড় গুণের অতীত। 

আপনি জড় জগতের সত্ত্বগুণের উর্ধ্বে চিন্ময় বিশুদ্ধ সত্ত্বে অধিষ্ঠিত এবং আপনার দিব্য নাম সব রকমের জড় গুণের বিশৃঙ্খলার অতীত। 

আপনার নাম, রূপ, গুণ, লীলা ইত্যাদি এই জড় জগতের অতীত এবং তা কখনও প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয় না।

 যারা কঠোর তপশ্চর্যা করেছেন এবং যারা প্রকৃতির রজ ও তম গুণের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়েছেন, তারাই কেবল আপনার ধামে প্রবেশ করতে পারেন।  

কেউ যদি মনে করে যে, আপনি যখন এই জড় জগতে অবতরণ করেন, তখন আপনি জড় জগতের গুণের দ্বারা প্রভাবিত হন, 

তবে সে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। জড়া প্রকৃতির গুণভিত্তিক মায়াজাল আপনাকে স্পর্শ করতে পারে না এবং জগতে অবস্থানকালে আপনিও তাদের গ্রহণ করেন না। আপনি কখনই জড়া প্রকৃতির নিয়মের দ্বারা আবদ্ধ হন না।

"হে প্রভু! আপনিই হচ্ছেন সমস্ত জগতের পরম পিতা। আপনিই সমস্ত জগতের পরম গুরু, এবং আপনিই সব কিছুর পরম অধীশ্বর। মহাকাল রূপে আপনি অত্যন্ত সুদক্ষভাবে অপরাধীদের দণ্ড দান করেন।

এই জগতে আমার মতাে বহু মুর্খ রয়েছে, যারা নিজেদের এই ব্রহ্মাণ্ডে পরম ঈশ্বর বা সর্বেসর্বা বলে মনে করে। আপনি এত করুণাময় যে, তাদের সেই অপরাধের দণ্ড না দিয়ে, 

আপনি তাদের গর্ব খর্ব করবার আয়ােজন করেন, যাতে তারা বুঝতে পারে যে, আপনিই হচ্ছেন সর্বলােক-মহেশ্বর পরমেশ্বর ভগবান।

"হে প্রভু, আপনিই হচ্ছেন পরম পিতা, পরম গুরু এবং পরম ঈশ্বর। তাই কোন জীব যখন অন্যায় আচরণ করে, তখন তাদের শাসন করার সমস্ত অধিকার আপনার আছে। পিতা,

গুরুদেব এবং রাষ্ট্রপ্রধান সব সময়ই যথাক্রমে তাদের পুত্র, শিষ্য এবং প্রজাদের শুভাকাক্ষী; এবং শুভাকাক্ষীরূপে তাদের শাসন করার অধিকার আছে। 

আপনার ইচ্ছার প্রভাবে এই জগতের মঙ্গল সাধনের জন্য আপনার অনন্ত রূপে আপনি আবির্ভূত হন। এই ধরিত্রীকে ধন্য করবার জন্য আপনি আসেন এবং ঈশ্বর অভিমানে যারা এই জড় জগৎকে ভােগ করতে চায়,

তাদের আপনি দণ্ডদান করেন। এই জড় জগতে বিভিন্ন ধরনের মানুষ সমাজের নেতা হওয়ার জন্য নিরন্তর পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযােগিতা করে চলেছে।

নেতা হয়ে পরমপদ প্রাপ্ত হওয়ার আশা ব্যর্থ হলে সেই সমস্ত মুর্খ মানুষেরা পরমেশ্বর ভগবান সাজতে চাইছে। এই জগতে আমার মতাে সেই রকম অনেক মুর্খ জীব রয়েছে, কিন্তু যথাসময়ে, যখন তারা প্রকৃতিস্থ হয়,

তখন তারা আপনার সেবায় যুক্ত হয়। আপনার প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ মানুষদের আপনি সেই উদ্দেশ্যেই শাসন করেন।

“হে প্রভু, আমি আপনার চরণে মহা অপরাধ করেছি। ঐশ্বর্যমত্তে মত্ত হয়ে আমি আপনার অনন্ত বৈভব উপলব্ধি করতে পারিনি।

তাই হে প্রভু, কৃপা করে আমাকে ক্ষমা করুন, কেননা আমি অতি মুর্খ। আপনি দয়া করে আমাকে আশীর্বাদ করুন যেন আমি কোনদিনও এই রকম মূর্খের মতাে আচরণ না করি। 

হে প্রভু, আপনি যদি মনে করেন যে, এই অপরাধ এতই গর্হিত যে তা ক্ষমার যোগ্য নয়, তা হলে আমি আপনার কাছে আবেদন করব যে, আমি আপনার নিত্য দাস; 

এই জগতে আপনার আবির্ভাবের কারণ হচ্ছে আপনার নিত্য সেবকদের রক্ষা করা এবং যে সমস্ত অসুর এই পৃথিবীকে ভারাক্রান্ত করার জন্য প্রবল সামরিক শক্তি সংগ্রহ করে, তাদের আপনি সংহার করেন। আপনার নিত্য সেবক বলে মনে করে আপনি কৃপা করে আমাকে ক্ষমা করুন।

“হে প্রভু, আপনিই হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। আমি আপনাকে আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণতি নিবেদন করি, কেননা আপনিই হচ্ছেন পরম পুরুষ এবং পরম আত্মা।

আপনি হচ্ছেন বসুদেবের পুত্র এবং আপনিই হচ্ছেন সমস্ত শুদ্ধ ভক্তদের আশ্রয়-পরম ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণ। আপনি কৃপা করে আমার দণ্ডবৎ প্রণতি গ্রহণ করুন। আপনিই হচ্ছেন পরম জ্ঞানের মূর্ত বিগ্রহ।

আপনি আপনার ইচ্ছা অনুসারে আপনার নিত্য রূপ নিয়ে যে কোনও জায়গায় আবির্ভূত হতে পারেন। আপনিই হচ্ছেন সমস্ত সৃষ্টির মূল কারণ এবং সমস্ত জীবের পরমাত্মা। 

আমার মহা মুর্খতার ফলে আমি ঝড়ঝঞ্জা এবং শিলাবৃষ্টি বর্ষণ করে বৃন্দাবনে মহা উৎপাত সৃষ্টি করেছি। আপনি আমার যজ্ঞ বন্ধ করে দিয়েছিলেন বলে প্রচণ্ড ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আমি এইভাবে আচরণ করেছি। 

কিন্তু প্রভু, আপনি আমার প্রতি এতই কৃপাময় যে, আমার দর্পচূর্ণ করে আপনি আমার প্রতি আপনার করণা প্রদর্শন করেছেন। আমি তাই আপনার শ্রীপাদপদ্মে আশ্রয় গ্রহণ করেছি। হে প্রভু, আপনি কেবল পরম নিয়ন্তাই নন, আপনি সমস্ত জীবের পরম গুরুদেব।”

এইভাবে ইন্দ্র পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করলে ভগবান মধুর হাসি হেসে বললেন, “হে ইন্দ্র, তােমার প্রতি আমার অহৈতুকী কৃপা প্রদর্শন করার জন্য এবং আমি যে তােমার নিত্য প্রভু সেই কথা তােমাকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য আমি তােমার যজ্ঞ বন্ধ করেছিলাম।

আমি কেবল তােমারই প্রভু নই, আমি সমস্ত দেবতাদেরই প্রভু। তােমার সব সময় মনে রাখা উচিত যে, তােমার যে ঐশ্বর্য তা আমারই কৃপার প্রভাবে তুমি প্রাপ্ত হয়েছ।

 সকলের সব সময় মনে রাখা উচিত যে, আমিই হচ্ছি পরমেশ্বর ভগবান। আমি কাউকে আমার অনুগ্রহ প্রদর্শন করতে পারি, আবার কাউকে শাসনও করতে পারি।

কেননা সকলেই আমার অধীন এবং আমার থেকে বড় কেউ নেই। আমি যখন দেখি যে, কেউ অহংকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে, তখন আমার অহৈতুকী কৃপা প্রদর্শন করে আমি তার সমস্ত ঐশ্বর্য হরণ করে নিই।”

কখনও কখনও শ্রীকৃষ্ণ কোন ধনী ব্যক্তির সমস্ত ধন অপহরণ করে নেন যাতে তিনি তার চরণে আত্মনিবেদন করতে পারেন। এটি ভগবানের একটি বিশেষ কৃপা। 

অনেক সময় দেখা গেছে যে, অত্যন্ত ঐশ্বর্যশালী কোন মানুষ ভগবানের ভক্ত হওয়ার পর দরিদ্র হয়ে গেছেন। তা দেখে কারাের মনে করা উচিত নয় যে, 

পরমেশ্বর ভগবানের আরাধনা করার ফলেই তিনি দরিদ্র হয়ে গেছেন। তার প্রকৃত কারণ হচ্ছে যে, ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও তার যথার্থ উদ্দেশ্য বিস্মৃত হয়ে তিনি জড় জগতকে ভােগ করতে চেয়েছিলেন এবং তার ফলে তাঁর ভগবন্তুক্তি ব্যাহত হচ্ছিল।

তাই ভগবান তাঁর প্রতি বিশেষ কৃপা প্রদর্শন করে তার সমস্ত জড় ঐশ্বর্য অপহরণ করে নিলেন যাতে তিনি পরমেশ্বর ভগবানের চরণে সর্বতােভাবে আত্মনিবেদন করতে পারেন। 

ইন্দ্রকে উপদেশ দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ তাকে স্বর্গলােকে ফিরে যেতে বললেন এবং তাকে সব সময় মনে রাখতে বললেন যে, তিনি পরমেশ্বর নন, তিনি হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবানের নিত্য সেবক।

 তিনি তাকে আরও বললেন যে, তিনি যেন সর্বদাই তার আদেশ পালন করে গর্বরহিত হয়ে স্বর্গের দেবতাদের রাজা রূপে অবস্থান করেন।

তারপর দিব্য সুরভী গাভী, যিনি ইন্দ্রের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করতে এসেছিলেন, তিনি শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করলেন এবং তাকে আরাধনা করলেন। সুরভী শ্রীকৃষ্ণের বন্দনা করে বললেন, 

“হে শ্ৰীকৃষ্ণ, আপনি সমস্ত যােগীদের ঈশ্বর, কেননা আপনিই হচ্ছেন সমস্ত বিশ্বের আয়া, এবং আপনার থেকেই সমস্ত সৃষ্টি প্রকাশিত হয়েছে।

তাই যদিও ইন্দ্র আমার সন্তান-সন্ততি, বৃন্দাবনের গাভীদের বধ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে, কিন্তু আপনার আশ্রয়ে ছিল বলে আপনি তাদের সকলকে রক্ষা করেছেন। 

আপনি ছাড়া আর কাউকে আমরা পরমেশ্বর বলে জানি না, এবং অন্য কোনও দেবতাদের কাছেও আমরা আশ্রয় ভিক্ষা করি না। 

তাই আপনিই হচ্ছেন আমাদের ইন্দ্র, আপনি সমস্ত বিশ্ব-চরাচরের পরম পিতা এবং আপনি গাে, ব্রাহ্মণ, দেবতা ও শুদ্ধ ভক্তদের রক্ষাকর্তা। 

হে বিশ্বের পরমাত্মা! এই পৃথিবীর ভার হরণের জন্য আপনি অবতীর্ণ হয়েছেন। হে প্রভু! আমরা আমাদের দুধ দিয়ে আপনার অভিষেক করতে চাই।”

এই ভাবে সুরভী গাভী তার দুধ দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের অভিষেক করলেন। দেবমাতৃদের প্রেরণায় ইন্দ্র, দেবতা ও ঋষিদের সঙ্গে ঐরাবতের শুঁড় মাধ্যমে মন্দাকিনীর জল দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের অভিষেক করলেন এবং তার গােবিন্দ’ নামকরণ করলেন। 

এইভাবে গােবিন্দ শ্রীকৃষ্ণ তাদের সকলের প্রতি প্রসন্ন হলেন। তখন গন্ধর্ব, বিদ্যাধর, সিদ্ধ, চারণ সকলে সমবেত হয়ে ভগবানের দিব্য নাম স্মরণ করে তার মহিমা কীর্তন করতে লাগলেন। অপ্সরারা হৃষ্টচিত্তে নৃত্য করতে লাগলেন।

দেবতারা শ্রীকৃষ্ণের উপর পারিজাত-পুষ্প বর্ষণ করতে লাগলেন এবং তার স্তুতি করতে লাগলেন। তখন ত্রিলােক শান্তি লাভ করেছিল এবং গাভীরা পৃথিবীকে দুগ্ধধারায় সিক্ত করেছিল। 

নদীগুলি ক্ষীরবাহিনী হয়েছিল, বৃক্ষগলি মধুবর্ষণ করেছিল। কর্ষণ বিনা পরিপক ওষধি পরিপূর্ণ পর্বতসমূহ গর্ভাগত মণিমাণিক্য বাইরে প্রকাশিত করে ধারণ করেছিল।

শ্রীকৃষ্ণের উপস্থিতির ফলে তখন সব কিছুই অত্যন্ত মঙ্গলময় হয়ে উঠেছিল এবং হিংস্র-স্বভাব পশুরাও শত্রুভাব রহিত হয়েছিল। এইভাবে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের ফলে সমস্ত জগতের মঙ্গল হয়। এমন কি হিংস্র পশুরাও তাদের হিংস্র প্রবৃত্তি বর্জন করে দিব্য গুণাবলীতে ভূষিত হয়।

গাে এবং গােকুলের পতি গােবিন্দকে সন্তুষ্ট করে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর অনুমতি নিয়ে অন্য সমস্ত দেবতা পরিবৃত হয়ে স্বর্গলােকে ফিরে গেলেন।

আরও পড়ুন

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
৩২. অক্রুরের বৃন্দাবনে আগমন
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url