অপূর্ব লীলাময় শ্রীকৃষ্ণ-এই কলি যুগে কৃষ্ণ কথা-শ্রীমদ্ভাগবত কাহিনী
অপূর্ব লীলাময় শ্রীকৃষ্ণ
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মর্ম উপলব্ধি করতে না পেরে এবং তার অপ্রাকৃত ঐশ্বর্য সম্বন্ধে না জানার ফলে সরলচিত্ত বৃন্দাবনবাসীরা শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত আশ্চর্য কার্যকলাপ সম্বন্ধে আলােচনা করতে লাগলেন—যে সব কার্যকলাপ সাধারণ মানুষের সাধ্যাতীত।
তাদের মধ্যে একজন বললেন, হে বন্ধুগণ, এই রকম অসাধারণ একজন বালক, যার কার্যকলাপ এত বিস্ময়কর, সে বৃন্দাবনে আমাদের সঙ্গে বাস করছে, কিভাবে এটি সম্ভব হল?
এটা সত্যিই অসম্ভব, একটু বিবেচনা করে দেখ! তার বয়স এখন মাত্র সাত বৎসর! কিন্তু সে এই গােবর্ধন পর্বত তুলে ধরল ঠিক যেমন ঐরাবত একটি পদ্মফুল তুলে ধরে।”
একটি হাতির পক্ষে একটি পদ্মফুল তােলা যেমন অতি তুচ্ছ একটি ব্যাপার, শ্রীকৃষ্ণ ঠিক তেমনিভাবে গিরি গােবর্ধনকে তুলে ধরেছিলেন। তিনি যখন একটি ছোেট্ট শিশু এবং যখন তার ভালমতাে চোখও ফোটেনি,
তখন তিনি পূতনা রাক্ষসীকে হত্যা করেছিলেন, তার স্তন্যপান করে তিনি তার প্রাণবায়ু শুষে নিয়েছিলেন। মহাকাল যেমন জীবের শরীর থেকে জীবন আর্কষণ করে, ঠিক সেইভাবে শ্রীকৃষ্ণ মহাবল পুতনা রাক্ষসীর স্তন্যপান করে তার প্রাণ সংহার করেছিলেন।
তার বয়স যখন মাত্র তিন মাস, তখন তাকে একটা শকটের নীচে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। ক্ষুধার্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ কাদতে কাঁদতে তার পা ছুঁড়তে লাগলেন,
এবং সেই পায়ের আঘাতে সেই শকটটি তৎক্ষণাৎ ভেঙ্গে গিয়েছিল। যখন তার বয়স মাত্র এক বৎসর, তখন ঘূর্ণিঝড়ের রূপে তৃণাবর্ত অসুর তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং যদিও সে তাঁকে আকাশে অনেক উঁচুতে নিয়ে গিয়েছিল,
কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তার গলা টিপে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলে, এবং তার ফলে সেই অসুর প্রচণ্ড বেগে ভূপতিত হয় এবং তৎক্ষণাৎ প্রাণত্যাগ করে।
একবার ননী চুরি করার অপরাধে তার মা তাকে একটা উদুখলের সঙ্গে বেঁধে রাখেন এবং শ্রীকৃষ্ণ তার কোমরের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা সেই উদুখলটি টানতে টানতে দুটি অর্জুন বৃক্ষের মাঝখানে সেটি আটকে একটু টান দিয়েছিলেন, এবং তার ফলে সেই বৃক্ষ দু'টি ভূপতিত হয়।
একবার কৃষ্ণ তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরামের সঙ্গে বনে গােবৎসদের নিয়ে বিচরণ করছিলেন, তখন তাদের হত্যা করার উদ্দেশ্য নিয়ে বকাসুর নামক এক প্রবল অসুর সেখানে উপস্থিত হয়। কিন্তু। শ্রীকৃষ্ণ তার মুখ থেকে আরম্ভ করে সমস্ত শরীর বিদীর্ণ করে দিয়েছিলেন।
