শরতের বর্ণনা-কৃষ্ণলীলা-শ্রীমদ্ভাগবত কাহিনী-কৃষ্ণ কথা
শরতের বর্ণনা-কৃষ্ণলীলা কথা
ভারতবর্ষে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপের পর বর্ষা অত্যন্ত সুখাবহ। আকাশে সূর্য ও চন্দ্রকে আচ্ছাদিত করে ঘন কালাে মেঘ দেখা দিল, যে কোনও মুহূর্তে অঝাের ধারায় বৃষ্টি নামবে বলে মনে করে মানুষ আনন্দে উৎফুল্ল হল। তখন মেঘের গর্জন এবং বিদ্যুতের ঝলক মনুষের কাছে অত্যন্ত আনন্দদায়ক বলে মনে হয়।
জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা আচ্ছন্ন জীবের সঙ্গে এই বর্ষার্ ঋতুর তুলনা করা চলে। অনন্ত আকাশ হচ্ছে পরব্রহ্মের মতাে এবং ক্ষুদ্র জীব বা জড়া প্রকৃতি তিনটি গুণের দ্বারা আচ্ছাদিত। ব্রহ্ম হচ্ছে মেঘে ঢাকা আকাশের মতাে। প্রকৃতপক্ষে, সকলেই হচ্ছেন ব্রহ্মের বিভিন্ন অংশ। অনন্ত আকাশ যেমন কখনই মেঘের দ্বারা আচ্ছাদিত হতে পারে না, তেমনই জড়া প্রকৃতির গুণ কখনই পরব্রহ্মকে আচ্ছাদিত করতে পারে না।
ভগবদ্গীতাতে বলা হয়েছে, জীব হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের বিভিন্ন অংশ, কিন্তু তারা হচ্ছে ক্ষুদ্র অংশ। এই অতি ক্ষুদ্র অংশ জীব জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে পড়ার ফলে তারা এই জড় জগতে পতিত হয়।
ব্ৰহ্মজ্যোতি হচ্ছে সূর্যের আলােকের মতাে; সূর্যের আলােকে যেমন অসংখ্য কিরণ কণা রয়েছে তেমনই ব্ৰহ্মজ্যোতিও পরমেশ্বর ভগবানের বিভিন্ন অংশ অসংখ্য অণুচৈতন্যে পূর্ণ। পরমেশ্বর ভগবানের এই অসংখ্য অণুসদৃশ অংশের কিছু অংশ জড়া প্রকৃতির প্রভাবে আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে কিন্তু অন্য অংশগুলি সেই অবস্থাতেই থাকে।
আটমাস ধরে সূর্য বিভিন্ন জলাশয় থেকে জল শােষণ করে এবং বর্ষার আগমনে সেই জল মেঘে পরিণত হয় যা বর্ষার আকারে এই পৃথিবীর ওপর নেমে আসে।
বিচক্ষণ সরকার ঠিক সেইভাবে তার নাগরিকদের কাছ থেকে কৃষি, বাণিজ্য এবং শিল্প উৎপাদনের উপর কর ধার্য করেন; আয়কর এবং বিক্রয়কর রূপেও সরকার কর সংগ্রহ করেন।
সরকারের এই কর সংগ্রহ পৃথিবী থেকে সূর্যের জল সংগ্রহের মতাে। তারপরে যখন পৃথিবীতে আবার জলের প্রয়ােজন হয়, তখন সেই সূর্যকিরণ সেই জলকে মেঘে পরিণত করে পৃথিবীর সর্বত্র বিতরণ করে।
তেমনই, সরকার যে কর আদায় করেন, তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজসেবা, স্বাস্থ্য উন্নয়ন প্রকল্প ইত্যাদি জনহিতকর কার্যের মাধ্যমে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া সরকারের কর্তব্য।
যথার্থ সরকারের পক্ষে এটা অবশ্য করণীয়। জনসাধারণের কাছ থেকে কর আদায় করে সেই টাকা অনর্থক নষ্ট করা সরকারের উচিত নয়; জনসাধারণের কাছ থেকে আদায় করা কর রাষ্ট্রের জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য ব্যয় করা উচিত।
বর্ষার সময় প্রবল বায়ুতাড়িত মেঘগুলি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীর বুকে জলবর্ষণ করতে থাকে।
গ্রীষ্মের পরে যখন জলের অত্যন্ত প্রয়ােজন দেখা দেয়, তখন বর্ষার মেঘগুলিকে জনসাধারণের অভাবকালে তার ভাণ্ডার উজাড় করে দানরত ধনীর মতাে মনে হয়। বর্ষার মেঘগুলিও তেমন পৃথিবীর সর্বত্র জল বিতরণ করে নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে পড়ে।
একজন কৃষক তার জমি থেকে সমস্ত আগাছাগুলি সমূলে উৎপাটিত করে ফেলে দেয়, শ্রীরামচন্দ্রের পিতা মহারাজ দশরথ ঠিক সেইভাবে তার শত্রুদের উৎপাটিত করতেন। আর যখন দান করার প্রয়ােজন হত, তখন বর্ষার মেঘ যেভাবে জল বিতরণ করে ঠিক সেইভাবেই তিনি অর্থদান করতেন।
বর্ষার মেঘের জল বিতরণ এতই উদার যে মহাবদান্য ও উদারচিত্ত মানুষের ধন বিতরণের সঙ্গে তার তুলনা করা হয়। প্রয়ােজন থাক বা না থাক্, বর্ষার মেঘ যেমন সর্বত্রই তার প্রয়ােজন মুক্তহস্তে দান করে।
বর্ষার আগমনের পূর্বে এই পৃথিবী শক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন এবং তাকে অত্যন্ত কৃশাঙ্গী দেখাচ্ছিল। বর্ষার পরে এই পৃথিবী আবার জীবনােচ্ছল সবুজ রঙে রঞ্জিত এবং তাঁকে অত্যন্ত সুস্থ, সবল বলে মনে হল।
