কুমারী গােপবালিকাদের বস্ত্রহরণ-কৃষ্ণলীলা-শ্রীমদ্ভাগবত কাহিনী

 
কুমারী গােপবালিকাদের বস্ত্রহরণ-কৃষ্ণলীলা-শ্রীমদ্ভাগবত কাহিনী

 কুমারী গােপবালিকাদের বস্ত্রহরণ লীলা

 
 
বৈদিক সংস্কৃতিতে দশ থেকে চোদ্দ বছর বয়স্কা অবিবাহিতা বালিকারা সুযােগ্য পতি লাভের জন্য শিব এবং দুর্গার পূজা করে থাকেন।
 
কিন্তু বৃন্দাবনের অবিবাহিতা বালিকারা ইতিমধ্যেই শ্রীকৃষ্ণের রূপে মােহিত হয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। হেমন্তকালের আগমনে তারা দুর্গা বা কাত্যায়নীর পূজা করেছিলেন।
 
হেমন্তকালের প্রথম মাস অগ্রহায়ণ মাসে বৃন্দাবনের সমস্ত অবিবাহিতা গােপীরা ব্রতসহকারে কাত্যায়নী দেবীর পূজা করতে শুরু করলেন। 
 
তারা প্রথম কোন মশলা ছাড়া ডাল এবং চাল সিদ্ধ করে হবিষ্যান্ন খেলেন। বৈদিক প্রথা অনুসারে ধর্ম-অনুষ্ঠান করার আগে এই হবিষ্যান্ন খেয়ে দেহ ও মনকে পবিত্র করতে হয়। 
 
বৃন্দাবনের সমস্ত অবিবাহিতা গােপিকারা সকালবেলায় যমুনায় স্নান করে প্রতিদিন কাত্যায়নী দেবীর পূজা করতেন। কাত্যায়নী হচ্ছে দুর্গা দেবীর আরেক নাম। যমুনার মাটির সঙ্গে বালি মিশিয়ে প্রতিমা তৈরি করে তারা দেবীর পূজা করতেন। 
 
বৈদিক শাস্ত্রে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, বিভিন্ন রকমের জড় পদার্থ দিয়ে দেব দেবীর প্রতিমা বা ভগবানের শ্রীবিগ্রহ তৈরি করা যেতে পারে; 
 
আলেখ্য অঙ্কন করে, ধাতু দিয়ে, মণিমাণিক্য দিয়ে, কাঠ দিয়ে, মাটি দিয়ে অথবা পাথর দিয়ে, অথবা হৃদয়ে ধ্যান করে বিভিন্ন দেব-দেবীর বা ভগবানের পূজা করা যায়। মায়াবাদী দার্শনিকেরা ভগবানের সচ্চিদানন্দ বিগ্রহকে কল্পনাপ্রসূত আকৃতি বলে মনে করে, 

চন্দন লেপন করে, মাল্য অর্পণ করে, ধূপ-দীপ জ্বালিয়ে, এবং সব রকমের উপচার সহকারে—ফল, ফুল, পল্লব আদি দিয়ে দেবী কাত্যায়নীর পূজা করতেন, পূজা শেষ করার পর কোন বর প্রার্থনা করাটাই হচ্ছে রীতি। 
 
অবিবাহিতা বালিকারা গভীর আবেগের সঙ্গে কাত্যায়নী দেবীর কাছে প্রার্থনা করতেন, পরমেশ্বর ভগবানের পরাশক্তি, হে যােগমায়া, হে জড় জগতের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, অনুগ্রহ পূর্বক আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন যেন নন্দ মহারাজের পুত্র শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে আমার বিবাহ হয় এইভাবে প্রতিটি অবিবাহিতা গােপবালিকাই মনে মনে কাত্যায়নী দেবীর কাছে প্রার্থনা করতেন।
 
বৈষ্ণবেরা সাধারণত কোন দেব-দেবীর পূজা করেন না। সমস্ত শুদ্ধ ভক্তিমার্গে অগ্রসর হতে চান, তাদের জন্য শ্রীল নরােত্তম দাস ঠাকুর কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন কোন দেব-দেবীর পূজা না করতে।
 
তবুও ব্রজগােপিকারা, যাদের কৃষ্ণপ্রেমের তুলনা হয় না, তাদের এখানে দুর্গাদেবীর পূজা করতে দেখা যাচ্ছে। দেব-দেবীদের উপাসকেরা মাঝে মাঝে বলে যে, ব্রজগোপীকারা দুর্গাদেবীর পূজা করেছিলেন, কিন্তু এখানে আমাদের বুঝতে হবে কি উদ্দেশ্য নিয়ে তারা সেই পূজা করেছিলেন।
 
সাধারণত মানুষ দুর্গা পূজা করে কোন জড়জাগতিক লাভের আশায়, কিন্তু এখানে দেবীর কাছে প্রার্থনা করছেন—তারা যেন শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করতে পারেন।
 
এর তাৎপর্য হচ্ছে, শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়াই যদি চরম উদ্দেশ্য হয়, তা হলে ভক্ত সেই উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য যে কোনও পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার জন্য বা তার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য গােপিকারা যে কোনও উপায় অবলম্বন করতে পারেন।  
 
এটাই হচ্ছে ব্রজগােপিকাদের চরিত্রের অপূর্ব মাহাত্ম্য। তারা পুরাে একমাস ধরে দুর্গাদেবীর পূজা করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করার জন্য। প্রতিদিন তারা প্রার্থনা করেছিলেন, নন্দ মহারাজের পুত্র শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে যেন তাদের বিবাহ হয়।

খুব ভােরবেলা ব্রজগােপিকারা স্নান করতে যমুনায় যেতেন। তারা একত্রিত হয়ে পরস্পরের হাত ধরে উচ্চস্বরে শ্রীকৃষ্ণের অপূর্ব লীলাসমূহ কীর্তন করতেন। 
 
ভারতবর্ষে প্রাচীন প্রথা অনুসারে স্ত্রীলােকেরা এবং বালিকারা নদীর তীরে কাপড় খুলে রেখে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে নদীতে ডুব দিয়ে স্নান করেন। নদীর যেখানে স্ত্রীলােকেরা স্নান করেন, সেখানে কোন পুরুষের যাওয়া নিষেধ এবং এই প্রথা আজও প্রচলিত আছে। 
 
পরমেশ্বর ভগবান অবিবাহিতা ব্রজবালিকাদের মনের কথা জানতে পেরে তাঁদের বাসনা পূর্ণ করার জন্য তাদের প্রতি কৃপা করলেন। তাঁরা শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। আর শ্রীকৃষ্ণ তাদের সেই মনােবাঞ্ছা পূর্ণ করতে ইচ্ছা করলেন।


ব্রত মাসের শেষে, একদিন শ্রীকৃষ্ণ তার সখাদের সঙ্গে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। শ্রীকৃষ্ণের আর এক নাম যােগেশ্বর।
 
যােগ অনুশীলন করার মাধ্যমে যােগীরা অন্য মানুষের মনােভাব বুঝতে পারে এবং সমস্ত যােগীদের ঈশ্বর হওয়ার ফলে শ্রীকৃষ্ণ অবশ্যই ব্রজগােপিকাদের মনের ভাব বুঝতে পেরেছিলেন। 
 
সেখানে উপস্থিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ সেই কুমারী ব্রজবালিকাদের বস্ত্রগুলি নিয়ে যমুনার তীরবর্তী কদম্ব বৃক্ষে আরােহণ করে হাসতে হাসতে বলতে লাগলেন, "প্রিয় বালিকারা, তােমরা একে একে এখানে এসে তােমাদের বস্ত্র প্রার্থনা করে তা নিয়ে যাও। 
 
আমি তােমাদের সঙ্গে পরিহাস করছি না, আমি সত্য কথাই বলছি। তােমরা একমাস ধরে কাত্যায়নী দেবীর পূজা করে ব্রত পালন করেছ, তাই তােমাদের সঙ্গে পরিহাস করার কোন বাসনা আমার নেই। 
 
তােমরা দয়া করে সকলে একসঙ্গে এখানে এসাে না। একে একে এসাে, কেননা আমি তােমাদের পূর্ণ সৌন্দর্য দর্শন করতে চাই। তােমরা সকলেই হচ্ছ ক্ষীণকটিসম্পন্না, সুমধ্যমা। আমি তােমাদের একে একে এখানে আসতে অনুরােধ করছি। দয়া করে আমার কথা তােমরা শােন।”

জলের মধ্যে থেকে বালিকারা যখন শ্রীকৃষ্ণের এই পরিহাস বাক্য শুনলেন, তখন তাঁরা স্মিত হাসি হেসে একে অপরের দিকে তাকালেন। 
 
শ্রীকৃষ্ণের এই অনুরােধে তাঁরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন, কেননা তারা ইতিমধ্যেই তার প্রেমে মগ্ন ছিলেন। কিন্তু স্ত্রীসুলভ লজ্জাবশত তারা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। নগ্ন থাকার ফলে তারা জল থেকে উঠে আসতে পারলেন না। অনেকক্ষণ জলে থাকার ফলে তারা ঠাণ্ডায় কাঁপতে লাগলেন, কিন্তু তবুও গােবিন্দের মধুর পরিহাসবাক্য শুনে তাদের মন মহা আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল।

তারা শ্রীকৃষ্ণকে বলতে লাগলেন, “হে নন্দনন্দন, দয়া করে আমাদের সঙ্গে এইভাবে পরিহাস করাে না। এটা আমাদের প্রতি অন্যায়।
 
তুমি অত্যন্ত সম্রান্ত ঘরের সন্তান, তুমি হচ্ছ নন্দ মহারাজের পুত্র, আর তুমি আমাদের অত্যন্ত প্রিয়। তাই আমাদের সঙ্গে এইভাবে পরিহাস করা তােমার উচিত নয়, কেননা আমরা সকলেই এখন এই জলে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডায় কাঁপছি। কৃপা করে তুমি আমাদের বস্ত্রগুলি ফিরিয়ে দাও, তা না হলে আমাদের খুব কষ্ট হবে।”
 
এইভাবে তারা শ্রীকৃষ্ণের কাছে ব্যাকুলভাবে আবেদন করতে লাগলেন। তারা বললেন, “হে শ্যামসুন্দর, আমরা সকলেই তােমার নিত্য সেবক।
 
তুমি আমাদের যা আদেশ করবে নিঃসঙ্কোচে তা পালন করতে আমরা বাধ্য, কেননা আমরা মনে করি যে, সেটাই হচ্ছে আমাদের ধর্ম। কিন্তু যে শর্তটি তুমি আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছ, তা পালন করা অসম্ভব। 
 
তা হলে অবশ্যই আমাদের নন্দ মহারাজের কাছে গিয়ে তােমার বিরুদ্ধে নালিশ করতে হবে। নন্দ মহারাজ যদি তার কোন প্রতিবিধান না করেন, তা হলে আমরা তােমার এই দুর্ব্যবহারের জন্য মহারাজ কংসের কাছে নালিশ করব।

গােপকুমারীদের এই আবেদন শুনে শ্রীকৃষ্ণ বললেন, "প্রিয় বালিকারা, তােমরা যদি সত্যিই মনে করাে যে, তােমরা হচ্ছ আমার নিত্য সেবক এবং সেই জন্য সর্বদাই যদি তােমরা আমার আদেশ পালন করতে প্রস্তুত থাক,
 
তা হলে আমার আদেশ হচ্ছে যে, হাসিমুখে তােমরা একে একে এখানে এসে তােমাদের বস্ত্র নিয়ে যাও। তােমরা যদি এখানে না আস এবং তােমরা যদি আমার পিতার কাছে নালিশ করতে যাও, তার আমি কোন পরােয়া করি না, কেননা আমার পিতা হচ্ছেন বৃদ্ধ এবং তিনি আমাকে কিছুই করতে পারবেন না।”

গােপিকারা যখন দেখলেন যে, শ্রীকৃষ্ণ সম্পূর্ণভাবে দৃঢ়সংকল্প, তখন আর গত্যন্তর না দেখে তারা তার শর্ত মেনে নিলেন।
 
একে একে তারা জল থেকে উঠে এলেন, কিন্তু যেহেতু তারা সম্পূর্ণ নগ্ন ছিলেন, তাই তারা বাম হাত দিয়ে তাদের স্ত্রী-অঙ্গ আচ্ছাদন করে তাদের লজ্জা নিবারণ করার চেষ্টা করলেন। তাঁরা সকলেই তখন শীতে কাঁপছিলেন।
 
এই সরল আত্মনিবেদন এত নির্মল ছিল যে, শ্রীকৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ তাঁদের প্রতি প্রীত হলেন। সমস্ত গােপকুমারীরাই শ্রীকৃষ্ণকে তাদের পতিরূপে পাওয়ার জন্য কাত্যায়নী দেবীর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন এবং এইভাবে তাদের সেই মনােবাঞ্ছা পূর্ণ হল। 
 

কোন স্ত্রী তাঁর স্বামী ছাড়া আর কারাে সামনে নগ্ন অবস্থায় যেতে পারেন না। গােপকুমারীরা শ্রীকৃষ্ণকে তাঁদের পতিরূপে কামনা করেছিলেন এবং এইভাবে তিনি তাদের সেই মনােবাসনা পূর্ণ করেছিলেন।
 
তাদের প্রতি প্রীত হয়ে তিনি তাদের বস্ত্র কাঁধে নিয়ে বলতে লাগলেন, “হে প্রিয় বালিকারা, তােমরা নগ্ন অবস্থায় যমুনায় গিয়ে মহা অপরাধ করেছ। 
 
তার ফলে যমুনার অধিষ্ঠাতা দেবতা বরুণদেব তােমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তাই দয়া করে এখন তােমরা করজোড়ে বরুণদেবকে প্রণতি জানিয়ে তােমাদের এই অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর।" সেই গােপিকারা ছিলেন অত্যন্ত সরলচিত্ত বালিকা এবং শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের যা বলতেন, তাই তারা সত্য বলে মেনে নিতেন। 
 
বরুণদেবের ক্রোধ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এবং তাদের ব্রতপালনের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য, এবং সর্বোপরি তাদের পরমারাধ্য শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য তারা তৎক্ষণাৎ তার সেই আদেশ পালন করলেন। এইভাবে তারা শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়তম ভক্ত এবং সব চাইতে অন্তরঙ্গ সেবকে পরিণত হলেন।

শ্রীকৃষ্ণের প্রতি গােপিকাদের প্রেমের কোন তুলনা হয় না। প্রকৃতপক্ষে, ব্ৰজগােপিকারা বরুণদেব অথবা অন্য কোন দেবতার প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন, তারা কেবল শ্রীকৃষ্ণকেই সন্তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন।
 
গােপিকাদের এই সরল আচরণে শ্রীকৃষ্ণ অত্যন্ত সন্তুষ্ট এবং কৃতজ্ঞ হলেন, এবং তিনি তৎক্ষণাৎ একে একে তাদের সকলের বস্ত্র ফিরিয়ে দিলেন। 
 
শ্রীকৃষ্ণ যদিও গােপকুমারীদের তাঁর সামনে নগ্ন অবস্থায় দাঁড়াতে বাধ্য করে ছলনা করেছিলেন এবং তাদের সঙ্গে উপহাস করেছিলেন এবং তাদের বস্ত্র হরণ করেছিলেন, তবুও তাঁর প্রতি তাঁরা বিরক্ত হননি এবং তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ করেননি।
 
ব্রজগােপিকাদের এই মনােভাবের বর্ণনা করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রার্থনা করেছেন, হে প্রাণনাথ কৃষ্ণ, এই পাদরতা দাসীকে তুমি আলিঙ্গনপূর্বক পেষণ কর অথবা অদর্শন দ্বারা মর্মাহতই কর, তুমি— লম্পট পুরুষ, আমার প্রতি তুমি যেরকম বিধানই কর না কেন, তুমিই আমার প্রাণনাথ, অপর কেউ নয়।

শ্রীকৃষ্ণ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং যেহেতু তারা সকলেই তাকে তাদের পতিরূপে কামনা করেছিলেন, তাই তিনি তাদের বললেন, “আমার প্রিয়। 
 
বালিকারা, আমার প্রতি তােমাদের মনােভাব আমি জানি, এবং আমি জানি কেন তােমরা কাত্যায়নী দেবীর পূজা করেছ এবং তােমাদের এই আচরণ আমি সর্বতােভাবে সমর্থন করি।
 
যার চেতনা সম্পূর্ণভাবে আমাতে মগ্ন হয়েছে, তা কামনার বশে হলেও, সে আমার অতি অন্তরঙ্গ আপনজন। দগ্ধ বীজ যেমন কোনদিনও অঙ্কুরিত হয় না, তেমনই আমার সম্পর্কে ভক্তিযুক্ত কোন কামনা সাধারণ কর্মের মতাে ফল প্রসব করে না।"

ব্রহ্মসংহিতাতে বলা হয়েছে, "কর্মাণি নির্দরহতি কিন্তু চ ভক্তিভাজাং।” সকলেই কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ, কিন্তু ভক্ত যেহেতু ভগবানের সন্তুষ্টিবিধানের জন্যই কেবল কর্ম করেন, তাই তাকে কোন কর্মফল ভােগ করতে হয় না। 
 
তেমনই, শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ব্রজগােপিকাদের মনােভাব আপাতদৃষ্টিতে যদিও কামপূর্ণ, কিন্তু তা কখনই কোন সাধারণ স্ত্রীলােকের কাম বলে মনে করা উচিত নয়। শ্রীকৃষ্ণ নিজেই তার কারণ বিশ্লেষণ করেছেন। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিযুক্ত সমস্ত কর্মই অপ্রাকৃত এবং সেই সমস্ত কর্মের কোন কর্মফল নেই।

শ্রীকৃষ্ণ তাদের বললেন, প্রিয় গােপবালিকারা, আমাকে পতিরূপে লাভ করার বাসনায় তােমরা কাত্যায়নী দেবীর পূজা করেছ, তাই তােমাদের এই বাসনা পূর্ণ হবে। 
 
আমি তােমাদের কাছে প্রতিজ্ঞা করছি যে, আগামী শরৎকালে তােমরা আমার সঙ্গে মিলিত হবে এবং তােমাদের পতিরূপে আমাকে তােমরা লাভ করবে।

গাছের ছায়ার আশ্রয়ে শ্রীকৃষ্ণ অত্যন্ত প্রীত হলেন। পথ চলতে চলতে তিনি তাঁর গােপসখাদের সম্বােধন করে বললেন, স্তোককৃষ্ণ, প্রিয় বরূথপা, প্রিয় ভদ্রসেন, প্রিয় সুদামা, প্রিয় অর্জুন, প্রিয় বিশাল, প্রিয় ঋষভ—অতি সৌভাগ্যশালী বৃন্দাবনের এই গাছগুলিকে দেখ। 
 
অপরের উপকার করার জন্য তারা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে। ব্যক্তিগতভাবে তারা প্রখর তাপ এবং প্রচণ্ড শীত ইত্যাদি সব রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহ্য করছে, কিন্তু অপরের দুঃখ দূর করার জন্য এবং আমাদের আশ্রয় দান করার জন্য তারা অত্যন্ত সচেতন। 
 
প্রিয় সখারা, আমার মনে হয় এই জন্মে বৃক্ষরূপে জন্মগ্রহণ করে তারা ধন্য হয়েছে, তারা অপরকে আশ্রয় প্রদান করার জন্য এতে তারা অতি উচ্চকুলােদ্ভূত, মহা-দানশীল মানুষের মতাে, যারা কখনও কাউকে প্রত্যাখ্যান করে না।  
 
এই গাছগুলি কাউকে তাদের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত করে না। তারা মানব- সমাজকে পত্র, পুষ্প, ফল, ছায়া, মূল, বাকল, নির্যাস এবং কাঠ প্রদান করে নানাভাবে সাহায্য করে।
 
মহান জীবনের তারাই হচ্ছে চরম দৃষ্টান্ত। তারা দেহ, মন, কার্য, বুদ্ধি এবং বাক্য সর্বতােভাবে জীবের মঙ্গল সাধনের জন্য উৎসর্গীকৃত। 

এইভাবে পরমেশ্বর ভগবান যমুনার তীরে বিচরণ করতে লাগলেন এবং পথ চলতে চলতে গাছের ফল, ফুল ও পাতা স্পর্শ করতে করতে তাদের জনহিতকর কার্যকলাপের মহিমা কীর্তন করতে লাগলেন। 
 
বিভিন্ন মানুষ তাঁদের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে বিভিন্ন রকমের কার্যকলাপ মানব-সমাজের পক্ষে হিতকর বলে মনে করতে পারেন।
 
 কিন্তু জনসাধারণের জন্য নিত্য মঙ্গলময় সেবা হচ্ছে কৃষ্ণভক্তির প্রচার করা। এই কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন প্রচার করার জন্য সকলেরই এগিয়ে আসা উচিত। 
 
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন, 'তৃণাদপি সুনীচেন তরােরীব তরুর সহিষ্ণুতার কথা শ্রীকৃষ্ণ নিজেই এখানে বর্ণনা করলেন, আর যারা কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারে আকাক্ষী, তাদের কর্তব্য হচ্ছে গুরুপরম্পরার ধারায় শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা অনুশীলন করা।

যমুনার পাশ দিয়ে বৃন্দাবনের বনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে শ্রীকৃষ্ণ একটা অতি সুন্দর জায়গায় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসলেন এবং গাভীদের যমুনার নির্মল শীতল জল পান করতে দিলেন। 
 
ক্লান্ত হয়ে গােপবালকসহ কৃষ্ণ এবং বলরামও জল পান করলেন। গােপকুমারীদের যমুনায় স্নান করতে দেখার পর শ্রীকৃষ্ণ সারা সকাল তার সখাদের সঙ্গে কাটালেন।

আরও পড়ুনঃ 

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url