রাসলীলার সূচনা-কৃষ্ণ লীলা কথা - শ্রীমদ্ভগবদ গীতা যথাযথ বাংলা

নতুন পোষ্ট

Add

মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২০

রাসলীলার সূচনা-কৃষ্ণ লীলা কথা

রাস লীলার সূচনা

 রাসলীলার সূচনা

শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, শারদীয়া পূর্ণিমায় রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পূর্ববর্তী অধ্যায় থেকে জানা যায় যে, গােবর্ধন পুজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল কার্তিক মাসে অমাবস্যার ঠিক পরের দিন এবং তারপর ভ্রাতৃদ্বিতীয়া অনুষ্ঠিত হয়;

 

তারপর ইন্দ্রের রােষে ঝড়ঝঞ্জা এবং প্রচণ্ড বর্ষণ হয়, এবং শ্রীকৃষ্ণ শুক্লপক্ষের নবমী তিথি পর্যন্ত সাতদিন গিরি-গোবর্ধন ধারণ করেছিলেন। তারপর দশমীর দিন বৃন্দাবনবাসীরা নিজেদের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের আশ্চর্য সমস্ত কার্যকলাপের আলােচনা করেন এবং তার পরের দিন নন্দ মহারাজ একাদশী পালন করেন। 

 

তারপর দ্বাদশীর দিন নন্দ মহারাজ যমুনায় স্নান করতে গিয়ে বরুণের ভৃত্য কর্তৃক বন্দী হন, এবং তারপর শ্রীকৃষ্ণ তাকে উদ্ধার করেন। তারপর শ্রীকৃষ্ণ গােপগণসহ নন্দ মহারাজকে বৈকুণ্ঠলােক প্রদর্শন করান।

 

এইভাবে অবশেষে শরৎ ঋতুর পূর্ণিমা এল। আশ্বিন মাসের পূর্ণিমাকে শারদীয় পূর্ণিমা বলা হয়। শ্রীমদ্ভাগবতের বর্ণনা থেকে জানতে পারা যায় যে, ব্রজগােপিকাদের সঙ্গে রাসলীলা উপভােগ করবার জন্য শ্রীকৃষ্ণকে আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। 

 

সাত বছর বয়সে শ্রীকৃষ্ণ গােবর্ধন পর্বত ধারণ করেছিলেন। তাই যখন রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তখন শ্রীকৃষ্ণের বয়স ছিল আট বছর।

 

বৈদিক শাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে, একজন নট বন বহু নটাদের সঙ্গে নৃত্য করলে তখন সেই যৌথ নৃত্যকে বলা হয় রাসনৃত্য। শরৎকালের পূর্ণিমার রাত্রে শ্রীকৃষ্ণ নানা রকম সুন্দর পুস্পে, বিশেষ করে অত্যন্ত সুগন্ধযুক্ত মল্লিকা পুপ্পে সজ্জিত হলেন। 

 

তাকে পতিরূপে লাভ করবার জন্য কাত্যায়নী দেবীর কাছে গােপীদের প্রার্থনার কথা তার মনে পড়ে গেল। তিনি ভাবলেন যে, শরৎকালের পূর্ণিমার রাত তাদের সঙ্গে নৃত্যানুষ্ঠানের উপযুক্ত সময়। সুতরাং শ্রীকৃষ্ণ তখন তাকে তাদের পতিরূপে পাওয়ার বাসনা পূর্ণ করবেন।

 

শ্রীমদ্ভাগবতে এখানে 'ভগবান অপি কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে, তার অর্থ হচ্ছে—যদিও শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, তাই তিনি বড়ৈশ্বর্যপূর্ণ, তার কোন বাসনাই অপূর্ণ থাকে না, কিন্তু তবুও তিনি গােপিকাদের সঙ্গসুখ উপভােগ করতে চেরেছিলেন। ভগবান অপি’কথাটির মাধ্যমে বােঝানাে হচ্ছে যে, 

 

সাধারণ যুবক যেভাবে বুবতীদের সাঙ্গে নাচে, ব্ৰজগােপিকাদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের রাসনৃত্য সেই রকম নয়। শ্রীমদ্ভাগবতে আরও বলা হয়েছে, যােগমায়ার-উপাশ্রিত' যার অর্থ হচ্ছে—যােগমায়াকে আশ্রয় করে শ্রীকৃষ্ণ গােপীদের সঙ্গে তাঁর নৃত্যলীলা বিলাস করেছিলেন, মহামায়ার কবলিত হয়ে নয়।

 

এই জড় জগতে যুবক-যুবতীদের যে নাচ, তা ভগবানের বহিরঙ্গা শক্তি মহামায়ার কর্তৃত্বাধীনে হয়ে থাকে। কিন্তু গােপিকাদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা যােগমায়ার স্তরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মহামায়া এবং যােগমায়ার পার্থক্য সম্বন্ধে শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে বলা হয়েছে, সােনার সঙ্গে লােহার পার্থক্যের মতাে।

 

সােনা এবং লােহা উভয়েই ধাতু, কিন্তু গুণগতভাবে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তেমনই, যদিও আপাতদৃষ্টিতে ব্রজগােপিকাদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা সাধারণ যুবক-যুবতীর মিলনের মতাে বলে মনে হয়, কিন্তু গুণগতভাবে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মহান আচার্যেরা এর পার্থক্য নিরূপণ করে গেছেন, কেননা তারা সাধারণ মানুষের কাম এবং কৃষ্ণপ্রেমের পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারেন।

 

মহামায়ার রাজ্য এই জড় জগতে যুবক-যুবতীর নৃত্য ইন্দ্রিয় সুখভােগের কামনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ যখন তার বাঁশি বাজিয়ে গােপীদের আহ্বান করেছিলেন, তখন গােপীরা আকুল হয়ে রাসস্থলীতে ছুটে এসেছিলেন শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত বাসনার তৃপ্তি সাধন করার জন্য। 

 

শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের প্রণেতা শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গােস্বামী বলেছেন,আত্মেন্দ্রিয়গ্ৰীতি-বাঞ্ছা—তারে বলি কাম'। কৃষ্ণেন্দ্রিয়প্ৰীতি-ইচ্ছা ধরে প্রেম’ নাম ॥ অর্থাৎ আমাদের ইন্দ্রিয়তৃপ্তির যে বাসনা, তা হচ্ছে কাম, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তি সাধন করার যে ইচ্ছা, তা হচ্ছে প্রেম। 

 

অর্থাৎ আমাদের নিজেদের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন করার জন্য যখন কর্ম করা হয়, সেই কর্ম হচ্ছে জড় কর্ম, কিন্তু তা যখন শ্রীকৃষ্ণের তৃপ্তিসাধন করবার জন্য করা হয়, তখন তা চিন্ময় ভগবন্তুক্তি।

 

সমস্ত কর্মের পেছনেই ইন্দ্রিয়তৃপ্তির বাসনা রয়েছে। চিন্ময় স্তরে তা সাধিত হয় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য, কিন্তু জড়জাগতিক স্তরে ব্যক্তিগত ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধনই হচ্ছে উদ্দেশ্য।

 

দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, এই জড় জগতে একজন ভূত্য যখন প্রভুর সেবা করে, সে তখন প্রকৃতপক্ষে তার প্রভুর ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধনের চেষ্টা করে না; পক্ষান্তরে, তার নিজের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধনের চেষ্টা করে।

 

মালিক যদি বেতন দেওয়া বন্ধ করে দেয়, তা হলে সেই ভূত্য আর সেই প্রভুর সেবা করবে না। অর্থাৎ ভৃত্য প্রভুর সেবা করছে, মাসের শেষে বেতন পেয়ে নিজের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন করার জন্য। 

 

চিন্ময় স্তরে কিন্তু ভক্ত কোন রকম বেতন বা প্রতিদানের প্রত্যাশা না করেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করেন, এবং সর্ব অবস্থাতেই তিনি ভগবানের সেবা করে চলেন।  

এটাই হচ্ছে কৃষ্ণভক্তি এবং জড়ভােগের পার্থক্য। এখানে আমরা দেখতে পাই যে, শ্রীকৃষ্ণ যখন গােপীদের সঙ্গে রাসলীলা বিলাস করেছিলেন, তখন তার বয়স ছিল আট বছর।

 

সেই সময় অনেক গােপাই বিবাহিত ছিলেন। কেননা ভারতবর্ষে, বিশেষ করে সেই সময়, মেয়েদের খুব অল্প বয়সেই বিবাহ হয়ে যেত। অনেক সময় দেখা গেছে, বার বছর বয়সেই বালিকারা মা হয়ে গেছে।

 

তখন যে সমস্ত গােপীরা শ্রীকৃষ্ণকে তাদের পতিরূপে কামনা করেছিলেন, তাদের ইতিমধ্যেই বিবাহ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা হলেও তারা শ্রীকৃষ্ণকে তাদের পতিরূপে পাওয়ার আশা পােষণ করেছিলেন।

 

 শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাদের মনােভাব ছিল প্রণয়িনীর মতাে। তাই গােপীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের এই প্রেমকে বলা হয় পরকীয়া প্রেম। কোন বিবাহিত পুরুষ অথবা স্ত্রী যখন অপর স্ত্রী বা পুরুষকে কামনা করে, তখন তাকে বলা হয় পরকীয়া প্রেম।

 

প্রকৃতপক্ষে শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সকলের পতি, কেননা তিনিই হচ্ছেন পরম ভােক্তা। সমস্ত গােপীর শ্রীকৃষ্ণকে তাদের পতিরূপে কামনা করেছিলেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের পক্ষে তাদের সকলকে বিবাহ করা সম্ভব ছিল না।

 

যেহেতু শ্রীকৃষ্ণকে তাদের পরম পতিরূপে পাওয়ার স্বাভাবিক বাসনা তাঁদের মধ্যে ছিল, তাই গােপিকাদের সঙ্গে সেই সম্পর্ককে বলা হয় পরকীয়া প্রেম। 

 

এই পরকীয়া সে অপ্রাকৃত জগতে গােলােকধামে নিত্য বিরাজমান। জড় জগতে পরকীয়া সে যে সমস্ত বিকৃতি দেখা যায়, আগ্রাকৃত জগতে গােলােক বৃন্দাবনে সেই রকম বিকৃতির কোন সন্তাবনা নেই।

 

 এই জড় জগতে পরকীয়া রস অতি জঘন্য, কিন্তু অপ্রাকৃত জগতে এই রসে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে গােপীদের সম্পর্ক, তা সর্বোচ্চ মহিমামণ্ডিত। শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তার ভক্তের সম্পর্ক নানা রকমের হতে পারে, যথা—দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য মাধুর্য। এই সমস্ত সম্পর্কের মধ্যে পরকীয়া রসের যে সম্পর্ক, তা হচ্ছে সর্বোত্তম।

 

এই জড় জগৎ হচ্ছে চিৎ জগতের প্রতিবিম্ব; এটা ঠিক জলাশয়ের পাশে একটি গাছের প্রতিবিম্বের মতাে। গাছের ডগাটা যেমন প্রতিবিম্বতে সব চাইতে নীচে দেখা যায়, তেমনই পরকীয়া প্রেম যখন এই জড় জগতে বিকৃতভাবে হয়, তখন তা অত্যন্ত জঘন্য বলে মনে হয়। 

 

তাই মানুষ যখন গােপীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা অনুকরণ করে, তখন তারা কেবল অপ্রাকৃত পরকীয়া রসের জঘন্য বিকৃত প্রতিবিম্ব উপভােগ করার চেষ্টা করে। এই জড় জগতে এই অপ্রাকৃত পরকীয়া রস উপভােগ করা কখনই সম্ভব নয়। 

 

শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে যে, স্বপ্নে এবং কল্পনাতেও এই পরকীয়া রস অনুকরণ করার চেষ্টা করা উচিত নয়। যারা তা করে, তারা সব চাইতে তীব্র বিষ পান করছে।

 

পরম ভােক্তা শ্রীকৃষ্ণ যখন শরৎকালের পূর্ণিমার রাতে ব্রজগােপিকাদের সঙ্গসুখ ভােগ বাসনা করলেন, ঠিক সেই সময় তারকাদের রাজা চন্দ্র তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে আকাশে উদিত হলেন। শরৎকালের পূর্ণিমার রাত হচ্ছে সব চাইতে সুন্দর রাত্রি।

 

ভারতবর্ষের উত্তরপ্রদেশের আগ্রা শহরে তাজমহল নামে একটি স্মৃতিসৌধ আছে যা সব চাইতে দুর্লভ মর্মর দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। শরৎকালের পূর্ণিমার রাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষেরা আসে এই স্মৃতিসৌধে চাদের অপূর্ব সুন্দর প্রতিফলন দর্শন করবার জন্য। এইভাবে আজও শারদীয়া পূর্ণিমা হয়ে আসছে।

 

যখন পূর্ণিমার চাঁদের উদয় হল, তখন সব কিছু তার রক্তিম আভায় রঞ্জিত হল। চন্দ্র উদয়ের ফলে মনে হল যেন সমস্ত আকাশ কুমকুমের রঙে আরক্তিম হয়ে উঠল।

 

 দূর প্রবাস থেকে বহুদিন পরে পতি যখন ঘরে ফিরে আসে, তখন সে কুমকুম দিয়ে তাঁর পত্নীর মুখ রাঙিয়ে তােলে। এইভাবে বহু আকাক্ষিত শারদীয়া পূর্ণিমার চন্দ্রোদয় পূর্ব দিগন্তকে রাঙিয়ে তুলেছিল।

 

চন্দ্র উদয়ের ফলে গােপীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের নাচবার বাসনা বর্ধিত হল। বনগুলি তখন সুবাসিত ফুলে ফুলে ভরে গিয়েছিল। চারদিক তখন স্নিগ্ধ এবং উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল।

 

শ্রীকৃষ্ণ যখন তার বাঁশি বাজাতে লাগলেন, বৃন্দাবনের সমস্ত গােপীরা তখন মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। পূর্ণচন্দ্রের উদয়, রক্তিম দিগন্ত, এবং মনােরম পরিবেশ এবং পূর্ণ বিকশিত পুষ্পের সৌরভ সেই বাঁশির সুরের প্রতি তাদের আকর্ষণ সহস্র গুণে বর্ধিত করেছিল। 

 

এই সকল গােপীরাই স্বাভাবিকভাবে শ্রীকৃষ্ণের সৌন্দর্যের প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট ছিলেন, এবং তারা যখন তার বংশীধ্বনি শুনতে পেলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণের ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তিসাধন করার জন্য তারা আকুল হয়ে উঠলেন।

 

সেই বংশীধ্বনি শােনামাত্রই তাঁরা তাঁদের সমস্ত কাজ ফেলে দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখানে ছুটে গেলেন। তারা যখন দ্রুতবেগে ছুটছিলেন, তখন তাদের কানের দুল আন্দোলিত হচ্ছিল। তারা সকলে বংশীবটের দিকে ধাবিত হলেন। 

 

তাদের কেউ তখন গাে-দহন করছিলেন, কিন্তু সেই দোহন কার্য ফেলে রেখে তারা তৎক্ষণাৎ শ্রীকৃষ্ণের কাছে ছুটে গেলেন। তাদের একজন উনানে দুধ জ্বাল দিচ্ছিলেন, সেই দুধ উথলে পড়ে গেল কিনা সেই সম্বন্ধে কোন ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি তৎক্ষণাৎ শ্রীকৃষ্ণের কাছে ছুটে গেলেন।

 

তাদের কেউ কেউ তাদের শিশুদের স্তন্যদান করছিলেন, এবং কেউ পরিবারের সদস্যদের খাদ্য পরিবেশন করছিলেন, কিন্তু তারা সেই সমস্ত কাজ ফেলে রেখে দিয়ে তৎক্ষণাৎ শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য ছুটে গেলেন। অনেকে তাদের পতিদের সেবা করছিলেন এবং কেউ ভােজন করছিলেন, কিন্তু তাদের পতিসেবা,

 

ভােজন সব কিছু ফেলে রেখে তারা তৎক্ষণাৎ শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগে তাদের মুখে প্রসাধন করছিলেন অথবা সুন্দর সজ্জায় ভূষিত হচ্ছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁরা তাদের প্রসাধন সমাপ্ত করতে পারলেন না, এবং সুন্দরভাবে তাঁদের কাপড় পরতে পারলেন না। তৎক্ষণাৎ তারা আকুল হয়ে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করার জন্য বেরিয়ে পড়লেন।

 

 তাদের প্রসাধন অসমাপ্ত রয়ে গেল। তাদের কেউ কেউ অঙ্গের উপরিভাগের বস্ত্র নিম্নভাগে এবং নিম্নভাগের বস্ত্র উপরিভাগে পরিধান করে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লেন।

 

গােপীরা যখন ত্ৰস্তপদে তাদের আবাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাদের পতি, পিতা এবং ভ্রাতারা হতবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন তারা কোথায় যাচ্ছেন! তারা ছিলেন যুবতী স্ত্রী, তাই তাঁরা তাঁদের পতি, জ্যেষ্ঠভ্রাতা অথবা পিতার তত্ত্বাবধানে ছিলেন। 

 

তাদের অভিভাবকেরা তাদের শ্রীকৃষ্ণের কাছে যেতে নিষেধ করলেন। কিন্তু তারা সেই কথা শুনলেন না। কেউ যখন পূর্ণ কৃষ্ণভাবনায় শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট হন, তখন তিনি আর কোন রকম জাগতিক কর্তব্যের পরােয়া করেন না, তা সে যত জরুরীই হােক না কেন। কৃষ্ণভাবনার অমৃত এতই মধুর যে, তা সব রকমের জড় বন্ধন থেকে স্বস্তি দান করে।  

শ্রীল রূপ গােস্বামী একটি অপূর্ব সুন্দর শ্লোক রচনা করে গেছেন যেখানে একজন আরেক গােপীকে উপদেশ দিচ্ছেন, সখী, তুমি যদি সমাজ, আত্মীয়-স্বজনের স্নেহ এবং বন্ধুর ভালবাসা উপভােগ করতে চাও দয়া করে স্মিতমুখ কাছে যেও না, যিনি যমুনার তীরে দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজাচ্ছেন, পূর্ণচন্দ্রের আলােকে অধর ওষ্ঠ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।”

 

শ্রীল রূপ গােস্বামী প্রকারান্তরে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, শ্রীকৃষ্ণের মধুর হাস্যমণ্ডিত মুখচন্দ্রের সৌন্দর্যে যিনি আকৃষ্ট হয়েছেন, তার জড় সুখভােগের সমস্ত বাসনা বিনষ্ট হয়ে গেছে। এটাই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনায় প্রগতির লক্ষণ। যে মানুষ কৃষ্ণভাবনায় প্রগতি লাভ করেছেন, তিনি অবশ্যই সব রকমের জড়জাগতিক কার্যকলাপ এবং ইন্দ্রিয়তৃপ্তির প্রচেষ্টা বর্জন করেন।

 

কয়েকজন গােপী তাদের পতিদের দ্বারা প্রতিহত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য যেতে পারলেন না, তাদের পতিরা তাদের দরজা বন্ধ করে আটকে রাখলেন।

 

শ্রীকৃষ্ণের কাছে যেতে না পেরে তারা চোখ বন্ধ করে শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত রূপের ধ্যান করতে লাগলেন। তাদের মনের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের রূপ ইতিমধ্যে বিরাজমান ছিল।

 

এই সমস্ত গােপিকারাই হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ যােগী; যা বলা হয়েছে-যােগিনামপি সর্বেষাং শ্রদ্ধাবান্ ভজতে যাে মে যুক্ততমাে মতাে। যিনি সর্বক্ষণ প্রীতি সহকারে তার হৃদয়ে শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করেন এবং নিরন্তর শ্রদ্ধা সহকারে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করেন, তিনিই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ যােগী।

 

প্রকৃতপক্ষে, যােগী তার হৃদয়ে বিষ্ণুর ধ্যান করেন। তিনি যথার্থ শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত বিষ্ণুতত্ত্বের উৎস। তাই ধ্যানে মগ্ন, তারা হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ যােগী। সেই গােপীরা শ্রীকৃষ্ণের কাছে যেতে পারলেন না, তাই তাঁরা সিদ্ধ যােগীর মতাে হৃদয়ে তার ধ্যান করতে লাগলেন।

 

বদ্ধ অবস্থায় জীব দুই রকমের কর্ম করতে পারে—যে সমস্ত বদ্ধ জীব নিরন্তর পাপকর্মে রত, তারা সেই পাপের ফলে দুঃখ ভােগ করে এবং যারা পুণ্যকর্ম করে, তার ফলে তারা জড় সুখ করে। এই জড় দুঃখ বা জড় সুখ জড় প্রকৃতির প্রভাবে ভােগ হয়।

 

শ্রীকৃষ্ণের সহচরী গােপিকারা, যারা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য সমবেত হয়েছিলেন, বিভিন্ন গােষ্ঠীভুক্ত। অধিকাংশ গােপী শ্রীকৃষ্ণের নিত্য সহচরী। এই সম্বন্ধে ব্রহ্মসংহিতায় বলা প্রতিভাবিতাভি। অপ্রাকৃত জগতে শ্রীকৃষ্ণের সহচরেরা, বিশেষ করে গােপিকারা তাঁর হ্লাদিনীশক্তির শ্রীমতী রাধারাণীর প্রকাশ। 

 

কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ যখন এই জড় জগতে তার লীলাবিলাস করেন, তখন কেবল তার নিত্য সহচরেরাই নয়, যারা জড় স্তর থেকে সেই স্তরে উন্নীত হচ্ছেন, তারা তাঁর সেই লীলায় অংশগ্রহণ করার সুযােগ পান।

 

যে সমস্ত গােপিকারা এই জড় জগৎ থেকে শ্রীকৃষ্ণের লীলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন, তারা ছিলেন সাধারণ মানবী। তারা যদিও কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ থেকে থাকেন, নিরন্তর শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করার ফলে তাঁরা সেই কর্মফল থেকে পূর্ণরূপে মুক্ত হয়েছিলেন। 

 

শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে না পাওয়ার গভীর বেদনাময় আকুলতায় তারা সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়েছিলেন, এবং শ্রীকৃষ্ণের বিরহে তাঁর প্রতি তাঁদের অপ্রাকৃত প্রেমের আনন্দানুভূতি তাদের সব রকমের জড়জাগতিক পুণ্যকর্মের অতীত অপ্রাকৃত স্তরে উন্নীত করেছিল।

 

বদ্ধ জীবেরা পাপ অথবা পুণ্যের প্রভাবে জন্ম- মৃত্যুর বন্ধনে আবদ্ধ, কিন্তু গােপিকারা শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান শুরু করার ফলে সেই পাপ-পুণ্যের স্তর অতিক্রম করে সম্পূর্ণভাবে নির্মল হয়ে শ্রীকৃষ্ণের নিত্য সহচরী ব্ৰজগােপিকার পদ প্রাপ্ত হয়েছিলেন, যা হচ্ছে তাঁর হ্রাদিনীশক্তির প্রকাশ।

 

সমস্ত গােপিকারাই তাদের চিত্তে পরকীয়া প্রেমে শ্রীকৃষ্ণের চিন্তায় মগ্ন হয়েছিলেন, তার ফলে তারা জড় জগতের সব রকমের কর্মবন্ধনের কলুষ থেকে মুক্ত হয়েছিলেন এবং তাদের অনেকে তৎক্ষণাৎ জড়া প্রকৃতির তিন গুণের অধীন জড় দেহ পরিত্যাগ করে অপ্রাকৃত দেহ প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

 

যে সমস্ত গােপী রাসলীলায় শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সমবেত হয়েছিলেন, তাদের কথা পরীক্ষিৎ মহারাজ শুকদেব গােস্বামীকে বর্ণনা করতে শুনলেন। তিনি যখন শুনলেন যে, কয়েকজন গােপী কেবল শ্রীকৃষ্ণকে তাদের প্রণয়ীরূপে ধ্যান করার ফলে জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন মুক্ত হয়ে অপ্রাকৃত জগতে প্রবেশ করেছিলেন,

 

তিনি তখন জিজ্ঞাসা করলেন, “গােপীরা জানতেন না যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান।। তাদের কাছে তিনি ছিলেন কেবল একটি অপূর্ব সুন্দর বালক, যে ছিল তাদের প্রণয়ী। তা হলে কিভাবে তাকে কেবল তাদের প্রণয়ী বলে মনে করে তারা। জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছিলেন?”

 

 এখানে মনে রাখতে হবে, শ্রীকৃষ্ণ এবং সাধারণ জীব উভয়েই গুণগতভাবে এক। সাধারণ জীবও শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন অং শ হওয়ার ফলে ব্রহ্ম, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরব্রহ্ম। তা হলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভক্ত যদি কেবল শ্রীকৃষ্ণের কথা চিন্তা করেই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে,

 

যারা অন্যদের কথা চিন্তা করছে, তারাই বা কেন জড় জগতের বন্ধনমুক্ত হবে না? যেহেতু সমস্ত জীবই হচ্ছে ব্রহ্ম, তা হলে কেউ যদি তার পতি বা পুত্র বা অন্য কারাে কথা চিন্তা করে, তবে কেন তারা জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হবে না?

 

 এই প্রশ্নটি অত্যন্ত বিচক্ষণ, কেননা নাস্তিকেরা সব সময়ই শ্রীকৃষ্ণকে অনুকরণ করছে। এই কলিযুগে অনেক পাষন্ডই আছে যারা মনে করে যে, তারাও শ্রীকৃষ্ণের মতাে মহান এবং তারা জনসাধারণকে প্রতারণা করে প্রচার করে তারাই শ্রীকৃষ্ণ এবং তাদের কথা চিন্তা করা শ্রীকৃষণের কথা চিন্তা করারই সামিল। 

 

পরীক্ষিৎ মহারাজ এই রকম আসুরিক অনুকরণকারীদের অন্ধ অনুগামীদের ভয়ঙ্কর অবস্থা উপলব্ধি করে এই প্রশ্ন করেছিলেন এবং এই কথা শ্রীমদ্ভাগবতে লিপিবদ্ধ হয়েছে যাতে সরলচিত্ত মানুষেরা বুঝতে পারে যে, একজন সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করা এবং শ্রীকৃষ্ণের কথা চিন্তা করা এক নয়।

 

প্রকৃতপক্ষে, দেবতাদের কথা চিন্তা করাও শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে চিন্তা করার সমতুল্য নয়। বৈষ্ণবতন্ত্রে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে যে, কেউ যদি বিষ্ণু, নারায়ণ অথবা শ্রীকৃষ্ণকে দেব-দেবীদের সমপর্যায়ভুক্ত বলে মনে করে,

তা হলে সে হচ্ছে একটা পাষণ্ডী। পরীক্ষিৎ মহারাজের এই প্রশ্ন শুনে শুকদেব গােস্বামী উত্তর দিলেন, “হে রাজন, এই প্রশ্নের উত্তর এই ঘটনার বহু পূর্বে দেওয়া হয়েছে।”

 

যেহেতু পরীক্ষিৎ মহারাজ এই বিষয়ে সমস্ত সংশয় দূর করতে চেয়েছিলেন, তাই তার গুরুদেব অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তার উত্তর দিলেন, “যে বিষয়ে পুর্বেই বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেই সম্বন্ধে কেন তুমি আবার প্রশ্ন করছ? তুমি কেন পূর্ববর্ণিত বিষয় সম্বন্ধে বিস্মৃত হচ্ছ?” 

 

গুরুদেব সর্বদাই উচ্চতর পদে অধিষ্ঠিত, তাই এইভাবে শিষ্যকে শাসন করার অধিকার তার রয়েছে। শুকদেব গােস্বামী জানতেন যে, পরীক্ষিৎ মহারাজ তাকে এই প্রশ্ন করেছিলেন তার নিজের বােঝবার জন্য নয়, ভবিষ্যতের সরলচিত্ত মানুষেরা যাতে অন্য কোন মানুষকে শ্রীকৃষ্ণের সমতুল্য মনে না করে, সেই বিষয়ে সাবধান করে দেওয়ার জন্যই।

 

শুকদেব গােস্বামী তারপর পরীক্ষিৎ মহারাজকে শিশুপালের মুক্তির কথা মনে করিয়ে দিলেন। শিশুপাল সব সময়ই শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ ছিল এবং তার এই ঈর্ষার ফলে শ্রীকৃষ্ণ তাকে বধ করেছিলেন। 

 

যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান তাই তার হাতে নিহত হওয়ার ফলে শিশুপাল মুক্তিলাভ করেছিল। তাই এই রকম ঈর্ষাপরায়ণ একজন মানুষ যদি শ্রীকৃষ্ণকে শত্রুরূপে দর্শন করেও মুক্তিলাভ করে থাকে, তা হলে যে সমস্ত গােপীরা শ্রীকৃষ্ণের এত প্রিয় ছিলেন এবং যারা সর্বক্ষণ প্রেমভরে তার কথা চিন্তা করতেন,

 

তাদের অবস্থা সহজেই অনুমান করা যায়। শত্রু এবং বন্ধুর মধ্যে অবশ্যই কিছু পার্থক্য রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের শত্রুরা যদি জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে সাযুজ্য মুক্তি লাভ করে থাকে, তা হলে তার প্রতি অনুকুল ভাবাপন্ন গােপীরা নিশ্চয়ই মুক্তিলাভ করে তাঁর ধামে তার সেবাসুখ লাভ করেছিলেন।

ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণকে বলা হয়েছে হৃষীকেশ। শুকদেব গােস্বামীও শ্রীকৃষ্ণকে হৃষীকেশ বা পরমাত্মা বলে সম্বোধন করেছেন। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ হচ্ছে বদ্ধ জীবাত্মা এবং সে জড় দেহের আবরণে আচ্ছাদিত। শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীকৃষ্ণের দেহ অভিন্ন, কেননা তিনি হচ্ছেন হৃষীকেশ।

 

যে মানুষ শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীকৃষ্ণের দেহের মধ্যে পার্থক্য দর্শন করে, সে মহামূর্খ। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন হৃষীকেশ এবং অধােক্ষজ। এখানে পরীক্ষিৎ মহারাজ এই দু'টি শব্দের ব্যবহার করেছেন। হৃষীকেশ হচ্ছেন পরমাত্মা, এবং অধােক্ষজ হচ্ছেন এই জড়া প্রকৃতির অতীত পরমেশ্বর ভগবান। 

 

সাধারণ জীবকে কৃপা প্রদর্শন করে, তার অহৈতুকী কৃপার প্রভাবে, ভগবান তার স্বরূপ নিয়ে আবির্ভূত হন। দুর্ভাগ্যবশত, মুর্খ লােকেরা তাকে একজন সাধারণ মানুষ বলে ভুল করে এবং তার ফলে তারা নরকগামী হয়। শুকদেব গােস্বামী প্রতিপন্ন করলেন যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন অবিনশ্বর ভগবান, যাকে জড় জগতের কোন কলুষ স্পর্শ করতে পারে না।

 

শুকদেব গােস্বামী মহারাজ পরীক্ষিৎকে বলতে লাগলেন যে, শ্রীকৃষ্ণ কোনও সাধারণ মানুষ নন। তিনি হচ্ছেন সমস্ত গুণাবলীতে ভূষিত পরমেশ্বর ভগবান। 

 

তার অহৈতুকী কৃপার প্রভাবে তিনি তার নিত্য অপরিবর্তনীয় রূপ নিয়ে এই জড় জগতে আবির্ভূত হন। সেই কথা ভগবদগীতাতেও প্রতিপন্ন করা হয়েছে। সেখানে ভগবান বলেছেন যে, তিনি তাঁর যােগমায়ার প্রভাবে প্রকাশিত হন। জড়া প্রকৃতির অধীনে তিনি প্রকাশিত হন না।

 

এই জড় শক্তি তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন। ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে যে, তাঁরই অধ্যক্ষতায় জড়া প্রকৃতি পরিচালিত হচ্ছে। ব্রহ্মসং হিতাতেও প্রতিপন্ন হয়েছে যে, জড় শক্তি বা দুর্গা ভগবানের ছায়ারূপিণী এবং প্রাকৃত বস্তুর গতিবিধির ফলে যেমন ছায়ার গতিবিধি নির্ধারিত হয়, ঠিক তেমনই ভাবেই জড়া প্রকৃতি কার্য করছে।

 

 অর্থাৎ কেউ যদি শ্রীকৃষ্ণের রূপ, গুণ, ঐশ্বয, যশ, বীর্য, জ্ঞান, বৈরাগ্য অথবা কাম, ক্রোধ, ভয় অথবা স্নেহ এবং সখ্যের প্রভাবে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাঁর প্রতি অনুরক্ত হন, তা হলে তিনি যে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করবেন, সেই সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই।

 

ভগবদগীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ে পরমেশ্বর ভগবান বলেছেন যে, যারা কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার করেন, তারা তার অতি প্রিয়। শুদ্ধ কৃষ্ণভক্তি প্রচার করতে গিয়ে ভগবানের বাণীর প্রচারককে নানা রকম দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হতে হয়। কখনও কখনও তাদের দৈহিক লাঞ্ছনা ভােগ করতে হয় এবং কখনও তাদের মৃত্যু বরণ করতে হয়। 

 

শ্রীকৃষ্ণের জন্য তার ভক্তের গভীর তপস্যা বলেই শ্রীকৃষ্ণ তা মনে করেন। শ্রীকৃষ্ণ তাই বলছেন যে, তাঁর বাণীর প্রচারকেরা তাঁর অতি প্রিয়। 

 

শ্রীকৃষ্ণের শত্রুরাও যদি বৈরীভাবাপন্ন হয়ে শ্রীকৃষ্ণের কথা চিন্তা করার ফলে মুক্তিলাভ করতে পারে, তা হলে যারা শ্রীকৃষ্ণের এত প্রিয়, তাদের মুক্তি সম্বন্ধে ত কোন সংশয়ই থাকতে পারে না।

 

যে সমস্ত মানুষ এই জগতে কৃষ্ণভাবনার অমৃত প্রচার করছেন, সর্ব অবস্থাতেই তাদের মুক্তি অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এই ধরনের প্রচারকেরা কখনই মুক্তির আকাক্ষা করেন না, কেননা যারা কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করে ভগবানের প্রতি ভক্তিযুক্ত হয়েছেন, তারা ইতিমধ্যেই মুক্তিলাভ করেছেন।

 

 শুকদেব গােস্বামী তাই পরীক্ষিৎ মহারাজকে আশ্বাস দিলেন যে, যারা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন, তারা অবশ্যই এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হবেন, কেননা শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন যােগেশ্বর।

 

সমস্ত গােপীরা যখন শ্রীকৃষ্ণের সামনে সমবেত হলেন, তখন তিনি তাদের সাদরে আহ্বান করলেন এবং সেই সঙ্গে তাদের বাকচ্চাতুর্যের দ্বারা তাঁদের নিরাশ করতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম বক্তা; তিনি ভগবদগীতার বক্তা।

 

তিনি সর্বোচ্চ দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে কথা বলতে পারেন এবং যে সমস্ত গােপীরা তার প্রতি এত অনুরক্ত ছিলেন, তাদের সঙ্গেও তিনি কথা বললেন। তিনি তাদের বাকচ্চাতুর্যের দ্বারা তাঁদের মােহিত করতে চেয়েছিলেন এবং তাই তিনি তাদের বললেন, “হে ব্রজবধূগণ, তােমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যশালিনী এবং তােমরা আমার অতি প্রিয়।

 

 তােমরা যে এখানে এসেছ, সেই জন্য আমি খুব খুশি হয়েছি, এবং আমি আশা করি যে, বৃন্দাবনের সমস্ত সংবাদ শুভ। এখন তােমরা দয়া করে আমাকে আদেশ করাে, আমি তােমাদের জন্য কি করতে পারি? তােমরা কেন গভীর রাতে এখানে এসেছ? দয়া করে তােমরা আসন গ্রহণ করাে। এবং আমাকে বলাে আমি তােমাদের জন্য কি করতে পারি।”

 

গােপীরা এসেছিলেন শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গসুখ উপভােগ করবার জন্য, তার সঙ্গে নাচবার জন্য, তাকে আলিঙ্গন করবার জন্য এবং চুম্বন করবার জন্য, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ যখন এইভাবে শিষ্টাচার প্রদর্শন করে তাদের সাথে কথা বলতে লাগলেন,

 

তখন তারা অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। তিনি তাদের প্রতি এমনভাবে আচরণ করতে লাগলেন যেন তারা হচ্ছে সাধারণ ভদ্রমহিলা। 

 

তাই তারা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে লাগলেন এবং গভীর আগ্রহের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের এই সমস্ত কথা শুনতে লাগলেন। তিনি যখন দেখলেন যে, তারা তাকে নিয়ে হাসছে, তিনি তখন বললেন, “হে সখীরা, তােমাদের অবশ্যই জানা উচিত যে, এখন গভীর রাত্রি, এবং এই বন অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল।

 

এই সময় বাঘ, ভাল্লুক, শেয়াল, নেকড়ে ইত্যাদি সমস্ত হিংস্র পশুরা এই জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই তােমাদের পক্ষে অত্যন্ত এখানে কোন নিরাপদ স্থান তােমরা খুঁজে পাবে না।

 

তােমরা যেখানেই যাও না কেন, সেখানেই এই সমস্ত হিংস্র পশুরা তাদের শিকারের অন্বেষণে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই আমার মনে হয় যে, এই গভীর রাত্রে এখানে এসে তােমরা একটা মস্ত বড় ঝুঁকি নিয়েছ। এখনই আর দেরী না করে তােমরা ঘরে ফিরে যাও।”

 

শ্রীকৃষ্ণ যখন দেখলেন যে, গােপীরা তখনও হাসছেন, তিনি তখন তাদের বললেন, “তােমরা সকলেই অত্যন্ত সুন্দরী এবং তােমাদের এই সৌন্দর্যের প্রশংসা না করে আমি থাকতে পারছি না। তােমাদের সকলেরই কটিদেশ অত্যন্ত ক্ষীণ এবং তােমরা সকলেই সুমধ্যমা।”

 

সমস্ত গােপীরা ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী। তাই তাদের সৌন্দর্য বর্ণনা করে তাদের সুমধ্যমা বলা হয়েছে; স্ত্রীলােকদের কটিদেশ বা কোমর পাতলা হওয়াটা তাদের সৌন্দর্যের লক্ষণ এবং সেই ক্ষীণ কটিসম্পন্না স্ত্রীলােকদের সুমধ্যমা বলা হয়। 

 

শ্ৰীকৃষ্ণ তাঁদের বােঝালেন যে, তাদের সকলেরই বয়স কম এবং তাঁরা তাঁদের ভালমন্দ বিচার করতে পারেন না। তাই তাদের রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়ােজন। সুতরাং তারা যে এই গভীর রাত্রে শ্রীকৃষ্ণের কাছে ছুটে এসেছেন, সেটা খুব ভাল কাজ হয়নি। শ্রীকৃষ্ণ তাদের বললেন যে, তিনি একজন বালক তারা বালিকা।

 

তাই এই গভীর রাত্রে একজন বালকের সঙ্গে সেই বালিকাদের মিলন অবশ্যই নয়। শ্রীকৃষ্ণের এই উপদেশ শুনে গােপীরা বিশেষ খুশি হলেন না; তাই শ্রীকৃষ্ণ ভিন্নভাবে বােঝাতে লাগলেন। “হে প্রিয় সখীগণ, আমি বুঝতে পারছি যে, 

 

তােমরা তােমাদের অভিভাবকদের অনুমতি ছাড়াই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছ; তাই আমি বুঝতে পারছি তােমাদের মা, বাবা, পুত্র, কন্যা, ভাই এবং পতিরা তােমাদের জন্য উৎকষ্ঠিত হয়ে উঠেছেন। 

 

যতক্ষণ তােমরা এখানে আছ, তারা নিশ্চয় ততক্ষণে বিভিন্ন জায়গায় তােমাদের খুঁজে বেড়াবেন, এবং তাঁরা অন্তরে নিশ্চয়ই গভীর উদ্বেগ অনুভব করছেন। সুতরাং আর দেরি করাে না, তােমরা ঘরে ফিরে যাও এবং তাদের উৎকণ্ঠা দূর কর ।

 

 গােপীরা তখন শ্রীকৃষ্ণের এই অযাচিত উপদেশে বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ হলেন, তারা তখন অন্য দিকে তাকিয়ে বনের সৌন্দর্য দেখতে লাগলেন। সেই সময় সমস্ত বন চন্দ্রের জ্যোৎস্নায় আলােকিত হয়ে উঠেছিল, এবং প্রস্ফুটিত ফুলের উপর দিয়ে মৃদুমন্দ সমীরণ বইছিল, এবং তখন সবুজ গাছের পাতাগুলি কম্পিত হচ্ছিল।

 

তাদের বনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের উপদেশ দিতে লাগলেন, আমার মনে হয় তােমরা এই রাত্রে বৃন্দাবনের সৌন্দর্য দর্শন করতে এসেছ। তবে এখন নিশ্চয়ই তােমাদের তৃপ্তি হয়েছে। সুতরাং এখন তােমরা আর দেরি না করে ঘরে ফিরে যাও।

 

আমি জানি যে, তােমরা সকলেই অত্যন্ত সতী-সাধ্বী স্ত্রী। তাই, এখন যখন তােমরা বৃন্দাবনের সৌন্দর্য দর্শন করেছ, এবার আর দেরি না করে ঘরে ফিরে যাও এবং অনুগত স্ত্রীর মতাে তােমাদের পতিদের সেবা কর। 

 

যদিও তােমরা সকলেই খুব অল্পবয়সী, তবুও তােমাদের মধ্যে কেউ কেউ সন্তানের মা হয়েছ। তােমাদের সেই শিশু-সন্তানদের নিশ্চয়ই তােমরা ঘরে ফেলে এসেছ, আর তারা নিশ্চয়ই এখন কাঁদছে।

 

দয়া করে এক্ষুণি তােমরা ঘরে ফিরে যাও এবং তাদের তােমাদের বুকের দুধ দিয়ে শাস্ত কর। আমি এটাও বুঝতে পারছি যে, আমার প্রতি তােমাদের গভীর অনুরাগ রয়েছে, এবং সেই অনুরাগের বশবর্তী হয়ে আমার বংশীধ্বনি শুনে তােমরা এখানে এসেছ। আমার প্রতি তােমাদের এই প্রীতি এবং অনুরাগের ফলে আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছি। 

 

আমিই হচ্ছি পরমেশ্বর ভগবান। প্রতিটি জীবই হচ্ছে আমার বিভিন্ন অংশ এবং স্বাভাবিকভাবেই তারা আমার প্রতি অনুরক্ত। তাই আমার প্রতি তােমাদের এই অনুরাগের ফলে আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছি এবং সেই জন্য আমি তােমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।

 

 এখন তােমরা ঘরে ফিরে যাও। আরেকটা কথা আমাকে তােমাদের বলতে হবে, তা হচ্ছে, সরল চিত্তে পতির সেবা করাটাই হচ্ছে সাধ্বী স্ত্রীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম।

 

 পতির প্রতি বিশ্বস্ত হওয়াটাই স্ত্রীলােকের পক্ষে যথেষ্ট নয়, তাকে পতির বন্ধুদের প্রতি স্নেহশীলা হতে হবে, পতির পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীলা এবং তাদের বাধ্য হতে হবে এবং দেবরদের প্রতি স্নেহশীলা হতে হবে; এবং সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, স্ত্রীকে অবশ্যই তার সন্তানের দেখাশোনা করতে হবে।" 

 

এইভাবে কৃষ্ণ একজন স্ত্রীলােকের কর্তব্য সম্পর্কে উপদেশ দিলেন। পতিসেবার উপর জোর দিয়েও তিনি বললেন, “যদি তার চরিত্র ভাল নাও হয়, অথবা যদি তিনি অত্যন্ত ধনী বা সৌভাগ্যবান নাও হন অথবা তিনি যদি বৃদ্ধ এবং নানা রকম রােগের ফলে রুগ্ন ও দুর্বল হয়,

 

কোন স্ত্রীলােক যদি পারমার্থিক উন্নতি করতে চান, তা হলে তাকে কখনই তাঁর পতিকে ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত নয়, বা তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ হওয়া উচিত নয়। আর এ ছাড়া কোন স্ত্রীলােক যদি মিথ্যা আচরণ করে পরপুরুষের অন্বেষণ করে, তা হলে সেই আচরণকে সমাজে অত্যন্ত জঘন্য বলে গণ্য করা হয়। 

 

এই রকম আচরণ করলে কোন স্ত্রীলােক উচ্চতর লােকে উন্নীত হতে পারবে না এবং এই ধরনের জঘন্য কর্মের ফল অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। কোন বিবাহিতা স্ত্রীলােকের পরপুরুষের সঙ্গ করা উচিত নয়, 

 

বৈদিক শাস্ত্রে তা নিষিদ্ধ। তােমরা যদি মনে কর যে, তােমরা আমার প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত এবং সেই জন্য তােমরা আমার সঙ্গ করতে চাও, তা হলে আমি তােমাদের উপদেশ তােমরা আমার সঙ্গ উপভােগ করার চেষ্টা করাে না।

 

তােমাদের পক্ষে ঘরে ফিরে যাওয়াই শ্রেয় হবে এবং ঘরে ফিরে গিয়ে তােমরা কেবল আমার কথা চিন্তা কর, আমার কথা এবং তার ফলে নিরন্তর আমাকে স্মরণ করার মাধ্যমে এবং আমার নাম কীর্তন করার ফলে অবশ্যই অপ্রাকৃত স্তরে উন্নীত হবে। এইভাবে আমার কাছে আসার কোন প্রয়ােজন নেই।

 

দয়া করে তােমরা ঘরে ফিরে যাও।” এখানে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গােপীদের যা বললেন, তা তিনি পরিহাস করে বলেননি। 

 

সেটা ছিল তাদের প্রতি তার উপদেশ। সমস্ত সাধ্বী স্ত্রীলােকদের এই উপদেশগুলি অত্যন্ত গ্রহণ করা উচিত। পরমেশ্বর ভগবান এখানে সতীত্ব সম্বন্ধে বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। তাই যে স্ত্রীলােকেরা উচ্চতর জীবনে উন্নীত হতে চান, তাদের এই নির্দেশগুলি মেনে চলা অবশ্য কর্তব্য। 

 

শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত জীবের পরম প্রেমাস্পদ। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি যখন এই অনুরাগ বিকশিত হয়, তখন তা সমস্ত বৈদিক নির্দেশগুলি অতিক্রম করে তাদের অতীত হন।

 

গােপীদের পক্ষে তা সম্ভব হয়েছিল, কেননা তারা শ্রীকৃষ্ণের হয়ে তাকে দর্শন করেছিলেন। বদ্ধ অবস্থায় কোন পক্ষে তা সম্ভব নয়।

 

দুর্ভাগ্যবশত গােপীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের এই আচরণের অনুকরণ করে কখনও কখনও কোন পাষণ্ডী অদ্বৈতবাদ দর্শনের আশ্রয়ে শ্রীকৃষ্ণকে অনুকরণ করে, সরলচিত্ত স্ত্রীলােকদের প্রতারণা করে, ধর্মের নামে তাদের বিপথগামী করে, এই রাসলীলার অনুকরণ করে। 

 

সেই সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ এখানে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, গােপীদের পক্ষে যা সম্ভব হয়েছিল, সাধারণ স্ত্রীলােকদের পক্ষে তা সম্ভব নয়।

 

যদিও কোন কৃষ্ণভক্তি অনুশীলন করার ফলে ভক্তিমার্গে অনেক উন্নত স্তরে অধিষ্ঠিত হতে পারেন, কিন্তু কোন অবস্থাতেই যে সমস্ত প্রবঞ্চক বলে যে তারাই হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ, তাদের দ্বারা প্রলুব্ধ হওয়া উচিত নয়।

 

 তার কর্তব্য হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করে, শ্রীকৃষ্ণের দিব্য নাম কীর্তন করার মাধ্যমে অনুশীলন করা, যে সম্বন্ধে এখানে উপদেশ দেওয়া হয়েছে।

 

 যে সমস্ত মানুষ ভগবদ্ভক্তিকে অত্যন্ত লঘুভাবে গ্রহণ করেছে, তাদের বলা হয় সহজিয়া। কখনই এই সমস্ত সহজিয়াদের অনুগামী হওয়া উচিত নয়।

 

শ্রীকৃষ্ণ যখন এইভাবে গােপীদের নিরাশ করে উপদেশ দিতে লাগলেন, তখন অত্যন্ত দুঃখিত হলেন, কেননা তারা মনে করলেন যে, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে রাসলীলা উপভােগ করা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হবে না।

 

এইভাবে তাঁরা অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলেন। গভীর মর্মবেদনায় দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণের মুখের দিকে না তাকিয়ে, তারা মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং তাদের পায়ের আঙ্গুল দিয়ে তারা মাটির উপর নানা রকম নকশা আঁকতে লাগলেন।

 

তাদের চোখ দিয়ে দরদর ধারায় অশ্রু ঝরে পড়ছিল এবং তার ফলে মুখের সমস্ত প্রসাধন চোখের জলে ধুয়ে গিয়েছিল। তাদের চোখের জলের সঙ্গে বুকের কুমকুম মিশে গিয়ে মাটিতে ঝরে পড়তে লাগল। তারা শ্রীকৃষ্ণকে কিছুই বলতে পারলেন না, কেবল নিঃশব্দে অশ্রুপাত করতে করতে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁদের হৃদয় যে কত গভীরভাবে আহত হয়েছিল তাদের এই মৌনতার মাধ্যমেই তা প্রকাশ পেল।

 

গােপীরা সাধারণ ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে, তাঁরা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের সমপর্যায়ভুক্ত। তাঁরা ছিলেন তার নিত্য পার্ষদ। ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে যে, তারা হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তির প্রকাশ, এবং তার শক্তিরূপে তারা তার থেকে অভিন্ন। 

 

যদিও তারা শ্রীকৃষ্ণের কথায় অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন, তবুও তারা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি কোন কটুক্তি করতে চাননি। তবে শ্রীকৃষ্ণের এই নির্দয় বাক্যের জন্য তাঁরা তিরস্কার করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে কোন কটুক্তি করতে চাননি, কেননা শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন প্রিয়তম, তিনি ছিলেন প্রাণনাথ। 

 

তাদের সমস্ত হৃদয় জুড়ে কেবল শ্রীকৃষ্ণই ছিলেন। তার চরণে তারা সর্বতােভাবে নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে এই রকম নির্দয় বাক্য শুনে তারা তার উত্তর দিতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু সেই চেষ্টা করতে গিয়ে তাদের চোখ দিয়ে দরদর ধারায় ঝরে পড়তে লাগল।

 

অবশেষে স্বলিত কণ্ঠে তারা বলতে লাগল তুমি অত্যন্ত নির্দয়। এইভাবে কথা বলা তােমার উচিত নয়। আমরা সর্বতােভাবে তােমার কাছে আমাদের আত্মনিবেদন করেছি।

 

দয়া করে তুমি আমাদের গ্রহণ করাে, এবং রকম নির্দয়ভাবে কথা বলল না। আমরা জানি যে, তুমি হচ্ছ পরমেশ্বর ভগবান এবং তুমি তােমার যা ইচ্ছা তাই করতে পার, কিন্তু আমাদের প্রতি এই রকম নির্মমভাবে আচরণ করা তােমার শোভা পায় না। 

 

আমরা সব কিছু ফেলে দিয়ে তােমার কাছে ছুটে এসেছি, কেবল তােমার শ্রীপাদপদ্মে আশ্রয় গ্রহণ করার জন্য। আমরা জানি যে, তুমি হচ্ছ সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারাে।

 

কিন্তু আমরা আকুলভাবে তােমার কাছে প্রার্থনা করব, তুমি আমাদের দূরে ঠেলে দিও না। আমরা তােমার ভক্ত। নারায়ণ যেভাবে তার ভক্তদের গ্রহণ করেন, আমাদেরও ঠিক সেইভাবে গ্রহণ করা তােমার কর্তব্য। নারায়ণের অনেক ভক্ত আছেন, 

 

যাঁরা মুক্তিলাভের জন্য তার আরাধনা করেন, তিনিও তাদের মুক্তি দান করেন। তেমনই তােমার শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় ছাড়া আর কোন আশ্রয় যখন আমাদের নেই, তখন কিভাবে তুমি আমাদের পরিত্যাগ করতে পার?”

 

তারা বলতে লাগলেন, “হে প্রাণনাথ শ্রীকৃষ্ণ, তুমিই হচ্ছ পরম উপদেষ্টা। সেই সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। পতিদের প্রতি বিশ্বস্ত হওয়া, সন্তানদের প্রতি স্নেহপরায়ণা হওয়া, গৃহকার্যের তত্ত্বাবধান করা এবং গুরুজনদের বাধ্য হওয়া সম্বন্ধে স্ত্রীলােকদের যে উপদেশ তুমি দিয়েছ, তা শাস্ত্রের নির্দেশ।

 

কিন্তু আমরা জানি যে, তােমার শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করলে এই সমস্ত শাস্ত্র নির্দেশ আপনা থেকেই পালন হয়ে যায়। তুমি আছ বলেই আমাদের পতি, পুত্র, পিতা, মাতা, ভাই, বন্ধু সকলে আমাদের এত প্রিয়, কেননা তুমি হচ্ছ প্রতিটি জীবের পরমাত্মা।

 

তােমার উপস্থিতি বিনা সব কিছুই নিরর্থক। তুমি যখন দেহটা ছেড়ে চলে যাও, তৎক্ষণাৎ দেহটির মৃত্যু হয়। শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে মৃতদেহকে তৎক্ষণাৎ পুড়িয়ে ফেলা উচিত অথবা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া উচিত।

 

তাই এই জগতে তুমিই হচ্ছ প্রিয়তম। তােমাকে আমাদের বিশ্বাস এবং প্রেম অর্পণ করার ফলে আর পতি, পুত্র, পিতা, মাতা, ভাই, বন্ধু—এদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই।

 

কোন স্ত্রী যখন তােমাকে পরম পতিরূপে বরণ করে, তখন আর তার দেহের সম্পর্কে সম্পর্কিত পতির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার মতাে, তােমার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আর কোন সম্ভাবনা থাকে না।

 

আমরা যদি তােমাকে আমাদের পরম পতিরূপে গ্রহণ করি, তা হলে তােমার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার, অথবা বিধবা হওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তুমিই হচ্ছ নিত্য পতি, নিত্য পুত্র, নিত্য সখা, এবং নিত্য প্রভু, এবং কেউ যখন তােমার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়,

 

তখন সে নিত্য আনন্দ লাভ করে। যেহেতু তুমিই হচ্ছ সমস্ত ধর্মতত্ত্বের মুল শিক্ষক, তাই সর্বপ্রথমে তােমার শ্রীপাদপদ্মের আরাধনা করতে হবে। তাকেই শাস্ত্রে বলা হয় আচার্য-উপাসনা। তােমার শ্রীপাদপদ্মের আরাধনাই হচ্ছে সমস্ত ধর্মের মূল তত্ত্ব। 

 

আর তা ছাড়া ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে যে, তুমিই হচ্ছ একমাত্র ভােক্তা, তুমিই হচ্ছ একমাত্র প্রভু, এবং তুমিই হচ্ছ একমাত্র সখা। আমরা তথাকথিত সমস্ত পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, সমাজ-সংসার সব কিছু ফেলে দিয়ে তােমার কাছে এসেছি, এখন তুমিই আমাদের ভােক্তা হও।

 

 আমরা নিত্যকাল তােমার ভােগ্য হতে চাই। আমাদের সমস্ত মালিকানা এখন তােমার, কেননা সেটা তােমার স্বাভাবিক অধিকার। এখন তুমি আমাদের পরম সখা হও কেননা স্বাভাবিকভাবে তুমি হচ্ছ তাই।  


তারপর গােপীরা কমলাক্ষ শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, “বহুকাল ধরে যে আমরা তােমাকে আমাদের পতিরূপে পাওয়ার বাসনা করেছি, দয়া করে তুমি তা ব্যর্থ করাে না।

 

যে কোনও বুদ্ধিমান মানুষ, যে তার যথার্থ স্বার্থ সম্বন্ধে সচেতন, সে তার অন্তরের সমস্ত ভালবাসা তােমাতে অর্পণ করে। যে সমস্ত মানুষ মায়ার দ্বারা মােহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে, যারা মায়ার কুহেলিকার পিছনে ছুটে আনন্দ লাভের ব্যর্থ প্রয়াস করছে, তারাই কেবল তােমাকে ছাড়া আনন্দ উপভােগ করতে চায়। 

 

তথাকথিত পতি, পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, ভাই, বন্ধু—এরা সকলেই দুঃখের কারণ। তথাকথিত পিতা, মাতা, পতি, পুত্র, ভাই, বন্ধু—এদের এই জড় জগতে কেউই কোনদিন সুখী হতে পারেনি। যদিও পিতা-মাতার কর্তব্য হচ্ছে সন্তানদের পালন করা, তবুও বহু শিশু খাদ্য ও আশ্রয়ের অভাবে দুঃখ ভােগ করছে। 

 

অনেক ভাল ভাল চিকিৎসক থাকা সত্ত্বেও কারও যখন মৃত্যু হয়, তখন এই সমস্ত চিকিৎসকরা তাকে বাঁচাতে পারে না। আত্মরক্ষার নানা রকম আয়ােজন করা হয়েছে, কিন্তু কারও যখন সর্বনাশ করা হয়,

 

তখন আত্মরক্ষার এই সমস্ত আয়ােজনগুলি তাকে রক্ষা করতে পারে না; এবং তুমি যদি রক্ষা না করাে, তা হলে এই সমস্ত তথাকথিত রক্ষার আয়ােজনগুলি কেবল নিরন্তর দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, 

 

তাই তােমার কাছে আবেদন করছি, হে ঈশ্বরের ঈশ্বর, তােমাকে আমাদের পরম পতিরূপে লাভ করার বাসনাকে তুমি নিরাশ করাে না।

 

শ্রীকৃষ্ণ, আমরা স্ত্রীজাতি, তাই গৃহকাজে ব্যস্ত থাকলে আমাদের হৃদয় স্বাভাবিকভাবেই তৃপ্ত হয়, কিন্তু আমাদের সেই হৃদয় ত তুমি চুরি করে নিয়ে গেছ।

 

তাই আর আমরা গৃহকর্মে লিপ্ত হতে পারি না। আর তা ছাড়া তুমি আমাদের বারবার বলছ ঘরে যাওয়ার জন্য, সেটা খুবই উপযুক্ত উপদেশ, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমরা নিশ্চল হয়ে পড়েছি।

 

তােমার কাছ থেকে এক পা দুরে সরে যাওয়ার আমাদের নেই। তাই তােমার যদিও আমরা ঘরে ফিরে যেতে চাই হলেও বা সেই ক্ষমতা আমাদের কোথায়?

 

তােমাকে ছাড়া কিছু করার ক্ষমতা আর আমাদের নেই। স্ত্রীরূপে গৃহকার্যে যুক্ত। হওয়ার পরিবর্তে আমাদের হৃদয়ে অন্য এক ধরনের কামের উদয় হয়েছে, যা আমাদের হৃদয়কে নিরন্তর দগ্ধ করছে।

 

তাই এখন আমরা তােমাকে অনুরােধ করছি, প্রিয় কৃষ্ণ, তােমার সুমধুর হাস্য এবং তােমার মুখনিঃসৃত দিব্য শব্দতরঙ্গের দ্বারা তুমি সেই অগ্নিকে নির্বাপিত কর।

 

তুমি যদি আমাদের এইভাবে কৃপা করতে সম্মত না হও, তা হলে অবশ্যই আমরা এই বিরহ বেদনার অগ্নিতে দগ্ধ হবে। তখন তােমার কথা চিন্তা করতে করতে আমরা দেহত্যাগ করব। তা হলে নিশ্চয়ই পরজন্মে আমরা তােমার শ্রীপাদপদ্মে স্থান পাব।

 

প্রিয় শ্রীকৃষ্ণ, তুমি যদি বল যে, আমাদের কামনার অগ্নি প্রশমিত হবে, তা হলে আমরা তােমাকে শুধু এইটুকুই জানিয়ে দিতে পারি যে, সেটা আর সম্ভব নয়।

 

পূর্বে এক সময় তুমি এই বনে আমাদের উপভােগের সুযােগ দিয়েছিলে এবং আমাদের পয়েধর স্পর্শ করেছিলে। আমরা তাকে তােমার আশীর্বাদ বলে গ্রহণ করেছিলাম, ঠিক যেমন বৈকুণ্ঠলােকে লক্ষ্মীদেবীরা মনে করেছিলেন।

 

তােমার দ্বারা তাদের উপভােগ হওয়ার পরে সেই দিব্য স্বাদ আস্বাদন করার পর, আমাদের কামের তৃপ্তিসাধনের জন্য তােমাকে ছাড়া আর কারাে কাছে যাওয়ার স্পৃহা নেই। 

 

প্রিয় শ্রীকৃষ্ণ, স্বর্গের দেবতারা নিরন্তর লক্ষ্মীদেবীর পদযুগলের আরাধনা করেন, অথচ সেই লক্ষ্মীদেবী বৈকুণ্ঠলোকে সর্বদাই তােমার বক্ষলগ্না। 

 

তুলসীদলের দ্বারা আচ্ছাদিত তােমার শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় লাভ করার জন্য তিনি কঠোর তপস্যা করেছিলেন। 

 

তােমার শ্রীপাদপদ্মই হচ্ছে তােমার সেবকদের যথার্থ আশ্রয়, এবং সৌভাগ্যের অধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীদেবী তােমার বক্ষলগ্না হয়ে না থেকে তােমার শ্রীপাদপদ্মের আরাধনা করার জন্য নেমে আসেন। 

 

 আমরা এখন তােমার সেই শ্রীপাদপদ্মের ধূলিকণায় অধিষ্ঠিত হয়েছি, দয়া করে তুমি আমাদের প্রত্যাখ্যান করাে না, কেননা আমরা সর্বতােভাবে তােমার চরণে সমর্পিত আত্মা। 

 

"প্রিয় শ্রীকৃষ্ণ, তােমার আরেক নাম হরি। সমস্ত জীবের বিশেষ করে যারা তাদের গৃহ এবং পরিবার-পরিজনের প্রতি সমস্ত আসক্তি বর্জন করে সম্পূর্ণরূপে তােমার আশ্রয় গ্রহণ করেছে, তাদের সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা তুমি হরণ করাে।

 

তােমার সেবায় সর্বতােভাবে নিজেদের উৎসর্গ করার জন্য আমরা আমাদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি, আমরা কেবল তােমার সেবাদাসীরূপে তােমার সেবায় যুক্ত হতে প্রার্থনা করছি। 

 

আমরা চাই না যে, তুমি আমাদের তােমার পত্নীরূপে গ্রহণ করাে। তােমার দাসীরূপেই কেবল তুমি আমাদের গ্রহণ করাে। যেহেতু তুমি হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবান এবং পরকীয়া রস আস্বাদন করতে উৎসুক এবং যেহেতু তুমি হচ্ছ অপ্রাকৃত লম্পট,

 

 তাই তােমার সেই অপ্রাকৃত বাসনা চরিতার্থ করবার জন্য আমরা এসেছি, আমরা আমাদের তৃপ্তি লাভেরও অভিলাষী, কেননা তােমার হাস্যোজ্জ্বল মুখ দর্শন করে আমরা অত্যন্ত কামাতুর হয়ে পড়েছি।

 

নানা রকম সাজসজ্জা এবং অলঙ্কারে ভূষিত হয়ে আমরা তােমার সামনে এসেছি, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি আমাদের আলিঙ্গন করছ, ততক্ষণ আমাদের সাজসজ্জা এবং অঙ্গসৌষ্ঠব অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তুমিই হচ্ছ পরম পুরুষ, এবং পুরুষভূষণরূপে তুমি যদি আমাদের অঙ্গসজ্জাকে পূর্ণ করাে, তা হলে আমাদের সমস্ত বাসনা এবং দেহের সৌন্দর্য পূর্ণ হবে।।

 

"প্রিয় শ্রীকৃষ্ণ, তিলক এবং কর্ণভূষণে ভূষিত কেশরাজি পরিবেষ্টিত এবং মধুর হাস্যমণ্ডিত তােমার অপূর্ব সুন্দর মুখমণ্ডল দর্শন করে আমরা মােহিত হয়ে তােমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি, শুধু তাই-ই নয়, সর্বদাই সমর্পিত আত্মাকে অভয় দান করে তােমার যে বাহুযুগল, আমরা তার দ্বারাও আকৃষ্ট হয়েছি।

 

 নিরন্তর সৌভাগ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মীকে আলিঙ্গন করে যে বক্ষ, আমরা তার দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছি, তবে আমরা সৌভাগ্যের অধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীদেবীর স্থান অধিকার করতে চাই না। আমরা কেবল তােমার দাসীরূপে তােমার সেবা করতে পারলেই সন্তুষ্ট হব। 

 

যদি তুমি বল যে, আমরা বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করছি, তা হলে আমরা কেবল তােমাকে জিজ্ঞাসা করব এই ত্রিজগতে কি এমন কোন স্ত্রী আছে যে তােমার রূপে এবং তােমার অপ্রাকৃত বাঁশির সুরে মােহিত হয়নি? তােমার কাছে স্ত্রী এবং পুরুষের কোন ভেদ নেই,

 

কেননা প্রতিটি জীবই হচ্ছে তােমার তটস্থা শক্তি বা তােমার প্রকৃতি-জাত। প্রকৃতপক্ষে, কেউই পুরুষ বা ভােক্তা নয়, সকলেই তােমার ভােগ্য। এই ত্রিভুবনে এমন কোন স্ত্রী নেই যে তােমার এই কন্দর্পকোটি কমনীয় রূপে আকৃষ্ট হয়ে তার সতীত্ব বজায় রাখতে পারে।

 

তােমার এই রূপে কেবল মানুষেরাই আকৃষ্ট হয় না—গাভী, পশু-পক্ষী এমন কি বৃক্ষ, লতা, গুল্ম, ফল, ফুল সকলেই মােহিত হয়, আর আমাদের কথা কি বলব?

 

বিষ্ণু সর্বদাই অসুরদের আক্রমণ থেকে দেবতাদের রক্ষা করেন, তাই তুমি এই বৃন্দাবনে আবির্ভূত হয়েছ নানা রকম দুঃখ-দুর্দশা থেকে ব্রজবাসীদের রক্ষা করবার জন্য।

 

হে দীনবন্ধু, কৃপা করে তুমি আমাদের তপ্ত উরসিজে এবং আমাদের মাথায় তােমার হাত রাখাে, কেননা তােমার নিত্য দাসীরূপে আমরা তােমার কাছে নিজেদের সমর্পণ করেছি।

 

তুমি যদি মনে করাে যে, আমাদের তপ্ত উরসিজে তােমার করকমল স্থাপন করলে তা দন্ধ হবে, তা হলে আমরা তােমাকে আশ্বাস দিচ্ছি যে, বেদনার পরিবর্তে তােমার করকমল সুখ অনুভব করবে, ঠিক যেমন কোমল পদ্মফুল প্রচণ্ড সূর্যের তাপ উপভােগ করে থাকে।

 

এই আকুল আবেদন শুনে, পরমেশ্বর ভগবান হাসতে লাগলেন, এবং গােপীদের প্রতি অত্যন্ত কৃপাপরবশ হয়ে, পরমেশ্বর ভগবান বললেন, যদিও তিনি আত্মারাম, তাদের বাসনা অনুসারে তাদের আলিঙ্গন করতে লাগলেন, এবং চুম্বন করতে লাগলেন। 

 

স্মিতহাস্যে শ্রীকৃষ্ণ যখন গােপীদের দিকে তাকালেন, তখন তাদের মুখমণ্ডল শতগুণ সৌন্দর্যমণ্ডিত হল। মাঝে তিনি যখন তাদের উপভােগ করছিলেন, তখন তাকে দেখে মনে হল যেন লক্ষ লক্ষ তারকা পরিবৃত পূর্ণচন্দ্র। 

 

এইভাবে পরমেশ্বর ভগবান শত শত পরিবৃত হয়ে এবং নানা রঙের ফুলমালায় ভূষিত হয়ে সেই বৃন্দাবনের বনে ভ্রমণ করতে লাগলেন। কখনও তিনি এককভাবে গান গাইছিলেন, আবার কখনও কখনও তিনি গােপিকাদের সঙ্গে গান গাইছিলেন।

 

এইভাবে পরমেশ্বর ভগবান এবং গােপিকারা স্নিগ্ধ বালুকা আচ্ছাদিত যমুনার তটে এসে উপস্থিত হলেন যেখানে কুমুদ, এবং পদ্মফুল ফুটে ছিল। সেই দিব্য পরিবেশে শ্রীকৃষ্ণ এবং গােপিকারা পরস্পরকে উপভােগ করতে লাগলেন।

 

তারা যখন যমুনার তীরে ভ্রমণ করছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ তখন তার বাহুযুগল দিয়ে কোন গােপিকার মস্তক, বক্ষ অথবা কটিতট বেষ্টন করছিলেন। পরস্পরকে স্পর্শ করে, পরস্পরকে পরিহাস করে এবং পরস্পরকে দর্শন করে, তারা মহা আনন্দ উপভােগ করতে লাগলেন।

 

 শ্রীকৃষ্ণ যখন গােপিকাদের দেহ স্পর্শ করলেন, তখন তাদের আলিঙ্গন করার বাসনা অত্যন্ত তীব্র হয়ে উঠল, তাঁরা সকলেই এই লীলাবিলাস উপভােগ করলেন। এইভাবে পরমেশ্বর ভগবান গােপীদের কৃপা প্রদর্শন করলেন কেননা তারা সর্বতােভাবে জড় কামের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে তার সঙ্গসুখ উপভােগ করতে চেয়েছিলেন।

 

অচিরেই গােপীরা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গলাভ করার এই সৌভাগ্য অর্জন করে গর্ব অনুভব করতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণ, যার আরেক নাম কেশব, তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলেন যে, সঙ্গসুখ লাভ করার পরম সৌভাগ্য অর্জন করে গােপিকারা গর্বিত হয়েছেন এবং তাদেরকে তার অহৈতুকী কৃপা প্রদর্শন করবার জন্য এবং তাদের গর্ব খর্ব করার জন্য,

 

তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর পরম বৈরাগ্য প্রদর্শন করে সেখান থেকে অন্তর্হিত হয়ে গেলেন। পরমেশ্বর ভগবান সর্বদাই ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ, এখানে বৈরাগ্যরূপী ঐশ্বর্য আমরা দর্শন করতে পারি। এই বৈরাগ্য প্রতিপন্ন করে যে তিনি সর্বতােভাবে অনাসক্ত। তিনি সর্বদাই আত্মারাম এবং কোন কিছুর জন্য তাকে কারাে উপর নির্ভর করতে হয় না। এই স্তরে তাঁর দিব্যলীলা সম্পন্ন হয়েছিল।

 

 

আরও পড়ুন

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
৩২. অক্রুরের বৃন্দাবনে আগমন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন