অঘাসুর বধ-কৃষ্ণলীলা কাহিনী-শ্রীমদ্ভাগবত


কৃষ্ণলীলা

অঘাসুর বধ-কৃষ্ণলীলা

 
একদিন শ্রীকৃষ্ণ বনে প্রাতঃকালীন ভোজন সম্পাদন করবার ইচ্ছায় খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে, মধুর স্বরে তাঁর শিঙ্গা বাজিয়ে গোপসখাদের ঘুম ভাঙলেন এবং গোবৎসদের  সামনে নিয়ে বৃন্দাবনের বনের দিকে যাত্রা করলেন। 
 
এইভাবে কৃষ্ণ তাঁর হাজার হাজার বন্ধুদের একত্রিত করে বনভোজনে চললেন। তাদের সকলেরই হাতে ছিল লাঠি, বাঁশি, শিঙ্গা এবং খাবারের থলি। তাদের প্রত্যেকে হাজার হাজার গোবৎস তত্ত্বাবধান করছিল। 
 
 
এই বনভোজনের সম্ভাবনায় তারা সকলেই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। তাদের প্রত্যেকেই তাদের নিজেদের গো-বৎসদের যত্ন সহকারে রক্ষণাবেক্ষণ করছিল। 
 
তাদের অঙ্গ নানা রকম স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত ছিল এবং খেলাচ্ছলে তারা ফুল, পাতা, মঞ্জরী, ময়ূরের পালক এবং গেরুমাটি বনের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে বিভিন্নভাবে নিজেদের সাজাচ্ছিল। বনপথে চলতে চলতে একটি বালক অপর এক বালকের খাবারের পুঁটলি চুরি করে অপর একটি বালককে দিল। 
 
যার খাবারের পুঁটলি চুরি হয়েছে, সে যখন তা জানতে পেরে সেটা নেবার চেষ্টা করল, তখন সেই বালকটি পুঁটলিটি অন্য একটি বালককে ছুঁড়ে দিল। এইভাবে তারা খেলা করে শিশুসুলভ আনন্দ উপভোগ করতে লাগল।

কৃষ্ণ যখন কোন বিশেষ দৃশ্য দেখবার জন্য অনেকটা এগিয়ে যেতেন, তখন তাঁর অনুবর্তী বালকেরা কে তাঁকে প্রথম ছুঁতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে তাঁর দিকে ছুটে যেত। এইভাবে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হত। 
 
কেউ বলত, “আমি কৃষ্ণকে প্রথমে ছোঁব”, অন্য কেউ বলত, “না তুমি পারবে না, আমি প্রথম কৃষ্ণকে ছোঁব।” কেউ তাদের বাঁশি বাজাত আবার কেউ মোষের শিঙের তৈরি শিঙ্গা বাজাত। 
 
তাদের মধ্যে কেউ আবার আনন্দে অধীর হয়ে বনের ময়ুরদের অনুসরণ করত এবং কোকিলের ডাক অনুকরণ করত। আকাশে উড়ন্ত পাখিদের ছায়া অনুসরণ করে তারা সেই পাখির গতিপথের অনুবর্তী হত। 
 
কেউ আবার বাঁদরের কাছে গিয়ে নিঃশব্দে তাদের পাশে গিয়ে বসত। কেউ আবার নৃত্যরত ময়ূরের অনুকরণ করত। কেউ বাঁদরের লেজ ধরে তাদের সঙ্গে খেলা করত। বাঁদর যখন মুখ ভ্যাংচাত, তখন তারা তার অনুকরণ করে ঠিক সেইভাবেই তাকে ভ্যাংচাত। 
 
যমুনার তীরে ব্যাঙগুলিকে দেখে কেউ তাদের দিকে ছুটে যেত এবং ভয় পেয়ে ব্যাঙগুলি যখন জলে ঝাঁপ দিত, তখন তারাও তাদের অনুকরণে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ত। 
 
তারপর জল থেকে উঠে এসে তারা নিজেদের প্রতিবিম্বকে দেখে নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করত এবং খুব মজা পেয়ে হাসত। কোন শুকনো কুয়োয় গিয়ে তারা উচ্চস্বরে শব্দ করত, তাতে প্রতিধ্বনি হত এবং প্রতিধ্বনির প্রতি ভর্ৎসনা করে তারা আনন্দ উপভোগ করত।

ভগবদগীতায় পরমেশ্বর ভগবান নিজেই বলেছেন যে, পরমার্থ প্রয়াসীরা তাঁদের প্রপত্তি অনুসারে তাঁকে ব্রহ্ম, পরমাত্মা এবং পরমেশ্বর ভগবান রূপে জানতে পারেন, এখানে সেই উক্তির সত্যতা প্রতিপন্ন হচ্ছে। 
 
নির্বিশেষবাদী জ্ঞানীরা শ্রীকৃষ্ণের দেহনির্গত রশ্মিচ্ছটা ব্রহ্মজ্যোতি দর্শন করে সেটাকেই পরম সুখ বলে মনে করে। তাঁর ভক্তদের কাছে তিনি তাঁর পরমেশ্বর ভগবানরূপ প্রকাশ করেন। আর যারা তাঁর বহিরঙ্গা শক্তি মায়ার প্রভাবে আচ্ছন্ন, তারা তাঁকে কেবল একটি সুন্দর নরশিশু বলেই মনে করে। 
 
আর তিনি গোপবালকদের সঙ্গে খেলা করে তাঁদের দিব্য আনন্দ দান করেছিলেন। তাদের পূর্বজন্মের অর্জিত পুঞ্জীভূত পুণ্যরাশির প্রভাবে তারা এইভাবে পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে খেলা করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিল। 
 
এই ব্রজবাসীদের সৌভাগ্যের হিসাবনিকাশ কে করতে পারে?  তাঁরা প্রত্যক্ষভাবে পরমেশ্বর ভগবানকে দর্শন করেছিলেন, যাঁর দর্শন যোগীরা কঠোর তপস্যা করেও পান না, যদিও তিনি সকলেরই হৃদয়ে বিরাজ করছেন। 
 
এই সত্য ব্রহ্মসংহিতাতেও প্রতিপন্ন হয়েছে। বেদ ও উপনিষদের পাতায় এই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে কেউ খুঁজতে পারে, কিন্তু কেউ যদি ভগবানের ভক্তের সঙ্গ করার সৌভাগ্য লাভ করে, তা হলে তিনি প্রত্যক্ষভাবে পরমেশ্বর ভগবানকে দর্শন করতে পারেন। 
 
পূর্বজন্মের সঞ্চিত বহু পূণ্যরাশির ফলে গোপবালকেরা কৃষ্ণকে প্রত্যক্ষভাবে দর্শন করে বন্ধুর মতো তাঁর সঙ্গে খেলা করছিল। তারা জানত না যে, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। কিন্তু তাঁর প্রতি গভীর ভালবাসায় মগ্ন হয়ে তারা তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো খেলা করছিল।

শ্রীকৃষ্ণ যখন তাঁর সখাদের সঙ্গে বাল্য লীলাবিলাস করছিলেন, তখন অঘাসুর নামক একটি অসুর কৃষ্ণকে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে দেখে অধৈর্য হয়ে তাদের সকলকে হত্যা করতে মনস্থ করল। 
 
অঘাসুর এত ভয়ঙ্কর ছিল যে, স্বর্গের দেবতারা পর্যন্ত তাকে ভয় পেত। স্বর্গের দেবতারা যদিও অমৃত পান করে তাদের আয়ু ও বল বৃদ্ধি করেছে, কিন্তু তারও এই অঘাসুরের ভয়ে ভীত ছিল এবং তারা ভাবত, “কবে এই অসুরটার মৃত্যু হবে?” 
 
স্বর্গলোকবাসীরা অমরত্ব লাভ করবার জন্য অমৃত পান করে, কিন্তু তাদের অমরত্ব সম্বন্ধে তাদের পূর্ণ আস্থা নেই। পক্ষান্তরে, যে সমস্ত বালকেরা কৃষ্ণের সঙ্গে খেলা করছিল, তারা সেই অসুরটাকে মোটেই ভয় পেল না। 
 
তারা ছিল সম্পূর্ণভাবে নির্ভীক। মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবার সব রকম জড় আয়োজন-গুলিই অনিশ্চিত। কিন্তু কেউ যদি কৃষ্ণের শরণাগত হয়, ত হলে অমরত্ব সম্পর্কে তার কোন সংশয় থাকে না।

অঘাসুর, কৃষ্ণ এবং তাঁর বন্ধুদের সামনে এসে উপস্থিত হল। সে ছিল পূতনা এবং বকাসুরের ছোট ভাই। সে ভাবল “কৃষ্ণ আমার ভাই এবং বোনকে হত্যা করেছে। এখন আমি তার সখা এবং গোবৎসসহ তাকে হত্যা করব।” 
 
অঘাসুর কংসের দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিল, তাই খুব দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সে এসেছিল। অঘাসুর ভাবছিল, যখন সে তার ভাইয়ের উদ্দেশ্যে শস্য ও জল অর্পণ করবে এবং সমস্ত গোপবালকসহ কৃষ্ণকে হত্যা করবে, তখন আপনা থেকেই সমস্ত ব্রজবাসীরা মারা যাবে। 
 
সাধারণত গৃহস্থদের কাছে শিশুরাই হচ্ছে জীবন। যখন শিশুদের মৃত্যু হয়, তখন তাদের প্রতি গভীর স্নেহবশত তাদের পিতা-মাতারাও প্রাণত্যাগ করেন।

এইভাবে সমস্ত ব্রজবাসীদের হত্যা করার সংকল্প করে মহিমা সিদ্ধি নামক সিদ্ধির প্রভাবে যোগী নিজেকে তার ইচ্ছা অনুসারে বিরাট আকার ধারণ করতে পারে। অঘাসুর সেই যোগ সিদ্ধির প্রভাবে ৮ মাইল লম্বা একটি বিশাল আকৃতি অজগর সাপের রূপ ধারণ করল। 
 
এই অদ্ভাত আকৃতি ধারণ করে সে যখন তার মুখব্যাদান করল, তখন তা দেখে মনে হল সেটা যেন একটা পর্বতের গুহা। কৃষ্ণ এবং বলরাম সহ সমস্ত বালকদের গ্রাস করার আশায় সে পথের উপর শয়ন করে রইল।

সেই বিশাল আকৃতি অজগর সাপের রূপ ধারণ করে যখন সে তার মুখ হাঁ করল, তখন তার অধর এবং ওষ্ঠ আকাশ ও মাটিতে স্পর্শ করে রইল। তার মুখবিবর দেখে মনে হল যেন একটা অন্তর্হীন পাহাড়ের গুহা। 
 
তার জিহ্বাকে মনে হল যেন এক বিস্তীর্ণ পথ। তার নিঃশ্বাস ছিল প্রচন্ড ঝড়ের মতো আর তার চোখ দু’টো ছিল জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ডের মতো। প্রথমে বালকেরা মনে করল যে, সেটা মুখ হাঁ করে রাস্তার উপর পড়ে থাকা একটা বিশাল সাপের মতো। 
 
বালকেরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, “মনে হচ্ছে এটা যেন বিরাট একটা সাপ, আমাদের গিলে খাওয়ার জন্য এইভাবে এখানে শুয়ে আছে। দেখ, আমাদের খাওয়ার জন্য ও কেমন মুখটা হাঁ করে রয়েছে!”

তাদের মধ্যে একজন বলল, “হ্যা, তুমি যা বলছ তা ঠিক, এর ওষ্ঠতা যেন সূর্যকিরণে রঞ্জিত মেঘমন্ডলের মতো আর এর অধর ভূমিতে প্রতিবিম্বিত রক্তিম আভাযুক্ত সূর্যরশ্মির মতো। 
 
এর মুখের ডান এবং বাঁ দিকটা দেখ, এর মুখটা দেখে মনে হচ্ছে যেন একটা বিরাট পাহাড়ের গুহা যার উচ্চতা মাপা যায় না। এর তীক্ষ্ম দাঁতগুলো পাহাড়ের চূড়ার মতো। 
 
এই বিস্তৃত ও দীর্ঘ পথটি হচ্ছে এর জিহ্বা আর মুখবিবর পর্বতের গুহার মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন। দাবানলের মতো উষ্ণ বায়ু হচ্ছে এর নিঃশ্বাস এবং এর মুখ থেকে যে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে সেটা তার উদরস্থ প্রাণীসমুহের গলিত মাংসের গন্ধ।”

তারপর তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল, “আমরা সকলে যদি একসঙ্গে এই মহাসর্পের মুখে প্রবেশ করি, তা হলে কিভাবে ও আমাদের গিলে খাবে? আর যদিও আমাদের সকলকে একসঙ্গে গিলে ফেলে তবুও কৃষ্ণকে গিলতে পারবে না। কৃষ্ণ তক্ষণি ওকে মেরে ফেলবে, ঠিক যেমন বকাসুরকে মেরেছিল।” 
 
এইভাবে কথা বলতে বলতে তারা কৃষ্ণের পদ্মসম অপূর্ব মাধুর্যমন্ডিত মুখ দর্শন করে উচ্চহাস্য করতে করতে এবং হাততালি দিতে দিতে সেই বিশাল অজগরের মুখে প্রবশে করতে লাগল।

এদিকে কৃষ্ণ, যিনি পরমাত্মারূপে সকলেরই হৃদয়ে বিরাজমান, বুঝতে পারলেন যে, এই বিরাট শিলারূপী শরীরটি একটি অসুর। তখন তিনি পরিকল্পনা করতে লাগলেন কিভাবে তিনি তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধুদের রক্ষা করবেন। গো এবং গোবৎসসহ সমস্ত বালকেরা তখন সেই বিরাট আকৃতি অজগরের মুখে প্রবেশ করেছে। 
 
কিন্তু কৃষ্ণ তখনও প্রবেশ করেননি। অসুরটি কৃষ্ণের প্রবেশ করার প্রতীক্ষা করতে লাগল এবং সে ভাবতে লাগল, “কৃষ্ণ ছাড়া আর সকলেই প্রবেশ করেছে। এই কৃষ্ণই আমার ভাই এবং বোনকে হত্যা করেছে।”

কৃষ্ণ হচ্ছেন সকলের নিরাপত্তার পরম প্রতিশ্রুতি। কিন্তু তিনি যখন দেখলেন যে, তাঁর বন্ধুরা সেই মহাসর্পের উদরে প্রবেশ করেছে, তখন ক্ষণকালের জন্য তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। 
 
তাঁর স্বকীয় মায়াশক্তি কি অদ্ভুতভাবে কাজ করে সেটা দেখে তিনি অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। তিনি তখন ভাবতে লাগলেন কিভাবে এই অসুরটিকে হত্যা করা যায়, অথচ এই সমস্ত বালক এবং গোবৎসদের উদ্ধার করা যায়। যদিও কৃষ্ণের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ নেই, তবু তিনি এভাবে ভাবতে লাগলেন। 
 
অবশেষে, তিনি উপায় স্থির করে সেই অসুরের মুখে প্রবেশ করলেন। এইভাবে কৃষ্ণকে প্রবেশ করতে দেখে মেঘের অন্তরালে অবস্থিত দেবতারা ভয়ে হাহাকার করে উঠলেন আর সেই সময় কংস আদি রক্তমাংসভুক রাক্ষসেরা অত্যন্ত আনন্দিত হল।

অসুরটি যখন কৃষ্ণ এবং তাঁর সাথীদের পিষে ফেলবার চেষ্টা করছিল, কৃষ্ণ তখন দেবতাদের হাহাকার শুনতে পলেন এবং তিনি তৎক্ষণাৎ সেই অসুরের গলদেশে নিজেকে বর্ধিত করতে লাগলেন। 
 
যদিও সেই অসুরটি একটি বিরাট শরীর ধারণ করেছিল, কিন্তু তবুও কৃষ্ণের বর্ধিত হওয়ার ফলে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল এবং চোখ দু’টো ঠিকরে বেরিয়ে পড়ল। তার প্রাণবায়ু কোনদিক দিয়ে বেরোবার পথ না পেয়ে তা ব্রক্ষরন্ধ্র ভেদ করে বেরিয়ে গেল। এইভাবে সেই অসুরটির মৃত্যু হল। 
 
কৃষ্ণ তখন তাঁর বন্ধুদের এবং গোবৎসদের প্রতি তাঁর করুণাঘন দৃষ্টিপাত করে তাদের চেতনা ফিরিয়ে আনলেন এবং সেই অসুরের মুখ থেকে বেরিয়ে এলেন। 
 
কৃষ্ণ যখন অঘাসুরের মুখে ছিলেন, তখন সেই অসুরের আত্মা এক অদ্ভুত জ্যোতিতে দশদিক উদ্ভাসিত করে কৃষ্ণের বেরিয়ে আসার প্রতীক্ষায় আকাশে অবস্থান করছিল এবং কৃষ্ণ যখন বেরিয়ে এলেন, তখন দেবতাদের সামনে সেই জ্যোতি কৃষ্ণের দেহে লীন হয়ে গেল।

আনন্দে আত্মহারা হয়ে স্বর্গের দেবতারা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপর পুষ্পবৃষ্টি করতে শুরু করলেন এবং এইভাবে তাঁরা তাঁর আরাধনা করলেন। 
 
অস্পরারা আনন্দে মগ্ন হয়ে নৃত্য করতে লাগলেন এবং গন্ধর্বেরা সুমধুর সুরে ভগবানের বন্দনা করতে লাগলেন। বাদকেরা বাদ্য বাজাতে লাগলেন, ব্রাহ্মণেরা বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন এবং ভগবানের সমস্ত ভক্তরা জয়ধ্বনি দিতে লাগলেন, “জয়! পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জয়!”

ব্রহ্মা যখন সেই মঙ্গলধ্বনি শুনলেন, তখন কি হয়েছে তিনি তা দেখতে এলেন। তিনি দেখলেন যে, অঘাসুর হত হয়েছে। একটি শিশুরূপী ভগবানের সেই অসাধারণ লীলা দর্শন করে তিনি অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হলেন। 
 
বহুদিন ধরে সেই অসুরের মুখ হাঁ হয়ে রইল এবং কালক্রমে তার সেই সর্প-শরীরটি শুকিয়ে গেল, গোপবালকদের কাছে সেটি ভগবানের দিব্য লীলা স্মরণের আনন্দ উপভোগের একটি স্থান হয়ে রইল।

কৃষ্ণ যখন অঘাসুরকে বধ করেছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল পাঁচ বছরেরও কম। পাঁচ বছরের কম বয়সের বালকদের বলা হয় কুমার, এবং সেই অবস্থাকে বলা হয় কৌমার। 
 
পাঁচ থেকে দশ বছর পর্যন্ত বয়সকে বলা হয় পৌগন্ড এবং দশ বছর থেকে পনের বছর পর্যন্ত বয়সকে বলা হয় কৈশোর। পনের বছরের পরে বালকদের বলা হয় যুবক। 
 
এক বছর এই অঘাসুর বধের ঘটনা নিয়ে বৃন্দাবনের গ্রামে আলোচনা হয়নি। কিন্তু যখন তাদের বয়স ছ’বছর হল, তখন তারা তাদের পিতা-মাতাকে সেই অদ্ভাত ঘটনার কথা বললেন। পরবর্তী অধ্যায়ে তার কারণ বর্ণনা করা হবে।

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যিনি ব্রহ্মার মতো দেবতাদের চেয়েও অনেক অনেক মহান, তাঁর পক্ষে কাউকে তাঁর দেহে লীন হয়ে যাওয়ার সাযুজ্য মুক্তি প্রদান করা মোটেই কোন কঠিন কাজ নয়। তিনি অঘাসুরকে সেই মুক্তি দান করেছিলেন। 
 
অঘাসুর ছিল সব চাইতে পাপাত্মা এবং পাপীদের পক্ষে পরম ব্রহ্মে লীন হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই বিশেষ অবস্থায় যেহেতু কৃষ্ণ অঘাসরের শরীরে প্রবেশ করেছিলেন, তাই সেই অসুরটি সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়েছিল। 
 
যে চিন্তা করেন, তাঁরা ভগবানের ধামে প্রবিষ্ট হয়ে পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গলাভ কার সৌভাগ্য অর্জন করেন। সুতরাং ভগবান যার শরীরে প্রবেশ করেছিলেন সেই অঘাসুর যে কত সৌভাগ্যবান, তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। 
 
ধ্যানযোগী, মহর্ষি এবং ভক্তরা সর্বক্ষণ তাঁদের হৃদয়ে ভগবানের ধ্যান করেন অথবা মন্দিরে তাঁর শ্রীবিগ্রহের দর্শন করেন,  এইভাবে তাঁরা সব রকম জড় কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে দেহান্তে ভগবদ্ধামে প্রবেশ করতে পারেন। 
 
কেবলমাত্র ভগবানের রূপ মনের মধ্যে ধারণ করে এই পরম প্রাপ্তি লাভ হয়। কিন্তু অঘাসুরের দেহে ভগবান নিজে প্রবেশ করেছিলেন, তাই অঘাসুরের স্থান সাধারণ ভক্ত বা শ্রেষ্ঠ যোগীদের থেকেও অনেক উপরে।

মহারাজ পরীক্ষিৎ শ্রীকৃষ্ণের দিব্য লীলাবিলাসমূহ শ্রবণ করছিলেন। (এই শ্রীকৃষ্ণই মহারাজ পরীক্ষিৎকে তাঁর মাতৃগর্ভে অবস্থানকালে রক্ষা করেছিলেন)। 
 
শ্রীকৃষ্ণের লীলাসমূহ শ্রবণ করে ক্রমান্বয়ে তাঁর উৎসাহ বাড়তে লাগল এবং তিনি শুকদেব গোস্বামীকে, যিনি তাঁকে শ্রীমদ্ভাগবত শোনাচ্ছিলেন, জিজ্ঞাসা করলেন। 
 
পরীক্ষিৎ মহারাজ যখন জানতে পারলেন যে, অঘাসুর বুধের কথা বালকদের পৌগন্ড বয়স প্রাপ্তি অবধি অর্থাৎ এক বছর আলোচনা হয়নি, তা শুনে তিনি অত্যন্ত আশ্চর্য হলেন। তিনি অত্যন্ত উৎসুকভাবে তার কারণ জানতে চাইলেন, কেন না তিনি জানতেন যে, শ্রীকৃষ্ণের লীলাশক্তির প্রভাবেই তা হয়েছিল।

সাধারণত ক্ষত্রিয়রা তাঁদের রাজনৈতিক কাজে সব সময় ব্যস্ত থাকেন এবং তাই পরমেশ্বর ভগবানের দিব্য লীলাসমূহ শোনবার যথেষ্ট সময় ও সুযোগ তাঁরা পান না। 
 
কিন্তু পরীক্ষিৎ মহারাজ যখন সর্বশ্রেষ্ট ভগবত্তত্ত্ববেত্তা শ্রীল শুকদেব গোস্বামীর শ্রীমুখ থেকে শ্রীমদ্ভাগবত শুনছিলেন, তখন তিনি নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান বলে মনে করলেন। পরীক্ষিৎ মহারাজের অনুরোধে শুকদেব গোস্বামী পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রূপ, গুণ, যশ এবং পরিকর বিষয়ক দিব্য লীলা বর্ণণা করতে লাগলেন।

আরও পড়ুন

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url