দামোদর লীলা- মা যশোদা কর্তৃক কৃষ্ণকে বন্ধন
দামোদর লীলা
এক সময় যখন দাসীরা নানা রকম গৃহকার্যে ব্যস্ত ছিল, তখন মা যশোদা নিজেই দাধিমন্থন করতে শুরু করলেন এবং সেই দধিমন্থন-কালে তিনি শ্রীকৃষ্ণের অদ্ভুত মাধুর্যমন্ডিত বাল্যলীলা গান করছিলেন এবং এইভাবে তাঁর পুত্রের স্মরণ করে গভীর আনন্দে মগ্ন হচ্ছিলেন।
দধিমন্থন করার সময় তাঁর শাড়ির আঁচলটা তিনি শক্ত করে কোমরে বেঁধে নিয়েছিলেন। দধিমন্থনজনিত পরিশ্রমের ফলে তাঁর সর্বাঙ্গ কম্পিত হচ্ছিল এবং তাঁর পুত্রের প্রতি গভীর স্নেহবশত তাঁর স্তনযুগল থেকে দুগ্ধ ক্ষরিত হচ্ছিল।
এবং তাঁর হাতের চুড়িগুলিতে পরস্পর স্পর্শমাত্রই কনকন শব্দ হচ্ছিল এবং তাঁর কানের দুল ও পয়োধর যুগল কম্পিত হচ্ছিল। তাঁর মুখমন্ডলে স্বেদবিন্দু দেখা দিয়েছিল এবং তাঁর মাথার ফুলের মালাটি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল।
সেই সময় শিশু কৃষ্ণ ক্ষুধার্ত হয়ে সেইখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি তখন তাঁর মায়ের প্রতি স্নেহের বশে দাবি করলেন যে, তিনি যেন দধিমন্থন বন্ধ করে তাঁকে স্তন্যদান করা তার পরে তিনি দধিমন্থন করতে পারেন।
মা যশোদা কৃষ্ণকে তাঁর কোলে তুলে নিলেন এবং তাঁকে স্তন্যদান করলেন। কৃষ্ণ যখন স্তন্যপানে রত ছিল, তখন তার সুন্দর মুখমন্ডল দর্শন করে মা যশোদা আনন্দসাগরে মগ্ন হয়ে ভাসতে লাগলেন।
এমন সময় হঠাৎ আগুনে বসানো দুধ উত্থলে পড়তে লাগল এবং সেই আগুন থেকে দুধ নামানোর জন্য মা যশোদা তাড়াতাড়ি কৃষ্ণকে কোল থেকে নামিয়ে দুধ নামাতে ছুটে গেলেন। এইভাবে তাঁকে ফেলে চলে যাওয়ার ফলে তাঁর মায়ের উপর ভীষণ রাগ হল।
রাগে তাঁর চোখ আর ঠোঁট লাল হয়ে উঠল। দাঁত দিয়ে ঠোঁটে কামড়ে একটা পাথরের টুকরো তুলে নিয়ে তৎক্ষণাৎ তিনি ননীর ভান্ডটি ভেঙে ফেললেন, এবং অশ্রুপুর্ণ নয়নে গৃহের এক নির্জন কোণে বসে সেই ননী খেতে লাগলেন।
ইতিমধ্যে দুধের পাত্রটি নামিয়ে রেখে মা যশোদা দধিমন্থন স্থানে ফিরে এলেন। যে পাত্রে তিনি ননী তুলে রাখছিলেন, সেটিকে তিনি ভগ্ন অবস্থায় দেখলেন এবং তাঁর শিশুপুত্রটিকে না দেখতে পেয়ে তিনি বুঝতে পারলেন যে, এটি তাঁরই কর্ম।
তিনি স্মিতহাস্যে ভাবতে লাগলেন, “ছেলেটা খুব চালাক। পাত্রটা ভেঙে শাস্তি পাওয়ার ভয়ে এখান থেকে পালিয়ে গেছে।” কিছুক্ষণ খোঁজার পর তিনি দেখতে পেলেন যে, একটা উপুড় করে রাখা উদুখলের উপর কৃষ্ণ বসে আছেন এবং শিকায় ঝোলানো ননীর পাত্র থেকে এই দুস্কৃতকর্মের জন্য শাস্তির ভয়ে কৃষ্ণ এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন।
তিনি নিঃশব্দে পিছন থেকে ধীরে ধীরে তাঁর দিকে এগোতে লাগলেন। কিন্তু কৃষ্ণ তাঁকে দেখে ফেলনের এবং তৎক্ষণাৎ উদুখল থেকে লাফিয়ে পড়ে ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলেন।
মা যশোদাও তাঁকে ধরবার জন্য তাঁর পিছন পিছন ছুটতে লাগলেন। যোগীরা ধ্যানে যাঁকে পায় না, সেই পরমেশ্বর ভগবানকে ধরবার জন্য মা যশোদা তাঁর পিছন পিছন ছুটতে লাগলেন।
পক্ষান্তরে বলা যায়, যোগী এবং জ্ঞানীরা অনেক সাধ্যসাধনা করেও যে পরমেশ্বর ভগবানকে পায় না, সেই ভগবানই একটি শিশুরূপে তাঁর ভক্ত মা যশোদার সাথে খেলা করছিলেন।
মা যশোদা দ্রুতগতিতে পলায়নপর সেই শিশুটিকে প্রথমে ধরতে পারলেন না, কারণ তাঁর ক্ষীণ কটিতট আর স্থুল শরীরের জন্য তিনি জোরে দৌড়তে পারছিলেন না।
তবুও যতদূর সম্ভব দ্রুতগতিতে তিনি তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করার চেষ্টা করছিলেন। তাঁর কেশপাশ তখন আলুলায়িত হয়ে পড়েছিল এবং তাঁর খোঁপার ফুল মাটিতে ঝরে পড়েছিল।
ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও অবশেষে তিনি তাঁর দুষ্টু শিশুসন্তানটিকে ধরলেন। মায়ের হাতে ধরা পড়ে কৃষ্ণ ভয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠলেন।
তাঁর দুই হাত দিয়ে তিনি চোখের জল মুছতে লাগলেন, এবং তার ফলে তাঁর চোখের কাজল সারা মুখে লেগে গেল। মাকে ছড়ি হাতে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি অত্যন্ত ভয় পেয়েছিলেন। মা যশোদা তখন ভাবলেন যে, শিশুটি অনর্থক ভয় পাচ্ছে।
পুত্রের শুভাকাঙ্ক্ষী রূপে তিনি ভাবলেন যে, তাঁর শিশুটিকে এতটা ভয় দেখানো ঠিক হবে না, অথচ তাঁকে একটু দন্ড না দিলেই নয়। তাই তিনি হাতের ছড়িটা ফেলে একটা দড়ি দিয়ে তাঁকে বেঁধে রাখতে মনস্থ করলেন।
তিনি জানতেন না যে, কৃষ্ণ হচ্ছেন তাঁর ছোট্র শিশু-পুত্র, তিনি জানতেন না যে, তাঁর সেই শিশুটি আদি অন্তহীন। তাঁর অন্তর-বাহির নেই অর্থাৎ তিনি সর্বব্যাপক। তিনি অনন্ত এবং সর্বব্যাপ্ত। তিনিই সমস্ত জগৎস্বরূপ। তবুও মা যশোদা তাঁকে তাঁর পুত্র বলে মনে করছিলেন।
যদিও তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয়ের অগোচর, তিনি তাঁকে একজন সাধারণ বালকের মতো দড়ি এনে তার সঙ্গে সেগুলি জুড়ে বাঁধবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তখনও দেখলেন যে, তা সেই পরিমাণেই ছোট। এইভাবে সব কটি দড়িই তিনি দেখলেন যে, তা দু’ইঞ্চি ছোট।
এইভাবে গৃহের সমস্ত দড়ি একত্রিত করেও যখন মা যশোদা তাঁকে বাঁধতে পারলেন না, তখন গোপীরা হাসতে লাগলেন, এবং যশোদাও তাঁকে বাঁধতে পারলেন না, তখন গোপীরা হাসতে লাগলেন, এবং যশোদাও হাসতে হাসতে বিস্ময়াপন্ন হলেন। এটা কি করে সম্ভব?
তাঁর শিশুপুত্রকে বাঁধতে গিয়ে তিনি পরিশ্রান্ত হয়ে ঘর্মাক্ত হয়ে উঠলেন এবং তাঁর চুলের বাঁধা মালা স্খলিত হয়ে পড়ে গিয়েছিল। তখন বালক কৃষ্ণ তাঁর মাকে পরিশ্রান্তা দেখে কৃপাপূর্বক বন্ধনগ্রস্ত হলেন।
মা যশোদার গৃহে একজন সাধারণ শিশুর মতো কৃষ্ণ তাঁর লীলাবিলাস করছিলেন। কেউই পরমেশ্বর ভগবানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। শুদ্ধ ভক্ত ভগবানের চরণারবিন্দে নিজেকে সর্বতোভাবে সমর্পণ করেন।
ভগবান তাঁকে মারবেন, না, রাখবেন, সেটা তাঁরা ভগবানও আবার ভক্তকে আনন্দ দান করবার জন্য তাঁদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। মা যশোদার কাছে কৃষ্ণের আত্মসমর্পণ তার এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত।
কৃষ্ণ তাঁর ভক্তদের সব রকমের মুক্তি প্রদান করেন। কিন্তু মা যশোদার প্রতি তিনি যে অনুগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, তা ব্রহ্মা, মহেশ্বর এমন কি সর্বদা ভগবানের বক্ষ-বিলাসিনী লক্ষ্মীদেবীরও দুর্লভ।
পরমেশ্বর ভগবান, যিনি যশোদানন্দন এবং নন্দনন্দন নামে খ্যাত, যোগী এবং জ্ঞানীরা কখনও তাঁকে পূর্ণরূপে জানতে পারেন না। কিন্তু তাঁর ভক্তদের কাছে তিনি সুলভ। যোগী এবং জ্ঞানীরা কখনও তাঁকে সমস্ত আনন্দের পরম উৎস বলে উপলব্ধি করতে পারেন না।
মা যশোদা তাঁর ছেলেকে বেঁধে রেখে গৃহকার্যে ব্যস্ত হলেন। সেই সময়, উদুখলে বাঁধা শ্রীকৃষ্ণ বাড়ির সামনে দু’টি অর্জুন বৃক্ষ দেখতে পেলেন। সমস্ত আনন্দের পরম উৎস পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন মনে মনে ভাবলেন, “মা প্রথমে আমাকে দুধ না খাইয়েই চলে গিয়েছিলেন, তাই আমি ননীর ভান্ড ভেঙ্গে ফেলে সেগুলি বাঁদরদের খাইয়েছি।
আর এখন আবার তিনি আমকে এই উদুখলে বেঁধে রেখেছেন। তাই এখন আমি আগের থেকে আরও বেশি রকমের দুষ্টুমি করব।” এই ভেবে তিনি মনস্থ করলেন যে, সেই দু’টি বিশাল অর্জুন বৃক্ষকে তিনি উপড়ে ফেলে দেবেন।
এই দু’টি অর্জুন গাছের একটা ইতিহাস আছে। তাদের পূর্বজন্মে তারা ছিল নলকুবর এবং মণিগ্রীব নামক কুবেরের দুই পুত্র। সৌভাগ্যক্রমে তারা ভগবানের কৃপাদৃষ্টি লাভ করেছিল।
পূর্ব জীবনে মহর্ষি নারদ তাদের অভিশাপ দিয়েছিলেন। যার ফলে তারা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। এই আশীর্বাদরূপী অভিশাপ তাদের দেওয়া হয়েছিল, কেননা অত্যধিক মাত্রায় মদ্যপান করার ফলে তাদের স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিল। পরবর্তী অধ্যায়ে সেই কাহিনী বর্ণিত হবে।
আরও পড়ুন