বৃন্দাবনে প্রলয়ঙ্কর বারিবর্ষণ-কৃষ্ণলীলা কাহিনী-কৃষ্ণ কথা
বৃন্দাবনে প্রলয়ঙ্কর বারিবর্ষণ-কৃষ্ণ লীলা কথা
ইন্দ্র যখন বুঝতে পারলেন যে, তার উদ্দেশ্যে বৃন্দাবনের গােপেরা যে যজ্ঞের আয়ােজন করেছিল শ্রীকৃষ্ণ তা বন্ধ করে দিয়েছেন, তখন তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন এবং তার সেই রাগ ব্রজবাসীদের উপর বর্ষিত হল।
যদিও দেবরাজ ইন্দ্র জানতেন যে, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তাদের রক্ষা করছেন। বিভিন্ন মেঘের পরিচালক ইন্দ্র তখন সাম্বর্তক মেঘকে আহ্বান করলেন। জড় সৃষ্টি যখন ধ্বংস করার প্রয়ােজন হয়,
তখন এই মেঘকে ডাকা হয়। ইন্দ্র সেই প্রলয়ঙ্কর সাম্বর্তক মেঘকে আদেশ দিলেন বৃন্দাবনের উপর প্রবলভাবে বারিবর্ষণ করে সেই অঞ্চলকে সম্পূর্ণভাবে প্লাবিত করতে।
আসুরিক ভাবাপন্ন হয়ে ইন্দ্র মনে করেছিলেন যে, তিনিই হচ্ছেন সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর। অসুরেরা যখন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখন তারা পরম নিয়ন্তা পরমেশ্বর ভগবানকে অস্বীকার করে।
ইন্দ্র যদিও অসুর ছিলেন না কিন্তু তাঁর উচ্চ পদের গৌরবে গর্বান্বিত হয়ে তিনি পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন যে, তিনি শ্রীকৃষ্ণের মতাে শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন।
ইন্দ্র বললেন, "দেখ, বৃন্দাবনের অধিবাসীরা কি রকম উদ্ধত হয়ে উঠেছে! তারা সাধারণ বনবাসী, কিন্তু একটা সাধারণ বালক কৃষ্ণকে আশ্রয় করে আমার যজ্ঞ বর্জন করে দেবতাদের অবমাননা করতে সাহস করছে।
ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ ঘােষণা করেছেন যে, যারা দেবতাদের পূজা করে, তারা বিশেষ বুদ্ধিমান নয়। তিনি আরও বলেছেন যে, সব রকমের পূজা-অর্চনা এবং তথাকথিত ধর্ম অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করে কেবল তার শরণাগত হতে।
এইভাবে ইন্দ্রের ক্রোধ উৎপাদন করে এবং অবশেষে তাকে শাসন করে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভক্তদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, যারা কৃষ্ণভাবনা সহকারে শ্রীকৃষ্ণের সেবায় যুক্ত হয়েছেন, তাদের অন্য কোন দেব-দেবীর পূজা করার কোন প্রয়ােজন নেই,
তাতে যদি সেই সমস্ত দেব-দেবীরা ক্রুদ্ধ হন, তবুও নয়। শ্রীকৃষ্ণ তার ভক্তদের সর্বতােভাবে রক্ষা করেন এবং তাই ভক্তের কর্তব্য হচ্ছে, সম্পূর্ণভাবে তাঁর কৃপার উপর নির্ভর করা।
ইন্দ্র বৃন্দাবনবাসীদের আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের অভিশাপ দিলেন, দেবতাদের আধিপত্যের অবমাননা করার ফলে বৃন্দাবনবাসীরা জীবনে নানা রকম দুঃখ-কষ্ট ভােগ করবে।
দেবতাদের যজ্ঞে অবহেলা করার ফলে তারা বিপদসঙ্কুল এই ভবসমুদ্র পার হতে পারবে না। ইন্দ্র আরও বললেন, বৃন্দাবনের গােপেরা কৃষ্ণ নামক একটি বাচাল বালকের উপদেশে আমার আধিপত্যকে অবহেলা করেছে।
এই কৃষ্ণ একটি শিশু, এবং সেই শিশুর উপর নির্ভর করে তারা আমার ক্রোধ উৎপাদন করেছে।” এইভাবে তিনি সাম্বর্তক মেঘকে আদেশ দিলেন বৃন্দাবনের সমস্ত সম্পদ ধ্বংস করতে।
ইন্দ্র বললেন, “বৃন্দাবনবাসীরা তাদের জড় ঐশ্বর্যের গর্বে এবং তাদের ক্ষুদ্র বন্ধু কৃষ্ণের উপস্থিতির ফলে অত্যন্ত গর্বান্বিত হয়ে উঠেছে।
এই কৃষ্ণ একটি বাচাল শিশুমাত্র এবং এই সম্পূর্ণ জড় সৃষ্টি সম্বন্ধে তার কোন ধারণাই নেই, যদিও সে একটা বাচাল ছেলের মতাে মনে করে যে, সে সব কিছু জেনে বসে আছে।
যেহেতু তারা কৃষ্ণের উপর এই রকম গুরুত্ব আরােপ করেছে, তাই তাদের দণ্ডভােগ করতে হবে। আর তাই আমি সাম্বর্তক মেঘকে আদেশ দিয়েছি সেখানে গিয়ে সেই স্থানকে সম্পূর্ণভাবে প্লাবিত করতে।
তাদের গাভীসহ তারা যেন বিনাশ প্রাপ্ত হয়। এখানে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, গ্রামে এবং শহরের বাইরে মানুষদের সমৃদ্ধি নির্ভর করে গাভীর উপর।
গাে-ধন যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখন মানুষ সর্বতােভাবে শ্রীহীন হয়ে পড়ে। ইন্দ্র যখন সাম্বর্তক এবং তার সহচর মেঘদের বৃন্দাবনে গিয়ে বর্ষণ করতে আদেশ দিলেন, তখন সেই মেঘেরা অত্যন্ত ভীত হল।
তাই ইন্দ্র তাদের অভয় দিয়ে বললেন, “তােমরা যাও এবং তােমাদের সঙ্গে ঐরাবতে চড়ে ঝক্সাসহ আমিও যাচ্ছি, এবং বৃন্দাবনবাসীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আমি আমার সমস্ত শক্তি প্রয়ােগ করব।"
এইভাবে দেবরাজ ইন্দ্র কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে ভয়ঙ্কর সমস্ত মেঘেরা বৃন্দাবনের উপর এসে উপস্থিত হল এবং তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রবলভাবে বর্ষণ করতে লাগল।
তখন নিরন্তর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল এবং বজ্রপাত হচ্ছিল, আর বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ডভাবে হাওয়া বইছিল। তীক্ষ্ণ বাণের মতাে সেই বৃষ্টির ধারা ঝরে পড়ছিল।
নিরন্তর স্তম্ভের মতাে স্থুল জলধারা বর্ষণ হওয়ার ফলে বৃন্দাবনের সমস্ত ভূমি জলরাশিতে প্লাবিত হয়ে গেল এবং তখন আর বােঝা গেল না কোথায় ভূমি উঁচু আর কোথায় নীচু।
সেই পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল, বিশেষ করে পশুদের জন্য। বৃষ্টির সঙ্গে প্রচণ্ড বেগে বায়ু বইছিল এবং ভীষণ শীতে বৃন্দাবনের প্রতিটি প্রাণী থরথর করে কাঁপতে লাগল।
তাদের আর কোন আশ্রয় ছিল না, তাই তারা গােবিন্দের কাছে গিয়ে তার শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করল। গাভীরা এই প্রচণ্ড বর্ষণে অত্যন্ত উৎপীড়িত হয়ে তাদের দেহের দ্বারা মস্তক এবং বৎসদের আচ্ছাদিত করে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করল।
সেই সময় বৃন্দাবনের সমস্ত অধিবাসীরা শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন, হে কৃষ্ণ, তুমি সর্বশক্তিমান এবং তুমি ভক্তবৎসল, কৃপা করে এখন তুমি আমাদের রক্ষা কর। ক্রুদ্ধ ইন্দ্রের দ্বারা আমরা অত্যন্ত উত্ত্যক্ত হয়েছি।”
এই প্রার্থনা শুনে শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে পারলেন যে, ইন্দ্র তাঁর যজ্ঞের সম্মান থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে ক্রুদ্ধ হয়ে এই অসময়ে ঝড়-ঝঞ্গাসহ শিলা এবং বৃষ্টি বর্ষণ করছেন।
শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে পারলেন যে, এটা ক্রুদ্ধ ইন্দ্রের বলপ্রকাশ। তিনি তাই ঠিক করলেন, এই দেবতা নিজেকে সর্বশক্তিমান বলে মনে করে তার শক্তি প্রদর্শন করছে কিন্তু এখন আমি এর জবাব দেব এবং আমি ওকে শিক্ষা দেব যে,
এই ব্রহ্মাণ্ডের পরিচালনার কাজে সে সর্বেসর্বা নয়। আমি হচ্ছি কলের পরম নিয়ন্তা এবং তার পদমর্যাদার গর্ব ও তার শক্তির দর্প এবার আমি চূর্ণ করব।
দেবতারা আমার ভক্ত, তাই তাদের পক্ষে আমার পরম পদ ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু পদমর্যাদার গর্বে সে এতই গর্বিত হয়ে উঠেছে যে, তার দুর্মতি হয়েছে। আমি এখন তাকে এই মিথ্যা অহঙ্কার থেকে মুক্ত করব।
বৃন্দাবনের শুদ্ধ ভক্তরা এখন সর্বতােভাবে আমার কৃপার ওপর নির্ভর করে আছে এবং আমিও সম্পূর্ণভাবে তাদের আমার আশ্রয়ে গ্রহণ করেছি। এখন আমি তাদের রক্ষা করব। আমার যােগমায়ার প্রভাবে আমি তাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করব।"
মনে মনে এইভাবে চিন্তা করে শ্রীকৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ এক হাতে গােবর্ধন পর্বত তুলে ধরলেন—ঠিক যেভাবে একটি শিশু মাটি থেকে একটা ব্যাঙের ছাতা তােলে। এইভাবে তিনি গিরি গােবর্ধন ধারণ লীলা প্রদর্শন করলেন।
তারপর তার ভক্তদের সম্বােধন করে তিনি বললেন, “হে মাতঃ, হে পিতঃ, হে ব্রজজন, তােমরা তােমাদের গাে-ধনের সঙ্গে নিশ্চিন্তে এই গােবর্ধন পর্বতের নীচে এসে দাঁড়াও যা আমি এখন একটা ছাতার মতাে তুলে ধরেছি। তােমরা এই মনে করে ভয় পেও না যে, আমার হাত থেকে এই পর্বত পড়ে যাবে।
প্রবল বর্ষণে এবং ঝঞ্জায় তােমরা খুবই ক্লিষ্ট হয়ে পড়েছ, তাই আমি এই পর্বত তুলে ধরেছি যা একটা বিট দুতার মতাে তােমাদের এই বর্ষণ থেকে রক্ষা করবে।
তােমাদের পরিত্রাণের জন্য আমি এই উপায় বিধান করেছি। তোমরা এখন তােমাদের পশুসহ এই বিরাট ছাতার নীচে এসে সুখে আশ্রয় গ্রহণ কর।”
শ্রীকৃষ্ণ তাদের এইভাবে আশ্বাস দিলে সমস্ত ব্রজবাসীরা তাদের পশু, শকটসমূহ, ভূত্য আদি সঙ্গে নিয়ে একুধের আদেশ অনুসারে সেই বিরাট পর্বতের নীচে আশ্রয় গ্রহণ করলেন।
তাদের পশুসহ ব্ৰজবাসীরা এক সপ্তাহকাল সেখানে অবস্থান করলেন। শ্রীকৃষ্ণ ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং নিজের সমস্ত সুখ পরিত্যাগ করে সেই এক সপ্তাহ ধরে একটা ছাতার মতো গােবর্ধন পর্বত ধারণ করে রইলেন।
তাঁর বাম হাতের কড়ে আঙ্গুলের উপর শ্রীকৃষ্ণকে সেই বিরাট পর্বত ধারণ করতে দেখে ব্রজবাসীরা অবাক হয়ে গেলেন। শ্রীকৃষ্ণের এই অলৌকিক শক্তি দেখে দেবরাজ ইন্দ্র বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সংকল্লচ্যুত হলেন।
তিনি তৎক্ষণাৎ মেঘদের ডেকে তাদের নিবারিত করলেন। আকাশ যখন সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত হল, তখন আবার সূর্যোদয় হল এবং প্রচণ্ড বায়ু ও বৃষ্টি নিবৃত্ত হল।
সেই সময় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, এখন যাঁর আরেক নাম হল গিরিধারী, বললেন, “হে গােপগণ তােমরা, এখন তােমাদের স্ত্রী-পুত্র, গাভী এবং ধনসম্পদ সহ ফিরে যেতে পার। এখন আর কোন ভয় নেই। বায়ু ও বৃষ্টি এখন নিবৃত্ত হয়েছে এবং নদীর প্লাবন প্রশমিত হয়েছে।
তখন সমস্ত গােপেরা তাঁদের উপকরণসমূহ শকটে পূর্ণ করে তাদের গাভী এবং অন্যান্য পশুদের নিয়ে ধীরে ধীরে সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন।
তাঁরা সকলে বেরিয়ে এলে শ্রীকৃষ্ণ সকলের সামনে অনায়াসে গােবর্ধন পর্বতকে আগের মতাে স্বস্থানে স্থাপন করলেন। তখন প্রেমের আবেগে পরিপূর্ণ চিত্তে বৃন্দাবাসীরা কৃষের কাছে এসে তাকে আলিঙ্গন করলেন।
শ্রীকৃষ্ণের প্রতি স্বভাবত স্নেহশীলা গােপীরা তাদের অশ্রুমিশ্রিত দধি তাকে দিলেন এবং তাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। মা যশােদা, মা রােহিলী, নন্দ মহারাজ এবং মহাবলীয়ান বলরামও তখন স্নেহবিহুল হয়ে একে একে শ্রীকৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে আশীর্বাদ করলেন।
তখন স্বর্গের দেবতা, সিদ্ধ, গন্ধর্ব এবং চারণেরা তুষ্ট হয়ে স্তুতি এবং পুষ্পবর্ষণ করতে লাগলেন। তখন স্বর্গের দেবতারা শঙ্খ, দুন্দুভি, ডম্বরু প্রভৃতি বাজনা বাজাচ্ছিলেন এবং গন্ধর্বপতিরা গান করছিলেন।
তারপর পরমেশ্বর ভগবান তার সখা এবং পশু-পরিবৃত হয়ে তার গৃহে ফিরে গেলেন। গােপিকারা হৃদয়স্পর্শী শ্রীকৃষ্ণের সেই বিস্ময়জনক কার্যের বিষয়ে হৃষ্টচিত্তে গান করতে লাগলেন।