গােপীদের কৃষ্ণ অন্বেষণ-কৃষ্ণ লীলা কথা-রাস লীলা কাহীনি - শ্রীমদ্ভগবদ গীতা যথাযথ বাংলা

নতুন পোষ্ট

Add

বুধবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২০

গােপীদের কৃষ্ণ অন্বেষণ-কৃষ্ণ লীলা কথা-রাস লীলা কাহীনি

  গােপীদের কৃষ্ণ অন্বেষণ-রাস লীলা কাহীনি

কৃষ্ণ যখন হঠাৎ গােপীদের সামনে থেকে অন্তর্হিত হলেন, তখন তারা সব জায়গায় তাকে খুঁজতে লাগলেন। কোথাও তাকে না পেয়ে তারা অত্যন্ত ভয় পেলেন এবং তাঁর জন্য উন্মাদিনীর মতাে হয়ে গেলেন। তারা গভীর প্রীতি এবং অনুরাগের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের লীলাসমূহের কথা চিন্তা করতে লাগলেন।

 

শ্রীকৃষ্ণের চিন্তায় তন্ময় হয়ে তাদের স্মৃতিভ্রংশ হল এবং অশ্রু আচ্ছাদিত চক্ষে তারা শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত লীলা দর্শন করতে লাগলেন। তার সঙ্গে তাদের যে মধুর আলাপ-আলােচনা হয়েছিল, সেই কথা তাদের মনে পড়তে লাগল। 

 

তার আলিঙ্গন, তার চুম্বন এবং তার সমস্ত কার্যকলাপের কথা তাঁদের মনে পড়তে লাগল। কৃষ্ণের প্রতি এইভাবে আকৃষ্ট হয়ে তারা তার নাচ, তার হাঁটা এবং তার হাসি অনুকরণ করতে লাগলেন, যেন তারাই হচ্ছেন কৃষ্ণ।

 

 কৃষ্ণের বিরহে তারা সকলেই উন্মাদ হয়ে গেলেন, এবং তারা পরস্পরকে বলতে লাগলেন, "আমিই সেই কৃষ্ণ।" অচিরেই তারা একত্রিত হয়ে উচ্চস্বরে শ্রীকৃষ্ণের নাম-কীর্তন করতে লাগলেন, এবং তার অন্বেষণে তারা বনের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে বিচরণ করতে লাগলেন।

 

প্রকৃতপক্ষে, কৃষ্ণ হচ্ছেন সর্ব-ব্যাপক; তিনি আকাশে আছেন, তিনি বনে আছেন, এমন কি তিনি সকলের হৃদয়ে আছেন, এইভাবে তিনি সর্বত্রই সর্বক্ষণ বিরাজমান।

 

গােপীরা বৃক্ষ ও লতাদের কৃষ্ণের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। বনে নানা রকম বড় বড় গাছ এবং ছােট ছােট লতাগুল্ম ছিল, এবং তাদের সম্বােধন করে গােপীরা বলতে লাগলেন, “হে বটবৃক্ষ, তুমি কি মধুর হাস্যে চারদিক আলােকিত করে তার বাঁশি বাজাতে বাজাতে নন্দনন্দনকে এদিক দিয়ে যেতে দেখেছ?

 

সে আমাদের হৃদয় চুরি করে নিয়ে পালিয়ে গেছে। যদি তুমি তাকে দেখে থাক তা হলে দয়া করে তুমি আমাদের বল কোনদিকে সে গেছে। প্রিয় অশােকবৃক্ষ, নাগচম্পা বৃক্ষ এবং চম্পা বৃক্ষ, তােমরা কি বলরামের অনুজ কৃষ্ণকে এদিক দিয়ে যেতে দেখেছ? আমাদের মনে গর্ব হয়েছিল তাই সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।”

 

কৃষ্ণের হঠাৎ এভাবে চলে যাওয়ার কারণ গােপীরা জানতেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, যখন তারা কৃষ্ণের সঙ্গসুখ উপভােগ করছিলেন, তখন তারা মনে মনে ভেবেছিলেন যে, তারাই হচ্ছেন এই ব্রহ্মাণ্ডে সব চাইতে সৌভাগ্যশালী স্ত্রী, এবং যেহেতু তাদের মনে এই গর্ব হয়েছিল, তৎক্ষণাৎ কৃষ্ণ সেখান থেকে অন্তর্হিত হন তাদের গর্ব খর্ব করবার জন্য।

 

কৃষ্ণ চান না যে তার ভক্তরা তাকে সেবা করার সৌভাগ্যগর্বে গর্বিত হােক। তিনি সকলেরই সেবা গ্রহণ করেন, কিন্তু ভক্তরা তাঁকে সেবা করার গর্বে গর্বিত হয়ে পরস্পরের সঙ্গে বিবাদ করুক, এটা তিনি চান না। মাঝে মাঝে এইরকম মনােভাব প্রকাশ পেলেও, কৃষ্ণ তাঁর ভক্তের প্রতি তার আচরণের পরিবর্তন করে এই ধরনের মনােভাবের সংশােধন করেন।

 

গােপীরা তখন তুলসীবৃক্ষকে সম্বােধন করে বললেন, "প্রিয় তুলসী, তুমি কৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয় কেননা তােমার পাতা সব সময় তার চরণকমলে থাকে। প্রিয় মালতী, মল্লিকা, যুথিকা, আমাদের দিব্য আনন্দে মগ্ন করার পর এ পথ দিয়ে যাওয়ার সময় কৃষ্ণ নিশ্চয়ই তােমাদের সকলকে স্পর্শ করেছেন।

 

তােমরা কি মাধবকে এ পথ দিয়ে যেতে দেখেছ? হে আত্র, পিয়াল, অসন, জম্বু, বিল্ব, কদম্ব এবং অন্যান্য পরহিতকর যমুনা তটস্থিত পুণ্যবান বৃক্ষগণ, কৃষ্ণ নিশ্চয়ই এ পথ দিয়ে গেছে তােমরা কি দয়া করে আমাদের বলবে কোন দিক দিয়ে সে গেছে?”

 

গােপীরা যখন যেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন, সেখানে মাটির উপর তাকালেন এবং ধরিত্রীকে সম্বােধন করে বললেন, “হে ধরিত্রী, তুমি কোন্ তপস্যার আচরণ করেছিলে,

 

যেহেতু শ্রীকৃষ্ণের চরণ-স্পর্শজনিত আনন্দে তােমার রােমরাজি পুলকিত হয়ে শােভা পাচ্ছে? কৃষ্ণ নিশ্চয়ই তােমার প্রতি অত্যন্ত প্রসন্ন, তা না হলে বরাহরূপে কেন তিনি তােমাকে আলিঙ্গন করেছিলেন? তুমি যখন জলে ডুবে গিয়েছিলে, তখন তিনি তােমাকে তার দন্তাগ্রভাগে ধারণ করে সেই জল থেকে তােমাকে তুলে এনেছিলেন এবং এইভাবে তােমাকে রক্ষা করেছিলেন।"

 

অসংখ্য বৃক্ষ-লতাদের এইভাবে সম্বােধন করে তাঁরা অপূর্ব সুন্দর হরিণদের দিকে তাকালেন যারা অত্যন্ত মনােরমভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেই হরিণদের সম্বোধন করে তারা বললেন, “তােমাদের দেখে মনে হচ্ছে যে, কৃষ্ণ, যিনি হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান নারায়ণ, নিশ্চয়ই তার পার্ষদ-সৌভাগ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে এখান দিয়ে গেছে।

 

তা না হলে লক্ষ্মীর বক্ষের কুমকুমের রক্তরাগে রঞ্জিত তার মালার সৌরভ কি করে এখানকার সমীরণকে সুরভিত করল? মনে হচ্ছে যে, তারা নিশ্চয়ই এখান দিয়ে গেছেন এবং তারা তােমাদের অঙ্গ স্পর্শ করেছেন। তাই তােমরা এত আনন্দিত এবং আমাদের দিকে এইভাবে সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টিপাত করছ।

 

তােমরা কি আমাদের বলবে কোনদিকে কৃষ্ণ গেছেন? কৃষ্ণ বৃন্দাবনের শুভাকাঙ্ক্ষী, আমাদের প্রতি তার যেরকম করুণা, ঠিক তেমনই তিনি তােমাদের প্রতিও করুণাময়; তাই আমাদের ছেড়ে আসার পর তিনি নিশ্চয়ই তােমাদের সঙ্গদান করেছেন।

 

হে সৌভাগ্যশালী বৃক্ষগণ, আমরা বলরামের অনুজ শ্রীকৃষ্ণের চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছি। এক হাতে লক্ষ্মীদেবীর কণ্ঠ আলিঙ্গন করে এবং অপর হাতে লীলাকমল ধারণ করে এখান দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি নিশ্চয়ই ফলভারে অবনত তােমাদের প্রণাম গ্রহণ করেছেন এবং মহা-আনন্দে তােমাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেছেন।”

 

তখন কয়েকজন গােপী অন্য গােপীদের সম্বােধন করে বলতে লাগলেন, “প্রিয় সখীগণ, এই যে সমস্ত লতাগুলি পতিকে আলিঙ্গন করে রয়েছে, এদের আমরা জিজ্ঞাসা করি না কেন? মনে হচ্ছে এই লতাগুলির ফুল নিশ্চয়ই কৃষ্ণের নখস্পর্শ লাভ করেছে। তা না হলে এরা আজ কেন এত আনন্দে মগ্ন?" 

 

সর্বত্র শ্রীকৃষ্ণের অন্বেষণ করে গােপীরা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়লেন, তখন তারা উন্মাদিনীর মতাে প্রলাপ বকতে লাগলেন। তারা কৃষ্ণের বিভিন্ন লীলার অনুকরণ করতে লাগলেন। তাদের মধ্যে একজন পুতনা রাক্ষসীকে অনুকরণ করলেন এবং একজন কৃষ্ণের মতাে আচরণ করে তার স্তনপান করতে লাগলেন।

 

অন্য কোন সুন্দরী কৃষ্ণের বালকভাব ধারণ করে শকটাসুরের মতো অবস্থিত অন্য গােপীকে চরণাঘাত করলেন। কোন গােপী তৃণাবর্ত দৈত্যের ভাব গ্রহণ করে কৃষ্ণের বাল্যভাব আচরণকারিণী অন্য এক গােপীকে হরণ করলেন।

 

কোন গােপীকে ভূমিতে জানুদ্বয় ঘর্ষণ সহকারে কিঙ্কিনীধ্বনি করতে করতে শ্রীকৃষ্ণের হাঁটবার চেষ্টার অনুকরণ করতে লাগলেন। দুজন গােপী কৃষ্ণ এবং বলরামের অনুকরণ করলেন, এবং অন্য অনেক গােপিকারা গােপবালকের ভাব ধারণ করলেন। 

 

একজন গােপা বকাসুরের ভাব ধারণ করলেন, এবং অন্য একজন গােপী কৃষ্ণভাব ধারণ করে বকাসুর বধ লীলা অনুকরণ করলেন; আর একজন গােপী বৎসাসুর বধ করলেন।

 

কৃষ্ণ যেভাবে গাভীদের বিভিন্ন নাম ধরে ডাকতেন, অনুকরণ করে গােপীরা গাভীদের বিভিন্ন নাম ধরে ডাকতে লাগলেন।

 

একজন গােপী বাঁশি বাজাতে লাগলেন, এবং অন্য গােপীরা তাঁর প্রশংসা করলেন—ঠিক যেভাবে গােপসখারা বংশীবাদনরত শ্রীকৃষ্ণের প্রশংসা করেন। একজন গােপী অন্য একজন গােপীর কাধে হাত রেখে চলতে চলতে কৃষ্ণগতচিত্তা হয়ে বলতে লাগলেন, “হে গােপীগণ, আমি কৃষ্ণ, আমার মনােরম গমনভঙ্গী দর্শন কর।” 

 

একজন গােপী তার পরিধেয় বসন উর্ধ্বে ধারণ করে বললেন, আর তােমরা এই প্রবল বর্ষণ এবং ঝঞ্চায় ভয় পেয়াে না। আমি তােমাদের রক্ষা করব। এইভাবে তিনি গিরি গােবর্ধন ধারণ লীলা অনুকরণ করলেন।

 

একজন গােপী অন্য আরেক ব্রজাঙ্গনার উপর দাঁড়িয়ে তাঁর মস্তকে পদাঘাত করে বললেন, “হে দুষ্ট আমি এখন তােমাকে কঠোরভাবে শাস্তি দেব। এখনই তুমি এই স্থান পরিত্যাগ করাে। আমি সমস্ত দুষ্কৃতকারীদের দণ্ড দেওয়ার জন্য এই পৃথিবীতে অবতরণ করেছি!”

 

 আরেকজন গােপী তার সখীদের বললেন, দাবানলের লেলিহান শিখা আমাদের গ্রাস করতে আসছে। তােমরা তােমাদের চোখ বন্ধ কর, এবং এই আসন্ন বিপদ থেকে আমি তােমাদের এক্ষুণি উদ্ধার করব।


এইভাবে উন্মাদিনীর মতাে শ্রীকৃষ্ণের বিরহ অনুভব করতে লাগলেন। বৃন্দাবনে তরুলতাদের কাছে কৃষ্ণের কথা জিজ্ঞাসা করতে করতে তারা ধ্বজ, পদ্ম, বজ্র, অঙ্কুশ চিহ্নিত তার পদচিহ্ন দেখতে পেলেন।

 

সেই পদচিহ্ন দর্শন তারা বলতে লাগলেন, দেখ, এখানে কৃষ্ণের পদচিহ্ন দেখা যাচ্ছে। তাঁর সমস্ত চিহ্ন—ধ্বজ, পদ্ম, অঙ্কুশ, বজ্র সবই স্পষ্টভাবে এখানে চিহ্নিত তারা সেই পদচিহ্ন অনুসরণ করতে লাগলেন এবং অচিরেই তারা দেখলেন যে, সেই পদচিহ্নের পাশে আর একজোড়া পায়ের ছাপ। 

 

তা দেখে তারা আর্তভাবে বলতে লাগলেন, “হে সখীগণ, নন্দসুত কৃষ্ণের পায়ের ছাপের পাশে আর একজোড়া পায়ের ছাপ। এই পায়ের ছাপগুলাে কার? করীবরের সঙ্গে যেভাবে গমন করে, সেইভাবে কৃষ্ণের সঙ্গে কোন ভাগ্যবতী গমন করেছে যার এই পদচিহ্নগুলি দেখা যাচ্ছে। 

 

গমনকালে কৃষ্ণ তাঁর কাঁধে হাত তাই আমাদের বুঝতে হবে যে, এই বিশেষ গােপীটি নিশ্চয়ই আমাদের থেকে বেশী প্রীতি এবং অনুরাগের সঙ্গে তার আরাধনা করেছিল। তাই যদিও তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, তিনি তাকে ছাড়তে পারেননি। তিনি তাকে তার সঙ্গে নিয়ে গেছেন। হে সখীগণ, ভেবে দেখ এই স্থানের কি দিব্য মহিমামণ্ডিত।

 

ব্রহ্মা, শিব এবং ঐশ্বর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মীও শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মের ধুলিকণা মস্তকে ধারণ করেন। ওই ভাগ্যবতীর এই পদচিহ্নগুলি আমাদের গভীর দুঃখ উৎপাদন করছে, সেই সৌভাগ্যশালিনী একলাই সমস্ত গােপীদের ধনস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণের অধরসুধা অপহরণপূর্বক পান করছে।”

 

তারপর কিছুদূর যাওয়ার পর সেই গােপীর পদচিহ্ন না দেখতে পেয়ে তারা বলতে লাগলেন, “হে সখীগণ, এখানে ত আর তার পদচিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই তৃণাঙ্কুরে তার সুকোমল পদতল ব্যথিত হওয়ায় কৃষ্ণ তাকে কাঁধে করে নিয়ে গেছেন। 

 

আহা, না জানি সে শ্রীকৃষ্ণের কত প্রিয়! এখানে কৃষ্ণ নিশ্চয়ই তার প্রিয়া সেই রাধার জন্য ফুল তুলেছেন। কেননা এখানে উঁচু ডাল থেকে ফুল পাড়ার জন্য তাকে উঁচু হতে হয়েছিল এবং তাই কেবল তার পায়ের অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে। 

 

হে সখীগণ, এখানে নিশ্চয়ই কৃষ্ণ রাধারাণীর সঙ্গে বসেছিলেন এবং তার কবরীতে সেই ফুলগুলি গুঁজে দিয়েছিলেন। তাঁরা যে এখানে একসঙ্গে . বসেছিলেন, সেই সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। কৃষ্ণ যে আত্মারাম, তাকে অন্য কোন উৎস থেকে আনন্দ উপভােগ করতে হয় না,

 

তবুও দেখ, তাঁর প্রিয় ভক্ত রাধারাণীকে সন্তুষ্ট করার জন্য একজন কামী বালক তার প্রিয়ার সঙ্গে যেভাবে আচরণ করে, ঠিক সেইভাবে আচরণ করেছেন। কৃষ্ণ এতই কৃপালু যে, তার সখীদের সমস্ত দৌরাত্ম তিনি সব সময় সহ্য করেন।”

 

এইভাবে সমস্ত গােপীরা সেই বিশেষ গােপীটি, যাঁকে কৃষ্ণ একলা নিয়ে গিয়েছিলেন তার দোষ দর্শন করতে লাগলেন। তারা বলতে লাগলেন যে, সেই প্রধানা গােপী, রাধারাণী, যাকে একলা তার সাথে নিয়ে কৃষ্ণ চলে গেছেন, তিনি নিশ্চয়ই সৌভাগ্যগর্বে অত্যন্ত গর্বিত হয়েছেন, তিনি হয়ত মনে করছেন যে, তিনিই হচ্ছেন গােপীশ্রেষ্ঠা।

 

