ব্রহ্মার গোপশিশু এবং গোবৎস হরণ-কৃষ্ণলীলা কাহীনি

ব্রহ্মার গোপশিশু এবং গোবৎস হরণ-কৃষ্ণলীলা কাহীনি

 ব্রহ্মার গোপশিশু এবং গোবৎস হরণ-কৃষ্ণলীলা কাহীনি


মহারাজ পরীক্ষিৎ যখন জিজ্ঞাসা করলেন, গোপ শিশুরা কেন এক বছর অঘাসুর বধের কথা আলোচনা করেনি, তখন শুকদেব গোস্বামী অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। 
 
তার ব্যাখ্যা করে তিনি বললেন, “হে ভাগবতবর মহারাজ পরীক্ষিৎ, তুমি অতি উত্তম প্রশ্ন করেছ, কেননা নিরন্তর হরিকথা শ্রবণ করেও তুমি সর্বদাই তা নতুন বলে অনুভব করছ।”

ভগবানের ভক্তদের স্বভাবই হচ্ছে তাদের কায়, মন, বাক্য, ইন্দ্রিয় ইত্যাদি বলা হয় কৃষ্ণ ভাবনামৃত এবং যিনি এইভাবে শ্রীকৃষ্ণের কথা শ্রবণ এবং শ্রীকৃষ্ণের গুণকীর্তনে মগ্ন, তাঁর কাছে এই বিষয় কখনও পুরানো হয় না। এটাই চিন্ময় এবং প্রাকৃত বিষয়ের পার্থক্য। 
 
 
প্রাকৃত বিষয়গুলি একটু পরেই বাসী হয়ে যায় এবং একটা সম্বন্ধে বেশিক্ষণ শোনা যায় না; মানুষ তার পরিবর্তন চায়। কিন্তু অপ্রাকৃত  বিষয়কে বলা হয় নিত্য নব নবায়মান। 
 
অর্থাৎ ভগবান সম্বন্ধে যতই শ্রবণ বা কীর্তন করা হোক না কেন, আমরা কখনও তাতে ক্লান্ত হই না। তা সব সময় নতুনই থাকে এবং আরও বেশি করে শোনবার জন্য  আমরা আগ্রহী হয়ে উঠি।

গুরুদেবের কর্তব্য হচ্ছে ঐকান্তিকভাবে কৌতুহলী শিষ্যের কাছে সমস্ত গুহ্য বিষয় ব্যক্ত করা। তাই শুকদেব গোস্বামী পরীক্ষিৎ মহারাজকে বলতে শুরু করলেন কেন অঘাসুর বধের এক বছর পর্যন্ত সেই ঘটনা সম্বন্ধে কেউ কোন আলোচনা করেনি। 
 
শুকদেব গোস্বামী মহারাজ পরীক্ষিৎকে বললেন, “এখন সেই গোপন রহস্য মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ কর। অঘাসুরকে বধ করে, তার মুখ থেকে তাঁর বন্ধুদের রক্ষা করার পর শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বন্ধুদের নিয়ে একটি সরোবরের তীরে এলেন এবং বলতে লাগলেন, হে সখাগণ, দেখ এই সরোবরের তীরটি কত মনোরম।
 
প্রস্ফুটিত পম্মফুলের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ভ্রমরেরা গুঞ্জন করেছে আর জলের মধ্যে পাখিদের কলরব গাছগুলিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। 
 
এই জায়গাটি কোমল ও নির্মল বালুকায় পরিপূর্ণ এবং আমাদের সব রকম খেলার উপকরণ এখানে রয়েছে। এস এখানেই আমরা ভোজন করি। 
 
আমরা সকলেই ক্ষুধার্ত, আর তা ছাড়া বেলাও অনেক হয়েছে। আমরা যখন ভোজন করব, গোবৎসরা তখন জলপান করে এখানেই নরম ঘাস আহার করুক।”

শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনে এখানেই সমস্ত বালকেরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলল, “নিশ্চয়ই। এস, এখানে বসে আমরা আহার গ্রহণ করি।” 
 
তারপর তারা গোবৎসদের জল খাইয়ে সবুজ ঘাসে ভরা মাঠে ঘাস খাওয়ার জন্য তাদের বাড়ি থেকে আনা খাবারের পুঁটলিগুলো খুলতে লাগল। 
 
তারা সকলে বৃত্তাকারে বসেছিল আর তাদের মাঝখানে করার অপূর্ব আনন্দ উপভোগ করতে লাগল। তাদের দেখতে ঠিক একটা পদ্মের মতো মনে হল, যার কর্ণিকা হচ্ছেন কৃষ্ণ আর তাঁকে ঘিরে বসে থাকা শিশুরা হচ্ছে তার পাপড়ি। 
 
বালকেরা ফুল, ফুলের পাপড়ি এবং গাছের বাকলের উপর তাদের খাওয়ার পুঁটলি রেখে কৃষ্ণের সঙ্গে তাদের বিভিন্ন সম্পর্ক প্রকাশ করতে লাগল এবং একে অপরের সঙ্গে কৌতুকপুর্ণ আলোচনা করতে লাগল। 
 
এইভাবে যখন তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে কৃষ্ণ বনভোজন উপভোগ করছিলেন, তখন তাঁর বাঁশিটা তাঁর কোমরে গোঁজা ছিল, তাঁর শিঙ্গা এবং লগুড় তাঁর কোমরের বাঁদিকে গোঁজা ছিল। 
 
দই, ননী, অন্ন আর ফল দিয়ে তৈরি খাবারের একটা দলা তিনি তাঁর বাঁ হাতের তালুতে ধরেছিলেন, যা তাঁর পদ্ম-সদৃশ আঙ্গুলগুলির মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছিল। 
 
যে পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত যজ্ঞের পরম ভোক্তা, তিনি হাসতে হাসতে, উপহাস করতে করতে, বৃন্দাবনে তাঁর বন্ধূদের সঙ্গে এইভাবে বনভোজন করছিলেন। স্বর্গের দেবতারা তখন সেই দৃশ্য দেখছিলেন। আর সেই গোপ-বালকেরা তখন পররমেশ্বর ভগবানের সান্নিধ্যে দিব্য আনন্দে মগ্ন ছিল।

সেই সময় গোবৎসগুলি কাছেই গোচারণভূমিতে ঘাস খেতে খেতে নতুন ঘাসের হাতছানিতে ধীরে ধীরে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করল এবং তখন আর তাদের দেখা গেল না। 
 
শিশুরা যখন দেখল যে, বাছুরগুলি কাছাকাছি কোথাও নেই, তখন তারা নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে খুব ভয় পেয়ে গেল এবং চিৎকার করে বলে উঠল, “কৃষ্ণ।” সমস্ত বিশ্বের ভয়স্বরূপ মৃত্যুও শ্রীকৃষ্ণকে ভয় পায়। 
 
‘কৃষ্ণ’ নাম উচ্চারণ করা মাত্রই শিশুদের সমস্ত ভয় দুর হয়ে গেল। তাদের প্রতি গভীর স্নেহের বশে তাদের খাওয়ায় বাধা না দিয়ে কৃষ্ণ তাদের বললেন, “তোমরা খাও, আমি দেখছি গোবৎসগুলি কোথায় গেল।” 
 
এইভাবে কৃষ্ণ তখন উঠে গিয়ে পাহাড়ের গুহায় এবং ঝোপেঝাড়ে বাছুরদের খুঁজতে লাগলেন। তাদের খুঁজতে খুঁজতে তিনি বনের মধ্যেও গেলেন, কিন্তু কোথাও তাদের খুঁজে পেলেন না।

ইতিমধ্যে অঘাসুর বধের পর স্বর্গের দেবতারা যখন অত্যন্ত বিস্ময়ািন্বিত হয়ে সেই ঘটনা দর্শন করছিলেন। তখন বিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে যাঁর জন্ম হয়েছে, সেই ব্রহ্মাও তা দেখতে এসেছিলেন। 
 
কৃষ্ণের মতো ছোট্র একটি শিশুকে এরকম অদ্ভুত একটা কর্ম করতে দেখে তিনি অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন। 
 
তিনি যদিও শুনেছিলেন যে, এই ছোট্র গোপবালকটি হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, তবুও তাঁর আরও অধিক মহিমামিন্ডিত লীলা দর্শন করার প্রয়াসী হয়ে তিনি সমস্ত গোবৎস এবং গোপ-শিশুদের চুরি করে অন্য এক জায়গায় রেখেছিলেন। 
 
গোবৎসদের অনেক খোঁজা সত্ত্বেও  কৃষ্ণ তাদের পেলেন না এবং সরোবরের তীরে যেখানে বসে তাঁর সখারা বনভোজন করছিল, সেখানে তাঁর সখাদেরও দেখতে পেলেন না। 
 
তখন সর্বান্তর্যামী শিশু কৃষ্ণ বুঝতে পারলেন যে, ব্রহ্মা তাঁর গোপসখা এবং গোবৎসদের চুরি করে নিয়ে গেছে। আমি এখন একা কিভাবে বৃন্দাবনে ফিরে যাব? মায়েরা অত্যন্ত দুঃখিত হবেন!”

তাই তাঁর সখাদের মায়েদের পুত্রবিচ্ছেদের দুঃখ মোচন করার জন্য এবং ব্রহ্মার কাছে তাঁর পরমেশ্বরত্ব প্রতিপন্ন করার জন্য তিনি নিজেকে গোপশিশু এবং গোবৎসরূপে প্রকাশিত করলেন। 
 
বেদে বলা হয়েছে যে, পরমেশ্বর ভগবান তাঁর অচিন্ত্য শক্তির প্রভাবে নিজেকে অসংখ্যভাবে প্রকাশিত করেন। তাই তাঁর পক্ষে সেই সমস্ত বালক এবং গোবৎসে প্রকাশিত হওয়া মোটেই কোন কঠিন কাজ নয়। 
 
তিনি নিজেকে ঠিক সেই বালকদের মতো প্রকাশিত করলেন, যাদের রূপ এবং আকৃতি ছিল ভিন্ন এবং যাদের সাজসজ্জা, আচার-আচরণ কার্যকলাপ সবই ছিল ভিন্ন। 
 
পক্ষান্তরে বলা যায় যে, স্বতন্ত্র জীবাত্মা হওয়ার ফলে প্রত্যেকেরই রুচি, কার্যকলাপ এবং আচরণ ভিন্ন, কিন্তু তবুও কৃষ্ণ সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন বালকরূপে নিজেকে প্রকাশিত করলেন। 
 
তিনি গোবৎসরূপেও নিজেকে প্রকাশিত করলেন, যাদের সকলেরই আকার, ধর্ম, কার্যকলাপ ইত্যাদি ছিল ভিন্ন। তাঁর পক্ষে এটা সম্ভব, কেননা সব কিছু তারই শক্তির প্রকাশ। 
 
বিষ্ণু পুরাণে বলা হয়েছে, ‘পরস্য ব্রহ্মণঃ শক্তি’ অর্থাৎ এই জগতে আমরা যা কিছু দেখি তা সে জড় পদার্থই হোক্ বা সচেতন জীবই হোক, তা সবই ভগবানের শক্তিরই প্রকাশ, যেমন তাপ এবং আলোক হচ্ছে অগ্নির শক্তির প্রকাশ।

এইভাবে নিজেকে গোপশিশু এবং গোবৎসরূপে প্রকাশ করে তাদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে কৃষ্ণ বৃন্দাবনে প্রবেশ করলেন। ব্রজবাসীদের কোন ধারণাই ছিল না যে, কি হয়েছে। 
 
বৃন্দাবনে পৌছে সমস্ত গোবৎসগুলি তাদের নিজের নিজের গোশালায় ফিরে গেল এবং বালকেরা তাদের নিজের নিজের গৃহে তাদের মায়ের কাছে ফিরে গেল।

তাদের মায়েরা দুর থেকে বাঁশির শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন, তাই তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে তাদের আলিঙ্গন করলেন। মাতৃস্নেহে তাদের স্তন থেকে দুধ ক্ষরিত হতে লাগল এবং তাঁরা তাঁদের শিশুদের তা পান করতে দিলেন। 
 
তাঁদের এই নিবেদন ঠিক তাঁদের শিশুদের তা পান করতে দিলেন। তাঁদের এই নিবেদন ঠিক তাঁদের পুত্রদের উদ্দেশ্যে ছিল না, তা হচ্ছিল পরমেশ্বর ভগবানের উদ্দেশ্যে, যিনি নিজেকে সেই সমস্ত গোপশিশুতে প্রকাশিত করেছিলেন। 
 
এইভাবে বৃন্দাবনের সমস্ত মায়েরা পরমেশ্বর ভগবানকে তাঁদের স্তন্যদান করার সুযোগ পেয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ কেবল মা যশোদাকেই তাঁর স্তন্যদান করবার সুযোগ দেননি, এখন তিনি সমস্ত মাতৃস্থানীয়া গোপীদের সেই সুযোগ দিলেন।

সমস্ত শিশুরা তাদের মায়ের সঙ্গে আগের মতোই আচরণ করতে লাগল এবং তাদের মায়েরাও সন্ধ্যাবেলা শিশুরা যখন বাড়িতে ফিরে আসত, তখন তাদের স্নান করাতেন, দ্বাদশ অঙ্গে তিলক এঁকে দিতেন এবং নানা রকম অলঙ্কারে তাদের সাজাতেন। 
 
গাভীরা সারাদিন গোচারণভুমিতে বিচরণ করার পর সন্ধাবেলা ফিরে এসে হাম্বা রবে তাদের বৎসদের আহ্বান করত। 
 
বৎসরাও তৎক্ষণাৎ তাদের মায়দের কাছে ছুটে আসত, মায়েরা স্নেহভরে তাদের শরীর চাটত। গোপী এবং গাভীরা তাঁদের পুত্র এবং বৎসরা সেখানে ছিল না। 
 
প্রকৃতপক্ষে তাঁদের পুত্রদের প্রতি গোপিকাদের স্নেহ এবং বৎসদের প্রতি গাভীদের স্নেহ যেন আকারণে বর্ধিত হল। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের স্নেহ বর্ধিত হল, যদিও সেই বালকগুলি এবং বৎসগুলি তাঁদের সন্তান ছিল না। 
 
কৃষ্ণের প্রতি বৃন্দাবনের গোপিকাদের এবং গাভীদের স্নেহ তাঁদের পুত্র এবং বৎসদের থেকেও অধিক ছিল, কিন্তু এই ঘটনার পরে তাঁদের সন্তানের প্রতি তাঁরা কৃষ্ণেরই মতো সমান স্নেহ অনুভব করতে লাগলেন।
 
 এক বছর ধরে কৃষ্ণ নিজেকে গোপশিশু এবং গোবৎসরূপে প্রকাশ করে বনে ও ব্রজে ক্রীড়া করেছিলেন।

ভগবদগীতায় বলা হয়েছে, পরমাত্মারূপে শ্রীকৃষ্ণ সকলেরই হৃদয়ে বিরাজ করেন। তেমনই পরমাত্মারূপে নিজেকে প্রকাশ না করে এক বছর তিনি গোপশিশু এবং গোবৎসরূপে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন। 
 
একদিন কৃষ্ণ যখন বালরামের সঙ্গে গোবৎসদের বনে চরাচ্ছিলেন, তখন তাঁরা দেখলেন যে, গোবর্ধন পর্বতের উপর চারণ করতে করতে কয়েকটি গাভী পাহাড়ের অনতিদুরে নীচে বিচরণশীল বৎসদের দেখা মাত্রই তাদের দিকে দৌড়তে শুরু করল। 
 
তারা দ্রুতগতিতে লাফাতে লাফাতে পাহাড়ের উপর থেকে নেমে এল। তাদের বৎসদের প্রতি গভীর বাৎসল্যের প্রভাবে তারা এত আত্মবিস্মৃত হয়েছিল যে, তারা গোবর্ধন পর্বতের দুর্গম পথ দ্রুতগতিতে হেলায় অতিক্রম করে। 
 
দুগ্ধে পরিপূর্ণ স্তন এবং পচ্ছভাগ উন্নত করে তারা নেমে এল। সেই সময় তাদের স্তন থেকে দুগ্ধ ক্ষরিত হচ্ছিল এবং তাদের বৎসের প্রতি বাৎসল্য স্নেহে, 
 
(যদিও তারা তাদের বৎস ছিল না, এবং সুদীর্ঘকালের মধ্যে সেই সমস্ত গাভীগুলি আবার সন্তান প্রসব করেছিল) গোবর্ধন পর্বতের নীচে এসে পরম স্নেহভরে তারা তাদের পূর্ববৎসদের শরীর লেহন করতে লাগল। 
 
যদিও সরাসরি স্তন থেকে দুধ পান করতে লাগল। তাদের দেখে মনে হল যেন তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত স্নেহের বন্ধন রয়েছে।

গাভীগুলি যখন গোবর্ধন পর্বতের উপর থেকে দৌড়ে নেমে আসছিল, তখন যে সমস্ত গোপেরাই গাভীর তত্ত্বাবধান করছিলেন, তাঁরা বাধা দেবার চেষ্টা করলেন। 
 
প্রাপ্ত বয়স্ক গোপেরাই গাভীর তত্ত্বাবধান করতেন আর বালকেরা গোবৎসদের তত্ত্বাবধান করতেন; এবং যতদুর সম্ভব গোবৎসদের গাভীদের থেকে আলাদা করে রাখা হত, যাতে তারা তাদের দুধ না খেয়ে ফেলে। 
 
তাই গোবর্ধন পর্বতের উপরে যে সমস্ত গোপেরা গাভীদের তত্ত্বাবধান করছিলেন, তাঁরা তাদের থামাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু থামাতে পারলেন না। 
 
তাঁদের এই অক্ষমতায় তাঁরা হতভম্ব হয়ে পড়লেন, তাঁরা অত্যন্ত লজ্জাবোধ করলেন এবং তারপরে তাঁদের খুব রাগ হল। 
 
কিন্তু যখন তাঁরা গরুগুলির পিছন পিছন নেমে এসে দেখলেন যে, তাঁদের শিশুপুত্ররা গোবৎসদের তত্ত্বাবধান করছে, তখন তাদের শিশুসন্তানদের প্রতি তাঁরাও এক গভরি স্নেহ অনুুভব করলেন। সেটা ছিল খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার।

তাঁরা যখন নেমে এসেছিলেন, তখন তাঁরা অত্যন্ত মর্মাহত, হতভম্ব এবং ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের শিশুপুত্রদের দেখা মাত্রই গভীর স্নেহে তাঁদের হৃদয় দ্রবীভূত হল। 
 
তৎক্ষণাৎ তাঁদের ক্রোধ, অসন্তুষ্টি এবং দুঃখ দুর হয়ে গেল। তাঁরা তাঁদের পুত্রদের প্রতি বাৎসল্য স্নেহ প্রদর্শন করতে লাগলেন এবং গভীর স্নেহে তাদের কোলে তুলে নিয়ে আলিঙ্গন করলেন। 
 
তাঁরা তাঁদের পুত্রদের মস্তক আঘ্রাণ করলেন এবং মহা আনন্দে তাঁদের সান্নিধ্য উপভোগ করলেন। এইভাবে তাঁদের পুত্রদের আলিঙ্গন করার পর তাঁরা গাভীগুলিকে নিয়ে গোবর্ধন পর্বতের উপরে ফিরে গেলেন এবং যেতে যেতে তাঁরা তাঁদের পুত্রদের কথা মনে করতে লাগলেন এবং বাৎসল্য স্নেহে তাঁদের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল।

বলরাম যখন গোবৎসদের প্রতি গাভীদের এবং পুত্রদের প্রতি পিতাদের এই অসাধারণ স্নেহ-বিনিময় দেখলেন-বিশেষ করে যখন বৎস অথবা বালকেরাই এই ধরনের প্রয়োজন ছিল না- তিনি ভাবতে লাগলেন,
 
কেন এই রকম অদ্ভুত ঘটনাটি ঘটল। সমস্ত ব্রজবাসীদের তাঁদের ‍শিশুসন্তানদের প্রতি এই গভীর স্নেহ দেখে তিনি আশ্চর্য হলেন। এই রকম স্নেহ ত’ কৃষ্ণ ছাড়া আর কারও প্রতি থাকা সম্ভব নয়! 
 
তেমনই গাভীরাও কৃষ্ণের প্রতি তাদের যেমন বাৎসল্য, ঠিক সেইভাবে তাদের বৎসদের প্রতি স্নেহপরায়ণ হয়ে উঠেছে। বলরাম তাই ভাবলেন যে, এই অসাধারণ স্নেহের নিশ্চয় কোন গুহ্য কারণ রয়েছে। 
 
তা না হলে এই অদ্ভুত আচরণের কি কারণ থাকতে পারে? তিনি বিচার করে দেখলেন যে, এর কারণ নিশ্চয় শ্রীকৃষ্ণ, যাঁকে তিনি তাঁর পরমারাধ্য পরমেশ্বর ভগবান বলেই জানেন। তিনি ভাবলেন, 
 
“এটা নিশ্চয়ই কৃষ্ণের কার্য, এমন কি আমিও এই মায়ার দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারছি না।” এইভাবে বলরাম বুঝতে পারলেন যে, সেই বালকেরা এবং বৎস্যগুলি সকলেই শ্রীকৃষ্ণের প্রকাশ।

বলরাম আসল ঘটনা সম্বন্ধে কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, “প্রিয় কৃষ্ণ, প্রথমে আমি মনে করেছিলাম যে, এই সমস্ত গাভী, গোবৎস এবং গোপবালকেরা হচ্ছে মহান ঋষি, মহাত্মা বা দেবতা। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে যে, আসলে এরা সকলে তোমারই প্রকাশ। 
 
এরা সকলেই তুমি; তুমিই গো, গোবৎস এবং গোপবালকরূপে তোমার লীলা আস্বাদন করছ। এর গোপন রহস্যটা কি? সেই গো, গোবৎস এবং গোপবালকেরা কোথায় গেছে? আর তুমিই বা কেন নিজেকে গো, গোবৎস রূপে প্রকাশিত করেছ? তুমি কি দয়া করে আমাকে এর কারণটা বলবে? বলরামের অনুরোধে কৃষ্ণ সংক্ষেপে সমস্ত ঘটনাটা বললেন; 
 
কিভাবে ব্রহ্মা গো, গোবৎস ও গোপবালকদের চুরি করে নিয়ে গেছে এবং লোকেরা যাতে তা না জানতে পারে, সেই জন্য কিভাবে তিনি নিজেকে সেই সমস্ত গো, গোবৎস এবং গোপবালকরূপে প্রকাশিত করেছেন।

কৃষ্ণ এবং বলরাম যখন এইভাবে কথা বলছিলেন, ব্রহ্মা তখন তাঁর সময়ের পরিমাণে এক নিমিষের মধ্যে সমস্ত গোপশিশু এবং গোবৎসদের একটা পাহাড়ের গুহার মধ্যে রেখে ফিরে এলেন। 
 
ভগবদগীতা থেকে আমরা জানতে পারি যে, এক হাজার চতুর্যুগে অর্থাৎ ৪৩,০০,০০০※১০০০ বৎসরে ব্রহ্মার বারো ঘন্টা হয়। সেই হিসাবে ব্রহ্মার এক নিমেষ আমাদের সময়ের পরিমাণে এক সৌর বৎসর। 
 
তাঁর সময়ের পরিমাণে এক নিমেষের মধ্যে সেই শিশুদের এবং গোবৎসদের চুরি করার ফলে কি হয়েছে তা দেখবার জন্য ব্রহ্মা ফিরে এলেন। তিনি অত্যন্ত ভীত হয়েছিলেন, কেননা তিনি জানতেন যে, তিনি আগুন নিয়ে খেলা করছেন। 
 
শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন তাঁর প্রভু এবং দুর্বিনীতভাবে মহা দেখাবার জন্য তিনি তাঁর গোবৎস এবং সখাদের চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন, তাই তিনি সময় নষ্ট না করে তৎক্ষণাৎ ফিরে এলেন। 
 
ফিরে এসে তিনি দেখলেন যে, সেই সমস্ত গোপবালকেরা এবং গোবৎসরা আগের মতোই খেলা করছে। তাঁর মনে কোন সংসয় ছিল না যে, তিনি তাদের মায়াশয্যায় ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছেন। 
 
কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের ঠিক আগের মতো খেলা করতে দেখে তিনি অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। ব্রহ্মা ভাবতে লাগলেন, “আমি এই সমস্ত গোপবালক এবং গোবৎসদের মায়াশয্যায় ঘুম পাড়িয়ে রেথে এসেছি। 
 
তা হলে কি করে সেই বালকেরাই এবং বৎসরাই এখানে কৃষ্ণের সঙ্গে খেলা করছে? তার মানে কি তারা আমার মায়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়নি? 
 
এরা কি গত এক বৎসর ধরে এইভাবে কৃষ্ণের সঙ্গে খেলা করছে?” ব্রহ্মা বুঝতে চেষ্টা করলেন যে, এরা কে এবং কিভাবেই বা তারা তাঁর মায়ার দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে  এখানে এইভাবে খেলা করছে। 
 
কিন্তু তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না। পক্ষান্তরে বলঅ যায় যে, তিনি নিজেই তাঁর মায়ার দ্বারা মোহিত হয়ে পড়লেন। তাঁর মায়াশক্তিতে তখন অন্ধকার রাত্রে তুষারের মতো বা দিনের আলোয় জোনাকী পোকার মতো মনে হল। 
 
পাহাড়ের উপর সঞ্চিত তুষার দিনের আলোয় ঝলমল করে, কিন্তু রাত্রিবেলা তাদের কোন উজ্জ্বলতা থাকে না, আবার রাত্রের অন্ধকারে জোনাকি পোকাকে জ্বলতে দেখা যায়, কিন্তু দিনের বেলায় তাদের কোন আলোই দেখা যায় না। 
 
তেমনই শ্রীকৃষ্ণের মায়াশক্তির কাছে ব্রহ্মার মায়াশক্তিকে রাতের অন্ধকারে তুষারের মতো বা দিনের আলোয় জোনাকির মতো মনে হল। 
 
অল্প শক্তিসম্পন্ন কোন মানুষ যখন প্রচন্ড শক্তিশালী কোন মানুষের কাছে তার শক্তি প্রকাশ করতে যায় তখন অনর্থক তার শক্তিরই ক্ষয় হয়, তাতে কখনই তার শক্তি বৃদ্ধি পায় না। 
 
ব্রহ্মার মতো মহান পুরুষও কৃষ্ণের কাছে তাঁর শক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে হাস্যাস্পদ হয়ে উঠলেন। এইভাবে ব্রহ্মা তাঁর নিজের মায়শক্তির প্রভাবে নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন।

সেই সমস্ত গোবৎস এবং গোপবালকেরা যে আসল গোবৎস ও গোপবালক নয়, তা ব্রহ্মাকে বোঝাবার জন্য শ্রীকৃষ্ণ তাদের বিষ্ণুসূর্তিতে রূপান্তরিত করলেন। প্রকৃতপক্ষে, প্রকৃত গোবৎস এবং গোপবালকেরা ব্রহ্মার মায়ার প্রভাবে নিদ্রামগ্ন ছিল, 
 
কিন্তু ব্রহ্মা যাদের দেখছিলেন তাঁরা সকলেই ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ বা বিষ্ণুর প্রকাশ। বিষ্ণু হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের প্রকাশ, তাই ব্রহ্মার সামনে সেই সমস্ত গোপবালকেরা চতুর্ভুজ বিষ্ণুমুর্তিতে প্রকাশিত হল। 
 
সমস্ত বিষ্ণুমূর্তির অঙ্গকান্তি ছিল বর্ষার জলভরা মেঘের মতো নীল এবং তাঁদের পরনে ছিল পীত বসন, তাঁরা সকলেই ছিলেন চতুর্ভুজ  এবং তাঁদের শঙ্খ, চক্র, গদা এবং পদ্ম শোভা পাচ্ছিল। তাঁদের মাথায় ছিল অদ্ভুত দ্যুতিসম্পন্ন মণিমাণিক্য খচিত সোনার মুকুট; কানে ছিল কুন্তল; 
 
তাঁদের হাতে রজুবন্ধ এবং অন্যান্য সমস্ত রত্নালঙ্কার। তাঁদের কোমরে ছোট ছোট ঘণ্টাযুক্ত সোনার কোমরবদ্ধ. তাঁদের আঙ্গুলে অঙ্গুরীয় শোভা পাচ্ছিল। ব্রহ্মা আরও দেখলেন যে, সেই সমস্ত বিষ্ণুমূর্তির শ্রীপাদপদ্ম থেকে মস্তক পর্যন্ত তুলসী মঞ্জরী শোভা পাচ্ছিল। 
 
সেই সমস্ত বিষ্ণুমূর্তির সকলেই দিব্য সৌন্দর্যে ভূষিত ছিলেন। তাঁদের মুখের হাসি পূর্ণচন্দ্রের জ্যোৎস্নার মতো স্নিগ্ধ এবং সকরুণ দৃষ্টিপাত প্রভাতের সূর্যের মতো উজ্জ্বল। 
 
তাঁদের দৃষ্টিপাতের ফলে মনে হল তাঁরা যেন রজোগুণ এবং তমোগুণের সৃষ্টিকর্তা এবং পালনকর্তা। বিষ্ণু স্বয়ং সত্ত্বগুণের প্রতীক, ব্রহ্মা রজোগুণের প্রতীক এবং মহেশ্বর হচ্ছেন তমোগুণের প্রতীক। তাই এই জগতের সব কিছুর পালনকর্তারূপে বিষ্ণু, ব্রহ্মা এবং শিবেরও সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা।

এই বিষ্ণুমূর্তিকে দর্শন করার পর ব্রহ্মা দেখলেন যে, অনেক অনেক ব্রহ্মা, শিব, দেব-দেবী, জীবসমূহ এমন কি পিপীলিকার মতো ক্ষুদ্র জীব এবং অতি ক্ষুদ্র তৃণ, গুল্ম-স্থাবর, জঙ্গম সব কিছুই মূর্ত হয়ে তাঁদের ঘিরে নৃত্য করছেন। 
 
তাঁদের সেই নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে মধুর সুরে গান হচ্ছে এবং বাজনা বাজছে, তাঁরা সকলেই সেই সমস্ত বিষ্ণুমূর্তির পূজা করছিলেন। ব্রহ্মা বুঝতে পারলেন যে, সেই সমস্ত বিষ্ণুমূর্তি, অণিমা প্রভৃতি ঐশ্বর্য, মায়া প্রভৃতি বিভূতি এবং মহত্তত্ত্ব

প্রভৃতি চতুর্বিংশতি তত্ত্বে পরিবেষ্টিত হয়ে রয়েছেন। ভগবান শ্রীবিষ্ণুর মহিমাবলে তাঁর অধীনস্থ সমস্ত শক্তি তাঁদের সেবায় রত। 
 
কাল, স্বভাব, সংস্কার, কাম, কর্ম, প্রকৃতির তিনটি গুণ প্রভৃতি পদার্থসকল মূর্তিমান হয়ে তাঁদের উপাসনা করছিলেন। ব্রহ্মা বুঝতে পারলেন যে, তাঁরা সত্য, জ্ঞান এবং আনন্দের উৎস। তাঁদের সেই বিগ্রহ সৎ, চিৎ ও আনন্দময় এবং তাঁরাই হচ্ছেন উপনিষদের অনুগামীদের আরাধ্য পরমতত্ত্ব। 
 
ব্রহ্মা বুঝতে পারলেন যে, সমস্ত গোবৎস এবং গোপবালকেরা কোন যৌগিক শক্তির প্রভাবে বা অলৌকিক শক্তির প্রভাবে বিষ্ণুমূর্তিতে রূপান্তরিত হয়নি। এমন কি তাঁরা বিষ্ণুমায়ার প্রভাবেও এই বিষ্ণুমূর্তিতে রূপান্তরিত হননি, তাঁরা হচ্ছেন স্বয়ং বিষ্ণু। 
 
বিষ্ণু এবং বিষ্ণুমায়ার পার্থক্য হচ্ছে আগুনের সঙ্গে তাপের পার্থক্যের মতো। তাপের মধ্যে উষ্ণতা আদি আগুনের গুণাবলী বর্তমান; কিন্তু তবুও তাপ আগুন নয়। সেই বালকদের এবং গোবৎসদের বিষ্ণুমূর্তিতে প্রকাশ অগ্নির তাপের মতো ছিল না, তা ছিল স্বয়ং আগুন। 
 
তাঁরা সকলেই ছিলেন বিষ্ণু, প্রকৃতপক্ষে বিষ্ণুর গুণাবলী হচ্ছে পূর্ণসত্তা, পূর্ণজ্ঞান এবং পূর্ণ আনন্দ। জড় অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আরেকটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়।- 
 
একই বস্তুর অনেক প্রতিবিম্ব দেখা যায়- এক সূর্যকে যেমন বিভিন্ন জলের পাত্রে ভিন্ন ভিন্ন সূর্যরূপে প্রতিবিম্বিত হতে দেখা যায়, 
 
কিন্তু সেই প্রতিবিম্বে যথার্থ তাপ এবং আলোক নেই; গোপবালক এবং গোবৎসরূপে শ্রীকৃষ্ণের প্রকাশ সেই রকম ছিল না। তাঁরা সকলেই ছিলেন পূর্ণ বিষ্ণুতত্ত্ব। তাঁদের সেই বিগ্রহ ছিল সৎ, চিৎ এবং আনন্দময়।

পরমেশ্বর ভগবানের সবিশেষ দিব্যরূপ এতই মহান যে, উপনিষদের নির্বিশেষ অনুগামীরাও তাঁর সেই রূপকে জানতে পারে না। 
 
যে সমস্ত নির্বিশেষবাদী জ্ঞানীরা উপনিষদের মাধ্যমে কেবল এইটুকু জানতে পারেন যে, পরম সত্য কোন জড় পদার্থ নয়, পরমতত্ত্ব জড়ের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়, এবং তা জড়া প্রকৃতির অতীত। 
 
পরমেশ্বর ভগবানের চিন্ময় রূপ এই সমস্ত সীমিত জ্ঞানসম্পন্ন নির্বিশেষবাদীদের উপলব্ধির অতীত। ব্রহ্মা, শ্রীকৃষ্ণকে এবং বিষ্ণুরূপে তাঁর প্রকাশকে বুঝতে পারলেন এবং তিনি বুঝতে পারলেন যে, পরমেশ্বর ভগবানের শক্তির প্রকাশের ফলেই এই জগতে স্থাবর এবং জঙ্গম সব কিছুরই অস্তিত্ব আছে।

ব্রহ্মা যখন তাঁর সীমিত শক্তি এবং একাদশ ইন্দ্রিয়ের অন্তর্গত সীমিত চেতনা নিয়ে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, তিনিও জড়া প্রকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ একটি জীবমাত্র এবং তিনি ভগবানের হাতের ক্রীড়নক মাত্র। 
 
একটি পুতুলের যেমন নিজে নিজে নাচবার ক্ষমতা নেই, সে কেবল নাচানেওয়ালার পরিকল্পনা অনুসারে নাচে, তেমনই সমস্ত দেবতা এবং সমস্ত  জীবেরা সকলেই পরমেশ্বর ভগবানের পরিচালনায় পরিচালিত হন। সেই সম্বন্ধে ‘চৈতন্য চরিতামৃতে’ বলা হয়েছে,

একেলা ঈশ্বর কৃষ্ণ আর সব ভৃত্য।
যারে যৈছে নাচায় সে তৈছে করে নৃত্য।।


সমস্ত জগৎ জড়া প্রকৃতির তরঙ্গের অন্তর্গত এবং সমস্ত জীব ক্ষুদ্র খড়কুটোর মতো তাতে ভাসছে। তাই তারা প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে চলেছে। কিন্তু কেউ যখন বুঝতে পারেন যে, তিনি হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবানের নিত্য সেবক, তখন ‘মায়া’ বা বেঁচে থাকার অর্থহীন সংগ্রাম বন্ধ হয়ে যায়।

এইভাবে ব্রহ্মা , যিনি হচ্ছেন জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর প্রভু, এবং যিনি সমস্ত বৈদিক জ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ, তিনিও পরমেশ্বর ভগবানের অচিন্ত্য শক্তি বুঝতে না পেরে এইভাবে মুহ্যমান হয়ে পড়লেন। জড় জগতে ব্রহ্মার মতো মহান ব্যক্তিও পরমেশ্বর ভগবানের মায়াকে বুঝতে পারেন না। 
 
ব্রহ্মা শুধু যে তা বুঝতে পারলেন না তা নয়, তাঁর সামনে শ্রীকৃষ্ণ যেভাবে তাঁর শক্তিকে প্রকাশ করেছিলেন, তা প্রত্যক্ষ করেই তিনি হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন।

শ্রীকৃষ্ণ যে কিভাবে নিজেকে গোবৎস ও গোপবালকে প্রকাশিত করেছিলেন, এবং তাঁরা সকলেই যে ছিলেন এক-একজন বিষ্ণু, তা যে কি করে সম্ভব, তা বুঝতে না পের ব্রহ্মা সম্পূর্ণরূপে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর এই অবস্থা দেখে তাঁর প্রতি শ্রীকৃষ্ণের করুণা হল। 
 
তিনি তখন সেই দৃশ্যের উপরে যোগমায়ার আবরণ টেনে দিলেন। ভগবদগীতায় বলা হয়েছে যে, যোগমায়ার দ্বারা আচ্ছাদিত ভগবানকে দেখা যায় না। 
 
সত্যকে যা আচ্ছাদিত করে, তা হচ্ছে মহামায়া বা ভগবানের বহিরঙ্গা শক্তি যা বদ্ধ জীবকে জড় ইন্দ্রিয়ের অতীত পরমেশ্বর ভগবানকে বুঝতে দেয় না। 
 
কিন্তু যে শক্তি আংশিকভাবে পরমেশ্বর ভগবানকে প্রকাশ করে এবং আংশিকভাবে তাঁকে আচ্ছাদিত করে রাখে, তাকে বলা হয় যোগমায়া। ব্রহ্মা কোন সাধারণ বদ্ধ জীব নন, তিনি সমস্ত দেবতাদের থেকেও অনেক অনেক মহান। 
 
কিন্তু তিনিও পরমেশ্বর ভগবানের লীলা বুঝতে পারলেন না। বদ্ধ জীব যে কেবল মোহিতই হয়ে পড়ে তা নয়, তারা ভগবানের অচিন্ত্য শক্তিকে বুঝতে পর্যন্ত পারে না। ভগবান যোগমায়ার আবরণ টেনে দিলেন যাতে ব্রহ্মা আর বিহুল হয়ে না পড়েন।

ব্রহ্মা যখন একটু প্রকৃতিস্থ হলেন, তখন তাঁর মনে হল যেন তিনি মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে পুনরুজ্জীবিত হলেন এবং অনেক কষ্টে তিনি তাঁর চোখ খুললেন।

তিনি তাঁর সাধারণ দৃষ্টি দিয়ে ভগবানের নিত্য ধাম দর্শন করতে সক্ষম হলেন। চারদিকে তাকিয়ে তিনি দেখলেন, মানুষের জীবনধারণের উপায়স্বরূপ বৃক্ষে পরিপূর্ণ, সর্ব ঋতুতে সুখদায়ক অপূর্ব মাধুর্যমন্ডিত বৃন্দাবন ধাম। 
 
তিনি দেখলেন যে, সেখানে সমস্ত জীবই জড়া প্রকৃতি নিরীহ জীবের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে শান্তিতে বসবাস করছে। তিনি বুঝতে পারলেন যে, যেহেতু সেই বৃন্দাবন ভগবানের নিত্য ধাম তাই কাম, ক্রোধ, লোভ আদি ভাবের সেখানে কোন স্থান নেই। 
 
ব্রহ্মা দেখলেন যে, সেখানে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একটি ছোট গোপশিশুরূপে তাঁর লীলাবিলাস করছেন, তিনি দেখলেন যে, দই মাখা ভাতের দলা হাতে, তিনি তাঁর বন্ধুদের এবং বৎসদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন, এক বছর আগে তারা হারিয়ে যাওয়ার পরে ঠিক যেভাবে তিনি তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।

ব্রহ্মা তখন তাঁর হংসবাহন থেকে নেমে এসে ভগবানের সামনে একটি স্বর্ণদন্ডের মতো ভূমিতে নিপতিত হলেন। এইভাবে প্রণাম করাকে বলা হয় ‘দন্ডবৎ’ অর্থাৎ একটি দন্ডের মতো পতিত হয়ে মাননীয় বৈষ্ণব বা ভগবানকে প্রণাম করা। 
 
ব্রহ্মা ভগবানের সামনে দন্ডবৎ প্রণতি জানালেন; এবং যেহেতু ব্রহ্মার গায়ের রং সোনার মতো, তাই তাঁকে দেখে মনে হল যেন একটি স্বর্ণদন্ড শ্রীকৃষ্ণের পায়ের কাছে পড়ে আছে। ব্রহ্মার মাথার চারটি মুকুট ভগবানের শ্রীপাদপদ্মকে স্পর্শ করল। 
 
আনন্দের আতিশয্যে ব্রহ্মার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল এবং সেই অশ্রুধারায় তিনি শ্রীকৃষ্ণের পদযুগল ধৌত করলেন। বহুক্ষণ, বহুবার দন্ডবৎ প্রণতি করবার পর ব্রহ্মা উঠে দাঁড়ালেন, হাত দিয়ে তাঁর চোখের জল মুছলেন এবং অবনত মস্তকে শ্রীকৃষ্ণকে অবলোকন করে বনিয়ে ও সাবধানে কৃতাঞ্জলি সহকারে কম্পিত কলেবরে গদগদ বাক্যে তাঁর স্তুতি করতে লাগলেন। 
 
আরও পড়ুন 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url