নলকূবের এবং মণিগ্রীব উদ্ধার-কৃষ্ণলীলা কাহীনি-শ্রীমদ্ভাগবত
নলকূবের এবং মণিগ্রীব উদ্ধার
সর্বমঙ্গলময় দেবর্ষি নারদের অভিশাপে নলকূবের এবং মণিগ্রীব কিভাবে শ্রীকৃষ্ণের দর্শন লাভ করে মুক্ত হয়েছিলেন সেই কাহিনী এখানে বর্ণিত হয়েছে। নলকুবের এবং মণিগ্রীব ছিল শিবভক্ত যক্ষরাজ কুবেরের পুত্র। মহাদেবের কৃপায় কুবের ছিলেন অসীম ঐশ্বর্যের অধিকারী।
ধনী পিতার পুত্ররা যেমন প্রায়ই মদ্যপান এবং স্ত্রী-সঙ্গে আসক্ত হয়ে পড়ে, তেমনই কুবেরের পুত্ররা তেমন প্রায়ই মদ্যপান এবং স্ত্রী-সঙ্গে আসক্ত ছিল। একবার এই দু’টি যক্ষ-রাজপুত্র শিবের আলয় কৈলাস পর্বতস্থ মন্দাকিনী গঙ্গার তীরে সরম্য উপবনে অপূর্ব সুন্দরী নারীদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল।
সেই সুবাসিত পুষ্পশোভিত উদ্যানে তারা অত্যধিক মাত্রায় মদ্যপান করে সেই সুন্দরী নারীদের কন্ঠে মধুর সঙ্গীত শুনছিল। মদ্যপানে মত্ত হয়ে তারা পদ্মশোভিত গঙ্গায় সেই সমস্ত রমণীদের সঙ্গে জলক্রীড়া করতে লাগল- ঠিক যেমন মত্ত হস্তী হস্তিনীদের সঙ্গে ক্রীড়া করে।
এইভাবে যখন তারা জলকেলি করছিল, তখন দেবর্ষি নারদ সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, নলকুবের এবং মণিগ্রীব মদ্যপানে অত্যন্ত মত্ত হয়ে আছে, তাই তাঁরা তার আগমন উপলব্ধি করতে পারেনি।
যুবতী রমণীরা ততটা মত্ত ছিল না, তাই তারা অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে শীঘ্র বস্ত্র দ্বারা তাদের শরীর আচ্ছাদিত করল। কিন্তু কুবেরের দুই পুত্র এতই নেশাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল যে, তারা নারদ মুনির উপস্থিতি অনুভব করতে পারল না, এবং তাদের নগ্ন শরীর আচ্ছাদিত করার কোন রকম চেষ্টা করল না। মদ্যপানে কুবেরের এই দু’টি পুত্রকে এত অধঃপতিত হতে দেখে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হলেন।
মহর্ষি নারদ তাদের প্রতি অত্যন্ত কৃপাপরবশ ছিলেন, তাই আসবপান এবং যুবতী স্ত্রী-সঙ্গে ইন্দ্রিয়সুখ উপভোগের ভ্রান্ত প্রয়াস থেকে মুক্ত হয়ে তারা যাতে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রত্যক্ষভাবে দর্শন করতে পারে তার ব্যবস্থা করলেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হল তিনি যেন তাদের অভিশাপ দিলেন।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁর সেই অভিশাপ ছিল আশির্বাদ। তিনি তাদের বললেন যে, জড় ইন্দ্রিয় সুখভোগের বাসনা বর্ধিত হয় রজোগুণের প্রভাবে। জড় জগতে কেউ যখন ধন এবং ঐশ্বর্য লাভ করে তখন তারা সাধারণত তিনটি বিষয়ে অত্যন্ত আসক্ত হয়ে পড়ে, সেগুলি হচ্ছে- আসবপান, স্ত্রী-সঙ্গ এবং দ্যূতক্রীড়া।
জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ মানুষ যখন ঐশ্বর্য লাভ করে, তখন ধনমদে মত্ত হয়ে তারা এত নির্দয় হয় যে, কেবল ইন্দ্রিয় উপভোগ বা চিত্ত বিনোদনের জন্য তারা কসাইখানা খুলে অসংখ্য পশু হত্যা করে।
তারা মনে করে যে, তাদের কোনদিনও মৃত্যু হবে না। “এই ধরনের নির্বোধ মানুষেরা প্রকৃতির নিয়মের কথা ভুলে গিয়ে তাদের দেহের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত হয়ে পড়ে।
তারা ভুলে যায় যে, তারা যতই উন্নত হোক না কেন, এমন কি তারা যদি স্বর্গের দেবতাও হয়, তবুও তাদের জড় দেহ একং সময় ভস্মে পরিণত হবে এবং জীবিত অস্থাতেও, বাহ্যিক অবস্থা যেরকমই হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে জড় দেহটি মল, মূত্র এবং ক্রিমি-কীটে পূর্ণ।
তাদের যথার্থ স্বার্থ সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণাই নেই। তারা জানে না যে, অনর্থক প্রাণী হিংসা করার ফলে তাদের অনন্তকাল ধরে নরক-যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে।
“এই ধরনের মুর্খ লোকেরা তাদের পরবর্তী জন্মে তাদের অনিত্য শরীর ধারণের জন্য নানা রকম পাপকর্মে লিপ্ত হয়। তারা বিবেচনা করে দেখে না যে, প্রকৃতপক্ষে এই শরীরটি কার। সাধারণত বলা হয় যে, যিনি এই শরীরটিকে অন্ন দান করেন, শরীরটি তাঁর।
তাই বিবেচনা করে দেখা উচিত যে, এই শরীরটি কি আমাদের সম্পত্তি, না, যাঁর কৃপায় আমরা এই শরীরটি লাভ করেছি, যাঁর কৃপায় এই শরীরের সমস্ত প্রয়োজনগুলি মিটছে, তাঁর সম্পত্তি। ক্রীতদাসের মালিকেরা ক্রীতদাসদের শরীরের উপর সম্পূর্ণ মালিকানা দাবি করে, কেননা তারা তাদের খেতে দেয়।
“নির্বোধ লোকেরা দেহাত্মবুদ্ধিতে মগ্ন হয়ে নানা রকম পাপকার্যে লিপ্ত হয়। সুখ ভোগের জন্য তারা নির্দভাবে পশু হত্যা করে কিন্তু তারা ভেবে দেখে না যে, এই শরীরটি প্রকৃতপক্ষে তার, না তার পিতার, না তার মাতার, না পিতামহের।
অনেক সময় পিতামহ বা পিতা এই চুক্তিতে কন্যাদান করে থাকেন যে, কন্যার গর্ভজাত পুত্রসন্তানকে তিনি পুত্ররূপে গ্রহণ করবেন। অনেক সময় বলপূর্বক কর্মে নিয়োগকারীকে দেহের মালিক বলে গণ্য করা হয়।
অনেক সময় আবার মূল্য দিয়ে ক্রয়কারীকে দেহের মালিক বলে গণ্য করা হয় আর জীবনান্তে এই দেহ অগ্নির সম্পত্তি হয়ে যায় এবং ভস্মে পরিণত হয়। অথবা কুকুর, শকুন যখন সেটি ভক্ষণ করে, তখন সেটি তাদের সম্পত্তি হয়ে যায়।
“এই দেহ ধারণ করার জন্য সব রকম পাপকর্মে লিপ্ত হওয়ার আগে আমাদের বিবেচনা করে দেখা উচিত যে, প্রকৃতপক্ষে এই শরীরটি কার। বুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে আমরা বুজতে পারি যে, প্রকৃতি থেকে এই দেহের উৎপত্তি এবং প্রকৃতিতেই তার লয় হয়; তাই তা প্রকৃতিরই সম্পত্তি।
এই জড় দেহকে ভ্রান্তিবশত নিজের সম্পত্তি মনে করা উচিত নয়। সুতরাং এই দেহ ধারণ করার জন্য অনর্থক পাপকার্যে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। এই দেহ ধরণ করার জন্য আমরা অনর্থক নিরীহ পশুগুলিকে হত্যা করি?