গােপিকারা বলতে লাগলেন, "কৃষ্ণ আমাদের সকলকে ফেলে কেন কেবল তাকে সঙ্গে নিয়ে গেল? সে নিশ্চয়ই অত্যন্ত গুণবতী এবং অত্যন্ত সুন্দরী। সে নিশ্চয়ই কৃষ্ণকে গভীর অরণ্যে নিয়ে গিয়ে বলেছে, 'হে কৃষ্ণ, আমি এখন অত্যন্ত ক্লান্ত। আমি আর চলতে পারছি না। দয়া করে তুমি এখন আমাকে বহন করে যেখানে তােমার ইচ্ছে নিয়ে চলাে।

 

রাধারাণী যখন কৃষ্ণকে এইভাবে বলল, কৃষ্ণ তখন নিশ্চয়ই তাকে বলেছিল, "ঠিক আছে, তুমি আমার কাধে ওঠো।' কিন্তু তখন কৃষ্ণ সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল, এবং এখন রাধারাণী নিশ্চয়ই তার জন্য আকুল হয়ে পরিতাপ করছে, 'হে প্রিয়ে, হে প্রাণনাথ, তুমি এত সুন্দর এবং এত শক্তিশালী।

 

আমি ত কেবল তােমার অনুগত দাসী। আমি অনুশােচনায় অধীর হয়ে উঠেছি। দয়া করে আবার আমার কাছে ফিরে এসাে। কৃষ্ণ কিন্তু তার কাছে ফিরে এলেন না। আড়াল থেকে তিনি নিশ্চয়ই দেখছেন এবং রাধারাণীর দুঃখ উপভােগ করছেন।”

 

সমস্ত গােপীরা তখন অরণ্যের গভীর থেকে গভীরতর প্রদেশে গিয়ে কৃষ্ণের অনুসন্ধান করতে লাগলেন, কিন্তু তারা যখন জানতে পারলেন যে, সত্যি সত্যিই রাধারাণীকে একলা ফেলে কৃষ্ণ চলে গেছেন, তখন তারা অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। এটাই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃতের পরীক্ষা।

 

সমস্ত গােপীদের ফেলে রেখে রাধারাণীকে একলা তার সঙ্গে নিয়ে কৃষ্ণ চলে গেছেন বলে তারা প্রথমে একটু ঈর্ষান্বিতা হয়েছিলেন, কিন্তু যখনই তারা জানতে পারলেন যে, কৃষ্ণ রাধারাণীকেও ফেলে চলে গেছেন এবং রাধারাণী গভীর অরণ্যে একলা তার জন্য শােক করছেন, তখন তারা তার প্রতি আরও বেশি সহানুভূতি-সম্পন্ন হলেন।

 

গােপীরা রাধারাণীকে খুঁজে পেলেন এবং তার কাছ থেকে সব কিছু জানতে পারলেন, কিভাবে তিনি কৃষ্ণের প্রতি অশােভন আচরণ করেছেন, কিভাবে তার গর্ব হয়েছিল এবং কিভাবে কৃষ্ণ তার সেই গর্ব খর্ব করেছেন।

 

তার কাছ থেকে সব শােনার পর, গােপীরা তার প্রতি অত্যন্ত সহানুভুতি-সম্পন্ন হলেন। তারপর রাধারাণীসহ সমস্ত গােপীরা কৃষ্ণকে খুঁজতে খুঁজতে অরণ্যের গভীর প্রদেশে প্রবেশ করলেন। অবশেষে তারা আর চাদের আলাে দেখতে পেলেন না।

 

তারা যখন দেখলেন যে, ক্রমশই অন্ধকার হয়ে আসছে, তখন তারা থামলেন। তাদের মন এবং বুদ্ধি শ্রীকৃষ্ণের চিন্তায় মগ্ন হল; তারা সকলেই কৃষ্ণের কার্যকলাপ এবং কথার অনুকরণ করতে লাগলেন।

 

তাদের মন, প্রাণ সবই সম্পূর্ণভাবে শ্রীকৃষ্ণের চরণে অর্পিত হয়েছিল, তাদের পরিবার-পরিজনের কথা সম্পূর্ণভাবে ভুলে গিয়ে তারা শ্রীকৃষ্ণের মহিমা কীর্তন করতে লাগলেন।

 

এইভাবে সমস্ত গােপীরা যমুনার তীরে সমবেত হলেন এবং কৃষ্ণ অবশ্যই তাদের কাছে ফিরে আসবেন, এই আশায় তারা কেবল হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে-কীর্তন করে শ্রীকৃষ্ণের মহিমা উপলব্ধি করতে লাগলেন।

আরও পড়ুন

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
৩২. অক্রুরের বৃন্দাবনে আগমন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন