কালীয় দমন-কৃষ্ণ লীলা- শ্রীমদ্ভভাগবত বাংলা
কালীয় দমন-কৃষ্ণলীলা কথা
শ্রীকৃষ্ণ যখন বুঝতে পারলেন যে, কালীয় সাপের বিষে যমুনার জল দুষিত হয়েছে, তখন তার প্রতিবিধান করার জন্য সেই সম্পর্কে তিনি সেখান থেকে নির্বাসন দিলেন; এবং এইভাবে সেই জলকে তিনি বিশুদ্ধ করলেন।
শুকদেব গােস্বামী যখন এই ঘটনা বর্ণনা করছিলেন, মহারাজ পরীক্ষিৎ তখন শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা শ্রবণ করার জন্য আকুল হয়ে উঠলেন। তিনি শুকদেব গােস্বামীকে জিজ্ঞাসা করলেন, সেই জলে বহু বছর ধরে বাস করেছিল যে কালীয় সর্প, শ্রীকৃষ্ণ কিভাবে তাকে দণ্ড দিয়েছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলা শ্রবণ করতে করতে মহারাজ পরীক্ষিতের উৎসাহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তাই গভীর আগ্রহের সঙ্গে তিনি সেই কথা জিজ্ঞাসা করলেন।
(শ্রীমদ্ভাগবত-শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলা এন্ড্রয়েড অ্যাপ ডাউনলোড করুন)
শুকদেব গােস্বামী বললেন, সেই যমুনা নদীর মধ্যে এক হ্রদ ছিল, ভীষণ সর্প কালীয় সেই হ্রদে বাস করত। তার ভয়ঙ্কর বিষের প্রভাবে চারদিক এত বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল যে, সেখান থেকে চব্বিশ ঘণ্টা বিষবাষ্প উত্থিত হত।
সেই হ্রদের উপর দিয়ে যখন কোন পাখি উড়ে যেত, সেই বিষের প্রভাবে সে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হত। এই বিষাক্ত বাষ্পের প্রভাবে যমুনার তীরবর্তী সমস্ত গাছপালা এবং ঘাস শুকিয়ে গিয়েছিল।
শ্রীকৃষ্ণ সেই ভীষণ সর্পের বিষের প্রভাব দর্শন করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, বৃন্দাবনের সামনে দিয়ে বয়ে চলছে যে যমুনা, তার সমস্ত জল বিষাক্ত হয়ে গেছে।
সমস্ত দুষ্কৃতকারীদের হত্যা করবার জন্য আবির্ভূত হয়েছেন যে-কৃষ্ণ, তিনি তৎক্ষণাৎ যমুনার তীরবর্তী একটি মস্ত্ব বড় কদম্ব বৃক্ষে আরােহণ করলেন।
সেই গাছের একেবারে উপরে উঠে তিনি তাঁর ধুতিটাকে ভাল করে কোমরে বেঁধে নিলেন। একজন কুস্তিগীরের মতাে হাত দিয়ে বাহতে আঘাত করতে করতে সেই অতি উচ্চ বৃক্ষ থেকে তিনি বিষময় হ্রদে ঝাপ দিলেন।
যে কদম্ব বৃক্ষটি থেকে শ্রীকৃষ্ণ ঝপ দিয়েছিলেন, সেইটি ছিল সেখানে একমাত্র বৃক্ষ যা তখনও মরে যায়নি। কোন কোন ভাষ্যকার বলেন যে, শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মের স্পর্শ লাভ করার ফলে বৃক্ষটি তৎক্ষণাৎ পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল।
অন্য কোনও পুরাণে বলা হয়েছে যে, বিষ্ণুর বাহন গরুড় জানতেন যে, ভবিষ্যতে শ্রীকৃষ্ণ এইভাবে লীলাবিলাস করবেন। তাই সেই গাছটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তিনি তাতে কিছু অমৃত ঢেলে দিয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ যখন ঝাপ দিয়ে জলে পড়লেন, তখন নদীর জল দু'কূল ছাপিয়ে উঠল, যেন বিরাট কিছু তাতে পতিত হয়েছে।
শ্রীকৃষ্ণের পক্ষে এই শক্তি প্রদর্শন মােটেই অস্বাভাবিক নয়, কেননা তিনিই হচ্ছেন সমস্ত শক্তির উৎস। শ্রীকৃষ্ণ যখন এক বিশাল মত্ত হস্তীর মতাে প্রচণ্ড শব্দ করতে করতে সেই জলে সাঁতার কাটতে লাগলেন, ভয়ঙ্কর কালীয় সর্প তা শুনতে পেল।
সেই প্রচণ্ড শব্দ তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠল এবং সে বুঝতে পারল যে, কেউ তার গৃহ আক্রমণ করার আয়ােজন করছে। সে তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে বেরিয়ে এসে শ্রীকৃষ্ণের সম্মুখীন হল।
কালীয় দেখল, শ্রীকৃষ্ণের দেহ এত কোমল এবং সুন্দর যে, তা দর্শনীয়ই বটে। তার অঙ্গকান্তি বর্ষার জলভরা মেঘের মতাে, তাঁর পদযুগল পদ্মফুলের মতাে, তিনি শ্রীবৎস মণিমাণিক্য এবং পীতবসনে ভূষিত, তার অপূর্ব সুন্দর মুখমণ্ডল শরৎকালের সকালের মতাে হাস্যোজ্জ্বল, এবং প্রচণ্ড শক্তিতে তিনি যমুনার জলে ক্রীড়ারত।
শ্রীকৃষ্ণের এই অপূর্ব সুন্দর রূপ দর্শন করা সত্ত্বেও কালীয় তার হৃদয়ে প্রচণ্ড ক্রোধ অনুভব করল এবং তার দেহের দ্বারা সে তৎক্ষণাৎ কৃষ্ণকে বেষ্টন করল।
গোপবালকরা শ্রীকৃষ্ণের কালীয়ের দেহের দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং নিশ্চেষ্ট দেখে অত্যন্ত আর্ত হয়ে, দুঃখ, অনুশােচনা এবং ভয়ে হতচেতন হয়ে ভূতলে পতিত হল। ধেনু, বৃষ এবং বৎসরাও কৃষ্ণের এই অবস্থা দেখে দুঃখ এবং ভয়ে রােদন করতে লাগল।
তখন নানা রকম অশুভ ইঙ্গিত দেখা যেতে লাগল। ব্রজে তখন ভূমিকম্প হল, আকাশে উল্কাপাত হতে দেখা যেতে লাগল। শরীরের বাম অঙ্গ কম্পন প্রভৃতি আসন্ন ভয়সূচক নানা রকম ইঙ্গিত দেখা যেতে লাগল।
এই সমস্ত অশুভ ইঙ্গিত দেখে নন্দ মহারাজ প্রমুখ গােপবৃন্দ ভয়ে ও উৎকণ্ঠায় অত্যন্ত অধীর হয়ে পড়লেন। সেই সময় তাঁরা জানতে পারলেন যে, সেদিন বলদেবকে ছাড়াই কৃষ্ণ গােচারণে গমন করেছেন।
যখনই নন্দ মহারাজ, মা যশােদা এবং গােপেরা তা শুনলেন, তখন তারা আরও বেশি করে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়লেন। কৃষ্ণের প্রতি তাঁদের অনুরাগের ফলে তাঁরা শােক ও উৎকণ্ঠায় মুহ্যমান হয়ে পড়লেন,
কেননা কৃষ্ণের থেকে প্রিয়তম তাদের আর কিছুই ছিল না এবং কৃষ্ণকেই তাঁরা তাঁদের জীবন তাঁদের দেহ, স্নেহ, মমতা, মন, বুদ্ধি সব কিছু অর্পণ করেছিলেন। কৃষ্ণের প্রতি তাদের এই গভীর আসক্তির ফলে তারা ভাবলেন, আজ নিশ্চয়ই আমাদের কৃষ্ণকে আমরা হারাব!”
