গােপী গীত- কৃষ্ণ কথা- শ্রীমদ্ভাগবত

গোপী গীত

   গােপী গীত-কৃষ্ণ কথা

একজন গােপী বললেন, হে প্রিয় কৃষ্ণ, এই ব্রজভূমিতে তােমার জন্ম নেওয়ার ফলে সব কিছুই অপূর্ব মহিমামণ্ডিত হয়েছে। এই বৃন্দাবন এত মহিমামণ্ডিত হয়েছে। যে, মনে হচ্ছে মহালক্ষ্মী যেন সর্বক্ষণ এখানে বিরাজ করছেন। 

 

কিন্তু আমরাই কেবল অত্যন্ত অসুখী, কেননা আমরা চতুর্দিকে তােমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, এবং এত চেষ্টা করা সত্ত্বেও তােমাকে দেখতে পাচ্ছি না। তােমার নিমিত্তই আমরা প্রাণধারণ করে আছি; তাই আমরা তােমার কাছে অনুরোধ করছি দয়া করে আবার আমাদের কাছে ফিরে এস।”

 

আরেকজন গােপী বললেন, "প্রিয় কৃষ্ণ, তুমি হচ্ছ পদ্মফুলেরও জীবন, যারা হেমন্তের নির্মল বর্ষণে স্বচ্ছ সরােবরে বিকশিত হয়েছে। যদিও পদ্মফুলেরা অত্যন্ত সুন্দর, কিন্তু তুমি যদি তাদের দিকে না তাকাও তা হলে তারা মলিন হয়ে যায়।

 

তেমনই তােমার বিরহে আমরাও মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছি। প্রকৃতপক্ষে, আমরা তােমার বিবাহিতা স্ত্রী নই। আমরা তােমার বিনামূল্যের দাসী। তােমার চোখের চাহনিতে আমরা আকৃষ্ট হয়েছি।

 

এখন তােমাকে দর্শন করতে না পেরে যদি আমাদের মৃত্যু হয়, তা হলে তুমি আমাদের সকলের মৃত্যুর জন্য দায়ী হবে। স্ত্রীলােক হত্যা করা মহাপাপ, এবং তুমি যদি আমাদের দেখতে না আসাে এবং তার ফলে যদি আমাদের মৃত্যু হয়, তা হলে সেই পাপের ফল তােমাকে ভােগ করতে হবে। তাই দয়া করে এসে আমাদের দেখা দাও।

 

তুমি মনে করাে না যে, কেবল কতকগুলি অস্ত্র দিয়েই মানুষকে হত্যা করা যায়, তােমার অনুপস্থিতির ফলে আমরা মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছি। এখন তােমার বিবেচনা করে দেখা উচিত কিভাবে তুমি স্ত্রী হত্যার দায়ে দায়ী হচ্ছে। 

 

আমরা তােমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ, কেননা তুমি বহুবার আমাদের রক্ষা করেছ; যমুনার বিষাক্ত জল থেকে, কালীয় নাগ থেকে, বকাসুর থেকে, ইন্দ্রের রােষ থেকে এবং তার প্রেরিত প্রচণ্ড ঝঞ্জা এবং বৃষ্টির হাত থেকে, দাবানল থেকে এবং এইভাবে কতবার তুমি আমাদের রক্ষা করেছ। 

 

তুমিই হচ্ছ মহত্তম এবং সর্বাপেক্ষা শক্তিসম্পন্ন। কিন্তু আমাদের আশ্চর্য লাগছে যে, যদিও তুমি নানা রকম বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করেছ, কিন্তু এইক্ষণে তুমি আমাদের অবহেলা করছ। প্রিয় কৃষ্ণ, প্রিয় সখা, আমরা জানি যে, তুমি প্রকৃতপক্ষে মা যশােদা অথবা নন্দ মহারাজের সন্তান নও।

 

তুমি হচ্ছ পরমেশ্বর ভগবান এবং সমস্ত প্রাণীর অন্তর্যামী। তােমার অহৈতুকী কৃপার প্রভাবে ব্রহ্মার প্রার্থনায় এই জগৎকে রক্ষা করার জন্য তুমি আবির্ভূত হয়েছ। 

 

তােমার করুণার প্রভাবেই কেবল তুমি যদুকুলে আবির্ভূত হয়েছ। হে যদুকুল- শিরােমণি, সংসার ভয়ে ভীত হয়ে কেউ যখন তােমার চরণকমলের আশ্রয় নেয়, তুমি কখনও তাদের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত কর না।

 

তােমার গমন অতি মধুর, এবং তুমি সর্বতােভাবে স্বাধীন, এক হাতে মহালক্ষ্মীকে স্পর্শ করাে এবং অপর হাতে তুমি লীলাকমল ধারণ কর। তাই দয়া করে তুমি এখন আমাদের কাছে এস এবং তােমার করকমলের দ্বারা আমাদের আশীর্বাদ কর।

