তৃণাবর্ত উদ্ধার-কৃষ্ণলীলা কাহিনী-শ্রীমদ্ভাগবত - শ্রীমদ্ভগবদ গীতা যথাযথ বাংলা

নতুন পোষ্ট

Add

সোমবার, ২৫ মে, ২০২০

তৃণাবর্ত উদ্ধার-কৃষ্ণলীলা কাহিনী-শ্রীমদ্ভাগবত



তৃণাবর্ত উদ্ধার-কৃষ্ণলীলা কাহিনী-শ্রীমদ্ভাগবত

লীলা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ-তৃণাবর্ত উদ্ধার

পরমেশ্বর ভগবান সর্ব-অবস্থাতেই ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ অর্থাৎ সমস্ত সম্পদ, সমস্ত বীর্য, সমস্ত শ্রী, সমস্ত যশ, সমস্ত জ্ঞান এবং সমস্ত বৈরাগ্য তাঁর মধ্যে বর্তমান। 
 
বহু রূপে তিনি অবতরণ করেন এবং তাঁর সেই অবতরণের ফলে বদ্ধ জীব তাঁর লীলাবিলাসের কাহিনী শ্রবণ করার অসীম সৌভাগ্য অর্জন করে। 
 
ভগবদগীতায় ভগবান বলেছেন, ‘জন্ম কর্ম চ মে দিব্যম’ অর্থাৎ ভগবানের জন্ম এবং তাঁর এই অসাধরণ কার্যকলাপের কাহিনী শ্রবণ করে অসীম সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে। 
 
ভগবানের লীলাবিলাসের কাহিনী শ্রবণ করার মাধ্যমে আমরা ভগবানের সঙ্গলাভ করতে পারি; ভগবানের এই সমস্ত লীলাবিলাস শ্রবণ করে আমরা জড় জগতের বন্ধন মুক্ত হয়ে অপ্রাকৃত ভগবদ্ধামে উন্নীত হতে পারি। 
 
প্রতিটি বদ্ধ জীবই গল্প, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদির আকারে অন্য জীবের কথা শুনতে ভালবাসে। অপরের কার্যকলাপ সম্বন্ধে শোনার এই প্রবণতার সদ্ধ্যবহার আমরা করতে পারি ভগবানের লীলাবিলাসের কাহিনী শ্রবণ করে এবং তার ফলে তৎক্ষণাৎ অপ্রাকৃত জগতে উন্নীত হতে পারি। শ্রীকৃষ্ণের লীলাসমূহ কেবল অপূর্ব সুন্দরই নয়, তা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষকও। 

কেউ যদি ভগবানের লীলাসমূহ শ্রবণ করেন, তা হলে দীর্ঘকাল জড় জগতে আবদ্ধ থাকার ফলে হৃদয়ে যে আবর্জনা সঞ্চিত হয়েছে, তা অচিরেই পরিষ্কার হয়ে যায়। 
 
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও নির্দেশ দিয়ে গেছেন যে, কেবল ভগবানের দিব্য নাম কীর্তন করার ফলে আমরা সব রকমের জড় কলুষ থেকে মুক্ত হতে পারি। আত্মোপলব্ধির অনেক রকম পন্থা রয়েছে, কিন্তু এই ভক্তিযোগের পন্থায়, যার সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে শ্রবণ, 
 
যে কেউই সব রকমের জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে এবং তার ফলে সে তার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে। জড় বন্ধনের কারণই হচ্ছে এই কলুষ, এবং হৃদয় যখন এই কলুষ থেকে মুক্ত হয়, তখনই জীবের সুপ্ত ভগবদ্ভক্তি জাগরিত হয়। 
 
পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার ফলে ভগবদ্ভক্তি জাগরিত হয়। পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার ফলে ভগবদ্ভক্তের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনে যোগ্যতা লাভ করা যায়। 
 
পরীক্ষিৎ মহারাজ তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পরামর্শ দিয়ে গেছেন যে, প্রতিটি জীবই যেন ভগবানের অপ্রাকৃত লীলাবিলাসের কাহিনী শ্রবণ করতে চেষ্টা করে। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই লীলা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ গ্রন্থ প্রকাশ করা হচ্ছে যাতে এই গ্রন্থ পাঠ করে প্রতিটি মানুষ তাঁর জীবনের পরম উদ্দেশ্য সাধন করতে পারেন।

ভগবান তাঁর অহৈতুকী কৃপার প্রভাবে এই জড় জগতে অবতরণ করেন এবং একজন সাধারণ মানুষের মতো তাঁর লীলাবিলাস করেন। দুর্ভাগ্যবশত দুস্কৃতকারীরা এবং নাস্তিকেরা শ্রীকৃষ্ণকে তাদেরই মতো একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করে তাঁকে অবজ্ঞা করে। 
 
ভগবদগীতায় ভগবান নিজেই এই ধরনের আচরণের নিন্দা করে তাঁকে অবজ্ঞা করে। ভগবদগীতায় ভগবান নিজেই এই ধরনের আচরণের নিন্দা করে বলেছেন, “অবজানন্তি মাং মূঢ়া”। ‘মূঢ়’ বা পাষন্ডেরা, শ্রীকৃষ্ণকে একজন সাধারণ মানুষ অথবা একটু বেশি শক্তিশালী মানুষ বলে মনে করে। 
 
তাদের চরম দুর্ভাগ্যের ফলে তারা শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান বলে গ্রহণ করতে পারে না। কখনও কখনও আবার এই ধরনের পাষন্ডেরা কোন রকম শাস্ত্র প্রমাণ ছাড়াই নিজেদের ভগবানের অবতার বলে অপপ্রচার করার চেষ্টা করে।

শ্রীকৃষ্ণের উত্থান অভিষেক

শ্রীকৃষ্ণের বয়স একটু একটু বাড়তে থাকলে কখন তিনি নিজে নিজেই পাশ ফিরে উপুড় হয়ে শুতে চেষ্টা করতেন। এই চেষ্টাকে ‘উত্থান’ বলা হয় এবং এই উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে নন্দ মহারাজ এবং মা যশোদা ‘উত্থান’ সম্বন্ধীয় অভিষেক উৎসব আয়োজন করেন। 
 
সেই উপলক্ষ্যে তাঁরা সমস্ত গোপ এবং গোপিকাদের নিমন্ত্রণ করলেন, এবং আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে তাঁরা সকলে এসে উপস্থিত হলেন। অতি সুন্দর বাদ্যযন্ত্র বাজতে লাগল এবং উপস্থিত সকলে সেই মঙ্গলগীত বাদ্য উপভোগ করতে লাগলেন। 
 
অনেক অনেক তত্ত্বদ্রষ্টা ব্রহ্মণদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল এবং তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের সৌভাগ্য কামনা করে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন। এইভাবে যখন মঙ্গলগীত হচ্ছিল এবং বাদ্য বাজছিল, এবং ব্রাহ্মণেরা বৈদিক মন্ত্র আবৃত্তি করছিলেন, তথন মা যশোদা সমাগত পুরনারীদের নিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে স্নান করালেন। এই স্নানক্রিয়াকে বলা হয় ‘অভিষেক’। আজও বৃন্দাবনের সব কটি মন্দিরে এই অনুষ্ঠান পালন করা হয়।

এই উপলক্ষ্যে মা যশোদা অপর্যাপ্ত পরিমাণ শস্য এবং স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত অতি উত্তম বহু গাভী তত্ত্বজ্ঞান-সমন্বিত ব্রাহ্মণদের দান করার আয়োজন করেছিলন। শ্রীকৃষ্ণকে স্নান করিয়ে এবং সুন্দরভাবে সাজিয়ে মা যশোদা স্নান করলেন এবং খুব সুন্দর সজ্জায় ভূষিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে কোলে নিয়ে ব্রাহ্মণদের মন্ত্রপাঠ শুনছিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর কোলে ঘুমিয়ে পড়লেন। 
 
যশোদা মা তখন তাঁকে সযত্নে একটি গরুর গাড়ির নীচে শুইয়ে দিলেন। সেই শুভ-উৎসবে সমস্ত আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং ব্রজবাসীদের তত্ত্ববধান করতে মা যশোদা এত ব্যস্ত ছিলেন যে, তিনি শ্রীকৃষ্ণকে দুধ খাওয়াতে ভুলে গিয়েছিলেন। তাই ক্ষুধার্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ কাঁদতে লাগলেন।
কৃষ্ণলীলা

কিন্তু চারিদিকে এত কোলাহল হচ্ছিল যে, মা যশোদা তাঁর ক্রন্দনের শব্দ শুনতে পেলেন না। একে ত তাঁর খুব ক্ষুধা পেয়েছিল আর তার ওপরে তাঁর মা তাঁকে এইভাবে অবহেলা করছে, তাই শিশু-শ্রীকৃষ্ণের খুব রাগ হল। 
 
তিনি তখন একজন সাধারণ শিশুর মতো তাঁর চরণকমলযুগল ছুঁড়তে লাগলেন, এবং তার ফলে তাঁর অতি ক্ষুদ্র পল্লবতুল্য কোমল চরণকমলযুগল ছুঁড়তে লাগলেন, এবং তার ফলে তাঁর অতি ক্ষুদ্র পল্লবতুল্য কোমল চরণকমলের আঘাতে সেই শকটটি উল্টে গেল। 
 
গাড়িটি কাঁসা ও পিতলের বাসনপত্রে বোঝাই ছিল এবং সেগুলি পড়ার ফলে প্রচন্ড শব্দ হল। গাড়ির অক্ষ থেকে চাকা দুটি খুলে গেল এবং গাড়ির জোয়াল ভেঙে গেল। মা যশোদা প্রমুখ ব্রজগোপিকারা, সেই অদ্ভুত ব্যাপারে অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে বলাবলি করতে লাগলেন, “কিভাবে এই গাড়িটি আপনা থেকেই ভেঙে গেল!” 
 
সে গাড়িটি ভাঙার আসল কারণ যে কি, তা কেউই স্থির করতে পারল না। কিন্তু যে সমস্ত শিশুদের উপর শ্রীকৃষ্ণকে দেখবার ভার ছিল তারা বলল, শ্রীকৃষ্ণ কাঁদতে কাঁদতে পদাঘাতে এই গাড়িটিকে ভেঙে ফেলেছে। 
 
তারা তাদের বলল যে, নিজেদের চোখে তারা এই ঘটনা ঘটতে দেখেছে এবং সেই বিষয়ে তাদের কোন সন্দেহ নেই। অনেকেই সেই শিশুদের কথা বিশ্বাস করলেন, কিন্তু অনেকে আবার বললেন, “কিভাবে সেই শিশুদের কথায় বিশ্বাস করা যায়? 
 
গোপ এবং গোপিকারা বুঝতে পারলেন না যে, সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর ভগবান একটি শিশুরূপে শয়ন করে আছেন এবং তিনি যা ইচ্ছা তা করতে পারেন । সম্ভব এবং অসম্ভব উভয়ই তাঁর শক্তির অধীন। 
 
যখণ এইভাবে সকলে আলোচনা করছিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ কাঁদতে লাগলেন। মা যশোদা তখন শিশুটিকে দুষ্টগ্রহ আক্রমণ করেছে, এই আশঙ্কায় তাঁকে কোলো তুলি নিয়ে ব্রহ্মণদের দিয়ে মাঙ্গলিক মন্ত্র উচ্চারণ সহকারে স্বস্ত্যয়ন করালেন। এবং স্তন্যপান করালেন।

শিশু যখন সুস্থভাবে মাতৃস্তন্য পান করে, তখন বোঝা যায় যে, সে সব রকম বিপদ থেকে মুক্ত হয়েছে। তারপর বলবান গোপেরা গাড়িটিকে ঠিক করলেন এবং যে সমস্ত বাসনপত্র ছিটকে-ছড়িয়ে পড়েছিল সেগুলি আবার ঠিক করে তাতে সাজিয়ে রাখলেন। তারপর ব্রাহ্মণেরা দই, ঘি, কুশ এবং জল দিয়ে হোমক্রিয়া সম্পাদন করলেন। শিশুটির সৌভাগ্য কামনা করে তাঁরা পরমেশ্বর ভগবানের আরাধনা করলেন।

যে সমস্ত ব্রাহ্মণেরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা সকলেই অত্যন্ত সুযোগ্য কেননা তাঁদের চিত্তে ঈর্ষার লেশমাত্র ছিল না; তাঁরা কখনও অসত্য আচরণ করেননি, তাঁরা কখনও গর্বান্বিত হননি, তাঁরা সম্পূর্ণভাবে অহিংস ছিলেন এবং তাঁরা অ-মানী ছিলেন। 
 
তাঁরা সকলেই ছিলেন যথার্থ ব্রাহ্মণ এবং এই ধরনের ব্রাহ্মণদের আশীর্বাদ কখনও মিথ্যা হয় না। এই ব্রাহ্মণদের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে নন্দ মহারাজ শিশু শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর কোলে তুলে নিলেন এবং পুণ্য ওষধিযুক্ত জলে তাঁর অভিষেক করলেন। ব্রাহ্মণেরা তখন ‘ঋক’ যজুঃ’ এবং ‘সামবেদ’ থেকে মন্ত্র উচ্চারণ করলেন।

শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, যথার্থ ব্রাহ্মণ না হলে বৈদিক মন্ত্র পাঠ করা উচিত নয়। এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সেই সমস্ত ব্রাহ্মণেরা সমস্ত ব্রাহ্মণসুলভ গুণের দ্বারা ভুষিত ছিলেন। নন্দ মহারাজেরও তাঁদের প্রতি পুর্ণ বিশ্বাস ছিল, তাই তিনি বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠান করতে তাঁদের আহ্বান করেছিলেন। 
 
ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের যজ্ঞ করার নির্দেশ দেওয়া আছে, কিন্তু যথার্থ ব্রাহ্মণ না হলে সেই মন্ত্রগুলি উচ্চারণ করা যায় না। 
 
এবং যেহেতু এই কলিযুগে এই ধরনের যোগ্য ব্রাহ্মণ পাওয়া যায় না, তাই এই যুগে সব রকমের বৈদিক যাগ-যজ্ঞ-অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ। তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই যুগের জন্য কেবল একটি মাত্র যজ্ঞ বিধির নির্দেশ দিয়ে গেছেন এবং সেটি হচ্ছে ‘সংকীর্তন যজ্ঞ’ অর্থাৎ ভগবানের নাম সমন্বিত মহামন্ত্র- ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে/হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।’ কীর্তন করা।

ব্রাহ্মণেরা যখন দ্বিতীয়বার বৈদিক মন্ত্র পাঠ করলেন এবং যজ্ঞ-অনুষ্ঠান করলেন, তখন নন্দ মহারাজ আবার তাঁদের প্রচুর পরিমাণ শস্য দান করলেন এবং অসংখ্য গাভী দান করলেন। এই সমস্ত গাভীগুলির গায়ে ছিল সোনার জরির কাজ করার বস্ত্র, 
 
তাদের শিংগুলি ছিল স্বর্ণ অলঙ্কারে ভূষিত, তাদের ক্ষুরগুলি ছিল রূপার পাত দিয়ে মোড়া, আর তাদের গলায় ছিল ফুলের মালা। তাঁর অদ্ভুত শিশুপুত্র শ্রীকৃষ্ণের মঙ্গলের জন্য তিনি অপর্যাপ্তভাবে ব্রাহ্মণদের দান করলেন। এবং ব্রাহ্মণেরাও তার বিনিময়ে প্রাণভরে শ্রীকৃষ্ণকে আশীর্বাদ করলেন। এই সমস্ত সুযোগ্য ব্রাহ্মণেরা আর্শীবাদ কখনও নিষ্ফল হয় না।

তৃণাবর্ত উদ্ধার

এই উৎসবের পর একদিন মা যশোদা শ্রীকৃষ্ণকে কোলে নিয়ে আদর করছিলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল, এই শিশুটি যেন অত্যন্ত ভারী হয়ে উঠেছে এবং তাঁকে আর বহন করতে না পেরে, তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁকে মাটির ওপরে রাখলেন। 
 
তার কিছুক্ষণ পরে তিনি নানা রকম গৃহকর্মে ব্যস্ত হয়ে এক ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিয়ে সেখানে এসে উপস্তিত হল। সে সেই শিশুটিকে তার কাঁধের উপর তুলে নিল এবং ধুলারাশি দিয়ে সমস্ত গোকুল আচ্ছন্ন করে ফেলল। তার ফলে কেউই আর কিছুই দেখতে পেল না এবং চারদিক তখন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল। 
 
এই ভীষণ দুর্যোগের সময় মা যশোদা তাঁর শিশুটিকে যেখানে রেখেছিলেন, সেখানে আর দেখতে পেলেন না। শ্রীকৃষ্ণকে তখন ঘূর্ণীঝড়ের রূপ নিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হল। সে সেই শিশুটিকে তার কাঁধের উপর তুলে নিল এবং ধূলারাশি দিয়ে সমস্ত গোকুল আচ্ছন্ন করে ফেলল। 
 
তার ফলে কেউই আর কিছুই দেখতে পেল না এবং চারদিক তখন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল। এই ভীষণ দুর্যোগের সময় মা যশোদা তাঁর শিশুটিকে যেখানে তৃণাবর্তাসুর আকাশে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। 
 
শ্রীকৃষ্ণকে না দেখতে পেয়ে মা যশোদা তখন মৃতবৎসা গাভীর মতো ভূমিতে পড়ে করুণভাবে রোদন করতে লাগলেন। মা যশোদা যখন এইভাবে বিলাপ করতে করতে কাঁদতে লাগলেন, তখন সমস্ত ব্রজগোপিকারা চারদিকে শ্রীকৃষ্ণকে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন, কিন্তু কোথাও তাঁরা তাঁকে খুঁজে পেলেন না।

তৃণাবর্ত তখন শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে নভোমন্ডলে অনেক উপরে উঠে গেছে, কিন্তু হঠাৎ শিশুটি এত ভারী হয়ে উঠল যে, সে তাকে নিয়ে আর ওপরে উঠতে পারল না। তখন তাকে ঘুর্ণিঝড়রূপী কার্যকলাপ বন্ধ করতে হল। শিশু শ্রীকৃষ্ণ অত্যন্ত ভারী হয়ে পড়ার ফলে তাঁর ভারে তৃণাবর্তাসুর নীচের দিকে পড়তে লাগল। 
 
শ্রীকৃষ্ণ তার গলা জড়িয়ে ধরে ছিল, তাই সে তাকে নিয়ে আর ওপরে উঠতে পারল না। তখন তাকে ঘুর্ণিঝড়রূপী কার্যকলাপ বন্ধ করতে হল। শিশু শ্রীকৃষ্ণ অত্যন্ত ভারী হয়ে পড়ার ফলে তাঁর ভারে তৃণাবর্তাসুর নীচের দিকে পড়তে লাগল।

শ্রীকৃষ্ণ তার গলা জড়িয়ে ধরে ছিল, তাই সে তাঁর ভার থেকে মুক্ত হতে পারছিল না। তৃণাবর্তের কৃষ্ণকে একটা পর্বতের মতো ভারী বলে মনে হল। সে তাঁর থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। তার চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে পড়ল। 
 
সে অস্ফুট শব্দ সহকারে প্রাণত্যাগ করে বৃন্দাবনে পতিত হল। তার সমস্ত শরীর বিধ্বস্ত হল এবং তাকে মহাদেবের বাণে নিহত ত্রিপুরাসুরের মতো মনে হল। পাথরের উপর পতনের ফলে তার সমস্ত শরীর বিধ্বস্ত হয়ে গেল। সমস্ত ব্রজবাসীরা তখন তার সেই শরীরটি দেখতে পেল।

ব্রজগোপিকারা যখন সেই নিহত অসুরটিকে এবং তার বুকের উপর ক্রীড়ারত শ্রীকৃষ্ণকে দেখলেন, তখন ছুটে গিয়ে তাঁরা গভীর স্নেহের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণকে কোলে তুলে নিলেন। এইভাবে শ্রীকৃষ্ণকে ফিরে পেয়ে গোপ এবং গোপাঙ্গনারা অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। 
 
তখন তাঁরা বলাবলি করতে লাগলেন, “কি আশ্বর্যের বিষয়! এই অসুরটা কৃষ্ণকে খাওয়ার জন্য তাকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল! কিন্তু পরিণামে তারই মৃত্যু হল।” কেউ কেউ বলল, “যারা অত্যন্ত পাপী, তাদের পাপের ফলে তাদের মরণ হয়, আর কৃষ্ণ হচ্ছে অত্যন্ত পুণ্যবান, তাই সব রকম বিপদ থেকে সে রক্ষা পায়। 
 
আর আমরাও নিশ্চয়ই আমাদের পূর্বজন্মে অনেক যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছি, পরমেশ্বর ভগবানের আরাধনা করেছি, অনেক ধন-সম্পদ দান করেছি এবং মানুষের মঙ্গলের জন্য অনেক অনেক ভাল কাজ করেছি-সেই পুণ্যকর্মের ফলেই এই শিশুটি সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে।”

গোপীরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন, “আমাদের পূর্বজন্মে আমরা না জানি কি কঠোর তপস্যা করেছিলাম কিংবা ভগবানের আরাধনা করেছিলাম, বা জনহিতকর কাজ করেছিলাম, বটবৃক্ষ রোপণ করেছিলাম বা কূপ খনন করেছিলাম, যার ফলে এই বালকটি আজ মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসে আমাদের আনন্দিত করছে।” এই আশ্চর্য ঘটনা দর্শন করে নন্দ মহারাজ বসুদেবের সাবধান বাণী স্মরণ করতে লাগলেন।

একদিন মা যশোদা শ্রীকৃষ্ণকে কোলে নিয়ে পুত্রস্নেহে বিগলিত হৃদয়ে স্বতঃপ্রবাহিত স্তনদুগ্ধ পান করবার পর চুম্বন করে তাঁকে আদর করছিলেন- এমন সময় শ্রীকৃষ্ণ হাই তুললেন এবং যশোদা দেবী তাঁর মুখের মধ্যে আকাশ, স্বর্গ, মর্ত্য, জ্যোতিশ্চক্র, সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি, বায়ু, সমুদ্র, দ্বীপ, পর্বত, নদী, বন, এবং স্থাবর জঙ্গম সমস্ত কিছু দেখতে পেলেন। 
 
মৃগনয়না যশোদা দেবী হঠাৎ শিশুর মুখে এইভাবে নিখিল বিশ্ব দর্শন করে কম্পিত কলেবরে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন “একি অপূর্ব দৃশ্য!” তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না। কেবল তাঁর নয়ন মুদিত করে তিনি বিস্ময়ান্বিত হয়ে রইলেন।

শিশুরূপে মাতৃক্রোড়ে অবস্থানকালে শ্রীকৃষ্ণের এই বিশ্বরূপ প্রদর্শন প্রমাণ করে যে, পরমেশ্বর ভগবান সর্ব অবস্থাতেই পরমেশ্বর ভগবান; তা তিনি মাতৃক্রোড়ে একটি শিশুরূপে নিজেকে প্রকাশিত করুন বা কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে একজন সারথিরূপে নিজেকে প্রকাশিত করুন। 
 
নির্বিশেষবাদীদের যে অনুমান, যে ধ্যান বা যোগ বা অন্য কোন জড় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ ভগবান হতে পারে, তা এখানেই ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হচ্ছে। ভগবান সর্ব অবস্থাতেই ভগবান এবং জীব হচ্ছে ভগবানের অংশ। তারা কখনই অচিন্ত্য এবং অপ্রাকৃত শক্তিসম্পন্ন ভগবানের সমকক্ষ হতে পারে না।

আরও পড়ুন

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

২টি মন্তব্য: