বকাসুর বধ-কৃষ্ণলীলা কাহীনি
বজ্রপাতের মতো প্রচন্ড শব্দ করে অর্জুন বৃক্ষ দুটি যখন ভূপতিত হল তখন নন্দ মহারাজ সহ গোকুলের সমস্ত অধিবাসীরা তৎক্ষণাৎ সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। এই দু’টি বৃক্ষকে হঠাৎ সেভাবে পড়তে দেখে তাঁরা অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হলেন। তাদের পতনের কারণ খুঁজে না পেয়ে তাঁরা হতভম্ব হয়ে গেলেন। উদুখলে রজ্জুবদ্ধ অবস্থায় কৃষ্ণকে সেখানে দেখে তাঁরা ভাবলেন যে, এটা নিশ্চয়ই কোন অসুরের কাজ হবে। তা না হলে এটা কি করে সম্ভব? তারা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন, কেননা শিশু কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে সব সময়ই এই ধরনের অদ্ভুত সমস্ত ঘটনা ঘটছিল। বয়স্ক গোপেরা যখন এইভাবে নানা রকম দুশ্চিন্তা করছিলেন, তখন সেখানে ক্রীড়ারত গোপ-শিশুরা বলল যে, উদুখলের সঙ্গে রজ্জুবদ্ধ কৃষ্ণ, সেই উদুখলের টানে সেই গাছ দু’টি ভূপতিত করেছে। তারা বলল, “কৃষ্ণ যখন এই দুটি গাছের মাঝখানে এসেছিল, তখন সেই উদুখলটি সেখানে আটকে যায়। কৃষ্ণ তখন সেই দড়িটা টানতে থাকে এবং তারা ফলে সেই গাছ দু’টি সমূলে উৎপাটিত হয়। গাছ দু’টি যখন পড়ে, তখন দুজন জ্যোতির্ময় পুরুষ সেই গাছ দু’টি থেকে বেরিয়ে আসে এবং তারা কৃষ্ণের সঙ্গে কথা বলে।”
অধিকাংশ গোপেরাই শিশুদের সেই কথায় বিশ্বাস করলেন না। তাঁরা বিশ্বাসই করতে পারলেন না যে, সেই রকম কিছু একটা ঘটা সম্ভব। কেউ কেউ কিন্তু তাতে বিশ্বাস করলেন এবং নন্দ মহারাজকে বললেন, “তোমার এই শিশুটি অন্য শিশুদের মতো নয়। তার অলৌকিক শক্তির প্রভাবে সেই রকম কিছু ঘটলেও ঘটতে পারে।” তাঁর পুত্রের এই অসাধারণ ক্ষমতার কথা শুনে নন্দ মহারাজ হাসতে লাগলেন। তিনি এগিয়ে এসে তাঁর কোমরের দড়িটি খুলে দিলেন। বয়স্কা গোপিকারা তখন কৃষ্ণকে তাঁদের কোলে তুলে নিলেন। তাঁরা তাঁকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে গেলেন এবং হাততালি দিয়ে তাঁর অদ্ভুত সমস্ত কার্যকলাপ কীর্তন করতে লাগলেন। কৃষ্ণ একজন সাধারণ শিশুর মতো তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে তালি দিতে লাগলেন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কাঠের পুতুলের মতো সম্পূর্ণভাবে গোপীদের বশীভূত হয়ে নাচতে লাগলেন, এবং গান করতে লাগলেন।
মা যশোদা কখনও কখনও বসবার জন্য কৃষ্ণকে একটা কাঠের পিঁড়ি আনতে বলতেন। যদিও একটা শিশুর পক্ষে সেই কাঠের পিঁড়িটি ছিল অত্যন্ত ভারী, তবুও কোনমতে কৃষ্ণ তা তাঁর মায়ের কাছে নিয়ে আসতেন। নারায়ণের আরাধনা করার সময় তাঁর পিতা কখনও তাঁকে তাঁর খড়ম জোড়া তাঁর পিতার কাছে নিয়ে আসতেন। যখন তাঁকে কোন ভারী জিনিস তুলতে বলা হত এবং তিনি সেটা তুলতে পারতেন না, তখন তিনি কেবল তাঁর হাত নাড়তেন। এইভাবে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ তিনি তাঁর পিতা-মাতাকে অসীম আনন্দে মগ্ন রেখেছিলেন। তিনি শিশুসুলভ এই সমস্ত লীলা ব্রজবাসীদের প্রদর্শন করেছিলেন, কেননা যে সমস্ত মুনি-ঋষিরা পরমতত্ত্বের অনুসন্ধান করছেন, তাঁদের তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন যে, কিভাবে পরমতত্ত্ব পরমেশ্বর ভগবান তাঁর শুদ্ধ ভক্তদের ইচ্ছার বশীভূত হয়ে যান।
একদিন এক ফলওয়ালী নন্দ মহারাজের বাড়ির সামনে এসে হাঁকতে লাগল, “ফল চাই, ফল চাই, ভাল ফল আছে, কে কিনবে এসো!” শিশু কৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ তাঁর ছোট্র ছোট্র হাতে করে কিছু শস্য নিয়ে এসে তার বিনিময়ে কছিু ফল নিতে এল। তখনকার দিনে বিনিময়ের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় হত; তাই বড়দের শস্যের বিনিময়ে ফল কিনতে দেখে শ্রীকৃষ্ণ তারই অনুকরণ করছিলেন। কিন্তু তাঁর হাত দুটো ছিল অত্যন্ত ছোট আর তার ওপর সেগুলি আনতে আনতে তার অধিকাংশ মাটিতে পড়ে গেল। যে ফলওয়ালীটি ফল বিক্রি করতে এসেছিল সে এইভাবে কৃষ্ণকে আসতে দেখে, তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে, তাঁর হাতের অবশিষ্ট কয়েকদানা শস্যের বিনিময়ে তাঁর হাত ভর্তি করে ফল দিয়ে দিল। তখন সে দেখল যে, তার ফলের ঝুড়িটি মণিমাণিক্যে পূর্ণ হয়ে গেছে। ভগবান হচ্ছেন সব রকমের আশীর্বাদ প্রদাতা। তাই কেউ যখন ভগবানকে কিছু দেয়, তাতে তার কোন ক্ষতি হয় না; উপরন্তু প্রতিদানে তার লক্ষ কোটিগুণ বেশি লাভ হয়।
একদিন যমলার্জুনের মুক্তিদাতা শ্রীকৃষ্ণ যমুনার তীরে বলরামসহ অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে খেলা করছিলেন। তখন অনেক বেলা হয়ে গিয়েছিল, তাই বলরামের মা রোহিণী তাদের ঘরে ফিরে আসবার জন্য ডাকতে গিয়েছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণ এবং বলরাম তখন তাঁদের বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় এত মত্ত ছিলেন যে, তাঁরা বাড়িতে আসতে চাইলেন না; তাঁরা খেলেই যেতে লাগলেন। তাঁদের ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে অসমর্থ হয়ে রোহিণী বাড়ি ফিরে এসে মা যশোদাকে পাঠালেন তাঁদের ডেকে আনবার জন্যে। মা যশোদা তাঁর পুত্রের প্রতি এত স্নেহবৎসল ছিলেন যে, তাঁকে ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য ডাকতে আসা মাত্রই তাঁর স্তন দুগ্ধপূর্ণ হয়ে উঠল। তিনি উচ্চস্বরে ডাকতে লাগলেন, “কৃষ্ণ, তোমার খাওয়ার সময় হয়েছে, বাড়ি চল। হে নীলোৎপললোচন কৃষ্ণ, আমার কাছে এসে আমার স্তন্য পান করো। তুমি অনেক খেলা করেছ। এখন নিশ্চয়ই তোমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে, তুমি এখন নিশ্চয় ক্লান্ত হয়ে পরেছ। এখন আর খেলার দরকার নেই।” তিনি বলরামকে আহ্বান করে বললেন, “হে কুলনন্দন বলদেব! তোমার ছোট ভাই কৃষ্ণকে নিয়ে এক্ষুনি ফিরে এসো। সেই সকল থেকে তোমরা খেলা করছ, তোমাদের পিতা নন্দ মহারাজ তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তোমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি খাবেন না। তাই তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।”
কৃষ্ণ এবং বলরাম যখন শুনলেন যে, নন্দ মহারাজ তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছেন এবং তাঁদের অনুপস্থিতিতে তিনি কিছুই খাবেন না, তখন অভিযোগ করল, “আমাদের খেলা এখন জমে উঠেছে আর কৃষ্ণ এখন চলে যাচ্ছে। এবারের মতো ওকে আমরা যেতে দিলাম, এরপরে আর কখনও আমরা ওদের খেলায় নেব না।”
এইভাবে তাঁর খেলার সাথীরা যখন তাঁকে ভয় দেখাল যে, আর তারা তাঁকে খেলতে নেবে না, কৃষ্ণের তখন খুব ভয় হল, এবং বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে তিনি আবার তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে শুরু করলেন। তখন মা যশোদা শিশুদের তিরস্কার করলেন এবং কৃষ্ণকে বললেন, “প্রিয় কৃষ্ণ, তুমি কি মনে কর যে তুমি একটা সাধারণ ছেলে? তোমার কি কোন ঘরবাড়ি নেই? সেই সকাল থেকে খেলা করার ফলে তোমার সারা শরীর ধুলো লেগে ময়লা হয়ে গেছে।
এখন চল বাড়ি গিয়ে স্নান করবে। আর তা ছাড়া আজ তোমার জন্মদিন, তাই তোমাকে আজ ব্রাহ্মণদের গাভী দান করতে হবে। তোমার বন্ধুদের দেখ, তাদের মায়েরা তাদের কি রকম সুন্দর করে পরিস্কার করে নানা রকম অলঙ্কার দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন। চল, এখন বাড়ি চল। স্নান করে সুন্দর পোশাক পরো তারপরে আবার এসে খেলতে পারবে।”
এইভাবে মা যশোদা ব্রহ্মা এবং দেবাদিদেব শিব আদি দেবতাদেরও উপাস্য শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরামকে ডেকে নিয়ে গেলেন। তিনি মনে করছিলেন যে, তাঁরা তারই শিশুপুত্র। মা যশোদার দুলাল কৃষ্ণ এবং বলরাম যখন বাড়ি ফিরে এলেন, তখন তিনি তাঁদের খুব ভাল করে স্নান করালেন, এবং নানা রকম অলঙ্কারে ভূষিত করলেন। তারপর ব্রাহ্মণদের ডেকে তাঁর পুত্রের হাত দিয়ে তাঁর জন্মতিথি উপলক্ষ্যে অসংখ্য গাভী দান করলেন। এইভাবে তিনি শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি পালন করলেন।
এই ঘটনার পর নন্দ মহারাজের নেতৃত্বে সমস্ত বৃদ্ধ গোপেরা সমবেত হলেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগলেন, মহাবনে অসুরদের নানা রকম উৎপাত হচ্ছে, সুতরাং এখন কি করা কর্তব্য। সেই সভায় নন্দ মহারাজের ভাই উপানন্দ উপস্থিত ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত অভিজ্ঞ এবং সুপন্ডিত, এবং তিনি ছিলেন কৃষ্ণ ও বলরামের পরম হিতৈষী। তিনি গোপেদের নেতা ছিলেন এবং তিনি সেই সভায় উপস্থিত সকলকে সম্বোধন করে বললেন, “বন্ধুগণ! এখন আমাদের এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাওয়া উচিত, কেননা আমরা দেখছি যে, বরাবর সমস্ত অসুররা এসে নানা রকম উৎপাত করে নানা রকম অশান্তির সৃষ্টি করছে। তারা বিশেষ করে ছোট শিশুদের হত্যা করার চেষ্টা করছে। পূতনা যেভাবে কৃষ্ণকে হত্যা করতে চেয়েছিল, সে কতা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। ভগবান শ্রীহরির কৃপাতেই কেবল কৃষ্ণ সেই রাক্ষসীর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। তারপর তৃণাবর্ত অসুর কৃষ্ণকে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ভগবান শ্রীহরির কৃপায় আমাদের কৃষ্ণ অক্ষত অবস্থায় আমাদের কাছে ফিরে এসেছে, এবং পাথরের উপর পড়ে সেই অসুরটির মৃত্যু হয়েছে। কয়েক দিন আগেই এই শিশুটি দু’টি গাছের মাঝে খেলা করছিল এবং হঠাৎ প্রচন্ডভাবে সেই গাছ দু’টি সমূলে উৎপাটিত হয় এবং সৌভাগ্যক্রমে শিশুটির গায়ে একটি আচঁড়ও লাগেনি। ভগবান শ্রীহরি আবার তাকে রক্ষা করেছেন। এই গাছের নীচে চাপা পড়ে এই শিশুটি এবং তার সঙ্গে ক্রীড়ারত অন্য কোন শিশুর যদি মৃত্যু হত, তা হলে যে কি শোচনীয় অবস্থা হত, তা আপনারা একবার ভেবে দেখুন। এই সমস্ত ঘটনা বিবেচনা করে আমার মনে হয় যে, এখানে থাকা আর নিরাপদ নয়। চলুন, আমরা এখান থেকে চলে যাই। ভগবান শ্রীহরির কৃপায় আমরা নানা রকম দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেয়েছি। এখন আমাদের সাবধান হওয়া উচিত এবং এই জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে বাস করা উচিত, সেখানে আমরা শান্তিতে থাকতে পারব। আমার মনে হয় নতুন ঘাস এবং ওষধিপূর্ণ বৃন্দাবন নামক বনে গিয়ে বসতি স্থাপন করলে সব চাইতে ভাল হবে। সেই স্থানটি আমাদের গোচারণের জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত এবং আমরা সেখানে সপরিবারে খুব শান্তিতে বসবাস করতে পারবো। বৃন্দাবনের কাছেই রয়েছে অতি মনোহর গিরিরাজ গোবর্ধন।
“সেখানে নতুন ঘাস গজিয়েছে। আমাদের পশুগুলি সেখানে অতি আনন্দে চরতে পারবে। সেখানে চলে গেলে আর আমাদের কোন অসুবিধা হবে না।
তাই আমি বলব যেম
এক্ষুনি আমাদের সেই অতীব
রমণীয় বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা উচিত, কেননা এখানে আর সময় নষ্ট করার কোনই কারণ নেই। আসুন, আমরা সকলে আমাদের
গুরুর গাড়িতে সব কিছু গুছিয়ে নিই, এবং গুরুদের সম্মুখভাবে রেখে আমরা যাত্রা
শুরু করি।”
উপানন্দের কথা শুনে, সমস্ত গোপেরা তৎক্ষণাৎ সম্মত হলেন। “চল, এক্ষুনি আমরা সেখানে যাই।” সকলে তখন তাদের গৃহস্থলীর সমস্ত আসবাবপত্র এবং বাসনপত্র গাড়িতে বোঝাই করে নিলেন এবং বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে’ যাত্রা শুরু করলেন।
বৃদ্ধ, শিশু এবং স্ত্রীলোকেরা গাড়িতে করে চললেন এবং ধনুর্বাণ নিয়ে গোপেরা বাড়ির পিছনে পিছনে চলতে লাগলেন। সমস্ত গরু, ষাঁড় এবং বাছুরদের সামনে নিয়ে ধনুর্বাণে সজ্জিত হয়ে শিঙ্গা বাজাতে বাজাতে গোপেরা চললেন। এইভাবে প্রবল শব্দ করতে তাঁরা বৃন্দাবনের দিকে যাত্রা করলেন।
