শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ব্রহ্মার স্তব- কৃষ্ণ লীলা কাহিনী-শ্রীমদ্ভাগবত


শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ব্রহ্মার স্তব-কৃষ্ণলীলা  


ব্রহ্মা বললেন, “হে পরমেশ্বর ভগবান, আপনিই পরম আরাধ্য। তাই আমি আপনার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য আপনার শ্রীপাদপদ্মে আমার প্রণতি এবং স্তুতি নিবেদন করছি। আপনার অঙ্গকান্তি বর্ষার জলভরা মেঘের মতাে। তাই আপনার নাম ঘনশ্যাম। আপনি বিদ্যুতের মতো পীত বস্ত্রধারী।

আপনি গােপরাজ নন্দের নিত্যপুত্র। আপনার মুখমণ্ডল গুঞ্জাবিরচিত কর্ণভূষণের দ্বারা বিভূষিত, এবং মাথায় শিখিপুচ্ছ। মুকুট, বনফুলের মালা, বেত্র, বেণু ইত্যাদির দ্বারা ভূষিত হয়ে আপনার পরম সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে। আপনার শ্রী চরণ যুগল অতিশয় কোমল। আমি আপনার স্তব করছি।

“হে ভগবান, লােকে মনে করে যে, আমি বৈদিক জ্ঞানের আধার এবং এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা, কিন্তু এখন প্রমাণিত হল যে, আমিও আপনাকে সম্পূর্ণভাবে অবগত হতে পারিনি, যদিও একটি শিশু রূপে আপনি আমার সম্মুখে বিরাজ করছেন। আপনি আপনার গােপসখা এবং গােবৎসদের সঙ্গে একজন সাধারণ গ্রাম্য বালকের মতাে খেলা করছেন, তা দেখে মনে হয় যেন আপনি যথেষ্ট শিক্ষাও লাভ করেননি। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে ঠিক যেন একটি অসহায় শিশু, হাতে এক দলা খাবার নিয়ে তার গােবৎসদের খুঁজে বেড়াচ্ছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও আপনার দেহ এবং আমার দেহের মধ্যে এত গভীর পার্থক্য রয়েছে যে, আপনার শক্তির অনুমান পর্যন্ত আমি করতে পারি না। ব্রহ্মসংহিতা তার বর্ণনা করে আমি বলেছি যে, আপনার শরীর জড় নয়—তা সচ্চিদানন্দময় বিগ্রহ।”

ব্রহ্মসংহিতায় বর্ণনা করা হয়েছে যে, ভগবানের শরীর চিন্ময়। ভগবানের সত্তার সঙ্গে তার দেহের কোন পার্থক্য নেই। তাঁর শরীরের প্রতিটি অঙ্গই অন্য সব কটি ইন্দ্রিয়ের কাজ করতে পারে। তিনি তার হাত দিয়ে দেখতে পারেন, তিনি তার চোখ দিয়ে শুনতে পারেন, তিনি তার পা দিয়ে নৈবেদ্য গ্রহণ করতে পারেন এবং তিনি তাঁর মুখ দিয়ে সৃষ্টি করতে পারেন।

ব্রহ্মা বললেন, “ভক্তদের কল্যাণের জন্যই আপনি গােপশিশুরূপে আবির্ভূত হয়েছেন এবং যদিও আমি আপনার গোবৎস এবং সখাদের চুরি করে আপনার শ্রীপাদপদ্মে অপরাধ করেছি, তবুও আমি জানি যে আপনি আমার প্রতি কৃপাপরবশ। সেটাই আপনার অপ্রাকৃত গুণাবলী; আপনার ভক্তদের প্রতি আপনি অত্যন্ত স্নেহশীল—আপনি ভক্তবৎসল। তাই আমার প্রতি আপনার এই অসীম স্নেহ। 

আমি আপনার শক্তির আদি অন্ত খুঁজে পাই না। আমি ব্ৰহ্মা, এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা, কিন্তু তা সত্ত্বেও আপনার এই শিশুরূপের গুণরাশির অনুমান পর্যন্ত আমি করতে পারছি না। তখন সাধারণ লােকের আর কি কথা! আমি যদি আপনার এই শিশু রূপের দিব্য গুণাবলীসমুহ গণনা করতে না পারি, তাহলে আপনার দিব্য লীলাসমূহই বা আমি কিভাবে বুঝতে পারব? তাই ভগবদ্গীতায়  বলা হয়েছে যিনি অতি অল্প পরিমাণেও ভগবানের দিব্য লীলা সমূহ, তার আবির্ভাবলীলা এবং অপ্রকটলীলা বুঝতে পারেন, তিনি এই জড় দেহ পরিত্যাগ করার পর ভগবানের রাজ্যে প্রবেশ করার যােগ্যতা অর্জন করেন। বেদেও এই উক্তি সত্য বলে প্রতিপন্ন হয়েছে এবং সেখানে বলা হয়েছে যে, পরমেশ্বর ভগবানকে জানার মাধ্যমে আমরা জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি। 

তাই আমি সকলকে সাবধান করে দিচ্ছি যেন তারা কখনও মনােধর্মপ্রসূত জ্ঞানের মাধ্যমে আপনাকে জানবার চেষ্টা না করে। "আপনাকে জানার সব চাইতে প্রকৃষ্ট পন্থা হচ্ছে, মনােধর্মপ্রসূত সব রকম জল্পনা কল্পনা পরিত্যাগ করে, বিনীতভাবে ভগবদগীতা আদি শাস্ত্রগ্রন্থের মাধ্যমে অথবা আপনার চরণে সর্বতােভাবে নিবেদিত-আত্মা কোন মহাজনের শ্রীমুখ থেকে আপনার অপ্রাকৃত লীলাসমুহ শ্রবণ করা। কোন রকম জল্পনা-কল্পনা না করে ভগবদ্ভক্তের শ্রীমুখ থেকে ভাগবতম্ শ্রবণ করতে হয়, জড় জাগতিক অবস্থার পরিবর্তন করার কোন প্রয়ােজন হয় না, কেবল আপনার প্রদত্ত বাণী শ্রবণ করার মাধ্যমেই মানুষ তার জীবনের যথার্থ উদ্দেশ্য সাধন করতে পারেন। জড় ইন্দ্রিয়েরমাধ্যমে আপনাকে জানা যায় না, কিন্তু তবুও কেবল আপনার কথা শ্রবণ করার মাধ্যমে মানুষ ধীরে ধীরে অজ্ঞানের অন্ধকারকে পরাভূত করে আপনাকে জানতে পাবে। আপনার অহৈতুকী কৃপার প্রভাবে আপনি ভক্তের হৃদয়ে প্রকাশিত হন। অন্য কোনভাবে আপনাকে জানা যায় না।

ভক্তিবিহীন জ্ঞানের মাধ্যমে আপনাকে জানার চেষ্টা কেবল সময়েরই অপচয় মাত্র। ভক্তি এতই অপূর্ব যে, তার অতি অল্প অনুশীলন করার ফলেই মানুষ পরম পূর্ণতা লাভ করতে পারে। তাই কারাের পক্ষেই এই অতি মঙ্গলজনক ভগবদ্ভক্তির পন্থা পরিত্যাগ করে জ্ঞানের মাধ্যমে আপনাকে জানার চেষ্টা করা উচিত নয়। মনন ধর্ম প্রসূত জল্পনা-কল্পনার মাধ্যমে আপনার আংশিক প্রকাশ—আপনার বিশ্বরূপ দর্শন করা যেতে পারে, কিন্তু সব কিছুর পরম উৎসরূপে আপনাকে জানা যায় না। যারা কেবল মনােধর্মপ্রসৃত জ্ঞানের প্রয়াসী, তারা কেবল তাদের শক্তির অপচয় করছে। ধানের তুষে প্রহার করলে যেমন তা থেকে চাল পাওয়া যায় না, ঠিক তেমনই ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে আপনাকে পাওয়া যায় না। অল্প একটু ধানও টেকিতে ভাঙলে তা থেকে চাল পাওয়া যায়, কিন্তু পর্বত পরিমাণ তুষ থেকে এক মুঠো চাল পাওয়া যায় । তাতে কেবল সময়ের অপচয় হয়।

“হে পরম প্রভু, মানব সমাজের ইতিহাসে বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে যেখানে মানুষ বহু প্রচেষ্টার মাধ্যমেও পারমার্থিক স্তরে অধিষ্ঠিত হতে অক্ষম হয়ে, কায়মনােবাক্যে আপনার সেবা করার ফলে আপনার দিব্য ধামে প্রবেশ করার সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধি লাভ করেছেন। ভক্তিযুক্ত সেবা ছাড়া জ্ঞান বা ধ্যানের মাধ্যমে আপনাকে জানা যায় না। তাই এই জড়জাগতিক কার্যে লিপ্ত থাকার সময় আপনার শ্রীপাদপদ্মের প্রতি ভক্তি যুক্ত হওয়া কর্তব্য, এবং সর্বদাই আপনার অপ্রাকৃত মহিমা শ্রবণ এবং কীর্তন করা কর্তব্য। কেবলমাত্র আপনার মহিমা শ্রবণ কীর্তন করার ফলে আপনার দিব্যধামে প্রবিষ্ট হওয়ার সালোক্য মুক্তি লাভ করা যায়। কেউ যখন আপনার দিব্য মহিমা শ্রবণ কীর্তন করার মাধ্যমে আপনার প্রতি অনুরক্ত হন এবং তার সমস্ত কর্মের ফল কেবল আপনার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য আপনাকে উৎসর্গ করেন, তা হলে অনায়াসে তিনি আপনার পরম ধামে প্রবেশ করার সৌভাগ্য অর্জন করে নিত্য আনন্দে মগ্ন হন। যারা তাদের চিত্তকে সর্বতােভাবে কলুষমুক্ত করে নির্মল হতে পেরেছেন, তারাই কেবল আপনাকে জানতে পারেন, এবং তা আপনার মহিমা শ্রবণ কীর্তন করার মাধ্যমেই সম্ভব হয়।”ভগবান সর্বব্যাপ্ত। শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতায় নিজেই বলেছেন, “আমাকে আশ্রয় করেই সব কিছু বিরাজ করছে, কিন্তু আমি কোন কিছুতেই আবদ্ধনই।

বেদান্ত-সুত্রের প্রথমেই বলা হয়েছে যে, পরমেশ্বর ভগবানই হচ্ছেন সমস্ত গুণের উৎস। সাধারণত তাকে বলা হয় নির্গুণ, অর্থাৎ তিনি সব রকমের গুণ থেকে মুক্ত। কিন্তু নির্বিশেষবাদীরা বলেন যে, নির্গুন মানে হচ্ছে তাঁর কোন গুণ নেই। যেহেতু তারা অপ্রাকৃত উপলব্ধির মাধ্যমে ভগবানের গুণাবলী উপলব্ধি করতে পারেন না, তাই তাঁরা বলেন যে, পরমেশ্বর ভগবানের কোন গুণ নেই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এই ধারণা অত্যন্ত ভ্রান্ত। ভগবানই হচ্ছেন সমস্ত গুণের উৎস। সমস্থ গুণাবলী নিত্য তাঁর থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে। তাই তিনি কিভাবে ওণহীন হবেন। আর কিভাবেই বা সীমিত চেতনা সম্পন্ন জীব ভগবানের গুণাবলীর বর্ণনা করবে? কেউ হয়ত ক্ষণিকের জন্য ভগবানের গুণাবলী গণনা করতে পারে, কিন্তু তাঁর গুণাবলী প্রতি মুহূর্তেই বর্ষিত হচ্ছে, তাই তাঁর দিব্য শুণাবলী গণনা করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই তাকে বলা হয় নি। তাঁর গুণাবলী গণনা করা যায় না।

জল্পনার-কল্পনার মাধ্যমে ভগবানের অচিন্ত্য গুণাবলী সম্বন্ধে অবগত হওয়ার চেষ্টা করা কেবল অনর্থক পরিশ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। মনােধর্মপ্রসূত জ্ঞানের মাধ্যমে অথবা যৌগিক শরীর চর্চার মাধ্যমে যােগসিদ্ধি লাভ করার কোনই প্রয়ােজনীয়তা নেই। আমাদের কেবল জানতে হবে যে, এই দেহের সুখ এবং দুঃখ পূর্ব থেকেই নির্ধারিত হয়ে আছে। দেহের দুঃখের নিরসন করে সুখ লাভের প্রয়াস করার কোন সার্থকতা নেই। সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হচ্ছে সর্বদা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে কায়মনােবাক্যে ভগবানের সেবা করার মাধ্যমে ভগবানের শ্রীপাদপদ্মে প্রপত্তি করা।

এই অপ্রাকৃত শ্রমের মধ্যেই নিহিত রয়েছে আমাদের অস্তিত্বের যথার্থ সার্থকতা। এ ছাড়া অন্য কোন প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরমতত্ত্বকে কখনই জানা যায় না। তাই যারা যথার্থ বুদ্ধিমান, তারা পরমেশ্বর ভগবানকে, পরম সত্যকে, যৌগিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জানবার চেষ্টা করেন না। পক্ষান্তরে, তারা ভক্তিসহকারে ভগবানের সেবায় যুক্ত হয়ে তাঁর ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে থাকেন। জানেন যে, এই দেহের সুখ দুঃখ সমস্তই পূর্বকৃত কর্মের ফল অনুসারে আপনা থেকেই আসে। কেউ যদি সরল জীবন যাপন করেন, তখন আপনা থেকেই ভগবদ্ধামে প্রবেশ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। 

কেউ যখন ভগবানের সেবায় যুক্ত হয়ে ভগবানের কাছে ফিরে যাওয়ার এই সরল অবলম্বন করেন, তখন থেকেই তিনি জড়া প্রকৃতির থেকে মুক্ত হয়ে অপ্রাকৃত স্তরে ভগবানের সঙ্গ লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শক্তি পরীক্ষা করার জন্য ব্রহ্মা অত্যন্ত সন্দিহান জীবরূপে ভগবানের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি ভগবানের গােবৎস এবং সখাদের হরণ করে দেখতে চেয়েছিলেন কিভাবে ভগবান তাদের পুনরুদ্ধার করেন। এইভাবে আচরণ করার পর ব্রহ্মা স্বীকার করেছিলেন যে, তার সেই প্রচেষ্টা চরম ধৃষ্টতায় পরিণত হয়েছে, কেননা তিনি সমস্ত শক্তির উৎস পরমেশ্বর ভগবানের কাছে তাঁর নিজের শক্তির পরীক্ষা করছিলেন। প্রকৃতিস্থ হওয়ার পর ব্রহ্মা দেখলেন যে, এই জড়া প্রকৃতির সমস্ত জীবের তুলনায় যদিও তিনি হচ্ছেন সব চাইতে শক্তিশালী, কিন্তু পরমেশ্বর ভগবানের শক্তির কাছে তার শক্তি নিতান্তই নগণ্য। জড় জগতের বৈজ্ঞানিকেরা পারমাণবিক অস্ত্র আদি নানা রকম অদ্ভুত বস্তু উদ্ভাবন করেছেন এবং এই গ্রহের কোন শহরে বা কোন স্থানে যখন তা প্রয়ােগ করা হয়, তখন এই অতি শক্তিশালী অস্ত্রগুলি সেই জায়গাকে ধ্বংস করে দিতে পারে, কিন্তু সেই পারমাণবিক অস্ত্র গুলি যদি সূর্যের ওপর প্রয়ােগ করা হয়, তখন তার কোন প্রতিক্রিয়াই হয় না। তেমনই, শ্রীকৃষ্ণের গোবৎস এবং গোপীদের চুরি রার মাধ্যমে ব্রহ্মা তার অদ্ভুত যৌগিক শক্তি প্রদর্শন করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ যখন অনায়াসে সেই গােবৎস এবং গােপবালকদের সৃষ্টি করে তার অচিন্ত শক্তি প্রদর্শন করলেন, তখন ব্ৰহ্মা বুঝতে পারলেন যে, ভগবানের শক্তির কাছে তার নিজের শক্তি কত নগণ্য।

ব্রহ্ম পরমেশ্বর ভগবানকে অচ্যুত বলে সম্বোধন করলেন, কেননা তার প্রতি তাঁর ভক্তের অতি নগণ্য সেবাও তিনি কখনও ভুলে যান না; তিনি তার ভক্তদের প্রতি এতই কৃপাপরায়ণ এবং স্নেহময় যে, তাদের অতি অল্প সেবাও তিনি গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেন। ব্রহ্মা অবশ্যই ভগবানের অনেক সেবা করেছেন। এই ব্রহ্মাণ্ডের অধ্যক্ষরূপে তিনি নিশ্চয়ই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বস্ত ভৃত্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও, দৈন্য সহকারে তিনি এইভাবে শ্রীকৃষ্ণের কাছে আবেদন করেছিলেন। তিনি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন যে, তিনি যেন তাকে তার অনুগত ভূত্য বলে মনে করে তার এই ঔদ্ধত্য ক্ষমা করে দেন। তিনি স্বীকার করেছিলেন যে, ব্রহ্মারূপে তাঁর উচ্চপদের গর্বে তিনি গর্বান্বিত হয়ে উঠেছিলেন। যেহেতু তিনি হচ্ছেন এই জড় জগতে ভগবানের রজোগুণের অবতার, তাই এই রকম আচরণ তার পক্ষে স্বাভাবিক, এবং তাই তিনি এই ভুল করেছিলেন। কিন্তু দয়া করে শ্রীকৃষ্ণ যেন তাঁর ভৃত্যের সেই সমস্ত অপরাধ মার্জনা করেন।

 

ব্রহ্ম তার প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করতে পারলেন, যদিও তিনি হচ্ছেন এই ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্তা; ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ব্যোম, মন, বুদ্ধি এবং অহংকার সমন্বিত এই জড় ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা, কিন্তু তবুও পরমেশ্বর ভগবানের তুলনায় তার শক্তি নিতান্তই নগণ্য। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্রহ্মাণ্ড বিশাল হতে পারে, কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে তা হচ্ছে ধূলিকণা-সদৃশ। এই ব্রহ্মাণ্ড যতই বড় হােক না কেন তা সীমিত, তাকে মাপা যায়। আমাদের শরীরের মাপ যেমন আমাদের হাতের মাপে সাড়ে তিন হাত। প্রত্যেকেই শরীরের দৈর্ঘ্য হচ্ছে তার হাতের মাপে সাড়ে তিন হাত। এই ব্রহ্মাও আমাদের কাছে একটা বিরাট শরীর বলে মনে হতে পারে, কিন্তু ব্রহ্মার কাছে তার মাপ মাত্র মাপের সাড়ে তিন হাত। এই ব্রহ্মাণ্ডের মতাে অনন্ত কোটি ব্রথাও রয়েছে। অসংখ্য ধূলিকণা যেমন জানালার ছিদ্র দিয়ে ঘরের মধ্যে ভেসে বেড়ায়, তেমনই অনন্ত কোটি ব্ৰহ্মাণ্ড মহাবিষ্ণুর রােমকূপ থেকে বেরিয়ে আসছে এবং সেই মহাবিষ্ণু হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের অশেপ্রকাশ। 

এইভাবে আমরা বুঝতে পারি যে, যদিও এই ব্ৰহ্মাণ্ড ব্রহ্মাই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ জীব, কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষের কাছে,তিনি অতি নগণ্য। তাই ব্ৰহ্মা নিজেকে মায়ের কোলে ক্রীড়ারত একটি শিশুর সঙ্গে তুলনা করলেন। মায়ের কোলে শিশু যখন হাত-পা চুঁড়ে খেলা করে, তখন যদি তার ছােট ছােট পা-গুলি মায়ের শরীর স্পর্শ করে, তাতে কি মা কোন অপরাধ নেন? অবশ্যই নেন না। তেমনই ব্ৰহ্মা যত মহৎই হন না কেন, তবুও তিনি পরমেশ্বর ভগবানের শিশুসন্তানের মতাে। ভগবানের শক্তি সর্বব্যাপক; জগতে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে তার শক্তি কার্যকরী নয়। সব কিছুই ভগবানের শক্তিকে আশ্রয় করে বিরাজ করছে, তাই এই ব্রহ্মাণ্ডের ব্রহ্মা অথবা অনন্তকোটি সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের ব্রহ্মন সকলেই পরমেশ্বর ভগবানের শক্তিকে আশ্রয় করে বর্তমান। তাই ভগবানকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এবং মায়ের কোলকে আশ্রয় করে যারা রয়েছে, তারা সকলেই তার শিশুসন্তান। সেই শিশু যদি কোন সময় তার পা তুলে তার মায়ের বুকে লাথি মারে, তাতে মা কখনও শিশুর প্রতি অসন্তুষ্ট হন না।

ব্রহ্মা তারপরে বললেন যে, মহাপ্রলয়ের পরে যখন আবার নতুন করে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হল, তখন নারায়ণের নাভিপদ্ থেকে একটি পদ্ম প্রকাশিত হয় এবং সেই পদ্মের মধ্যেই তার জন্ম হয়েছিল। ব্ৰহ্মাগুকে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল এই তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রলয়ের সময় এই তিনটি লােক কারণ সমুদ্রের জলে লীন হয়ে যায়, সেই সময় শ্রীকৃষ্ণের অংশ অবতার নারায়ণ কারণ সমুদ্রে শয়ন করেন এবং ধীরে ধীরে তার নাভি থেকে একটি পদ্ম প্রকাশিত হয়। সেই পদ্ম থেকে ব্রহ্মার জন্ম হয়। তাই নারায়ণকে ব্রহ্মার মাথা রূপে গণ্য করা হয়। প্রলয়ের পর তিনিই হচ্ছেন সমস্ত জীবের আশ্রয়, তাই তার নাম নারায়ণ। 'নার শব্দটির অর্থ হচ্ছে সমগ্র জীব নিচয়, এবং 'অয়ন শব্দটির অর্থ হচ্ছে আশ্রয়। গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুকে নারায়ণ বলা হয়, কেননা তিনি গর্ভসমুদ্রের জলে শয়ন করে থাকেন এবং সেই সঙ্গে তিনি হচ্ছেন সমস্ত জীবের আশ্রয়। নারায়ণ সকল জীবের হৃদয়েও বর্তমান থকেন, সেই কথা ভগবদ্গীতায় প্রতিপন্ন হয়েছে, সেই জন্যও তিনি 'নারায়ণ', কেননা অয়ন' কথাটির অর্থ হচ্ছে সমস্ত জ্ঞানের উৎস। ভগবত গীতায় বলা হয়েছে যে, পরমাত্মারূপে আমাদের হৃদয়ে উপস্থিত থেকে ভগবান আমাদের স্মৃতি দান করেন। দেহান্তর হওয়ার পর জীব তার পূর্বজন্মের সমস্ত কথা ভুলে যায়, কিন্তু যেহেতু পরমাত্মারূপে নারায়ণ তার হৃদয়ে থাকেন, তাই তিনি তাকে তার পূর্বজন্মের কামনা-বাসনা অনুসারে কর্ম করতে অনুপ্রাণিত করেন। ব্রহ্ম প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন আদি-নারায়ণ, অর্থাৎ তিনি হচ্ছেন নারায়ণেরও উৎস। 

নারায়ণ ভগবানের বহিঙ্গা প্রকৃতি মায়ার প্রকাশ বা মায়াসত নন, তিনি হচ্ছেন স্বয়ং ভগবানের প্রকাশ। বহিরঙ্গা শক্তি বা মায়ার কার্যকলাপ প্রকাশিত হয় এই জড় জগৎ সৃষ্টি হওয়ার পর, কিন্তু নারায়ণের আদি চিন্ময়-শক্তি সৃষ্টির পূর্বেও সক্রিয় ছিল। তাই শ্রীকৃষ্ণ থেকে কারণােদকশায়ী বিষ্ণু, কারণোদকশায়ী বিষ্ণু থেকে গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু এবং গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু থেকে প্রতিটি জীবের হৃদয়ে ক্ষীরােদকশায়ী বিষ্ণু রূপে নারায়ণের সমস্ত প্রকাশ ভগবানের চিন্ময় শক্তিরই প্রকাশ। এই সমস্ত রূপ জড়া প্রকৃতির দ্বারা পরিচালিত হয় না, তাই তারা অনিত্য নন। এই জড়া প্রকৃতিতে সবই অনিত্য কিন্তু ভগবানের পরাপ্রকৃতির সব কিছুই নিত্য।

শ্রীকৃষ্ণই যে আদি নারায়ণ, তা প্রমাণ করতে গিয়ে ব্রহ্মা বললেন যে, এই বিশাল ব্ৰহ্মাণ্ড গর্ভোদক সমুদ্রে বিশ্রাম করছে। তিনি বললেন, “এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ড রূপ যে শরীর তা আপনার শক্তিরই একটি প্রকাশ। গর্ভসমুদ্রের জলে বিশ্রাম করেন বলে তার এই বিশ্বরূপকেও নারায়ণ বলা হয় এবং আমরা সকলেই এই নারায়ণ রূপের গর্ভে অবস্থান করছি, আপনার বিভিন্ন নারায়ণ রূপ আমি সর্বদাই দর্শন করছি। আমি জলে আপনাকে দর্শন ছি, আমি আমার হৃদয়ে আপনাকে অনুভব করছি এবং আমি এখন আমার সামনে দণ্ডায়মান আপনাকে দেখতে পাচ্ছি। আপনিই হচ্ছেন আদি নারায়ণ। "হে ভগবান, এই অবতরণে আপনি প্রমাণ করেছেন যে, আপনিই হচ্ছেন মায়ার অধীশ্বর। আপনি যদিও এই জগতে রয়েছেন, তথাপি সমস্ত সৃষ্টি আপনার মধ্যে বিরাজ করছে। 

 আপনি যখন মা যশােদাকে আপনার মুখের মধ্যে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দর্শন করিয়েছিলেন, তখন আপনি প্রমাণ করেছেন যে, আপনার যােগমায়ার অচিন্ত্য শক্তির প্রভাবে এই ধরনের অসম্ভব কার্যকলাপ সাধিত হয়। “হে প্রিয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যে জড় সৃষ্টি আমরা দর্শন করছি, তা সবই আপনার শরীরের মধ্যে বর্তমান। তবুও আমি আপনাকে বাইরে দর্শন করছি এবং আপনিও আমাকে বাইরে দর্শন করছেন। আপনার অচিন্ত্য শক্তির দ্বারা প্রভাবিত না হলে কিভাবে তা সম্ভব?”

 প্রথমে আমি আপনাকে একাকী দর্শন করলাম। তারপর আপনি আপনার গােপসখারূপে, গােবৎসরূপে এবং বৃন্দাবনের সমস্ত উপকরণরূপে নিজেকে প্রকাশিত করলেন। তারপরে আমি আপনার গােপসখাদের চতুর্ভুজ বিষ্ণুমুর্তি রূপে দর্শন করলাম, এবং দেখলাম যে, স্বর্গের দেব-দেবীরা এবং প্রকৃতির সব কটি উপাদান মূর্ত হয়ে আপনার পূজা করছে, এমন কি আমিও আমাকে আপনার পূজা করতে দেখলাম। তারপরে তারা আবার গােপবালকের রূপ পরিগ্রহ করলেন, কিন্তু আপনি আগের মতাে একই রয়ে গেলেন। এর অর্থ কি এই নয় যে, আপনিই হচ্ছেন সব কিছুর উৎস পরমেশ্বর ভগবান এবং আপনার থেকেই সব কিছু প্রকাশিত হয় এবং সব কিছু আপনাতেই প্রবিষ্ট হয়, কিন্তু আপনার কোন পরিবর্তন হয় না।


"যারা আপনার অচিন্ত্য শক্তি সম্বন্ধে অবগত নয়, তারা বুঝতে পারে না যে, আপনিই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, পালনকর্তা বিষ্ণু এবং সংহারকর্তা শিবরূপে নিজেকে প্রকাশিত করেন। যাদের যথার্থ জ্ঞান নেই, তারা মনে করে যে, ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণু পালনকর্তা এবং শিব হচ্ছেন সংহারকর্তা। প্রকৃতপক্ষে, আপনিই হচ্ছেন সব কিছু সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা এবং সংহারকর্তা। তেমনই, বিভিন্ন অবতার রূপে আপনি নিজেকে প্রকাশ করেন; দেবতাদের মধ্যে আপনি বামনদেবরূপে, ঋষিদের মধ্যে পরশুরামরূপে, মানুষদের মধ্যে আপনার এই রূপ শ্রীকৃষ্ণরূপে বা শ্ৰীরামচন্দ্ররূপে, পশুদের মধ্যে বরাহ অবতাররূপে এবং জলচরদের মধ্যে মৎস্য অবতাররূপে আপনি নিজেকে প্রকাশিত করেন। কিন্তু তবুও আপনি অরূপ; আপনি সর্ব অবস্থাতেই নিত্য। সাধুদের পরিত্রাণ করবার জন্য এবং দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করবার জন্য আপনি আপনার অচিন্ত্য শক্তির প্রভাবে প্রকট হন।


"হে আমার প্রভু, হে সর্বব্যাপক পরমেশ্বর ভগবান, হে পরমাত্মা, হে যােগেশ্বর, এই ত্রিলােকে আপনার দিব্য লীলাসমুহ সম্বন্ধে কেউই যথাযথভাবে অবগত হতে পারে না; আপনি যে কিভাবে আপনার যােগমায়ার প্রভাবে বিস্তার করেন, অবতার রূপে অবতরণ করেন এবং আপনার অপ্রাকৃত লীলাবিলাস করেন, তা কেউই বুঝতে পারে না। হে প্রভু, সমস্ত জড় সৃষ্টি হচ্ছে একটি মুহূর্তের স্বপ্নমাত্র এবং এই অনিত্য আদিত্য কেবল মনকে আলােড়িত করে, যার ফলে উৎকণ্ঠায় আমাদের জীবন ভরে ওঠে। এই জড় জগতে বেঁচে থাকার অর্থ হচ্ছে কেবল দুঃখকষ্ট ভােগ করা। কিন্তু তবুও যেহেতু এই জড় জগৎ আপনার থেকেই প্রকাশিত হয়েছে, তাই এই জগতে এই অনিত্য অস্তিত্বও সুখদায়ক বলে মনে হয়, কেননা আপনি সৎ চিৎ এবং আনন্দময়।

“তাই আমি এখন বুঝতে পারছি যে, আপনিই হচ্ছেন পরম-আত্মা পরম সত্য এবং আদি পুরুষ। যদিও অনন্ত কোটি বিষ্ণু রূপে, অনন্ত কোটি জীব রূপে আপনার অচিন্ত্য দিব্য শক্তির মাধ্যমে আপনি নিজেকে প্রকাশিত করেছেন, তবুও আপনিই হচ্ছেন একমেবাদ্বিতীয়ম পরমেশ্বর, আপনিই হচ্ছেন পরম পরমাত্মা। অসংখ্য জীব হচ্ছে কেবল অগ্নি থেকে উদ্ভূত স্ফুলিঙ্গের মতাে আপনার বিভিন্ন অংশে। হে প্রভু, ভ্রান্তিবশত জ্ঞানীরা পরমাত্মাকে নির্বিশেষ বলে মনে করে, কিন্তু আমি দেখছি যে, আপনিই পরম আত্মা, এবং আপনিই হচ্ছেন আদি পুরুষ। অল্প জ্ঞানসম্পন্ন মানুষেরা মনে করতে পারে যে, আপনি নন্দ মহারাজের পুত্র, তাই আপনি আদি পুরুষ হবেন কি করে। 

তারা মনে করতে পারে যে, আপনি একজন সাধারণ মানুষের মতাে জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু তারা আপনার অপ্রাকৃত লীলা বুঝতে পারে না বলেই এরকম ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়। আমি এখন বুঝতে পেরেছি যে, আপনিই হচ্ছেন প্রকৃত আদি পুরুষ। নন্দ মহারাজের পুত্র হওয়া সত্ত্বেও আপনিই হচ্ছেন আদি পুরুষ এবং সেই সম্বন্ধে আমার কোন সংশয় নেই। আপনিই হচ্ছেন পরম সত্য। আপনি অন্ধকারাচ্ছন্ন জড় জগৎ থেকে প্রকাশিত হননি। আপনিই হচ্ছেন আদি ব্রহ্মজ্যোতি এবং জড় জগতের চন্দ্র, সূর্য আদি ভাস্বর গ্রহ সমূহের উৎস। 

আপনার দিব্য অঙ্গকান্তি হচ্ছে ব্রহ্ম জ্যোতি। অনেক বিষ্ণু অবতার আছেন এবং আপনার বিভিন্ন গুণাবলীর অবতার রয়েছে, কিন্তু এই সমস্ত অবতারেরা আপনার সমপর্যায়ভূক্ত নয়। আপনিই হচ্ছেন আদি-প্রদীপ। অন্য সমস্ত অবতারের মধ্যে আদি-প্রদীপের মতাে গুণাবলী থাকতে পারে, সমান শক্তি থাকতে পারে, কিন্তু আদি-প্রদীপটিই হচ্ছে সমস্ত আলােকের মূল কারণ। যেহেতু আপনি এই জড়াপ্রকৃতিজাত নন, তাই এই জড় সৃষ্টির প্রলয়ের পরেও আপনি থাকেন।


"যেহেতু আপনি হচ্ছেন আদি পুরুষ, তাই বৈদিক উপনিষদ গােপালতাপনি এবং 'সংহিতা' আপনাকে 'গোবিন্দম আদি পুরুষ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আপনি হচ্ছেন আদি পুরুষ, সর্ব কারণের পরম কারণ। ভগবদ্গীতাতেও বর্ণনা করা হয়েছে যে, আপনি হচ্ছেন ব্রহ্মজ্যোতির উৎস। কারােরই মনে করা উচিত নয় যে, আপনার দেহ একটা সাধারণ জড় দেহের মতাে। আপনার দেহ অক্ষয়, অবিনশ্বর, জ্ঞানময় এবং আনন্দময়। যশােদানন্দনরূপে বা গােপীনাথরূপে আপনার সমস্ত লীলাবিলাস কখনই জড় গুণের দ্বারা কলুষিত হয় না, তাই আপনার নাম নিরঞ্জন। যদিও আপনি নিজেকে এই সমস্ত গােপসখা এবং গােবৎসরূপে প্রকাশ করেছেন, তবুও আপনার প্রকৃত শক্তি হ্রাস পায় না। আপনি সর্বদা পূর্ণ।

উপনিষদে বলা হয়েছে যে, পরম ব্রহ্মা হচ্ছেন সুর্যের মতাে জ্যোতির্ময় এবং সব কিছুরই উৎস। যারা সেই আদি পুরুষকে জানতে পারেন, তারা এই জড় জগতের বদ্ধ জীবন থেকে মুক্তি লাভ করেন। কেউ যখন ভক্তিযুক্ত সেবার মাধ্যমে আপনার প্রতি অনুরক্ত হয়, তখন সে জানতে পারে, আপনি কে। তখন সে জানতে পারে যে, আপনার জন্ম, আবির্ভাব, অন্তর্ধান এবং কার্যকলাপ সবই অপ্রাকৃত। আপনার জন্ম, কর্ম এবং কার্যকলাপ দিব্য বলে জানতে পারার মাধ্যমে মানুষ তার দেহত্যাগের পর আপনার ধামে প্রবেশ করতে পারে। তাই বুদ্ধিমান মানুষ এই ভবসমুদ্র পার হওয়ার জন্য আপনার শ্রীপাদপদ্মের স্মরণ নেয় এবং অনায়াসে অপ্রাকৃত জগতে প্রবেশ করে। অনেক লােক তথাকথিতভাবে ধ্যান করে, কিন্তু তারা জানে না যে, আপনিই হচ্ছেন পরম-আত্মা। পরমাত্মারূপে আপনি সকলের হৃদয়ে বিরাজ করেন। তাই আপনাকে বাদ দিয়ে অন্য কিছুর ধ্যান করার কোন প্রয়ােজনীয়তা নেই। কেউ যখন সর্বক্ষণ আপনার এই কৃষ্ণরূপের ধ্যানে মগ্ন থাকেন, তখন অনায়াসে তিনি এই ভবসমুদ্র পার হয়ে যান।

 

 কিন্তু যারা জানে না যে, আপনি হচ্ছেন পরমাত্মা, তারা তাদের তথাকথিত যৌগিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই জড় জগতের বন্ধনেই আবদ্ধ থেকে যায়। আপনার ভক্তসঙ্গের প্রভাবে যদি কোন মানুষ জানতে পারে যে, আপনিই হচ্ছেন আদি পরমাত্মা, তা হলে তার পক্ষে ভবসমুদ্র পার হওয়া সম্ভব হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, রজ্জুতে সর্পভ্রম হওয়ার ফলে যে ভয়ের উদয় হয়, রজ্জু কি যে সর্প নয় তা জানার পর সেই ভয় থেকে সে মুক্ত হয়। তেমনই ভগবদ্গীতা গ্রন্থে আপনার বাণীর মাধ্যমে এবং এমাগত গ্রহে আপনার শুদ্ধ ভক্তদের বর্ণিত আপনার মহিমা সম্বন্ধে অবগত হওয়া মাধ্যমে যখন আপনাকে জীবনের পরম উদ্দেশ্যরূপে জানা যায়, তখন আর এ অমিত সম্বন্ধে কোন ভয় থাকে না। "যে জানে যে রজ্জুটি সর্প নয়, তার যেমন কোন ভয় থাকে না, ঠিক তেমনই যে-মানুষ ভক্তিসহকারে আপনার সেবা করছে, তার কাছে তথাকথিত বন্ধন বা মুক্তি উভ্য়ই সম্পূর্ণ নিরর্থক। ভক্ত জানেন যে, এই অড় জগতও আপনার সৃষ্টি, এবং তাই তিনি সব কিছু দিয়ে আপনার অপ্রাকৃত সেবা করেন। তাই তিনি সব রকমের বন্ধন থেকে মুক্ত। 

যে মানুষ সুগ্রহে বাস করে, তার কাছে যেমন দিন এবং রাত্রি রূপে সূর্যোদয় এবং সমাজের কোন প্রশ্নই ওঠে না, তেমনই নিত্য আনন্দময় আপনার ধামে যারা আপনার সঙ্গে আপনার লীলা উপভােগ করেন, তাদেরও তথাকথিত সমস্ত সুখ-দুঃখের সম্ভাব্য কোন প্রশ্নই ওঠে না। শাস্ত্রে আপনাকে সুর্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এবং মায়াকে অন্ধকারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সূর্য থাকলে যেমন অন্ধকারের কোন প্রশ্ন ওঠে না, তেমনই যারা সর্বদা আপনার সঙ্গে রয়েছেন, তাদেরও বন্ধন বা মুক্তির কোন প্রশ্ন ওঠে না। তারা ইতিমধ্যেই মুক্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু যারা আপনার শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ না করে ভ্রান্তিবশত নিজেদের মুক্ত বলে অভিমান করে, তারা আবার অধঃ পতিত হয়, কেননা তাদের বুদ্ধিবৃত্তি এখনও জড় জগতের কলুষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়নি।

তাই কেউ যদি মনে করে যে, পরমাত্মা আপনার থেকে ভিন্ন, এবং তা মনে করে বনে বা হিমালয়ের গুহায় গিয়ে পরমাত্মাকে খুজতে থাকে, তা হলে তাদের অবস্থা অত্যন্ত শােচনীয়।

"শাস্ত্রে আপনি সব রকমের ধর্ম পরিত্যাগ করে আপনার শরণাগত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, কেননা আপনার শরণাগত হওয়াই হচ্ছে জীবনের চরম উদ্দেশ্য। আপনি যেহেতু সব কিছুরই পরম উৎস, তাই যারা ব্রহ্মসুখের অনুসন্ধান করছে, তারা প্রকৃতপক্ষে আপনাকেই অনুসন্ধান করছে। 

 অন্য কোথাও পরমাত্মাকে খুঁজে ভক্ত আপনাতেই মনকে নিবন্ধ করেন। প্রকৃতপক্ষে, যে-মানুষ তার দেহাত্মবুদ্ধি থেকে মুক্ত হয়েছেন, তিনিই কেবল আপনাকে যথাযথভাবে খুঁজতে পারেন; অপর কেউ পারে সর্প্রমের দৃষ্টান্ত কেবল তাদের ক্ষেত্রেই প্রযােজ্য, যারা আপনাকে জানেন যে সর্প্রম হয়, সেই সর্পের ধারণাটি মনের মধ্যেই রয়েছে। তেমনই মায়াও মনের মধ্যে রয়েছে। আপনার সম্বন্ধে অজ্ঞতাই হচ্ছে মায়া। আপনাকে ভুলে যাওয়াই হচ্ছে মায়াবদ্ধ অবস্থা। তাই যিনি অন্তরে বাহিরে আপনারভাবনাতেই মগ্ন, তিনি কখনও মায়ার দ্বারা আচ্ছন্ন হন না। “যে জীব অতি অল্পমাত্রাতেও আপনার প্রতি ভক্তিপরায়ণ হয়েছেন, তিনি আপনার মহিমা উপলব্ধি করতে পারেন। ভক্তিপদ অবলম্বন করে যারা লাভের এবং পরমাত্মা উপলব্ধির প্রচেষ্টা করছেন, আপনাকে জানতে পারেন না। 

কেউ নির্বিশেষবাদীদের মহান গুরু হতে পারে অথবা বনে পাহাড়ের গুহায় গিয়ে বহু বছর ধরে তপস্বী জীবন যাপন করে ধ্যান করতে পারে, “হে প্রিয় প্রভু, আমি প্রার্থনা করি যে, জন্ম-জন্মান্তরে আমি যেন আপনার


কিন্তু ভক্তিযুক্ত সেবা ব্যতীত তারা কখনই আপনার মহিমা উপলব্ধি পারবে আপনার প্রতি ভক্তিপরায়ণ না হলে তারা বহু বছর ধরে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ এবং পরমাত্মা উপলব্ধির চেষ্টা করলেও সিদ্ধিলাভ করতে পারবে না।


অনুগত ভৃত্য হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারি। যেখানেই থাকি কেন, আমি প্রার্থনা করি যে, আমি যেন সর্বদাই আপনার সেবা করে যেতে পারি। ভবিষ্যতে কিরকম জীবন লাভ করব, নিয়ে আমার কোন ভাবনা নেই,


কেননা, আমি দেখতে পাচ্ছি যে, গােপসখারূপে আপনার ভক্তরা সর্বক্ষণ আপনার অপ্রাকৃত সেবা করার এবং আপনার সঙ্গ লাভ করার পরম সৌভাগ্য অর্জন করেছে। তাই আমি কামনা করি, আমি যেন তাদের মতাে হতে পারি। এই অতি উন্নত ব্রহ্মার পদে আর আমার কোন স্পৃহা নেই, আমাকে অজ্ঞানের অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বৃন্দাবনের গােপিকারা এবং গাভীরা এত সৌভাগ্যবতী যে, তারা আপনাকে তাদের বুকের যে সমস্ত মানুষ মহান যজ্ঞের অনুষ্ঠান আপনার প্রভূত ধনসম্পদ উৎসর্গ করছেন, প্রতি ভক্তি পরায়ণ এবং তাদের অতি তাদের দুধ দিয়ে আপনার সন্তুষ্টি বিধান করছেন।

প্রতিই আমার স্পৃহা নেই। অতি বিনীতভাবে আমি আপনার শ্রীপাদপদ্মে প্রার্থনা জানাই যেন আপনি কৃপা করে আমাকে এই বৃন্দাবনে যে কোনও শরীরে জন্মলাভ করার সুযােগ দেন, যাতে আমি বৃন্দাবনের ভক্তদের দ্বারা অভিষিক্ত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারি। এই ব্রজভূমিতে যদি আমি একটি নগণ্য তৃণরূপেও জন্মগ্রহণ করতে পারি, তা হলে আমি নিজেকে সার্থক বলে মনে করব। কিন্তু এই বৃন্দাবনে জন্মগ্রহণ করবার মতাে সৌভাগ্য যদি আমার থেকে থাকে, তা হলে আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি যেন কৃপা করে বৃন্দাবনের সন্নিকটেই আমি তৃণ গুল্ম রুপে জন্মগ্রহণ করতে  পারি যাতে ভক্তরা যখন বেড়াতে যাবে তখন যেন আমি তাদের শ্রীপাদপদ্মের স্পর্শলাভ করে ধন্য হতে পারি। সেটিই হবে আমার পরম সৌভাগ্য। আমার একমাত্র অভিলাষ হচ্ছে, আমি যেন আপনার ভক্তদের ধূলিকণা সারা গায়ে মেখে ধন্য হতে “আমি দেখছি যে, এখানে সকলেই আপনার চিন্তাতে সমস্ত বেদের আরাধ্য মুকুন্দ ছাড়া আর কাউকেই তারা জানে বলা হয়েছে যে, সমস্ত বৈদিক জ্ঞানের উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকে জানা। বলা হয়েছে যে, বৈদিক শাস্ত্র অধ্যয়ন করার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণকে খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু তার শুদ্ধ ভক্তের কৃপার মাধ্যমে তাকে অতি সহজে লাভ করা যায়। বৃন্দাবনের শুদ্ধ ভক্তরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান,

কেননা তারা সর্বক্ষণ মুকুন্দ (শ্রীকৃষ্ণের) দর্শন করতে পারেন। এই মুকুন্দ শব্দটির দু'টি অর্থ। মুক' শব্দটির অর্থ হচ্ছে মুক্তি। শ্রীকৃষ্ণ মুক্তিদান করে দিব্য আনন্দ দান করেন, তাই তার নাম মুকুন্দ। এর আরেকটি অর্থ হচ্ছে, কুন্দ ফুলের মতাে সুন্দর হাস্যোজ্জ্বল তার মুখ।

বৃন্দাবনের শুদ্ধ ভক্তদের সঙ্গে অন্য ভক্তদের পার্থক্য হচ্ছে যে, বৃন্দাবনবাসীদের কৃষ্ণসঙ্গলাভের বাসনা ছাড়া আর কোনও বাসনা নেই। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ভক্তবৎসল, যেহেতু তারা সর্বক্ষণ তাঁর সঙ্গলাভ করতে চান, তাই তিনি তাঁদের সেই বাসনা পূর্ণ করেন। বৃন্দাবনে ভক্তদের ভগবানের প্রতি যে প্রেম, তা স্বতঃস্ফূর্ত। শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে তাদের বৈধীভক্তির অনুশীলন করতে হয় না। তাঁদের কোন রকম বিধিনিষেধ পালন করতে হয় না, কেননা তারা স্বাভাবিকভাবেই শ্রীকৃষ্ণের প্রতি দিব্য অনুরাগ লাভ করেছেন। যারা দিব্য ভগবৎ-প্রেম লাভ করতে পারেননি, তাদের জন্যই শাস্ত্রের বিধিনিষেধগুলি দেওয়া হয়েছে। ব্রহ্মাও ভগবানের ভক্ত, কিন্তু তাকেও বৈধীভক্তির অনুশীলন করতে হয়। তিনি বৃন্দাবনে জন্মলাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করার জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছেন, যাতে তিনি ভগবানের প্রতি স্বতঃস্ফুর্ত প্রেম লাভ করতে পারেন।

ব্ৰহ্মা বললেন, হে প্রভু, মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে ভাবি কৃতজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে কিভাবে আপনি ব্রজবাসীদের প্রেমের প্রতিদান দেন! আমি জানি যে, আপনিই হচ্ছেন সমস্ত আশীর্বাদের পরম উৎস, কিন্তু তবুও আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবি, কিভাবে আপনি আপনার প্রতি তাদের সমস্ত সেবার প্রতিদান দেবেন। আমি ভাবি, আপনি কত কৃপালু, কত মহৎ যে, স্নেহময়ী মাতৃরূপ নিয়ে পুতনা আপনাকে হত্যা করতে এসেছিল বলে, সেও আপনার মাতৃপদ লাভ করে মুক্তিলাভ করেছে। অঘাসুর, বকাসুর আদি সমস্ত অসুরেরাও মুক্তি লাভ করেছে। তাই বিস্ময়বিহুল হয়ে আমি ভাবি, যে সমস্ত ব্রজবাসীরা তাদের শরীর, তাদের মন, তাদের প্রেম, তাদের গৃহ, সব কিছু আপনার সেবায় উৎসর্গ করেছে, তাদের ঋণ আপনি কিভাবে শােধ করবেন? মহাপাপিনী শিশুঘাতিনী সেই পুতনা আপনাকে হত্যা করতে এসেছিল, তাকে যখন আপনি মাতৃপদ দান করে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে তার কাছে অর্পণ করেছেন, তখন এই বৃন্দাবন বাসীদের কাছে আপনি যে কত ঋণী, তা কেউ কল্পনাও করতে পারে না। 

তাই আমার মনে হয় যে, ব্রজবাসীর এই ভালবাসার ঋণ শােধ করতে অক্ষম হয়ে আপনি তাদের কাছে চিরঋণী থেকে যাবেন। হে প্রভু, আমি বুঝতে পারি যে, ব্রজবাসীদের এই অপূর্ব মহিমামণ্ডিত সেবা আপনার প্রতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সব কিছু উৎসর্গ করার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিরই প্রকাশ। শাস্ত্রে বলা হয় যে, মায়ার প্রভাবেই জড় বিষয় এবং গৃহের প্রতি আসক্তি জন্মায়, যার ফলে বদ্ধ জীব এই জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। কিন্তু যারা নিরন্তর কৃষ্ণভাবনার অমৃত পান করছেন, তাদের কোন বন্ধনই থাকে না। কৃষ্ণ প্রেমে মগ্ন হওয়ার ফলে ব্রজবাসীরা সব রকম বন্ধন থেকে মুক্ত। যেহেতু তাঁদের সমস্ত আসক্তি আপনাতেই কেন্দ্রীভূত হয়েছে, তাই তাদের গৃহ মন্দিরে পরিণত হয়েছে, কেননা আপনি সর্বক্ষণ সেখানে বিরাজ করছেন এবং যেহেতু আপনার জন্য তারা সব কিছু ভুলে গেছেন, তাই আপনার প্রতি তাঁদের প্রেম অপ্রতিহতরূপে প্রবাহিত হচ্ছে। কৃষ্ণভাবনাময় ভাবিত মানুষের দেহ-গেহরূপী প্রতিবন্ধক থাকে না এবং তারা কখনও মায়ার দ্বারা মােহাচ্ছন্ন হন না। "আমি আরও বুঝতে পারছি যে, গােপশিশুরূপে আপনার এই আবির্ভাব আপনার অপ্রাকৃত লীলাবিলাস। গােপ-গােপীদের ভালবাসায় আপনি এতই কৃতজ্ঞ যে, আপনি সব সময় তাদের কাছে থেকে আপনাকে ভালবাসতে তাদের অনুপ্রাণিত করছে। বৃন্দাবনে জড় এবং চিন্ময়ের কোন পার্থক্য নেই, কেননা এখানে সব কিছুই আপনার সেবায় উৎসর্গীকৃত হয়েছে। হে প্রিয় প্রভু, আপনার এই বৃন্দাবন- লীলাবিলাসের দ্বারা আপনি আপনার ভক্তদের অনুপ্রাণিত করছেন। যদি কেউ আপনার এই বৃন্দাবন-লীলাকে প্রাকৃত কার্যকলাপ বলে মনে করে, তা হলে তারা বিপথগামী হবে। “হে প্রিয় প্রভু কৃষ্ণ, যে সমস্ত মানুষ আপনার চিন্ময় রূপকে একজন সাধারণ মানুষের জড় শরীর বলে মনে করে অবজ্ঞা করে তারা হচ্ছে অসুর এবং নির্বোধ। আপনি সর্ব অবস্থাতেই চিন্ময়। অভক্তরা আপনার দ্বারা প্রতারিত হয়, কেননা তারা মনে করে যে, আপনার রূপ হচ্ছে জড়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আপনি একটি সাধারণ গােপবালকের রূপ পরিগ্রহ করেছেন, কেবল আপনার ভক্তদের আপনার প্রতি ভক্তি বর্ধন করার জন্য এবং তাদের দিব্য আনন্দে মগ্ন করার জন্য।

“হে প্রিয় প্রভু, যে সমস্ত মানুষ ঘােষণা করে যে, তারা ইতিমধ্যেই ভগবানকে জেনে গেছে অথবা ভগবানকে জানার মাধ্যমে তারাই ভগবান হয়ে গেছে, তাদের মনােবৃত্তি এত জঘন্য যে, তাদের সম্বন্ধে আমার কিছুই বলার নেই। তবে আমার সম্বন্ধে আমি এইটুকু বলতে পারি যে, আমার শরীর, মন এবং বাক্য দিয়ে আপনাকে জানা সম্ভব নয়। আপনার মহিমা সম্বন্ধে আমি কি বলতে পারি, অথবা আমার ইন্দ্রিয় দিয়ে আমি কিভাবে আপনাকে জানতে পারি? সমস্ত ইন্দ্রিয়ের অধিপতি যে মন, সেই মন দিয়েও আমি আপনার সম্বন্ধে যথাযথভাবে চিন্তা করতে পারি না। আপনার গুণাবলী, আপনার কার্যকলাপ এবং আপনার রূপ জড় জগতের বন্ধনে আসক্তি মানুষ উপলব্ধি করতে পারে না। কেবলমাত্র আপনার কৃপার প্রভাবেই আপনাকে কিয়ৎপরিমাণে জানতে পারা যায়। 

হে প্রিয় প্রভু, যদিও আমি ভ্রান্তিবশত মাঝে মাঝে মনে করি যে, আমিই হচ্ছি এই ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্তা, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, আপনিই হচ্ছেন সমস্ত জগতের পরম ঈশ্বর। আমি এই ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্তা হতে পারি, কিন্তু অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ড রয়েছে এবং সেই সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্তারূপে ব্রহ্মা আর আপনি হচ্ছেন তাদের সকলেরই অধীশ্বর। প্রতিটি জীবের হৃদয়ে পরমাত্মারূপে বিরাজ করে আপনি আমাকে আপনার অনুগত ভক্তরূপে গ্রহণ করুন। আপনার গােপসখা এবং গােবৎসদের সঙ্গে লীলাবিলাসে আমি যে বাধা দিয়েছি, সেই জন্য আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আপনি যদি অনুমতি দেন, তা হলে এখনই আমি এখান থেকে বিদায় নেব যাতে আপনি আপনার গােপসখা এবং গােবৎসদের সঙ্গ উপভােগ করতে পারেন। হে প্রিয় প্রভু কৃষ্ণ, আপনার এই নামের অর্থ হচ্ছে যে, আপনিই হচ্ছেন সর্বাকর্ষক। সূর্য ও চন্দ্রের প্রতি আমাদের যে আকর্ষণ তার কারণও আপনি। 

আকর্ষণের দ্বারা আপনি যদুবংশকে মহিমান্বিত চন্দ্রের আকর্ষণের দ্বারা আপনি পৃথিবী, ব্রাহ্মণ, গরু এবং সমুদ্রকে মহিমান্বিত করেছেন। আপনার পরম আকর্ষণের ফলেই কংস আদি অসুরেরা বিনষ্ট হয়। তাই আমি বুঝতে পারছি যে, এই সৃষ্টিতে আপনিই হচ্ছেন পরম আরাধ্য। এই জড় জগতের প্রলয় পর্যন্ত আপনি আমার বিনীত প্রণতি গ্রহণ করুন। যতক্ষণ এই জগতে সূর্যের কিরণ থাকবে, ততক্ষণ কৃপা করে আপনি আমার বিনীত প্রণতি গ্রহণ করুন।” এইভাবে এই ব্রহ্মাণ্ডের ব্রহ্মা, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তিনবার প্রদক্ষিণ করে, সশ্রদ্ধ প্রণতি জানিয়ে তার আলয় ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। ইঙ্গিত করে পরমেশ্বর ভগবান তাকে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। ব্রহ্মা চলে যাওয়ার পরই শ্রীকৃষ্ণ গােবৎস এবং গােপবালকদের অন্তর্ধানের পর যেভাবে ছিলেন, ঠিক সেইভাবে লীলাবিলাস করতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণ যমুনার তীরে ভােজনরত অবস্থায় তার বন্ধুদের কাছ থেকে চলে গিয়েছিলেন এবং যদিও তিনি ঠিক এক বছর পরে ফিরে এলেন, গােপবালকেরা মনে করল যে, এক মুহূর্ত পরে যেন কৃষ্ণ তাদের কাছে ফিরে এলেন।

 

এটাই হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তি এবং লীলাবিলাসের ধরন। ভগবদগীতায় বলা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণ সকলের হৃদয়ে বিরাজ এবং তিনিই স্মৃতি ও বিস্মৃতির কারণ। প্রতিটি জীবই পরমেশ্বর ভগবানের শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কখন তারা তাদের স্বরূপ বিস্মৃত হয়, আবার কখন তাদের স্বরূপ সম্বন্ধে স্মৃতির উদয় হয়।  ঠিক আছে, এখনও আমরা আমাদের ভােজন শুরু করিনি, আমরা এক গ্রাস খাবারও খাইনি। তাই এস, আমরা সকলে মিলে একসঙ্গে আহার করি। কৃৃষ্ণ হেসে তাদের সেই নিমন্ত্রণ স্বীকার করলেন এবং তার সপাদের সঙ্গে কভােজনের আনন্দ উপভােগ করতে লাগলেন। খাওয়ার সময় কৃষ্ণ বলেছিলেন, এই সময় বালকেরা মনে করছে যে, আমি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ফিরে এসেছি, কিন্তু তারা জানে না যে, ব্রহ্মার অলৌকিক কার্যকলাপে প্রভাবিত হয়ে এক বছর গত হয়ে গেছে।"

 ভােজনান্তে কৃষ্ণ তার সখা এবং গােবৎসসহ ব্রজ ভূমিতে তাদের গৃহের দিকে যাত্রা করলেন। যেতে যেতে তারা এক বিরাট সর্পরূপী অসুরের মৃতদেহটা দেখে আনন্দে উৎুল্ল হল। কৃষ্ণ যখন ব্রজভূমিতে ফিরে এলেন, তথন সমস্ত ব্ৰজবাসীরা তাকে দর্শন করতে ছুটে এলেন। তার মাথায় শােভা পাচ্ছিল শিখিপুচ্ছ আর বনফুলের মালা। তাঁর গলদেশেও ফুলমালা শােভা পাচ্ছিল এবং গোবর্ধন পর্বতের গুহা থেকে আহরণ করা নানা রকম ধাতব রং দিয়ে তার শরীর রঞ্জিত হয়েছিল। সকলের কাছেই ছিল মহিষের শিংয়ের বিষাণ, বাঁশি আর যষ্টি এবং তারা সকলেই তাদের গােবৎসদের নাম ধরে ডাকছিল। 

এই সম্বন্ধে মহারাজ পরীক্ষিৎ শুকদেব গােস্বামীকে প্রশ্ন করলেন, “কৃষ্ণ যদিও তাঁদের পরিবারভুক্ত ছিলেন না, তবুও কৃষ্ণের প্রতি ব্রজবাসীরা কিভাবে এত অনুরক্ত হয়েছিলেন?” মহারাজ পরীক্ষিৎ জিজ্ঞাসা করলেন, “প্রকৃত গােপবালকদের অনুপস্থিতিতে কৃষ্ণ যখন নিজেকে সেই সমস্ত গােপবালকরূপে প্রকাশিত করলেন, তখন সেই সমস্ত বালকদের পিতা-মাতারা কেন কৃষ্ণের প্রতি তাদের নিজেদের ছেলেদের থেকেও বেশি স্নেহপরায়ণ হয়েছিলেন? আর গাভীরাই বা কেন তাদের নিজেদের বৎস থেকে কৃষ্ণের প্রকাশ বৎসদের প্রতি এত স্নেহপরায়ণ হয়েছিল?


শুকদেব গােস্বামী মহারাজ পরীক্ষিতের বললেন যে, প্রতিটি জীবই নিজের প্রতি সব চাইতে বেশি আসক্ত। পরিবার, পরিজন, বন্ধুবান্ধব, গৃহ, দেশ, সমাজ, বিত্ত, ঐশ্বর্য, যশ ইত্যাদি বহিরঙ্গা সমস্ত উপকরণগুলিই গৌণ। এই সমস্ত জিনিসগুলি আত্মাকে আনন্দ দান করে বলেই তাদের প্রতি আমরা আসক্ত হই। সেই কারণেই সকলেই আত্মকেন্দ্রিক এবং সেই জন্যই তারা স্ত্রী-পুত্র বন্ধুবান্ধবদের থেকে নিজের দেহ এবং আত্মার প্রতি সব চাইতে বেশি আসক্ত। যখন কেউ কোন বিপদের সম্মুখীন হয়, তখন অপরের থেকে নিজেকেই রক্ষা করতে তারা বেশি সচেষ্ট হয়। এটাই স্বাভাবিক। এর অর্থ হচ্ছে যে, আমরা আমাদের আত্মাকে সব চাইতে বেশি ভালবাসি। আত্মার পরে এই জড়দেহের প্রতিই আমাদের সব চাইতে বেশি আসক্তি।

যে মানুষের আত্মা সম্বন্ধে কোন ধারণা নেই, সে তার নিজের দেহের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত থাকে। তাদের দেহের প্রতি ঐ সব মানুষ এত আসক্ত থাকে যে, বৃদ্ধ বয়সেও তারা কৃত্রিম উপায়ের মাধ্যমে দেহটাকে রক্ষা করার চেষ্টা করে এবং তারা মনে করে যে, তারা তাদের বৃদ্ধ জরাগ্রস্ত শরীরটিকে রক্ষা করতে পারবে। দৈহিক বা আধ্যাত্মিক ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সকলেই সুখের অন্বেষণে দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করছে। আমরা জড় বিষয়ের প্রতি আসক্ত হই, কেননা তা দেহের ইন্দ্রিয় গুলোকে সুখ দান করে। দেহের প্রতি এই আসক্তির কারণ হচ্ছে, “আমিত্ব", এই দেহের আত্মা। তেমনই, কেউ যখন আরও উন্নত হন, তখন তিনি জানতে পারেন যে, এই আত্মা আমাদের আনন্দের অনুভূতি আনে, কেননা, এই আত্মা হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন অংশ। চরমে শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সর্ব আনন্দদায়ক এবং সর্বাকর্ষক। তিনিই হচ্ছেন সকলের পরমাত্মা। আমাদের এই সরল সত্যটি জানিয়ে দেওয়ার জন্যই শ্রীকৃষ্ণ অবতরণ করে আমাদের বলেন যে, তিনিই হচ্ছেন সমস্ত আকর্ষণের কেন্দ্র। শ্রীকৃষ্ণের প্রকাশ ছাড়া কোন কিছুই আকর্ষণীয় হতে পারে না। এই জগতে যা কিছুই আমাদের আকর্ষণ করে, তার কারণ হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। 

তাই শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সমস্তআনন্দের উৎস। সব কিছুরই মূল কারণ হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ এবং অতি উন্নত ভক্তরা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত রূপে সব কিছু দর্শন করেন। শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে বলা হয়েছে যে, অতি উন্নত স্তরের ভক্ত বা মহাভাগবত স্থাবর ও জঙ্গম সব কিছুর মধ্যেই শ্রীকৃষ্ণের দর্শন করেন। তাই এই জগতে সব কিছুই তিনি শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত রূপে দর্শন করেন। যে সৌভাগ্যবান মানুষ সর্বতােভাবে শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হয়েছেন, তিনি ইতিমধ্যেই মুক্তিলাভ করেছেন; তিনি আর জড় জগতে নেই, সেই কথা ভগবদ্গীতাতেও প্রতিপন্ন হয়েছে। যিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিযুক্ত সেবায় যুক্ত হয়েছে, তিনি ব্রহ্মাভূত স্তরে অধিষ্ঠিত। এই 'কৃষ্ণ নামটি সমস্ত পুণ্য এবং সমস্ত মুক্তির আধার। যিনি শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করেন, তিনিই এই ভবসমুদ্র পার হওয়ার নৌকায় আরােহণ করেছেন। তাঁর কাছে এই বিশাল ভবসমুদ্র গােষ্পদে পরিণত হয়েছে। 

শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সমস্ত মহাত্মাদের পরম প্রেমাস্পদ এবং তিনিই হচ্ছেন জড় জগতের পরম আশ্রয়। যিনি কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তির স্তরে উন্নীত হয়েছেন, তাঁর কাছে বৈকুণ্ঠ বা চিজ্জগৎ আর দূরে নেই। তিনি আর এই বিপদসঙ্কুল জড় জগতে বাস করছেন না। এইভাবে শুকদেব গােস্বামী মহারাজ পরীক্ষিতের কাছে কৃষ্ণভাবনাময় বিজ্ঞান বিশ্লেষণ করলেন। শুকদেব গােস্বামী মহারাজ পরীক্ষিতের ব্রহ্মার স্তব শােনালেন। তার গােপসখাদের সঙ্গে সরােবরের তীরে বনভোজন এবং তার প্রতি ব্রহ্মার স্তব, সবই চিন্ময়। যাঁরা এই লীলাবিলাস শ্রবণ করেন, তাদের সমস্ত পারমার্থিক কামনা বাসনা পূর্ণ হয়। এইভাবে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা, বৃন্দাবনে বলরাম সহ সখাদের সঙ্গে লীলাবিলাস বর্ণিত হয়েছে।

আরও পড়ুন
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url