বৃন্দাবনের সমস্ত অধিবাসীরা শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে ছুটে এলেন। শিশু, যুবক, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, পশু এবং অন্য সমস্ত জীব এইভাবে কৃষ্ণের জন্য আকুল হয়ে সমবেত হয়েছিলেন। তারা জানতেন যে, তাদের জীবনধারণের একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে কৃষ্ণ।
কৃষ্ণের প্রভাব সম্বন্ধে অভিজ্ঞ ভগবান বলদেব সমস্ত ব্রজবাসীদের এইভাবে কাতর হতে দেখে ঈষৎ হাস্য করেছিলেন, কিন্তু তিনি মুখে কিছুই বলেননি। তিনি জানতেন যে, তাঁর ছােট ভাই কৃষ্ণ কত বলবান এবং এই জড় জগতে একজন সাধারণ সর্পের সঙ্গে কৃষ্ণ যুদ্ধ করছে বলে উৎকষ্ঠিত হওয়ার কোন কারণ নেই।
তাই তিনি ব্যক্তিগতভাবে এতে কোন অংশগ্রহণ করলেন না। সমস্ত ব্রজবাসীরা তখন কৃষ্ণের শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম চিহ্নযুক্ত পদচিহ্ন অনুসরণ করতে করতে যমুনার তীরে এসে উপস্থিত হলেন এবং সেখানে দেখলেন যে, যমুনার জলে কালীয় সর্পের বেষ্টনে কৃষ্ণ অসহায় অবস্থায় আবদ্ধ হয়ে আছে,
এবং তাঁর এই অবস্থা দেখে সমস্ত বালকেরা এবং গাভীরা ক্রন্দন করছে। তখন তারা শােকে আরও মুহ্যমান হয়ে পড়লেন। তাদের এইভাবে শােক করতে দেখে বলরাম স্মিত হাসি হাসলেন।
সমস্ত ব্রজবাসীরা তখন দুঃখ সাগরে মগ্ন হয়েছিলেন, কেননা তাঁরা মনে করেছিলেন যে, কৃষ্ণ মারা গেছেন। বৃন্দাবনের অধিবাসীরা যদিও জানতেন যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, কিন্তু তাঁর প্রতি তাদের ভালবাসা ছিল অসীম।
যখন তারা দেখলেন যে, যমুনায় কালীয় সর্পের বেষ্টনে আবদ্ধ হয়ে কৃষ্ণ মৃতের মতাে নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছেন, তারা তখন কেবল কৃষ্ণের সখ্যের কথা, তাঁর হাস্যোজ্জ্বল সুন্দর মুখ, তাঁর মধুর বচন এবং তাদের সঙ্গে তার নানা রকম ব্যবহারের কথা মনে করতে লাগলেন।
সেই সমস্ত কথা মনে করে এবং কালীয় সর্পের বেষ্টনে আবদ্ধ কৃষ্ণকে দেখে তাদের মনে হল যে, সমস্ত জগৎ যেন শূন্য হয়ে গেছে।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও বলেছেন, 'শূন্যায়িতং জগৎ সর্ব গােবিন্দবিরহেন মেহে গােবিন্দ, তােমার বিরহে সমস্ত জগৎ শূন্য বলে মনে হচ্ছে। এটিই হচ্ছে কৃষ্ণভক্তির সর্বোচ্চ স্তর। বৃন্দাবনের অধিবাসীরা প্রায় সকলেই সর্বোচ্চ স্তরের কৃষ্ণপ্রেম লাভ করেছিলেন।
মা যশােদা এসেই যমুনায় ঝাপ দিতে চাইলেন। কিন্তু তাঁকে যখন বাধা দেওয়া হল, তখন তিনি মুচ্ছিত হয়ে পড়লেন।
অন্য যে সমস্ত আত্মীয়েরা সমভাবে শােকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন, তাদের চোখ দিয়ে বর্ষার ধারার মতাে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল এবং মা যশােদার চেতনা ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁরা উচ্চস্বরে কৃষ্ণের লীলা সমূহ কীর্তন করতে লাগলেন।
মা যশোদা মৃতের মতাে নিশ্চল হয়ে পড়েছিলেন, কেননা তার সমস্ত চেতনা কৃষ্ণের মুখারবিন্দে একাগ্রীভূত হয়েছিল।
নন্দ মহারাজ এবং অন্য সকলে, যাঁরা তাদের প্রাণ পর্যন্ত কৃষ্ণকে নিবেদন করেছিলেন, তারাও কৃষ্ণকে উদ্ধার করার জন্য যমুনায় প্রবেশ করতে চাইলেন। কিন্তু বলরাম তাঁদের বাধা দিলেন, কেননা তিনি জানতেন যে, কৃষ্ণের কোন বিপদের সম্ভাবনাই নেই।
কৃষ্ণ দু'ঘণ্টা ধরে কালীয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একটি সাধারণ শিশুর মতাে সেখানে পড়ে রইলেন। কিন্তু যখন তিনি দেখলেন যে, তার মা, বাবা, গােপিকা, গােপ শিশু, গাভী আদি সমস্ত গােকুলের অধিবাসীরা মৃতবৎ হয়ে পড়েছেন এবং অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর থেকে রক্ষা পাওয়ার মতাে কোন আশ্রয় তাঁদের নেই, তিনি তখন নিজেকে সেই সর্পের বন্ধন থেকে মুক্ত করলেন।
তিনি তার দেহটিকে বর্ধিত করতে লাগলেন এবং সর্পটি যখন তাকে ধরে রাখবার চেষ্টা করল, তখন সে প্রচণ্ড ভার অনুভব করল। সেই ভারের ফলে তার অঙ্গ শিথিল হয়ে গেল এবং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তার বন্ধন থেকে মুক্ত করা ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না।
কালীয় তখন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল এবং সে তার ফণা বিস্তার করল। তার নাসারন্ধ্র দিয়ে সে তখন বিষ উদ্গীরণ করতে লাগল, তার চোখগুলি আগুনের মতাে জ্বলতে লাগল এবং তার মুখ দিয়ে আগুন বেরােতে লাগল। সেই বিরাট সর্পটি কিছুক্ষণ শ্রীকৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে রইল।
দ্বিধাবিভক্ত জিহ্বা দিয়ে ওপ্রান্ত লেহন করতে লাগল এবং তার সেই দৃষ্টি ছিল বিষময়। গরুড় যেমন সাপের উপর ঝাপিয়ে পড়ে, কৃষ্ণ তেমনই তার উপর ঝাপিয়ে পড়লেন। এইভাবে আক্রান্ত হয়ে কালীয় তাঁকে দংশন করার সুযােগ খুঁজতে লাগল।
কিন্তু কৃষ্ণ এত দ্রুতগতিতে তার চারদিকে ঘুরতে লাগলেন যে, কৃষ্ণকে দংশন করার সমস্ত চেষ্টা তার ব্যর্থ হল। কৃষ্ণকে দংশন করবার এবং ধরবার চেষ্টায় ছুটাছুটি করে কালীয় অত্যন্ত অবসন্ন হয়ে পড়ল এবং তার মনে হল যে, তার সমস্ত শক্তিই যেন ক্ষয় হয়ে গেছে।
কৃষ্ণ তখন সেই সাপের ফণার উপর লাফিয়ে উঠলেন। সেই সাপের মাথার সমস্ত মণিমাণিক্যের দ্যুতিতে কৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্ম রক্তিম হয়ে উঠল।
তারপর সমস্ত শিল্পকলার আদি শিল্পী শ্রীকৃষ্ণ সেই সাপের মাথার উপর নাচতে লাগলেন। তা দেখে স্বর্গের দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন এবং নানা রকম বাদ্যযন্ত্র বাজাতে লাগলেন। এইভাবে গন্ধর্ব, সিদ্ধ এবং দেবতারা আনন্দসাগরে মগ্ন হলেন।
কৃষ্ণ যখন কালীয়ের মাথার উপরে নাচছিলেন, কালীয় তখন তার অন্য ফণা দিয়ে তাকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছিল।
কালীয়ের মাথায় প্রায় একশ ফণা ছিল, কিন্তু কৃষ্ণ তার সেই সমস্ত ফণাগুলিকে দমন করলেন। তিনি তার শ্রীপাদপদ্ম দিয়ে কালীয়ের মাথায় আঘাত করতে লাগলেন। কালীয়ের পক্ষে তা সহ্য করা সম্ভব হল না।
অচিরেই তার জীবন বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হল। সে বিষ বমন করতে লাগল এবং অগ্নি উদগীরণ করতে লাগল। এইভাবে তার ভেতরের সমস্ত বিষ বমন করে কালীয়ের পাপময় অস্তিত্ব ক্ষীণ হয়ে এল। ক্রোধে অধীর হয়ে সে তার জীবনরক্ষার চেষ্টা করতে লাগল এবং একটি ফণা তুলে ভগবানকে দংশন করার চেষ্টা করতে লাগল।
কৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ সেই ফণাটির উপরে পদাঘাত করে নাচতে লাগলেন। তা দেখে মনে হল, কালীয় যেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করছে। তার মুখনিঃসৃত বিষকে মনে হল যেন ফুলের নৈবেদ্য।
অবশেষে কালীয় বিষের পরিবর্তে রক্ত বমন করতে শুরু করল। সে তখন সম্পূর্ণ অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। ভগবানের পদাঘাতে তার সমস্ত শরীর চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
সে মনে মনে বুঝতে পেরেছিল যে, শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সর্বলােক-মহেশ্বর পরমেশ্বর ভগবান এবং সে তখন তাঁর কাছে আত্মনিবেদন করতে শুরু করল। কালীয়ের পত্নীরা দেখল যে, যার গর্ভে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড বিরাজ করে, সেই পরমেশ্বর ভগবানের পদাঘাতে তাদের পতির প্রাণান্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সেই নাগপত্নীরা তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্তব করতে শুরু করল। তাদের বসন-ভূষণ ও কেশবন্ধন শিথিল হয়ে পড়েছিল। তারা পুরাণ- পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের সম্মুখে উপস্থিত হল। তারপর সেই উদ্বিগ্নচিত্তা সাধ্বী নাগপত্নীরা নিজ শিশুদের অগ্রবর্তী করে কৃতাঞ্জলিপুটে পাপী স্বামীর মুক্তির কামনায় সমস্ত জীবের ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হয়ে ভূতলে নিপতিত হয়ে প্রণাম করল।
নাগপত্নীরা বলতে লাগল, "হে দেব, আপনি সকলের প্রতি সম-দৃষ্টিসম্পন্ন। আপনার কাছে আপনার পুত্র, বন্ধু বা শত্রুর কোন বিভেদ নেই।
তাই যে শাস্তি অত্যন্ত কৃপাপরবশ হয়ে আপনি কালীয়কে দিয়েছেন, তা উপযুক্তই হয়েছে। হে ভগবান, দুষ্ট দমনের জন্যই আপনি ভূতলে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং যেহেতু আপনিই হচ্ছেন পরমতত্ত্ব, তাই আপনার করুণা বা দণ্ডের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
আমরা তাই মনে করি, কালীয়কে আপনি যে দণ্ড দিয়েছেন, তা প্রকৃতপক্ষে তার প্রতি আপনার আশীর্বাদ। আপনার এই শাস্তিকে আমরা আমাদের প্রতি আপনার বিশেষ অনুগ্রহ বলেই মনে করছি, কেননা আপনি যখন কাউকে দণ্ড দান করেন, তখন তার পাপ মােচন হয়।
বিশেষত পাপের ফলে সর্পত্ব প্রাপ্ত আমাদের স্বামী কালীয়র মাথায় নৃত্য করার ফলে তার পাপ মােচন হয়েছে। তাই আপনি যে তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে এভাবে তাকে দণ্ড দিয়েছেন, তাতে ভালই হয়েছে।
তবে, এই সর্পের প্রতি আপনাকে এভাবে কৃপাপরবশ হতে দেখে আমরা অত্যন্ত আশ্চর্য হয়েছি। সে নিশ্চয়ই তার পূর্বজন্মে নানা রকম ধর্ম-অনুষ্ঠান করেছিল।
তার তপশ্চর্যা এবং সাধনার ফলে সকলে নিশ্চয়ই তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছিল এবং সে নিশ্চয়ই সমস্ত জগৎবাসীর কল্যাণের জন্য নানা রকম ধর্ম অনুষ্ঠান করেছিল।” নাগপত্নীদের এই কথায় বােঝা যায় যে, পূর্বজন্মকৃত সুকৃতি না থাকলে শ্রীকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসা যায় না।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষাষ্টক উপদেশ দিয়েছেন, তৃণের থেকেও সহিষ্ণু হয়ে কোন রকমের সম্মান আশা না করে এবং সকলকে সম্মান দান করে নিরন্তর হরে কৃষ্ণ' মহামন্ত্র কীর্তন করতে।
নাগপত্নীরা আশ্চর্য হয়েছিলেন যে, জঘন্যতম পাপ কার্য করার ফলে কালীয় যদিও সর্পত্ব প্রাপ্ত হয়েছিল, তবুও সে ভগবানের সংস্পর্শে এসেছিল এবং শুধু তাই নয়, ভগবান।
তাঁর শ্রীপাদপদ্ম দিয়ে তার মস্তক স্পর্শ করেছিলেন। এটা কোন সাধারণ পুণ্যের ফল নয়। এই দু'টি আপাতবিরােধী তত্ত্ব তাদের বিস্ময়ান্বিত করেছিল। তাই তারা প্রার্থনা করল, “হে প্রিয় প্রভু, আপনার শ্রীপাদপদ্মের ধূলি তার মস্তকে ধারণ করার সৌভাগ্য দেখে আমরা বিস্ময়ান্বিত হয়েছি।
মহাত্মারা এই সৌভাগ্য কামনা করে থাকেন। এমন কি, আপনার এই পদধূলি পাওয়ার জন্য লক্ষ্মীদেবী পর্যন্ত সব কিছু পরিত্যাগ করে ব্রতশীলা হয়ে তপস্যা করেছিলেন।
এই কালীয় কোন্ পুণ্যপ্রভাবে সেই চরণরেণু লাভের অধিকারী হল, তা আমরা বুঝতে পারছি না। মহাজনদের কাছে আমরা শুনেছি যে, যারা আপনার শ্রীপাদপদ্মের ধূলিকণার দ্বারা মহিমান্বিত হয়েছে, তারা স্বর্গলোক, সার্বভৌম পদ, ব্রহ্মা পদ, পৃথিবীর আধিপত্য, যােগসিদ্ধি কিংবা মােক্ষ বাসনা করে না।
হে প্রভু, যে পদরজ বাঞ্ছা করে সংসারচক্রে ভ্রমণশীল মানুষেরাও উৎকৃষ্ট ফল লাভ করে থাকে, ক্রোধপরবশ তমােগুণােত্তূত এই সর্পরাজ ব্রহ্মারও দুর্লভ সেই পদরজ প্রাপ্ত হয়েছে।
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত বলা হয়েছে, ব্রহ্মাণ্ড ভ্রমিতে কোন ভাগ্যবান জীব/গুরু কৃষ্ণ প্রসাদে পায় ভক্তিলতা বীজ। এইভাবে গুরু এবং কৃষ্ণের প্রসাদে মুক্তির পথ প্রশস্ত হয়।
নাগপত্নীরা বললেন, “আমরা তাই আপনার শ্রীপাদপদ্মে আমাদের প্রণতি জানাই। হে প্রাণনাথ, যেহেতু আপনিই হচ্ছেন পরমপুরুষ, তাই পরমাত্মা রূপে আপনি সকলেরই হৃদয়ে বিরাজ করেন।
যদিও আপনি জড় সৃষ্টির অতীত, তবুও সব কিছুই আপনাকে আশ্রয় করে বিবাজ করছে। আপনিই হচ্ছেন অনন্তকাল।
কালশক্তি আপনাতেই অবস্থান করছে এবং তাই অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যরুপী কালের আপনিই হচ্ছেন দ্রষ্টা। হে ভগবান, প্রতি মুহূর্তে, প্রতি ঘণ্টায়, প্রতিদিন, প্রতি বৎসর, অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতে যা কিছু ঘটছে, তা সবই পূর্ণকূপে আপনি দর্শন করেন।
অচিন্ত্যভাবে এই জড় জগতের সঙ্গে আপনার ভেদ এবং অভেদ বর্তমান। তাই আমরা আপনাকে আমাদের প্রণতি জানাই। আপনি হচ্ছেন সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড এবং আপনিই আবার সেই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা।
আপনি এই ব্রহ্মাণ্ডের অধ্যক্ষ ও পালনকর্তা এবং আপনিই হচ্ছেন তার আদি কারণ। যদিও আপনি আপনার তিন গুণাবতার ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বররূপে এই ব্রহ্মাণ্ডে বর্তমান তবুও আপনি এই জড় সৃষ্টির অতীত।
যদিও আপনিই হচ্ছেন সমস্ত জীবের, ইন্দ্রিয়ের, জীবনের, মনের, বুদ্ধির আর্বিভাবের কারণ আপনার অন্তরঙ্গা শক্তির দ্বারাই কেবল আপনাকে অনুভব করা যায়। তাই আমরা আপনাকে আমাদের প্রণতি জানাই।
আপনি অন্তহীন, আপনি সুক্ষ্মতম থেকেও সুক্ষ্মতর, আপনি সমস্ত সৃষ্টির কেন্দ্র এবং সব কিছুরই জ্ঞাতা। বিভিন্ন দার্শনিক আপনাকে জানবার চেষ্টা করে, আপনিই হচ্ছেন সমস্ত দর্শনের পরম উদ্দেশ্য এবং সমস্ত দার্শনিক মতবাদ প্রকৃতপক্ষে আপনাকেই বর্ণনা করছে।
আমরা আপনার শ্রীপাদপদ্মে আমাদের প্রণতি জানাই, কেননা আপনিই হচ্ছেন সমস্ত শাস্ত্রের মূল কারণ এবং সমস্ত জ্ঞানের উৎস। আপনিই হচ্ছেন সমস্ত প্রমাণের মুল, এবং আপনিই হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, যিনি পরম জ্ঞান প্রদান করতে পারেন।
আপনিই হচ্ছেন সমস্ত বাসনার কারণ, এবং আপনিই হচ্ছেন সমস্ত জ্ঞানের উৎস। আপনিই হচ্ছেন। মূর্তিমান বেদ। তাই আমরা আপনাকে প্রণতি জানাই।
“হে প্রিয় প্রভু, আপনি হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং আপনিই হচ্ছেন পরম ভোক্তা। এখন আপনি মূর্তিমান শুদ্ধসত্ত্ব বসুদেবের সন্তানরূপে আবির্ভূত হয়েছেন।
আপনিই হচ্ছেন বুদ্ধির অধিষ্ঠাতা প্রদ্যুম্ন অনিরুদ্ধ, এবং আপনিই হচ্ছেন সমস্ত বৈষ্ণবের ঈশ্বর। বাসুদেব, অনিরুদ্ধ, প্রদ্যুম্ন আপনিই হচ্ছেন এবং বুদ্ধির বিকাশের কারণ।
আপনার কার্যকলাপের ফলেই কেবল জীব বিস্মৃতির দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে অথবা তাদের স্বরূপ সম্বন্ধে অবগত হয়। এই সম্বন্ধে বলা হয়েছে, চাহং হৃদি সন্নিবিষ্ট ভগবান সকলেরই হৃদয়ে বিরাজ করছেন এবং তিনিই স্মৃতি দান করেন জ্ঞান ও অপহরণ করে (১৫/১৫)।
আমরা বুঝতে পারছি যে, আমাদের সকলের হৃদয়ে সাক্ষীরূপে বিরাজ করে আপনি আমাদের সমস্ত কার্যকলাপ দর্শন করছেন কিন্তু তবুও আপনার উপস্থিতি উপলব্ধি করা অত্যন্ত কঠিন।
আপনি জড়া এবং পরা প্রকৃতির পরম নিয়ন্তা, তাই আপনিই হচ্ছেন পরম পরিচালক, যদিও আপনি এই জড় সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আপনি হচ্ছেন সাক্ষী শ্রষ্টা এবং এই জড় সৃষ্টির উপাদান, তাই আমরা আপনাকে আমাদের প্রণতি জানাই। প্রিয় নাথ, এই সৃষ্টির ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে আপনি কিছুই করেন না।
আপনার বিভিন্ন শক্তি প্রকাশ করে যথা সত্ত্ব, রজ, তম গুণের প্রকাশ করে আপনি সৃষ্টি করেন, পালন করেন এবং বিনাশ করেন।
কালের নিয়ন্তারূপে আপনি জড়া প্রকৃতির প্রতি ঈক্ষণ করেন, তার ফলে এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রকাশ হয়, জড়া প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির প্রকাশ হয়, যা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জীবকে কার্যকরী করে।
তাই কিভাবে এই জগতে আপনার কার্যকলাপ হয়, কেউ অনুমান করতে পারে না। হে ভগবান, এই ব্রহ্মাণ্ডে আপনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর রুপে আবির্ভূত হয়ে সৃষ্টি, স্থিতি এবং বিনাশের কার্য সম্পাদন করেন।
বিষ্ণুমূর্তি আপনার আবির্ভাব জীবের মঙ্গল সাধনের জন্য। তাই যারা প্রকৃতই শান্তিপ্রিয় এবং পরম আকুল হন, তারা আপনার শান্তিময় উপাসনা করেন। হে ভগবান, আপনার শ্রীপাদপদ্মে আমাদের প্রার্থনা জানাই।
আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, এই হতভাগা সর্পটির প্রাণ যায়-যায় অবস্থা। আপনি জানেন যে, স্ত্রীদের পক্ষে তাদের পতিই হচ্ছে সব, তাই আমরা আপনাকে প্রার্থনা করি যে, আপনি কৃপা করে কালীয়কে ক্ষমা করে দিন, কেননা যদি এর মৃত্যু হয়, তা হলে আমাদের দুর্দশার অন্ত থাকবে না।
আমাদের মুখ চেয়ে কৃপা করে আপনি এই মহা অপরাধীকে ক্ষমা করুন। “হে প্রিয় ভগবান, প্রতিটি জীবই হচ্ছে আপনার সন্তান এবং আপনি সকলকেই পালন করেন।
এই আপনার সন্তান এবং যদিও আপনার শক্তি সম্বন্ধে অবগত না থাকার ফলে আপনার চরণে অপরাধ করেছে, আপনি কৃপা করে একে ক্ষমা করে দিন। আমরা প্রার্থনা করি যে, এবারের মতাে আপনি তাকে ক্ষমা করে দিন। ভগবান, আমরা সকলেই আপনার নিত্য সেবক, তাই প্রেমভরে আমরা আপনার সেবা করার প্রয়াসী।
নাগপত্নীরা এইভাবে স্তব করলে ভগবান পদাঘাতে ভগ্নমস্তক এবং কালীয়কে পরিত্যাগ করলেন। দুর্বল কালীয় ধীরে ধীরে একটু শক্তি সঞ্চয় করে অতি কষ্টে নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করে কৃতাঞ্জলি সহকারে শ্রীকৃষ্ণকে বলতে লাগল,
“হে নাথ, আমরা সর্পজাতি, তমােগুণের অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রদেশে জন্ম হওয়ার ফলে আমরা খল, তমােপ্রকৃতি এবং ক্রোধশীল।
প্রভু, আপনি জানেন যে, জীব যদিও তার স্বভাবের বশবর্তী হয়েই একদেহ থেকে অন্য দেহে দেহান্তরিত হয়, তবুও সেই স্বভাব পরিত্যাগ করা অত্যন্ত কঠিন বলা হয় কিন্তু কেউ যদি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হয়, তখন জড়া প্রকৃতির গুণগুলি তার ওপর কার্যকরী হয় না।
কালীয় বলতে লাগল, “হে প্রভু, আপনি বিভিন্ন স্বভাব, বীর্য, ওজ, যােনি, বীজ, আশয় এবং আকৃতিযুক্ত এই গুণজাত বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। হে প্রভু, আমি সর্পরূপে জন্ম গ্রহণ করেছি।
তাই জন্মাবধি আমি অতিশয় কোপনস্বভাব, অতএব আপনার কৃপা ব্যতীত কিভাবে আমি আমার এই স্বভাব বর্জন করব? কিভাবে আপনার দুস্তর মায়া ত্যাগ করব? আপনার মায়ার প্রভাবেই আমরা এই জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছি।
হে প্রভু, কৃপা করে আপনি আমার স্বভাবজাত অপরাধগুলি ক্ষমা করুন। এখন আপনি আপনার ইচ্ছা অনুসারে আমাকে দণ্ড দিন বা অনুগ্রহ করুন।
সেই কথা শুনে একটি ছােট মনুষ্য-শিশু রূপে লীলা পরায়ণ পরমেশ্বর ভগবান কালীয় সর্পকে আদেশ দিলেন, “তুমি এক্ষুনি এই স্থান পরিত্যাগ করে সমুদ্রে গমন কর।
তুমি আর এখানে এক মুহূর্তও থেকো না। তুমি তােমার স্ত্রী, পুত্র এবং তােমার সমস্ত সম্পত্তি তােমার সঙ্গে নিয়ে যেতে পার। যেন গাভী এবং মনুষ্যেরা নির্বিঘ্নে এই জল পান করতে পারে।
ভগবান তখন ঘােষণা করলেন যে, কালীয়ের প্রতি এই নির্দেশ যদি সকলে শ্রবণ এবং কীর্তন করে, তা হলে কালীয় থেকে আর তাদের কোন ভয় থাকবে না।
কালীয় সর্পের প্রতি এই দণ্ডবিধানের কাহিনী যে শ্রবণ করে, তার আর সর্প থেকে কোন ভয় থাকবে না। ভগবান আরও ঘােষণা করলেন, এই কালীয় হ্রদের যেখানে আমার গােপসখারা এবং আমি স্নান করেছি, সেখানে স্নান করে অথবা একদিন উপবাস করে এই হ্রদের জল দিয়ে, কেউ যদি পিতৃপুরুষের তর্পণ করেন,
তা হলে তিনি সব রকমের পাপ থেকে মুক্ত হবেন।” ভগবান কালীয়কে আশ্বাস দিলেন, “যে-গরুড়ের ভয়ে তুমি রমনক দ্বীপ ত্যাগ করে এই হ্রদ আশ্রয় করেছিলে, সেই গরুড় তােমার মস্তকে আমার পদচিহ্ন দেখে আর তােমাকে ভক্ষণ করবে না।
কালীয় এবং তার পত্নীদের প্রতি ভগবান প্রসন্ন হয়েছিলেন। তাঁর আদেশ শ্রবণ করা মাত্রই নাগপত্নীরা দিব্য অস্ত্র, মাল্য রত্ন, উত্তম ভূষণ, দিব্য গন্ধানুলেপন এবং উত্তম উৎপল মালার দ্বারা গরুড়পতি জগন্নাথের পুজা করে তার প্রসন্নতা উৎপাদনপূর্বক প্রীত এবং তার আদেশপ্রাপ্ত হয়ে প্রদক্ষিণ ও অভিবাদন করে স্ত্রী, আত্মীয় ও পুত্রসহ সমুদ্রের মধ্যবর্তী রমনক দ্বীপে গমন করল। তখনই মানব শিশুরূপে লীলাবিলাসপরায়ণ ভগবানের অনুগ্রহে সেই যমুনার জল বিষহীন হয়ে অমৃত তুল্য হল।