আর ব্রজঙ্গনাদের বর্ণনা কে করতে পারে? তাঁরা সকলেই কৃষ্ণের লীলাসমূহ কীর্তন করছিলেন। মা যশোদা এবং রোহিণী কৃষ্ণ ও বলরামকে কোলে নিয়ে একটা গাড়িতে বসেছিলেন। কৃষ্ণ ও বলরামের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাঁরা গভীর আনন্দে মগ্ন হয়েছিলেন। তখন তাঁদের আনন্দোজ্জ্বল মুখমন্ডল অপ্রাকৃত সৌন্দর্য ধারণ করেছিল।
এইভাবে তাঁরা বৃন্দাবনে পৌছলেন, যেখানে সকলেই নিত্যকাল অত্যন্ত সুখ এবং শান্তিতে বসবাস করে। তাঁরা বৃন্দাবন প্রদক্ষিণ করলেন এবং সমস্ত গাড়িগুলিকে একত্রিত করে রাখলেন।
যমুনার তীরে অপূর্ব সুন্দর গোবর্ধন পর্বত দর্শন করে তাঁরা তাদের বসবাসের জন্য বাড়ি তৈরি করতে লাগলেন। সমবয়সী বালকেরা একত্রে ঘোরাঘুরি করছিল এবং শিশুরা তাদের পিতামাতার সঙ্গে কথা বলছিল। এইভাবে সমস্ত ব্রজবাসীরা গভীর আনন্দে মগ্ন হলেন।
সেই সময় কৃষ্ণ এবং বলরামকে বাছুরদের দেখাশোনা করার ভার দেওয়া হল। গোপবালকদের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে ছোট ছোট বাছুরদের দেখাশোনা করা। শৈশব থেকেই এই বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হত। তাই কৃষ্ণ এবং বলরাম অন্য সমস্ত গোপবালকদের সঙ্গে গোচারণে গিয়ে বাছুরদের চরাতেন এবং তাঁদের খেলার সাথীদের সঙ্গে খেলা করতেন।
বাছুরদের পরিচালনা করতে করতে কখনও দুই ভাই তাঁদের বাঁশি বাজাতেন আর কখনও বা তাঁরা আমলকী বা বেল নিয়ে ছোট্র শিশুরা যেমন বল খেলে সেইভাবে খেলা করতেন। কখনও বা তাঁরা নাচতেন এবং তাঁদের পায়ের নূপুরের মধুর শব্দ হত।
কখনও বা তাঁরা নাচতেন এবং তাঁদের পায়ের নূপুরের মধুর শব্দ হত। কখনও বা গায়ে কম্বল জড়িয়ে তাঁরা গাভী এবং ষাঁড় সেজে খেলা করতেন। এইভাবে কৃষ্ণ আর বলরাম সাথীদের সঙ্গে খেলা করতেন।
এই দুই ভাই কখনও কখনও আবার গাভী এবং ষাঁড়দের শব্দ অনুকরণ করে ষাঁড়ে ষাঁড়ে লড়াইয়ের খেলা করতেন। কখনও বা তাঁরা বিভিন্ন পশুপাখির ডাক অনুকরণ করতেন। এইভাবে তাঁরা সাধারণ মানবশিশুর মতো তাঁদের বাল্যলীলা উপভোগ করেছিলেন।
এইভাবে যখন কৃষ্ণ এবং বলরাম যমুনার তীরে খেলা করছিলেন, তখন ‘বৎসাসুর’ নামে একটি অসুর, কৃষ্ণ এবং বলরামকে বধ করবার জন্য একটি বাছুরের আকৃতি নিয়ে বাছুরের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। কৃষ্ণ কিন্তু তা বুঝতে পেরেছিলেন এবং তিনি তৎক্ষণাৎ সেখানে সেই অসুরের আগমনের কথা বলরামকে বললেন।
দু’ভাই মিলে তখন সন্তর্পণে সেই বৎসাসুরের কাছে গেলেন, এবং কৃষ্ণ তার পিছনের দু’টি পা এবং লেজ ধরে ঘোরাতে ঘোরাতে সজোরে তাকে একটা গাছের উপরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। তাতেই অসুরটি প্রাণ ত্যাগ করে সেই গাছের উপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।
তাতেই অসুরটি প্রাণ ত্যাগ করে সেই গাছের উপর থেকে ভূমিতে নিপতিত হল। কৃষ্ণের খেলার সাথীরা যখন বিগতপ্রাণ অসুরটিকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখল, তখন তারা কৃষ্ণের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে বলতে লাগল, “খুব ভাল হয়েছে! খুব ভাল হয়েছে!”
স্বর্গের দেবতারা তখন মহানন্দে পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন। এইভাবে সমস্ত সৃষ্টির পালক কৃষ্ণ ও বলরাম প্রতিদিন সকালে বৃন্দাবনের গোচারণে বাছুরদের চরাতেন এবং এইভাবে ব্রজের রাখালরূপে তাঁরা তাঁদের বাল্যলীলা উপভোগ করতেন।
সমস্ত গোপবালকেরা প্রতিদিন গোবৎসগুলিকে জল খাওয়াবার জন্য যমুনাতে নিয়ে যেত। বছুরেরা যখন জল খেত, তখন তারাও জল খেত। একদিন যমুনার জল পান করে যখন তারা যমুনার তীরে বসে ছিল, তখন তারা একটা পাহাড়ের মতো বিরাট এক বকপক্ষী দেখতে পেল।
এই অদ্ভুতদর্শন জন্তুটিকে দেখে তারা অত্যন্ত ভীত হল। আসলে এটি ছিল বক পক্ষীর রূপধারী ‘বকাসুর’ নামক কংসের এক বন্ধু। সহসা সেই মহাদৈত্য তার তীক্ষ্ম চঞ্চু দিয়ে কৃষ্ণকে আক্রমণ করে তাঁকে গিলে ফেলল। এইভাবে কৃষ্ণকে গিলে ফেলতে দেখে বলদেব সহ সমস্ত বালকেরা মৃতবৎ অচেতন হয়ে পড়ল। বকাসুর যখন কৃষ্ণকে গিলতে যাচ্ছিল, তখন সে তার গলায় একটা প্রচন্ড জালা অনুভব করল।
কৃষ্ণের দেহনির্গত রশ্মিচ্ছটার প্রভাবে তারা গলা পড়ে গেল। অসুরটি তাড়াতিাড়ি কৃষ্ণকে তার মুখ থেকে ফেলে দিল এবং তার সুতীক্ষ্ম চঞ্চু দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাঁকে মারবার চেষ্টা করতে লাগল।
বকাসুর জানত না যে, যদিও কৃষ্ণ নন্দ মহারাজের শিশুপুত্ররূপৈ লীলাবিলাস করছিলেন, তবুও তিনি ছিলেন ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা- ব্রহ্মার আদি পিতা পরমেশ্বর ভগবান।
সমস্ত দেবতাদের আনন্দের উৎস এবং সাধুদের পরিত্রাণকারী যশোদানন্দন তখন পর্বতাকৃতি বকপক্ষীটির চঞ্চু ধরে, তাঁর সমস্ত গোপবালক সাথীদের সামনে, একটি শিশু যেমন অনায়াসে একটি ঘাসকে দ্বিধাবিভক্ত করে ছিঁড়ে ফেলে, ঠিক সেইভাবে তার মুখটা চিরে ফেলল।
স্বর্গলোকবাসীরা আকাশ থেকে বকবিনাশক শ্রীকৃষ্ণের উপর নন্দনবনজাত মল্লিকাপুষ্প বর্ষণ করলেন এবং দুন্দুভি ও শ্ঙ্খধ্বনি করে স্তোত্রদ্বারা তাঁরা স্তব করতে লাগলেন।
গোপবালকেরা যখন পুষ্পবৃষ্টি হতে দেখল, এবং দিব্য বাদ্যসহ দেবতাদের মধুর স্তব শুনতে পেল, তখন তারা অত্যন্ত বিস্মিত হল। কৃষ্ণকে অক্ষত অবস্থায় দেখে, বলরাম সহ তারা সকলে এত আনন্দিত হল যে, মনে হল যেন তরা নবজীবন লাভ করেছে। কৃষ্ণকে তাদের কাছে আসতে দেখে তারা সকলে একে একে সেই নন্দনন্দকে আলিঙ্গন করে তাদের বুকে ধরে রাখল। তারপর তারা সমস্ত গোবৎসদের একত্রিত করে ঘরে ফিরে গেল।
গৃহে ফিরে তারা নন্দদুলালের অদ্ভুত কার্যকলাপ সম্বন্ধে সকলকে বলতে লাগল। যখন সমস্ত গোপ এবং গোপিকারা শিশুদের কাছ থেকে সেই ঘটনার বর্ণনা শুনলেন, তখন তাঁরা অত্যন্ত আনন্দিত হলেন।
কেননা তাঁরা সকলেই কৃষ্ণকে তাঁদের স্নেহ আরও বর্ধিত হল। কৃষ্ণ যে আবার মৃত্যুমুখ থেকে উদ্ধার পেয়েছে, সেই কথা চিন্তা করে তাঁরা গভীর স্নেহ ও ভালবাসার সঙ্গে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তাঁরা সকলেই খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু তবুও কৃষ্ণের মুখমন্ডল থেকে তাঁরা তাঁদের দৃষ্টি ফেরাতে পারলেন না, এবং গোপিকারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন যে, অসুর কতভাবে কতবার শিশু কৃষ্ণকে আক্রমণ করেছে, তবুও তারা কৃষ্ণের কোন অনিষ্ট করতে পারেনি, উল্টে তারাই একে একে নিহত হয়েছে।
তাঁরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন, কিভাবে কত অসুর তাদের দুর্ধর্ষ শরীর নিয়ে কৃষ্ণকে হত্যা করবার জন্য তাঁকে আক্রমণ করেছে, কিন্তু ভগবান শ্রীহরির কৃপায় তারা কৃষ্ণের শরীরে একটা আঁচড় পর্যন্ত কাটতে পারেনি।
পক্ষান্তরে, একটা ক্ষুদ্র পতঙ্গ যেমন আগুনে পড়ে মরে যায়, ঠিক সেইভাবে তারা একে একে নিহত হয়েছে। বেদজ্ঞ এবং জ্যোতিষশাস্ত্র বিশারদ গর্গ মুনির কথা তাঁদের মনে পড়ে গেল, যিনি বলেছিলেন যে, অসুরেরা এই বালকটি অনিষ্ট সাধন করবার চেষ্টা করবে। এখন তাঁরা দেখলেন যে, তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়ে যাচ্ছে।
নন্দ মহারাজসহ সমস্ত প্রবীণ গোপেরা কৃষ্ণ এবং বলরামের অদ্ভুত সমস্ত কার্যকলাপের কথা বলাবলি করতেন এবং সেই আলোচনায় তাঁরা এতই মগ্ন হয়ে থাকতেন যে, তাঁরা এই জড় জগতের ত্রিতাপ দুঃখের কথা সম্পূর্ণভাবে ভুলে যেতেন। এটাই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃতের প্রভাব।
কৃষ্ণের চিন্তায় মগ্ন থেকে, আজ থেকে ৫০০০ বছর আগে, নন্দ মহারাজ যে আনন্দ উপভোগ করেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণের দিব্য লীলাবিলাসের কাহিনী আলোচনা করে আজও আমরা সেই আনন্দ উপভোগ করতে পারি।
শ্রীরামচন্দ্রের জন্য বানরেরা যে সেতু তৈরি করেছিল, এবং হনুমান যে লাফ দিয়ে সমুদ্র পার হয়ে লঙ্কায় গিয়েছিল, তার অনুকরণে কৃষ্ণ এবং বলরাম তাঁদের সাথীদের সঙ্গে খেলা করে তাঁদের বাল্য লীলাবিলাস করেছিলেন।
আরও পড়ুন