ধেনুকাসুর বধ-কৃষ্ণলীলা কাহিনী-শ্রীমদ্ভাগবত - শ্রীমদ্ভগবদ গীতা যথাযথ বাংলা

নতুন পোষ্ট

Add

বুধবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০

ধেনুকাসুর বধ-কৃষ্ণলীলা কাহিনী-শ্রীমদ্ভাগবত

 

 ধেনুকাসুর বধ-কৃষ্ণ লীলা কাহিনী

 
 
এইভাবে শ্রীকৃষ্ণ তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা বলরামের সঙ্গে তার কৌমার লীলাবিলাস করে পৌগণ্ডে পদার্পণ করলেন। ৬ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বয়সকে পৌগণ্ড বলা হয়। 
 
সেই সময় সমস্ত গােপেরা নিজেদের মধ্যে আলােচনা করে ঠিক করলেন যে, যে সমস্ত বালকের বয়স ৫ বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে, তাদের উপর গােচারণে গরু চরাবার ভার দেওয়া হােক। 
 
এইভাবে গাভীসমূহের দায়িত্বভার লাভ করে কৃষ্ণ ও বলরাম বৃন্দাবনে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন এবং তাদের পদচিহ্নের দ্বারা সেই ভূমি পবিত্র হল। 
 
বলরাম এবং গােপবালকসহ কৃষ্ণ গরু চরাতে লাগলেন এবং বৃন্দাবনের বনপথে যেতে যেতে মধুর স্বরে তার বাঁশি বাজাতে লাগলেন। সেই বৃন্দাবনে ভূমি ছিল ফুল, ফল এবং গােচারণভূমিতে পরিপূর্ণ। 
 
বৃন্দাবনের বন ভক্তের হৃদয়ের মতােই পবিত্র এবং তা ফুল, ফল ও ভ্রমরে পরিপূর্ণ। সেখানে কূজনরত পাখি ছিল, নির্মল সরােবর ছিল, যার জল মানুষের সমস্ত শ্রান্তি দূর করত। 
 
দেহ এবং মনকে ন্নিদ্ধ প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিতে সেখানে সর্বদা সুগন্ধ সমীরণ বইত। বলদেব সহ তার সখাদের সঙ্গে কৃষ্ণ বনে প্রবেশ করে কোন অনুকূল পরিস্থিতি দর্শন করে সেই পরিবেশ সম্পূর্ণভাবে উপভােগ করতেন। 
 
কৃষ্ণ দেখতেন গাছগুলি ফলভারে নত হয়ে ভূমি স্পর্শ করছে, যেন তার শ্রীপাদপদ্মে প্রণতি জানাচ্ছে। বৃক্ষ, ফল, ফুল এদের ব্যবহারে তিনি অত্যন্ত প্রীত হতেন এবং তাদের মনের কথা জানতে পেরে হাসতেন। 
 
এইভাবে একদিন বৃন্দাবনে বিচরণ করার সময় কৃষ্ণ তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা বলরামকে বললেন, “প্রিয় বলরাম, তুমি আমাদের মধ্যে সব চেয়ে বড়, এবং স্বর্গের দেবতারাও তােমার শ্রীপাদপদ্মের আরাধনা করে। 
 
দেখ, কিভাবে এই সমস্ত গাছগুলি ফলে ফুলে পূর্ণ হয়ে তােমার শ্রীপাদপদ্ম বন্দনা করার জন্য প্রণতি জানাচ্ছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে যে, তমসাচ্ছন্ন বৃক্ষরূপী শরীর থেকে তারা মুক্ত হবার চেষ্টা করছে। প্রকৃতপক্ষে, বৃন্দাবনের এই সমস্ত গাছগুলি কোন সাধারণ জীব নয়।
 
পূর্ববর্তী জীবনে নির্বিশেষবাদ পােষণ করে তারা এখন এই স্থবিরত্ব প্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু এখন তারা এই বৃন্দাবনে তােমার দর্শন লাভে ধন্য হয়েছে এবং তােমার সঙ্গলাভের মাধ্যমে তারা যাতে তাদের পারমার্থিক উন্নতি লাভ করতে পারে, সেই জন্য তারা প্রার্থনা করছে। সাধারণত বৃক্ষ হচ্ছে। 
 
তমােগুণে আচ্ছন্ন জীব। নির্বিশেষবাদী দার্শনিকেরা সেই তমােগুণের দ্বারা আচ্ছন্ন, কিন্তু তােমার উপস্থিতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে তারা সেই তমােগুণের আবরণ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে। 
 
এই যে সমস্ত ভ্রমরেরা তােমার চারিপাশে গুঞ্জন করছে, আমার মনে হয় তারাও পূর্বজন্মে তােমার ভক্ত ছিল। তারা তােমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না, কেননা তােমার থেকে অধিক স্নেহপরায়ণ প্রভু তারা আর কোথায় পাবে? 
 
তুমিই হচ্ছ পরমেশ্বর ভগবান এবং এই সমস্ত ভ্রমরেরা সর্বক্ষণ তােমার গুণকীর্তন করার চেষ্টা করছে। আমার মনে হয় তাদের কেউ কেউ নিশ্চয় তােমার ভক্ত, মহান ঋষি, মুনি, এবং তারা ভ্রমরের রূপ ধারণ করে এখানে এসেছে, কেননা এক মুহূর্তের জন্যও তােমার সঙ্গ ছাড়া তারা থাকতে পারবে না। প্রিয় দাদা, তুমিই হচ্ছ পরমারাধ্য ভগবান।
 
দেখ, ময়ুরেরা কেমন আনন্দে বিভাের হয়ে তােমার সামনে নাচছে। স্নেহপরায়ণ এবং ভীরু হরিণগুলির ব্যবহার ঠিক ব্রজগােপিকাদের মতাে, তাদের মতাে স্নেহভরে তারা তােমাকে স্বাগত জানাচ্ছে। 
 
আর বনের কোকিলেরা মহানন্দে তােমাকে বরণ করছে, কেননা তারা জানে যে, তােমার আবির্ভাব পরম মঙ্গলময়। যদিও এরা হচ্ছে বৃক্ষ এবং পশুপাখি, বৃন্দাবনের এই সমস্ত অধিবাসীরা সকলেই তােমার মহিমা কীর্তন করছে। 
 
তাদের যােগ্যতা অনুসারে তারা তােমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে, ঠিক যেভাবে মহাত্মারা অপর একজন মহাত্মাকে তাদের আলয়ে স্বাগত জানান। 
 
আর এই ভূমি এতই পবিত্র এবং সৌভাগ্যশালী যে, তােমার শ্রীপাদপদ্মের চিহ্নে তার অঙ্গ ভূষিত হয়েছে। “তােমার মতাে একজন মহাপুরুষকে এইভাবে বরণ করা বৃন্দাবনের অধিবাসীদের পক্ষে স্বাভাবিক। 
 
এখানকার তৃণ, গুল্ম এবং লতারাও কত সৌভাগ্যশালী যে, তারা তােমার শ্রীপাদপদ্মের স্পর্শ লাভ করছে। আর তােমার করকমলের স্পর্শে ছােট ছােট গাছগুলিও মহিমান্বিত হচ্ছে। 
 
এখানকার নদী এবং পাহাড়গুলিরও সৌভাগ্যের অন্ত নেই, কেননা তুমি তাদের দিকে তাকিয়ে দেখছ। আর সর্বোপরি ব্রজগােপিকারা হচ্ছে সব চাইতে ভাগ্যবান, কেননা তােমার রূপে তারা আকৃষ্ট হয়েছে এবং তােমার বলিষ্ঠ বাহ্যুগলের আলিঙ্গনে তারা ধন্য হয়েছে।” 
 
এইভাবে কৃষ্ণ এবং বলরাম মহা-আনন্দে যমুনার কুলে গাভী এবং গােবৎস সহ বৃন্দাবনের অধিবাসীদের সঙ্গম সুখ উপভােগ করছিলেন। কোন কোন জায়গায় তাদের সখারাও তাদের সঙ্গে যেত। 
 
