কেমন সেই চিন্ময় জগৎ/বৈকুণ্ঠলোক-শ্রীমদ্ভাগবত
কেমন সেই বৈকুণ্ঠলোক বা চিন্ময় জগৎ
(অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ)
চিন্তামণিপ্রকরসদ্মসুকল্পবৃক্ষ-
লক্ষাবৃতেষুসুরভীরভিপালয়ন্তম্।
লক্ষীসহস্রশতসম্ভ্রমসেব্যমানং
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।।
অনুবাদঃ “যিনি লক্ষ লক্ষ কল্পবৃক্ষ দ্বারা আবৃত, চিন্তাবণির দ্বারা রচিত স্থানে সমস্ত বাসনা পূর্ণকারী সুরভীদের পালন করেছেন এবং যিনি নিরন্তর শত সহস্র লক্ষীদেবীর দ্বারা সম্ভ্রমসহকারে সেবিত হচ্ছেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।”
এই শ্লোকটি ব্রহ্মসংহিতা ৫/২৯ থেকে উদ্বৃত। কৃষ্ণলোকের এই বর্ণনাটি আমাদের সেই চিন্ময় জগতের তথ্য প্রদান করছে, যেখানে সবকিছুই কেবল সৎ চিৎ ও আনন্দময়ই নয়, বরং সেখানে অপর্যাপ্ত ফল-মূল, দুধ, মণি-রত্ন ও উদ্যান, যা গোপাঙ্গনাদের দ্বারা পরিসেবিত এবং যাঁরা সকলেই হচ্ছেন লক্ষীদেবী। কৃষ্ণলোক হচ্ছে চিৎ-জগতের সর্বোচ্চ লোক এবং তার নিচে রয়েছে অসংখ্য বৈকুন্ঠলোক-যার বর্ণনা শ্রীমদ্ভাগবতে পাওয়া যায়।
অধ্যাত্ম-চেতনার বিকাশের প্রাথমিক স্তরে ব্রহ্মা নারায়ণের কৃপায় বৈকুন্ঠলোক দর্শন করেছিলেন। তারপর, শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় তিনি কৃষ্ণলোক দর্শন করেছিলেন। এই অপ্রাকৃত দর্শন অনেকটা টেলিভিশনে চন্দ্রগ্রহ দর্শনের মতো। টেলিভিশনে দর্শন সাধিত হয় যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার আলোক তরঙ্গের পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে, কিন্তু চিন্ময় দর্শন সম্ভব হয় অন্তর্মুখী তপশ্চর্যা এবং ধ্যানের প্রভাবে।
শ্রীমদ্ভাগবতের দ্বিতীয় স্কন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বৈকুন্ঠলোকে জড়া প্রকৃতির সত্ত্ব, রজো ও তম-এই গুণগুলোর কোনো প্রভাব নেই। জড়জগতে সর্বোচ্চ গুণ হচ্ছে সত্ত্বগুণ, যা শৌচ, মানসিক সমতা, ইন্দ্রিয়-সংযম, সরলতা, ভগবৎ-বিশ্বাস, যথার্থ জ্ঞান আদি বৈশিষ্ট্যের দ্বারা ভূষিত। কিন্তু তথাপি এ গুণগুলো রজোগুণ ও তমোগুণ দ্বারা মিশ্রিত। কিন্তু বৈকুণ্ঠলোকের গুণগুলো ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তির প্রকাশ এবং তাই সেগুলো সবরকমের জড়কলুষ থেকে মুক্ত এবং শুদ্ধ চিন্ময়। চিন্ময় বৈকুণ্ঠলোকের সঙ্গে জড়জগতের কোনো গ্রহেরই, এমনকি সত্যলোকেরও (যেখানে ব্রহ্মা থাকেন) গুণগতভাবে কোনো তুলনা হয় না। জড়জগতের পাঁচটি স্বাভাবিক গুণ-অজ্ঞান,ক্লেশ, অহংকার,ক্রোধ ও মাৎসর্য-চিৎ-জগতে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত।
জড়জগতের সাথে বৈকুণ্ঠলোকের পার্থক্য
জড়জগতে সবকিছুরই সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতায় যা কিছুই আমরা উপলব্ধি করি, এমনকি আমাদের দেহ এবং মন, তা-ও সৃষ্টি হয়েছে। এই সৃষ্টির শুরু হয় ব্রহ্মার জীবন থেকে এবং এই জড়জগতের সর্বত্র প্রকাশিত এই সৃষ্টিতত্ত্ব রজোগুণের প্রভাবজাত। কিন্তু বৈকুণ্ঠলোকে যেহেতু রজোগুণ অনুপস্থিত, তাই সেখানে কোনোকিছুরই সৃষ্টি হয় না; সেখানে সবকিছুর অস্তিত্বই নিত্য এবং যেহেতু সেখানে তমোগুণ অনুপস্থিত, তাই সেখানে কোনোকিছুরই সৃষ্টি হয় না; সেখানে সবকিছুর অস্তিত্বই নিত্য এবং যেহেতু সেখানে তমোগুণ অনুপস্থিত, তাই সেখানে কোনোকিছুরই ধ্বংস বা বিনাশ হয় না।
জড়জগতে সত্ত্বগুণের বিকাশের দ্বারা সবকিছু চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করা যেতে পারে, কিন্তু যেহেতু জড়জগতের সত্ত্বগুণ রজোগুণ ও তমোগুণ মিশ্রিত, তাই শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক মস্তিস্কের শত শত পরিকল্পনা সত্ত্বেও কোনোকিছুই চিরস্থায়ী হতে পারে না। তাই জড়জগতে নিত্যত্ব, পূর্ণজ্ঞান ও আনন্দ নেই। কিন্তু চিৎ-জগতে জড়া প্রকৃতির গুণগুলো নেই বলে, সবকিছুই সেখানে সৎ (নিত্য). চিৎ (চেতনাময়) ও আনন্দময়। সেখানে নিত্য আনন্দময় অস্তিত্বের ফলে সবকিছুই কথা বলতে পারে, চলাফেরা করতে পারে, শুনতে পারে এবং দেখতে পারে। সেখানে পরিবেশ এমনই যে, কাল ও স্থান স্বাভাবিকভাবেই অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রভাব থেকে মুক্ত।
চিদাকাশে কোনো পরিবর্তন হয় না, কেন না সেখানে কালের কোনো প্রভাব নেই। তেমনই, বহিরঙ্গা মায়াশক্তির প্রভাব, যা ভগবানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বিস্মৃতির ফলে জড়জগতের ভগবানের দেহনির্গত জ্যোতির চিন্ময় কণারূপে আমরা সকলেই তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত এবং গুণগতভাবে তাঁর সঙ্গে এক। কিন্তু জড় শক্তি সেই চিৎ-স্ফুলিঙ্গকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে, কিন্তু সেই আচ্ছাদন থেকে মুক্ত বৈকুন্ঠলোকের নিত্যমুক্ত জীবেরা কখনো তাঁদের স্বরূপ বিস্মৃত হন না। তাঁরা তাঁদের স্বরূপে ভগবানের প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত থেকে ভগবানের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে অবগত থাকেন।
যেহেতু তাঁরা নিরন্তর ভগবানের প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত, তাই স্বাভাবিকভাবেই সিদ্ধান্ত করা যায় যে, তাঁদের ইন্দ্রিয়সমূহ চিন্ময়, কেননা জড় ইন্দ্রিয় দিয়ে কেউ কখনো ভগবানের সেবা করতে পারে না। বৈকুণ্ঠলোকের অধিবাসীরা জড়জগৎ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জড় ইন্দ্রিয়সমন্বিত নন। অল্পজ্ঞান-সম্পন্ন মানুষেরা সিদ্ধান্ত করে, যে স্থান জড় গুণরহিত তা নিশ্চয়ই আকারবিহীন এবং শূন্য। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চিৎ-জগৎ গুণরহিত নয়, সেখানেও গুণ রয়েছে, তবে সেই গুণ জড়া প্রকৃতির গুণ থেকে ভিন্ন, কেননা সেখানে সবকিছুই নিত্য, অসীম ও বিশুদ্ধ।
চিন্ময়/বৈকুণ্ঠলোকে কোনো সূর্যের প্রয়োজন নেই।
সেই জগৎ স্বতঃপ্রকাশিত এবং তাই সেখানে সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি অথবা বিদ্যুতের আলোকের কোনো প্রয়োজন নেই। সেখানে একবার গেলে আর জড়দেহ নিয়ে জড়জগতে ফিরে আসতে হয় না। বৈকুণ্ঠলোকে ভগবৎ-বিদ্ধেষী বলে কেই নেই, কেননা সেখানে সকলেই জড়গুণ থেকে মুক্ত, এখানে সকলেই আনুগত্য সহকারে সেবা করেন। বৈকুণ্ঠবাসীদের উজ্জল শ্যাম অঙ্গকান্তি জড়জগতের নিষ্প্রভ সাদা অথবা কালো রং থেকে অনেক বেশি মনোহর ও আকর্ষণীয়। তাঁদের দেহ চিন্ময় হওয়ার ফলে জড়জগতের কোনোকিছুর সঙ্গেই তার তুলনা করা যায় না।
বর্ষার জলভরা মেঘে যখন বিদ্যুৎ চমকায়,সেই সৌন্দর্য বৈকুণ্ঠবাসীদের অঙ্গকান্তির সৌন্দর্যের আভাসমাত্র প্রদান করে। সাধারণত বৈকুণ্ঠবাসীরা পীতবসন পরিধান করেন। তাঁদের দেহ অত্যন্ত কোমল ও সুন্দর এবং তাঁদের চক্ষু পদ্মফুলের পাঁপড়ির মতো। শ্রীবিষ্ণুর মতো বৈকুণ্ঠবাসীরা চতুর্ভুজ এবং তাঁদের চারটি হাতে তাঁরা শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ধারণ করেন। তাঁদের প্রশস্ত বক্ষ অত্যন্ত সুন্দর এবং অদ্ভুত মনি-রত্নখচিত উজ্জ্বল কণ্ঠহার দ্বারা শোভিত। বৈকুণ্ঠলোকের অধিবাসীরা অত্যন্ত শক্তিশালী ও জ্যোতির্ময়। তাঁদের কারো কারো অঙ্গকান্তি প্রবালের মতো, কারো বৈদুর্যমণির মতো এবং কারো পদ্মফুলের মতো, আর তাঁদের সকলেরই কানে রয়েছে অপূর্ব মণি-রত্নখচিত কর্ণভূষণ, মাথায় ফুলের মুকুট।
বৈকুণ্ঠলোকে বিমান রয়েছে, কিন্তু তাতে কোনো আওয়াজ নেই। জড় জগতের বিমান মোটেই নিরাপদ নয় যেকোনো সময় তাতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, কেননা জড়পদার্থ সর্বতোভাবে ক্রুটি-বিচ্যুতিপূর্ণ। কিন্তু চিৎজগতের বিমান চিন্ময় ও জ্যোতির্ময়। সেসমস্ত বিমান ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ অথবা পরিকল্পনাকারীদের যাত্রীরূপে বহন করে না অথবা মালপত্র বা ডাক বহন করে না, কেননা সেখানে সেগুলো কোনো প্রয়োজন নেই। সেসমস্ত বিমান কেবল প্রমোদ-ভ্রমণের জন্য।বৈকুণ্ঠবাসীরা অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত সহচরীদের সঙ্গে সেসমস্ত বিমানে চড়ে ভ্রমণ করেন।
“বৈকুণ্ঠলোকের আশ্চর্যজনক বৈশিষ্ঠ্য এই যে, যদিও সেখানকার রমণীরা সুন্দর মুখমন্ডল ও মনিরত্নখচিত অলংকারে বিভূষিতা, কিন্তু সেখানকার পুরুষেরা কৃষ্ণভাবনায় এতটাই মগ্ন যে, রমণীদের সুন্দর দেহ তাদের আকৃষ্ট করতে পারে না। বৈকুণ্ঠবাসীদের আনন্দ উপভোগের মান এতই উন্নত যে, সেখানে যৌন সুখের কোনো আবশ্যকতাই নেই।” (ভা.৩.১৫.২০ তাৎপর্য)। বৈকুণ্ঠের স্ত্রী ও পুরুষে পরিপূর্ণ সমস্ত বিমান চিদাকাশের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। তা যে কত সুন্দর তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না, তবে আকাশে বিদ্যুৎ সমন্বিত মেঘের সৌন্দর্যের সঙ্গে তাঁদের সৌন্দর্যের তুলনা করা যেতে পারে।
বৈকুণ্ঠলোকের চিদাকাশ সর্বদা এভাবেই অলংকৃত। ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তির পূর্ণ ঐশ্বর্য নিরন্তর বৈকুণ্ঠলোকে পূর্ণভাবে প্রকাশিত। সেখানে শত সহস্র লক্ষীদেবী অন্তহীন অনুরাগ সহকারে পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের সেবা করেন। সখীপরিবৃতা এই সমস্ত লক্ষীগণ নিরন্তর অপ্রাকৃত আনন্দোৎসব-মুখর পরিবেশের সৃষ্টি করেন। তাঁরা সর্বক্ষণ ভগবানের মহিমা কীর্তনে মূখর থাকেন।
বৈকুন্ঠলোকের আকাশ
চিদাকাশে অসংখ্য বৈকুণ্ঠলোক রয়েছে এবং জড় আকাশের অনুপাতে চিদাকাশের পরিমাণ তিনগুণ বেশি। এভাবে সহজেই অনুমান করা যায় যে, জড়বাদীরা যেভাবে এই ছোট্র পৃথিবীতে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে চেষ্টা করছে, ভগবানের সিৃষ্টিতে তা কত নগণ্য। এই পৃথিবীর কী কথা, অগণিত গ্রহ-নক্ষত্র সমিন্বিত এই ব্রহ্মান্ড ভগবানের সৃষ্টিতে একটি সর্ষের মতো ক্ষুদ্র। কিন্তু মূর্খ জড়বাদী এখানে সুখে থাকবার পরিকল্পনা করতে করতে তার দুর্লভ মানব জন্মের অপচয় করে। কারণ, তার উচিত সরল ও সাদাসিধেভাবে জীবনযাপন করে পরমার্থ চিন্তায় মগ্ন থাকা।
এভাবেই সে চিরস্থায়ী জাগতিক অশান্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। কোনো জড়বাদী যদি উন্নত জড়সুখ উপভোগ করতে পারে! স্বর্গে সুখভোগের যে আয়োজন রয়েছে, তা এই পৃথিবীর মানুষের কল্পনারও অতীত। তবে সর্বশ্রেষ্ঠ পরিকল্পনা হচ্ছে এই জড়দেহ ত্যাগ করার পর ভগবৎ-ধামে ফিরে যাবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। জড় বৈজ্ঞানিকেরা বায়ু ও আলোকের গতি বিবেচনা করে, কিন্তু মন ও বুদ্ধির গতি সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণা নেই। এক নিমেষের মধ্যে মন হাজার হাজার মাইল দূরে যেতে পারে।
বেতার কেন্দ্র থেকে প্রেরিত বার্তা শব্দ-তরঙ্গের মাধ্যমে পলকের মধ্যে পৃথিবীর সর্বত্র ভ্রমণ করতে পারে। শব্দের সৃষ্টি হয় আকাশ থেকে। আকাশের থেকেও সূক্ষ্ম এবং মনের থেকেও সুক্ষ্ম হচ্ছে বুদ্ধি। আত্মা বুদ্ধির থেকেও সূক্ষ্ম এবং তা মন ও বুদ্ধির মতো জড় নয়, তা চিন্ময় বা অ-জড়। এভাবেই আমরা অনুমান করতে পারি, কত দ্রূত গতিতে আত্মা ব্রহ্মান্ডের সর্বত্র ভ্রমণ করতে পারে। সিদ্ধ যোগী স্থির করতে পারেন-দেহ ত্যাগ করার পর তিনি শ্রীকৃষ্ণের ধাম
চিন্ময় বৈকুণ্ঠলোকে যাবেন, না এ জড় ব্রহ্মান্ডের কোনো উচ্চতর লোকে যাবেন।
সিদ্ধযোগীর এই স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। শুদ্ধ চেতনায় দেহত্যাগ করার সিদ্ধিলাভ করছেন যে সিদ্ধ যোগী, তাঁর কাছে এক গ্রহ থেকে আর এক গ্রহে যাওয়া, একজন সাধারণ মানুষের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দোকানে যাওয়ার মতোই সহজ। ভগবানের কৃপায় আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। ভগবান এতই কৃপাময় যে, তিনি আমাদের পছন্দমতো জায়গায় থাকবার সুযোগ দিয়েছেন। চিৎ-জগতে অথবা এই জড়জগতে, যেকোনো গ্রহে আমরা আমাদের বাসানা অনুসারে থাকতে পারি। কিন্তু এই স্বাধীনতার অপব্যবহারের ফলে আমরা জড়জগতে অধঃপতিত হয়ে ত্রিতাপ দুঃখ ভোগ করি।
তেমনি, আত্মার বাসনার প্রভাবে সে পুনরায় তার প্রকৃত আলয় ভগবৎ-ধামে ফিরে যেতে পারে। কোনোরকম যান্ত্রিক সাহায্য ব্যতীত যোগী তাঁর ইচ্ছামতো যেকোনো গ্রহে যেতে পারেন এবং সেখানকার আবহাওয়া অনুসারে উপযুক্ত দেহ ধারণ করতে পারেন। প্রতিটি গ্রহেরই বিশেষ অবস্থা বা পরিবেশ রয়েছে এবং কেউ যদি এই ব্রহ্মান্ডের কোনো বিশেষ লোকে যেতে চায়, তাহলে তাকে সেই গ্রহের অবস্থা অনুযায়ী উপযোগী জড় দেহ গ্রহণ করতে হয়। যেমন, কেউ যদি ভারতবর্ষ থেকে ইউরোপে যেতে চায়, তাহলে তাকে সেখানকার পরিবেশের উপযোগী পোশাক পরতে হয়।
তেমনই, কেউ যদি চিন্ময় বৈকুন্ঠলোকে যায়, তাহলে তাকে সম্পূর্ণরূপে দেহ পরিবর্তন করতে হয়। তাঁকে মাটি, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশ দ্বারা গঠিত স্থুল দেহ এবং মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার দ্বারা গঠিত সূক্ষ্ম দেহ-এ উভয় জড় দেহেরই পরিবর্তন করতে হয়, কেননা চিন্ময় শরীর নিয়ে যেতে হয়। কেউ যদি সেই রকম বাসনা করেন, তাহলে মৃত্যুর সময় এই পোশাকের পরিবর্তন আপনা থেকেই হবে।
ভগবদ্গীতায় প্রতিপন্ন হয়েছে যে, দেহত্যাগের সময়ে বাসনা অনুসারে জীব তার পরবর্তী দেহ প্রাপ্ত হয়। মনের বাসনা আত্মাকে উপযুক্ত পরিবেশে বহন করে নিয়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত যারা ঘোর বিষয়ী, যারা আজীবন ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধনের প্রচেষ্টায় মগ্ন থাকে, তারা মৃত্যুর সময় দৈহিক ও মানসিক বিশৃঙ্খল অবস্থার প্রভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এই ধরনের অধঃপতিত চেতনা ও সঙ্গের প্রভাবে এমন কিছু বাসনা করে, যা তাদের প্রকৃত স্বার্থের বিরোধী এবং তার ফলে তারা আরেকটি নতুন দেহ ধারণ করে, যা তাদের জড় দুঃখ-দুর্দশা বাড়িয়েই তোলে।
কারা চিৎ জগৎ বা বৈকুণ্টলোকে প্রবেশ করতে পারেন
যাঁরা পরমেশ্বর ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত, তাঁরা ব্রহ্মান্ডের আবরণ ভেদ করে চিৎ-জগতে প্রবেশ করতে পারেন। শ্রীল শুকদেব গোস্বামীর মতে, জড় জগৎ ও চিৎ-জগতের এই বর্ণনা কাল্পনিক নয় অথবা অবাস্তব নয়। বৈদিক শাস্ত্রে এই সমস্ত তথ্য লিপিবদ্ধ হয়েছে। ব্রহ্মার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান বাসুদেব ব্রহ্মার কাছে এই তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। কেউ যখন বৈকুণ্ঠ ও পরমেশ্বর ভগবান সম্বন্ধে যথাযথভাবে অবগত হয়, তখনই কেবল জীবনের পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। তাই নিরন্তর পরমেশ্বর ভগবানের কথা চিন্তা করা উচিত এবং তাঁরা মহিমা কীর্তন করা উচিত। সমস্ত শাস্ত্রের শিরোমণি ভগবদ্গীতা ও শ্রীমদ্ভাগবত-এই গ্রন্থ দুটিতে সেই নির্দেশই দেওয়া হয়েছে। এই যুগের অধঃপতিত মানুষদের জন্য শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই তথ্য অত্যন্ত সরলভাবে উপস্থাপন করে গিয়েছেন, যাতে প্রতিটি মানুষই তা অতি সহজে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। -----হরেকৃষ্ণ------(চৈতন্যচরিতামৃত আদিলীলা ৫.২২ তাৎপর্য হতে সংগৃহীত)
আরও পড়ুন
* সৃষ্টির মূল কারণ ঈশ্বর নাকি প্রকৃতি* ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা যাত্রা-শ্রীমদ্ভাগবত
*শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সকল অধ্যায় সমূহ
* তুলসী মাহাত্ম-বৃক্ষ হয়েও তুলসী কেন পূজনীয়া?