বিদ্যাধর মােক্ষণ এবং শঙ্খাসুর বধ-কৃষ্ণ লীলা


 বিদ্যাধর মােক্ষণ এবং শঙ্খাসুর বধ

কোন এক সময় নন্দ মহারাজের নেতৃত্ব বৃন্দাবনের গােপেরা শিবরাত্রি অনুষ্ঠান করার জন্য অম্বিকা বনে যাওয়ার বাসনা করেছিলেন। রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল শরৎকালে এবং তারপরে বড় উৎসব হচ্ছে ফাল্গুনী পূর্ণিমায় হােলি অথবা দোলযাত্রা।

 

 রাসলীলা এবং দোলযাত্রার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হচ্ছে শিবরাত্রি, যা সাধারণত শৈব অথবা শিবের ভক্তরা পালন করেন। তবে কখনও কখনও বৈষ্ণবরাও এই উৎসব পালন করে থাকেন, কেননা তারা শিবকে এক মহান বৈষ্ণব বলে জানেন। তবে কৃষ্ণভক্তরা খুব নিয়মিতভাবে শিবরাত্রি পালন করেন না। তাই শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে যে, নন্দ মহারাজের নেতৃত্বে গােপেরা কোন এক সময় শিবরাত্রি পালন করতে মনস্থ করেছিলেন। 

 

এই অম্বিকা বন গুজরাট প্রদেশে অবস্থিত। অম্বিকা বন সরস্বতী নদীর তীরে অবস্থিত, তবে সরস্বতী নদী গুজরাট প্রদেশে প্রবাহিত হচ্ছে না; গুজরাট প্রদেশের মধ্য দিয়ে যে নদীটি প্রবাহিত হচ্ছে তার নাম সবরমতি। 

 

ভারতবর্ষের সমস্ত উল্লেখযোগ্য তীর্থস্থানগুলি গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, নর্মদা, গোদাবরী, কাবেরী ইত্যাদি অতি মনোরম নদীর তীরে অবস্থিত। অম্বিকা বন অবস্থিত ছিল সরস্বতী নদীর তীরে, এবং নন্দ মহারাজের নেতৃত্বে সমস্ত গােপেরা সেখানে গিয়েছিলেন। 

 

তারা গভীর ভক্তি সহকারে শিব এবং অম্বিকার পূজা করতে লাগলেন। সাধারণত শিব মন্দিরের পাশে অম্বিকা (বা দুর্গা) মন্দির অবশ্যই থাকে, কেননা শিবের পত্নী অম্বিকা হচ্ছেন পরম সতী। তাই তিনি তার পতিকে ছেড়ে থাকেন না। 

 

অম্বিকা বনে পৌছে বৃন্দাবনের গােপেরা প্রথমে সরস্বতী নদীতে স্নান করলেন। কেউ যখন কোন তীর্থস্থানে যায়, তখন তার প্রথম কর্তব্য হচ্ছে স্নান করা এবং সম্ভব হলে মস্তক মুণ্ডন করা। সেটিই হচ্ছে প্রথম কর্তব্য। নদীতে স্নান করে তারা শিব এবং অম্বিকার পূজা করলেন, তারপর সেই তীর্থস্থানে অনেক গােধন এবং সম্পদ দান করলেন।

 

বৈদিক প্রথা অনুসারে দান সাধারণত ব্রাহ্মণকেই দিতে হয়। বৈদিক শাস্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে যে, ব্রাহ্মণ এবং সন্ন্যাসীরা কেবল দান গ্রহণ করতে পারেন। বৃন্দাবনের গােপেরা নানা রকম স্বর্ণ-অলঙ্কার ও ফুলমালায় ভূষিত বহু গাভী দান করলেন। 

 

দান সাধারণত ব্রাহ্মণদেরকে করা হয়, কেননা তারা তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য কোন রকম প্রচেষ্টা করেন না। তাদের কর্তব্য হচ্ছে বৃত্তিতে যুক্ত থাকা, যে সম্বন্ধে ভগবদ্গীতায় বর্ণনা করা হয়েছে, পাণ্ডিত্য, তপশ্চর্যা, এবং ইন্দ্রিয় সংযম।

 

তারা কেবল নিজেরাই পাণ্ডিত্য অর্জন করেন না, তারা অপরকে শিক্ষাদানও করেন। ব্রাহ্মণ কেবল ব্রাহ্মণদের জন্য নয়; তাদের কর্তব্য হচ্ছে অন্যদেরও ব্রাহ্মণে পরিণত করা। কেউ যখন ব্রাহ্মণের শিষ্যত্ব বরণ করতে প্রস্তুত হয়, তখন তাকে ব্রাহ্মণ হওয়ার সুযােগ দেওয়া হয়। 

 

ব্রাহ্মণেরা সর্বদাই বিষ্ণুর আরাধনায় যুক্ত। তাই তারা সব রকমের দান গ্রহণে যােগ্য। তবে কোন ব্রাহ্মণ যদি প্রয়ােজনাতিরিক্ত দান লাভ করেন হলে তার কর্তব্য হচ্ছে বিষ্ণুর সেবার জন্য সেগুলি বিতরণ করে দেওয়া। তাই বৈদিক শাস্ত্রে ব্রাহ্মণদের দান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এবং তার ফলে ভগবান শ্রীবিষ্ণু এবং অন্যান্য দেবতারা তুষ্ট হন।

 

তীর্থযাত্রীরা তীর্থস্থানে গমন করেন, শ্রীবিগ্রহের আরাধনা করেন, এবং ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসীদের দান করেন; সেই সঙ্গে তাদের আরেকটি করণীয় হচ্ছে একদিন উপবাস করা। তীর্থস্থানে গিয়ে অন্ততপক্ষে তিনদিন বাস করা উচিত। প্রথম দিন উপবাস করতে হয়, সেদিন রাত্রে তারা একটু জল গ্রহণ করতে পারেন, কেননা জল গ্রহণে উপবাস ভঙ্গ হয় না।

 

নন্দ মহারাজের নেতৃত্বে গােপেরা সেই রাত্রিটি সরস্বতী নদীর তীরে যাপন করলেন। তারা সমস্ত দিন উপবাসী থেকে একটু জলগ্রহণ করলেন। কিন্তু রাত্রিবেলা যখন তারা বিশ্রাম করছিলেন, তখন নিকটবর্তী জঙ্গল থেকে একটি ক্ষুধার্ত সর্প এসে নন্দ মহারাজকে গিলতে লাগল। 

 

অসহায়ভাবে নন্দ মহারাজ তখন আর্তনাদ করতে লাগলেন, “হে কৃষ্ণ! তুমি এসে এই বিপদ থেকে আমাকে রক্ষা কর! এই সর্প আমাকে ভক্ষণ করছে!” নন্দ মহারাজ যখন সাহায্য প্রার্থনা করে আর্তনাদ করতে লাগলেন তখন সমস্ত গােপেরা ঘুম থেকে উঠে সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখল।

 

তারা তৎক্ষণাৎ জ্বলন্ত কাঠের টুকরাে নিয়ে সেই সর্পটিকে হত্যা করার মানসে তাকে আঘাত করতে লাগল। কিন্তু সেই জ্বলন্ত কাঠের আঘাত সত্ত্বেও সেই সর্পটি নন্দ মহারাজকে ছেড়ে দিল না।

 

শ্রীকৃষ্ণ তখন সেখানে এসে তাঁর চরণারবিন্দের দ্বারা যেই স্পর্শ করলেন, তার চরণারবিন্দের স্পর্শে সেই সপটি তৎক্ষণাৎ তার সর্প শরীর ত্যাগ করে এক অপূর্ব সুন্দর বিদ্যাধর রূপ ধারণ করল। তার অঙ্গসৌষ্ঠব এত সুন্দর ছিল যে, তাকে দেখেই মনে হল তিনি যেন আরাধ্য দেবতা।

 

তার দেহ থেকে এক দিব্য জ্যোতি নির্গত হচ্ছিল এবং তিনি স্বর্ণ অলঙ্কার ও দিব্যমাল্যে ভূষিত ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণকে প্রণতি নিবেদন করে তিনি অতি বিনীতভাবে তার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। শ্রীকৃষ্ণ তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, পরম সৌন্দর্যমণ্ডিত দিব্য দর্শন আপনি কে? কোন নিন্দিত কর্ম করার ফলে আপনি এই সর্প শরীর প্রাপ্ত হয়েছেন?" সেই বিদ্যাধর তখন তার পূর্বজীবনের কাহিনী বর্ণনা করতে লাগলেন।

তিনি বললেন, হে প্রভু! পূর্ব জীবনে আমার নাম ছিল বিদ্যাধর এবং আমার সৌন্দর্যের জন্য সমস্ত পৃথিবী জুড়ে খ্যাতি ছিল। একদিন আকাশমার্গে আমার বিমানে চড়ে ভ্রমণ করার সময় আমি অঙ্গিরা নামক একজন মহর্ষিকে দেখতে পেলাম।

 

তিনি ছিলেন অত্যন্ত কুৎসিত, এবং আমার সৌন্দর্যগর্বে গর্বিত হয়ে আমি সেই ঋষিকে উপহাস করেছিলাম। আমার সেই অপরাধের জন্য সেই মহর্ষি আমাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন এবং তার ফলে আমি একটি সর্পে পরিণত হয়েছিলাম।"

 

এই জড় জগতে যত উন্নত স্তরে অধিষ্ঠিত হন না কেন, কৃষ্ণের কৃপা লাভ করার পূর্বে জীব জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। বিদ্যাধর ছিলেন দেবতা এবং অপূর্ব রূপবান। তিনি অত্যন্ত উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং তিনি সর্বত্র বিমানে করে ভ্রমণ করতে পারতেন।

 

কিন্তু তবুও তার পরবর্তী জীবনে তাঁকে অভিশপ্ত হয়ে সর্প শরীর ধারণ করতে হয়েছিল। এই জড় জগতে যত উন্নত স্তরেই মানুষ থাকুক না কেন, তিনি যদি সাবধান না হন, তা হলে তাকে অধঃ পতিত হয়ে অতি নিম্নস্তরের জঘন্য জীবন যাপন করতে হতে পারে। অনেকে মনে করে যে একবার মনুষ্য-শরীর পেলে আর অধঃপতন হয় না, কিন্তু সেই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। 

 

এখানে বিদ্যাধর নিজেই বর্ণনা করেছেন যে, যদিও পূর্বজন্মে তিনি ছিলেন স্বর্গের দেবতা, তাকে অধঃপতিত হয়ে সর্পরূপে জন্মগ্রহণ করতে হয়েছিল। কিন্তু পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের স্পর্শ লাভ করার ফলে তিনি তৎক্ষণাৎ কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করেন।

 

তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, পূর্বজন্মে তিনি পাপ করেছিলেন। কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত জানেন যে, তিনি হচ্ছেন কৃষ্ণের নিত্য দাস। তিনি তার ক্ষুদ্রত্ব উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে তার সমস্ত ভাল কাজগুলি তিনি কৃষ্ণের কৃপায় এবং শ্রীগুরুদেবের কৃপায় সম্পাদন করছেন।

 

বিদ্যাধর শ্রীকৃষ্ণকে বলতে লাগলেন, " যেহেতু আমি আমার দেহের সৌন্দর্য গর্বে গর্বিত হয়ে মহর্ষি অঙ্গিরার কুৎসিত আকৃতির উপহাস করেছিলাম, তাই তিনি আমাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন এবং সেই অভিশাপের ফলে আমি সর্পে পরিণত হয়েছিলাম। 

 

এখন আমি বুঝতে পারছি যে, মহর্ষির সেই অভিশাপ প্রকৃতপক্ষে অভিশাপ ছিল না; তা ছিল আমার প্রতি তার আশীর্বাদ। তিনি যদি আমাকে অভিশাপ না দিতেন তা হলে আমি এই সর্প-শরীর ধারণ করতে পারতাম না। এবং আপনার চরণারবিন্দের স্পর্শে সমস্ত জড় কলুষ থেকে মুক্ত হতে পারতাম না।”

 

জড় জগতে চারটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—উচ্চকুলে জন্মগ্রহণ করা, অত্যন্ত ঐশ্বর্যশালী হওয়া, অত্যন্ত বিদ্বান হওয়া, অত্যন্ত রূপবান হওয়া। এইগুলিকে জড়জাগতিক সম্পদ বলে বিবেচনা করা হয়। 

 

দুর্ভাগ্যবশত, কৃষ্ণভক্তি বিনা, এই জড় সম্পদগুলি কখনও কখনও পাপকর্ম ও অধঃপতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিদ্যাধর ছিলেন দেবতা এবং অপূর্ব রূপবান, তার গর্বের জন্য তাকে অধঃপতিত হয়ে সর্পে পরিণত হতে হয়েছিল।

 

সর্প হচ্ছে সব চাইতে হিংস্র জীব, কিন্তু যে সমস্ত মানুষ অপরের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ, তাদের সর্পের থেকেও অধিক হিংস্র বলে বিবেচনা করা হয়, মন্ত্র এবং ঔষধির দ্বারা সর্পকে বশীভূত করা যায়, কিন্তু খল প্রকৃতির মানুষকে কোন কিছুর দ্বারা বশীভূত করা যায় না।

 

বিদ্যাধর বলতে লাগলেন, "হে প্রভু! এখন যেহেতু আমি আমার সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়েছি, আমি আমার লােকে ফিরে যাওয়ার জন্য আপনার অনুমতি প্রার্থনা করছি।” 

 

এই অনুরােধের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, যে সমস্ত মানুষ সকাম কর্মের প্রতি আসক্ত হয়ে উচ্চতর লােকে উন্নীত হয়ে নানা রকম সুখ স্বাচ্ছন্দ্য উপভােগ করতে চান, তারা পরমেশ্বর ভগবানের অনুমতি ব্যতীত তাদের ঈলিত বস্তু লাভ করতে পারেন না। 

 

ভগবদগীতাতেও বলা হয়েছে যে, অল্পবুদ্ধি- সম্পন্ন মানুষেরা জড় সুখসুবিধা ভােগ করার জন্য বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করে, কিন্তু তারা প্রকৃতপক্ষে শ্রীকৃষ্ণ বা বিষ্ণুর অনুমতিক্রমেই দেব-দেবীর আশীর্বাদ লাভ করে।

 

কোন রকম জড়জাগতিক সুখসুবিধা দানের ক্ষমতা দেবতাদের নেই। কেউ যদি জড়জাগতিক সুখসুবিধা ভােগের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত থাকেন তা হলে  তিনি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পূজা করতে পারেন এবং নিজের অভিলষিত বস্তু কামনা করে তার কাছে প্রার্থনা করতে পারেন।

 

কৃষ্ণ ইচ্ছা করলে জাগতিক বস্তুলাভের আশীর্বাদও করতে পারেন। তবে দেব-দেবীর কাছে জড়জাগতিক সুখসুবিধার প্রার্থনা করা এবং শ্রীকৃষ্ণের কাছে তা প্রার্থনা করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

 

ধ্রুব মহারাজ জড় বস্তু কামনা করে পরমেশ্বর ভগবানের আরাধনা করেছিলেন, কিন্তু যখন তিনি ভগবানের কৃপা লাভ করলেন, তখন তিনি এত সন্তুষ্ট হলেন যে, তিনি কোন রকম বর গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন।

 

বুদ্ধিমান পুরুষ দেব-দেবীর পূজা করেন না বা তাদের কাছ থেকে কোন রকম সুযােগসুবিধা কামনা করেন না; তিনি সরাসরিভাবে শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হন, যদি তার কোন জড় বাসনা থেকেও থাকে, তা হলে তিনি তার জন্য শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করেন, দেব দেবীর কাছে নয়।

 

স্বীয় লােকে ফিরে যাওয়ার জন্য শ্রীকৃষ্ণের অনুমতির প্রতীক্ষা করে বিদ্যাধর বললেন, এখন আমি আপনার শ্রীপাদপদ্মের স্পর্শলাভ করেছি এবং তার ফলে সমস্ত রকম জড় যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়েছি, আপনি সর্বশক্তিমান এবং যােগেশ্বর। 

 

আপনি আদিপুরুষ পরমেশ্বর ভগবান। আপনি ভক্তবৎসল। আপনি সমস্ত বিশ্ব চরাচরের পালনকর্তা, তাই আমি আপনার অনুমতি প্রার্থনা করি, আমি সর্বতােভাবে আপনার চরণে আত্মসমর্পিত হয়েছি। 

 

আমি খুব ভালভাবেই জানি যে, মানুষ যখন নিরন্তর আপনার দিব্য নাম কীর্তন করেন, তখন তারা সব রকমের পাপ থেকে মুক্ত হন এবং কেউ যদি আপনার শ্রীপাদপদ্মের স্পর্শলাভের সৌভাগ্য অর্জন করে থাকেন, তা হলে তৎক্ষণাৎ তিনি মুক্তিলাভ করেন। 

তাই আমি স্থির নিশ্চিতভাবে জানি যে, কেবলমাত্র আপনার শ্রীপাদপদ্মের স্পর্শলাভ করার ফলে আমি ব্রাহ্মণের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়েছি।” 

 

এইভাবে শ্রীকৃষ্ণের অনুমতি লাভ করে বিদ্যাধর স্বর্গে ফিরে গেলেন। এই সৌভাগ্য লাভ করে তিনি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রদক্ষিণ করলেন এবং তারপর তাকে তার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করে তিনি স্বর্গলোকে ফিরে গেলেন। এইভাবে নন্দ মহারাজও আসন্ন বিপদ থেকে মুক্ত হলেন।

 

যে সমস্ত গােপেরা শিব এবং অম্বিকার পূজা করার জন্য এসেছিলেন, তাঁরা তাদের পূজা সমাপন করে বৃন্দাবনে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। যেতে যেতে তারা শ্রীকৃষ্ণের অদ্ভুত সমস্ত কার্যকলাপ স্মরণ করতে লাগলেন।

 

বিদ্যাধর মােক্ষণের ঘটনা বর্ণনা করতে করতে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আরও বেশী আকৃষ্ট হলেন। তারা শিব এবং অম্বিকার পূজা করতে এসেছিলেন, কিন্তু পরিণামে তারা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আরও বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। তেমনই গােপিকারাও শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আরও বেশী আসক্ত হওয়ার জন্য কাত্যায়নী দেবীর পূজা করেছিলেন।

 

ভগবদগীতায় বর্ণনা করা হয়েছে, যে সমস্ত মানুষ ব্যক্তিগত সুখসুবিধার জন্য শিব, চন্দ্র, আদি দেবতাদের পূজা করেন, তারা অল্পবুদ্ধি-সম্পন্ন, এবং তারা জীবনের যথার্থ উদ্দেশ্যের কথা ভুলে গেছেন। কিন্তু ব্রজবাসী গােপেরা সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তারা যাই করতেন শ্রীকৃষ্ণের জন্যই করতেন।

কৃষ্ণভক্তি লাভ করার জন্য শিব, আদি দেবতাদের পূজা অনুমােদন করা হয়েছে, কিন্তু স্বার্থসিদ্ধির জন্য দেবতাদের পূজা বর্জনীয়।

 

এই ঘটনার পর এক মনােরম রজনীতে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অদ্ভুত বলবান জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরামের সঙ্গে বৃন্দাবনে গিয়েছিলেন। ব্রজভূমির বালিকারাও তাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন এবং পরস্পরের সঙ্গসুখ উপভােগ করছিলেন। ব্রজবালারা চন্দন চর্চিত হয়ে অপূর্ব সুন্দর সজ্জায় এবং ফুলমালায় সজ্জিত ছিলেন। 

 

উজ্জ্বল তারকা পরিবৃত হয়ে চন্দ্র তখন আকাশে শােভা পাচ্ছিল এবং মল্লিকা ফুলের গন্ধ বহন করে মৃদুমন্দ সমীরণ বইছিল, সেই সৌরভে ভ্রমরেরা উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। সেই অপূর্ব সুন্দর পরিবেশে শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরাম অপূর্ব সুরে গান গাইতে লাগলেন।

 

তাদের সেই সঙ্গীতের সুরে মগ্ন হয়ে ব্রজবালারা আত্মবিস্মৃত হলেন; তাদের কেশপাশ শিথিল হয়ে পড়ল, তাদের বসন স্বলিত হল, এবং তাদের গলার মালা গলা থেকে খুলে যেতে লাগল।

 

সেই সময়, তারা যখন এইভাবে মগ্ন হয়ে পাগলিনীর মতাে হয়ে গেলেন, তখন স্বর্গের কোষাধ্যক্ষ কুবেরের এক অনুচর সেখানে এসে উপস্থিত হল। তার মাথায় শঙ্খাকৃতি একটি অতি মূল্যবান রত্ন ছিল বলে সেই অসুরটির নাম ছিল শঙ্খাসুর।

 

কুবেরের দুই পুত্র যেমন ঐশ্বর্য মদে মত্ত হয়ে নারদ মুনিকে উপেক্ষা করেছিল, এই শঙ্খাসুরও তেমনই তার ধনগর্বে অত্যন্ত মত্ত ছিল। সে মনে করল যে, কৃষ্ণ এবং বলরাম, দুটি সাধারণ গােপবালক, এতগুলি সুন্দরী বালিকার সঙ্গসুখ উপভােগ করছে।

 

সাধারণত জড় জগতে ধনমদে মত্ত মানুষ মনে করে যে, সমস্ত সুন্দরী রমণীরা তার উপভােগের সামগ্রী। কুবেরের অনুচর ধনমদে মত্ত হয়ে মনে করল যে, শ্রীকৃষ্ণ-বলরাম ব্ৰজগােপিকাদের সঙ্গসুখ লাভের অধিকারী নন , সে-ই কেবল অনিন্দ্যসুন্দরী ব্ৰজগােপিকাদের সঙ্গসুখ লাভের অধিকারী। তাই সে তখন তাদের অধিকার করে নিতে মনস্থ করল। 

 

শ্রীকৃষ্ণ-বলরাম এবং ব্রজবালাদের সামনে এসে সে তখন সমস্ত বালিকাদের উত্তর দিকে নিয়ে যেতে লাগল। সে তাদের এমনভাবে আদেশ দিতে লাগল, যেন কৃষ্ণ এবং বলরামের উপস্থিতি সত্ত্বেও, সে-ই হচ্ছে তাদের প্রভু এবং পতি।

 

জোর করে শঙ্খাসুর যখন তাদের নিয়ে যেতে লাগল, ব্রজবালারা তখন তাদের রক্ষা করার জন্য কৃষ্ণ এবং বলরাম নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। দুই ভাই তৎক্ষণাৎ বিশাল দুটি দণ্ড নিয়ে তাদের রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এলেন। তারা গােপিকাদের বললেন, “তােমরা ভয় পেও না। এই অসুরকে যথাযথভাবে দণ্ড দেওয়ার জন্য আমরা এক্ষুণি আসছি।” দ্রুতগতিতে তারা শঙ্খাসুরের সামনে এসে দাঁড়ালেন।

 

শঙ্খাসুর তখন বুঝতে পারল যে, এই দুটি ভাই অত্যন্ত শক্তিশালী, তাই সে প্রাণভয়ে গােপীদের সঙ্গ পরিত্যাগ করে সেখান থেকে পালাতে লাগল। কিন্তু সে পালালেও শ্রীকৃষ্ণ তাকে ছাড়বেন না। বলরামের তত্ত্বাবধানে গােপিকাদের রেখে তিনি শঙ্খসুরকে ধরবার জন্য তার পিছন পিছন ছুটলেন। কৃষ্ণ চেয়েছিলেন সেই অসুরের মাথার অত্যন্ত মূল্যবান মণিটি নিতে।

 

কিছুদূর যাওয়ার পর কৃষ্ণ তাকে ধরে ফেললেন এবং তার মস্তকে মুষ্ট্যাঘাত করে তাকে হত্যা করলেন। তারপর তার মাথার অত্যন্ত মূল্যবান মণিটি নিয়ে ফিরে এলেন। ব্ৰজগােপিকাদের সমক্ষে তিনি সেই মণিটি তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরামকে উপহার দিলেন।

 

আরও পড়ুন

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
৩২. অক্রুরের বৃন্দাবনে আগমন

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url