দাবানল থেকে সুপ্ত ব্রজবাসীদের উদ্ধার-কৃষ্ণ লীলা কাহীনি
দাবানল থেকে সুপ্ত ব্রজবাসীদের উদ্ধার
কালীয় দমন লীলা শ্রবণ করার পর মহারাজ পরীক্ষিৎ শুকদেব গােস্বামীকে জিজ্ঞাসা করলেন, কালীয় কেন রমনক দ্বীপ পরিত্যাগ করেছিল এবং গরুড় কেন তার প্রতি এত বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিল? শুকদেব গােস্বামী মহারাজ পরীক্ষিত বললেন যে, নাগালয় রমনক দ্বীপ ছিল সর্পদের আবাসস্থল এবং কালীয় ছিল প্রধান নাগেদের একজন।
তার আহার বলে গরুড় সেই দ্বীপে এসে তার ইচ্ছামতাে অসংখ্য সর্প হত্যা করত। তাদের কিছু সে খেত, কিন্তু অনেক সর্পকেই সে অনর্থক হত্যা করত। তার ফলে সর্পকুল এত বিচলিত হয়ে পড়েছিল যে, তাদের রাজা বাসুকী ব্রহ্মার কাছে তাদের রক্ষার জন্য আবেদন করেছিলেন।
ব্রহ্মা এক বন্দোবস্ত করেছিলেন যাতে গরুড় অনর্থক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি না করে। প্রতি মাসে যেদিন চন্দ্র অধকৃতি গ্রহণ করবে, সেদিন সর্পকুল গরুড়কে একটি সর্প উৎসর্গ করবে।
একটি বিশেষ বৃক্ষের নীচে গরুড়ের নিবেদনস্বরূপ একটি সর্প রেখে দেওয়া হতাে। এই নৈবেদ্য পেয়ে গরুড় সন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং তিনি আর সর্পদের অনর্থক অশান্তির সৃষ্টি করত না।
কালীয় কিন্তু এই মেনে নিল না। তার সঞ্চিত বিষ এবং শক্তির গর্বে মত্ত হয়ে সে ভাবল, “গরুড়কে কেন এই উপহার দেওয়া হবে?” এই মনে করে সে নিজেই গরুড়কে উৎসর্গীকৃত উপহার ভােজন করতে শুরু করল।
ভগবান বিষ্ণুর মহান ভক্ত এবং বাহন গরুড় বুঝতে পারল যে তাকে উৎসর্গীকৃত উপহার কালীয়ই ভােগ করে নিচ্ছে, তখন তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে সেই অপরাধী সর্পকে হত্যা করার জন্য মহাবেগে সেই দ্বীপের প্রতি ধাবিত হলেন।
গরুড়কে অতি বেগে আসতে দেখে বিষায়ুধ দন্তরূপ অস্ত্রযুক্ত করাল জিহ্বা ও উগ্র লোচন কালীয় তার ফণা বিস্তার করে তার প্রতি ধাবিত হল এবং দন্ত দ্বারা দংশন করতে লাগল।
বিষ্ণুবাহন প্রচণ্ড বেগ মহাবল তার্ক্ষ্যসুত গরুড় তখন ক্রোধে কালীয়কে নিবারিত করে তারপর তার জ্যোতির্ময় সুবর্ণ বামপক্ষ দ্বারা প্রহার করলেন। গরুড়ের পক্ষ দ্বারা অত্যন্ত আহত হওয়ায় কদ্রসুত নামেও পরিচিত কালীয় তখন অতি বিহল হয়ে গরুড়ের অগম্য যমুনা হ্রদে প্রবেশ করেছিল।
কতকগুলি কারণে কালীয় যমুনার আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। গরুড় যেমন কালীয় সর্পের দ্বীপে গিয়ে সর্প আহার করতেন, তেমনই তিনি মাঝে মাঝে যমুনায় গিয়ে মাছ ধরে আহার করতেন।
সেই যমুনার জলে সৌভরি মুনি নামক এক মহামুনি যােগী তপস্যা করছিলেন এবং তিনি মাছের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি গরুড়কে সেখানে এসে মাছেদের বিরক্ত না করতে আদেশ দিয়েছিলেন। গরুড় যদিও কারও আদেশাধীন নন, তবুও তিনি সেই মহাযােগীর আদেশ অমান্য করেননি।
সেখানে অনেক মাছ খাওয়ার পরিবর্তে তিনি মাছের নেতা একটা বড় মাছকে ধরে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। মাছেদের এই রকম একজন বড় নেতাকে গরুড় ধরে নিয়ে গেছে জেনে সৌভরি মুনি অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন এবং তাদের রক্ষা করার জন্য তিনি গরুড়কে অভিশাপ দিয়েছিলেন, “এখন থেকে যদি গরুড় এখানে মাছ ধরতে আসে, তা হলে আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে বলছি যে, তৎক্ষণাৎ গরুড়ের মৃত্যু হবে।”
এই অভিশাপের কথা কেবল কালীয়ই জানত। তাই কালীয় নিশ্চিত ছিল যে, গরুড় সেখানে আসতে পারবে না এবং তাই সে যমুনার মধ্যে সেই হ্রদে আশ্রয় গ্রহণ করাটা সব চাইতে বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে করেছিল।
কালীয়র সৌভরি মুনির আশ্রয় গ্রহণ করা কিন্তু সফল হয়নি। গরুড়ের প্রভু শ্রীকৃষ্ণ তাকে যমুনা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
এখানে একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, গরুড় সরাসরিভাবে পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং তিনি এত শক্তিশালী যে, কারও আদেশ বা অভিশাপের অধীন তিনি নন।
প্রকৃতপক্ষে, শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে, ভগবানের অন্তরঙ্গ সেবক রূপে গরুড়ের পদ পরমেশ্বর ভগবানের মতাে এবং তাই তাকে অভিশাপ দেওয়ার ফলে সৌভরি মুনির অপরাধ হয়।
গরুড় যদিও এই অভিশাপের কোন প্রতিশােধ নেওয়ার চেষ্টা করেননি কিন্তু তার মতাে একজন মহাভাগবত বৈষ্ণব চরণে অপরাধ করার ফলে সৌভরি মুনি রক্ষা পাননি।
এই অপরাধের ফলে সৌভরি মুনি তার তপস্যা থেকে ভ্রষ্ট হয়েছিলেন এবং এই জড় জগতে ইন্দ্রিয় তর্পণকারী একজন গৃহস্থে গরিণত হয়েছিলেন। সৌভরি মুনি, যিনি ধ্যানে ব্রহ্মসুখে মগ্ন ছিলেন, তাঁর এই অধঃপতন বৈষ্ণব অপরাধের একটি দৃষ্টান্ত।
শ্রীকৃষ্ণ যখন কালীয় হ্রদ থেকে বেরিয়ে এলেন, তখন যমুনার তীর থেকে তাঁর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবরা তাকে দেখতে পেলেন। তারা দেখলেন যে শ্রীকৃষ্ণ অপূর্ব সজ্জায় সজ্জিত, বহুমুল্য মণিমাণিক্যে তিনি বিভূষিত এবং তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল তার সমস্ত শরীর যেন সুবর্ণমণ্ডিত।
বৃন্দাবনের সমস্ত অধিবাসীরা, গােপ এবং গােপবালকেরা, মা যশােদা, নন্দ মহারাজ, সমস্ত গাভী এবং গােবৎসরা যখন দেখলেন যে, শ্রীকৃষ্ণ যমুনা থেকে উঠে আসছেন, তখন তাঁদের মনে হল যে তারা যেন তাদের জীবন ফিরে পেলেন।
কেউ যখন তার জীবন ফিরে পায়, তখন স্বাভাবিক ভাবেই সে অত্যন্ত আনন্দিত হয়। সেই আনন্দে মগ্ন হয়ে তাঁরা সকলেই একে একে শ্রীকৃষ্ণকে আলিঙ্গন করলেন এবং স্বস্তি অনুভব করলেন।
মা যশোদা, মা রােহিণী, নন্দ মহারাজ এবং সমস্ত গােপেরা এত আনন্দিত হয়েছিলেন যে, কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে তাদের মনে হয়েছিল, তাদের জীবনের চরম উদ্দেশ্য সাধিত হল।
বলরামও কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করলেন, কিন্তু তিনি মৃদু মৃদু হাসছিলেন, কেননা তিনি জানতেন, সকলেই যখন উৎকণ্ঠায় এইভাবে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল, তখন কৃষ্ণ কি করছিলেন।
যমুনার তীরবর্তী সব কটি বৃক্ষ, সমস্ত গাভী, গােবস সকলেই কৃষ্ণের আগমনে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল। বৃন্দাবনের ব্রাহ্মণেরা কৃষ্ণ এবং তাঁর পরিবারের সকলকে অভিনন্দন জানাবার জন্য সস্ত্রীক এসে উপস্থিত হলেন। ব্রাহ্মণেরা হচ্ছেন সমাজের গুরু।
তাঁরা কৃষ্ণের এই বিপদ-মুক্তির জন্য তাকে এবং তার পরিবারের সকলকে আশীর্বাদ করলেন। এই উপলক্ষ্যে তারা নন্দ মহারাজকে দান করবার জন্য অনুরােধ করলেন।
কৃষ্ণের পুনরাগমনে নন্দ মহারাজ এতখুশি হয়ে ছিলেন যে, তিনি ব্রাহ্মণদের বহু গাভী এবং স্বর্ণ উপহার দিলেন। নন্দ মহারাজ যখন এইভাবে দান করতে ব্যস্ত ছিলেন, মা যশােদা তখন কৃষ্ণকে কোলে নিয়ে তাকে আলিঙ্গন করে অবিশ্রান্ত ধারায় কাঁদতে লাগলেন।
রাত্রি হয়ে এসেছিল, গাভী এবং গােবস সহ বৃন্দাবনের অধিবাসীরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তাই তারা যমুনার তীরেই বিশ্রাম করতে মনস্থ করলেন।
মধ্যরাত্রে সকলেই যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন, তখন হঠাৎ সেই বনে দাবানল জ্বলে উঠল এবং মনে হল যে, সে আগুন যেন অচিরেই সমস্ত ব্রজবাসীদের গ্রাস করবে। যখন তারা সেই আগুনের তাপ অনুভব করলেন, তৎক্ষণাৎ তাঁরা গােপশিশুরূপে লীলাবিলাসপরায়ণ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হলেন।
তারা বলতে লাগলেন, “হে প্রিয় কৃষ্ণ! হে পরমেশ্বর ভগবান! সমস্ত বলের উৎস হে বলরাম! এই সর্বগ্রাসী দাবানল থেকে তােমরা আমাদের রক্ষা কর। তােমরা ছাড়া আমাদের আর কোন আশ্রয় নেই।
এই আগুন আমাদের সকলকে গ্রাস করবে!” এইভাবে তারা কৃষ্ণ এবং বলরামের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন যে, তাদের শ্রীচরণারবিন্দ ছাড়া তাদের আর কোন আশ্রয় নেই।
যার প্রতিবেশীদের প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে শ্রীকৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ সেই দাবানল গ্রাস করে ফেললেন এবং তাদের রক্ষা করলেন। শ্রীকৃষ্ণের পক্ষে সেটা মােটেই অসম্ভব ছিল না, কেননা তিনি হচ্ছেন অনন্ত। তাঁর ইচ্ছা অনুসারে যা ইচ্ছা তাই করার মতাে অনন্ত শক্তি তার রয়েছে।
আরও পড়ুনঃ