পৃথিবীকে জড় বাসনা করার মানসে মানুষের সঙ্গেই তুলনা করা হয়েছে। জড় চরিতার্থ করার মানসে তপস্যারত মানুষ যেমন ক্লিষ্ট হয়ে পড়ে এবং তার বাসনা পূর্ণ হওয়ায় আবার সে সবল হয়ে ওঠে, বর্ষার পরই পৃথিবীকে তেমনই মনে হল।
কোন অবাঞ্ছিত সরকার যখন কোন দেশের ওপর রাজত্ব করে, তখন সেই দেশের মানুষেরা এবং সেখানকার রাজনৈতিক দলগুলি তাদের রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য নানা রকম কষ্ট স্বীকার করে, তপস্যা করে, তারপর যখন তারা তাদের রাজত্ব ফিরে পায়, তারা নিজেদের জন্য নানা রকম সুখসুবিধার বন্দোবস্ত করে অনেক টাকা পয়সা সংগ্রহ করে মহা আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন করতে থাকে।
বর্ষাকালে পৃথিবীর আড়ম্বর অনেকটা এইরকম। পারমার্থিক উন্নতি সাধন করবার জন্যই কেবল কঠোর তপস্যা করা উচিত।
শ্রীমদ্ভাগবতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, পরমেশ্বর ভগবানকে জানার জন্য তপস্যা করা উচিত। ভক্তিসহকারে ভগবানের সেবা করার জন্য যে তপস্যা তার পারমার্থিক জীবনে উন্নতি সাধন হয় এবং পারমার্থিক জীবন লাভ হওয়ার ফলে অন্তহীন দিব্য আনন্দ উপভােগ করা যায়।
কিন্তু তা না করে কেউ যদি কোন জড়জাগতিক লাভের জন্য তপস্যা করে তা হলে ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে। যে তার ফল অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী এবং অতি অল্পবুদ্ধি-সম্পন্ন মানুষেরাই কেবল সেই উদ্দেশ্যে তপস্যা করে।
বর্ষাকালে সন্ধ্যার অন্ধকারে সর্বত্রই অনেক জোনাকী পােকা দেখা যায় এবং তারা আলােকশিখার মতাে তাদের কিরণ বিতরণ করে, কিন্তু সেই সময় আকাশে চন্দ্র ও তারকাগুলি দেখা যায় না।
কলিযুগেও তেমন নাস্তিক এবং পাষণ্ডেরা অত্যন্ত প্রাধান্য লাভ করে, কিন্তু বৈদিক নীতি অনুসরণকারী ধার্মিক মহাত্মারা সকলের দৃষ্টির অগােচরে থেকে যান। মনােধর্মী বাক্চতুর মানুষ এবং তথাকথিত সমস্ত ধর্ম প্রবর্তকেরা জোনাকীর মতাে প্রাধান্য বিস্তার করে,
কিন্তু যারা যথাযথভাবে বৈদিক নির্দেশ পালন করে সৎ ধর্ম আচরণ করেন তারা এই যুগে মেঘে ঢাকা তারার মতাে সকলের দৃষ্টির অগােচরে থেকে যান।
জোনাকীর আলাের দ্বারা মােহিত না হয়ে প্রকৃত আলােকের উৎস সূর্য, চন্দ্র, তারকা আদি জ্যোতিষ্কের আলােকপ্রাপ্ত হওয়ার চেষ্টা করা উচিত।
অন্ধকার রাত্রে জোনাকী পােকা মােটেই আলাে দিতে পারে না। উপরন্তু তাদের সেই আলােয় অন্ধকার আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে। বর্ষাকালেও আকাশ মেঘমুক্ত হলে যেমন সূর্য, চন্দ্র এবং তারাদের আবার দেখা যায়, তেমনই কলিযুগেও কখনও কখনও যথার্থ মহাত্মার দর্শন লাভের সৌভাগ্য লাভ হয়।
শুদ্ধ বৈদিক ধারায় হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র’ বিতরণ করার যে সংকীর্তন যজ্ঞের সূচনা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু করে গেছেন, তা হঠাৎ আকাশ মেঘমুক্ত হওয়া সূর্যরশ্মির প্লাবনের মতাে।
যে সমস্ত মানুষ যথার্থ জীবন লাভ করতে চান, তাদের কর্তব্য হচ্ছে জোনাকীর মতাে আলাে প্রদানকারী নাস্তিক এবং প্রতারক নেতাদের পরিত্যাগ করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর এই সংকীর্তন যজ্ঞে যােগদান করা।
প্রথম বৃষ্টির পর যখন মেঘের গর্জন হয়, তখন ব্যাঙেরা ডাকতে থাকে। তাদের ডাক শুনে মনে হয় যেন পড়ুয়ারা পাঠ করছে। ছাত্রদের সাধারণত খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা উচিত।
কিন্তু তারা সাধারণত নিজে নিজেই ঘুম থেকে ওঠে না, মন্দিরে অথবা গুরুকুলে যখন ঘণ্টা বাজে, তখন সেই ঘণ্টার শব্দে তারা উঠে পড়ে।
গুরুদেবের আদেশে তারা তৎক্ষণাৎ উঠে তাদের প্রাতঃকৃত্য সমাপন করে বৈদিক মন্ত্র পাঠ করতে শুরু করে। কলিযুগের অন্ধকারে সকলেই ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু যখন কোন মহান আচার্যের আগমন হয়, তখন তার আহ্বানেই কেবল যথার্থ তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার জন্য সকলেই বেদ পাঠ করতে শুরু করেন।
বর্ষাকালে অনেক পুকুর, হ্রদ এবং ছােট ছােট নদী জলে ভরে যায়, তা না হলে বৎসরের বাকি সময়গুলি তারা শুকিয়ে থাকে। জড়বাদী মানুষেরাও তেমন শুষ্ক, কিন্তু যখন তারা তথাকথিত সম্পদ-স্ত্রী, পুত্র, গৃহ এবং ধন সম্পত্তি প্রাপ্ত হয়, তখন মনে হয় যে তারা খুব উন্নতি সাধন করেছে।
কিন্তু অল্পকাল পরেই তারা আবার সেই খানা, ডােবা এবং ছােট নদীর মতাে শুষ্ক হয়ে পড়ে। কবি বিদ্যাপতি বলেছেন : "তাতল সৈকতে বারিবিন্দুসম, সুতমিতরমণী-সমাজে।” স্ত্রী, পুত্র, বন্ধুবান্ধব এদের নিয়ে যে সমাজ তাতে অবশ্যই কিছু সুখ রয়েছে, কিন্তু সেই সুখ মরুভূমির বুকে একবিন্দু জলের মতাে।
মরুভূমিতে পথিক যেমন জলের জন্য আকুল হয়ে ওঠে তেমনই সকলেই সুখভােগের জন্য আকুল হয়ে রয়েছে। মরুভূমিতে যে মানুষের তৃষায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে তাকে যদি একবিন্দু জল দেওয়া হয় তাতে তার নিবৃত্তি হয় না।
ঠিক তেমনই জড়জাগতিক জীবনে আমরা সকলেই স্ত্রী, পুত্র, বন্ধুবান্ধব, সমাজ ইত্যাদির মাধ্যমে সুখের অন্বেষণ করে তাতে যা পাচ্ছি তা মরুভূমির মধ্যে একবিন্দু জল পাওয়ারই মতাে। তাতে আমাদের তৃপ্তি হয় না।
বৃষ্টি হওয়ার ফলে গাছপালা, তৃণগুল্ম এবং শস্যাদি ঘন সবুজ হয়ে ওঠে। কখনও কখনও সেই তৃণাদির উপর উজ্জ্বল লাল ইন্দ্রগােপকীট দেখা যায় এবং সেই সময় সাদা ব্যাঙের ছাতা গজিয়ে ওঠে, সেই দৃশ্য দেখে মনে হয় সে যেন হঠাৎ সম্পদ প্রাপ্ত হয়েছে।
তখন কৃষকেরা তাদের ক্ষেত ফসলে ভরে আছে দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হয়। কিন্তু পুঁজিপতিরা, যারা জানে না যে দৈবের বিধান অনুসারেই সব কিছু সাধিত হয়, তারা অত্যন্ত বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, কেননা তারা মনে করে যে অধিক ফসল হওয়ার ফলে জিনিসপত্রের দাম কমে যাবে। কোন কোন দেশে পুঁজিবাদী সরকার কৃষকদের যথেষ্ট শস্য উৎপাদন করতে দেয় তারা জানে না যে, শস্য উৎপাদন হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের আশীর্বাদ।
বৈদিক শাস্ত্রে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, একো যাে বিদধাতি কামান পরমেশ্বর ভগবান এই সৃষ্টির পালন করেন। তাই জীবের যা প্রয়ােজন তা তিনিই সরবরাহ করে থাকেন। জনসংখ্যা যখন বৃদ্ধি পায়, তখন তাদের অন্নের সংস্থান করার দায়িত্ব ভগবানেরই।
কিন্তু যারা দুষ্কৃতকারী বা নাস্তিক, তারা চায় না যে অপর্যাপ্ত শস্য উৎপাদন হয়, বিশেষ করে যদি সেই উৎপাদনের ফলে তাদের ব্যবসার কোন ক্ষতি হয়।
ভগবানের সেবায় যুক্ত হলে মানুষ যেমন অত্যন্ত প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, তেমনই বর্ষার সময় স্থল, জল এবং আকাশে সমস্ত জীব প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
আমাদের আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘে আমরা দেখেছি ভগবানের সেবায় যুক্ত হওয়ার ফলে মানুষ কত আনন্দময় এবং প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণ হয়ে ওঠে। ভগবানের সেবায় যুক্ত হওয়ার আগে তাদের দেখতে ছিল অত্যন্ত নােংরা, যদিও তাদের অবয়ব খুব সুন্দর কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকার ফলে তাদের দেখে মনে হত অত্যন্ত নােংরা এবং অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত।
কিন্তু কৃষ্ণভাবনাযুক্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়ার ফলে তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে এবং বৈদিক বিধিনিষেধগুলি পালন করার ফলে তাদের দেহ জ্যোতির্ময় হয়ে উঠেছে।
যখন তারা গৈরিক বসন পরে, কণ্ঠে তুলসী মালা ধারণ করে, দ্বাদশ অঙ্গে তিলক ধারণ করে ভগবানের নাম কীর্তন করে, তখন মনে হয় তারা যেন বৈকুণ্ঠ থেকে আবির্ভূত হয়েছে।
বর্ষাকালে যখন নদীগুলি প্রবল বেগে সমুদ্রের দিকে ধাবিত হয়, তখন মনে হয়, তারা যেন সমুদ্রকে উদ্বেলিত করছে। তেমনই, যে মানুষ অষ্টাঙ্গযোেগ অনুশীলন করছে, সে পারমার্থিক জীবনে খুব একটা উন্নত নয় এবং তারা যৌন আবেদনের দ্বারা উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
পর্বতের উপর প্রচুর বর্ষণ হলে যেমন পর্বতের কোন ক্ষতি হয় না, তেমনই যে মানুষ শুদ্ধ কৃষ্ণভক্তি লাভ করেছেন, তিনি কোন অবস্থাতেই বিচলিত হন না। যত দুঃখেই তিনি থাকুন না কেন, তিনি সেই দুঃখকে ভগবানের আশীর্বাদ বলে মনে করেন, এবং এইভাবে ভগবানের শরণাগত হওয়ার ফলে তিনি ভগবদ্ধামে প্রবেশ করার যােগ্যতা অর্জন করেন।
বর্ষার সময়ে কতকগুলি রাস্তায় সচরাচর যাতায়াত করা হয় না এবং সেই রাস্তাগুলি তখন লম্বা ঘাসে ঢাকা পড়ে যায়। যে ব্রাহ্মণ বেদের নির্দেশ অনুসারে চিত্তশুদ্ধিকারী নির্দেশের পঠন এবং অনুশীলন না করেন, তার চিত্ত মায়ারূপী বড় বড় ঘাসের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে।
সেই অবস্থায় তিনি তার স্বরূপ বিস্মৃত হন, তিনি ভুলে যান যে, তিনি হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবানের নিত্য সেবক। মায়াসৃষ্ট লম্বা লম্বা ঘাসের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে বিপথগামী হয়ে পড়ার ফলে মানুষ মায়িক সৃষ্টিতে তার পরিচয় খোঁজে, এবং তার ফলে তার চিন্ময় স্বরূপ বিস্মৃত হয়ে পড়েন।
বর্ষাকালে মেঘে মেঘে বিদ্যুৎ খেলে বেড়ায়। তা যেন কামার্তা রমণীর মতাে কোন একজন পুরুষে তার মনকে নিবিষ্ট করতে পারে না।
বর্ষার মেঘের সঙ্গে গুণবান পুরুষের তুলনা করা হয়েছে, কেননা মেঘ জলবর্ষণ করে মানুষকে জীবনদান করে, গুণবান পুরুষও তেমন তার পরিবারের সদস্য এবং তার কর্মচারীদের ভরণপােষণ করেন।
দুর্ভাগ্যবশত, তাঁর স্ত্রী যদি তাকে ত্যাগ করে চলে যায় তা হলে তার জীবন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়তে পারে। কোন মানুষ যখন বিরক্ত হয়ে পড়ে তখন তার সমস্ত পরিবার নষ্ট হয়ে যায়। তার ছেলেমেয়েরা এদিক সেদিক চলে যায় অথবা তার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় এবং তার ফলে সবকিছুই এলােমেলাে হয়ে যায়।
তাই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, কোন স্ত্রী যদি কৃষ্ণভাবনায় উন্নতি সাধন করতে চান, তা হলে তিনি যেন শান্তিপূর্ণভাবে তাঁর স্বামীর সঙ্গে বসবাস করেন এবং কখনই যেন তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ না হয়।
স্বামী-স্ত্রী যেন কামনা-বাসনা রহিত হয়ে তাদের চিত্তকে শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দে মগ্ন রাখেন এবং তা হলেই তাদের জীবন সার্থক হয়। এই জড় জগতে একজন পুরুষ স্বাভাবিকভাবে স্ত্রী-সঙ্গ কামনা করে এবং একজন স্ত্রীও স্বাভাবিকভাবে পুরুষের সঙ্গ কামনা করে। তারা যখন মিলিত হয়, তখন কৃষ্ণভাবনা যুক্ত হয়ে তারা যেন শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করে। কখনই যেন তারা এক মেঘ থেকে অন্য মেঘে খেলে বেড়ানাে বিদ্যুতের মতাে না হয়ে পড়ে।
আকাশে কখনও কখনও রামধনু দেখা যায়, যা দেখতে ঠিক ছিলাবিহীন ধনুকের মতাে। ধনুকের দুটি প্রান্ত ছিলা দিয়ে বাঁধা থাকে বলে ধনুক বেঁকে থাকে, কিন্তু রামধনুতে সেই রকম কোন নেই, কিন্তু তবুও তা অতি সুন্দর বক্রভাবে আকাশের বুকে প্রকাশিত হয়।
তেমনই, পরমেশ্বর ভগবান যখন এই জড় জগতে অবতরণ করেন, তখন তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতাে আবির্ভূত হন। কিন্তু তা হলেও জড়জাগতিক পরিস্থিতির দ্বারা তিনি কোনভাবে প্রভাবিত হন না।
ভগবান বলেছেন যে, তিনি তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তি যােগমায়ার প্রভাবে আবির্ভূত হন এবং বহিরঙ্গা মায়াশক্তির দ্বারা কখনই তিনি আবদ্ধ হয়ে পড়েন না। সাধারণ জীব যে জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, ভগবান কখনই সেই বন্ধনে আবদ্ধ হন না। তিনি সর্ব অবস্থাতেই মুক্ত, সম্পূর্ণ স্বাধীন।
বর্ষাকালে চাদ মেঘে ঢাকা পড়ে যায় কিন্তু মাঝে মাঝে মেঘের ফাক দিয়ে চাদকে দেখা যায়। চাদের সামনে ভাসমান মেঘগুলিকে দেখে মনে হয় যে, চাদ যেন ভেসে চলেছে।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চাদ এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে, ভাসমান মেঘগুলাের জন্য মনে হয় যেন ভেসে চলেছে। তেমনই যে মানুষ এই প্রবাহমান জড় জগতের পরিপ্রেক্ষিতে তার পরিচয় খুঁজে পেতে চায়, তার প্রকৃত জ্যোতির্ময় স্বরূপ মায়ার দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে এবং এই চির পরিবর্তনশীল জড় জগতের কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে সে মনে করছে যে, তার জীবনের বিভিন্ন পরিবর্তন হচ্ছে।
অহঙ্কারের প্রভাবেই তা হয়ে থাকে। ভাসমান মেঘ যেমন চন্দ্র কিরণ এবং অন্ধকারের সীমা নির্ধারণ করে, ঠিক তেমনই আমাদের চিন্ময় জীবন এবং জড় জীবনের সীমা নির্ধারণ করে।
বর্ষাকালের আকাশে যখন প্রথম মেঘ দেখা দেয়, তখন আনন্দে ময়ুরেরা নাচতে থাকে। এর সঙ্গে জড়জাগতিক জীবনে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের তুলনা করা চলে। যখন কোন সঙ্গলাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন, তখন তারা আনন্দে ময়ুরের মতােই উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন।
ব্যক্তিগতভাবে আমরা দেখেছি যে এই আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের অনেক ভক্ত এই সংস্থাতে যােগ দেওয়ার আগে অত্যন্ত অত্যন্ত বিষাদগ্রস্থ এবং দুঃখিত ছিল, কিন্তু ভগবদ্ভুক্তের সঙ্গের প্রভাবে তারা আজ আনন্দোচ্ছল ময়ুরের মতাে নৃত্য করছে।
কখনও কখনও দেখা যায় যে হাঁস, বক, সারস আদি পক্ষীরা নদী বা হ্রদের তীরে ঘুরে বেড়ায়, যদিও সেই জায়গাগুলি অত্যন্ত আবর্জনাপূর্ণ এবং কণ্টকযুক্ত তৃণগুন্মে পূর্ণ।
তেমনই যে সমস্ত মানুষ কৃষ্ণভক্তিবিহীন হয়ে গৃহে অবস্থান করছেন, তারা সর্বক্ষণ নানা রকম দুর্দশা ভােগ করছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত না হলে মানুষ কখনই যথার্থ আনন্দ লাভ করতে পারে না।
নরােত্তম দাস ঠাকুর প্রার্থনা করেছেন, গৃহে থাক বা বনেতে থাকে হা গৌরাঙ্গ' বলে ডাকে, নরােত্তম মাগে তার বিষয়াসক্ত মানুষদের এই জড়জাগতিক সমস্ত কার্যকলাপগুলি অত্যন্ত কলহপূর্ণ, কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত ভক্তের কাছে সব কিছুই শাস্তিময়।
প্রচণ্ড বর্ষণে মাঝে মাঝে ক্ষেতের আল ভেঙ্গে যায়। তেমনই এই কলিযুগে নাস্তিকদের অপপ্রচারের ফলে বিধিনিষেধের নির্দেশের সীমা ভেঙ্গে যায়। তার ফলে মানুষ ধীরে ধীরে অধঃপতিত হয়ে ভগবদ্ধিমুখ হয়ে পড়ে।
বর্ষাকালে বায়ুতাড়িত হয়ে মেঘ অমৃতের মতাে মধুর বারিবর্ষণ করে। বেদানুগ ব্রাহ্মণেরা যখন রাজা বা ধনী বণিকদের ভগবানের প্রীতি উৎপাদন করার জন্য যজ্ঞ এবং দান করতে অনুপ্রাণিত করেন, তখন অমৃত বর্ষণের মতােই মধুর বলে মনে হয়। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র মানব-সমাজের এই চারটি বর্ণ পরস্পরের সঙ্গে সহযােগিতা করে শান্তিপূর্ণভাবে জীবন যাপন করে।
এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তখনই সম্ভব হয়, যখন সুদক্ষ ভগবত্তত্ত্বজ্ঞান-সমন্বিত এবং দানশীল ব্রাহ্মণেরা সমাজকে পরিচালনা করেন।
বৃষ্টির ফলে বৃন্দাবনের বনে গাছপালাগুলি আম, জাম, খেজুর আদি সুপক্ক ফলে ভরে উঠল, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম সখাসহ সেই নতুন ঋতুকে উপভােগ করার জন্য বনে প্রবেশ করলেন। নতুন তাজা ঘাস পেয়ে গাভীরা অত্যন্ত সুস্থ সবল হয়ে উঠল এবং তাদের স্তন দুধে পূর্ণ হয়ে উঠল।
