সুদামা ও শ্রীকৃষ্ণের বন্ধুতের কাহিনী। শ্রীকৃষ্ণ ও সুদামা বিপ্রের মিলন
সুদামা ও শ্রীকৃষ্ণের লীলাকাহিনী
মহারাজ পরীক্ষিৎ শুকদেব গােস্বামীর কাছ থেকে কৃষ্ণ-বলরামের অলৌকিক লীলা-বিলাসের কাহিনী শ্রবণ করছিলেন। শ্রীভগবানের এইসব অপ্রাকৃত লীলাসমূহ সবই অতীব শ্রুতিমধুর। আর মহারাজ পরীক্ষিৎ শুকদেব গােস্বামীকে সম্বােধন। করে বললেন, “হে প্রভু, লীলা পুরুষােত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মুক্তি ও ভগবৎ-প্রেম দুই একসঙ্গে প্রদান করেন।
যিনি ভগবান মুকুন্দের প্রীতিপূর্ণ সেবায় নিয়ােজিত হন, বিনা প্রয়াসেই তিনি সংসার-বন্ধন থেকে মুক্তি প্রাপ্ত হন। ভগবান হচ্ছেন অনন্ত। তাই নিখিল বিশ্ব চরাচরের সৃষ্টি, পালন ও বিনাশ কার্যসাধন রূপ তার লীলাসমূহও অনন্ত। এখনও যা আপনি বর্ণনা করেননি, ভগবানের সেই সব অন্যান্য লীলা-বিলাসসমূহ আমি শুনতে ইচ্ছা করি।
(শ্রীমদ্ভাগবত-শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলা এন্ড্রয়েড অ্যাপ ডাউনলোড করুন)
হে প্রভু! ইন্দ্রিয়ভােগ থেকে সুখ লাভের প্রয়াসে মায়াবদ্ধ জীব ব্যর্থ হয়েছে। বিষয়ভােগ-তৃষ্ণা সর্বদাই মায়াবদ্ধ জীবের হৃদয় বিদীর্ণ করছে। কিন্তু আমি বাস্তবিক অনুভব করতে পারছি, কিভাবে দিব্য-কৃষ্ণলীলা কথামৃত বিষয়ভােগ-তৃষ্ণায় প্রপীড়িত জীবকে শাস্তি প্রদান করতে পারে।
আমি মনে করি যে, কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তিই দিব্য হরিকথামৃত বারবার শ্রবণের পন্থা পরিত্যাগ করতে পারে না। শুধু হরিকথামৃত আস্বাদন করেই দিব্য আনন্দে সর্বদা নিমজ্জিত থাকা যায়, এইভাবে তখন সে আর জড় ভােগ দ্বারা আকৃষ্ট হয় না।
এই উক্তিতে মহারাজ পরীক্ষিৎ দুটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করেছে—বিষন্নঃ এবং বিশেষজ্ঞঃ। জড়বাদীরা সুখী হওয়ার নানা পন্থা উদ্ভাবন করছে, কিন্তু বস্তুত তারা বিষগ্নই থেকে যায়। প্রশ্ন উঠতে পারে যারা যােগ অনুশীলনকারী তারাও সময়ে সময়ে বিষন্ন থাকে।
কিন্তু মহারাজ পরীক্ষিৎ বিশেষজ্ঞ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। দুই রকমের যােগী রয়েছে, (১)-নির্বিশেষবাদী, (২)-সবিশেষবাদী। যারা ভগবানের ব্যক্তিত্ব স্বীকার করে, তাদের বিশেষজ্ঞ বলা হয়—এরা ভগবানের অপ্রাকৃত বৈচিত্র্যের প্রতি অনুরাগী।
পরমেশ্বর ভগবানের ব্যক্তিগত কার্যাবলী শ্রবণ করে ভক্তরা আনন্দে উৎসুক হয়ে ওঠেন, অথচ নির্বিশেষবাদীরা ভগবানের অব্যক্ত মূর্তিতে আসক্ত, এবং তারা ভগবানের ব্যক্তিগত কার্যাবলীর প্রতি নামে মাত্র অনুরক্ত হয়। এই কারণেই ভগবৎ লীলার আস্বাদনের সুযােগ থাকলেও সম্পূর্ণভাবে তারা তা গ্রহণ করতে সক্ষম হয় না। কর্মফলাকাপ্ষার জন্য, জড়বাদীসহ নির্বিশেষবাদীরাও ঠিক পূর্বের মতাে বিষয়ই থেকে যায়।
মহারাজ পরীক্ষিৎ বলে চললেন, "একমাত্র ভগবানের দিব্য গুণাবলী বর্ণনা করেই বাকুশক্তি সার্থক হয়ে ওঠে। হাতগুলি যখন ভগবানের সেবায় নিযুক্ত করা হয়, তখনই শুধু হাতের কর্মক্ষমতা সার্থক হয়ে ওঠে। ঠিক সেইরকম পূর্ণ কৃষ্ণভাবনায় মন যখন শুধু কৃষ্ণচিন্তা করে তখনই শুধু মানসিক প্রশান্তি লাভ হয়।
শুধু চিন্তাশীলতাই নয়, উপরন্তু সর্বান্তর্যামী পরমাত্মা রূপে অদ্বয়-তত্ত্ব কৃষ্ণ যে সর্বত্র বিরাজমান তা শুধু হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। সর্বত্র, এমনকি, পরমাণুতেও পরমাত্মারূপে শ্রীকৃষ্ণ বিরাজ করছেন,—শুধু এই চিন্তা দ্বারা মনের ভাবনা, অনুভূতি ও ইচ্ছা ক্রিয়ার পূর্ণতা লাভ হয়। জড় দৃষ্টিতে দৃশ্যমান জগৎকে প্রকৃত ভক্ত দর্শন করেন না, তিনি সর্বত্র পরমাত্মারূপে তার আরাধ্য ভগবানের উপস্থিতি দর্শন করেন।"
মহারাজ পরীক্ষিৎ আরাে বলতে লাগলেন যে, ভগবানের দিব্য লীলাসমূহ শ্রবণের মাধ্যমে শ্রবণক্রিয়াকে সার্থক করে তােলা যায়। ভগবান ও তার প্রতিনিধি শুদ্ধভক্তের চরণকমলে যখন কেউ অবনত হয়, তখনই মস্তকের সদ্ব্যবহার করা যায়। ভগবান হচ্ছেন সকলের হৃদয়ের অন্তর্যামী—এটি বাস্তব সত্য, তাই দেহকে ভগবানের মন্দির বিবেচনা করে মহাভাগবতগণ সকল জীবকে সশ্রদ্ধ প্রণতি জানান।
অচিরেই এই স্তরে অধিষ্ঠিত হওয়া সকল ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়, কেননা এটি উত্তম অধিকারীর স্তর। মধ্যম অধিকারী ভগবদ্ভক্ত শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি বৈষ্ণবকে চিনতে পারেন। আর কনিষ্ঠ অধিকারী নবীনভক্ত ভগবানের সাক্ষাৎ প্রকাশ সদগুরুকে ও মন্দিরের শ্রীবিগ্রহকে প্রণাম করতে পারে।
কনিষ্ঠ, মধ্যম ও উত্তম অধিকারী ভগবদ্ভক্ত ভগবান বা ভগবানের প্রতিনিধিকে প্রণাম করে তার মস্তকের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারেন। সেইরকম ভগবানের প্রতিনিধি বা শ্রীবিগ্রহ দর্শন করে তিনি নয়নেন্দ্রিয়ের ক্রিয়াকে সার্থক করে তুলতে পারেন।
এইভাবে শুধু ভগবান বা তার প্রতিনিধি সেবায় দেহের বিভিন্ন অঙ্গকে নিযুক্ত করে প্রত্যেকেই সাফল্যের সর্বোত্তম স্তরে অধিষ্ঠিত হতে পারে। আর কিছু না পারলেও, শুধু শ্রীবিগ্রহ ও তার প্রতিনিধি শুদ্ধ কৃষ্ণভক্তকে সশ্রদ্ধ-চিত্তে ও অবনত মস্তকে প্রণাম অথবা শুদ্ধভক্ত ভগবানের পাদোদক বা চরণামৃত পারে পান করতে।
মহারাজ পরীক্ষিতের মুখনিঃসৃত হরিকথামৃত আস্বাদন করে শুকদেব গােস্বামী ভক্তিরসামৃতে নিমজ্জিত হন, কেননা মহারাজ পরীক্ষিৎ ছিলেন বৈষ্ণব তত্ত্ব-দর্শনের অত্যুন্নত স্তরে অধিষ্ঠিত। শুকদেব গােস্বামী ইতিমধ্যেই দিব্য বর্ণনা করছিলেন এবং মহারাজ পরীক্ষিৎ আরও হরিকথামৃত পরিবেশন করতে অনুরােধ করলে পরমানন্দে শুকদেব গােস্বামী শ্রীমদ্ভাগবত কথা বর্ণনা করতে লাগলেন।
সুদামা ও শ্রীকৃষ্ণের বন্ধুতের কাহিনী
এক সময় পরম নিষ্ঠাবান এক ব্রাহ্মণ ছিল। সে ছিল কৃষ্ণের সখা। একজন যথার্থ ব্রাহ্মণ হওয়ায় দিব্য-জ্ঞানের অত্যুচ্চ সােপানে সে অধিষ্ঠিত ছিল। তত্ত্বজ্ঞানের অত্যুচ্চ শিখরে অবস্থিত হওয়ায় সে জড় বিষয়ভােগে আদৌ আসক্ত ছিল না। তাই সে ছিল অতীব ও জিতেন্দ্রিয়, অর্থাৎ এই ছিল একজন শুদ্ধভক্ত কেননা শুদ্ধ ভক্ত না হলে সে পরম তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে পারে না।
ভগবদগীতায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, যথার্থ জ্ঞানে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি পরমেশ্বর ভগবানের চরণারবিন্দে শরণাগত হয়। পক্ষান্তরে বলা যায়—যে ভগবানের প্রীতিপূর্ণ সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে, সে যথার্থ জ্ঞানের স্তরে অধিষ্ঠিত। প্রকৃত জ্ঞানের উদয় হলে ভোগময় সংসার জীবনে বৈরাগ্যের উদয় হয়।
বৈরাগ্যের অর্থ পূর্ণ ইন্দ্রিয় ইন্দ্রিয়গুলি সর্বদাই জড়ভােগে আকৃষ্ট। ভক্তের ইন্দ্রিয়গুলি পবিত্র ও নির্মল হয়ে উঠে। শুদ্ধ ইন্দ্রিয়গুলি তখন ভগবানের সেবায় নিয়োজিত হয়,এই হচ্ছে পন্থা।
শ্রীকৃষ্ণের এই ব্রাহ্মণ-সখা গৃহস্থ হলেও, আরামপ্রদ জীবন-যাপনের উদ্দেশ্যে অর্থ সঞ্চয়ে আদৌ ব্যস্ত ছিল না। তাই ভাগ্য অনুসারে স্বাভাবিকভাবে যে অর্থসম্পদ লাভ হােত, সে তাতেই তুষ্ট ছিল।
এই হচ্ছে যথার্থ জ্ঞানীর লক্ষণ। যিনি যথার্থ জ্ঞান লাভ করেছেন, তিনি জানেন যে তার ভাগ্যে যা আছে, তার চেয়ে সে বেশি সুখী হতে পারবে না। ভবসংসারে প্রত্যেকের জীবনেই কিছু দুঃখ ও কিছু সুখ তার ভাগ্যদ্বারা নির্দিষ্ট হয়ে আছে।
প্রত্যেক জীবের ক্ষেত্রেই দুঃখের পরিমাণ তার ভাগ্য অনুসারে নির্দিষ্ট রয়েছে। এই কারণে আরাে বিষয়-সুখের জন্য ব্রাহ্মণ অতিরিক্ত চেষ্টা করেনি, পক্ষান্তরে কৃষ্ণভক্তিতে উন্নতির সময়ের সদ্ব্যবহার করছিল। প্রকাশ্যে তাকে দীন দরিদ্র মনে হোত কেননা মূল্যবান পােশাক ছিল না এবং পত্নীকেও মূল্যবান বস্ত্র দিতে পারত না।
বৈষয়িক অবস্থা তেমন উন্নত না হওয়ায় তারা যথেষ্ট পরিমাণে আহার পর্যন্ত করত না। তাই ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী দুজনকে ক্ষীণকায় মনো হােত। ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তার পত্নী উদ্বিগ্ন ছিল না।
কিন্তু নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ স্বামীর দৈহিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য খুবই চিন্তিত ছিল। দুর্বল স্বাস্থ্যের জন্য সর্বদাই সে দৈহিক কম্পন অনুভব করত। তখন স্বামীকে কোন অনুরােধ করতে না চাইলেও সে বলল-
আমি জানি লক্ষ্মীপতি ভগবান কৃষ্ণ হচ্ছেন আপনার ব্যক্তিগত সখা। আপনিও একজন পরম ভক্ত। কৃষ্ণ অতীব ভক্তবৎসল। আপনি ভগবানের কোন সেবা করছেন বলেও মনে করেন না তবুও আপনি তার শরণাগত আর ভগবানও শরণাগতের রক্ষক।
তাছাড়া আমি জানি ভগবান কৃষ্ণ হচ্ছেন বৈদিক সংস্কৃতির আদর্শ পুরুষ। তিনি সর্বদাই ব্ৰহ্মণ্য ধর্মের প্রতি অনুকূল এবং যথার্থ ব্রাহ্মণদের প্রতি অতীব করুণাময়।
আপনি সবচেয়ে ভাগ্যবান কেননা পরমেশ্বর ভগবানকে আপনি নিজ সখারূপে লাভ করেছেন। কৃষ্ণ একমাত্র আপনার মতাে ব্যক্তিদের আশ্রয় দাতা, কেননা আপনি সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণের শরণাগত। আপনি সাধু, শাস্ত্রজ্ঞ জিতেন্দ্রিয়। সব রকম পরিস্থিতিতে ভগবান কৃষ্ণই আপনার একমাত্র আশ্রয়। এই জন্য দয়া করে একবার তার কাছে যান। আমি নিশ্চিত তিনি অচিরেই আপনার দারিদ্র্যের কথা উপলব্ধি করবেন।
আপনি একজন গৃহস্থ তাই অর্থহীনতার ফলেই আপনার এ দুর্দশা। তিনি আপনার দুর্দশা হৃদয়ঙ্গম করা মাত্রই, আপনাকে অবশ্যই অর্থ দান করবেন যাতে আপনি সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারেন। ভগবান কৃষ্ণ এখন ভােজ, বৃষ্ণি ও অন্ধক রাজবংশীয়দের রাজা; এবং আমি শুনেছি তিনি রাজধানী দ্বারকাপুরী কখন ত্যাগ করেন না।
কৃষ্ণ দ্বারকাপুরীতেই বসবাস করেন; বাইরে তার কোন কাজকর্ম নেই। তাই এমনই দয়ালু উদার শরণাগত ব্যক্তিকে তিনি সবকিছু এমনকি নিজেকেও পর্যন্ত দান করেন।
ভক্তের কাছে যখন নিজেকে পর্যন্ত অর্পণ করেন, তখন জড়-জাগতিক কিছু সম্পদ দান করা তার পক্ষে আশ্চর্যের কিছুই নয়। যে ভক্তের নিষ্ঠা নেই, ঐকান্তিকতা নেই তাকে কৃষ্ণ বেশি সম্পদ দেন না; কিন্তু আমার মনে হয়, আপনি ভগবদ্ভুজনে কত নিষ্ঠাবান তা কৃষ্ণ ভালভাবেই জানেন। তাই জীবন যাপনের একান্ত প্রয়ােজনীয় কিছু সম্পদ দানে কৃষ্ণ আদৌ দ্বিধা বােধ করবেন না।”
সুদামার দ্বারকা যাত্রা
এইভাবে কৃষ্ণের কাছে যাওয়ার জন্য সুদামা বিপ্রকে তার পত্নী বারবার অনুনয় করল। সুদামা মনে করল, ভগবান কৃষ্ণের কাছে কোন জাগতিক সম্পদ চাওয়ার কোন প্রয়ােজন নেই, তবু পত্নীর বারবার অনুরােধে সে দ্বারকা যেতে উদ্বুদ্ধ হল।
তাছাড়া সুদামা মনে মনে ভাবল, "সেখানে গেলে আমি ব্যক্তিগতভাবে ভগবানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারব, আর তার কাছে কোন সম্পদ না চাইলেও অন্ততপক্ষে তাকে দেখার এক বিরাট সুযােগ ও সৌভাগ্য আমার হবে।” দ্বারকায় যেতে মনস্থ করে, সে পত্নীর কাছে জানতে চাইল, কৃষ্ণকে দেওয়ার জন্য গৃহে কিছু আছে কিনা, কেননা সখার জন্য অবশ্য কিছু উপহার নেওয়া চাই।
অবিলম্বে পত্নী চার মুষ্ঠি চিড়া প্রতিবেশী বান্ধবীর কাছ থেকে সংগ্রহ করে একখণ্ড কাপড়ে বেঁধে কৃষ্ণকে উপহার দেওয়ার জন্য স্বামীর কাছে দিল।
শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করবার উদ্দেশ্যে উপহারটি নিয়ে, ব্রাহ্মণ তক্ষুণি দ্বারকা অভিমুখে যাত্রা করল। এই সময় কিভাবে সে শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে সক্ষম হবে, সেই চিন্তায় তন্ময় হয়ে পড়ল। শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া তখন তার হৃদয়-মনে অন্য কিছুই রইল না।
যাদব রাজন্যবর্গের প্রাসাদে উপস্থিত হওয়া অবশ্য খুবই কঠিন, কিন্তু সেই ব্রাহ্মণকে তবু রাজদর্শনের সুযােগ দেওয়া হল, অন্যান্য ব্রাহ্মণসহ কৃষ্ণসখা সুদামা বিপ্রকে ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দিলে, তাকে তিনটি সেনানিবাসের মধ্য দিয়ে যেতে হল।
প্রতিটি সেনানিবাসে সুউচ্চ তােরণ রয়েছে, সুদামা বিপ্রকে এই তােরণগুলি অতিক্রম করতে হল। সেনানিবাস ও তােরণের পর রয়েছে ষোল হাজার বিরাট বিরাট প্রাসাদ।
এখানে শ্রীকৃষ্ণের ষোল হাজার মহিষী থাকেন। তাদের মধ্যে ঐশ্বর্যমণ্ডিত একটি প্রাসাদে ব্রাহ্মণ প্রবেশ করল। এই সুন্দর প্রাসাদে প্রবেশ করা মাত্র তার মনে হল সে যেন এক দিব্য আনন্দ সমুদ্রে সম্ভরণ করছে। সর্বদাই সে যেন পরম আনন্দে সেখানে লীলাবিলাস করছে বলে তার অনুভব হল।
সেই সময় শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিণীদেবীর পালঙ্কে বসেছিলেন। বেশ কিছুটা দূরে হলেও ব্রাহ্মণকে তার গৃহের দিকে আসতে দেখে, তার সখা বলে তিনি চিনতে পারলেন। তক্ষুণি আসন ত্যাগ করে সখাকে স্বাগত জানাতে শ্রীকৃষ্ণ এগিয়ে গেলেন।
তারকাছে উপস্থিত হয়ে দুবাহু দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ ব্রাহ্মণকে আলিঙ্গন করলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং দিব্য আনন্দের উৎস হলেও, দরিদ্র ব্রাহ্মণকে আলিঙ্গন করে তিনি নিজেও পরম আনন্দ অনুভব করলেন কেননা ব্রাহ্মণটি ছিল তার অতি প্রিয় সখা।
তখন তিনি নানা সুগন্ধি ধূপ জ্বালালেন এবং প্রথা অনুসারে জ্বলন্ত দীপ দ্বারা ব্রাহ্মণকে আরতি করলেন। এইভাবে যথেষ্ট সম্বর্ধনার পর, ব্রাহ্মণ আহার্য ও পানীয় গ্রহণ করল, তারপর শ্রীকৃষ্ণ বললেন, হে সখা, তুমি যে এখানে এসেছ, এটা আমার পরম সৌভাগ্য।”
অত্যন্ত দরিদ্র হওয়ায় ব্রাহ্মণের বেশভূষা আদৌ ভাল ছিল না। শীর্ণকায়, জীর্ণবেশ ব্রাহ্মণকে খুব পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছিল না। দেহ দুর্বল হওয়ায় তার শরীরের হাড়গুলি স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল। লক্ষ্মীদেবী রুক্মিণী স্বয়ং চামর দিয়ে তাকে ব্যজন করতে লাগলেন, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ ব্রাহ্মণকে ঐভাবে অভ্যর্থনা করায় প্রাসাদের অন্যান্য রমণীরা অবাক হয়ে যান। এই বিশেষ ব্রাহ্মণটিকে সম্বর্ধনার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এত আগ্রহ দেখে তারা বিস্মিত হন।
অপরিচ্ছন্ন দীন-বেশযুক্ত এই দরিদ্র ব্রাহ্মণকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং কিভাবে অভ্যর্থনা করলেন রমণীরা অবাক হয়ে তা ভাবতে লাগলেন। কিন্তু তখন তারা একথাও বুঝতে পারলেন যে, এই ব্রাহ্মণ একজন সাধারণ জীব নন—তিনি নিশ্চয় বহু পুণ্যকর্ম করেছেন। তা না হলে স্বয়ং লক্ষ্মীপতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেন তাকে এমনভাবে সাদরে অভ্যর্থনা করবেন? তার উপর ব্রাহ্মণকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শয্যায় উপবিষ্ট দেখে তারা আরও বিস্মিত হলেন। অগ্রজ শ্রীবলরামকে যেভাবে আলিঙ্গন করেন, কৃষ্ণ ব্রাহ্মণকেও সেইভাবে আলিঙ্গন করায় তারা বিশেষভাবে অবাক হলেন কেননা ভগবান বিশেষত রুক্মিণীদেবী ও বলরামকেই শুধু আলিঙ্গন করেন, অন্য কাউকেই করেন না।
ব্রাহ্মণকে সম্বর্ধনা করে, তাকে কোমল শয্যায় বসিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ব্রাহ্মণ, হে সখা, তুমি একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তুমি ধর্মজীবন সম্বন্ধে একজন বিজ্ঞজন। আমার বিশ্বাস এই যে, গুরুগৃহে শিক্ষা সমাপন করে, তাঁকে যথেষ্ট গুরুদক্ষিণা দান করে তুমি নিশ্চয় স্বগৃহে ফিরে গিয়েছিলে এবং তারপর উপযুক্ত পত্নী গ্রহণ করেছিলে। আমি জানি, তুমি শুরু থেকেই বৈষয়িক জীবনে আদৌ আসক্ত ছিলে না, আবার খুব ধন-সম্পদও তুমি কখনও কামনা করনি এজন্য তােমার অর্থের প্রয়ােজন হয়েছে।
এই জড় জগতে ধনসম্পদে অনাসক্ত ব্যক্তি বিরল। ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য এই রকম অনাসক্ত ব্যক্তিরা ধন-সম্পদ সঞ্চয়ে আদৌ ইচ্ছা করেন না, কিন্তু আদর্শ গৃহস্থ জীবনের দৃষ্টান্ত স্থাপনের উদ্দেশ্যেই শুধু কখনও কখনও তাদের অর্থ সংগ্রহ করতে দেখা যায়। উপযুক্তভাবে সম্পদ বিতরণের মাধ্যমে কিভাবে একজন আদর্শ গৃহস্থ ও একই সময়ে মহাভাগবতে পরিণত হওয়া যায়, তারা সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এইরকম আদর্শ গৃহস্থরা আমার পদাঙ্ক অনুসরণকারী বলে গণ্য হন। হে ব্রাহ্মণ, হে সখা, আশা করি তােমার স্মরণ আছে—সেই দিনগুলির কথা, সেই গুরুকুল জীবনের কথা, যখন তুমি আর আমি একসঙ্গে গুরুগৃহে বসবাস করতাম। বস্তুত তুমি ও আমি দুজনে জীবনে যে জ্ঞান লাভ করেছি, তা সবই এই গুরুকুল জীবনের সঞ্চিত জ্ঞান।
"সদগুরুর পরিচালনায় গুরুকুল জীবনে সুশিক্ষা প্রাপ্ত হলে, ভবিষ্যতে মানুষের জীবন সফল ও সার্থক হয়, সহজেই সে অবিদ্যার তমাে অন্ধকার অতিক্রম করতে পারে। অলীক মায়া তাকে প্রভাবিত করতে পারে না। হে সখা, পিতাকেই প্রথম গুরুরূপে প্রত্যেকের বিবেচনা করা উচিত কেননা পিতার করুণায় একজন এই দেহ প্রাপ্ত হয়। এইজন্য স্বাভাবিকভাবে পিতাই গুরু। তারপর যিনি আমাদের দিব্য-জ্ঞান প্রদান করেন তিনি হচ্ছেন সদগুরু এবং তিনি আমার মতােই আরাধ্য ও পূজনীয়।
একাধিক গুরু হতে পারে। যিনি উপদেশ ও পারমার্থিক শিক্ষা দেন, তিনি হচ্ছেন শিক্ষাগুরু; আর যিনি দীক্ষা দান করেন, তিনি হচ্ছেন দীক্ষাগুরু। শিক্ষাগুরু ও দীক্ষাগুরু দুজনই আমার প্রতিনিধি। শিক্ষাগুরু অনেক হতে পারে, কিন্তু দীক্ষা একজনই দান করেন। গুরুদেবের কৃপা ও তাঁর কাছ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের মাধ্যমে সংসার-সমুদ্র অতিক্রম করলে, মানব জীবন সার্থক হয়েছে বলে বুঝতে হবে। মানব জীবনের উদ্দেশ্য হল পারমার্থিক সাফল্য, এবং তা একমাত্র এই মানব জীবনেই লভ্য। এই ব্যবহারিক জ্ঞান যার আছে তিনি বৈকুণ্ঠে ফিরে যান।
“হে সখা, আমি সকলের হৃদয়ে বিরাজিত অন্তর্যামী পরমাত্মা এবং আমার মুখ্য আদেশ হচ্ছে মানব সমাজ মাত্রই বর্ণাশ্রম ধর্ম পালনীয়। ভগবদগীতায় আমার শিক্ষানুযায়ী মানব সমাজকে গুণ ও কর্ম অনুসারে চারটি বর্ণ ও চারটি আশ্রমে বিভক্ত করা উচিত। সগুরুর সেবায় যাতে সম্পূর্ণভাবে জীবন উৎসর্গ করা যায়, সেই জন্য ইন্দ্রিয়তৃপ্তি ত্যাগ ও ব্রহ্মচর্য ধারণ করে, তত্ত্বজ্ঞান লাভের উদ্দোশে জীবনের প্রথম ভাগ সৎ শিক্ষানবীশরূপে অতিবাহিত করা কর্তব্য।
ব্রহ্মচারীর জীবন তপশ্চর্যা ও কৃষ্ণ সাধনের জন্য। সংযত ও পরিমিত ইন্দ্রিয়তৃপ্তির জন্য গৃহস্থ জীবন। কিন্তু জীবনের তৃতীয় ধাপে কারাে গৃহস্থ জীবন-যাপন করা উচিত নয়। তখন আবার তাকে পূর্বের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে পালিত তপশ্চর্যা ও কৃচ্ছসাধন পূর্ণ জীবনে ফিরে যাওয়া উচিত এবং এইভাবে গৃহস্থ জীবনের আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়া কর্তব্য। বৈষয়িক সংসার জীবনের আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়ার পর সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণীয়।
"সকলের হৃদয়ে অন্তর্যামী পরমাত্মারূপে অবস্থান করে আমি প্রত্যেকের জীবনের প্রতি মুহূর্তের কার্যাবলী লক্ষ্য করি। ঐকান্তিক ও নিষ্কপট ভাবে যে গুরু-আদিষ্ট কর্তব্য পালন করে ও এইভাবে গুরু সেবায় জীবন উৎসর্গ করে, যে অবস্থায়ই সে অবস্থিত হােক না, সেই আমার সবচেয়ে প্রিয় হয়।
গুরুদেবের আদেশ অনুযায়ী কেউ যদি সারা জীবন ব্রহ্মচর্য পালন করে, তবে তা পরম কল্যাণকর। কিন্তু ব্রহ্মচর্য জীবনে স্ত্রীসঙ্গের স্পৃহা হলে, কিংবা কামার্ত হলে, গুরুদেবের ইচ্ছা অনুযায়ী তখন গুরুর আশ্রম ত্যাগ করা উচিত। তখন বৈদিক বিধান অনুসারে গুরু-দক্ষিণা নামে গুরুদেবকে একটি উপহার দেওয়া কর্তব্য। তারপর শিষ্যের গৃহস্থ জীবন গ্রহণীয়, তখন ধর্মীয় রীতি অনুসারে সে একজন পত্নী গ্রহণ করে।”
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তার সখা শাস্ত্রজ্ঞ সুদামা বিপ্রের এই কথােপকথন প্রসঙ্গে উপদেশগুলি মানব সমাজের পক্ষে খুবই মঙ্গলজনক। যে মানব সমাজ বর্ণাশ্রমমুখী নয়, তা বাহ্যত সভ্য দেখালেও প্রকৃতপক্ষে পশুর সমাজ ছাড়া আর কিছুই নয়। নর-নারীর অবৈধ যৌন সম্পর্ক মানব সমাজে কখনই স্বীকার্য নয়। মানুষ মাত্রেরই কঠোরভাবে ব্রহ্মচর্য ব্রত পালনীয়। তা না হলে, গুরুদেবের আদেশ নিয়ে গৃহস্থ জীবন-যাপন করা উচিত। অবিবাহিত জীবনে অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ হচ্ছে পশুর জীবন। কেননা পশুদের মধ্যে বিবাহ বিধি নেই।
বর্তমান সমাজে মানব জীবনের উদ্দেশ্য ইন্দ্রিতৃপ্তি পূর্ণ করবার লক্ষ্য নেই। মানব জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে ভগবদ্ধাম বৈকুণ্ঠে ফিরে যাওয়া। এই উদ্দেশ্য সাধনে বর্ণাশ্রম ধর্ম অবশ্যই পালনীয়। সচেতনতার সহিত বর্ণাশ্রম ধর্ম কঠোরভাবে পালন করলে মানব-জীবনের উদ্দেশ্য সাধিত হবে। সাধু-গুরু-শাস্ত্রের আনুগত্যহীন পরােক্ষভাবে এই ধর্ম পালন করলে, মানব সমাজে উৎপাতই শুধু সৃষ্টি হবে, সমাজের শান্তি ও সমৃদ্ধি কিছুই হবে না।
সুদামা বিপ্রকে শ্রীকৃষ্ণ আরাে বললেন, “হে সখা, আমার মনে হয়, তােমার নিশ্চয় মনে পড়ে আমাদের সেই গুরুকুল জীবনের দিনগুলির কথা। তােমার কি মনে পরে গুরুপত্নীর আদেশে আমরা শুষ্ক কাঠ সংগ্রহের জন্য বেরিয়েছিলাম। সেই সময় হঠাৎ আমরা গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলে পথ হারিয়ে ফেলি। অকস্মাৎ ধুলিময় এক প্রচণ্ড ঝড় তখন মেঘ ও বিদ্যুৎ আলােক সহ আকাশ থেকে বজ্রপাতের ভয়ঙ্কর শব্দ হতে থাকে, তারপর সূর্য অস্ত যায়। আমরা অন্ধকারময় জঙ্গলে হারিয়ে গেলাম, এবং তারপর প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হল। ফলে সমগ্র বনভূমি প্লাবিত হল। আমরা গুরুদেবের আশ্রমে ফিরে যাবার পথ খুঁজে পেলাম না।
তােমার হয়তাে সেই প্রবল বৃষ্টির কথা মনে আছে, প্রকৃতপক্ষে তাকে বৃষ্টি না বলে ক্ষুদ্র প্রলয় বলা চলে। সেই ঝড় ও প্রবল বৃষ্টিতে আমাদের দুঃখকষ্টের অন্ত ছিল না, তাই আমরা যাওয়ার চেষ্টা করে কেবল বিভ্রান্তই হয়েছি। এই রকম দুরবস্থায় একজন অন্যজনের হাত ধরে আমরা পথ খুঁজে বের করবার চেষ্টায় সারা রাত অতিবাহিত করেছি। আমাদের অনুপস্থিতির কথা প্রত্যুষে জানতে পেরে গুরুদেব আমাদের খোঁজ করবার জন্য তার অন্যান্য শিষ্যদের প্রেরণ করেন। তিনিও তাদের সঙ্গে বের হন। জঙ্গলের মধ্যে আমাদের কাছে উপস্থিত হয়ে তিনি আমাদের অত্যন্ত বিপন্ন অবস্থায় দেখতে পেলেন।
"পরম করুণাময় গুরুদেব বললেন, তােমরা আমার জন্য এত কষ্ট স্বীকার করেছ—আমি বাস্তবিক অবাক হয়েছি। প্রত্যেকেই তার দেহের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা প্রথমে বিবেচনা করে কিন্তু তােমরা আমার যােগ্য শিষ্য, গুরুদেবের প্রতি তােমরা এতই শ্রদ্ধাবান যে, নিজ দেহের স্বাচ্ছন্দ্য উপেক্ষা করে তােমরা আমার জন্য এত কষ্ট স্বীকার করেছ। তােমাদের মতাে যােগ্যতাসম্পন্ন শিষ্য গুরুদেবের জন্য যেকোন রকম কষ্ট স্বীকার করবে, তা দেখে আমি খুবই তুষ্ট হয়েছি। সদগুরুর থেকে মুক্ত হওয়ার এই হচ্ছে উপযুক্ত শিষ্যের পথ।
গুরুদেবের সেবায় জীবন উৎসর্গ করাই হচ্ছে শিষ্যের কর্তব্য। হে দ্বিজ শ্রেষ্ঠ, আমি তােমাদের কাজে অতীব তুষ্ট হয়ে আশীর্বাদ করছি তােমাদের সকল মনষ্কামনা পূর্ণ হােক। আমার নিকট থেকে প্রাপ্ত বৈদিক জ্ঞান সর্বদা তােমাদের স্মরণে থাকুক, যাতে প্রতি মুহূর্তে তা স্মরণ করে অনায়াসে ঐ উপদেশ তােমরা উল্লেখ করতে পার। এইভাবে এই জীবনে বা ভবিষ্যৎ জীবনে তােমরা কখনও বিফল মনােরথ হবে না। শ্ৰীকৃষ্ণ বলতে লাগলেন, "প্রিয় সখা, তােমার মনে আছে, গুরুদেবের আশ্রয়ে থাকাকালীন এইরকম অনেক ঘটনা ঘটেছিল।
আমরা দুজনেই বুঝতে পেরেছিলাম যে সদগুরুর আশীর্বাদ ছাড়া কেউ জীবনে সুখী হতে পারে না। গুরুদেবের কৃপা ও আশীর্বাদেই কেবল শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জন করে মানব জীবনের ব্রত ও উদ্দেশ্য পূর্ণ করা যায়।"
এই কথা শুনে শাস্ত্রজ্ঞ সুদামা বিপ্র বললেন "হে কৃষ্ণ, তুমি সকলের পরম প্রভু, পরম গুরু। গুরুগৃহে তােমার সঙ্গে বসবাস করবার আমার সৌভাগ্য হয়েছিল, তাই বৈদিক বিধি-নির্দিষ্ট কোন কর্তব্যই আমার করবার নেই বলে আমি মনে করি। হে প্রভু, বৈদিক স্তবস্তুতি, ক্রিয়া-কর্ম, ধর্ম, অর্থ, মােক্ষাদি সহ মানব- জীবনের সাফল্যের অন্যান্য সবকিছুই প্রাপ্ত হওয়ার একটাই উৎস—পরম পুরুষ তােমার থেকেই। জীবনের অন্যান্য পন্থা সকলের অন্তিম উদ্দেশ্য হচ্ছে তােমাকে উপলব্ধি করা, পক্ষান্তরে বলা যায়—সেগুলাে হচ্ছে তােমার দিব্য রূপের বিভিন্ন অংশ।
তবু তুমি শিষ্যের ভূমিকায় গুরুগৃহে আমাদের সঙ্গে বসবাসের অভিনয় করেছিলে। এর অর্থ হচ্ছে নিজের প্রীতির জন্য তুমি এইসব লীলাবিলাস করেছিলে। তা না হলে তােমার এই ধরনের মনুষ্যলীলা করবার কোন দরকার ছিল না।
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জীবকুলের অন্তর্যামী পরমাত্মা হওয়ায়, সকলের মনােভিলাষ সম্বন্ধে তিনি অভিজ্ঞ। তিনি বিশেষভাবে ব্রাহ্মণ ভক্তদের প্রতি অনুরাগ পরায়ণ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ব্ৰহ্মণ্যদেব বলা হয় অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ব্রাহ্মণদের উপাস্য। এইজন্য যিনি পরমেশ্বর ভগবানের পাদপদ্মের পূর্ণ শরণাগতি করেছেন, ইতিমধ্যেই তিনি ব্রাহ্মণের পদ প্রাপ্ত হয়েছেন বলে বুঝতে হবে। ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্তি। হওয়া পর্যন্ত কেউ পরম ব্রহ্ম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হতে পারে না। শ্রীকৃষ্ণ বিশেষভাবে ভক্তের দুর্গতি নাশ করেন এবং শুদ্ধ ভক্তের তিনিই একমাত্র আশ্রয়।
পূর্বে একত্রে জীবন-যাপনের কথা আলােচনায় শ্রীকৃষ্ণ সুদামা বিপ্রের সঙ্গে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। তারপর একজন পুরানাে বন্ধুর সঙ্গ উপভােগ করবার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, "প্রিয় বন্ধু, আমার জন্য তুমি কি এনেছ? তােমার স্ত্রী কি আমার জন্য কোন উপাদেয় খাবার তােমার সঙ্গে পাঠিয়েছে?" বন্ধুর উদ্দেশ্যে এই কথা বলার সময় তার মুখের দিকে তাকিয়ে শ্ৰীকৃষ্ণ অত্যন্ত প্রীতিসহকারে হাসছিলেন।
সুদামার পুটলি থেকে জুর করে শ্রীকৃষ্ণের চিড়া গ্রহণ
শ্রীকৃষ্ণ আরাে বললেন, "প্রিয় সখা, গৃহ থেকে তুমি নিশ্চয় কিছু উপহার আমার জন্য এনেছ।” ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জানতেন যে খাওয়ার অনুপযুক্ত অতি তুচ্ছ চিড়া দিতে সে ইতন্তত করছে। তাই সুদামার মনােভাব বুঝতে পেরে ভগবান বললেন, “বন্ধু, নিঃসন্দেহে আমার কোন অভাব নেই, কিন্তু ভক্ত যদি প্রীতি ভরে আমাকে কোন দ্রব্য দান করে, তা অতি তুচ্ছ হলেও, পরম প্রীতি সহকারে আমি তা গ্রহণ করি।
পক্ষান্তরে অত্যন্ত মূল্যবান দ্রব্য প্রদান করা সত্ত্বেও অভক্তের উপচার আমি গ্রহণ করতে ইচ্ছা করি না। অনুরাগ ও ভক্তি সহকারে যা অর্পণ করা হয়, বস্তুত তাই শুধু আমি গ্রহণ করি, নয়তাে যতই মূল্যবান হােক না কেন, আমি তা গ্রহণ করি না। যদি আমার শুদ্ধভক্ত প্রীতি ও ভক্তির সহিত হৃদয়ে অতীব তুচ্ছ উপচার, একটি ছােট্ট ফুল, একটু জল ও একটি তুলসী পত্র অর্পণ করে, তখন আমি সানন্দে তা শুধু গ্রহণই করি না, পরম আনন্দে তা আহারও করি।"
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সুদামা বিপ্রকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, গৃহ থেকে আনা চিড়া তিনি অত্যন্ত আনন্দ সহকারে গ্রহণ করবেন, তবু অত্যন্ত লজ্জাবশত সুদামা বিপ্র ঐ চিড়া তাকে দিতে খুবই দ্বিধাবােধ করলেন। তিনি তখন ভাবলেন, "কিভাবে আমি শ্রীকৃষ্ণকে এই অতি তুচ্ছ দ্রব্য অর্পণ করব?" এই রকম ভেবে তিনি লজ্জায় মাথা নত করে রইলেন।
অন্তর্যামী পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ সকলেরই হৃদয়ের ভাব জানেন। সকলের প্রয়ােজন এবং মনােবাসনাও তিনি অবগত আছেন। তাই সুদামা বিপ্রের আগমনের কারণও তিনি জানতেন। তিনি জানতেন যে চরম দারিদ্র পীড়িত হয়ে পত্নীর অনুরােধে সে তার কাছে এসেছে। একই আশ্রমের সহপাঠী প্রিয় সখা সুদামার কথা চিন্তা করে, তিনি জানতেন সখারূপে তাঁর প্রতি সুদামার অনুরাগ কখনই জড় বাসনাময় ছিল না।
শ্রীকৃষ্ণ ভাবলেন, "পত্নীর অনুরােধে আমাকে পরিতুষ্ট করবার জন্য সে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছে—আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করতে সে এখানে আসেনি।” তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ইন্দ্রেরও কল্পনাতীত বিপুল ঐশ্বর্য সুদামা বিপ্রকে প্রদান করতে ইচ্ছা করলেন।
তারপর দরিদ্র ব্রাহ্মণের কাধে ঝুলন্ত পুটলিতে রাখা চিড়া কৃষ্ণ ছিনিয়ে নিয়ে বললেন, "সখা, এ কি? তুমি আমার জন্য উপাদেয় চমৎকার চিড়া এনেছ।" সুদামাকে অনুপ্রাণিত করে তিনি আরাে বললেন, "এই চিড়া শুধু আমাকেই সন্তুষ্ট করবে না, নিখিল বিশ্বকে তা তুষ্ট করবে।"
এই বাণী থেকে বুঝতে হবে যে, সব কিছুর আদি উৎস শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন নিখিল সৃষ্টির মূলতত্ত্ব। বৃক্ষমূলে জল সিঞ্চন করলে অচিরেই যেমন বৃক্ষের প্রতি অংশে তা সিঞ্চিত হয়, সেই রকম শ্রীকৃষ্ণের তুষ্টি বিধানের জন্য যে সেবা করা হয়, বা শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে যা অৰ্পণ করা হয়, তাতে প্রত্যেকের সর্বোত্তম কল্যাণ সাধিত হয় বলে বিবেচনা করতে হবে; কেননা শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে এই রকম নিবেদনের ফল নিখিল সৃষ্টির মধ্যে বিতরিত হয়। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনুরাগ হলে তা জীবকুলের সকলের মধ্যেই বিতরিত হয়।
এই ঘটনা থেকে জানা যায় যে, প্রীতি ও ভক্তি ভরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভােগ নিবেদন করা হলে, তিনি আনন্দে ভক্তের নৈবেদ্য গ্রহণ করেন; তার ফলে, স্বয়ং লক্ষ্মী রুক্মিণীদেবী কৃতজ্ঞ চিত্তে স্বয়ং ভক্তের গৃহে গিয়ে সেটিকে জগতের শ্রেষ্ঠ ঐশ্বর্যশালী গৃহে পরিণত করেন। ভগবান নারায়ণকে যে প্রচুর ভােগ দান করে, স্বাভাবিকভাবেই স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী তার গৃহে আতিথ্য স্বীকার করেন অর্থাৎ তার গৃহ ঐশ্বর্যশালী হয়ে ওঠে।
সুদামা বিপ্র সেই রাত কৃষ্ণের গৃহে অতিবাহিত করলেন। সেখানে থাকাকালীন তার মনে হল তিনি বৈকুণ্ঠ ধামে রয়েছেন। বাস্তবিক তিনি বৈকুণ্ঠে ছিলেন, কেননা যেখানে মূল নারায়ণ শ্রীকৃষ্ণ ও স্বয়ং লক্ষ্মী রুক্মিণীদেবীর আবাস, সেই স্থান ও ভগবদ্ধাম বৈকুণ্ঠ অভিন্ন।
ভগবানের সঙ্গে থাকাকালীন সুদামা বিপ্র বিশেষ মূল্যবান কিছু পেলেন বলে মনে হল না। তবু সুদামা ভগবানের কাছে কিছুই চাননি। পরদিন প্রাতে সুদামা বিপ্র স্বগৃহাভিমুখে যাত্রা করলেন। কৃষ্ণের সাদর অভ্যর্থনার কথা চিন্তা করতে করতে তিনি দিব্য আনন্দে নিমগ্ন হলেন। সমস্ত পথ তিনি কৃষ্ণের অতুলনীয় ব্যবহারের কথাই ভাবতে লাগলেন, এবং কৃষ্ণের দর্শন লাভ করায় তিনি পরম আনন্দ অনুভব করতে লাগলেন।
সুদামা বিপ্র ভাবতে লাগলেন, “ব্রাহ্মণদের সবচেয়ে কল্যাণকামী ভগবান কৃষ্ণের দর্শন লাভ করা পরম আনন্দের বিষয়। ব্রাহ্মণের ধর্মের প্রতি কৃষ্ণের কত গভীর অনুরাগ। স্বয়ং পরম ব্রহ্ম হওয়া সত্বেও কৃষ্ণ ব্রাহ্মণের প্রীতিতে সাড়া দেন। একমাত্র লক্ষ্মীদেবী ছাড়া যদিও কৃষ্ণ কাউকে আলিঙ্গন করেন না, তবুও ব্রাহ্মণদের প্রতি তার এতই শ্রদ্ধা যে, আমার মতাে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণকেও বক্ষে ধারণ করে কৃষ্ণ আলিঙ্গন করল। কোথায় লক্ষ্মীদের একমাত্র আশ্রয় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আর কোথায় এক পাপী দরিদ্র ব্রাহ্মণ আমি। কার সঙ্গে কার তুলনা।
তবু আমাকে ব্রাহ্মণ বিবেচনা করে প্রসন্ন চিত্তে দিব্য বাহুদ্বারা কৃষ্ণ আমাকে আলিঙ্গন করলেন। কৃষ্ণ সত্যি কৃপাসিন্ধু কেননা যেখানে স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী শয়ন করেন, সেই শয্যায় কৃষ্ণ আমাকে বসতে দিয়েছেন, কৃষ্ণ আমাকে তার নিজের ভাই বলে সম্মুধন করেছেন। কৃষ্ণের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা কিভাবে আমি প্রকাশ করব? আমি অবসন্ন হয়ে পড়লে রুক্মিণীদেবী যিনি স্বয়ং লক্ষ্মী, চামর হাতে আমাকে ব্যজন করতে শুরু করেন।
তিনি কখন নিজেকে কৃষ্ণের প্রধান মহিষীরূপে মনে করেন না। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং আমার সেবা করলেন, কারণ তিনি ব্রাহ্মণদের প্রতি পরম শ্রদ্ধাবান। আমার পাদসেবন করে, আমাকে আহার্য দান করে, কৃষ্ণ বস্তুত আমার পূজা করলেন। যারা যশ কামনা করে, যারা মােক্ষ কামনা করে, যারা সব রকম ধনসম্পদ কামনা করে, কিংবা যারা যৌগিক সিদ্ধি কামনা করে সকলেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দের আরাধনা করে। তবু ভগবান এমনি করুণাময় যে, আমি দরিদ্র, তাই অর্থসম্পদ প্রাপ্তিতে যদি আমি ধনমত্ত হয়ে ভগবানকে ভুলে যাই, এই কথা ভেবে কৃষ্ণ আমাকে সামান্যমাত্র অর্থ-সম্পদও দান করেননি।”
সুদামা বিপ্রের এই কথাগুলি বাস্তবিক যথার্থ ঠিক। একজন কপর্দকহীন নিঃস্ব ব্যক্তি বিষয়-সম্পদ লাভের উদ্দেশ্যে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে, এবং কোন উপায়েই হােক ধনশালী হলে, অবিলম্বেই সে ভগবানের প্রতি তার কর্তব্যের কথা ভুলে যায়। একেবারে নিঃস্ব না হলে ভগবান তার ভক্তকে বিষয়-সম্পদ দেন না, পক্ষান্তরে নবীন ভক্ত নিষ্কপটভাবে ভগবানের সেবা করে কখন বিষয়-সম্পদ কামনা করলে, ভগবান তাকে বিষয়-সম্পদ থেকে দূরে রাখেন।
কৃষ্ণ কৃপায় সুদামার বিপুল ধনসম্পদ ও প্রাসাদ লাভ
এইভাবে চিন্তা করতে করতে শাস্ত্রজ্ঞ সুদামা বিপ্র ক্রমে স্বগৃহে পৌছলেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখলেন যে সবকিছুই আশ্চর্যজনকভাবে পরিবর্তন হয়ে গেছে। কুটীরের পরিবর্তে সেখানে সূর্য, চন্দ্র ও অগ্নিরশ্মির মতো চাকচিক্যপূর্ণ বহু মূল্যবান মণিরত্নময় প্রাসাদ তিনি দেখতে পেলেন। শুধু তাই নয়, বড় বড় প্রাসাদের সুসজ্জিত উদ্যান ও কাননগুলিতে সে সুন্দর সুন্দর নর-নারীকে পদচারণ করতে দেখতে পেলেন।
কমল ও সুন্দর লিলিফুলে পূর্ণ উদ্যানের সরােবরগুলি বিভিন্ন রঙিন ফুলে পরিপূর্ণ ছিল। স্বগৃহের এইরকম আশ্চর্যজনক পরিবর্তন দেখে ব্রাহ্মণ মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন, আমি কি দেখছি? এই গৃহ কি আমার? না অন্য কারাের? আমি যেখানে বসবাস করতাম, এটি যদি সেই স্থানই হয়, তা হলে এমন আশ্চর্যজনক পরিবর্তন হল কিভাবে?
ব্রাহ্মণ যখন এইভাবে চিন্তামগ্ন তখন দেবতুল্য সুন্দর একদল নরনারী কাছে এসে তাকে স্বাগত জানাল। তারা সকলেই মঙ্গল গীত গাইছিল। ব্রাহ্মণের আগমন বার্তা পেয়ে ব্রাহ্মণপত্নী খুবই খুশি হল। অতি শীঘ্র সেও প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এল। ব্রাহ্মণ পত্নীকে এমন সুন্দর দেখাচ্ছিল যে, মনে হচ্ছিল স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী যেন অভ্যর্থনা করতে এসেছে। পতিকে সম্মুখে উপস্থিত দেখে তার চোখ থেকে আনন্দাশ্রু প্রবাহিত হল, কণ্ঠ রুদ্ধ হওয়ায় সে তার স্বামীকে সম্ভাষণ করতে পারল না। আনন্দের আতিশয্যে সে শুধু চোখ দুটি বুজল।
গভীর প্রীতি ও অনুরাগে, অবনত হয়ে পতিকে প্রণাম করল ও অন্তরে তাকে আলিঙ্গন করতে ইচ্ছা করল। সুবর্ণ কণ্ঠহার ও আভরণে অলংকৃত ও পরিচারিকা পরিবৃত দণ্ডায়মান ব্রাহ্মণ-পত্নীকে দিব্য বিমান থেকে অবতরণকারিণী এক দেবপত্নী বলে মনে হচ্ছিল। সুদামা পত্নীর এই রকম রূপ দেখে বিস্মিত হলেন, কোন কথা না বলে, গভীর অনুরাগে পত্নীর সঙ্গে তিনি প্রাসাদে প্রবেশ করলেন।
প্রাসাদের নিজ কক্ষে প্রবেশ করে ব্রাহ্মণ দেখলেন সেটি কক্ষ নয়, যেন স্বর্গরাজ্যের আবাস। এই প্রাসাদের চতুর্দিকে ছিল বহু রত্নময় স্তম্ভ ও সুকোমল আরামপ্রদ আসন। কমলদলের মতাে কোমল দুগ্ধফেনার মতাে শুভ্র ছিল শয্যাগুলি; হস্তিদন্তে নির্মিত পালঙ্কগুলি ছিল স্বর্ণময় ও রত্ন খচিত। স্বর্ণদণ্ডযুক্ত চামর ও অরবিন্দদলের মতাে কোমল ছিল স্বর্ণসিংহাসনগুলি। বিভিন্ন স্থানে, মুক্তার জরি সমন্বিত মখমল ও রেশমের চন্দ্রাতপ শােভা পাচ্ছিল। স্বচ্ছ স্ফটিক নির্মিত প্রাসাদটি ছিল মহামরকত মণিতে সুশােভিত। সেখানে ললনারা রত্নময় দীপ ধারণ করল। দীপশিখা ও রত্নচ্ছটা একসঙ্গে এক অদ্ভুত উজ্জ্বল আলােক সৃষ্টি করল। হঠাৎ তার এইরকম বিপুল ঐশ্বর্যশালী অবস্থা প্রাপ্তি দেখে, এর কারণ নিরূপণ করতে অসমর্থ সুদামা বিপ্র এ বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন।
এইভাবে সুদামা বিপ্র ভাবতে লাগলেন, আমার জীবনের শুরু থেকেই আমি চরম দারিদ্র পীড়িত। কিন্তু হঠাৎ এরকম বিপুল ঐশ্বর্য ও বৈভবের কারণ কি? আমার প্রিয় সখা যদুবর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপা-দৃষ্টি ছাড়া আমি অন্য কোন কারণ দেখি না। নিঃসন্দেহে এগুলি সবই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অহৈতুকী করুণার দান। ভগবান হচ্ছেন আত্মারাম। তিনি সম্যক পূর্ণ। তিনি হচ্ছেন লক্ষ্মীপতি তাই তিনি সর্বদাই ঐশ্বর্যে পূর্ণ। তিনি তার ভক্তের মনােভিলাষ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন, এবং ভক্তের প্রচুর মনােবাঞ্ছা তিনি পূর্ণ করেন। এসবই আমার প্রিয় সখা কৃষ্ণের কাজ। আমার সখা কৃষ্ণ আকাশের চেয়েও অনেক বেশি উদার ও বদান্য, যদিও আকাশ বিপুল পরিমাণে জল দান করে সমুদ্রকে পূর্ণ করতে সক্ষম।
কৃষককে তুষ্ট করবার জন্য দিবাভাগে বিরক্তিকর বারিবর্ষণ না করে, মেঘ উদারভাবে রাত্রিকালে প্রবল বারিবর্ষণ করে। প্রাতে শয্যা ত্যাগ করে কৃষক মনে করে যথেষ্ট পরিমাণে বৃষ্টি হয়নি; সেই রকম ভগবান প্রত্যেকের অবস্থা অনুযায়ী তার ইচ্ছা পূর্ণ করেন; তবু কৃষ্ণানুশীলন করে না যে অভক্ত, সে ভগবদ্দত্ত সকল দানই যথেষ্ট বলে বিবেচনা করে না।
পক্ষান্তরে ভক্তি ও প্রীতির সহিত ভক্তের কাছ থেকে সামান্য কিছু পেলেও ভগবান তা মহামূল্যবান উপহাররূপে বিবেচনা করেন। আমি নিজেই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমি তাকে সামান্য এক মুষ্টি চিড়া দিয়েছিলাম, প্রতিদানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাকে দেবরাজ ইন্দ্রের চেয়ে বেশি ঐশ্বর্য ও সম্পদ দান করেছেন। বস্তুত ভক্ত ভগবানকে যা অর্পণ করেন, ভগবানের তার কোনই প্রয়ােজন নেই। কারণ তিনি আত্মারাম এবং স্বয়ং সম্পূর্ণ। ভক্ত ভগবানকে কিছু অর্পণ করলে ভক্তের অনুকূলে তা কার্য করে; কেননা ভক্ত ভগবানকে যা কিছু অর্পণ করে, তার অনন্ত গুণ বেশি সে ফিরে পায়। ভগবানকে কিছু নিবেদন করলে, তাতে কারাের কিছুমাত্র ক্ষতি হয় না, পক্ষান্তরে সে লক্ষ লক্ষ গুণে লাভবানই হয়।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি পরম কৃতজ্ঞ সুদামা বিপ্র মনে মনে ভাবলেন, "ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বন্ধুত্ব কামনা করে, আমি তার সেবায় নিযুক্ত হতে চাই। জন্ম জন্ম প্রীতি ও অনুরাগভরে আমি তার সম্পূর্ণ শরণাগত হওয়ার প্রার্থনা করি। আমি ঐশ্বর্য চাই না। আমি যেন কখনও তার সেবা থেকে বঞ্চিত না হই। আমি শুধু তার শুদ্ধ ভক্তদের পূত সান্নিধ্য কামনা করি। আমার মন ও দেহ সর্বদা কৃষ্ণসেবায় নিযুক্ত থাকুক—এই আমার ঐকান্তিক কামনা ও প্রার্থনা।
অজ পরমেশ্বর ভগবান জানেন যে, অতিরিক্ত ঐশ্বর্যের প্রভাবে বহু বহু মহান ব্যক্তিত্বশালীই তাদের সুউচ্চ পদ থেকে পতিত হয়েছে। এইজন্য যখন কেউ ভগবানের কাছে ঐশ্বর্য কামনা করে, ভগবান কখনও কখনও তা দান করেন না। এই ব্যাপারে তাঁর ভক্তের ক্ষেত্রে তিনি খুবই সতর্ক। জড় জগতে অবস্থান করায় পতনের সম্ভাবনা হেতু অপরিণত ভক্তকে ভগবান বিপুল ঐশ্বর্য দান করেন না। এইটি হচ্ছে ভক্তের প্রতি ভগবানের অহৈতুকী করুণার আর একটি লক্ষণ। ভক্তের যাতে পতন না হয়, সেদিকেই ভগবানের প্রথম লক্ষ্য। তিনি হচ্ছেন কল্যাণকামী পিতার মতো, যিনি অপরিণত পুত্রকে প্রচুর অর্থ-সম্পদ দান করেন না, কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে অর্থের সদ্ব্যবহার করতে শিক্ষা করলে, তখন স্নেহময় পিতা সমস্ত ধন-ভাণ্ডারই পুত্রকে দান করেন।
শাস্ত্রজ্ঞ সুদামা বিপ্র এইভাবে সিদ্ধান নিলেন যা কিছু ঐশ্বর্য-বৈভব তিনি পেয়েছেন, তা অসংযতভাবে ইন্দ্রিয়তৃপ্তিতে নয়, পক্ষান্তরে ভগবৎ-সেবায় নিযুক্ত করা উচিত। বৈরাগ্য ভাবাপন্ন ইন্দ্রিয় ভােগে অনাসক্ত হয়ে ব্রাহ্মণ সেই নবলব্ধ পত্নীসহ সকল ঐশ্বর্য-সম্পদ ও সুযােগ-সুবিধাগুলিকে ভগবানের প্রসাদরূপে গ্রহণ করে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে আরম্ভ করলেন। সেইরকম ভাবে আমরাও যদি ক্ষমতা, শিক্ষা, সৌন্দর্য, বিষয়-সম্পদ আদি জড়-জাগতিক ঐশ্বর্য লাভ করি, তা হলে সেগুলি আমাদের ইন্দ্রিয়ভােগ্য বিষয়রূপে গণ্য না করে, সবই ভগবানের দান বিবেচনা করে, অবশ্যই ভগবানের সেবায় নিয়ােগ করা উচিত।
অতুল ঐশ্বর্যে বসবাস করলেও, শাস্ত্রজ্ঞ সুদামা একই অবস্থায় রইলেন, তার কোন অধঃপতন ঘটল না, পক্ষান্তরে কৃষ্ণের প্রতি প্রীতি অনুরাগ দিন দিন বৃদ্ধি পেতে লাগল। বিষয়-সম্পদ কি উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, তদনুযায়ী তা অধঃপতন বা উন্নতির কারণ হতে পারে। ইন্দ্রিয়তৃপ্তির উদ্দেশ্যে ঐশ্বর্য ব্যবহৃত হলে তা অধঃপতনের কারণ হয়; আর ভগবৎ-সেবায় ব্যবহৃত হলে তা উন্নতির কারণ হয়।
সুদামা বিপ্রের প্রতি কৃষ্ণের ব্যবহার থেকে প্রতিপন্ন হয় যে পরমেশ্বর ভগবান ব্রাহ্মণ-গুণসম্পন্ন ব্যক্তির প্রতি অত্যন্ত প্রসন্ন। ব্রাহ্মণ গুণসম্পন্ন সুদামা স্বাভাবিকভাবেই একজন মহান কৃষ্ণভক্ত। এইজন্যই বলা হয় অর্থাৎ ব্রাহ্মণ গুণ-সম্পন্ন ব্যক্তিই বৈষ্ণব হন কখনও কখনও বলা হয় ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। পণ্ডিত মানে যিনি অতিশয় বিদ্বান ও শাস্ত্রজ্ঞ। ব্রাহ্মণ কখনও অশিক্ষিত অথবা মুর্খ হতে পারে না। এইজন্যই বৈষ্ণব ও পণ্ডিত মানে ব্রাহ্মণদের মধ্যে দুটি ভাগ রয়েছে।
যারা শুধু শাস্ত্রজ্ঞ অথচ এখনও বৈষ্ণব বা ব্রহ্মণ হননি, তারা হচ্ছে পণ্ডিত। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাদের প্রতি বিশেষ প্রসন্ন নন। কেবল ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত এই গুণই পরমেশ্বর ভগবানকে আকৃষ্ট করতে যথেষ্ট নয়। ব্রাহ্মণকে শুধু ভগবদগীতা, শ্রীমদ্ভাগবত আদি শাস্ত্র অনুযায়ী হলেই চলবে না, তাকে অবশ্যই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত হতে হবে। সুদামা বিপ্র হচ্ছে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সুদামা বিপ্র ছিলেন যােগ্য ব্রাহ্মণ।
সব রকম ইন্দ্রিয়ভােগে তিনি অনাসক্ত ছিলেন। সকল যজ্ঞ ও তপস্যার একমাত্র ভােক্তা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সুদামা বিপ্রের মতাে একজন ব্রাহ্মণের প্রতি খুবই অনুরাগ সম্পন্ন ছিলেন। এইজন্য সুদামা বিপ্রের মতাে একজন ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব হওয়াই মানব জীবনে সাফল্যের আদর্শ সােপান।
সুদামা বিপ্র হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন যে অজিত হলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভক্তের কাছে বিজিত হন। শ্রীকৃষ্ণ যে পরম করুণাময়, তা সুদামা বিপ্র উপলব্ধি করেছিলেন, সব সময় কৃষ্ণচিস্তায় তিনি মগ্ন থাকতেন। এইরকম নিরন্তর কৃষ্ণ সান্নিধ্যের ফলে তার হৃদয়ে যা কিছু জড় কলুষতা ছিল, তা সবই নির্মল হয়ে, অতি শীঘ্রই তিনি ভগবানের চিন্ময় ধাম প্রাপ্ত হয়েছিলেন, যা সিদ্ধ অবস্থায় সকল শুদ্ধ-বৈষ্ণবের অন্তিম লক্ষ্য।
শুকদেব গােস্বামী বলেছেন যে, কৃষ্ণ ও সুদামা বিপ্রের এই কাহিনী যে শ্রবণ করবে, সে জানতে পারবে সুদামা বিপ্রের মতা ব্রাহ্মণরা ভগবানের কত প্রিয়। তাই যে এই কাহিনী শ্রবণ করে, ক্রমশ সে সুদামা বিপ্রের মতাে গুণসম্পন্ন হয়ে, শ্রীকৃষ্ণের চিন্ময় ধাম প্রাপ্ত হয়।