“কেউ যখন ধনগর্বে মত্ত হয়ে পড়ে তখন সে কোন রকম নৈতিক উপদেশ গ্রাহ্য না করে মদ্যপান, স্ত্রী-সঙ্গ এবং পশুহত্যায় লিপ্ত হয়। সেদিক দিয়ে একজন দরিদ্র লোক অনেক ভাগ্যবান, কেননা সে অন্যের দুঃখ অনুভব করতে পারে।
প্রায়ই দেখা যায় যে দরিদ্র লোকেরা অন্যকে কোন রকম ব্যথা দিতে চায় না, কেননা তারা জানে, ব্যথা কত কষ্টদায়ক।” এইভাবে দেবর্ষি নারদ বিবেচনা করলেন, যেহেতু কুবের-পুত্র নলকূবর এবং মণিগ্রীব অহঙ্কারে মগ্ন হয়ে এত অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছে যে, তাদের এখন সব রকম ঐশ্বর্য থেকে বঞ্চিত করে এমন একটা অবস্থায় রাখা উচিত, যাতে তারা তাদের দিব্য গুণাবলী বিকশিত করতে পারে।
যে মানুষের শরীর কণ্টকবিদ্ধ হয়েছে, সে চায় না যে, অন্য কেউ কণ্টকবিদ্ধ হোক। দারিদ্রগ্রস্ত বিচক্ষণ মানুষ চায় না যে, অন্য কেউ সেই অবস্থায় পতিত হোক।
সাধারণত দেখা যায়, যে সকল মানুষ দারিদ্র্যগ্রস্ত জীবন থেকে বিত্তবান হয়েছেন, তাঁরা সাধারণত শেষ জীবনে নানা রকম দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।
সংক্ষেপে বলা যায় যে, কৃপাপরায়ণ দরিদ্র লোকেরাই অপরের সুখ-দুঃখে সহানুভূতি সম্পন্ন হতে পারে। দারিদ্রগ্রস্থ মানুষেরা সাধারণত অহঙ্কারে মদমত্ত হন না এবং তাঁরা সব রকম আসক্তি থেকে মুক্ত হতে পারেন। ভগবানের কৃপায় যা লাভ হয়, তা নিয়েই তাঁরা সন্তুষ্ট থাকতে পারেন।
দারিদ্রগ্রস্ত অবস্থায় থাকা এক রকমের তপস্যা। তাই বৈদিক সমাজে ব্রাহ্মণেরা দারিদ্রগ্রস্ত জীবন বরণ করে নিতেন, যাতে জড় ঐশ্বর্যের অহঙ্কারে তাঁরা মত্ত না হন। জড় ঐশ্বর্যজনিত অহঙ্কার পারমার্থিক উন্নতি-সাধনের পথে একটা মস্ত বড় প্রতিবন্ধক।
দারিদ্রগ্রস্ত মানুষ কখনই অত্যাহারের ফলে অত্যধিক মোটা হন না এবং তাঁরা প্রয়োজনাতিরিক্ত আহার না করতে পারায় তাঁদের ইন্দ্রিয়গুলি অসংযত হয়ে পড়ে না। ইন্দ্রিয়গুলি যখন সংযত থাকে, তখন মানুষ অপরকে হিংসা করে না।
দারিদ্র্যের আর একটা সুবিধা হচ্ছে যে, সাধু-মহাত্মারা অনায়াসে তাদের গৃহে প্রবেশ করতে পারেন, এবং সেই জন্য দরিদ্র মানুষদের পক্ষে সাধু-মহাত্মার সঙ্গ লাভ করা অতি সহজ। অত্যন্ত ঐশ্বর্যশালী মানুষেরা কাউকেই তাঁদের বাড়িতে ঢুকতে দেন না; তাই, সাধুরা তাঁদের বাড়িতে ঢুকতে পারেন না।
বৈদিক প্রথা অনুসারে সাধুরা ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করেন যাতে গৃহস্থদের কাছ থেকে ভিক্ষা করার ব্যস্ত থাকার ফলে গৃহস্থরা সাধারণত পারমার্থিক জীবনে অগ্রসর হওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা ভুলে যান, কিন্তু যখন তাঁরা কোন মহাত্মার সঙ্গলাভ করেন, তখন তাঁরা পারমার্থিক জীবন সম্বনে সচেতন হন।
সাধু-সঙ্গের প্রভাবে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার একটা মস্ত বড় সুযোগ এইভাবে দরিদ্র মানুষেরা পেয়ে থাকেন। ভগবদ্ভক্ত সাধু-মহাত্মার সঙ্গ থেকে বঞ্চিত জড় ঐশ্বর্যপূর্ণ, অহঙ্কারে মত্ত মানুষদের জীবনের কি মূল্য আছে?
তারপর নারদ মুনি ভাবলেন যে, কুবেরের এই পুত্র দু’টিকে এমন একটা অবস্থায় রাখা উচিত যেখানে তারা তাদের জড় ঐশ্বর্য এবং প্রতিপত্তির মিথ্যা গর্বে মদমত্ত হতে না পারে। নারদ মুনি তাদের প্রতি কৃপাপরবশ হয়েছিলেন এবং তাদের অধঃপতিত জীবন থেকে উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন।
তারা তমোগুণে আচ্ছন্ন ছিল এবং তাই ইন্দ্রিয় সংযম করতে অক্ষম হয়ে তারা স্ত্রী-সঙ্গে অত্যন্ত আসক্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের এই ঘৃণ্য জীবন থেকে উদ্ধার করা দেবর্ষি নারদ তাঁর কর্তব্য বলে মনে করলেন। পশুরা তাদের নগ্নতার ফলে কোন রকম লজ্জা অনুভব করে না।
কিন্তু কুবের ছিলেন দেবতাদের কোষাধ্যক্ষ, একজন অতি দায়িত্বসম্পন্ন পুরুষ; এবং নলকুবর ও মণিগ্রীব ছিল তাঁর দুই পুত্র। কিন্তু তারা এত পাশবিক এবং দায়িত্বহীন হয়ে পড়েছিল যে, নেশাচ্ছন্ন হয়ে তারা তাদের শরীরের নগ্নতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে পড়েছিল।
সভ্য মানব-সমাজের রীতি হচ্ছে, শরীরের নিম্নাংশ অন্তত আচ্ছাদিত করে রাখা, এবং কোন স্ত্রী এবং পুরুষ যখন সেই রীতির কথা ভুলে যায়, তখন তারা অধঃপতিত হয়। নারদ মুনি তাই ভাবলেন যে, তাদের বৃক্ষে পরিণত করে স্থবরত্ব প্রদান করাই হবে।
সব চাইতে ভাল শাস্তি। প্রকৃতির নিয়েমে বৃক্ষ চলচ্ছক্তিরহিত স্থাবর জীব। বৃক্ষ যদিও তমোগুণে আচ্ছন্ন, তবু তারা কারো কোন ক্ষতি করতে পারে না। নারদ মুনি স্থির করলেন, যদিও কুবেরের এই দু’টি পুত্র তাঁর অভিশাপের ফলে বৃক্ষে পরিণত হবে, তবুও তাদের স্মৃতি অক্ষুণ্ণ থাকবে, যাতে তারা বুঝতে পারে, কেন তারা এই দন্ডভোগ করছে।
সাধারণত দেহ পরিবর্তন হওয়ার ফলে জীব তার পূর্বজন্মের কথা ভুলে যায়। কিন্তু ভগবানের কৃপায় বা ভগবদ্ভক্তের কৃপায় কোন বিশেষ ক্ষেত্রে স্মৃতি অক্ষুণ্ণ থাকে, যেমন নলকুবর এবং মুণিগ্রীবের ক্ষেত্রে হয়েছিল।
নারদ মুনি তাই বিবেচনা করলেন যে, এই দুটি দেবপুত্র দেবতাদের হিসাব অনুসারে একশ বছর বৃক্ষ হয়ে থাকবে এবং তারপরে তারা পরমেশ্বর ভগবানের অহৈতুকী কৃপার প্রভাবে প্রত্যক্ষভাবে তাঁকে দর্শন করার সৌভাগ্য অর্জন করবে, এবং তারপরে ভগবানের মহান ভক্তরূপে তারা পুনরায় তাদের দেবশরীর লাভ করবে।
তারপর নারদ মুনি নারায়ণ আশ্রয় নামক তাঁর আলয়ে ফিরে গেলেন, আর নলকুবর এবং মণিগ্রীব দু’টি অর্জুন বৃক্ষে পরিণত হল। এই দুটি দেবতা নারদ মুনির অহৈতুকী কৃপা লাভ করে নন্দ মহারাজের অঙ্গনে বৃক্ষরূপে জন্মগ্রহণ করবার সুযোগ পেয়েছিল যাতে তারা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রত্যক্ষভাবে দর্শন করতে পারে।
শিশু কৃষ্ণকে যদিও সেই উদুখলে বেঁধে রাখা হয়েছিল, তিনি তাঁর প্রিয়তম ভক্ত নারদের ভবিষ্যদ্বাণী সার্থক করার জন্য সেই বিশাল অর্জুন বৃক্ষ দু’টির দিকে সেই উদুখল সহ এগোতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণ জানতেন যে, নারদ মুনি তাঁর একজন মস্ত বড় ভক্ত এবং সেই অর্জুন বৃক্ষ দু’টি ছিল প্রকৃতপক্ষে কুবেরের দুই পুত্র।
তিনি ভাবলেন, “আমার প্রিয় ভক্ত নারদের বাক্য আমাকে সার্থক করতেই হবে।” তিনি দু’টি গাছের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেলেন। গাছ দু’টির মাঝখান দিয়ে তিনি যেতে পারলেন ঠিকই, কিন্তু সেই বিরাট উদুখলটি আড়াআড়িভাবে গাছ দু’টির মাঝখানে আটকে গেল।
কৃষ্ণ তখন উদুখলে বাঁধা দড়িটাতে টান দিলেন এবং তৎক্ষণাৎ সেই গাছ দু’টি সমূলে উৎপাটিত হয়ে প্রচন্ড শব্দে ভূপতিত হল। সেই দু’টি গাছের মধ্য থেকে তখন জ্বলন্ত অগ্নির মতো দীপ্তিমান দু’জন পুরুষ বেরিয়ে এলেন। তাঁদের দেহনির্গত রশ্মিচ্ছটায় চারদিক আলোকিত হয়ে উঠল। তাঁরা তখন শিশু কৃষ্ণের কাছে এসে নত হয়ে তাঁদের সশ্রদ্ধ প্রণাম জানালেন এবং তাঁর স্তব করতে লাগলেন।
“হে শ্রীকৃষ্ণ, আপনি যোগেশ্বর, আপনার প্রভাব অচিন্ত্য, আপনি পরমপুরুষ, পরমেশ্বর ভগবান। ব্রহ্মবিদেরা খুব ভালভাবে জানেন যে, এই ব্যক্তি এবং অব্যক্ত জগৎ আপনারই শক্তির প্রকাশ।
আপনিই সর্বভূতের দেহ, প্রাণ, অহঙ্কার এবং ইন্দ্রিয়সমূহের নিয়ন্তা। আপনি অব্যক্ত ঈশ্বর, সর্বব্যাপ্ত এবং সব কিছুর নিয়ন্তা বিষ্ণু। আপনি সমস্ত জগতের মূল উৎস যা সত্ত্ব, রজ এবং তম প্রকৃতির এই তিনটি গুণের প্রভাবে কার্য করে।
সমস্ত জীবের হৃদয়ে আপনি পরমাত্মারূপে বিরাজ করেন, এবং সকলের দেহে এবং মনে কি হচ্ছে, তা সবই আপনি জানেন। তাই সমস্ত জীবের, সমস্ত কার্যকলাপের পরম নিয়ন্তা হচ্ছেন আপনি। কিন্তু যদিও আপনি গুণের প্রভাবে পরিচালিত সব কিছুরই মাঝখানে রয়েছেনম, কিন্তু তবুও এই প্রকৃতির কলুষ আপনাকে স্পর্শ করতে পারে না।
জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা জীব যখন প্রভাবিত থাকে, তখন সে আপনার আদি-অন্তহীন, জন্ম-মৃত্যুহীন দিব্য স্বরূপ বুঝতে পারে না, তাই আপনাকে পরম ব্রহ্ম বলঅ হয়। আপনার অন্তরঙ্গা শক্তির প্রভাবেই আপনার মহিমা প্রকাশিত হয়।
আপনার বিভিন্ন অবতারের মাধ্যমেই কেবল এই জড় জগতে আবদ্ধ জীব আপনাকে জানতে পারে। যদিও আপনি বিভিন্ন রূপ ধারণ করেন কিন্তু এই রূপগুলি জড়া প্রকৃতিজাত নয়। সর্ব অস্থাতেই তারা অনন্ত ঐশ্বর্য, বীর্য, শ্রী, জ্ঞান, এবং বৈরাগ্য পূর্ণ।
জড়া প্রকৃতিতে দেহ এবং দেহীর পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু যেহেতু আপনি আপনার আদি চিন্ময় রূপ নিয়ে আবির্ভূত হন, তাই আপনার রূপ এবং আপনি অভিন্ন। আপনি যখন আসেন, তখন আপনার অলৌকিক কার্যকলাপের মাধ্যম বোঝা যায় যে, আপনিই হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান।
এই ধরনের অলৌকিক কার্য জড় জগতে কারোর পক্ষেই সম্পাদন করা সম্ভবপর নয়। আপনিই হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং এখন সমস্ত জীবকে তাদের পরম সম্পদ এবং মুক্তি প্রদান করার জন্য সান করতে পারেন। হে ভগবান! হে সমস্ত সৌভাগ্য এবং মঙ্গলের অধীশ্বর! আমরা আপনাকে আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।
আপনি সর্বব্যাপ্ত পরমেশ্বর ভগবান, সমস্ত শান্তির উৎস এবং যদুকুলের ঈশ্বর। হে ভগবান! আমাদের পিতা কুবের আপনার ভৃত্য। তেমনই দেবর্ষি নারদ আপনার সেকব এবং তাঁদের কৃপার ফলে আমরা প্রত্যক্ষভাবে আজ আপনাকে দর্শন করতে সমর্থ হয়েছি।
তাই আমরা আপনার কাছে প্রার্থনা করি যেন আমরা সর্বদাই আপনার প্রতি ভক্তিযুক্ত সেবায় রত থাকতে পারি, সর্বদাই আপনার মহাত্ম্য শ্রবণ এবং কীর্তন করতে পরি।
আমাদের হস্ত-পদ-আদি সমস্ত অঙ্গ যেন আপনার সেবায় যুক্ত থাকতে পারে। আমাদের মন যেন সর্বদাই আপনার চরণারবিন্দের ধ্যানে মগ্ন থাকতে পারে এবং আমাদের মস্তক যেন সর্বদাই আপনার সম্মুখে প্রণত থাকতে পারে।”
যখন নলকুবর এবং মণিগ্রীবের প্রার্থনা শেষ হল, তখন গোকুলাধিপতি শিশু শ্রীকৃষ্ণ যশোদা কর্তৃক রজ্জু দ্বারা উদুখলে আবদ্ধ অবস্থায় স্মিতহাস্যে বললেন, “আমি জানি যে, আমার প্রিয়তম ভক্ত দেবর্ষি নারদ, তোমাদের অসাধারণ শ্রী, ঐশ্বর্যের গৌরবে মদমত্ত অতি জঘন্য জীবন থেকে রক্ষা করবার জন্য তোমাদের প্রতি তাঁর অহৈতুকী কৃপা প্রদর্শন করেছেন।
নরকের নিকৃষ্টতম প্রদেশে অধঃপতিত হওয়া থেকে তিনি তোমাদের রক্ষা করেছেন। তোমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান, কেননা তোমরা শুধু তাঁর দ্বারা শাপগ্রস্তই হওনি, তোমরা তাঁকে সাক্ষাৎ দর্শনও করতে পেরেছ।
কেউ যদি সৌভাগ্যক্রমে নারদের মতো শান্ত, স্নিগ্ধ, সকলের প্রতি দয়াপরবশ মহাত্মার দর্শন পায়, তা হলে তৎক্ষণাৎ সে তার বদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত হয়। তা ঠিক সূর্যের পূর্ণ আলোকে অবস্থিত হওয়ার মতো- তখন আর কোন কিছু দর্শন করতে কোন বাধা থাকে না।
হে নলকুবর এবং মণিগ্রীব, তাই তোমাদের জন্ম আজ সার্থক হয়েছে, কেননা তোমরা আমার প্রতি প্রেমভক্তি লাভ করেছ। এই জড় জগতে এটাই তোমাদের শেষ জীবন। এখন তোমরা স্বর্গলোকে তোমাদের পিতার আলয়ে ফিরে যাও। আমার প্রতি ভক্তিযুক্ত হয়ে সেখানে থাকো।
এই জীবনেই তোমরা মুক্তি লাভ করবে।” কুবেরের দুই পুত্র তখন ভগবানকে প্রদক্ষিণ করে পুনঃ পুনঃ তাঁকে প্রণাম করে সেখান থেকে বিদায় নিল। আর ভগবান উদখলে রজ্জুবদ্ধ অবস্থায় সেখানেই রইলেন।
আরও পড়ুন