কৃষ্ণ যখন তাদের নাম ধরে ডাকতেন, তখন তারা স্নেহভরে তৎক্ষণাৎ তার কাছে ছুটে আসত এবং আনন্দের আতিশয্যে তাদের স্তন থেকে দুধ ঝরে পড়ত। গােবর্ধন পর্বতের পাশ দিয়ে বৃন্দাবনের বনের মধ্য দিয়ে যেতে কৃষ্ণের খুব আনন্দ হত।
যমুনার পাড়ে তিনি দেখতেন যে গাছগুলিতে মৌচাক থেকে মধু ঝরে পড়ছে। গােবর্ধন পর্বতে অনেক ঝরণা ছিল এবং তা থেকে অতি সুন্দর শব্দ হত। সেই পাহাড়ের গুহাগুলির দিকে তাকিয়ে শ্রীকৃষ্ণ সেই শব্দ শুনতেন। বর্ষা ঋতু যখন ধীরে ধীরে শরতে পর্যবসিত হত, তখন মাঝে মাঝে বনে বৃষ্টি হত।
কৃষ্ণ তাঁর সখাদের সঙ্গে তখন কোন গাছের নীচে অথবা গােবর্ধন পর্বতের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করতেন এবং সুপক ফল খেতে খেতে মহা আনন্দে তার সখাদের সঙ্গে কথা বলতেন। কৃষ্ণ ও বলরাম যখন সারাদিন বনে বনে থাকতেন, তখন মা যশােদা তাদের জন্য দধি মিশ্রিত অন্ন, ফল, এবং মিষ্টি পাঠিয়ে দিতেন।
যমুনার পাড়ে পাথরের উপরে বসে কৃষ্ণ তা খেতেন। খেতে খেতে কৃষ্ণ বলরাম এবং তার সখারা তাদের গাভী ও গােবৎসদের তত্ত্বাবধান করতেন। দুগ্ধপূর্ণ স্তনের ভারে গাভীরা বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না।
তাই বসে বসে তারা ঘাস খেত এবং তাদের দেখে কৃষ্ণ মহা আনন্দ উপভােগ করতেন। সেই বনের সৌন্দর্য দেখে কৃষ্ণ গর্ব অনুভব করতেন, কেননা তা ছিল তাঁরই শক্তির প্রকাশ।
সেই সময় কৃষ্ণ বর্ষার সৌন্দর্যের প্রশংসা করতেন। ভগবদগীতায় বলা হয়েছে। যে জড়া শক্তি বা প্রকৃতি স্বাধীন নয়। শ্রীকৃষ্ণের পরিচালনায় প্রকৃতি কার্য করে।
ব্রহ্মসংহিতাতেও বলা হয়েছে যে, জড়া প্রকৃতি, যার নাম দুর্গা, কৃষ্ণের ছায়ারূপে কার্য করেন। শ্রীকৃষ্ণ তাকে যে আদেশ দেন, তিনি তাই পালন করেন। তাই বর্ষাকালীন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শ্রীকৃষ্ণেরই ইচ্ছা অনুসারে প্রকাশিত হয়েছিল।
অচিরেই শরতের আগমনে সব ক'টি জলাশয় অত্যন্ত নির্মল এবং সুখাবহ হয়ে উঠল এবং সর্বত্রই স্নিগ্ধ সমীরণ বইতে লাগল। আকাশ সম্পূর্ণভাবে মেঘমুক্ত হল এবং তার স্বাভাবিক নীল রং ফিরে এল।
যােগসাধনা থেকে পতন হওয়ার পর যােগী যখন আবার তার পারমার্থিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত হন, তখন তাঁকে দেখতে যেমন সুন্দর লাগে, নির্মল সরােবরের জলে প্রস্ফুটিত পদ্মগুলিকেও ঠিক তেমন সুন্দর লাগছিল।
শরতের আগমনে সব কিছুই স্বাভাবিকভাবে সুন্দর হয়ে ওঠে। তেমনই, জড় বিষয়াসক্ত মানুষ যখন শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হয়ে পারমার্থিক জীবন শুরু করেন, তখন তিনিও শরতের আকাশের মতাে এবং জলাশয়ের মতাে নির্মল হন।
শরতের আকাশ থেকে ঘন কালাে মেঘগুলি যখন সরে যায়, তখন জলাশয়ের জল আর ঘােলা থাকে না। ভূমিও নির্মল হয়।
তেমনই, কোন মানুষ যখন কৃষ্ণভক্তি অবলম্বন করেন, তখন তিনি অন্তরে এবং বাইরে সব রকম কলুষ থেকে মুক্ত হন। তাই কৃষ্ণের একটি নাম হচ্ছে হরি, অর্থাৎ যিনি হরণ করেন; কেউ যখন শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হন, তখন শ্রীকৃষ্ণ তার সমস্ত কলুষ হরণ করে নেন।
শরৎকালে মেঘের রং সাদা, কেননা তারা কোন জল বহন করে না। সেই রকমই যে মানুষ তাঁর সংসার জীবনের সমস্ত ভার থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণভাবে শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হন, তখন তিনি সব রকম উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত হন এবং তাকে দেখতে তখন শরৎকালের মেঘের মতাে শুভ্র নির্মল মনে হয়।
শরৎকালে কখনও পাহাড় থেকে ঝরণা নির্মল জলধারা বহন করে নেমে আসে, আবার কখনও কখনও থেমে যায়। তেমনই, মহাত্মারা কখনও নির্মল বিতরণ করেন, আবার কখনও মৌনতা অবলম্বন করেন।
সমস্ত পুকুর বর্ষার জলে ভরে গিয়েছিল, তারা শরৎকালে ধীরে শুকিয়ে যায়। সেই জলাশয়ের ক্ষুদ্র জলচর প্রাণীগুলি বুঝতে পারে ধীরে তাদের আয়ু ক্ষীণ হয়ে আসছে, ঠিক তেমনই জড় বিষয়াসক্ত মানুষেরাও বুঝতে পারে যে, প্রতিদিন তাদের আয়ু ক্ষয় হচ্ছে।
এই ধরনের মানুষেরা তাদের ধনসম্পত্তি, স্ত্রী, পুত্র, বন্ধুবান্ধব এদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। জল কমে যাওয়ার ফলে শরতের প্রখর সূর্যের উত্তাপে সেই সমস্ত জলাশয়ের ছােট জলচর জীবেরা অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে তাদের অবস্থাটা ঠিক ইন্দ্রিয় সুখভােগে আসক্ত মানুষদের মতাে—যারা নানাভাবে চেষ্টা করা সত্ত্বেও সুখভােগ করতে পারে অথবা তাদের পরিবার প্রতিপালন করতে পারে না।
শরৎকালে কাদা শুকিয়ে যায় এবং নতুন গজানাে তৃণগুল্মগুলিও শুকিয়ে যায়। তেমনই, মানুষ শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হয়েছেন, তার সব রকম জড় সুখভােগের বাসনা ধীরে শুকিয়ে যায়।
আত্মজ্ঞানী পুরুষ যেমন জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা আর প্রভাবিত হয়ে আত্মসমাহিত হন, তেমনই শরৎকালে সমুদ্রের জল ধীর শান্ত হয়ে ওঠে। শরৎকালে কৃষকেরা আল বেঁধে ক্ষেতে জল ধরে রাখে।
তখন আর বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না, তাই জমিতে যতটুকু জল থাকে, সেটাই তারা ধরে রাখবার চেষ্টা করে। তেমনই, যে মানুষ আত্মজ্ঞান লাভের পথে অগ্রসর হতে চান, তিনি তার ইন্দ্রিয় দমন করে তার সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করেন। শাস্ত্রে উপদেশ দেওয়া হয়েছে যে, পঞ্চাশ বছর হয়ে গেলে সংসার জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার জন্য শরীরের সমস্ত শক্তি উপযােগ করা উচিত।
যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষ ইন্দ্রিয়গুলিকে দমন করে পরমেশ্বর ভগবান মুকুন্দের অপ্রাকৃত সেবায় যুক্ত হচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তার মুক্তি লাভের কোন সম্ভাবনা থাকে না।
শরৎকালে দিনের বেলা সূর্যের তাপ থাকে অত্যন্ত প্রখর, কিন্তু রাত্রিবেলা নির্মল প্রভাবে মানুষ তার দিনের শ্রান্তি থেকে স্বস্তি লাভ করে। কেউ যখন মুকুন্দ বা শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হন, তখন এই জড় দেহটাকে তার স্বরূপ বলে মনে করার দুর্বিষহ যাতনা থেকে তিনি মুক্ত হন।
মুকুন্দ বা শ্রীকৃষ্ণ ব্রজবালাদের সমস্ত সান্ত্বনার উৎস। ব্রজবালারা সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণের বিরহে শােকাতুর, কিন্তু শরৎকালের চন্দ্রালােকিত রাত্রে যখন শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাদের মিলন হয়, তখন তাদের বিরহজনিত সমস্ত বেদনা বিদূরিত হয়।
মেঘমুক্ত রাতের আকাশে তারাগুলি যেমন অত্যন্ত উজ্জ্বল ও সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়, তেমনই কোন মানুষ যখন কৃষ্ণভক্তি অবলম্বন করেন, তখন তিনি সব রকম কলুষ থেকে মুক্ত হন এবং শরৎকালের তারাদের মতাে সুন্দর ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন।
বেদে যে যজ্ঞ কর্ম করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেই সম্পর্কে ভগবদ্গীতায় বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যে, তাদের চরম উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে সব কিছু উৎসর্গ করা।
বেদের যথার্থ অর্থ হৃদয়ঙ্গম করে তাই মহাত্মারা শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে আত্মনিবেদন করে কৃষ্ণভাবনার অমৃত গ্রহণ করেন। কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত ভক্তের নির্মল হৃদয়কে তাই শরৎকালের আকাশের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
শরৎকালের নির্মল আকাশে তারকারাজি পরিবৃত হয়ে চন্দ্রকে অত্যন্ত উজ্জ্বল দেখায়। যদুকুলের আকাশে কৃষ্ণচন্দ্রের উদয় হয়েছিল এবং তিনি ছিলেন যদুকুলতারকা পরিবৃত চন্দ্রের মতাে।
বনে যখন গাছগুলি ফুলে ফুলে ভরে যায়, তখন সমীরণ স্নিগ্ধ সুবাস বহন করে গ্রীষ্ম ও বর্ষা ক্লিষ্ট মানুষদের স্বস্তি প্রদান করে। কিন্তু এই সমীরণ ব্রজগােপিকাদের কোনও রকম স্বস্তি দান করতে পারেনি, কেননা তারা তাদের হৃদয় শ্রীকৃষ্ণকে উৎসর্গ করেছিলেন।
অন্য সমস্ত মানুষ শরৎকালের সেই মধুর সমীরণে সুখ অনুভব করতে পারে, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের আলিঙ্গন থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে ব্ৰজগােপিকাদের হৃদয়ের উত্তাপের উপশম হয়নি।
শরতের আগমনে গাভী, হরিণী এবং বিবাহিতা স্ত্রীরা গর্ভবতী হয়, কেননা সেই ঋতুতে পুরুষেরা সাধারণত স্ত্রী-সঙ্গসুখ ভােগ করবার জন্য আকুল হয়ে ওঠে। যথাসময়ে পতির সঙ্গপ্রভাবে স্ত্রী যেমন গর্ভবতী হয়, তেমনই ভগবন্তুক্তি অনুশীলন করার ফলে এবং সাধুসঙ্গ করার ফলে ভগবানের ভক্ত যথাসময়ে ভগবৎ-প্রেম লাভ করেন।
উৎসাহ, ধৈর্য, দৃঢ় বিশ্বাস, শাস্ত্র-নির্দেশ পালন, জড় জগতের কলুষিত প্রভাব থেকে দূরে থাকা এবং ভগবানের ভক্তের সঙ্গ করা, এই নির্দেশগুলি পালন করলে যথাসময়ে অবশ্যই ভগবদ্ভক্তির ঈপ্সিত ফল লাভ করা যায়। যে ভক্ত ধৈর্য এবং উৎসাহ সহকারে ভগবদ্ভক্তির বিধিনিষেধগুলি অনুশীলন করেন, তিনি যথাসময়ে ভগবৎ-প্রেমরূপী ফল লাভ করেন।
শরৎকালে সরােবরগুলি পদ্মফুলে ভরে যায়, কেননা তখন সেখানে শালুক ফুল থাকে না। শালুক এবং পদ্ম উভয়েই সূর্যের কিরণে বিকশিত হয়, কিন্তু শরৎকালের অত্যন্ত উত্তপ্ত সূর্যকিরণে কেবল পদ্মই বিকশিত হয়। শালুক তখন ফুটতে পারে না। যে রাজ্যের রাজা বা সরকার অত্যন্ত বলবান, সেই রাজ্যে দস্যু, তস্কর আদি অবাঞ্ছিত দুর্বৃত্তরা থাকতে পারে না।
নাগরিকেরা যখন নিঃসংশয় হয় যে, তারা দস্যু-তস্করদের দ্বারা আক্রান্ত হবে না, তখন তারা মহানন্দে উন্নতি সাধন করে। তেজস্বী এবং বিচক্ষণ সরকারকে শরৎকালের তপ্ত সূর্যকিরণের সাথে তুলনা করা হয়েছে, দস্যু-তস্কর আদি অবাঞ্ছিত মানুষদের শালুক ফুলের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে আর রাষ্ট্রের প্রগতিশীল সৎ নাগরিকদের পদ্মফুলের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
শরৎকালে ক্ষেতগুলি পাকা শস্যে ভরে যায়। সেই সময় মানুষ ফসল কেটে মহা আনন্দে সেইগুলি ঘরে তােলার আয়ােজন করে। সেই উপলক্ষ্যে তারা নবান্ন আদি উৎসবের আয়ােজন করে।
এই নবান্ন উৎসবে নতুন শস্য পরমেশ্বর ভগবানকে নিবেদন করা হয়। বিভিন্ন মন্দিরে ভগবানের শ্রীবিগ্রহের কাছে সেই নবান্ন উৎসর্গ হয় এবং তা নিয়ে পায়েস তৈরি করে তা সকলকে বিতরণ করা হয়। শরৎকালে আরও নানা রকম পূজার আয়ােজন হয়, বিশেষ করে বাংলাদেশে তখন সেখানকার সব চাইতে বড় উৎসব দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়।
বৃন্দাবনে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরাম উপস্থিত থাকার ফলে শরৎ ঋতু সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল। শরৎকালে বণিকেরা, রাজপুরুষেরা এবং মহাআত্মারা স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করে তাদের অভীষ্ট সাধন করতে পারেন।
বর্ষার সময় বণিকেরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় তাদের পণ্যসন্তার বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতে পারেন না। রাজপুরুষেরাও জায়গায় জায়গায় গিয়ে প্রজাদের থেকে কর আদায় করতে পারেন না।
আর দিব্য জ্ঞান প্রদানকারী সাধু-মহাত্মারাও বর্ষাকালে চলাফেরা করতে পারেন না। কিন্তু শরতের আগমনে তারা সকলেই বেরিয়ে পড়েন।
রনী, যােগী এবং ভগবদ্ভক্ত, এই পরমার্থবাদী পরমার্থ সাধনের চেষ্টায় মগ্ন থাকলেও জড় দেহের বন্ধনে আবদ্ধ থাকার ফলে সম্পূর্ণরূপে দিব্য আনন্দ লাভ করতে পারে না, কিন্তু যখন তারা জড় দেহের বছন মুক্ত হন, তখন অনী পরমেশ্বর ভগবানের দেহ নিপতি রহিতা এখজ্যোতিতে লীন হয়ে যান, যােগী উচ্চতর লােকে উন্নীত হন এবং ভক্তরা পরমেশ্বর ভগবানের ধাম গােলােক বৃন্দাবনে বা বৈকুণ্ঠলােকে প্রবেশ করেন এবং সেখানে নিত্য আনন্দময় দিব্য জীবন উপভােগ করেন।
আরও পড়ুনঃ