বরুণের কবল থেকে নন্দ মহারাজকে উদ্ধার-কৃষ্ণ লীলা কথা
বরুণের কবল থেকে নন্দ মহারাজকে উদ্ধার
গোবর্ধন পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল অমাবস্যার দিন। তারপর সাতদিন ধরে ইন্দ্রের রােষে প্রচণ্ড ঝড়ঝঞ্ঝা এবং শিলাবৃষ্টি হয়েছিল।
শুক্লপক্ষের নটি দিন কেটে গেল, দশম দিনে দেবরাজ ইন্দ্র শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করেন এবং এইভাবে সেই ঘটনার শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হয়।
তারপর শুক্লপক্ষের একাদশীর দিন মহারাজ নন্দ সারাদিন উপবাস করে দ্বাদশীর দিন খুব ভােরে যমুনায় স্নান করতে গেলেন।
তিনি নদীর গভীর জলে প্রবেশ করলেন এবং তখন জলের দেবতা বরুণের ভৃত্যরা তাকে। বন্দী করে বরুণদেবের কাছে নিয়ে যায় কেননা তিনি অসময়ে সেই নদীতে স্নান করছিলেন।
জ্যোতিষ গণনা অনুসারে, যে সময় তিনি স্নান করছিলেন, সেই সময়টা ছিল আসুরি সময়। প্রকৃতপক্ষে, নন্দ মহারাজ সূর্যোদয়ের পূর্বে যমুনায় স্নান করতে চেয়েছিলেন,
কিন্তু সেই সময়টা ছিল সূর্য উদয়ের অনেক পূর্বে এবং সেই সময়টা ছিল অশুভ। তাই বরুণদেবের অনুচরেরা তাকে বন্দী করে নিয়ে যায়।
বরুণদেবের ভৃত্যরা যখন নন্দ মহারাজকে ধরে নিয়ে গেল, তখন নন্দ মহারাজের সহচরেরা উচ্চস্বরে শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরামের নাম ধরে ডাকতে লাগলেন।
তখনই শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরাম বুঝতে পারলেন যে, বরুণদেব নন্দ মহারাজকে বন্দী করে নিয়ে গেছেন। তাই তারা তৎক্ষণাৎ তাদের পিতাকে রক্ষা করার জন্য বরুণের আলয়ে গেলেন।
বৃন্দাবনবাসী ভগবানের শুদ্ধ ভক্তদের ভগবান ছাড়া আর কোন আশ্রয় নেই, তাই শিশু যেমন বিপদে পড়লে তার মা-বাবার সাহায্য প্রার্থনা করে, তারাও ঠিক তেমনভাবেই শ্রীকৃষ্ণের সাহায্য প্রার্থনা করতেন।
বরুণদেব শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে সম্বর্ধনা করে বললেন, “হে প্রভু! আজ আপনার দর্শন পেয়ে আমার দেহ ধারণ সার্থক হল। যদিও আমি সমুদ্রের সমস্ত রত্নরাজির অধীশ্বর তবুও আমি জানি যে, এই সমস্ত ধন সম্পদের দ্বারা জীবন সার্থক হয় না।
কিন্তু আজ আপনার দর্শন পেয়ে আমার জীবন সম্পূর্ণভাবে সার্থক হল। কেননা আপনার দর্শন লাভের ফলে আমাকে আর জড় শরীর ধারণ করতে হবে । তাই হে প্রভু! হে পরম ব্রহ্ম, সর্ব জীবের পরমাত্মা, পরমেশ্বর ভগবান, আমি আপনাকে আমার সশ্রদ্ধ দণ্ডবৎ প্রণতি জানাই।
আপনি হচ্ছেন পরম পুরুষ; জড়া প্রকৃতির দ্বারা আপনি কোনভাবে প্রভাবিত হন না। আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে, আমার মুর্খতার বশে, কর্তব্য-অকর্তব্য জ্ঞান রহিত হয়ে ভ্রান্তিবশত আমি আপনার পিতা নন্দ মহারাজকে বন্দী করেছি। তাই আমার ভৃত্যদের এই অপরাধের জন্য আমি আপনার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করি।
আমার মনে হয় এ যেন আমাকে আপনার দর্শন দান করে কৃপা প্রদর্শন করবার জন্য আপনারই পরিকল্পনা। হে প্রভু শ্রীকৃষ্ণ, গােবিন্দ, আমার প্রতি প্রসন্ন হােন—আপনার পিতা এখানে উপস্থিত। আপনি এখনই তাকে নিয়ে যেতে পারেন।”
এইভাবে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার পিতাকে নিয়ে গভীর হর্ষভরে তার বন্ধুদের সামনে উপস্থিত হলেন। বরুণদেবতা এত ঐশ্বর্যশালী হওয়া সত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণকে তিনি যে সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন,
তা দেখে নন্দ মহারাজ অত্যন্ত আশ্চর্য হয়েছিলেন এবং তার বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনদের কাছে তিনি সেই আশ্চর্য ঘটনার কথা সবিস্তারে বর্ণনা করেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে, শ্রীকৃষ্ণ যদিও এই রকম আশ্চর্য সমস্ত কর্ম করছিলেন, কিন্তু তবুও নন্দ মহারাজ এবং মা যশােদা ভাবতেই পারলেন না যে, তিনি হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান।
পক্ষান্তরে, তারা সব সময়ই তাকে তাদের স্নেহের দুলাল বলেই মনে করতেন। তাই নন্দ মহারাজ বুঝতে পারলেন না যে, বরুণদেব শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করেছিলেন, কেননা একি হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান।
পক্ষান্তরে, তিনি মনে করেছিলেন যে, যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন তাদের অপূর্ব মাধুর্যমণ্ডিত শিশুপুত্র, তাই সবাই তাকে শ্রদ্ধা করেছিলেন।
নন্দ মহারাজের বন্ধুরা, সমস্ত গােপেরা অধীর আগ্রহে, জানতে চেয়েছিলেন যে, প্রকৃতপক্ষে শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং তারা জানতে চেয়েছিলেন, তিনি তাদের মুক্তিদান করবেন কিনা।
এইভাবে তারা যখন নিজেদের মধ্যে আলােচনা করছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ তখন তাদের মনের কথা জানতে পেরে, তারা যে ভগবদ্ধামে ফিরে যাবেন, সেই সম্বন্ধে তাদের আশ্বস্ত করার জন্য তাদের বৈকুণ্ঠলােক প্রদর্শন করালেন।
সাধারণ মানুষেরা সচরাচর এই জড় জগতে নানা রকম কঠোর পরিশ্রম করে চলে, এবং তাদের কোন ধারণাই নেই যে, আর একটি জগৎ আছে যার নাম চিৎ-জগৎ, যেখানে জীবন সৎ,
চিৎ এবং আনন্দময়। যে কথা ভগবদ্গীতায় ভগবান বলেছেন ন তদ্ধাম পরমং মম। অর্থাৎ আমার সেই দিব্য ধামে একবার গেলে কাউকে আর এই মৃত্যু এবং দুঃখময় জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না।
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সব সময়ই বদ্ধ জীবদের এই জড় জগতের অনেক অনেক উর্ধ্বে, এই জড় জগতের অনন্তকোটি ব্রহ্মাণ্ডের অতীত, চিন্ময় জগতের কথা জানালেন।
শ্রীকৃষ্ণ সব সময়ই বদ্ধ জীবের প্রতি অত্যন্ত করুণাময়। কিন্তু ভগবদগীতায় তিনি বলেছেন যে, ভক্তদের তিনি বিশেষভাবে বাৎসল্য প্রকাশ করেন। তাদের অন্তরের কথা জানতে পেরে শ্রীকৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ বিবেচনা করলেন যে,
বৃন্দাবনে ভক্তদের তিনি চিদাকাশে বৈকুণ্ঠলােকের কথা জানাবেন। এই জড় জগতে প্রতিটি বদ্ধ জীবই অজ্ঞানের অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তাই তার জড় দেহটাকে তাদের স্বরূপ বলে মনে করে দেহাত্মবুদ্ধিতে মগ্ন হয়ে আছে।
প্রত্যেকেই ভ্রান্তিবশত মনে করছে যে, জড় জগৎ এবং এই ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে প্রত্যেকেই অজ্ঞানের দ্বারা আচ্ছন্ন।
জড় দেহের বিভিন্ন কার্যকলাপকে বদ্ধ জীবই তার দেহকে তার স্বরূপ বলে মনে করে দেহের অনুসারে কর্ম করে চলেছে। এই সমস্ত কর্মের ফলে তার পরবর্তী জীবন হচ্ছে।
যেহেতু চিন্ময় জগৎ বা ভগবদ্ধাম সম্বন্ধে তাদের ধারনা নেই তাই তারা চিন্ময় কার্যকলাপের ভক্তিযােগের অনুশীলন করে না। যারা অনুশীলন করেন, তারা এই দেহত্যাগ করার পর সরাসরিভাবে চিৎ জগতে ফিরে যান এবং সেখানে অধিষ্ঠিত হন।
সূর্য যেমন সর্বক্ষণই এই পৃথিবীর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় তার কিরণ বিতরণ করছে, ঠিক তেমনই শ্রীকৃষ্ণের লীলা এই জড় জগতে এক ব্রহ্মাণ্ড থেকে আরেক ব্রহ্মাণ্ডে নিত্যকাল ধরে চলছে।
ভগবানের যে শুদ্ধ ভক্তরা সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভক্তি সম্পাদন করেছেন, তারা তৎক্ষণাৎ যেই ব্রহ্মাণ্ডে শ্রীকৃষ্ণ তার লীলাবিলাস করছেন, সেখানে শ্রীকৃষ্ণের সেই লীলায় অংশগ্রহণ করার সুযােগ পান।
সেই ব্রহ্মাণ্ডে ভক্ত শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার প্রথম সুযােগ পান। এইভাবে তার শিক্ষা চলতে থাকে, যেমন এই ব্রহ্মাণ্ডে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা আমরা দেখতে পাচ্ছি। শ্রীকৃষ্ণ তাই ব্রজবাসীদের কাছে বৈকুণ্ঠলােক প্রকাশিত করলেন যাতে তাঁরা তাঁদের গম্ভব্যস্থল সম্বন্ধে অবগত হতে পারেন।
এইভাবে শ্রীকৃষ্ণ তাদের নিত্য, শাশ্বত, অন্তহীন এবং পূর্ণ জ্ঞানময় চিৎ-জগৎ প্রদর্শন করালেন। এই জড় জগতের বিভিন্ন স্তর অনুসারে বিভিন্ন রূপ আছে।
এবং বিভিন্ন স্তর অনুপাতে জ্ঞান প্রকাশিত হয়। যেমন, একটি শিশুর জ্ঞান প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জ্ঞানের মতাে পূর্ণ নয়।
সর্বত্রই বিভিন্ন স্তরের জীব রয়েছে জলচর, গাছপালা, সরীসৃপ, কীটপতঙ্গ, পক্ষী, পশু, এবং অসভ্য ও সভ্য মানুষেরও উর্ধ্বে রয়েছেন দেবতা, চারণ, সিদ্ধ এবং অবশেষে সর্বোচ্চলােক ব্রহ্মলােক, যেখানে ব্রহ্মা বাস করেন এবং এই দেবতাদের মধ্যেও জ্ঞানের বিভিন্ন স্তর রয়েছে।
কিন্তু এই জড় জগৎ অতিক্রম করে বৈকুণ্ঠলােকে সকলেই পূর্ণ জ্ঞানময়। বৈকুণ্ঠলােকে বা কৃষ্ণলােকে প্রতিটি জীবই ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবায় যুক্ত।
ভগবদগীতায় প্রতিপন্ন হয়েছে, পূর্ণজ্ঞান মানে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানা। বেদ এবং ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে যে, ব্রহ্মজ্যোতি বা চিদাকাশে সূর্য, চন্দ্র বা বৈদ্যুতিক আলােকের প্রয়ােজন হয় না।
সেই সমস্ত গ্রহগুলি জ্যোতির্ময় এবং তা নিত্য। ব্রহ্মজ্যোতি বা চিদাকাশে সৃষ্টি এবং প্রলয়ের কোন প্রশ্ন ওঠে না। ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে যে, এই জড় জগতের উর্ধ্বে আর একটি নিত্য জগৎ রয়েছে, যেখানে সব কিছুই নিত্য, শাশ্বত, অবিনশ্বর।
এই চিৎ-জগতের তথ্য পাওয়া যায় মহান মুনি-ঋষি এবং মহাত্মাদের কাছ থেকে, যারা জড়া প্রকৃতির গুণের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়েছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষ সেই চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠিত হচ্ছে, ততক্ষণ তার পক্ষে চিন্ময় জগৎ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়
তাই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ভক্তিযােগ অবলম্বন করে দিনের মধ্যে ২৪ ঘণ্টা কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হলে এই জড়া প্রকৃতির গুণ থেকে মুক্ত হয়ে অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত হওয়া যায়।
কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত ভক্ত সহজেই চিৎ-জগৎ বা বৈকুণ্ঠলােকের প্রকৃতি উপলব্ধি করতে পারেন। বৃন্দাবনের অধিবাসীরা সর্বক্ষণ শ্রীকৃষ্ণের চিন্তায় মগ্ন থাকার ফলে অতি সহজেই বৈকুণ্ঠলােকের দিব্য প্রকৃতি সম্বন্ধে অবগত হতে পেরেছিলেন।
এইভাবে নন্দ মহারাজের অধীন সমস্ত গােপদের শ্রীকৃষ্ণ সেই স্থানে নিয়ে গেলেন যেখানে পরে তিনি অক্রুরকে বৈকুষ্ঠলােক দেখিয়েছিলেন। তারা সেখানে স্নান করলেন এবং বৈকুণ্ঠলােক দর্শন করলেন।
চিৎ-জগৎ এবং বৈকুণ্ঠলােক দর্শন করার পর নন্দ আদি গােপেরা দেখলেন যে, অপূর্ব সুন্দর স্তুতি দ্বারা মূর্তিমান বেদ সকল শ্রীকৃষ্ণের স্তুতি করছেন। তা দেখে তারা অত্যন্ত বিস্মিত এবং পরমানন্দে মগ্ন হলেন।