"প্রিয় কৃষ্ণ, তুমি বৃন্দাবনবাসীদের সমস্ত ভয়হারী। তুমি হচ্ছ পরম শক্তিশালী বীর, এবং আমরা জানি যে, কেবল তােমার মধুর হাসির দ্বারা তুমি তােমার ভক্তের এবং আমাদের মতাে স্ত্রীলােকদের অনর্থক অভিমান বিনাশ করতে পার। আমরা তােমার পরিচারিকা এবং ক্রীতদাসী; তাই দয়া করে তােমার অপূর্ব সুন্দর মুখকমলের দর্শন দান করে আমাদের কৃতার্থ কর।

 

"প্রিয় কৃষ্ণ, তােমার শ্রীচরণকমলের স্পর্শলাভ করে আমরা অত্যন্ত কামার্ত হয়ে পড়েছি। তােমার চরণকমল অবশ্যই তােমার শরণাগত ভক্তের সমস্ত পাপ বিনাশ করে। তুমি এতই করুণাময় যে, সাধারণ পশুরা পর্যন্ত তােমার চরণারবিন্দে আশ্রয় গ্রহণ করে।

 

তােমার ওই চরণকমল লক্ষ্মীদেবীরও আবাসস্থল, আর সেই চরণকমলের উপর ভর দিয়েই তুমি কালীয়র মাথায় নৃত্য কর। এখন আমরা তােমাকে অনুরােধ করছি—দয়া করে তােমার সেই চরণকমল আমাদের স্তনের উপরে রাখ যাতে তােমাকে স্পর্শ করার জন্য আমাদের সমস্ত কামবাসনা তৃপ্ত হয়।

 

“হে প্রভু, কমলের মতাে আয়ত এবং চিত্তাকর্ষক তােমার আঁখিযুগল কত সুন্দর মনােমুগ্ধকারী। তােমার মধুর বাণী এতই মনােরম যে, তাতে সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিতেরাও মুগ্ধ হয়ে তােমার প্রতি আকৃষ্ট হয়। আমরাও তােমার মধুর বাণীর দ্বারা এবং তােমার শ্রীমুখমণ্ডলের এবং আঁখিযুগলের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়েছি।

 

তাই দয়া করে তােমার অমৃতমধুর চুম্বনের দ্বারা আমাদের তৃপ্ত কর। হে নাথ, তােমার শ্ৰীমুখের বাণী এবং তােমার কার্যকলাপের বর্ণনা অমৃতের মতােই মাধুর্যমণ্ডিত, এবং তােমার সেই বাণী শ্রবণ করা বা কীর্তন করার ফলে সংসাররূপী দাবানল থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। 

 

ব্রহ্মা, শিব আদি মহান দেবতারাও সর্বক্ষণ তােমার মহিমা কীর্তন করে। তারা তা করে এই জড় জগতের সমস্ত বদ্ধ জীবদের পাপ মােচন করার জন্য। কেউ যদি কেবল তােমার অপ্রাকৃত বাণী শ্রবণ করতে চেষ্টা করে, তখন তিনি অতি শীঘ্র এই পাপপঙ্কিল সংসার-সমুদ্র উত্তীর্ণ হন।

 

তােমার বাণী বৈষ্ণবদের দিব্য আনন্দ দান করে এবং যে সমস্ত মহাত্মা সমস্ত জগৎ জুড়ে তােমার বাণী প্রচার করেছেন, তারাই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা।" (শ্রীল রূপ গােস্বামীও সেই কথা প্রতিপন্ন করে গেছেন। তিনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে মহাবদান্য। অবতার বলে সম্বােধন করেছেন কেননা তিনি অকাতরে কৃষ্ণপ্রেম বিতরণ করেছিলেন।)

 

গােপীরা বলতে লাগলেন, "প্রিয় কৃষ্ণ, তুমি অত্যন্ত চতুর। তুমি সহজেই অনুমান করতে পার তােমার চতুর হাসি, তােমার মধুর ঈক্ষণ, বৃন্দাবনের বনে আমাদের সঙ্গে তােমার ইতস্তত বিহার এবং পরম মঙ্গলময় তােমার ধ্যান করে আমরা কত কাতর হয়ে পড়েছি। 

 

নিভৃতে আমাদের সাথে তােমার আলাপন, আমাদের হৃদয় গভীর আবেগে পরিপূর্ণ করে তুলত। এখন সেই সমস্ত কথা মনে করে আমরা গভীর মর্মবেদনায় অভিভূত হচ্ছি। দয়া করে তুমি আমাদের রক্ষা কর। প্রিয় কৃষ্ণ, তুমি জান, তুমি যখন গােচারণ করতে করতে ব্রজ থেকে বনে প্রবেশ কর, তখন আমরা কত ব্যথিত হই।

 

তখন তােমার কমলের মতাে সুকোমল চরণ পাছে শুষ্ক ঘাস এবং ছােট পাথরের টুকরােতে ব্যথা পায় মনে করে আমরা গভীর বেদনা অনুভব করি! আমরা তােমার প্রতি এতই আসক্ত যে, আমরা সর্বক্ষণ তােমার শ্রীচরণকমলের কথা চিন্তা করি।

 

“হে কৃষ্ণ, তুমি যখন সন্ধ্যাবেলায় গাভীদের নিয়ে গােচারণ থেকে ফিরে আস, তখন আমরা গােধুলি-ধূুসরিত নীল কুস্তলাবৃত তােমার মুখকমল দর্শন করি। স্মিতহাস্যযুক্ত তােমার সেই অপূর্ব সৌন্দর্যমণ্ডিত মুখকমল দর্শন করে তােমাকে উপভােগ করার জন্য আমাদের হৃদয় আকুল হয়ে ওঠে।

 

 হে প্রিয় কৃষ্ণ, তুমিই হচ্ছ পরম প্রেমিক, এবং তুমি সর্বদাই সমর্পিত আত্মাকে আশ্রয় দান করাে। তুমি সকলের মনােবাঞ্ছা পূর্ণ করাে; এই ব্রহ্মাণ্ডে স্রষ্টা ব্রহ্মাও তােমার চরণারবিন্দের আরাধনা করেন। যে তােমার চরণকমলের আরাধনা করে, তুমি তার ওপরই তােমার কৃপা বর্ষণ করাে।

 

তাই দয়া করে আমাদের প্রতি প্রসন্ন হও এবং আমাদের স্তনের উপর তােমার চরণকমল অর্পণ করে আমাদের এই মর্মবেদনা বিদূরিত করাে। প্রিয় কৃষ্ণ, তােমার বাঁশিকে পর্যন্ত যে চুম্বন দান করাে, সেই চুম্বনের জন্য আমরা আকুল হয়ে উঠেছি। তােমার বাঁশির সুর সমস্ত জগৎকে মােহিতে করে এবং আমাদের হৃদয়ও সেই সুরে মােহিত হয়েছে। তাই দয়া করে ফিরে এসাে এবং তােমার অধরামূতের চুম্বনে আমাদের তৃপ্ত করাে।

 

“হে প্রিয়, দিনের বেলায় যখন তুমি ব্ৰজে ভ্রমণ করাে, তখন তােমাকে না। দেখে এক নিমেষকে আমাদের এক যুগ বলে মনে হয়, আর দিনাস্তে যখন তােমার কুটিল কুন্তলযুক্ত শ্রীমুখমণ্ডল দর্শন করি, তখন নিমেষমাত্র ব্যবধান সহ্য না হওয়ায় আমাদের কাছে চোখের পত্র নির্মাতা বিধাতাকে বিবেকহীন বলে মনে হয়।

 

“হে অচ্যুত, আমরা আমাদের পতি, আত্মীয়স্বজন, পুত্র, ভ্রাতা, বন্ধু সকলকে ছেড়ে তােমার কাছে এসেছি। হে কপট, আমাদের আসবার কারণ জান, আমরা তােমার সুমধুর গীতে মােহিত হয়েই এসেছি। কিন্তু এই সমস্ত বিষয় জানা সত্ত্বেও এই রাত্রিবেলা আমাদের ছেড়ে কোথায় গেছ?

 

"হে নাথ, তােমার নির্জন আলাপ, কামভাবােদ্দীপক হাস্যবদন, সপ্রেম দৃষ্টি ও লক্ষ্মীর নিকেতন বিশাল বক্ষঃস্থল বারবার নিরীক্ষণ করে তাতে আমাদের অতিশয় স্পৃহা জন্মাচ্ছে এবং তার ফলে আমাদের চিত্ত মুগ্ধ হচ্ছে।

 

হে প্রিয়, আমরা তােমার সুকুকমল পাদপদ্ম যখন অতি সন্তর্পণে আমাদের স্তনের উপর ধারণ করি, তখন মনে হয় যেন আমাদের কঠিন স্তন তােমার পদযুগলকে ব্যথা দেবে, সেই চরণে তুমি বনে ভ্রমণ করছ, অতএব সেই চরণকমল তীক্ষ্ম ও সুচ্যগ্র শিলার দ্বারা নিশ্চয়ই ব্যথিত হচ্ছে। তুমি আমাদের জীবন স্বরূপ, তােমার বিরহে আমাদের হৃদয় অত্যন্ত ব্যথিত হচ্ছে।"

 

আরও পড়ুন

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
৩২. অক্রুরের বৃন্দাবনে আগমন

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url