দুর্গাপূজার কাহিনী, মা দুর্গা আসলে কে? লক্ষী, স্বরস্বতী, গণেশ ও কার্তিক- সম্মিলিত পূজার গূঢ়তত্ত্ব
দুর্গাপূজার কিছু অজানা কথা
আমরা বাঙ্গালিরা মা দুর্গাকে যেভাবে দেখে অভ্যস্ত তা হলো দশভুজা, মহিষাসুর বধে উদ্যতা, সিংহবাহিনী, বামে লক্ষ্মী ও গণেশ এবং ডানে সরস্বতী ও কার্তিক। আমরা দেবীকে মহিষাসুরমর্দিনীরূপে পূজা করি। উত্তর ভারতে দেবী দুর্গা অবশ্য এই যুদ্ধংদেহী মূর্তিতে পূজিত হন না। সেখানে দেবী অষ্টভুজা, অস্ত্রশস্ত্র সমন্বিতা হয়েও শান্তভাবে প্রসন্নবদনে সিংহ বা বাঘের পিঠে বসে আছেন এবং এক হাত আশীর্বাদ মুদ্রায় রেখেছে ভক্তদের উদ্দেশ্যে। আবার, দক্ষিণভারতে সাধারণত চর্তুভুজা, পদ্মাসনে উপবিষ্টা রূপে তিনি পূজিত হন। তবে রূপ যা-ই হোক না কেন, তিনি সর্বরূপেই ভক্তদের কল্যাণকাররিণী।
দুর্গা, লক্ষী, সরস্বতী, গণেষ ও কার্তিক-সম্মিলিত পূজার গূঢ়তত্ত্ব
দেবীদুর্গার বামে ধনদাত্রী লক্ষী এবং ডানে জ্ঞানদাত্রী সরস্বতী। তারা মা দুর্গার দুই কন্যারূপে পরিচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে, তারা পরমেশ্বর ভগবানের আদি শক্তিরেই ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। আদি শক্তি তিনরূপে হয়েছিলেন- সৃষ্টিকার্যে ব্রহ্মার জ্ঞানশক্তিরূপে সরস্বতী, পালনকার্যে বিষ্ণুর পালনকারিণী শক্তিরূপে মহালক্ষ্মী এবং সংহারকার্যে শিবের প্রলয়কারিণী শক্তিরূপে মহাকালী, যিনি দুর্গা থেকে অভিন্ন। আর, সেই সঙ্গে দেবী দুর্গা স্বয়ং বিষ্ণুশক্তি মহালক্ষ্মীর প্রকাশ। তাইতো তার মন্ত্রে নারায়ণী, বৈষ্ণবী শব্দের পুনঃ ব্যবহার। দুর্গাপূজার আবশ্যকীয় অঙ্গ হলো শালগ্রামশিলা বা নারায়ণশিলার অর্চনা। নারয়ণশিলা পূজা না করে ব্রাহ্মণগণ দুর্গাপূজা করেন না।
মায়ের বামে সিদ্ধিদাতা বিঘ্নহর্তা গণেশ এবং ডানে শৌর্য বীর্যের প্রতীক দেবসেনাপতি কার্তিক। গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে এই চারজন দেবতা যেন সমাজের চারবর্ণের প্রতীক। সমাজের চারবর্ণ হলো বুদ্ধিজীবি-ব্রাহ্মণ, শাসকশ্রেণি-ক্ষত্রিয়, বৃত্তিজীবি-বৈশ্য এবং শ্রমজীবি-শুদ্র। সরস্বতী বুদ্ধি ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী ও সত্ত্বগুণস্বরূপিণী। তাই তিনি ব্রাহ্মণগণের প্রতীক। বীরত্ব ও তেজের প্রতীক কার্তিকেয় ক্ষত্রিয় শক্তির প্রতিনিধিত্ব করছেন। দেবী লক্ষ্মী অন্ন, শস্য, সমৃদ্ধি ও ধনসম্পদের অধিষ্ঠাত্রী যা বৈশ্যদের দ্বারা সম্পাদিত কৃষিকাজ ও ব্যবসার মাধ্যমে পূর্ণ হয়।
মায়ের বামে সিদ্ধিদাতা বিঘ্নহর্তা গণেশ এবং ডানে শৌর্য বীর্যের প্রতীক দেবসেনাপতি কার্তিক। গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে এই চারজন দেবতা যেন সমাজের চারবর্ণের প্রতীক। সমাজের চারবর্ণ হলো বুদ্ধিজীবি-ব্রাহ্মণ, শাসকশ্রেণি-ক্ষত্রিয়, বৃত্তিজীবি-বৈশ্য এবং শ্রমজীবি-শুদ্র। সরস্বতী বুদ্ধি ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী ও সত্ত্বগুণস্বরূপিণী। তাই তিনি ব্রাহ্মণগণের প্রতীক। বীরত্ব ও তেজের প্রতীক কার্তিকেয় ক্ষত্রিয় শক্তির প্রতিনিধিত্ব করছেন। দেবী লক্ষ্মী অন্ন, শস্য, সমৃদ্ধি ও ধনসম্পদের অধিষ্ঠাত্রী যা বৈশ্যদের দ্বারা সম্পাদিত কৃষিকাজ ও ব্যবসার মাধ্যমে পূর্ণ হয়।
আর গণপতি গণেশ যেন গণদেবতারূপে শ্রমিকশ্রেণিকে বা শূদ্রদের কর্মদক্ষতা প্রদান করছেন। চারটি বর্ণেরই গুরুত্ব আছে। শরীরে মাথার যেমন প্রয়োজন তেমনি পায়েরও প্রয়োজন। সবগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিকমতো কাজ করলে তবেই শরীর সুস্থ থাকবে।
বেদে দেবী দুর্গা বলেছেন- ‘অহং রাষ্ট্রী’- তেমনি এই চারবর্ণ সঠিকভাবে কাজ করলেই রাষ্ট্র উন্নত হয়। দেবীর পদতলে মহিষাসুর শূলবিদ্ধ অবস্থায় আছে। দেবীর বাহন সিংহ অসুরকে চেপে ধরে আছে। পশুরাজ সিংহটি আমাদের মনের প্রতীক। যদি আমরা আমাদের পশুরাজ সিংহরূপী মনের উপর ধর্মরূপী দেবীকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তবে তিনি আমাদের মনের অসুররূপী আসুরিক প্রবৃত্তিগুলোকে শূলাঘাতে বিনষ্ট করবেন।
এখন আমরা দেখবো বেদে কি আসলেই দুর্গা নেই এবং দুর্গাপূজার মতো মহাপূজা হঠাৎ করেই মাঠি ফুঁড়ে বের হয়েছে। কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্গত তৈত্তিরীয় আরণ্যকে বলা হয়েছে-
অর্থাৎ, অগ্নিবর্ণা তপ প্রদীপ্তা সূর্য ( বা অগ্নিস্বরূপিণী) যিনি কর্মফলের প্রার্থিত হন, সেই দুর্গাদেবীর আমি শরণাপন্ন হই, হে সুন্দররূপে, ত্রাণকারিণী, তোমাকে নমস্কার। ঋগবেদে দেবীসুক্ত যা দুর্গাপূজায় চন্ডীপাঠের পূর্বে পাঠ করা বিধি আছে, সেখানে দেবীকে পরমা প্রকৃতি, নির্বিকারা ও জগতের ধাত্রীরূপে বর্ণিত আছে।
সমস্ত দেবতার তেজ হতে দেবীদুর্গার আবির্ভাবের পর দেবী দুর্গা দেবতাদের ঋকমন্ত্রে নিজের পরিচয় দিলেন বলে দেবী পুরাণে উল্লেখিত আছে; আর সেই ঋকমন্তই হলো ঋগবেদের দেবীসুক্ত। এছাড়া বেদের রাত্রিসুক্তে কালী, শ্রীসুক্তে লক্ষ্মী এবং বাণীসুক্তে সরস্বতীর বন্দনা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, বেদ দেবতাদের মহিমাতে রূপ ও পূজাপদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। আর বেদকে স্বীকার করলে পুরাণকেও স্বীকার করতে হবে। কারণ, বেদ এবং বেদান্ত নিজেই পুরাণকে স্বীকার করেছে।
যেমন- ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছে-‘ইতিহাস ও পুরাণসমূহ হলো পঞ্চম বেদ। আবার, অথর্ববেদ বলছে ‘ইতহাসস্য চ বৈ পুরাণস্য চ....চ’। যেহেতু বেদ পুরাণকে শাস্ত্র বলে স্বীকার করেছে, তাই পুরাণ মতেই দেবী দুর্গার রূপ ও পূজাপদ্ধতি প্রণীত হয়েছে। যাহোক, আবারো আমরা বৈদিক ধারায় ফিরে আসি। শুক্ল যর্জুবেদের বাজসনেয়ী সংহিতায় অম্বিকাদেবীর সাংখ্যায়ন গৃহ্যসূত্রে ভদ্রকালীর, কেন উপনিষদে দেবী উমার কথা পাই যারা দেবী দুর্গারই অপর নাম।
যাজ্ঞিকা উপনিষদে দুর্গার গায়ত্রী আছে- ‘কাত্যায়নার বিমতে কন্যাকুমারীং ধীমহি তন্নো দুর্গি প্রচোদয়াৎ।’ এখানে দুর্গা সম্বোধনপদে দুর্গি হয়েছে। এতে কাত্যায়নী বা কন্যাকুমারী দুর্গার অপর নাম তা সকলেই জানে। এছাড়া গোপাল তাপনী উপনিষদ, নারায়ণ উপনিষদ ইত্যাদি বৈদিক গ্রন্থে দুর্গার উল্লেখ আছে।
কলাগাছ, কালোকচু গাছ, হলুদ গাছ, মানকচু গাছ, ধানগাছ, বেল গাছ, জয়ন্তী গাছ, অশোক গাছ ও ডালিম গাছ- এই নয়টি গাছ যথাক্রমে ব্রহ্মাণীদেবী, দেবী কালী, দেবী দুর্গা, দেবী চামুন্ডা, দেবী লক্ষী, দেবী শিবানী, দেবী জয়ন্তী, শোকরহিতা ও রক্তদন্তিকা-দেবী দুর্গার এ নয় রূপের প্রতিনিধিত্ব করে।
যেদিন দুর্গামূর্তিতে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করা হয় অর্থাৎ, মূল পূজা শুরু হয়, সেই সপ্তমীর সকালে কলাবউ বা নবপত্রিকা স্নান করিয়ে তাকে নতুন শাড়ি পড়িয়ে মন্ডপে গণেশের পাশে রেখে পূজা করে তারপর মূল দুর্গাপূজা শুরু হয়। অর্থাৎ, নবপত্রিকা স্বয়ং দেবী দুর্গারই প্রকৃতিস্বরূপিণী রূপ।
ভক্তি স্ত্রী গুণ মনে করা হয়, তাই আমরা বলি ভক্তিদেবী।
যিনি বিষ্ণুভক্তা, বিষ্ণুরূপা এবং বিষ্ণুর শক্তিস্বরূপিণী, বিষ্ণৃকর্তৃক সৃষ্টিকালে সৃষ্টা হন, তিনিই বৈষ্ণবীরূপে আহূতা হন। অর্থাৎ, তিনি বিষ্ণুর শক্তি ও বিষ্ণুর পরম ভক্ত হবার কারণে তাকে বৈষ্ণবী বলা হয়। এজন্য শ্রীশ্রী চন্ডীতে বলা হয়েছে- “ত্বং বৈষ্ণবী শক্তি অনন্তবীর্যা, বিশ্ববীজস্য পরমাসি মায়া”। আবার, তাকে পরমা প্রকৃতি বলা হয়, কারণ তিনি পরমপুরুষ শ্রীনারায়ণের প্রকৃতি। নারায়ণের প্রকৃতি বলেই তিনি শ্রীশ্রীচন্ডীর বহু শ্লোকে নারয়ণী বলে আখ্যায়িত হয়েছেন। এখানে লক্ষণীয়, যদি শিবই পরম পুরুষ হতেন, তাহলে পরমাপ্রকৃতিকে নারায়ণী না বলে শিবানী নামের আধিক্য থাকতো। এমনকি দেবীর প্রণামমন্ত্রেও আমরা দেখি
বেদে দেবী দুর্গা বলেছেন- ‘অহং রাষ্ট্রী’- তেমনি এই চারবর্ণ সঠিকভাবে কাজ করলেই রাষ্ট্র উন্নত হয়। দেবীর পদতলে মহিষাসুর শূলবিদ্ধ অবস্থায় আছে। দেবীর বাহন সিংহ অসুরকে চেপে ধরে আছে। পশুরাজ সিংহটি আমাদের মনের প্রতীক। যদি আমরা আমাদের পশুরাজ সিংহরূপী মনের উপর ধর্মরূপী দেবীকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তবে তিনি আমাদের মনের অসুররূপী আসুরিক প্রবৃত্তিগুলোকে শূলাঘাতে বিনষ্ট করবেন।
বেদে কি দুর্গাদেবীর অস্তিত্ব আছে?
বর্তমানযুগে একদল অতিপন্ডিতের আবির্ভাব হয়েছে, যারা বেদকে ঢাল বানিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ও নিজমত প্রতিষ্ঠা করতে সকল প্রকার ছলচাতুরির আশ্রয় নিচ্ছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান হিন্দুসমাজে বেদ তো দূরের ব্যাপার, গীতা, ভাগবতাদি গ্রন্থও অধিকাংশ লোক জানার চেষ্টা করে না; ফলে তাদের খুব সহজেই বিভ্রান্ত করে নিজ মতে দীক্ষিত করা খুব সহজ। এই শ্রেণির লোকেরা বেদকে কেন্দ্র করে নানারকম অপপ্রচার, অর্ধসত্য, অর্ধশ্লোক ও বিকৃত অর্থ করার মাধ্যমে বেদে মূর্তিপূজা নিষেধ, ঈশ্বর সাকার নন বা দুর্গা দেবীর অস্তিত্ব বেদে নেই, এমন কিছু উদ্ভট সিদ্ধান্ত প্রচার করে থাকেন।এখন আমরা দেখবো বেদে কি আসলেই দুর্গা নেই এবং দুর্গাপূজার মতো মহাপূজা হঠাৎ করেই মাঠি ফুঁড়ে বের হয়েছে। কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্গত তৈত্তিরীয় আরণ্যকে বলা হয়েছে-
তাং অগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম,
দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে সুতরসি তরমে নমঃ।।
(তৈত্তিরীয় আরণ্যক-১০/২)
অর্থাৎ, অগ্নিবর্ণা তপ প্রদীপ্তা সূর্য ( বা অগ্নিস্বরূপিণী) যিনি কর্মফলের প্রার্থিত হন, সেই দুর্গাদেবীর আমি শরণাপন্ন হই, হে সুন্দররূপে, ত্রাণকারিণী, তোমাকে নমস্কার। ঋগবেদে দেবীসুক্ত যা দুর্গাপূজায় চন্ডীপাঠের পূর্বে পাঠ করা বিধি আছে, সেখানে দেবীকে পরমা প্রকৃতি, নির্বিকারা ও জগতের ধাত্রীরূপে বর্ণিত আছে।
সমস্ত দেবতার তেজ হতে দেবীদুর্গার আবির্ভাবের পর দেবী দুর্গা দেবতাদের ঋকমন্ত্রে নিজের পরিচয় দিলেন বলে দেবী পুরাণে উল্লেখিত আছে; আর সেই ঋকমন্তই হলো ঋগবেদের দেবীসুক্ত। এছাড়া বেদের রাত্রিসুক্তে কালী, শ্রীসুক্তে লক্ষ্মী এবং বাণীসুক্তে সরস্বতীর বন্দনা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, বেদ দেবতাদের মহিমাতে রূপ ও পূজাপদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। আর বেদকে স্বীকার করলে পুরাণকেও স্বীকার করতে হবে। কারণ, বেদ এবং বেদান্ত নিজেই পুরাণকে স্বীকার করেছে।
যেমন- ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছে-‘ইতিহাস ও পুরাণসমূহ হলো পঞ্চম বেদ। আবার, অথর্ববেদ বলছে ‘ইতহাসস্য চ বৈ পুরাণস্য চ....চ’। যেহেতু বেদ পুরাণকে শাস্ত্র বলে স্বীকার করেছে, তাই পুরাণ মতেই দেবী দুর্গার রূপ ও পূজাপদ্ধতি প্রণীত হয়েছে। যাহোক, আবারো আমরা বৈদিক ধারায় ফিরে আসি। শুক্ল যর্জুবেদের বাজসনেয়ী সংহিতায় অম্বিকাদেবীর সাংখ্যায়ন গৃহ্যসূত্রে ভদ্রকালীর, কেন উপনিষদে দেবী উমার কথা পাই যারা দেবী দুর্গারই অপর নাম।
যাজ্ঞিকা উপনিষদে দুর্গার গায়ত্রী আছে- ‘কাত্যায়নার বিমতে কন্যাকুমারীং ধীমহি তন্নো দুর্গি প্রচোদয়াৎ।’ এখানে দুর্গা সম্বোধনপদে দুর্গি হয়েছে। এতে কাত্যায়নী বা কন্যাকুমারী দুর্গার অপর নাম তা সকলেই জানে। এছাড়া গোপাল তাপনী উপনিষদ, নারায়ণ উপনিষদ ইত্যাদি বৈদিক গ্রন্থে দুর্গার উল্লেখ আছে।
নবপত্রিকা বা কলাবৌ নিয়ে বিভ্রান্তি
নবপত্রিকা তথা প্রচলিত ভাষায় কলাবৌ নিয়ে আমাদের অনেকেরই কৌতুহল ছোট বেলা থেকেই। গণেশের পাশে একটি কলাগাছকে শাড়ি, মালা, সিঁদুর পড়িয়ে পূজা করার দৃশ্য বাঙ্গালি হিন্দু মাত্রেরই পরিচিত। আসলে দুর্গাদেবী প্রকৃতিস্বরূপা, তিনিই মাতার ন্যায় প্রকৃতিকে পালন করেন। দেবী দুর্গার এই কৃষি, অন্নদাত্রী বা প্রকৃতিস্বরূপা রূপই হলো নবপত্রিকা। এতে নয় রকম গাছের শাখা একত্রে শ্বেত অপরাজিতা ফুল গাছের লতা দ্বারা বেঁধে পূজা করা হয়। ‘নব’ অর্থ নয়, আর ‘পত্রিকা’ অর্থ পাতা। এই নয় প্রকার বৃক্ষ আদিশক্তির নয়জন রূপকে প্রতীকায়িত করে। নয় প্রকার বৃক্ষের অধিষ্ঠাত্রী ৯ জন দেবী রয়েছেন-কলাগাছ, কালোকচু গাছ, হলুদ গাছ, মানকচু গাছ, ধানগাছ, বেল গাছ, জয়ন্তী গাছ, অশোক গাছ ও ডালিম গাছ- এই নয়টি গাছ যথাক্রমে ব্রহ্মাণীদেবী, দেবী কালী, দেবী দুর্গা, দেবী চামুন্ডা, দেবী লক্ষী, দেবী শিবানী, দেবী জয়ন্তী, শোকরহিতা ও রক্তদন্তিকা-দেবী দুর্গার এ নয় রূপের প্রতিনিধিত্ব করে।
যেদিন দুর্গামূর্তিতে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করা হয় অর্থাৎ, মূল পূজা শুরু হয়, সেই সপ্তমীর সকালে কলাবউ বা নবপত্রিকা স্নান করিয়ে তাকে নতুন শাড়ি পড়িয়ে মন্ডপে গণেশের পাশে রেখে পূজা করে তারপর মূল দুর্গাপূজা শুরু হয়। অর্থাৎ, নবপত্রিকা স্বয়ং দেবী দুর্গারই প্রকৃতিস্বরূপিণী রূপ।
দেবী দুর্গা স্বয়ংই বিষ্ণুভক্তি
দেবীভক্তদের মধ্যে প্রসিদ্ধ আদ্যাস্তোত্রে প্রথম শ্লোকে বলা হয়েছে ‘যঃ পঠেৎ সততং ভক্তা স এব বিষ্ণুবল্লভঃ’। অর্থাৎ, যিনি আদ্যাস্তোত্র পাঠ করেন, তিনি বিষ্ণুর প্রিয় হন। সেখানে আরো বলা হয়েছে- ‘বিষ্ণুভক্তি প্রদা দুর্গা, সুখদা মোক্ষদা সদা’-অর্থাৎ, দেবী দুর্গা বিষ্ণুভক্তি প্রদায়িনী। অর্থাৎ বিষ্ণু বা কৃষ্ণভক্তি দান করাটাই দেবীর কৃপার চরম পর্যায়। শ্রীশ্রী চন্ডীতেও তাই উল্লেখ আছে- ‘যা দেবী সর্বভূতেষু ভক্তি রূপেণ সংস্থিতা’। তিনিই জীবের মধ্যে ভক্তিরূপে বিরাজ করেন। চৈতন্য ভাগবতে (মধ্যখন্ড ১৬৬.১৭০) মহাপ্রভু যখন দেবী দুর্গার আবেশ নেন, তখন ভক্তগণ দেবীর স্তুতি করে বলেন-
‘জগৎস্বরূপা তুমি, সর্বশক্তি।
তুমি শ্রদ্ধা, দয়া, লজ্জা তুমি বিষ্ণুভক্তি’।
ভক্তি স্ত্রী গুণ মনে করা হয়, তাই আমরা বলি ভক্তিদেবী।
দেবী দুর্গার বৈষ্ণবী নামের অর্থ
শ্রীশ্রী চন্ডীতে বলা হয়েছে-
যা দেবী সর্বভূতেষু বিষ্ণুমায়েতি শব্দিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।
“যে দেবী সর্বভূতে (সর্বজীবে) বিষ্ণুমায়ারূপে বিরাজ করেন, তাঁকে বারংবার নমস্কার।”
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতিখন্ডে দুর্গা সম্পর্কে (৫৭/২১) বলা হয়েছে-
বিষ্ণুভক্তা বিষ্ণুরূপা বিষ্ণোঃ শক্তিস্বরূপিণী।
সৃষ্টৌ চ বিষ্ণুনা সৃষ্টা বৈষ্ণবী তেন কীর্তিতা।।
যিনি বিষ্ণুভক্তা, বিষ্ণুরূপা এবং বিষ্ণুর শক্তিস্বরূপিণী, বিষ্ণৃকর্তৃক সৃষ্টিকালে সৃষ্টা হন, তিনিই বৈষ্ণবীরূপে আহূতা হন। অর্থাৎ, তিনি বিষ্ণুর শক্তি ও বিষ্ণুর পরম ভক্ত হবার কারণে তাকে বৈষ্ণবী বলা হয়। এজন্য শ্রীশ্রী চন্ডীতে বলা হয়েছে- “ত্বং বৈষ্ণবী শক্তি অনন্তবীর্যা, বিশ্ববীজস্য পরমাসি মায়া”। আবার, তাকে পরমা প্রকৃতি বলা হয়, কারণ তিনি পরমপুরুষ শ্রীনারায়ণের প্রকৃতি। নারায়ণের প্রকৃতি বলেই তিনি শ্রীশ্রীচন্ডীর বহু শ্লোকে নারয়ণী বলে আখ্যায়িত হয়েছেন। এখানে লক্ষণীয়, যদি শিবই পরম পুরুষ হতেন, তাহলে পরমাপ্রকৃতিকে নারায়ণী না বলে শিবানী নামের আধিক্য থাকতো। এমনকি দেবীর প্রণামমন্ত্রেও আমরা দেখি
‘সর্বমঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সবার্থসাধিকে,
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী নারায়ণী নমঃহস্তুতে।’
যারা দুর্গা পূজা করেন, তারা ভারতের কাশ্মীরের হিমালয়ে ত্রিকূট পর্বতের গুহায় দেবী দুর্গার অতি প্রসিদ্ধ এক মন্দির হলো বৈষ্ণোদেবীর মন্দির, যেখানে দেবী দুর্গা বৈষ্ণবী নামে খ্যাত। এখানে দেবীর এরূপ নামকরণের কারণ, এখানে দেবী দুর্গা বিষ্ণুস্বরূপ ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের পাদপদ্মের ধ্যানে রত রয়েছেন। দেবীর ধ্যানে যেন বিঘ্ন না হয়, সেজন্য প্রভু শ্রীরামের পরমভক্ত হনুমানজি সর্বদা সেখানে অবস্থান করেন। নবরাত্রি পূজার সময় সারা ভারতের লক্ষ লক্ষ শক্তি উপাসকগণ দেবী মায়ের দর্শানার্থে সেখানে সমবেত হন।----হরেকৃষ্ণ----