বৎসাসুর নামক একটি অসুর যখন গােবৎসদের সঙ্গে মিশে শ্রীকৃষ্ণকে বধ করার চেষ্টা করেছিল, তখন শ্রীকৃষ্ণ সেই অসুরটিকে চিনতে পেরে তাকে একটা গাছের উপর ছুঁড়ে দিয়ে মেরে ফেলে।
শ্রীকৃষ্ণ যখন তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরামের সঙ্গে তালবনে প্রবেশ করেন, তখন গর্দভ-রূপধারী ধেনুকাসুর তাদের আক্রমণ করে এবং বলরাম তৎক্ষণাৎ তার পেছনের পা-দুটি ধরে মাথার উপর ঘােরাতে ঘােরাতে একটি তালগাছের উপর ছুঁড়ে ফেলে তাকে বধ করেন।
যদিও ধেনুকাসুরের গর্দভ রূপধারী বন্ধুরা তাঁদের আক্রমণ করেছিল, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম তাদের সকলকে বধ করেছিলেন; এবং তখন থেকে বৃন্দাবনবাসীরা এবং সমস্ত পশুরা স্বচ্ছন্দে সেই তালবনে প্রবেশ করতে শুরু করে।
প্রলম্বাসুর যখন তাঁর গােপসখাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে বলরামকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল, তখন বলরাম তাকে অনায়াসে বধ করেছিলেন।
তারপর শ্রীকৃষ্ণ তার সখাদের এবং গাভীদের ভয়ঙ্কর দাবানল থেকে রক্ষা করেন এবং যমুনা হ্রদে কালীয় সর্পকে দমন করে তাকে যমুনা থেকে নির্বাসন দেন। এইভাবে তিনি যমুনার জলকে বিষমুক্ত করেন।
নন্দ মহারাজের আরেক বন্ধু বললেন, "প্রিয় নন্দ, আমরা জানি না তােমার পুত্র শ্রীকৃষ্ণের প্রতি কেন আমরা এই গভীর আকর্ষণ অনুভব করি। আমরা তাকে ভুলে যেতে চাই, কিন্তু তা সম্ভব হয় না।
কেন আমরা এই রকম স্বাভাবিকভাবে তার প্রতি আকৃষ্ট হই? একবার ভেবে দেখ এটি কী আশ্চর্য! তার বয়স এখন মাত্র সাত বছর, আর সে অনায়াসে এই বিরাট গোবর্ধন পূর্বত তার হাতের উপর তুলে ধরল! হে নন্দ মহারাজ!
আমাদের এখন সন্দেহ হচ্ছে তােমার পুত্র শ্রীকৃষ্ণ নিশ্চয়ই কোন দেবতা হবেন, তিনি কোন সাধারণ নরশিশু নন। হয়ত বা তিনি পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং।”
এইভাবে বৃন্দাবনে গােপেদের মুখে শ্রীকৃষ্ণের প্রশংসা শুনে নন্দ মহারাজ বললেন, "বন্ধুগণ, তােমাদের এই প্রশ্নের উত্তরে আমি কেবল গর্গ মুনি যা বলেছিলেন তা বলতে পারি।
যাতে তােমাদের সন্দেহের নিরসন হয়। গর্গ মুনি যখন শ্রীকৃষ্ণের নামকরণ সংস্কার করার জন্য এসেছিলেন, তখন তিনি বলেন যে, এই বালক বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন বর্ণের রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হন এবং এখন তিনি বৃন্দাবনে কৃষ্ণবর্ণ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন, তাই তার নাম শ্রীকৃষ্ণ।
পুর্বে তিনি শ্বেত এবং পীতবর্ণ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন যে, এই বালক একসময় বসুদেবের গৃহে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই জন্য তত্ত্বজ্ঞ পুরুষেরা তাকে বাসুদেব বলে সম্বোধন করে থাকেন।
"এছাড়া তিনি বলেছিলেন যে, এই বালকের গুণ এবং কর্ম অনুসারে বহু নাম ও রূপ আছে। গর্গাচার্য আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, এই বালক আমাদের বংশে সর্ববিধ মঙ্গলসাধন করবে এবং বৃন্দাবনের মানুষদের এবং গাভীদের দিব্য আনন্দ দান করবে।
যদিও আমরা নানা রকম বিপদের সম্মুখীন হব, তবুও এই বালকের কৃপায় আমরা অনায়াসে মুক্ত হব। তিনি আরও বলেছিলেন যে, পুর্বে এই শিশু অধর্মের প্রভাব থেকে জগৎকে রক্ষা করেন এবং সাধুদের দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে রক্ষা করেন।
এছাড়াও তিনি বলেছিলেন, যে সৌভাগ্যবান মানুষ এই শিশুর প্রতি অনুরক্ত হবেন, তিনি কখনও তার শত্রুদের দ্বারা পরাভূত হবেন না এবং কখনই তার বিনাশ হবে না।
এই শিশুটি ঠিক ভগবান বিষ্ণুর মতাে যিনি সব সময় দেবতাদের সহায়তা করেন, এবং যার ফলে তারা কখনই অসুরদের দ্বারা পরাভূত হন না।
গর্গাচার্য সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে, আমার এই শিশুপুত্রটি ঠিক বিষ্ণুর মতাে শ্রী, গুণাবলী, কার্যকলাপ, প্রভাব এবং ঐশ্বর্যসম্পন্ন হবে, তাই তার এই সমস্ত আশ্চর্য কার্যকলাপ দেখে আমাদের বিস্মিত হওয়া উচিত নয়।
এই কথা বলে গর্গাচার্য তার আশ্রমে ফিরে যান এবং সেই থেকে আমরা নিরন্তর এই শিশুটির আশ্চর্য সমস্ত কার্যকলাপ দর্শন করছি।
গর্গাচার্যের সিদ্ধান্ত অনুসারে আমিও মনে করি যে, এই শিশুটি নিশ্চয় স্বয়ং নারায়ণ অথবা নারায়ণের অবতার।"
সমস্ত গােপেরা যখন গভীর মনােযােগ সহকারে নন্দ মহারাজের কাছ থেকে গর্গ মুনির বিবরণ শুনলেন, তখন তারা আরও গভীরভাবে শ্রীকৃষ্ণের আশ্চর্য সমস্ত কার্যকলাপ উপলব্ধি করলেন এবং অন্তরে গভীর হর্ষ ও প্রশান্তি অনুভব করলেন, তার সঙ্গে আলােচনা করার ফলে শ্রীকৃষ্ণের সম্পর্কে তাদের সমস্ত সংশয় দূর হল।
তারা বললেন, "পরম করুণাময়, সৌন্দর্যময় এবং কৃপাময় শ্রীকৃষ্ণ আমাদের রক্ষা করুন। ক্রুদ্ধ ইন্দ্র যখন শিলা এবং ঝড় ঝঞ্চাসহ প্রচণ্ড বারিবর্ষণ করেছিল,
তখন আমাদের প্রতি তার গভীর সহানুভূতির ফলে পরিবার, পরিজন, গাভী এবং ধন-সম্পত্তি সহ আমাদের রক্ষা করার জন্য গােবর্ধন পর্বত তুলে ধরেছিলেন ঠিক যেভাবে একটি শিশু একটা ব্যাঙের ছাতা তুলে ধরে।
তিনি আশ্চর্যভাবে আমাদের রক্ষা করেছিলেন। তিনি নিরন্তর আমাদের উপর এবং আমাদের গাভীদের উপর তাঁর কৃপাদৃষ্টি বর্ষণ করুন। এই অপূর্ব লীলাময় শ্রীকৃষ্ণের আশ্রয়ে আমরা যেন শান্তিতে বসবাস করতে পারি।”