কৃষ্ণ ও বলরামের সঙ্গে যেতে যেতে তারা ভ্রমরের গুঞ্জন অনুকরণ করে গান গাইত। পথ চলতে চলতে কখনও তারা সরােবরে হংসের ডাক অনুকরণ করত অথবা কোন ময়ূরকে নাচতে দেখে তারা সেই নাচের অনুকরণ করে কৃষ্ণের সামনে নাচতে থাকত। কৃষ্ণও সেই নাচের ছন্দে তাঁর ঘাড় দোলাতেন এবং তার সখারা তখন আনন্দের আতিশয্যে হেসে উঠে। 
 
কৃষ্ণ যে সমস্ত গাভীর তত্ত্বাবধান করতেন, তাদের বিভিন্ন নাম ছিল, এবং স্নেহভরে তাদের সেই নাম ধরে ডাকতেন। কৃষ্ণের ডাক শুনে গাভীরা হাম্বা রবে তার সেই ডাকের সাড়া দিত এবং বালকেরা তাদের হৃদয় ভরে ভাব-বিনিময় আস্বাদন করত। 
 
তারা বিভিন্ন পাখির ডাক অনুকরণ করত; বিশেষ করে চকোর, ময়ূর, কোকিল এবং ভরদ্বাজ পাখির ডাক তারা অনুকরণ করত। 
 
কখনও কখনও তারা যখন দেখত যে, কোন দুর্বল পশু বাঘ ও সিংহের ডাক শুনে ভয় পেয়ে পালাচ্ছে, তারাও তখন কৃষ্ণ ও বলরামের সঙ্গে সেই সমস্ত পশুর অনুকরণে তাদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে পালাবার অনুকরণ করত। 
 
তারা যখন শ্রান্ত হয়ে পড়ত, তখন তারা মাটিতে বসে বিশ্রাম করত। কোন বালকের কোলে মাথা রেখে বলরাম বিশ্রাম করতেন এবং কৃষ্ণ তার পা টিপে দিতেন। 
 
কখনও বা একটা তালপাতার পাখা নিয়ে তিনি বলরামকে হাওয়া করতেন। অন্য বালকেরা তখন নাচত বা গান গাইত, আর কখনও তারা একে অপরের সঙ্গে কুস্তি করত বা লম্ম দিত। 
 
এইভাবে বালকেরা যখন খেলা করত, কৃষ্ণ তখন তাদের সঙ্গে যােগ দিতেন এবং তাদের হাত ধরে তাদের সঙ্গম সুখ উপভােগ করতেন এবং হাসতে হাসতে তাদের কার্যকলাপের প্রশংসা করতেন। 
 
কৃষ্ণ যখন পরিশ্রান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়তেন, তখন তিনি কোন বড় গাছের গুঁড়িতে বা কোন গােপবালকের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়তেন। 
 
তিনি যখন এইভাবে কোন বালকের কোল বা গাছের গুঁড়িকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে পড়তেন তখন কয়েকজন বালক এসে তাঁর পা টিপে দিত, আর কেউ গাছের পাতা দিয়ে তাকে হাওয়া করত।
 
অধিকতর গুণবান কোন ছেলে তার প্রীতিসাধনের জন্য অতি মধুর স্বরে গান গাইত। এইভাবে অচিরেই তার শ্রান্তি বিদূরিত হত। 
 
লক্ষ্মীদেবী যার শ্রীপাদপদ্মের নিরন্তর সেবা করেন, সেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, এইভাবে গােপবালকদের সঙ্গে বালক হয়ে অঙ্গা শক্তির প্রভাবে তাঁর লীলাবিলাস করেছিলেন। 
 
কিন্তু একজন সাধারণ গােপবালকের মতাে লীলাবিলাস করলেও অনেক সময়েই তিনি তার পরমেশ্বরত্ব প্রদর্শন করেছেন। 
 
কখনও কখনও কিছু মানুষ নিজেদের ভগবান বলে প্রচার করে জনসাধারণকে প্রতারিত করে, কিন্তু তারা কেবল প্রতারণাই করতে পারে, তারা কখনই ভগবানের পরম ঐশ্বর্য প্রদর্শন করতে পারে না। 
 
কৃষ্ণ যখন তার পরম সৌভাগ্যশালী সখাদের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ শক্তি প্রদর্শন করছিলেন, তখন তার ভগবত্তা প্রদর্শন করার আর একটা সুযােগ এল। 
 
তার প্রিয়তম সখা শ্রীদাম, সুবল এবং কৃষ্ণ ও বলরাম কে সম্বোধন করে গভীর আবেগের সঙ্গে বললেন, "প্রিয় বলরাম, তুমি অত্যন্ত শক্তিশালী, তােমার বাহুযুগল অত্যন্ত বলিষ্ঠ। প্রিয় সমস্ত অনিষ্টকারী অসুরদের বিনাশ করতে তুমি অতি সুদক্ষ।
 
দেখ, কাছেই তালবন বলে একটি বন আছে। সেই বনটি তালগাছে পুর্ণ এবং সেই সব কটি গাছই ফলে ভরে আছে। তাদের কিছু ফল গাছ থেকে ঝরে পড়ছে, আর কিছু অতি সুপক্ক অবস্থায় গাছেই রয়েছে। 
 
সেটা খুব সুন্দর জায়গা, কিন্তু ধেনুকাসুর নামে এক অসুর সেখানে থাকায় কেউই সেখানে যেতে পারে না। কেউই সেখানে গিয়ে ফলগুলাে খেতে পারে না। প্রিয় কৃষ্ণ, প্রিয় বলরাম, সেই অসুরটি একটি গর্দভের রূপ পরিগ্রহ করে সেখানে রয়েছে আর তাকে ঘিরে একই রূপ পরিগ্রহ করে তার অনেক অসুর বন্ধু রয়েছে। 
 
তারা সকলেই অত্যন্ত শক্তিশালী। তাই সেখানে যাওয়া খুবই দুষ্কর। তােমরাই কেবল সেই অসুরগুলিকে সংহার করতে পার। তােমরা ছাড়া মৃত্যুভয়ে কেউই সেখানে যেতে পারবে না।
 
বনের পশুরা পর্যন্ত সেখানে যায় না, পাখিরা পর্যন্ত সেখানে ঘুমায় না, তারা সকলেই সেখান থেকে চলে গেছে। সেখানে রয়েছে কেবল সুমিষ্ট তালফলের গন্ধ। 
 
মনে হয়, এখনও পর্যন্ত কেউই গাছে বা মাটিতে সেই মিষ্টি ফলগুলি আস্বাদন করেনি। প্রিয় কৃষ্ণ, সত্যি কথা বলতে কি, আমরা সেই মিষ্টি সুবাসের দ্বারা গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছি। 
 
প্রিয় বলরাম, চল, আমরা সেখানে যাই এবং সেই ফল গুলো আস্বাদন করি। সেই ফলের গন্ধ এখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তােমরা কি সেই সুবাস আঘ্রাণ করছ না?” 
 
এইভাবে তাদের  বন্ধুরা যখন আবেদন করতে লাগল, তখন কৃষ্ণ এবং বলরাম তাদের মনােবাঞ্ছা পূর্ণ না করে পারলেন না এবং তাঁরা তাদের সখা পরিবৃত হয়ে সেই বনের দিকে এগোতে লাগলেন। 
 
তালবনে পৌছেই বলরাম হাত দিয়ে গাছওুলি যাকাতে লাগলেন। তাকে দেখে বােঝা গেল যে, তাঁর শরীরে লক্ষ হস্তীর বল রয়েছে। এইভাবে যাকানাের ফলে গাছ থেকে সমস্ত পাকা ফলগুলি ঝরে পড়তে লাগল। 
 
সেই ফল পড়ার শব্দ শুনে গর্দভরূগী ধেনুকাসুর মহাবেগে ধেয়ে এল এবং তার ফলে সমভ ভূমি এমনভাবে কাপতে লাগল এবং গাছওুলি দুলতে লাগল যে, মনে হল যেন ভূমিকম্প হচ্ছে।
 
 অসুরটি বলরামের সামনে এসে তার পিছনের পা দিয়ে বলরামের বুকে লাথি মারতে লাগল। প্রথমে বলরাম কিছুই বললেন না। 
 
কিন্তু রাগে অন্ধ হয়ে অসুরটি যখন বারবার তাকে লাথি মারতে লাগল, তখন বলরাম এক হাতে সেই গর্দভের পা দুটি ধরে ঘােরাতে ঘােরাতে একটা গাছের উপরে চুঁড়ে ফেললেন। 
 
বলরাম যখন সেই অসুরটির পা দুটি ধরে ঘােরাচ্ছিলেন, তখনই তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল। বলরাম তাকে সর্বোচ্চ তালগাছটির উপরে ছুঁড়ে ফেললেন। 
 
অসুরের শরীরটা এত ভারী ছিল যে, তৎক্ষণাৎ সেই তালগাছটি ভেঙ্গে অন্য গাছগুলির উপরে পড়ল এবং তার ফলে আরাে কয়েকটি গাছ ভেঙ্গে গেল। মনে হলে যেন একটা প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় সেই বনের উপর দিয়ে বয়ে গেল এবং একে একে গাছগুলি ভেঙ্গে পড়তে লাগল।
 

নিখিল ব্রহ্মান্ড যাকে আশ্রয় করে বিরাজ করছে সেই জগদীশ্বর ভগবান অনন্তদেৱে পক্ষে এই কার্য কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। এইভাবে ধেনুকাসুরকে গাছের উপর ছুড়ে দেওয়া হলে তার সমস্ত আত্মীয়রা তাদের বান্ধবের মৃত্যুতে ক্রুদ্ধ ও আক্রোশযুক্ত হয়ে সমবেতভাবে কৃষ্ণ এবং বলরামকে আক্রমণ করল। 
 
কিন্তু কৃষ্ণ এবং বলরাম। দু’জনে সমাগত অসুরদের পেছনের পা দুটো ধরে অবলীলাক্রমে তালগাছের উপর ছুঁড়ে ফেলতে লাগলেন। 
 
মেঘমালায় আকাশের যেমন শােভা হয়, ভাগ্ন তালগারে উপর প্রাণহীন দৈত্যদের দেহগুলিকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন নানা রঙে রঞ্জিত মেঘ সেই গাছ গুলোর উপর সমবেত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরামের সেই সুমহান কর্ম দর্শন করে স্বর্গের দেবতারা পুষ্পবর্ষণ, বাদ্যধ্বনি  করেছিলেন।
 
ধেনুকাসুর বধের কয়েকদিন পরে মানুষেরা নির্ভয়ে সেই তাল বনে এসে তাল ফল আহরণ করতে লাগল এবং গাভীরা সেখানকার অতি সুন্দর তৃণ ভােজন করতে লাগল। কৃষ্ণ এবং বলরামের এই অপ্রাকৃত লীলা সমূহ শ্রবণ এবং কীর্তন করার হলে অপরিমিত পুণ্য অর্জন করা যায়। 
 
সখা পরিবৃত হয়ে বৃন্দাবনে প্রবেশ করার সময় কৃষ্ণ ও বলরাম তাঁদের বাঁশি বাজাচ্ছিলেন এবং বালকেরা বনে তাঁদের অলৌকিক কার্যকলাপের কথা বলাবলি করে তাদের স্তুতি করছিলেন। 
 
সেই সময় গাভীদের পদবিক্ষিপ্ত ধূলিরাশিতে শ্রীকৃষ্ণের ময়ূরপুচ্ছ এবং বনফুল গ্রথিত কুন্তল রঞ্জিত হয়েছিল। তিনি সুরম্য হাস্য, মনােহর কটাক্ষপাত এবং বেণুধ্বনি সহকারে আসছিলেন। 
 
তার অনুচর রা তার যশােগান করছিলেন। কৃষ্ণকে ফিরে আসতে দেখে ব্রজ যুবতীরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। কৃষ্ণের বিরহে তারা সকলেই অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে পড়েছিলেন। সারাদিন তারা চিন্তা করছিলেন, বনে কৃষ্ণ কি করছেন অথবা কিভাবে তিনি গােচারণে গাভী চরাচ্ছেন।
 
কৃষ্ণকে ফিরে আসতে দেখে তাদের সমস্ত উৎকণ্ঠা বিদৃরিত হল এবং ভ্রমর যেভাবে পদ্মের মধুর জন্য আকুল হয়ে থাকে, ঠিক সেইভাবে তাঁরা কৃষ্ণের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। 
 
কৃষ্ণ যখন গ্রামে প্রবেশ করলেন, গােপ যুবতীরা তখন আনন্দে মগ্ন হয়ে হাসতে লাগলেন। কৃষ্ণ, তাঁর বেণু বাজাতে বাজাতে সেই গােপিকাদের হাস্যোজ্জ্বল সুন্দর মুখ দর্শন করে পরম আনন্দ উপভােগ করতে লাগলেন। পুত্রবৎসলা যশোদা ও রােহিণীদেবী তাঁদের পুত্র কৃষ্ণ বলরামকে কোলে তুলে নিলেন এবং তাদের সমস্ত বাসনা চরিতার্থ করলেন। 
 
তারা তাদের অপ্রাকৃত পুত্রদের সেবা করলেন, এবং সেই সঙ্গে তাদের আশীর্বাদও করলেন। তাদের স্নান করালেন এবং খুব সুন্দর সাজ-সজ্জায় ভূষিত করলেন। কৃষ্ণকে পীত বসন পরানাে হল এবং বলরামকে নীল বসন পরানাে হল। 
 
নানা রকম রত্ন-অলঙ্কার এবং ফুল মালায় তাঁদের সাজানাে হল। গােচারণ থেকে পরিশ্রান্ত হয়ে ফিরে এসে এইভাবে তাদের শ্রান্তি দূর হওয়ার ফলে তাদের অত্যন্ত প্রাণােচ্ছল এবং সুন্দর দেখাতে লাগল। 
 
তাদের মায়েরা তাঁদের নানা রকম সুস্বাদু খাবার খেতে দিলেন এবং তৃপ্তি সহকারে তাঁরা সেইগুলি খেলেন। খাওয়ার পর তাঁরা সুন্দর শয্যায় বসলেন এবং তাদের মায়েরা তাদের বিভিন্ন কার্যকলাপ নিয়ে গান করতে লাগলেন। 
 
অল্পক্ষণ পরেই তারা গভীর নিদ্রায় মগ্ন হলেন। এই ভাবে কৃষ্ণ এবং বলরাম গােপবালকরূপে তাদের বৃন্দাবন লীলা উপভােগ করেছিলেন। কখনও কখনও কৃষ্ণ বলরাম সহ তার সখাদের সঙ্গে, আবার কখনও বা একলাই তিনি যমুনার তীরে গাভীদের চরাতে যেতেন। 
 
ধীরে ধীরে গ্রীষ্মের আগমন হল এবং একদিন বালকেরা ও গাভীরা অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত হয়ে যমুনার জল পান করতে লাগল। সেই নদীর জল কালীয় নামে এক ভীষণ সর্পের বিষে বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। 
 
সেই জল পান করার ফলে গােপবালক এবং গাভীরা তৎক্ষণাৎ ভূমিতে পড়ে প্রাণত্যাগ করল, কেননা সেই জল খুবই বিষাক্ত ছিল। 
 
সমস্ত জীবনের জীবন শ্রীকৃষ্ণ তখন তাদের উপর তার কৃপাদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন এবং সমস্ত বালক ও গাভীরা তখন পুনরুজ্জীবিত হল এবং মহা বিস্ময়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। 
 
তারা বুঝতে পেরেছিল যে, যমুনার জল পান করার ফলে তাদের মৃত্যু হয়েছিল এবং কৃষ্ণের কৃপাদৃষ্টি তাদের পুনরুজ্জীবিত করেছে। এইভাবে তারা যােগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ যুগশক্তি মর্ম উপলব্ধি করল

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন