আত্মজ্ঞান লাভের উপায় - শ্রীমদ্ভগবদ গীতা যথাযথ বাংলা

নতুন পোষ্ট

Add

সোমবার, ১ মার্চ, ২০২১

আত্মজ্ঞান লাভের উপায়

 
শ্রীল প্রভুপাদ

আত্মজ্ঞান লাভের উপায়


সততং কীর্তয়ন্তো মাং যতন্তশ্চ নমস্যন্তশ্চ মাং ভক্ত্যা নিত্যযুক্তা উপাসতে

আমার মহিমা কীর্তন করে গভীর নিষ্ঠা সহকারে প্রয়াস করে, আমাকে প্রণতি নিবেদন মহাত্মারা গভীর ভক্তি সহকারে নিরন্তর আমার উপাসনা করেন।” (ভঃ গীঃ)

শ্রীকৃষ্ণ এখানে বর্ণনা করেছেন, যথার্থ মহাত্মা কে। যথার্থ মহাত্মা হচ্ছেন তিনি, যিনি নিরন্তর ভগবানের মহিমা কীর্তন করার মাধ্যমে পরমেশ্বর ভগবানের উপাসনা করেন। কীর্তন করার অর্থ হচ্ছে বর্ণনা করা। আপনি সঙ্গীতের মাধ্যমে বর্ণনা করতে পারেন; লেখার মাধ্যমে বর্ণনা করতে পারেন; কথা বলার মাধ্যমে বর্ণনা করতে পারেন। 

 

যেকোন রকমের বর্ণনা করাকে বলা হয় কীর্তন। ভগবদ্ভক্তি শুরু হয় কীর্তন এবং শ্রবণের মাধ্যমে। আপনি যদি না শােনেন, হলে আপনি বর্ণনা করতে পারবেন না। কি বর্ণনা করবেন? আপনি যদি পরমেশ্বর ভগবান সম্বন্ধে কিছুই না জানেন, তা হলে কিভাবে আপনি তার কথা বর্ণনা করবেন? তাই শ্রবণ হচ্ছে ভক্তির প্রথম স্তর।

 

সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রকে বলা হয় শ্রুতিশাস্ত্র। শ্রুতি কথাটির অর্থ হচ্ছে শ্রবণের মাধ্যমে আহরণ করা। আপনি যদি পরমেশ্বর সম্বন্ধে জানতে চান, তা হলে কোন রকম জড় উপাধির প্রয়ােজন হয় না। জড়জাগতিক বিষয়ে জ্ঞানের প্রয়ােজন হয় না, আপনি যেখানে সেখানেই থেকে সেই জ্ঞান আহরণ করতে পারেন। তবে আপনাকে কেবল শ্রবণ করতে হবে। ভগবান আপনাকে শ্রবণের শক্তিদিয়েছেন। 

 

আপনি যদি প্রামাণিক সূত্র থেকে, অর্থাৎ যারা ভগবত্ত্ব সম্বন্ধে জানেন, তাদের কাছ থেকে শ্রবণ করেন, তা হলে আপনি ভগবান সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান লাভ করতে পারবেন—কেবলমাত্র শ্রবণ করার মাধ্যমে। তাই শ্রবণ হচ্ছে প্রথম স্তর এবং তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

পুরাকালে শিষ্য শ্রীগুরুদেবের কাছ থেকে শ্রবণ করত। যেমন, ভগবদগীতায় আপনারা দেখবেন যে, অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে শ্রবণ করছেন। কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে তিনি বেদান্ত-দর্শন অধ্যয়ন করছিলেন না, তিনি কেবল শ্রবণ করেছিলেন। 

 

আপনি যে-কোনও জায়গায় শ্রবণ করতে পারেন। এমন কি যুদ্ধক্ষেত্রেও, আপনি প্রামাণিক সূত্র থেকে তত্ত্বজ্ঞান শ্রবণ করতে পারেন। তাই জ্ঞান আহরণের এই পন্থা চিরকাল ধরে চলে আসছে।

 

শ্রবণ করার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান আহরণ করা—জ্ঞান তৈরি করা নয়। কিছু লােক আছে যারা মনে করে, আমি কেন ওর কাছ থেকে শুনব? আমি তাে নিজে নিজেই চিন্তা করতে পারি। আমি অনুমান করতে পারি, নানা রকম জল্পনা-কল্পনা করতে পারি। আমি একটি নতুন কিছু চিন্তাধারা সৃষ্টি করতে পারি এবং তা আমার বন্ধু-বান্ধবদের কাছে প্রচার করতে পারি।” এটি হচ্ছে নির্বুদ্ধিতা। এটি বৈদিক পন্থা নয়। বৈদিক পন্থা হচ্ছে শ্রবণ। 

 

জ্ঞান আহরণের দুটি পন্থা রয়েছে আরোহ পন্থা এবং অবরােহ পস্থা। আরােহ পন্থার অর্থ হচ্ছে ওপরে ওঠার চেষ্টা করা—নিজের শক্তির দ্বারা নিজেকে উন্নত স্তরে অধিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা; আর অবরােহ পন্থার অর্থ হচ্ছে উন্নত পর্যায়ভুক্ত কোন ব্যক্তির কাছ থেকে অথবা ভগবত্তত্ত্বজ্ঞান সম্পন্ন কোন ব্যক্তির কাছ থেকে বিশুদ্ধ জ্ঞান লাভ করা। 

 

তাই আরােহ পন্থাকে বৈদিক জ্ঞান আহরণের উপায় বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বৈদিক জ্ঞানলাভের পন্থা হচ্ছে অবরোহ পন্থা—শিক্ষার্থী শিষ্য সদ্গুরুর কাছ থেকে বিনীতভাবে শ্রবণ করার মাধ্যমে এই জ্ঞান লাভ করতে পারে | এইভাবে আমরা যথার্থ জ্ঞান লাভ করতে পারি।

 

গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে (৪/২) ভগবান বলেছেন, “সর্বপ্রথমে আমি এই জ্ঞান সূর্যদেব বিবস্বানকে দিয়েছিলাম, বিবস্বান তারপর তার পুত্র মনুকে তা দান করেন। মনু দান করেন তার পুত্র ইক্ষাকুকে।” সেই সময় ইক্ষাকু ছিলেন এই পৃথিবীর রাজা। এইভাবে ইক্ষাকুর কাছ এই জ্ঞান প্রবাহিত হচ্ছিল—পিতা থেকে অথবা গুরু থেকে শিষ্যতে।

 

এখন যেহেতু সেই গুরু-পরম্পরা ছিন্ন হয়েছে, শ্রীকৃষ্ণ তাই বলেছেন, সেই পুরাতন জ্ঞান আমি আবার তােমাকে দান করছি, তুমি আমার ভক্ত, তুমি আমার প্রিয় সুতরাং এটিই হচ্ছে পন্থা। শ্রবণ করা হচ্ছে প্রাথমিক স্তর। শ্রবণের প্রক্রিয়াটি এতই শক্তিশালী যে, কেবলমাত্র প্রামাণিক সূত্র থেকে শ্রবণ করার মাধ্যমে পূর্ণ সিদ্ধি লাভ করা যায়। অবশ্য বিনীতভাবে শ্রবণ করতে হবে।  


আজকাল সকলেই মনে করছে, আমি মনগড়া একটি মত তৈরি করব। কেন আমি অন্য কারও বশ্যতা স্বীকার করতে যাব? আমি নিজেই বিবেচনা করব আমি কে এবং আমার কি করা উচিত। কিন্তু সেটি বৈদিক পন্থা নয়। বৈদিক পন্থা হচ্ছে শ্রবণ—নির্ভরযােগ্য সূত্র থেকে শ্রবণ। 

 

 তাই আমরা যদি আমাদের নিজেদের চেষ্টার মাধ্যমে পরমতত্ত্বকে জানার পন্থা বর্জন করি এবং বিনীত হই, তা হলেই আমরা দিব্য জ্ঞান লাভে সার্থক হব। বিনীত হওয়ার অর্থ হচ্ছে আমাদের অক্ষমতা সম্বন্ধে অবগত হওয়া। 

 

জড় জগতে বদ্ধ অবস্থায় কেউই বলতে পারে না, "আমি ভুল করব না”, বা আমি ভুল করি না। সেটি কখনই সম্ভব নয়। ভুল আমাদের হবেই। ভুল করাই মানুষের ধর্ম। সুতরাং এটি আমাদের একটি অপূর্ণতা।

 

দ্বিতীয়ত আমরা প্রমাদগ্রস্ত। যা অলীক, তাকে আমরা বাস্তব বলে মনে করি। যেমন, আমরা আমাদের শরীরটিকে আমাদের স্বরূপ বলে মনে করি। আমাদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে, আমরা কে, তখন আমরা উত্তর দিই, “ওঃ, আমি আমেরিকান”, “আমি ইউরােপীয়ান” ইত্যাদি। কিন্তু আমেরিকান বলতে কি এই শরীরগুলি আমেরিকান, কিন্তু আমরা তা নই। কারণ আমরা আমাদের এই শরীর নই। সুতরাং এটি প্রমাদ বা মােহ।

 

তারপর আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি ভ্রান্ত। আমাদের দৃষ্টিশক্তি নিয়ে আমরা কত গর্ব করি, কিন্তু যখনই আলাে নিভিয়ে দেওয়া হয়, তখন আমরা আর কিছুই দেখতে পাই না। তাই আমাদের এই দৃষ্টিশক্তি আপেক্ষিক। আর তেমনই, আমাদের আর সব কটি ইন্দ্রিয়ও আপেক্ষিক। তাই সেইগুলি ভ্রান্ত।

 

আমরা সকলেই প্রতারণা করতে চাই। আমরা কিছুই জানি না, কিন্তু আমরা অন্যদের বােঝাতে চাই যে, আমরা সব কিছুই জেনে বসে আছি। সেই ধরনের মহামূর্খ আবার একদল শিষ্য যোগাড় করে তাদের নানা রকম মনগড়া তথ্য শিক্ষা দিচ্ছে। সেটি প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।

 

পরমতত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে হয় গুরুদেবের কাছ থেকে এবং তারপর সেই জ্ঞান অন্যদের দান করতে হয়। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে শিক্ষা দান করেছিলেন, আর আমরা সেই জ্ঞান আজও প্রচার করে চলেছি। আর যারা অর্জুনের মতাে বিনীতভাবে সেই জ্ঞান শ্রবণ করছে ভগবদ্গীতার যথার্থ শিক্ষার্থী।


তাই আমাদের ভ্রান্ত ইন্দ্রিয় এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পরমতত্ত্ব উপলব্ধি করার চেষ্টা সম্পূর্ণ অর্থহীন। আমাদের শ্রবণ করতে হবে। সেটিই বৈদিক পন্থা। পুরাকালে শিষ্য গুরুগৃহে যেতেন সেই জ্ঞান আহরণ করবার জন্য। তাকে বলা হত গুরুকুল।

 

প্রত্যেক ব্রাহ্মণ, প্রতিটি ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষ, প্রতিটি বিপ্র (অথবা বৈদিক তত্ত্বজ্ঞান সম্বন্ধে পারদর্শী ব্যক্তি) কয়েকজন ব্রহ্মচারীকে শিষ্যরূপে বরণ করে শিক্ষা দান করতেন। সেই সমস্ত শিক্ষার্থীরা ব্রহ্মচর্য পালন করে গুরুগৃহে অবস্থান করতেন এবং গুরুদেব বৈদিক তত্ত্বজ্ঞানসমূহ প্রদান করতেন। সেটিই যথার্থ পন্থা।

 

সুতরাং আরােহ পন্থার মাধ্যমে কখনই পরমতত্ত্বজ্ঞান লাভ করার চেষ্টা করা উচিত নয়। জ্ঞানে প্রয়াসমুদপাস্য। কথাটির অর্থ হচ্ছে বর্জন করে এবং নমস্ত নমস্ত এব জীবন্তি সম্মুখরিতম্ ভবদীয় যদি তত্ত্বদ্রষ্টা পুরুষের কাছে বিনীতভাবে শ্রবণ করেন-ঠিক যেভাবে অর্জুন পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে শ্রবণ করেছে।

 

ধর তুমি একজন ব্যবসায়ী এবং তুমি তােমার প্রতিনিধিকে পাঠিয়ে ব্যবসা কর। এখন, তােমার প্রতিনিধি যদি তােমার খরিদ্দারের কাছে গিয়ে বলে, "আমিই মালিক", তা হলে কতদিন আর সে তােমার চাকরি করতে পারবে? যখনই তুমি জানতে পারবে যে, সেই লােকটি নিজেকে তােমার প্রতিষ্ঠানের মালিক বলে প্রচার করে বেড়াচ্ছে তৎক্ষণাৎ তুমি তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেবে। কারণ সেই লােকটি হচ্ছে প্রতারক—সে মালিক নয়। তেমনই যে বলে, “আমি ভগবান সে একটি প্রতারক এবং তার কাউকে শিক্ষা দেওয়া উচিত নয়।

 

কেউ মনে করতে পারে যে, সে নিজে নিজেই জ্ঞান লাভ করতে পারে। সেটি ভিন্ন বিষয়। আমি ভগবান বলে জাহির করার পিছনে ভগবানের গুণগুলি সম্বন্ধে বলা হচ্ছে। আমরা যেহেতু ভগবানের বিভিন্ন অংশ, তাই গুণগতভাবে আমরা ভগবানের অংশ বিশেষ।

 

যেমন, একটি সােনার কণাও সােনা। সেটি সােনা ছাড়া আর কিছু নয়। তেমনই, আমরা যদি পরমেশ্বর ভগবানের বিভিন্ন অংশ, তাই গুণগতভাবে আমরা ভগবানের সঙ্গে এক। তাই আমি যদি আমার গুণাবলী বিশ্লেষণ করি, তা হলে আমি ভগবানের সম্বন্ধেও জানতে পারি, কারণ তার মাধ্যমে আমরা ভগবানের গুণাবলী জানতে পারি, কিন্তু তা বলে ভগবানের আয়তন আমরা জানতে পারি না।

 

যেমন ধর, তুমি কিছু ভাল চাল পেলে। প্রথমে কতটা চাল তা নিয়ে তুমি বিবেচনা কর না, কিন্তু এক মুঠো চাল দেখে তুমি বুঝতে যে, সেগুলি কি রকম চাল, তারপর তুমি তা কিনতে পার, এবং তারপর তুমি তােমার লেনদেন কাছে কত চাল আছে? আপনার কাছ থেকে আমি কতটা চাল কিনতে পারি?” সুতরাংআয়তন হচ্ছে আর একটি ভিন্ন বিষয়।

 

কিন্তু গুণ দেখে তুমি বিবেচনা করতে পার, তুমি কতটা চাল কিনবে। তেমনই, গুণগতভাবে আমরা ভগবানের সঙ্গে এক, কিন্তু আয়তনগতভাবে ভিন্ন। ভগবান হচ্ছেন। মহান, আর আমরা সেই তুলনায় নিতান্তই ক্ষুদ্র।

 

তাই আমরা কখনই দাবি করতে পারি না, আমি ভগবান।" তুমি নিজেকে ভগবান বলে জাহির কর, আর কেউ যদি এসে তােমাকে জিজ্ঞাসা করে, আপনি যদি ভগবান হন, তা হলে আপনি আমাকে আপনার সর্বশক্তিমত্তা প্রদর্শন করুন, তখন তা তােমার পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই তুমি দাবি করতে পার না যে, আমি ভগবান।"

 

কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ প্রমাণ করে গেছেন যে, তিনি ভগবান। কিভাবে? ভগবদ্গীতার একাদশ অধ্যায়ে অর্জুন যখন তাঁকে অনুরােধ করেন, “হে কৃষ্ণ! তুমি কি দয়া করে আমাকে তােমার বিশ্বরূপ প্রদর্শন করবে?”—শ্রীকৃষ্ণ তখন তাকে তা দেখিয়েছিলেন।

 

এটি সমস্ত জগতের কাছে অর্জুনের চিরস্থায়ী বাণী—“ভবিষ্যতে বহু মূর্খ লােক যখন নিজেদের ভগবান বলে জাহির করবার চেষ্টা করবে, তখন তাদের দ্বারা প্রতারিত হয়ো না। তাদের জিজ্ঞাসা কর, দয়া করে আপনার বিশ্বরূপ প্রদর্শন করুন। যদি তারা তা পারে, তখন তাদের ভগবান বলে স্বীকার কর। কিন্তু কখনই কোন মূর্খ, ভণ্ড প্রতারককে ভগবান বলে স্বীকার করাে না। 

 

সেটিই হচ্ছে সব চাইতে বড় অপূর্ণতা। মানুষ জড় জগতের কঠোর নিয়মের দ্বারা আবদ্ধ—একটু দাঁত ব্যথা হলে সে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে থাকে—অথচ সে নিজেকে ভগবান বলে জাহির করতে চায়। মূর্খ লােকেরাই এই ধরনের মানুষের দ্বারা প্রতারিত হয়। ভগবান ছাড়া আর কেউই পরমেশ্বর হতে পারে না এবং কেউই ভগবানের সমকক্ষ হতে পারে না।

 

বৈদিক শাস্ত্রে ভগবানকে অসমােধ্ধ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। অসম' মানে "যার সমান কেউ নেই। কেউই ভগবানের সমকক্ষ হতে পারে না এবং কেউই ভগবানের থেকে মহৎ হতে পারে না। সকলেই ভগবানের অধস্তনতা শিকার করে, সে যতই বড় হােক না কেন। এই সম্পর্কে একটি সুন্দর শ্লোক রয়েছে—শিব-বিরিঞ্চি-নুতম্। শিব মানে হচ্ছে দেবাদিদেব মহাদেব, এবং বিরিঞ্চি হচ্ছেন ব্রহ্মা। 

 

এই জড় জগতে তারাই সমস্ত দেবতাদের মধ্যে সর্বোত্তম। কিন্তু তারাও পরমেশ্বর ভগবান বা বিষ্ণুকে তাদের সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করেন। তাই পরমেশ্বর ভগবানের সমকক্ষ কেউই হতে পারে না। তাই ভগবানের সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা না করে অথবা আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞান বা অপূর্ণ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ভগবানকে জানবার চেষ্টা না করে আমাদের তার শরণাগত হওয়া উচিত।

 

জ্ঞানে প্রয়াসমুদপাস্য—“অবােধ মূর্খের মতাে জল্পনা-কল্পনার মাধ্যমে আমি ভগবানকে জানতে পারি”,—এই ধরনের প্রয়াস না করে বিনীতভাবে সদ্গুরুর শরণাগত হয়ে তাঁর কাছ থেকে দিব্যজ্ঞান লাভ করার চেষ্টা করা উচিত।

 

পরম প্রামাণিক তত্ত্ব কোথা থেকে লাভ করা যায়? শ্রীকৃষ্ণ ভগবান-অথবা তার প্রতিনিধির কাছ থেকে। যেমন, বৃন্দাবনের ষড় গােস্বামীগণ, তারা ছিলেন ভগবানের প্রতিনিধি। তাই তাঁরা হচ্ছেন এই জ্ঞান লাভের এক নির্ভরযােগ্য সূত্র। তেমনই, ভগবানের যথার্থ প্রতিনিধি বা তার অবতারের কাছ থেকে এই জ্ঞান লাভ করা যায়। 

 

তারা কখনই বলেন না, "আমি ভগবান। পক্ষান্তরে তাঁরা বলেন, "আমি ভগবানের দাস।” সেটিই ভগবানের প্রতিনিধির যোগ্যতা। তিনি কখনও বলেন না, আমি ভগবান। তিনি সব সময় বলেন, আমি ভগবানের দাস, অথবা আমি ভগবানের সেবক।” তিনিই ভগবানের যথার্থ প্রতিনিধি।

 

তাই তার কাছ থেকে বিনীতভাবে আমাদের শ্রবণ করতে হবে। তােমরা কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনীয়ার, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ কেরানী। তােমরা কে কি, তাতে কিছু আসে যায় না। তােমাদের বৃত্তি যাই হােক কেন, তােমাদের জাতি যাই কেন, তােমাদের ধর্ম যাই হােক না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। বাণী আহরণ করার ক্ষেত্রে সেইগুলি কোন প্রতিবন্ধক নয়। 

 

 জ্ঞান যে-কেউই লাভ করতে পারে। যেমন, তােমরা যখন কলেজে যাও, তখন কেউ প্রশ্ন করে যে, তুমি আমেরিকান না ভারতীয়, আফ্রিকান। স্কুলে, কলেজে, অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকলেই জ্ঞান লাভ করতে পারে। 

 

তেমনই, এই কৃষ্ণভাবনার অমৃত বিজ্ঞান যে-কেউই লাভ করতে পারে। স্থানে বৃত্তি পরিবর্তন করার কোন প্রয়ােজন নেই। শ্রুতিগত তনুবাক কেবলমাত্র কায়, মন এবং বাক্যের দ্বারা যথার্থ বুদ্ধিমত্তা সহকারে নির্ভরযােগ্য সূত্র থেকে বিনীতভাবে শ্রবণ করার মাধ্যমে এই লাভ করতে হয়।

 

ভগবানের আরেক নাম হচ্ছে অজিত। অর্থাৎ, যিনি হচ্ছেন অজেয়। যেহেতু সকলেই ভগবানের অধীন তাই কে তাঁকে পরাভূত করবে? ভগবানের কি কথা—আমরা ভগবানের শক্তিকে পর্যন্ত জয় করতে পারি না। আমরা সকলেই এখন ভগবানের মায়া-শক্তির অধীন। 

 

সেই মায়া-শক্তিকে পর্যন্ত আমরা জয় করতে পারি না। সুতরাং আমরা ভগবানকে জয় করব কি করে ? তা কখনই সম্ভব নয়। তাই । ভগবানের আরেক নাম অজিত। কিন্তু সেই অজিত যে ভগবান, তিনিও কখনও কখনও পরাজিত হন। কিভাবে? বিনীতভাবে ভগবানের কথা শ্রবণ করে এবং যথাযথভাবে সেই জ্ঞান লাভ করার চেষ্টা করার মাধ্যমে,সেটিই হচ্ছে পন্থা।

 

ভগবান খ্রিস্টান নন, অথবা হিন্দু নন, অথবা মুসলমান নন, অন্য কিছু নন। ভগবান হচ্ছেন ভগবান। তােমরা যদি ভগবদ্গীতা বিনীতভাবে কেবল শ্রবণ কর এবং বুদ্ধির দ্বারা তাঁর সেই নির্দেশ পালন করার চেষ্টা কর, তা হলেই তােমরা ভগবানকে জানতে পারবে। 

 

তাকে এত ভালভাবে জানতে পারবে যে, অজিত যে ভগবান, তিনিও তােমার কাছে পরাভূত হবেন। তােমরা তাকে জয় করতে পারবে কেবলমাত্র এই সরল পন্থার মাধ্যমে। তাই শ্রবণের এত গুরুত্ব, এবং তাই তা হচ্ছে ভক্তিযােগের প্রাথমিক স্তর। তারপর তুমি যা জানবে, তা যদি তুমি কীর্তন কর, তা হলে এই পারমার্থিক জ্ঞানের পথে তুমি উন্নতি সাধন করতে পারবে। 

 

আজ এখানে আমরা যা আলােচনা করলাম তা যদি যথাযথভাবে তােমরা শ্রবণ করে থাক এবং তা যদি তােমাদের বন্ধু-বান্ধবদের কাছে বা আত্মীয়-স্বজনদের কাছে তােমরা পুনরাবৃত্তি কর—তা হলে তােমরা সেই জ্ঞানে অধিষ্ঠিত হবে। তাকে বলা হয় কীর্তন। শ্রবণ-কীর্তন— দিন-রাত আমরা কত কিছু শ্রবণ করছি। টেলিভিশনে, রেডিওতে, খবরের কাগজে কত কিছু আমরা শ্রবণ করছি। 

 

 কিন্তু সেই শ্রবণ আমাদের পারমার্থিক জ্ঞান লাভে কোন সাহায্য করবে না। শ্রবণ কীর্তন বিষ্ণুঃ—বিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণের কথা শ্রবণ করতে হবে। কৃষ্ণকীর্তনম্কীর্তনাৎ এব কৃষ্ণস্য মুক্তসঙ্গ পরংব্রজেৎ। 

 

 তােমরা যদি কেবল তাই কর—তা হলে তােমরা এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হবে, এবং তােমরা পরম প্রকৃতিতে ভগবানের রাজ্যে উন্নীত হবে। এই যুগের পন্থা হচ্ছে—শ্রবণ এবং কীর্তন। অন্য কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পারমার্থিক জীবনে সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব নয়। 

 

তােমরা যথাযথভাবে যজ্ঞানুষ্ঠান করতে পার না। তােমরা মননের মাধ্যমে বা ধ্যান করার মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করতে পার না। তােমরা অষ্টাঙ্গ যােগ অভ্যাস করতে পার না। কিছুই করতে পার না। তােমরা কেবল বিনীতভাবে ভগবত্তত্ত্ব-বিজ্ঞান নির্ভরযােগ্য সূত্র থেকে শ্রবণ করতে পার। সেটি করার চেষ্টা কর এবং তাতেই সিদ্ধিলাভ হবে।

আরও পড়ুন

* আত্মা ও দেহের পার্থক্য 

* ভক্তি জীবনে অপরাধ সমূহ 

* হরে কৃষ্ণ জপের মাহাত্ম্য 

* মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ 

* কৃষ্ণ ভক্তি অনুশীলনের পন্থা ও ভক্তির অঙ্গগুলি-ভক্তি-রসামৃতসিন্ধু  


1 টি মন্তব্য: